08-07-2020, 10:25 AM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১১)
ভিজে ভিজে ওই পাড়ে গিয়ে বাস ধরলাম বেহালা আসার জন্য। হাওড়া ব্রিজ পার হতেই ছন্দা আমার হাত ধরে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি ব্যাপার, কি হয়েছে?"
আমার হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ নিজের বুকে চেপে আদুরে কন্ঠে বললো, "আজকে না বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না আমার।"
আমি আঁতকে উঠে বললাম, "তুমি পাগল হয়েছো নাকি? কোথায় যাবে?"
একটু খানি নেচে নিয়ে বললো, "তোমার সাথে এই কোলকাতার রাস্তায় আজ ঘুরে বেড়াবো।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তা এখন কি করতে চাও?"
ও বললো, "হেঁটে কলেজ স্ট্রিট যাই চলো, অনেক দিন কফি হাউসে বসে আড্ডা মারিনি।"
এক ছাতার তলায় হেঁটে হেঁটে বড়তলা স্ট্রিট, চারপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে টানা রিক্সা আর রিক্সাওয়ালা গুলো পাশের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি ছন্দাকে বললাম যে হেঁটে যেতে, ছন্দা একবার আমার দিকে দেখলো একবার ওই ভিজে রিক্সা গুলোর দিকে দেখে আবদার করলো যে ওই টানা রিক্সায় চাপবে। শেষ পর্যন্ত দুইজনে মিলে টানা রিক্সায় চাপলাম। রিক্সা ওয়ালা ভাড়া চাইল তিন টাকা, ছন্দা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ভিজে রাস্তার ওপর দিয়ে ভিজতে ভিজতে সেই লোকটা রিক্সা টানতে টানতে আমাদের কলেজ স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত নিয়ে গেল। যাওয়ার পথে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে পেয়েই ঢিপ করে একটা প্রনাম ঠুকে নিল।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাতে উত্তর দিল, "যা বাবা এনাকে ভুলে গেলে কি করে হবে। ওই ছোটবেলার সহজ পাঠের - ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া; এর মধ্যেই ভুলে গেলে? ওই জন্যই আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি।"
আমি হেসে দিলাম, ওর ধরন দেখে, সত্যি মেয়েটা পারেও বটে। রিক্সা থেকে নেমে ছন্দা পার্স থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা বললো যে ওর কাছে খুচরো পয়সা নেই, ছন্দা ওকে টাকাটা রেখে দিতে বললো।
আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল, "ওর বাড়িতে নিশ্চয় একটা বৌ আছে আর আছে চার পাঁচটা বাচ্চা কাচ্চা। এই বৃষ্টিতে এরপরে আর কোন যাত্রী পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ওর ছেলে মেয়েরা নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে কখন ওদের বাবা আসবে আর ওদের জন্য কিছু নিয়ে আসবে। আমি ওই বাচ্চাদের মনের কথা বুঝি কারন এক সময়ে আমিও আমার বাবার জন্য ওই রকম হাপিত্যেস হয়ে বসে থাকতাম।"
কথাটা আমার বুকে বড় বেজে উঠলো, নারী তোমার এই অঙ্গে কত রুপ। ছন্দা হারায়নি তবে এই তিলোত্তমা হারিয়ে গেছে!
কফিহাউসে বসেই আমাদের ভিজে কাপড় শুকিয়ে গেল। তারপর ছন্দাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে এলাম।
কোলকাতায় আমরা শুধু তিনজনে পড়ে রইলাম, বাকিরা সব দূরে দূরে। দেবুর সাথে মাসে একবার দেখা হত, কোন মাসে হত না। দিল্লী যাওয়ার পরে নবীনের সাথে বার তিনেক দেখা হয়েছিলো, ও আর সেই আগেকার রোগা পটকা নবীন নেই, দিল্লী গিয়ে বেশ ফুলে গেছে। পচার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত গুজরাটে গিয়ে কোন গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে, শ্যামলীর বিয়ের পরে ওর সাথে একবার শুধু মাত্র কথা হয়েছিলো আর হয়নি। কে আই এস ডি করবে আর গল্প করবে?
