06-07-2020, 07:31 PM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৪)
আমি বেশ কিছুক্ষন ওইখানে দাঁড়িয়ে মধুছন্দার অপরূপ মাধুর্য দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে গলা খাঁকড়ে জানান দিলাম যে সারথি প্রস্তুত। আমার চোখের রক্তিম আভা দেখেই মনে হয় মধুছন্দা বুঝতে পেরে গেছিলো যে আমি ওইখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করে গেছি। আমার গলার আওয়াজ শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসে শাড়ি ঠিক করে নিল সেই সাথে অনু নিজের বেশভূষা ঠিক করে নিল।
অনু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, "কি রে কখন এলি?"
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, "এই তো, এক্ষুনি এলাম।"
অনু আমাকে নিচে বসতে বললো আর বললো যে কিছুখনের মধ্যে মধুছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি কাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে আর সেই পূণ্য কর্মের জনেই আমার প্রত্যাবর্তন। নিচের বসার ঘরে বসে কাকিমার হাতের চা খেতে খেতে উৎকণ্ঠায় শুধু ঘড়ির দিকে দেখি, কখন যে মধুছন্দা বের হবে আর খালি রাস্তা দিয়ে আমরা দুইজনে বাইকে করে যাবো। দিদিদের নিয়ে বাইকে যাওয়া অথবা অনুকে নিয়ে বাইকে যাওয়া আলাদা কথা, সেই প্রথম সত্যিকারের কোন বান্ধবীকে বাইকে বসিয়ে যাওয়া ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার যোগাড়।
নিচে নেমেও যেন ওদের গল্প আর শেষ হয় না, কিছু বলতেও পারছি না শুধু মাত্র আড় চোখে দুইজনের দিকে মাঝে মাঝে তাকাই। পাঁচ মিনিট করতে করতে প্রায় আধা ঘন্টা পরে অনু মধুছন্দাকে ছাড়ল। বাইকের পেছনে বেশ আড়ষ্ট হয়ে একটু তফাৎ রেখে বসল। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে অনু আমাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে তবে ছাড়লো। আমাকে ইশারায় জানিয়ে দিল যে এর ঘুষ দিতে হবে। আমিও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম যে দিতে প্রস্তুত আমি।
গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত বেশ আস্তে আস্তে চালালাম, ইট পাতা রাস্তা বাইক নিয়ে চলা একটু মুশকিল। তাও বেশ সামলে চলতে হল কারন পেছনে যে বসে তাকে বেশি ঘাঁটানো যাবে না পাছে কি ভাবতে কি ভেবে বসে। বড় রাস্তায় বাইক চড়াতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। সিট ধরে বসে থাকা হাত খানি আমার ডান কাঁধে উঠে এল। খোঁপা খুলে এলো চুল আমার ঘাড়ের ওপরে এসে দোল খেতে লাগলো।
কিছু মনে হয় বললো, কারন আমার কাঁধের ওপরে থাবা বেশ জোড়ালো হয়ে গেল। গাড়ি একটু ধীরে করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ফিসফিস জড়ানো কণ্ঠে আমাকে একটু ধীরে চালাতে অনুরোধ করলো। আমার যেমন এই প্রথম কোন বান্ধবীকে নিয়ে বাইকে চাপা তেমনি মধুছন্দার সেই প্রথম কারুর সাথে বাইকে চাপা। দুইজনের মধ্যেই কেমন একটা আড়ষ্টভাব প্রতি নিয়ত ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠলাম।
কানে ভেসে এল দূর থেকে এক নারীর কণ্ঠস্বর, "তুই কি এর পরেও পড়াশুনা করবি না চাকরি করবি?"
ঠিক শুনতে পারিনি ওর কথা তাই জিজ্ঞেস করলাম, "কি বলছিস?"
মধুছন্দা জিজ্ঞেস করলো, "তুই কি এম টেক করবি না এর পরে চাকরি করবি?"
উত্তরে বললাম, "না রে এখুনি চাকরি করার কোন মতলব নেই আমার। বি টেক করার পরে এম টেক, পি এইচ ডি রিসার্চ যা আছে সব করব আর বাড়ির অন্ন ধ্বংস করব। বাবা জেঠার এত পয়সা খাবে কে? তুই কি করবি?"
মিহি কণ্ঠে উত্তর এলো, "না রে, এই ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যন্ত আমার দৌড় এর পরে আমাকে চাকরি করতে হবে। মা অনেক কষ্টে এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর টাকা যোগাড় করেছে। এর পরে বাড়ির দায়িত্ত, ছোট ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ত আমাকেই সামলাতে হবে। দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, বাড়িতে টাকা দেয় না।"
বুঝতে পারলাম যে মধুছন্দার বাবা গত হয়েছেন, কণ্ঠে একটা না বলা অব্যক্ত বেদনা ফুটে উঠলো ওর, বেশ কিছু দূর দুইজনেই চুপচাপ থাকলাম।
গাড়ির গোঁগোঁ আওয়াজ বড় একঘেয়ে লাগছিলো তাই আবার আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "পুজোতে আমাদের এখানে আসবি? আমাদের এখানে যাত্রা নাটক হয়"
উদাসিন কণ্ঠের উত্তর, "জানি না রে। ভাবছিলাম মামাবাড়ি যাবো, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।"
প্রশ্ন করলাম, "তোর মামাবাড়ি কোথায়?"
