07-07-2020, 12:02 PM
২য় খন্ড
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৫)
সকালে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অনুর প্রশ্ন, "কি ব্যাপার, সব ঠিকঠাক? রাতে ঘুম হয়েছে?"
না, সেই রাতে আমার দুই চোখে ঘুম আসেনি, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়েছিলাম। আমার সারা গায়ে যেন মধু মধু গন্ধ মিশে ছিলো। ডান কাঁধে যেখানে হাত রেখে সারা রাস্তা এসেছিলো মনে হচ্ছিল এখন পর্যন্ত সেইখানে ওই কাঁধে চাঁপার কলি আঙ্গুল রাখা।
দিন যায় আর ভোরের ফুটন্ত শিউলির মতন ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে কবে দুইজনে বেশ মিশে গেলাম সেটার ঠিক নেই। সবার চোখের আড়াল হলেও অনু ঠিক বুঝেছিলো আমাদের দুইজনের মাঝের ওই অদৃশ্য বন্ধন। সর্ব সমক্ষে চোখে চোখ রেখে কথা বার্তা বলতে সাহস পেত না মধুছন্দা তবে ওই কলেজের মধ্যে একটু দেখা একটু কথা বলা অথবা বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে একটু গল্প করা পর্যন্ত আমাদের সময় সীমা সীমিত ছিলো। কোনোদিন যদি বলতাম আজকে একটু দেরি করে বাড়ি গেলে হয় না? হেসে জবাবে বলতো বাসে চেপে বাড়ি পর্যন্ত যেতে। আর তার ফলে যাদবপুর থেকে বেহালা বাসে চেপে যাওয়া আর গল্প করা। কিছু একটা অছিলায় অনুকে ক্ষান্ত করতে হতো, কিন্তু ওর শ্যেন নজর এড়ান বড় মুশকিল। কিছুতেই সময় করে মধুছন্দাকে একা পাওয়া যায় না, অনু না হয় শ্যামলী না হয় বনানী কেউ না কেউ ওর সাথে সবসময়ে থাকে। কলেজ শেষ হলেই সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বুঝি এই বয়সে মাথায় অনেক চিন্তা আর সেই কারনে ওকে কোনোদিন জোর করার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি।
দেখতে দেখতে কাছে এসে গেল বিশ্বকর্মা পুজো। আমিও ছোড়দির পার্স ঝেড়ে কুড়ি টাকা জমিয়ে ফেললাম, এবারে একান্তে কোথাও একটা যেতেই হবে ওকে নিয়ে।
কলেজের পরে মধুছন্দাকে এক দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, "বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে বেড়াতে যাবি?"
প্রশ্ন করলো রমণী, "কে কে যাবে?"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, আমি কিনা ওকে নিয়ে একা কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই, ওদিকে মধুছন্দা সবাইকে নিয়ে যেতে চায়। বার কয়েক ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, "শুধু আমি আর তুই।"
চশমার আড়াল থেকে বড় বড় কাজল টানা চোখে আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে বললো, "মোটেই নয়। অনু, দেবাশিস, পরাশর সবাইকে ডেকে নিলেই হয় সবাই বেশ মজা করতে করতে যাবো। সবাই যদি যায় তাহলে যেতে রাজি আছি।"
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, "এ কিরে সবাই কেন?"
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিচকি হেসে বললো, "ওই যে বলেছিলাম না, একটা বাঁদর কে ভরসা করা বড় দুস্কর সেই কারনে।"
আমি মাথা চুলকে বললাম, "একা অনু যেতে পারে অন্য কেউ নয়।"
মুখ খানি লাল করে হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "থাক আর ওই বেচারাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?" কাছে এসে বাজুর ওপরে চিমটি কেটে বললো, "সবার কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কিছু করার মতলব নেই তো তোর?"
খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে ওইখানে জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলি, লুকিয়ে রাখবো বুকের মধ্যে কারন তুই অমূল্য। ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, "অনেক দূরে কোথাও যাবো, তবে এখন ঠিক করিনি কোথায়।"
ওর চোখ দুটো ভাসা ভাসা হয়ে উঠলো পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বললো, "তুই থাকবি পাশে তাহলে যেতে রাজি।"
সেদিন ওকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত সারা রাস্তা একদম চুপচাপ। ওর বাড়ির বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সন্ধে তারার সাথে সাথে একে একে রাস্তার বিজলী বাতি জ্বলে উঠলো। সময়টা যদি দাঁড়িয়ে যেত সেদিন তাহলে বড় ভালো হত।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করলো, "শাড়ি পরবো না সালোয়ার কামিজ?"
