09-07-2020, 06:59 AM
#চোরাবালি
পর্ব তিন। সানাইয়ের সুর (#1-#11)
সল্টলেকে দেবশিস চ্যাটারজির ফ্লাটে বেশি আসা যাওয়া করত না অভি। মাঝে মধ্যে সপ্তাহে কি দুই সপ্তাহে একদিন বিকেলে গিয়ে একবার দেখা করে আসত দেবাশিস বাবুর সাথে। তাছাড়া যখন দেবাশিস বাবু বাড়িতে থাকতেন না তখন খুব ড্রিঙ্ক করার ইচ্ছে হলে, কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে রাত কাটিয়ে দিত ওই ফ্লাটে। দেবাশিস বাবুর বাড়িটা আসলে অভির জন্য একটা আমোদ প্রমোদের জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়। সেদিন বিকেলে খুব করে ধরলেন দেবাশিস বাবু, “আসো একটু কথা বার্তা বলি, আলাপ করি, তুমি ত একদম থাকোই না আমার কাছে।” বড়মাও বলল, দিদিও বলল, “সেই ত কতদিন আগে একবার রাতে থেকে ছিলি। যা একবার থেকে আয়, একটা রাতের ত ব্যাপার।” সেটা অনেকদিন আগের কথা, তখন সবে জোকা থেকে পাস করেছে। সেই ভেবে সেদিন অভি সন্ধ্যের পরেই দেবাশিস বাবুর বাড়ি পৌঁছে গেল।
সবে অফিস থেকে ফিরে দেবাশিস বাবু টিভিতে কোন কিছু একটা দেখছিলেন। দরজা খোলাই ছিল, কারন অভি বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে আসছে। ওকে দেখে একটু হেসে সোফা দেখিয়ে বসতে বলেন দেবাশিস বাবু। রান্না ঘরে একটা ছেলেকে দেখতে পেল, মনে হল কাজের লোক। ইতিমধ্যে যে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়ে একটা ছেলেকে রেখেছে সেটা ওর অবগত ছিল না। গতবার যখন এসেছিল তখন একটা কাজের মেয়ে দেবাশিস বাবুর বাড়িতে কাজ করত।
সোফার মাঝখানে রাখা ছোট কাঁচের টেবিলে দুটো ক্রিস্টালের কাট গ্লাস রাখা, তার পাশে এক একটা আইস বাকেটে বরফ আর ঠান্ডা জল, পাশে একটা দামী হুইস্কির বোতল। একটা প্লেটে চিকেনের টুকরো, বেশ কিছু কাজু, বাদাম ইত্যাদি। মনে মনে হেসে ফেলল অভি, বেশ সাজিয়েই বসেছেন।
একটা গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে দেবাশিস বাবু অভিকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো?”
অভি মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “ভালোই চলে যাচ্ছে।”
দ্বিতীয় গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করেন, “সোডা দিয়ে নেবে নাকি আইস দিয়ে?”
হেসে ফেলে অভি, “না না আমি নেব না, তুমি খাও।”
বক্র একটা হাসি দিয়ে দেবাশিস বাবু বলেন, “আমি না থাকলে ত বাড়িটাকে বার বানিয়ে ফেলো। এখন নিতে দোষ কোথায়?”
অভি হেসে ফেলে, “না সেই রকম নয়, মানে...”
কথাটা কেড়ে নিয়ে, গ্লাসে তিনটে বরফ আর একটু ঠান্ডা জল মিশিয়ে ওর দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “নাও নাও, এখানে তোমার বড়মা পাপা কেউ নেই আর আমার কাছে অত লজ্জা মান করে লাভ নেই।”
অভি খানিক দোনামনা করে শেষ পর্যন্ত দেবাশিস বাবুর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়েই নিল। ছোট একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কাজের মেয়েটাকে কবে ছাড়ালে?”