কফি হাউসে বসে ছন্দা বললো একবার কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? হঠাৎ ওর ভাবের এই পরিবরতনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে চায়। চাকরি পাওয়ার পরে ওর ভাইকে দেওঘরের বেশ নামকরা এক মিশন কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে যেতে চায়। আমি বলাম বেশ, কিন্তু ওই বৈদ্যনাথ ধামের কথা শুনেই একটু বেঁকে গেলাম, সেই মন্দির আর মন্দির আর ছন্দার চটি খুলে ঢিপ করে প্রনাম করার কথা মনে পড়ে গেল। আমার চেহারা দেখে মনের ভাব বুঝতে ওর একটুকু সময় লাগলো না। আমি এই ভেবে রাজি হয়ে গেলাম যে এবারে একসাথে বেশ কয়েকদিন একসাথে কাটান যাবে। তখন বাঙালির বেড়াতে যাওয়া মানে দার্জিলিং, সিমলা কুল্লু মানালি, সমুদ্র সৈকত বলতে পুরী মাড্রাস কন্যাকুমারী, আমি কোনোদিন দেওঘর যাইনি ছন্দার দৌলতে যাওয়া।
ঠিক হল যে পুজোর ছুটির পরে নভেম্বরের মাঝের দিকে আমরা দেওঘর বেড়াতে যাবো। নভেম্বরে কোলকাতায় বিশেষ ঠাণ্ডা না পড়লেও দেওঘরে বেশ ঠাণ্ডা পরে। ওইদিন কফিহাউসে বসে পরিকল্পনা করার পর থেকে আমার চোখে আর ঘুম নেই, যখনি ছন্দার সাথে দেখা হয় তখনি ওকে শয়তানি করে বলি, এক কামরায়, এক বিছানায় এক লেপের নিচে ওকে আমি ছিঁড়ে খাব। সেই শুনে বলতো যে একটা রামপুরি চাকু সাথে নিয়ে যাবে নিজের আত্মরক্ষা করার জন্য। প্রেমের আগুন দুইদিকেই সমান ভাবেই লেগেছিলো। ছন্দার বিশেষ অসুবিধে হল না, বাড়িতে বললো এক বন্ধুর সাথে ভাইয়ের কাছে যাবে। আমিও সেই মতন বাড়িতে জানালাম যে কয়েক দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি সে সব আর বলার দরকার পড়লো না।
ট্রেন রাত দশটায়, আমি আটটায় হাওড়া পৌঁছে গেছিলাম, কথা ছিলো বড় ঘড়িটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। একটা সিগারেট ধরালাম আর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রঙ বেরঙ্গের শাল সোয়েটার জ্যাকেট পরা মানুষ এদিক ওদিকে চলাফেরা করছে। একটু বাদে ছন্দাকে দেখলাম, শালোয়ারের ওপরে একটা লম্বা সোয়েটার আর গলায় একটা শাল জড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমি কাছে গিয়ে ওর হাতের থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। আমার কাছে একটা ছোট ব্যাগ ছিলো দুই জোড়া জামাকাপড় আর দুটো জ্যাকেট কিন্তু মেয়েদের ব্যাগে পুরো সংসার যায় তাই ছন্দার ব্যাগের আকার আমার চেয়ে তিনগুন বড়।