আমি একটু ওর দিকে ঝুঁকে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ও পেছনে সরে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাকে ভেসে এলো ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ সেই গন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে বললাম, "কাপড়ে কি আসে যায় তুই যা পরবি তাতেই সুন্দরী দেখাবি।"
হাত বাড়ালাম ওর হাতের দিকে কিন্তু এপাস অপাস দেখে হাত টেনে মিষ্টি হেসে বললো, "আজ আসি, পরশু তাহলে ন'টায় এস্প্লানেড ট্রাম ডিপোর সামনে দেখা হচ্ছে।"
দুইদিন পরে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বাড়িতে বললাম যে বন্ধুদের সাথে মায়াপুর ঘুরতে যাচ্ছি। জেঠিমা জিজ্ঞেস করেছিলো যে অনু নবীন যাচ্ছে কি না। আমি বলেছিলাম যে না ওরা যাচ্ছে না তবে অন্যরা যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে সেটা জানিয়ে দিলাম। অনু আর নবীন জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে। ঠিক ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটা নাগাদ এস্প্লানেড বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেলাম। জানি আধা ঘন্টা আগেই পৌঁছেছি তাও মন মানে না, একটু কি তাড়াতাড়ি আসতে পারে না? এই ভেবে ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
ঠিক তখন কাঁধে হাত পড়লো, "সেই চারমিনার? আমার সাথে থাকলে ওই চারমিনার ছাড়তে হবে। ওর গন্ধ মোটেই আমার ভালো লাগে না বলে দিচ্ছি।"
পেছন ঘুরে দেখি মধুছন্দা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে সেই সাথে কপালে ছোট সবুজ রঙের টিপ আঁকা। আমি দাঁড়িয়ে থ বনে গেলাম।
আমার থ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জায় পড়ে গেল, "কি হলো? সব ঠিকঠাক না কিছু বলবি?"
আমতা আমতা করে আধা পোড়া সিগারেটে শেষ টান মেরে বললাম, " মানে চল।"
আমার বাঁ পাশ ঘেঁসে রাস্তা পার হয়ে হাঁটার সময়ে চাঁপার কলি নরম আঙ্গুলে ছোঁয়া লাগলো। সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি ধাঁ করে সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আচমকা ট্যাক্সি এসে যাওয়াতে আমি ওর হাত ধরে আমার পেছনে করে দিলাম আর ও আমার জামা খামচে ধরলো ভয়ে।
দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাক্সির মুন্ডপাত করতে করতে বললো, "এই পাঞ্জাবী ট্যাক্সিওয়ালা গুলোকে না মারতে ইচ্ছে করে।"
আমি ওকে শান্ত করে বললাম, "ছাড় ওই ট্যাক্সিকে। বল এখন কোথায় যাবি?"
হাত উলটে উত্তর দিল, "আমি কি জানি কোথায় যাবো, তুই কোথায় নিয়ে যাবি?"
বাস স্টান্ডে সবুজ রঙের সারি সারি সরকারি দূরপাল্লার বাস দাঁড়িয়ে। এদিক অদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে বেশ খানিক্ষন ভেবে বললাম, "গঙ্গা অনেক দেখলাম, এবারে ইচ্ছামতি দেখলে কেমন হয়?"
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এখানে ইচ্ছামতি নদী কোথায়?"
উত্তর দিলাম, "বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে হাসনাবাদ, যাবি?"
ক্ষণিকের জন্য মধুছন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, গাঢ় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, "না, ইছামতী নদী দেখার কোন শখ নেই আমার। তুই যদি অন্য কোথাও নিয়ে যাস তাহলে যেতে রাজি না হলে আমি বাড়ি চললাম।"
ওর সুন্দর মুখের হঠাৎ পরিবর্তনের কারন ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু দুই ফর্সা কান লাল হয়ে উঠলো সেই সাথে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠলো। আমি এই টুকু বুঝলাম যে ওই ইছামতী নদীর সাথে ওর পুরানো কোন ব্যাথা জড়িয়ে। আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না।
বললাম, "আরে না না একবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছি এখুনি বাড়ি ফিরলে মুশকিল হয়ে যাবে। তোর যখন ইচ্ছে নেই তাহলে মায়াপুর নবদ্বীপ ঘুরে আসি।"
চুপচাপ আমার পেছন পেছন বাসে উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে দিল, কিন্তু মধুছন্দা মুখ নিচু করে জানালার পাশে বসে রইলো। দুই চোখ ছলছল দেখে আমার বুকের ব্যাথা শত গুন বেড়ে গেল।
কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে তোর, হঠাৎ এমন থম মেরে গেলি যে?"
