07-07-2020, 07:26 PM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৮)
অনুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আমি অনুকে বললাম, "তোর সাথে একটু কথা আছে।"
অনু জিজ্ঞেস করলো, "কি কথা?"
আমি ওকে দেবুর ঘ্যানঘ্যানানির কথা, নবীনের সাবধান বাণী সব খুলে বললাম। সব কিছু শুনে অনু চুপ করে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না। তারপরে আমাকে বললো একবার নবীনকে ডেকে দিতে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠ্যালা মেরে বললো তাড়াতাড়ি যেতে আর নবীনকে ডেকে আনতে। আমি নবীন কে ডাকতে গেলাম, নবীন কে বললাম যে অনুকে দেবুর কথা বলেছি কিন্তু অনু একবার ওর সাথে দেখা করতে চায়। আমার কথা শুনে নবীন আমাকে জানিয়ে দিল যে যা বলার অনুকে সব যখন আমি বলেই দিয়েছি তাহলে ওর আর কিছু বলার নেই। আমি পড়লাম মহা মুশকিলে, এই দুইজনের মধ্যে আবার কি ফল্গু ধারা চলছে? যাই হোক পেছনে তাকিয়ে দেখি ছন্দা আর অনু দাঁড়িয়ে।
অনু হাজার প্রশ্ন মাখা চাহনি নিয়ে নবীনকে জিজ্ঞেস করলো, "তোর কি কিছু বলার আছে?"
মাটির দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, "পুটুর কাছ থেকে সবই তো শুনেছিস, আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?"
দুইজনে চুপ, ছন্দা আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে চুপ থাকতে বললো। আমি ওই দুজনার দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতন চেয়ে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অনু হেসে ওকে বললো, "তুই নাকি দেবু কে কেটে ফেলবি বলেছিস?"
সেই শুনে নবীন জবাবে বাঁকা হাসি দিল, "আমি চাই তুই ভালো থাক তাই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।"
বুক ভরে শ্বাস নিল অনু, তারপরে ছন্দার হাত ধরে বললো, "চল, বাড়ির দিকে চল।"
নবীন ওইখানে একা দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপরে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
বাড়ির পথে যেতে যেতে অনু, ছন্দাকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে আমাকে বললো, "তোদের দেখার পরে জীবনে একবারের জন্য প্রেম করতে বড় ইচ্ছে করছে।"
ছন্দা হেসে ওকে বললো, "তুই কি আর সত্যি আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলি? তোর নিজেরই ঠিক নেই দেবুকে হ্যাঁ বলবি না না বলবি।"
অনুকে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখিনি, কিন্তু ওইদিন মেয়েটা লাজুক হেসে আমাকে বললো, "আগেকার কথা ছেড়ে দে। দেবুর সাথে ঝগড়া করতাম এই কারনে কেননা ওর বুকে সেই পাটা নেই। বিয়ের পরে দেখলাম ওকে আমাকেই খাইয়ে দিতে হচ্ছে।"
কথায় গল্পে অনুর বাড়ি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে এলো। বাড়ি ঢুকতেই অনুর ছোট কাকিমা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো যে আমি রাতে থাকবো কি না। আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে রাতে এই বাড়িতেই থাকবো। ছোট কাকিমা একবার আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বললো যে আমি যেন এক তলার বসার ঘরের পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমি কিছু বললাম না, আমি কি এখানে ঘুমাতে এসেছি নাকি?