লোকের ভিড় ঠেলে ব্যাগ কাঁধে প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলাম। বিহারের ট্রেন, প্লাটফরম যেন জনসমুদ্র। ট্রেন দিতে না দিতেই ঠ্যালা ঠেলি শুরু, এটা অবশ্য আমার পক্ষে নতুন নয়। ছন্দা গজগজ করতে করতে আমার পেছনে কোন রকমে লুকিয়ে পড়ল। সেই সময়ে খুব বড়লোক ছাড়া মধ্যবিত্তরা এসি তে উঠতো না, আমরাও সেকেন্ড ক্লাসে রিজার্ভেশান করিয়েছিলাম। আমি ওকে বললাম যে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে, ভিড় কমার পরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। উঠে দেখি প্রায় পঙ্গপালের মতন একটা পরিবার আমাদের সিট দখল করে বসে, একটা বুড়ো, একটা মাঝ বয়সি লোক তার বউ, চারখানা বাচ্চা কাচ্চা। ওদের সঙ্গের মালের কোন সিমানা নেই, তিনটে বস্তা, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, দুটো কাপড়ের পুটুলি মার্কা ব্যাগ। আমি আমাদের সিট দেখিয়ে বললাম যে এই দুটো আমাদের সিট। বৌটা একটু সরে গিয়ে ছন্দাকে বসতে জায়গা দিল, যেন আমরা ওদের কাছে সিটে বসার জন্য ভিক্ষে চেয়েছি। ওই দেখে ছন্দার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে তেড়ে উঠলো, "এই সিট আমাদের হ্যায়, পয়সা দেকে রিসার্ভ করা হ্যায় বিনা পয়সায় জাতা নেহি।"
বউটা কি বুঝলো কি বুঝল না জানিনা হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছন্দা এক টানে সিটের ওপর থেকে ওদের মালপত্র গুলো নিচে ফেলে দিল সঙ্গে সঙ্গে সাথের যে লোকটা ছিলো সে তেড়ে ফুঁড়ে উঠলো। আমি লোকটাকে ওর টিকিট দেখাতে বললাম, লোকটা টিকিট দেখালো। ওদের জেনারেল কম্পার্টমেন্টের টিকিট। আমি ওদের ওইখান থেকে নেমে যেতে বললাম। সে লোক কিছুতেই বুঝতে চায় না, টিকিট কেটেছে আলবাত যাবে।
ছন্দা ওকে তেড়ে বললো, "তুম লোগ কে মুন্ডি মে কিছু নেই, খোট্টার জাত এখুনি না নামলে আমি টিটি বুলায়গা।"
আমি বুঝতে পারলাম যে এদের সাথে বচসা করে লাভ নেই। রাগে গজগজ করতে করতে বৌটাকে ঠেলে দিয়ে ছন্দা জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ল আর আমাকে টেনে ওর পাশে বসিয়ে দিল। ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়ল আর বর্ধমানে টিটি উঠলো।
ছন্দা তো টিটিকে তেড়ে ওঠে, "যাত্রী ওঠানোর সময়ে আপনাদের দেখা উচিত কার রিজার্ভেশান আছে আর কার নেই। এখুনি ওদের নামিয়ে দিন না হলে আমি স্টেসান মাস্টারের কাছে যাবো।"
টিটি হেসে বললো, "ম্যাডাম এত লোকের টিকিট চেক করে তো আর ওঠানো যায় না, তাহলে ট্রেন ছাড়তেই সকাল হয়ে যাবে।"
ওদেরকে বর্ধমানে নামিয়ে দিল টিটি। বর্ধমান ছাড়ার পরে দেখলাম যে ট্রেন বেশ খালি, কম্পারট্মেন্টে লোকজন বিশেষ নেই। আমাদের ওই ছয়জনার কুপে শুধু মাত্র দুইজনেই ছিলাম, তাতে আমাদের বেশ সুবিধে হল একটু একত্রে থাকার। ছন্দা বেশ কয়েকবার দেওঘর গেছে আর প্রত্যেক বার এই রকম কিছু না কিছু ঘটেছে। ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করলো। ছন্দা বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে এনেছিলো লুচি আর আলুর তরকারি, খবরের কাগজ পেতে খাওয়া দাওয়া সেরে বার্থ নামিয়ে শুয়ে পড়লাম। আসানসোল থেকে আরও কয়েকজন উঠলো।