কালো মেঘের ছায়া সরিয়ে মিষ্টি হেসে জবাব দিল, "কই কিছু না, কিছুই হয়নি।"
বাস ততক্ষণে মধ্যমগ্রাম ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে। জানালা থেকে মিষ্টি রোদে ওর সারা মুখ ভিজে গেল, এক অনাবিল স্বাধীনতার আনন্দে চিকচিক করে উঠলো ওর চোখ দুটো।
আমার পাশ ঘেঁসে বসে মিহি কণ্ঠে বললো, "এতদিন পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজকে খুব ভালো লাগছে।"
আমি ওকে বললাম, "তোকে একা পাওয়া খুব দুষ্কর সবসময়ে কেউ না কেউ তোর চারপাশে মাছির মতন লেগে থাকে।"
উত্তর এলো, "কার কথা বলছিস, অনু?"
আমি বললাম, "ওর কথা ছাড় দিকি।"
বারে বারে এক গুচ্ছ চুল ওর মুখের ওপরে এসে দোল খেয়ে যাচ্ছিল আর সেই দুষ্টু চুলের গোছাকে সামলে মিচকি হেসে উত্তর দিল, "ওর নাক কিন্তু বড় কঠিন কিসে না কিসে গন্ধ শুঁকে ঠিক বের করে নেবে যে আমরা মায়াপুর গেছিলাম।"
আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলাম, "অনু জানলে কি কোন অসুবিধে আছে?"
নিজের আঙ্গুল গুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বললো, "না সে নেই, তবে....."
আমার ভেতরে অট্টহাসির কলরব ফেটে পড়ার জোগাড়, জানি অনুকে একদিন জানাতেই হবে না জানালে আমাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে সেটা বলা কঠিন। বাবা জ্যাঠা কাকার সামনে কোন ভাই বোনের আওয়াজ শোনা যায় না, ওদিকে মা কাকিমার সামনে প্রায় এক রকম অবস্থা। একমাত্র যদি জেঠিমাকে হাতে করা যায় আর সেটা সম্ভব ছোড়দি আর অনুকে দিয়েই হবে।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৫)
সকালে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অনুর প্রশ্ন, "কি ব্যাপার, সব ঠিকঠাক? রাতে ঘুম হয়েছে?"
না, সেই রাতে আমার দুই চোখে ঘুম আসেনি, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়েছিলাম। আমার সারা গায়ে যেন মধু মধু গন্ধ মিশে ছিলো। ডান কাঁধে যেখানে হাত রেখে সারা রাস্তা এসেছিলো মনে হচ্ছিল এখন পর্যন্ত সেইখানে ওই কাঁধে চাঁপার কলি আঙ্গুল রাখা।
দিন যায় আর ভোরের ফুটন্ত শিউলির মতন ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে কবে দুইজনে বেশ মিশে গেলাম সেটার ঠিক নেই। সবার চোখের আড়াল হলেও অনু ঠিক বুঝেছিলো আমাদের দুইজনের মাঝের ওই অদৃশ্য বন্ধন। সর্ব সমক্ষে চোখে চোখ রেখে কথা বার্তা বলতে সাহস পেত না মধুছন্দা তবে ওই কলেজের মধ্যে একটু দেখা একটু কথা বলা অথবা বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে একটু গল্প করা পর্যন্ত আমাদের সময় সীমা সীমিত ছিলো। কোনোদিন যদি বলতাম আজকে একটু দেরি করে বাড়ি গেলে হয় না? হেসে জবাবে বলতো বাসে চেপে বাড়ি পর্যন্ত যেতে। আর তার ফলে যাদবপুর থেকে বেহালা বাসে চেপে যাওয়া আর গল্প করা। কিছু একটা অছিলায় অনুকে ক্ষান্ত করতে হতো, কিন্তু ওর শ্যেন নজর এড়ান বড় মুশকিল। কিছুতেই সময় করে মধুছন্দাকে একা পাওয়া যায় না, অনু না হয় শ্যামলী না হয় বনানী কেউ না কেউ ওর সাথে সবসময়ে থাকে। কলেজ শেষ হলেই সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বুঝি এই বয়সে মাথায় অনেক চিন্তা আর সেই কারনে ওকে কোনোদিন জোর করার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি।
দেখতে দেখতে কাছে এসে গেল বিশ্বকর্মা পুজো। আমিও ছোড়দির পার্স ঝেড়ে কুড়ি টাকা জমিয়ে ফেললাম, এবারে একান্তে কোথাও একটা যেতেই হবে ওকে নিয়ে।
কলেজের পরে মধুছন্দাকে এক দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, "বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে বেড়াতে যাবি?"