কাকিমা চলে যেতেই অনু আমাকে নিয়ে পা টিপে টিপে দুতলায় উঠে এলো। ওর ঘর দু'তলার বারান্দার একদম শেষে। অনু ছন্দাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল, আর আমাকে বললো ছাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে যেতে। আমি ওর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এত রাতে এখানে আমি ঘুমাতে আসিনি ওই দিকে ছন্দা মিচকি হেসে আমার দিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেনুনি দুলিয়ে চলে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ওই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম তারপরে চুপচাপ চারতলার চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলাম।
এই ঘরটায় কেউ শুতে আসে না, এই ঘরে বরাবর ছেলেদের আড্ডা জমে। বিশ্বজিৎদার বন্ধু, মেজদার বন্ধু, মাঝে মাঝে আমি নবীন পিতু এসে এখানে মেজদার সাথে আড্ডা মেরে বিড়ি খেয়ে যাই। পকেটের শেষ সিগারেটটা ওই মন্ডপে শেষ করে এসেছিলাম। আমি ঘরে ঢুকে এদিক ওদিকে খুজে একটা আধা পোড়া সিগারেট পেলাম আর সেটাকে জ্বালিয়ে ছাদে চলে এলাম। ছাদের কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে আয়েশ করে পোড়া সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দিলাম। মাথার ওপরে গাঢ় নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা, এদিক অদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের মাঝে হাজার হাজার তারায় আলোকিত আকাশের বুক।
পায়ের শব্দে চোখ তুলে দেখি শাড়ি ছেড়ে অনুর একটা মাক্সি পরে ছন্দা দাঁড়িয়ে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলাম।
একটানে আমার হাতের পোড়া সিগারেট ফেলে দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, "আর যদি এই সব টেনেছিস তাহলে কিন্তু চলে যাবো। শেষ পর্যন্ত কি না পোড়া বিড়ি?"
এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ে না, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে থাকলেও বেশি কথা বলে না, নতুন মানুষের সামনে একদম মুখে কুলুপ আঁটা। কিন্তু যদি কেউ আমাদের অইদিন রাতে দেখতো তাহলে বুঝতো যে ছন্দা আসলে কত কথা বলতে পারে। বিগত পাঁচদিনের কথা আর গল্প যেন আর ফুরায় না, ওর পুরানো দিনের গল্প ওর বাড়ির গল্প, যে ছেলে মেয়ে গুলোকে পড়ায় তাদের বাঁদরামোর কথা ওর ভাইয়ের কথা আরও কত নি। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেল, ওর ভাই, সত্যজিত ওর চেয়ে বছর দশেকের ছোট, পড়াশুনায় খুব ভালো, ভাইয়ের জন্মের এক বছরের মধ্যেই ওর বাবা গত হন। বাবা আগে এস এস কে এম হাসপাতালে কিছু একটা কাজ করতেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মা এস এস কে এম হাসপাতালে আয়ার চাকরি পায়, তারপরে নার্সিং পড়ে সেই হাসপাতালে নার্স হয়ে যান। কতক্ষণ ওই ভাবে দুইজনে গল্প করেছিলাম সে ঠিকানা নেই।
দূর থেকে শাঁখের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে কাল প্রারম্ভ শুরু হয়েছে আর একটু পরেই বোধন পুজো শুরু হবে। কিছু পরে চোখ ডলতে ডলতে অনু এসে আমাদের একটু বকাঝকা দিল।
ছন্দার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সারা রাত জেগে ওর চোখ দুটো তখন চকচক করছে আর একটু বসলে কি এমন হয়ে যেত। কিন্তু অনুর জন্য সেখানেই ক্ষান্ত হল আমাদের গল্প। ছন্দা চলে যাওয়ার পরে চিলেকোঠার ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে ভাবতে শুরু করলাম যে সব ঠিক কিন্তু বাড়িতে কি করে বলবো যে প্রেম করেছি আর ওই মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে চাই। যাক সে সব না হয় পরে ভাবা যাবে।