আমি চোখ বন্ধ করতে যাবো কি ছন্দা ধড়মড় করে আমাকে উঠিয়ে বললো একটু পরেই নাকি জসিডি এসে যাবে। যাঃবাবা যাও বা একটু চোখ লেগেছিলো তাও কেটে গেল।
সূর্যি মামা পুবদিক থেকে কোন রকমে উঁকিঝুকি মারছে আর সেই সময়ে আমরা নেমে পড়লাম জসিডিতে। জসিডিতে নামতেই ছ্যাক করে ঠাণ্ডা আমাদের চেপে ধরলো। আমি আমার জ্যাকেটটা আরও জড়িয়ে ধরলাম আর ছন্দা শালটা বার করে ওর সোয়েটারের ওপরে চাপিয়ে নিল। ছন্দা জানাল সেখান থেকে কয়লার ইঞ্জিনের ছোট লাইনের অন্য একটা ট্রেন ধরে দেওঘর যেতে হবে। ওই ছোট ট্রেনে উঠলাম, সেখানে রিসারভেসানের কোন বালাই নেই, বেশির ভাগ যাত্রী বিনা টিকিটের। যাই হোক ঠেলে মেলে জায়গা করে সেই ছোট ট্রেন করে দেওঘর যাওয়া হল। স্টেসানে নামতেই এক গাদা হোটেল অয়ালা, টাঙ্গা ওয়ালা আর বৈদ্যনাথ ধামের পান্ডা ছেঁকে ধরলো। ছন্দা পটীয়সী মহিলার মতন আমার হাত ধরে ওদের বাঁচিয়ে বেড়িয়ে চলে এলো।
একটা এক ঘোড়া টানা টাঙ্গায় চেপে একটা হোটেলের নাম করে বললো সেখানে নিয়ে যেতে। সে এক অদ্ভুত অনুভুতি, ভোরের আকাশ হালকা রোদে মাখা, খালি রাস্তা আর চারপাশে কুয়াশা ভরা সকালো আর আমার কোল ঘেঁসে ছন্দা বসে। কোথাও বেশ কয়েকজন লোক আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে, সেই কাঠের ধুয়োর গন্ধে এক অদ্ভুত গন্ধ। পথের দুপাশে উঁচু উঁচু সারবাঁধা ইউক্যালিপ্টাস গাছ, নিম গাছ ইত্যাদি।
পথে যেতে যেতে আমাকে বললো, "ভাইয়ের কলেজে গেস্ট হাউস আছে, তবে সেখানে একসাথে থাকাটা একটু দৃষ্টি কটু লাগবে। তাই আমরা একটা হোটেলে উঠবো।"
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, "মা তারা তুমি আমাকে যেখানে ফেলবে সেখানেই দেহ রাখবো।"
আমার ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো, "ছিঃ দেহ রাখার কথা একদম বলতে নেই।"
শহরের ভিড় ছাড়িয়ে একটু তফাতে এক নিরিবিলি জায়গায় আমাদের হোটেল। খুব বড় না হলেও বেশ ছিমছাম, হোটেল দেখে ছন্দা বেশ খুশি, কিন্তু বাঙালি মেয়ে একটু খুঁতখুঁতে না হলে চলে না। রুমে ঢুকেই ছেলেটাকে বললো যে বিছানার চাদর বদলে দিতে। ছেলেটা যত বুঝাতে চায় যে বিছানার চাদর পরিষ্কার কিন্তু ছন্দা সে কথা মানতে নারাজ। একটানে চাদর সরিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে বললো এখুনি যদি চাদর না বদলায় তাহলে হোটেল থেকে চলে যাবে। অগত্যা কি করে একটা নতুন চাদর এনে পেতে দিল। সেই সাথে বালিশের অয়ার বদলে দিল। আমি চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে শুধু ছন্দাকে দেখে গেলাম।
ভিজে ভিজে ওই পাড়ে গিয়ে বাস ধরলাম বেহালা আসার জন্য। হাওড়া ব্রিজ পার হতেই ছন্দা আমার হাত ধরে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি ব্যাপার, কি হয়েছে?"