দেবাশিস বাবু উত্তর দিলেন, “এই দুইদিন হল। মেয়েটা রাতের দিকে আসে, কোনদিন আসে কোনদিন আসেনা, তাই এই রঘুকে রেখেছি। চব্বিশ ঘন্টার জন্য, বাড়ির পুরো দেখাশুনা করুক।” প্রমাদ গুনল অভি, এইবার ওদের আমোদ প্রমোদের দিন শেষ। ভাবটা বুঝতে পারলেন দেবাশিস বাবু, হেসে ফেলেন অভির চিন্তিত চেহারা দেখে, “ভেবো না কিছু, তোমরা তোমাদের মতন পারটি কর, ওকে দিয়েই কাজ করিয়ে নিও, তোমাদের হেল্পিং হ্যান্ড হয়ে যাবে।” বলেই হিহি করে হেসে উঠলেন।
অভি ও নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তর দিল, “যাক তাহলে, আমি ত ভেবেছিলাম আবার অন্য একটা জায়গা খুঁজতে হবে।” বলেই হেসে ফেলল।
দেবাশিস বাবু জিজ্ঞেস করেন, “তুমি চাকরি কবে করছ? অনেকদিন ত বসে?”
অভি একটু হেসে উত্তর দেয়, “এই দিদির বিয়ের পরে চাকরি খুঁজব।”
দেবাশিস বাবু বলেন, “তুমি এত পড়াশুনা করলে, বাইরে কেন গেলে না?”
একটু বাঁকা হাসি দিয়ে উত্তর দেয় অভি, “বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাবো না, তাই চাকরি করিনি এতদিন। এইবার দেখি এইখানে, মানে কোলকাতায় যা পাবো তাতেই ঢুকে যাবো।”
কিছুক্ষন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলেন দেবাশিস বাবু, “আগামী সপ্তাহে আমি একটা খুব বড় মিডিয়া হাউসে ডায়রেক্টর হিসাবে জয়েন করছি।”
একটু অবাক হয়ে অভি প্রশ্ন করে, “একে বারে ডায়রেক্টর?”
দেবাশিস বাবু এক স্বভিমানী হাসি দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ,ঐ মিডিয়া হাউসের কিছু স্টেক কিনে নিয়েছি এবং ডাইরেক্টর হিসাবে কিছু শেয়ার পাবো। বল’ত সেখানে তোমার জন্য একটা কিছু ব্যাবস্থা করে দেব।”
অভির এই ফ্লাট দেখে ঠিক ধারনা করতে পারেনি যে দেবাশিস বাবু এতটাও বড়োলোক হতে পারেন। যদিও জানত যে রাজারহাটের জমি বিক্রি করে প্রচুর টাকা কামিয়েছে, তাও। মাথা নাড়ায় অভি, “না, তার ঠিক দরকার পরবে না, আমি ঠিক খুঁজে নেব আমার মতন।”
একটা ক্ষুন্ন হাসি দিয়ে বলেন, “আমার কাছে সাহায্য নিতে তোমার বাধে?”
হ্যাঁ, সেটা সত্যি খুব বাধে, তাও মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “না ঠিক তেমন নয়, তবুও নিজের মেধা দক্ষতায় চাকরি পাওয়াটা বেশি আনন্দের।”
একটু হেসে উত্তর দেন দেবাশিস বাবু, “সেটা সত্যি। আচ্ছা চাকরি সুত্রে কোম্পানি যদি তোমাকে বাইরে পাঠায় তখন কি তুমি বাইরে যাবে না?”
অভি মাথা নাড়ায়, “না, বড়মা পাপা বেঁচে থাকতে ত কখনই নয়। তারপর দেখা যাবে কি হয় না হয়।”
দেবাশিস বাবুর বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়না যে অভির প্রান আটকে আছে ওই মধ্যমগ্রামের মাটিতে, সেখান থেকে এত সহজে উতপাটি করা অসম্ভব। একটু চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে মনামির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।”
অভি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, এই কালীপুজোর আগেই আশীর্বাদ হয়ে যাবে আর ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে বিয়ে।”
দেবাশিস বাবু, “জামাই কি করে?”
অভি উত্তর দেয়, “দিল্লীতে একটা বড় কোম্পানিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।”
মাথা দুলায় দেবাশিস বাবু, “গুড গুড, তোমার দুই জামাই বাবুই ইঞ্জিনিয়ার। ওই মধ্যমগ্রামে থেকেও দাদা বেশ ভালোই জামাই পেয়ে গেছেন দেখছি।”
কথাটা তির্যক হিসাবে বললেন না এমনি বললেন সেটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে অভি, “হুম” করে একটা ছোট উত্তর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবাশিস বাবুকে আপাদমস্তক জরিপ করে নেয়। কথাটা তির্যক মনে হল ওর, যেন পাপা ওই গ্রামে থেকে কিছুই করতে পারবে না, এমন একটা ভাব দেবাশিস বাবুর চোখে মুখে। বেশ কিছুক্ষন কারুর মুখে কোন কথা নেই, টিভিতে খবর চলছে। ইতিমধ্যে রঘু নামের ছেলেটা আরো একটা প্লেট ভরে চিকেন পকোড়া রেখে চলে গেল।
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর অভি জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, ফাল্গুনী ম্যাডাম এখন কোথায় আছেন?”