সেবার পুজোর সময়ে ছন্দা দুই দিন ছিলো অনুর বাড়িতে। একমাত্র সেই রাতে ছোট কাকিমা ছাড়া আর কেউ আমাদের একসাথে দেখেনি তাই অনু ছোট কাকিমাকে হাতে করে নিয়েছিলো। সর্বসমক্ষে ছন্দা অনুর বান্ধবী আমাদের কেউ নয় আমরা চিনিনা, সুতরাং না আমি না নবীন কেউ দিনের আলোতে ওর সাথে কথা বলতে পারতাম না। অবশ্য দিনের বেলায় অনেক কাজ থাকত আমাদের, পুজোর মন্ডপে বসা, খাওয়া দাওয়া তদারকি করা ইত্যাদি। আগে এই সব বিশ্বজিৎদা, আকাশদা অরা করত এখন আমাদের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে ফুলটুসির মতন সেজে গুজে দুইজনে এসে দেখা দিয়ে যেত কিন্তু দিনের আলোতে সেই পর্যন্ত দৌড় ছিলো। রাতের লোকজনের ভিড়ে একটু সময় পেতাম ওর সাথে গল্প করার আর সেই গল্প চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। অষ্টমীর দিনে সকালো বেলাতেই মধুছন্দা বাড়ি চলে গেল। নবীন বিশ্বজিৎদার বাইকে করে ওকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছিলো।
অষ্টমীর দিনে দেবুকে ডাকলাম, ওকে দেখে অনু এমন ভাব দেখালো যেন ওর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো সারা জীবন ধরে। ওদের কথার শুরু সেই একটা ঝগড়া দিয়েই, কেন দেবু নিজে থেকে বলতে পারেনি এতোদিন সেই নিয়ে ওদের কথা কাটাকাটি। আমি আর নবীন দেখলাম যে এবারে চার চোখ মিলে গেছে, আমে দুধে মিশে গেছে এবারে আঁঠির আর কি কাজ। ষষ্টির দিনে যেমন আমি অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে রাত কাটিয়েছিলাম তেমনি অষ্টমীর রাতে দেবু আর অনুকে নিয়ে আমার ছাদের ঘরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারা রাত কি করেছিলো জানি না তবে এইটুকু প্রত্যয় ছিলো যে অনু ওকে হাত ধরা ছাড়া বেশি কিছু করতে দেবে না। অনুর আমাদের বাড়িতে থাকা কোন ব্যাপার নয় তবে দেবুকে মাঝরাতে ঘরে ঢুকাতে হয়েছিলো আর সকালেই ওকে নবীনের বাড়িতে পাচার করে দিতে হয়েছিলো। আমি আর নবীন সারা রাত ধরে যাত্রা পালা দেখলাম। আমার বারেবারে শুধু মনে হয়েছিলো ইস যদি ছন্দা থাকতো আমার সাথে, তাহলে বেশ মজা হতো।
পুজো ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। দশমীতে মেয়েদের দেবী বরন, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিসর্জনের পালা। লরি করে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলো, সেদিন আর বাড়ি ফিরলাম না। সেদিন প্লাস্টিক কিনে সেই গিলে সবাই কুটির ঘাটে রাত কাটালাম। মাঝরাতে মেজদা মানে আকাশদার কি নাচ, সেদিন নবীন কে জোর করে মদ খাওয়ানো হলো। সবাই মিলে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম যে কবে প্রেম করবে, শালা মদে টোল হয়েও মুখ থেকে একটা কথাও বের করলো না।
বেশ কিছুদিন থেকে ছোড়দির জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিলো, আর ঠিক কালী পুজোর আগেই বাড়িতে বোমা ফাটালো ছোড়দি। ওর কথা শুনে সবার চক্ষু চড়ক গাছ, এমন কি আমি আর অনু তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বিশ্বজিৎদা আর ছোড়দি ডুবে ডুবে এত জল খেয়েছে। বাবার কাছে পড়তে এসে যে একদম ছোড়দিকে হাতিয়ে নেবে সেটা ঠিক কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলো না। যা হোক দুই বাড়ির যেমন আম দুধের সম্পর্ক, তাতে ওদের এই ভালোবাসা মেনে নিতে কারুর কষ্ট হল না।
বড় জামাইবাবু ডিভিসি তে ইঞ্জিনিয়ার, এবারে আরেক জামাই হল ডাক্তার। চাপ পড়ে গেল মেজভাই শুভদিপ আর ছোটভাই অনির্বাণের ওপরে। মেজ ভাই এতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আগে আমার ওপরে চাপ ছিলো ডাক্তার হও ডাক্তার হও। ঠাকুরদা বড় ডাক্তার ছিলেন, বাবা ডাক্তার আর এই বাড়িতে একজন ডাক্তার হবে না? তবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাওয়ার পরে আমার ওপরে সেই ক্ষোভ একটু কমে গিয়েছিলো।
অনু ছোড়দিকে বললো, "এই ছোড়দি, তোকে কিন্তু বৌদি বলে ডাকতে পারবো না, তোকে ছেদি বলে ডাকবো, চলবে ত?"