আমার হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ নিজের বুকে চেপে আদুরে কন্ঠে বললো, "আজকে না বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না আমার।"
আমি আঁতকে উঠে বললাম, "তুমি পাগল হয়েছো নাকি? কোথায় যাবে?"
একটু খানি নেচে নিয়ে বললো, "তোমার সাথে এই কোলকাতার রাস্তায় আজ ঘুরে বেড়াবো।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তা এখন কি করতে চাও?"
ও বললো, "হেঁটে কলেজ স্ট্রিট যাই চলো, অনেক দিন কফি হাউসে বসে আড্ডা মারিনি।"
এক ছাতার তলায় হেঁটে হেঁটে বড়তলা স্ট্রিট, চারপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে টানা রিক্সা আর রিক্সাওয়ালা গুলো পাশের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি ছন্দাকে বললাম যে হেঁটে যেতে, ছন্দা একবার আমার দিকে দেখলো একবার ওই ভিজে রিক্সা গুলোর দিকে দেখে আবদার করলো যে ওই টানা রিক্সায় চাপবে। শেষ পর্যন্ত দুইজনে মিলে টানা রিক্সায় চাপলাম। রিক্সা ওয়ালা ভাড়া চাইল তিন টাকা, ছন্দা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ভিজে রাস্তার ওপর দিয়ে ভিজতে ভিজতে সেই লোকটা রিক্সা টানতে টানতে আমাদের কলেজ স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত নিয়ে গেল। যাওয়ার পথে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে পেয়েই ঢিপ করে একটা প্রনাম ঠুকে নিল।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাতে উত্তর দিল, "যা বাবা এনাকে ভুলে গেলে কি করে হবে। ওই ছোটবেলার সহজ পাঠের - ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া; এর মধ্যেই ভুলে গেলে? ওই জন্যই আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি।"
আমি হেসে দিলাম, ওর ধরন দেখে, সত্যি মেয়েটা পারেও বটে। রিক্সা থেকে নেমে ছন্দা পার্স থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা বললো যে ওর কাছে খুচরো পয়সা নেই, ছন্দা ওকে টাকাটা রেখে দিতে বললো।
আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল, "ওর বাড়িতে নিশ্চয় একটা বৌ আছে আর আছে চার পাঁচটা বাচ্চা কাচ্চা। এই বৃষ্টিতে এরপরে আর কোন যাত্রী পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ওর ছেলে মেয়েরা নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে কখন ওদের বাবা আসবে আর ওদের জন্য কিছু নিয়ে আসবে। আমি ওই বাচ্চাদের মনের কথা বুঝি কারন এক সময়ে আমিও আমার বাবার জন্য ওই রকম হাপিত্যেস হয়ে বসে থাকতাম।"
কথাটা আমার বুকে বড় বেজে উঠলো, নারী তোমার এই অঙ্গে কত রুপ। ছন্দা হারায়নি তবে এই তিলোত্তমা হারিয়ে গেছে!
কফিহাউসে বসেই আমাদের ভিজে কাপড় শুকিয়ে গেল। তারপর ছন্দাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে এলাম।
কোলকাতায় আমরা শুধু তিনজনে পড়ে রইলাম, বাকিরা সব দূরে দূরে। দেবুর সাথে মাসে একবার দেখা হত, কোন মাসে হত না। দিল্লী যাওয়ার পরে নবীনের সাথে বার তিনেক দেখা হয়েছিলো, ও আর সেই আগেকার রোগা পটকা নবীন নেই, দিল্লী গিয়ে বেশ ফুলে গেছে। পচার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত গুজরাটে গিয়ে কোন গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে, শ্যামলীর বিয়ের পরে ওর সাথে একবার শুধু মাত্র কথা হয়েছিলো আর হয়নি। কে আই এস ডি করবে আর গল্প করবে?