প্রশ্ন শুনে বিষম খেলেন দেবাশিস বাবু, “মানে? হটাত কি ব্যাপার?”
অভি উত্তর দেয়, “না মানে পাপা বলছিল, যদি বিয়েতে অথবা বৌভাতে আসতে পারে।”
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “না, তার দরকার নেই।”
অভি বেশি আর কথা বাড়াল না সেই দিকে। আবার দুই জনেই চুপ, মাঝে মাঝে হুইস্কির গলাসে চুমুক দেওয়া আর টিভি স্ক্রিনের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকা। বেশ কিছু পরে দেবাশিস বাবু নিজেকে থেকে বললেন, “ওই হলদিরামের কাছে একটা ফ্লাটে থাকে।” তারপরে ফোন নাম্বার দিয়ে বলেন, “যত হোক দাদা যখন বলেছেন তখন খেলাপ করা খারাপ দেখায়। ফোন করে ঠিকানা জেনে নিও। তবে একটু খেয়াল রেখো যেন...”
অভি সেই খেয়ালের কথাটা বুঝতে পেরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ বুঝে গেছি, তুমি বিয়েতে এসো, ফাল্গুনী ম্যাডামকে না হয়ত বউভাতে নিমতন্ন করব।”
মুচকি হেসে উত্তর দেন দেবাশিস বাবু, “অনেক কিছুই বুঝে যাও দেখছি।”
মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয় অভি, “হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই।”
কথায় কথায় ততক্ষনে তিনটে পেগের মতন দুইজনার শেষ। চোখে একটু রঙ লেগে গেছে অভির, এত দামী হুইস্কি আগে কোনদিন খায়নি। হুইস্কির সাথে সাথে সিগারেট এটাই অভ্যেস, কিন্তু প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে খুব সিগারেটে পেয়েছে কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলতে পারছে না, আর সামনে বসে দেবাশিস বাবু সমানে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে যাচ্ছেন, তার ফলে অভির আরো বেশি করে সিগারেটের নেশাটা চাগিয়ে উঠেছে।
অভি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি একটু আসছি।”
ঘোলা দৃষ্টিতে অভির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন দেবাশিস বাবু, “সিগারেট চাই? আগেই বললে হত।” বলে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
অভির সঙ্কোচ অনেক আগেই কেটে গেছিল, যেটুকু বাকি ছিল সেটা ওই সিগারেট প্যাকেট হাতে নিয়ে কাটিয়ে দিল। সিগারেটে একটা টান দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে নেশাটাকে আরো বেশি করে চাগিয়ে তোলে। নেশা একটু হয়েছে তবে অভি এখন স্বচেতন। সেইদিন দেবাশিস বাবুর বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। পরের দিন বাড়ি ফিরে মনামির প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল।
মনামিকে দেখে যাওয়ার সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই দিল্লী থেকে শিতাভ্র আসে দেখতে। তারপর থেকে রোজ রাতেই মনামির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা শিতাভ্রর ফোনে কথাবার্তা চলে। শিতাভ্র দেখতে অচল নয়, তবে একটু বেটে খাটো মানুষ কিন্তু বেশ ভালো ছেলে। মনামির হিল তোলা জুতো পড়ার দিন শেষ হয়ে যায়, সেই নিয়ে অভির খুব হাসাহাসি, তোর বেঁটে বর, তোর বেঁটে বর। এই নিয়ে মনামি, ভাইয়ের ওপরে একটু খেপেও যেত, যত হোক, এই কয়দিনে কথাবার্তা বলে, হবু বরের প্রতি একটা কেমন যেন টান অনুভব করে। সেটা অভিও বুঝতে পারে, তাও খেপাতে ছাড়ে না। পুজোর আগে, একবার দুই দিনের ছুটি নিয়ে লুকিয়ে মনামির সাথে দেখাও করে গেছে শিতাভ্র। দেহরক্ষী হিসাবে মনামির সাথে অভি গিয়েছিল, কারন দুই বাড়ির কেউ জানত না যে শিতাভ্র ছুটি নিয়ে কোলকাতা এসেছে।