শুভ বললো, "এ কি রকম ব্যাপার? বউ কি হেঁটে হেঁটে স্বশুর বাড়ি যাবে নাকি?"
আমি বললাম, "তুই হাগতে আসিস এই বাড়িতে আর ছুঁচাতে যাস ওই বাড়িতে।"
মেজদা মানে আকাশদা বললো, বর যাত্রীর জন্য বাস ভাড়া করতে হবে, কিছু না হোক নৈহাটি মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসবে বাস চেপে। বরযাত্রী কারা হবে, দুই বাড়ির লোকই তো বর যাত্রী আবার কনে যাত্রী দুটোই।
এসব নিয়ে কি হাসাহাসি। বিয়ে ডিসেম্বরে কিন্তু দুই বাড়িতে সাজ সাজ রব পরে গেল। অনু বায়না ধরলো জামদানি দিতে হবে, তার কমে কিছু নয়। দুই বাড়িতে লোক সংখ্যা কম নয়, এক হাঁক পারলেই জনা চল্লিশ লোক জড় হয়ে যাবে শুধু দুই বাড়ি মিলিয়ে।
আমি ভাবলাম যে এই প্রেম ভালোবাসা নিয়ে যখন কারুর অমত নেই তাহলে আমাদের সময় বিশেষ কিছু অসুবিধে হবে না। ছন্দাকে সব খুলে বললাম, সব কথা শুনে ছন্দা হাঁফ ছেড়ে বললো, "তোর বাড়ি যা কড়া তাতে কখন কি হয় বলা একটু মুশকিল আছে। সময় হলে দেখা যাবে তবে বেশি দেরি করিস না যেন।"
আমি হেসে বললাম, "আরে না না, তুই অত চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোড়দির পরে আমার নাম্বার আর তোকে মিসেস চট্টোপাধ্যায় করতে বিশেষ দেরি হবে না।"
আমার কথা শুনে লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে সে আর বুঝে পেল না।
অনুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আমি অনুকে বললাম, "তোর সাথে একটু কথা আছে।"
অনু জিজ্ঞেস করলো, "কি কথা?"
আমি ওকে দেবুর ঘ্যানঘ্যানানির কথা, নবীনের সাবধান বাণী সব খুলে বললাম। সব কিছু শুনে অনু চুপ করে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না। তারপরে আমাকে বললো একবার নবীনকে ডেকে দিতে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠ্যালা মেরে বললো তাড়াতাড়ি যেতে আর নবীনকে ডেকে আনতে। আমি নবীন কে ডাকতে গেলাম, নবীন কে বললাম যে অনুকে দেবুর কথা বলেছি কিন্তু অনু একবার ওর সাথে দেখা করতে চায়। আমার কথা শুনে নবীন আমাকে জানিয়ে দিল যে যা বলার অনুকে সব যখন আমি বলেই দিয়েছি তাহলে ওর আর কিছু বলার নেই। আমি পড়লাম মহা মুশকিলে, এই দুইজনের মধ্যে আবার কি ফল্গু ধারা চলছে? যাই হোক পেছনে তাকিয়ে দেখি ছন্দা আর অনু দাঁড়িয়ে।
অনু হাজার প্রশ্ন মাখা চাহনি নিয়ে নবীনকে জিজ্ঞেস করলো, "তোর কি কিছু বলার আছে?"
মাটির দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, "পুটুর কাছ থেকে সবই তো শুনেছিস, আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?"
দুইজনে চুপ, ছন্দা আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে চুপ থাকতে বললো। আমি ওই দুজনার দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতন চেয়ে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অনু হেসে ওকে বললো, "তুই নাকি দেবু কে কেটে ফেলবি বলেছিস?"