কফি হাউসে বসে ছন্দা বললো একবার কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? হঠাৎ ওর ভাবের এই পরিবরতনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে চায়। চাকরি পাওয়ার পরে ওর ভাইকে দেওঘরের বেশ নামকরা এক মিশন কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে যেতে চায়। আমি বলাম বেশ, কিন্তু ওই বৈদ্যনাথ ধামের কথা শুনেই একটু বেঁকে গেলাম, সেই মন্দির আর মন্দির আর ছন্দার চটি খুলে ঢিপ করে প্রনাম করার কথা মনে পড়ে গেল। আমার চেহারা দেখে মনের ভাব বুঝতে ওর একটুকু সময় লাগলো না। আমি এই ভেবে রাজি হয়ে গেলাম যে এবারে একসাথে বেশ কয়েকদিন একসাথে কাটান যাবে। তখন বাঙালির বেড়াতে যাওয়া মানে দার্জিলিং, সিমলা কুল্লু মানালি, সমুদ্র সৈকত বলতে পুরী মাড্রাস কন্যাকুমারী, আমি কোনোদিন দেওঘর যাইনি ছন্দার দৌলতে যাওয়া।
ঠিক হল যে পুজোর ছুটির পরে নভেম্বরের মাঝের দিকে আমরা দেওঘর বেড়াতে যাবো। নভেম্বরে কোলকাতায় বিশেষ ঠাণ্ডা না পড়লেও দেওঘরে বেশ ঠাণ্ডা পরে। ওইদিন কফিহাউসে বসে পরিকল্পনা করার পর থেকে আমার চোখে আর ঘুম নেই, যখনি ছন্দার সাথে দেখা হয় তখনি ওকে শয়তানি করে বলি, এক কামরায়, এক বিছানায় এক লেপের নিচে ওকে আমি ছিঁড়ে খাব। সেই শুনে বলতো যে একটা রামপুরি চাকু সাথে নিয়ে যাবে নিজের আত্মরক্ষা করার জন্য। প্রেমের আগুন দুইদিকেই সমান ভাবেই লেগেছিলো। ছন্দার বিশেষ অসুবিধে হল না, বাড়িতে বললো এক বন্ধুর সাথে ভাইয়ের কাছে যাবে। আমিও সেই মতন বাড়িতে জানালাম যে কয়েক দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি সে সব আর বলার দরকার পড়লো না।
ট্রেন রাত দশটায়, আমি আটটায় হাওড়া পৌঁছে গেছিলাম, কথা ছিলো বড় ঘড়িটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। একটা সিগারেট ধরালাম আর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রঙ বেরঙ্গের শাল সোয়েটার জ্যাকেট পরা মানুষ এদিক ওদিকে চলাফেরা করছে। একটু বাদে ছন্দাকে দেখলাম, শালোয়ারের ওপরে একটা লম্বা সোয়েটার আর গলায় একটা শাল জড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমি কাছে গিয়ে ওর হাতের থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। আমার কাছে একটা ছোট ব্যাগ ছিলো দুই জোড়া জামাকাপড় আর দুটো জ্যাকেট কিন্তু মেয়েদের ব্যাগে পুরো সংসার যায় তাই ছন্দার ব্যাগের আকার আমার চেয়ে তিনগুন বড়।