পুজোর আগে থেকেই পুজোর জন্য কেনাকাটা শুরু সেই সাথে বিয়ের জন্য কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। প্রণামীর কাপড় অবশ্য নরেন মামার দোকান থেকেই আসবে, বাকি বাড়ির লোকজনের কাপড় কেনার জন্য গড়িয়াহাট, কলেজস্ট্রিট। সেদিন এই প্রনামি শাড়ি আর কিছু জামা কাপড় কেনা কাটার জন্য বড়মাকে নিয়ে আর মনামিকে নৈহাটি যাওয়া হয়েছিল। অভি লক্ষ্য করে যে স্বাতীলেখা একটু মন মরা। সবার সামনে ঠিক প্রশ্ন করতে পারেনি, তবে সন্ধ্যের পরে যখন সবাই দোকানে যায় কাপড় দেখতে তখন অভি একাকী লেখাকে একটু অন্যত্র ডেকে নিয়ে যায়। অভি জানে, লেখা ভীষণ মুখচোরা মেয়ে, খুব করে চেপে না ধরলে কিছুই জানাবে না।
অভি লেখাকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে এত মুখ শুকনো কেন, ঝন্টুদার সাথে কিছু হয়েছে নাকি?”
লেখা স্মিত হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, “তুমি’ত দিদি ভাইয়ের বিয়ের কেনা কাটা করতে এসেছ। ভেতরে যাও, জামা কাপড় দেখ।”
লেখার কাঁধ ধরে আলতো ঝাকিয়ে হেসে ফেলে অভি, “সুন্দরী লেখা, জব সে তেরেকো দেখা...”
সেই সাথে হেসে ফেলে লেখাও, “যাও, তুমি না বড্ড শয়তান।” বলেই চোখের কোল একটু মুছে নেয়।
পর্ব তিন। সানাইয়ের সুর (#1-#11)
সল্টলেকে দেবশিস চ্যাটারজির ফ্লাটে বেশি আসা যাওয়া করত না অভি। মাঝে মধ্যে সপ্তাহে কি দুই সপ্তাহে একদিন বিকেলে গিয়ে একবার দেখা করে আসত দেবাশিস বাবুর সাথে। তাছাড়া যখন দেবাশিস বাবু বাড়িতে থাকতেন না তখন খুব ড্রিঙ্ক করার ইচ্ছে হলে, কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে রাত কাটিয়ে দিত ওই ফ্লাটে। দেবাশিস বাবুর বাড়িটা আসলে অভির জন্য একটা আমোদ প্রমোদের জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়। সেদিন বিকেলে খুব করে ধরলেন দেবাশিস বাবু, “আসো একটু কথা বার্তা বলি, আলাপ করি, তুমি ত একদম থাকোই না আমার কাছে।” বড়মাও বলল, দিদিও বলল, “সেই ত কতদিন আগে একবার রাতে থেকে ছিলি। যা একবার থেকে আয়, একটা রাতের ত ব্যাপার।” সেটা অনেকদিন আগের কথা, তখন সবে জোকা থেকে পাস করেছে। সেই ভেবে সেদিন অভি সন্ধ্যের পরেই দেবাশিস বাবুর বাড়ি পৌঁছে গেল।
সবে অফিস থেকে ফিরে দেবাশিস বাবু টিভিতে কোন কিছু একটা দেখছিলেন। দরজা খোলাই ছিল, কারন অভি বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে আসছে। ওকে দেখে একটু হেসে সোফা দেখিয়ে বসতে বলেন দেবাশিস বাবু। রান্না ঘরে একটা ছেলেকে দেখতে পেল, মনে হল কাজের লোক। ইতিমধ্যে যে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়ে একটা ছেলেকে রেখেছে সেটা ওর অবগত ছিল না। গতবার যখন এসেছিল তখন একটা কাজের মেয়ে দেবাশিস বাবুর বাড়িতে কাজ করত।
সোফার মাঝখানে রাখা ছোট কাঁচের টেবিলে দুটো ক্রিস্টালের কাট গ্লাস রাখা, তার পাশে এক একটা আইস বাকেটে বরফ আর ঠান্ডা জল, পাশে একটা দামী হুইস্কির বোতল। একটা প্লেটে চিকেনের টুকরো, বেশ কিছু কাজু, বাদাম ইত্যাদি। মনে মনে হেসে ফেলল অভি, বেশ সাজিয়েই বসেছেন।
একটা গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে দেবাশিস বাবু অভিকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো?”