প্রশ্ন করলো রমণী, "কে কে যাবে?"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, আমি কিনা ওকে নিয়ে একা কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই, ওদিকে মধুছন্দা সবাইকে নিয়ে যেতে চায়। বার কয়েক ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, "শুধু আমি আর তুই।"
চশমার আড়াল থেকে বড় বড় কাজল টানা চোখে আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে বললো, "মোটেই নয়। অনু, দেবাশিস, পরাশর সবাইকে ডেকে নিলেই হয় সবাই বেশ মজা করতে করতে যাবো। সবাই যদি যায় তাহলে যেতে রাজি আছি।"
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, "এ কিরে সবাই কেন?"
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিচকি হেসে বললো, "ওই যে বলেছিলাম না, একটা বাঁদর কে ভরসা করা বড় দুস্কর সেই কারনে।"
আমি মাথা চুলকে বললাম, "একা অনু যেতে পারে অন্য কেউ নয়।"
মুখ খানি লাল করে হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "থাক আর ওই বেচারাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?" কাছে এসে বাজুর ওপরে চিমটি কেটে বললো, "সবার কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কিছু করার মতলব নেই তো তোর?"
খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে ওইখানে জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলি, লুকিয়ে রাখবো বুকের মধ্যে কারন তুই অমূল্য। ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, "অনেক দূরে কোথাও যাবো, তবে এখন ঠিক করিনি কোথায়।"
ওর চোখ দুটো ভাসা ভাসা হয়ে উঠলো পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বললো, "তুই থাকবি পাশে তাহলে যেতে রাজি।"
সেদিন ওকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত সারা রাস্তা একদম চুপচাপ। ওর বাড়ির বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সন্ধে তারার সাথে সাথে একে একে রাস্তার বিজলী বাতি জ্বলে উঠলো। সময়টা যদি দাঁড়িয়ে যেত সেদিন তাহলে বড় ভালো হত।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করলো, "শাড়ি পরবো না সালোয়ার কামিজ?"
আমি একটু ওর দিকে ঝুঁকে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ও পেছনে সরে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাকে ভেসে এলো ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ সেই গন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে বললাম, "কাপড়ে কি আসে যায় তুই যা পরবি তাতেই সুন্দরী দেখাবি।"
হাত বাড়ালাম ওর হাতের দিকে কিন্তু এপাস অপাস দেখে হাত টেনে মিষ্টি হেসে বললো, "আজ আসি, পরশু তাহলে ন'টায় এস্প্লানেড ট্রাম ডিপোর সামনে দেখা হচ্ছে।"
দুইদিন পরে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বাড়িতে বললাম যে বন্ধুদের সাথে মায়াপুর ঘুরতে যাচ্ছি। জেঠিমা জিজ্ঞেস করেছিলো যে অনু নবীন যাচ্ছে কি না। আমি বলেছিলাম যে না ওরা যাচ্ছে না তবে অন্যরা যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে সেটা জানিয়ে দিলাম। অনু আর নবীন জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে। ঠিক ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটা নাগাদ এস্প্লানেড বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেলাম। জানি আধা ঘন্টা আগেই পৌঁছেছি তাও মন মানে না, একটু কি তাড়াতাড়ি আসতে পারে না? এই ভেবে ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
ঠিক তখন কাঁধে হাত পড়লো, "সেই চারমিনার? আমার সাথে থাকলে ওই চারমিনার ছাড়তে হবে। ওর গন্ধ মোটেই আমার ভালো লাগে না বলে দিচ্ছি।"
পেছন ঘুরে দেখি মধুছন্দা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে সেই সাথে কপালে ছোট সবুজ রঙের টিপ আঁকা। আমি দাঁড়িয়ে থ বনে গেলাম।
আমার থ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জায় পড়ে গেল, "কি হলো? সব ঠিকঠাক না কিছু বলবি?"