লোকের ভিড় ঠেলে ব্যাগ কাঁধে প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলাম। বিহারের ট্রেন, প্লাটফরম যেন জনসমুদ্র। ট্রেন দিতে না দিতেই ঠ্যালা ঠেলি শুরু, এটা অবশ্য আমার পক্ষে নতুন নয়। ছন্দা গজগজ করতে করতে আমার পেছনে কোন রকমে লুকিয়ে পড়ল। সেই সময়ে খুব বড়লোক ছাড়া মধ্যবিত্তরা এসি তে উঠতো না, আমরাও সেকেন্ড ক্লাসে রিজার্ভেশান করিয়েছিলাম। আমি ওকে বললাম যে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে, ভিড় কমার পরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। উঠে দেখি প্রায় পঙ্গপালের মতন একটা পরিবার আমাদের সিট দখল করে বসে, একটা বুড়ো, একটা মাঝ বয়সি লোক তার বউ, চারখানা বাচ্চা কাচ্চা। ওদের সঙ্গের মালের কোন সিমানা নেই, তিনটে বস্তা, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, দুটো কাপড়ের পুটুলি মার্কা ব্যাগ। আমি আমাদের সিট দেখিয়ে বললাম যে এই দুটো আমাদের সিট। বৌটা একটু সরে গিয়ে ছন্দাকে বসতে জায়গা দিল, যেন আমরা ওদের কাছে সিটে বসার জন্য ভিক্ষে চেয়েছি। ওই দেখে ছন্দার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে তেড়ে উঠলো, "এই সিট আমাদের হ্যায়, পয়সা দেকে রিসার্ভ করা হ্যায় বিনা পয়সায় জাতা নেহি।"
বউটা কি বুঝলো কি বুঝল না জানিনা হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছন্দা এক টানে সিটের ওপর থেকে ওদের মালপত্র গুলো নিচে ফেলে দিল সঙ্গে সঙ্গে সাথের যে লোকটা ছিলো সে তেড়ে ফুঁড়ে উঠলো। আমি লোকটাকে ওর টিকিট দেখাতে বললাম, লোকটা টিকিট দেখালো। ওদের জেনারেল কম্পার্টমেন্টের টিকিট। আমি ওদের ওইখান থেকে নেমে যেতে বললাম। সে লোক কিছুতেই বুঝতে চায় না, টিকিট কেটেছে আলবাত যাবে।
ছন্দা ওকে তেড়ে বললো, "তুম লোগ কে মুন্ডি মে কিছু নেই, খোট্টার জাত এখুনি না নামলে আমি টিটি বুলায়গা।"
আমি বুঝতে পারলাম যে এদের সাথে বচসা করে লাভ নেই। রাগে গজগজ করতে করতে বৌটাকে ঠেলে দিয়ে ছন্দা জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ল আর আমাকে টেনে ওর পাশে বসিয়ে দিল। ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়ল আর বর্ধমানে টিটি উঠলো।
ছন্দা তো টিটিকে তেড়ে ওঠে, "যাত্রী ওঠানোর সময়ে আপনাদের দেখা উচিত কার রিজার্ভেশান আছে আর কার নেই। এখুনি ওদের নামিয়ে দিন না হলে আমি স্টেসান মাস্টারের কাছে যাবো।"
টিটি হেসে বললো, "ম্যাডাম এত লোকের টিকিট চেক করে তো আর ওঠানো যায় না, তাহলে ট্রেন ছাড়তেই সকাল হয়ে যাবে।"
ওদেরকে বর্ধমানে নামিয়ে দিল টিটি। বর্ধমান ছাড়ার পরে দেখলাম যে ট্রেন বেশ খালি, কম্পারট্মেন্টে লোকজন বিশেষ নেই। আমাদের ওই ছয়জনার কুপে শুধু মাত্র দুইজনেই ছিলাম, তাতে আমাদের বেশ সুবিধে হল একটু একত্রে থাকার। ছন্দা বেশ কয়েকবার দেওঘর গেছে আর প্রত্যেক বার এই রকম কিছু না কিছু ঘটেছে। ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করলো। ছন্দা বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে এনেছিলো লুচি আর আলুর তরকারি, খবরের কাগজ পেতে খাওয়া দাওয়া সেরে বার্থ নামিয়ে শুয়ে পড়লাম। আসানসোল থেকে আরও কয়েকজন উঠলো।