অভি মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “ভালোই চলে যাচ্ছে।”
দ্বিতীয় গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করেন, “সোডা দিয়ে নেবে নাকি আইস দিয়ে?”
হেসে ফেলে অভি, “না না আমি নেব না, তুমি খাও।”
বক্র একটা হাসি দিয়ে দেবাশিস বাবু বলেন, “আমি না থাকলে ত বাড়িটাকে বার বানিয়ে ফেলো। এখন নিতে দোষ কোথায়?”
অভি হেসে ফেলে, “না সেই রকম নয়, মানে...”
কথাটা কেড়ে নিয়ে, গ্লাসে তিনটে বরফ আর একটু ঠান্ডা জল মিশিয়ে ওর দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “নাও নাও, এখানে তোমার বড়মা পাপা কেউ নেই আর আমার কাছে অত লজ্জা মান করে লাভ নেই।”
অভি খানিক দোনামনা করে শেষ পর্যন্ত দেবাশিস বাবুর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়েই নিল। ছোট একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কাজের মেয়েটাকে কবে ছাড়ালে?”
দেবাশিস বাবু উত্তর দিলেন, “এই দুইদিন হল। মেয়েটা রাতের দিকে আসে, কোনদিন আসে কোনদিন আসেনা, তাই এই রঘুকে রেখেছি। চব্বিশ ঘন্টার জন্য, বাড়ির পুরো দেখাশুনা করুক।” প্রমাদ গুনল অভি, এইবার ওদের আমোদ প্রমোদের দিন শেষ। ভাবটা বুঝতে পারলেন দেবাশিস বাবু, হেসে ফেলেন অভির চিন্তিত চেহারা দেখে, “ভেবো না কিছু, তোমরা তোমাদের মতন পারটি কর, ওকে দিয়েই কাজ করিয়ে নিও, তোমাদের হেল্পিং হ্যান্ড হয়ে যাবে।” বলেই হিহি করে হেসে উঠলেন।
অভি ও নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তর দিল, “যাক তাহলে, আমি ত ভেবেছিলাম আবার অন্য একটা জায়গা খুঁজতে হবে।” বলেই হেসে ফেলল।
দেবাশিস বাবু জিজ্ঞেস করেন, “তুমি চাকরি কবে করছ? অনেকদিন ত বসে?”
অভি একটু হেসে উত্তর দেয়, “এই দিদির বিয়ের পরে চাকরি খুঁজব।”
দেবাশিস বাবু বলেন, “তুমি এত পড়াশুনা করলে, বাইরে কেন গেলে না?”
একটু বাঁকা হাসি দিয়ে উত্তর দেয় অভি, “বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাবো না, তাই চাকরি করিনি এতদিন। এইবার দেখি এইখানে, মানে কোলকাতায় যা পাবো তাতেই ঢুকে যাবো।”
কিছুক্ষন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলেন দেবাশিস বাবু, “আগামী সপ্তাহে আমি একটা খুব বড় মিডিয়া হাউসে ডায়রেক্টর হিসাবে জয়েন করছি।”
একটু অবাক হয়ে অভি প্রশ্ন করে, “একে বারে ডায়রেক্টর?”
দেবাশিস বাবু এক স্বভিমানী হাসি দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ,ঐ মিডিয়া হাউসের কিছু স্টেক কিনে নিয়েছি এবং ডাইরেক্টর হিসাবে কিছু শেয়ার পাবো। বল’ত সেখানে তোমার জন্য একটা কিছু ব্যাবস্থা করে দেব।”
অভির এই ফ্লাট দেখে ঠিক ধারনা করতে পারেনি যে দেবাশিস বাবু এতটাও বড়োলোক হতে পারেন। যদিও জানত যে রাজারহাটের জমি বিক্রি করে প্রচুর টাকা কামিয়েছে, তাও। মাথা নাড়ায় অভি, “না, তার ঠিক দরকার পরবে না, আমি ঠিক খুঁজে নেব আমার মতন।”
একটা ক্ষুন্ন হাসি দিয়ে বলেন, “আমার কাছে সাহায্য নিতে তোমার বাধে?”