সেই শুনে নবীন জবাবে বাঁকা হাসি দিল, "আমি চাই তুই ভালো থাক তাই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।"
বুক ভরে শ্বাস নিল অনু, তারপরে ছন্দার হাত ধরে বললো, "চল, বাড়ির দিকে চল।"
নবীন ওইখানে একা দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপরে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
বাড়ির পথে যেতে যেতে অনু, ছন্দাকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে আমাকে বললো, "তোদের দেখার পরে জীবনে একবারের জন্য প্রেম করতে বড় ইচ্ছে করছে।"
ছন্দা হেসে ওকে বললো, "তুই কি আর সত্যি আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলি? তোর নিজেরই ঠিক নেই দেবুকে হ্যাঁ বলবি না না বলবি।"
অনুকে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখিনি, কিন্তু ওইদিন মেয়েটা লাজুক হেসে আমাকে বললো, "আগেকার কথা ছেড়ে দে। দেবুর সাথে ঝগড়া করতাম এই কারনে কেননা ওর বুকে সেই পাটা নেই। বিয়ের পরে দেখলাম ওকে আমাকেই খাইয়ে দিতে হচ্ছে।"
কথায় গল্পে অনুর বাড়ি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে এলো। বাড়ি ঢুকতেই অনুর ছোট কাকিমা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো যে আমি রাতে থাকবো কি না। আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে রাতে এই বাড়িতেই থাকবো। ছোট কাকিমা একবার আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বললো যে আমি যেন এক তলার বসার ঘরের পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমি কিছু বললাম না, আমি কি এখানে ঘুমাতে এসেছি নাকি?
কাকিমা চলে যেতেই অনু আমাকে নিয়ে পা টিপে টিপে দুতলায় উঠে এলো। ওর ঘর দু'তলার বারান্দার একদম শেষে। অনু ছন্দাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল, আর আমাকে বললো ছাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে যেতে। আমি ওর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এত রাতে এখানে আমি ঘুমাতে আসিনি ওই দিকে ছন্দা মিচকি হেসে আমার দিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেনুনি দুলিয়ে চলে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ওই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম তারপরে চুপচাপ চারতলার চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলাম।
এই ঘরটায় কেউ শুতে আসে না, এই ঘরে বরাবর ছেলেদের আড্ডা জমে। বিশ্বজিৎদার বন্ধু, মেজদার বন্ধু, মাঝে মাঝে আমি নবীন পিতু এসে এখানে মেজদার সাথে আড্ডা মেরে বিড়ি খেয়ে যাই। পকেটের শেষ সিগারেটটা ওই মন্ডপে শেষ করে এসেছিলাম। আমি ঘরে ঢুকে এদিক ওদিকে খুজে একটা আধা পোড়া সিগারেট পেলাম আর সেটাকে জ্বালিয়ে ছাদে চলে এলাম। ছাদের কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে আয়েশ করে পোড়া সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দিলাম। মাথার ওপরে গাঢ় নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা, এদিক অদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের মাঝে হাজার হাজার তারায় আলোকিত আকাশের বুক।
পায়ের শব্দে চোখ তুলে দেখি শাড়ি ছেড়ে অনুর একটা মাক্সি পরে ছন্দা দাঁড়িয়ে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলাম।
একটানে আমার হাতের পোড়া সিগারেট ফেলে দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, "আর যদি এই সব টেনেছিস তাহলে কিন্তু চলে যাবো। শেষ পর্যন্ত কি না পোড়া বিড়ি?"
এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ে না, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে থাকলেও বেশি কথা বলে না, নতুন মানুষের সামনে একদম মুখে কুলুপ আঁটা। কিন্তু যদি কেউ আমাদের অইদিন রাতে দেখতো তাহলে বুঝতো যে ছন্দা আসলে কত কথা বলতে পারে। বিগত পাঁচদিনের কথা আর গল্প যেন আর ফুরায় না, ওর পুরানো দিনের গল্প ওর বাড়ির গল্প, যে ছেলে মেয়ে গুলোকে পড়ায় তাদের বাঁদরামোর কথা ওর ভাইয়ের কথা আরও কত নি। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেল, ওর ভাই, সত্যজিত ওর চেয়ে বছর দশেকের ছোট, পড়াশুনায় খুব ভালো, ভাইয়ের জন্মের এক বছরের মধ্যেই ওর বাবা গত হন। বাবা আগে এস এস কে এম হাসপাতালে কিছু একটা কাজ করতেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মা এস এস কে এম হাসপাতালে আয়ার চাকরি পায়, তারপরে নার্সিং পড়ে সেই হাসপাতালে নার্স হয়ে যান। কতক্ষণ ওই ভাবে দুইজনে গল্প করেছিলাম সে ঠিকানা নেই।
দূর থেকে শাঁখের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে কাল প্রারম্ভ শুরু হয়েছে আর একটু পরেই বোধন পুজো শুরু হবে। কিছু পরে চোখ ডলতে ডলতে অনু এসে আমাদের একটু বকাঝকা দিল।
ছন্দার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সারা রাত জেগে ওর চোখ দুটো তখন চকচক করছে আর একটু বসলে কি এমন হয়ে যেত। কিন্তু অনুর জন্য সেখানেই ক্ষান্ত হল আমাদের গল্প। ছন্দা চলে যাওয়ার পরে চিলেকোঠার ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে ভাবতে শুরু করলাম যে সব ঠিক কিন্তু বাড়িতে কি করে বলবো যে প্রেম করেছি আর ওই মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে চাই। যাক সে সব না হয় পরে ভাবা যাবে।
সেবার পুজোর সময়ে ছন্দা দুই দিন ছিলো অনুর বাড়িতে। একমাত্র সেই রাতে ছোট কাকিমা ছাড়া আর কেউ আমাদের একসাথে দেখেনি তাই অনু ছোট কাকিমাকে হাতে করে নিয়েছিলো। সর্বসমক্ষে ছন্দা অনুর বান্ধবী আমাদের কেউ নয় আমরা চিনিনা, সুতরাং না আমি না নবীন কেউ দিনের আলোতে ওর সাথে কথা বলতে পারতাম না। অবশ্য দিনের বেলায় অনেক কাজ থাকত আমাদের, পুজোর মন্ডপে বসা, খাওয়া দাওয়া তদারকি করা ইত্যাদি। আগে এই সব বিশ্বজিৎদা, আকাশদা অরা করত এখন আমাদের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে ফুলটুসির মতন সেজে গুজে দুইজনে এসে দেখা দিয়ে যেত কিন্তু দিনের আলোতে সেই পর্যন্ত দৌড় ছিলো। রাতের লোকজনের ভিড়ে একটু সময় পেতাম ওর সাথে গল্প করার আর সেই গল্প চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। অষ্টমীর দিনে সকালো বেলাতেই মধুছন্দা বাড়ি চলে গেল। নবীন বিশ্বজিৎদার বাইকে করে ওকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছিলো।
অষ্টমীর দিনে দেবুকে ডাকলাম, ওকে দেখে অনু এমন ভাব দেখালো যেন ওর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো সারা জীবন ধরে। ওদের কথার শুরু সেই একটা ঝগড়া দিয়েই, কেন দেবু নিজে থেকে বলতে পারেনি এতোদিন সেই নিয়ে ওদের কথা কাটাকাটি। আমি আর নবীন দেখলাম যে এবারে চার চোখ মিলে গেছে, আমে দুধে মিশে গেছে এবারে আঁঠির আর কি কাজ। ষষ্টির দিনে যেমন আমি অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে রাত কাটিয়েছিলাম তেমনি অষ্টমীর রাতে দেবু আর অনুকে নিয়ে আমার ছাদের ঘরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারা রাত কি করেছিলো জানি না তবে এইটুকু প্রত্যয় ছিলো যে অনু ওকে হাত ধরা ছাড়া বেশি কিছু করতে দেবে না। অনুর আমাদের বাড়িতে থাকা কোন ব্যাপার নয় তবে দেবুকে মাঝরাতে ঘরে ঢুকাতে হয়েছিলো আর সকালেই ওকে নবীনের বাড়িতে পাচার করে দিতে হয়েছিলো। আমি আর নবীন সারা রাত ধরে যাত্রা পালা দেখলাম। আমার বারেবারে শুধু মনে হয়েছিলো ইস যদি ছন্দা থাকতো আমার সাথে, তাহলে বেশ মজা হতো।