আমতা আমতা করে আধা পোড়া সিগারেটে শেষ টান মেরে বললাম, " মানে চল।"
আমার বাঁ পাশ ঘেঁসে রাস্তা পার হয়ে হাঁটার সময়ে চাঁপার কলি নরম আঙ্গুলে ছোঁয়া লাগলো। সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি ধাঁ করে সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আচমকা ট্যাক্সি এসে যাওয়াতে আমি ওর হাত ধরে আমার পেছনে করে দিলাম আর ও আমার জামা খামচে ধরলো ভয়ে।
দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাক্সির মুন্ডপাত করতে করতে বললো, "এই পাঞ্জাবী ট্যাক্সিওয়ালা গুলোকে না মারতে ইচ্ছে করে।"
আমি ওকে শান্ত করে বললাম, "ছাড় ওই ট্যাক্সিকে। বল এখন কোথায় যাবি?"
হাত উলটে উত্তর দিল, "আমি কি জানি কোথায় যাবো, তুই কোথায় নিয়ে যাবি?"
বাস স্টান্ডে সবুজ রঙের সারি সারি সরকারি দূরপাল্লার বাস দাঁড়িয়ে। এদিক অদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে বেশ খানিক্ষন ভেবে বললাম, "গঙ্গা অনেক দেখলাম, এবারে ইচ্ছামতি দেখলে কেমন হয়?"
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এখানে ইচ্ছামতি নদী কোথায়?"
উত্তর দিলাম, "বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে হাসনাবাদ, যাবি?"
ক্ষণিকের জন্য মধুছন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, গাঢ় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, "না, ইছামতী নদী দেখার কোন শখ নেই আমার। তুই যদি অন্য কোথাও নিয়ে যাস তাহলে যেতে রাজি না হলে আমি বাড়ি চললাম।"
ওর সুন্দর মুখের হঠাৎ পরিবর্তনের কারন ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু দুই ফর্সা কান লাল হয়ে উঠলো সেই সাথে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠলো। আমি এই টুকু বুঝলাম যে ওই ইছামতী নদীর সাথে ওর পুরানো কোন ব্যাথা জড়িয়ে। আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না।
বললাম, "আরে না না একবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছি এখুনি বাড়ি ফিরলে মুশকিল হয়ে যাবে। তোর যখন ইচ্ছে নেই তাহলে মায়াপুর নবদ্বীপ ঘুরে আসি।"
চুপচাপ আমার পেছন পেছন বাসে উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে দিল, কিন্তু মধুছন্দা মুখ নিচু করে জানালার পাশে বসে রইলো। দুই চোখ ছলছল দেখে আমার বুকের ব্যাথা শত গুন বেড়ে গেল।
কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে তোর, হঠাৎ এমন থম মেরে গেলি যে?"
কালো মেঘের ছায়া সরিয়ে মিষ্টি হেসে জবাব দিল, "কই কিছু না, কিছুই হয়নি।"
বাস ততক্ষণে মধ্যমগ্রাম ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে। জানালা থেকে মিষ্টি রোদে ওর সারা মুখ ভিজে গেল, এক অনাবিল স্বাধীনতার আনন্দে চিকচিক করে উঠলো ওর চোখ দুটো।
আমার পাশ ঘেঁসে বসে মিহি কণ্ঠে বললো, "এতদিন পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজকে খুব ভালো লাগছে।"
আমি ওকে বললাম, "তোকে একা পাওয়া খুব দুষ্কর সবসময়ে কেউ না কেউ তোর চারপাশে মাছির মতন লেগে থাকে।"
উত্তর এলো, "কার কথা বলছিস, অনু?"
আমি বললাম, "ওর কথা ছাড় দিকি।"
বারে বারে এক গুচ্ছ চুল ওর মুখের ওপরে এসে দোল খেয়ে যাচ্ছিল আর সেই দুষ্টু চুলের গোছাকে সামলে মিচকি হেসে উত্তর দিল, "ওর নাক কিন্তু বড় কঠিন কিসে না কিসে গন্ধ শুঁকে ঠিক বের করে নেবে যে আমরা মায়াপুর গেছিলাম।"
আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলাম, "অনু জানলে কি কোন অসুবিধে আছে?"
নিজের আঙ্গুল গুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বললো, "না সে নেই, তবে....."
আমার ভেতরে অট্টহাসির কলরব ফেটে পড়ার জোগাড়, জানি অনুকে একদিন জানাতেই হবে না জানালে আমাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে সেটা বলা কঠিন। বাবা জ্যাঠা কাকার সামনে কোন ভাই বোনের আওয়াজ শোনা যায় না, ওদিকে মা কাকিমার সামনে প্রায় এক রকম অবস্থা। একমাত্র যদি জেঠিমাকে হাতে করা যায় আর সেটা সম্ভব ছোড়দি আর অনুকে দিয়েই হবে।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!