হ্যাঁ, সেটা সত্যি খুব বাধে, তাও মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “না ঠিক তেমন নয়, তবুও নিজের মেধা দক্ষতায় চাকরি পাওয়াটা বেশি আনন্দের।”
একটু হেসে উত্তর দেন দেবাশিস বাবু, “সেটা সত্যি। আচ্ছা চাকরি সুত্রে কোম্পানি যদি তোমাকে বাইরে পাঠায় তখন কি তুমি বাইরে যাবে না?”
অভি মাথা নাড়ায়, “না, বড়মা পাপা বেঁচে থাকতে ত কখনই নয়। তারপর দেখা যাবে কি হয় না হয়।”
দেবাশিস বাবুর বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়না যে অভির প্রান আটকে আছে ওই মধ্যমগ্রামের মাটিতে, সেখান থেকে এত সহজে উতপাটি করা অসম্ভব। একটু চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে মনামির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।”
অভি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, এই কালীপুজোর আগেই আশীর্বাদ হয়ে যাবে আর ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে বিয়ে।”
দেবাশিস বাবু, “জামাই কি করে?”
অভি উত্তর দেয়, “দিল্লীতে একটা বড় কোম্পানিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।”
মাথা দুলায় দেবাশিস বাবু, “গুড গুড, তোমার দুই জামাই বাবুই ইঞ্জিনিয়ার। ওই মধ্যমগ্রামে থেকেও দাদা বেশ ভালোই জামাই পেয়ে গেছেন দেখছি।”
কথাটা তির্যক হিসাবে বললেন না এমনি বললেন সেটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে অভি, “হুম” করে একটা ছোট উত্তর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবাশিস বাবুকে আপাদমস্তক জরিপ করে নেয়। কথাটা তির্যক মনে হল ওর, যেন পাপা ওই গ্রামে থেকে কিছুই করতে পারবে না, এমন একটা ভাব দেবাশিস বাবুর চোখে মুখে। বেশ কিছুক্ষন কারুর মুখে কোন কথা নেই, টিভিতে খবর চলছে। ইতিমধ্যে রঘু নামের ছেলেটা আরো একটা প্লেট ভরে চিকেন পকোড়া রেখে চলে গেল।
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর অভি জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, ফাল্গুনী ম্যাডাম এখন কোথায় আছেন?”
প্রশ্ন শুনে বিষম খেলেন দেবাশিস বাবু, “মানে? হটাত কি ব্যাপার?”
অভি উত্তর দেয়, “না মানে পাপা বলছিল, যদি বিয়েতে অথবা বৌভাতে আসতে পারে।”
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “না, তার দরকার নেই।”
অভি বেশি আর কথা বাড়াল না সেই দিকে। আবার দুই জনেই চুপ, মাঝে মাঝে হুইস্কির গলাসে চুমুক দেওয়া আর টিভি স্ক্রিনের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকা। বেশ কিছু পরে দেবাশিস বাবু নিজেকে থেকে বললেন, “ওই হলদিরামের কাছে একটা ফ্লাটে থাকে।” তারপরে ফোন নাম্বার দিয়ে বলেন, “যত হোক দাদা যখন বলেছেন তখন খেলাপ করা খারাপ দেখায়। ফোন করে ঠিকানা জেনে নিও। তবে একটু খেয়াল রেখো যেন...”