পুজো ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। দশমীতে মেয়েদের দেবী বরন, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিসর্জনের পালা। লরি করে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলো, সেদিন আর বাড়ি ফিরলাম না। সেদিন প্লাস্টিক কিনে সেই গিলে সবাই কুটির ঘাটে রাত কাটালাম। মাঝরাতে মেজদা মানে আকাশদার কি নাচ, সেদিন নবীন কে জোর করে মদ খাওয়ানো হলো। সবাই মিলে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম যে কবে প্রেম করবে, শালা মদে টোল হয়েও মুখ থেকে একটা কথাও বের করলো না।
বেশ কিছুদিন থেকে ছোড়দির জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিলো, আর ঠিক কালী পুজোর আগেই বাড়িতে বোমা ফাটালো ছোড়দি। ওর কথা শুনে সবার চক্ষু চড়ক গাছ, এমন কি আমি আর অনু তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বিশ্বজিৎদা আর ছোড়দি ডুবে ডুবে এত জল খেয়েছে। বাবার কাছে পড়তে এসে যে একদম ছোড়দিকে হাতিয়ে নেবে সেটা ঠিক কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলো না। যা হোক দুই বাড়ির যেমন আম দুধের সম্পর্ক, তাতে ওদের এই ভালোবাসা মেনে নিতে কারুর কষ্ট হল না।
বড় জামাইবাবু ডিভিসি তে ইঞ্জিনিয়ার, এবারে আরেক জামাই হল ডাক্তার। চাপ পড়ে গেল মেজভাই শুভদিপ আর ছোটভাই অনির্বাণের ওপরে। মেজ ভাই এতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আগে আমার ওপরে চাপ ছিলো ডাক্তার হও ডাক্তার হও। ঠাকুরদা বড় ডাক্তার ছিলেন, বাবা ডাক্তার আর এই বাড়িতে একজন ডাক্তার হবে না? তবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাওয়ার পরে আমার ওপরে সেই ক্ষোভ একটু কমে গিয়েছিলো।
অনু ছোড়দিকে বললো, "এই ছোড়দি, তোকে কিন্তু বৌদি বলে ডাকতে পারবো না, তোকে ছেদি বলে ডাকবো, চলবে ত?"
শুভ বললো, "এ কি রকম ব্যাপার? বউ কি হেঁটে হেঁটে স্বশুর বাড়ি যাবে নাকি?"
আমি বললাম, "তুই হাগতে আসিস এই বাড়িতে আর ছুঁচাতে যাস ওই বাড়িতে।"
মেজদা মানে আকাশদা বললো, বর যাত্রীর জন্য বাস ভাড়া করতে হবে, কিছু না হোক নৈহাটি মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসবে বাস চেপে। বরযাত্রী কারা হবে, দুই বাড়ির লোকই তো বর যাত্রী আবার কনে যাত্রী দুটোই।
এসব নিয়ে কি হাসাহাসি। বিয়ে ডিসেম্বরে কিন্তু দুই বাড়িতে সাজ সাজ রব পরে গেল। অনু বায়না ধরলো জামদানি দিতে হবে, তার কমে কিছু নয়। দুই বাড়িতে লোক সংখ্যা কম নয়, এক হাঁক পারলেই জনা চল্লিশ লোক জড় হয়ে যাবে শুধু দুই বাড়ি মিলিয়ে।
আমি ভাবলাম যে এই প্রেম ভালোবাসা নিয়ে যখন কারুর অমত নেই তাহলে আমাদের সময় বিশেষ কিছু অসুবিধে হবে না। ছন্দাকে সব খুলে বললাম, সব কথা শুনে ছন্দা হাঁফ ছেড়ে বললো, "তোর বাড়ি যা কড়া তাতে কখন কি হয় বলা একটু মুশকিল আছে। সময় হলে দেখা যাবে তবে বেশি দেরি করিস না যেন।"
আমি হেসে বললাম, "আরে না না, তুই অত চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোড়দির পরে আমার নাম্বার আর তোকে মিসেস চট্টোপাধ্যায় করতে বিশেষ দেরি হবে না।"
আমার কথা শুনে লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে সে আর বুঝে পেল না।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!