আমি চোখ বন্ধ করতে যাবো কি ছন্দা ধড়মড় করে আমাকে উঠিয়ে বললো একটু পরেই নাকি জসিডি এসে যাবে। যাঃবাবা যাও বা একটু চোখ লেগেছিলো তাও কেটে গেল।
সূর্যি মামা পুবদিক থেকে কোন রকমে উঁকিঝুকি মারছে আর সেই সময়ে আমরা নেমে পড়লাম জসিডিতে। জসিডিতে নামতেই ছ্যাক করে ঠাণ্ডা আমাদের চেপে ধরলো। আমি আমার জ্যাকেটটা আরও জড়িয়ে ধরলাম আর ছন্দা শালটা বার করে ওর সোয়েটারের ওপরে চাপিয়ে নিল। ছন্দা জানাল সেখান থেকে কয়লার ইঞ্জিনের ছোট লাইনের অন্য একটা ট্রেন ধরে দেওঘর যেতে হবে। ওই ছোট ট্রেনে উঠলাম, সেখানে রিসারভেসানের কোন বালাই নেই, বেশির ভাগ যাত্রী বিনা টিকিটের। যাই হোক ঠেলে মেলে জায়গা করে সেই ছোট ট্রেন করে দেওঘর যাওয়া হল। স্টেসানে নামতেই এক গাদা হোটেল অয়ালা, টাঙ্গা ওয়ালা আর বৈদ্যনাথ ধামের পান্ডা ছেঁকে ধরলো। ছন্দা পটীয়সী মহিলার মতন আমার হাত ধরে ওদের বাঁচিয়ে বেড়িয়ে চলে এলো।
একটা এক ঘোড়া টানা টাঙ্গায় চেপে একটা হোটেলের নাম করে বললো সেখানে নিয়ে যেতে। সে এক অদ্ভুত অনুভুতি, ভোরের আকাশ হালকা রোদে মাখা, খালি রাস্তা আর চারপাশে কুয়াশা ভরা সকালো আর আমার কোল ঘেঁসে ছন্দা বসে। কোথাও বেশ কয়েকজন লোক আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে, সেই কাঠের ধুয়োর গন্ধে এক অদ্ভুত গন্ধ। পথের দুপাশে উঁচু উঁচু সারবাঁধা ইউক্যালিপ্টাস গাছ, নিম গাছ ইত্যাদি।
পথে যেতে যেতে আমাকে বললো, "ভাইয়ের কলেজে গেস্ট হাউস আছে, তবে সেখানে একসাথে থাকাটা একটু দৃষ্টি কটু লাগবে। তাই আমরা একটা হোটেলে উঠবো।"
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, "মা তারা তুমি আমাকে যেখানে ফেলবে সেখানেই দেহ রাখবো।"
আমার ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো, "ছিঃ দেহ রাখার কথা একদম বলতে নেই।"
শহরের ভিড় ছাড়িয়ে একটু তফাতে এক নিরিবিলি জায়গায় আমাদের হোটেল। খুব বড় না হলেও বেশ ছিমছাম, হোটেল দেখে ছন্দা বেশ খুশি, কিন্তু বাঙালি মেয়ে একটু খুঁতখুঁতে না হলে চলে না। রুমে ঢুকেই ছেলেটাকে বললো যে বিছানার চাদর বদলে দিতে। ছেলেটা যত বুঝাতে চায় যে বিছানার চাদর পরিষ্কার কিন্তু ছন্দা সে কথা মানতে নারাজ। একটানে চাদর সরিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে বললো এখুনি যদি চাদর না বদলায় তাহলে হোটেল থেকে চলে যাবে। অগত্যা কি করে একটা নতুন চাদর এনে পেতে দিল। সেই সাথে বালিশের অয়ার বদলে দিল। আমি চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে শুধু ছন্দাকে দেখে গেলাম।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!