অভি সেই খেয়ালের কথাটা বুঝতে পেরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ বুঝে গেছি, তুমি বিয়েতে এসো, ফাল্গুনী ম্যাডামকে না হয়ত বউভাতে নিমতন্ন করব।”
মুচকি হেসে উত্তর দেন দেবাশিস বাবু, “অনেক কিছুই বুঝে যাও দেখছি।”
মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয় অভি, “হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই।”
কথায় কথায় ততক্ষনে তিনটে পেগের মতন দুইজনার শেষ। চোখে একটু রঙ লেগে গেছে অভির, এত দামী হুইস্কি আগে কোনদিন খায়নি। হুইস্কির সাথে সাথে সিগারেট এটাই অভ্যেস, কিন্তু প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে খুব সিগারেটে পেয়েছে কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলতে পারছে না, আর সামনে বসে দেবাশিস বাবু সমানে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে যাচ্ছেন, তার ফলে অভির আরো বেশি করে সিগারেটের নেশাটা চাগিয়ে উঠেছে।
অভি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি একটু আসছি।”
ঘোলা দৃষ্টিতে অভির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন দেবাশিস বাবু, “সিগারেট চাই? আগেই বললে হত।” বলে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
অভির সঙ্কোচ অনেক আগেই কেটে গেছিল, যেটুকু বাকি ছিল সেটা ওই সিগারেট প্যাকেট হাতে নিয়ে কাটিয়ে দিল। সিগারেটে একটা টান দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে নেশাটাকে আরো বেশি করে চাগিয়ে তোলে। নেশা একটু হয়েছে তবে অভি এখন স্বচেতন। সেইদিন দেবাশিস বাবুর বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। পরের দিন বাড়ি ফিরে মনামির প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল।
মনামিকে দেখে যাওয়ার সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই দিল্লী থেকে শিতাভ্র আসে দেখতে। তারপর থেকে রোজ রাতেই মনামির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা শিতাভ্রর ফোনে কথাবার্তা চলে। শিতাভ্র দেখতে অচল নয়, তবে একটু বেটে খাটো মানুষ কিন্তু বেশ ভালো ছেলে। মনামির হিল তোলা জুতো পড়ার দিন শেষ হয়ে যায়, সেই নিয়ে অভির খুব হাসাহাসি, তোর বেঁটে বর, তোর বেঁটে বর। এই নিয়ে মনামি, ভাইয়ের ওপরে একটু খেপেও যেত, যত হোক, এই কয়দিনে কথাবার্তা বলে, হবু বরের প্রতি একটা কেমন যেন টান অনুভব করে। সেটা অভিও বুঝতে পারে, তাও খেপাতে ছাড়ে না। পুজোর আগে, একবার দুই দিনের ছুটি নিয়ে লুকিয়ে মনামির সাথে দেখাও করে গেছে শিতাভ্র। দেহরক্ষী হিসাবে মনামির সাথে অভি গিয়েছিল, কারন দুই বাড়ির কেউ জানত না যে শিতাভ্র ছুটি নিয়ে কোলকাতা এসেছে।
পুজোর আগে থেকেই পুজোর জন্য কেনাকাটা শুরু সেই সাথে বিয়ের জন্য কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। প্রণামীর কাপড় অবশ্য নরেন মামার দোকান থেকেই আসবে, বাকি বাড়ির লোকজনের কাপড় কেনার জন্য গড়িয়াহাট, কলেজস্ট্রিট। সেদিন এই প্রনামি শাড়ি আর কিছু জামা কাপড় কেনা কাটার জন্য বড়মাকে নিয়ে আর মনামিকে নৈহাটি যাওয়া হয়েছিল। অভি লক্ষ্য করে যে স্বাতীলেখা একটু মন মরা। সবার সামনে ঠিক প্রশ্ন করতে পারেনি, তবে সন্ধ্যের পরে যখন সবাই দোকানে যায় কাপড় দেখতে তখন অভি একাকী লেখাকে একটু অন্যত্র ডেকে নিয়ে যায়। অভি জানে, লেখা ভীষণ মুখচোরা মেয়ে, খুব করে চেপে না ধরলে কিছুই জানাবে না।
অভি লেখাকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে এত মুখ শুকনো কেন, ঝন্টুদার সাথে কিছু হয়েছে নাকি?”
লেখা স্মিত হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, “তুমি’ত দিদি ভাইয়ের বিয়ের কেনা কাটা করতে এসেছ। ভেতরে যাও, জামা কাপড় দেখ।”
লেখার কাঁধ ধরে আলতো ঝাকিয়ে হেসে ফেলে অভি, “সুন্দরী লেখা, জব সে তেরেকো দেখা...”
সেই সাথে হেসে ফেলে লেখাও, “যাও, তুমি না বড্ড শয়তান।” বলেই চোখের কোল একটু মুছে নেয়।