উত্তর এলো, "জলপাইগুড়ি।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুই নাটক যাত্রা পালা এই সব দেখিস?"
উত্তরে জানালো, "নাহ সেই সময় কোথায় আমার। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে একগাদা টিউশন থাকে নিজের পড়াশুনা থাকে এই সবে সময় চলে যায়।২
প্রশ্ন করলাম, "আজকে টিউশন ছিলো না?"
উত্তর এলো, "তোর আর অনুর টানাটানিতে আজকে আর হল না, শনিবার ওদের পড়িয়ে দেব খানে।"
সেই সময়ে মেয়েদের সামনে গোঁফে তা দিয়ে সিগারেট খাওয়া খুব বড় ব্যাপার। মনের এক কোনে সেই অভিপ্রায় জেগে উঠলো তাই বাইক দাঁড় করালাম একটা পানের দোকানের সামনে। বাইক থামাতেই মধুছন্দা কারন জিজ্ঞেস করলো, আমি জানালাম যে একটা সিগারেট ধরাবো। পকেটে দুটি চারমিনার পরে আছে একটা বের করে ধরাতে যাবো তখন মধুছন্দা আমাকে চারমিনার খেতে বারন করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি হল, তুই ও কি আমাকে সিগারেট খেতে দিবি না?"
হেসে জবাব দিল, "আমি না বললে তুই শুনবি না, তবে ওই সাদা কাগজে মোড়া বিড়ি ধরাস না, ওর গন্ধ বড় বিটকেল। এই নে এক টাকা, অন্য কোন সিগারেট নিয়ে আয়।"
আমার চক্ষু চড়ক গাছ, "তুই আমাকে সিগারেট খাবার পয়সা দিবি!"
হেসে জবাব দিল, "জানি জানি তোদের বরাদ্দ বাবদ কত হাত খরচ। আজকে পার্স ঝেড়ে পাঁচ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়েছিস, তোর পকেটে কোন পয়সা নেই সেটা জানা আছে।"
অনু আর ছোড়দি আমার ব্যাঙ্ক কিন্তু সেই কথাও যে অনু ওকে বলে দেবে সেটা ভাবিনি। আমি মনে মনে অনুর মুন্ডপাত করলাম কিন্তু ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিগারেট খাব সেটা ঠিক মনে ধরলো না। তাই ওই চারমিনার ধরালাম।
ওর একটু অভিমান হলো আর অভিমানিনী কণ্ঠে আমাকে বললো, "অনুর কাছ থেকে টাকা নিতে তোর বাধে না, তাহলে আমার কাছ থেকে কেন বাধে?"
কি করে ওকে বুঝাই, অনুসুয়া আর ওর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু আমার বান্ধবী, আমার দিদি, আমার বোন আমার অনেক কিছু, আর মধুছন্দা এখন পর্যন্ত ঠিক কোন পর্যায় এসেছে সেটার ঠিক নেই।
আমি হেসে জবাব দিলাম, "আজকে ট্যাক্সিতে তোর টাকাও গেছে, কালো তোর পয়সায় আমাকে সিগারেট খাওয়াস।"
উত্তরে বললো, "না অনু আমাকে পয়সা দিতে দেয়নি।" ঘড়ির দিকে দেখে আমাকে বললো, "এবারে একটু তাড়াতাড়ি চল, বাড়িতে মা একা চিন্তা করবে।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "মাসিমাকে ফোন করে দিয়েছিস তাহলে এত চিন্তা কেন?"
আমার মাথার পেছনে আলতো চাঁটি মেরে জবাব দিল, "তাই বলে কি এই কোলকাতার রাস্তায় তোর সাথে রাত কাটাবো?"
আমি ওকে হেসে বললাম, "এবারে বুঝলি তোর আর অনুর মধ্যের তফাৎ। আমি নবীন অনু যদি কোথাও এক রাত কাটিয়ে আসি অথবা এক বিছানায় শুয়ে থাকি তাহলেও ঘুম ছাড়া গল্প ছাড়া কিছু হবার নেই অথবা কেউ আমাদের দিকে আঙ্গুল পর্যন্ত তুলবে না।"
আমি বাইকে বসে পড়লাম, এবারে আগের সেই জড়তা ভাব কাটিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বসল। ওই চাঁপার কলি আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্ত প্রবাহ শত গুন বেরে গেল। বাইক চালিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে গান বেজে উঠলো।
আমি ওকে বললাম, "মামাবাড়ি না গেলে চলে আসিস আমাদের এখানে। অনু তো থাকবেই, তোর কোন অসুবিধে হবে না।"
মৃদু হেসে উত্তর দিল, "হ্যাঁ অনু থাকবে, ভয় তো আর ওকে নিয়ে নয়। ভয় অতি অচেনা একটা বাঁদরকে নিয়ে। হঠাৎ করে যদি আমাকে খামচে দেয় তাহলে কি হবে?"
এই মস্করার একটা যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আর হচ্ছে না। আমি ওকে বললাম, "বাঁদর কে খোঁচালে তবেই বাঁদর কামড়ায়, হঠাৎ করে কোন জড় বস্তুর ওপরে বাঁদর আচমকা হামলা করতে যাবে কেন?"
খোঁচাটা বেশ হয়েছে তাই খিল খিল করে হেসে বলে, "কে বলেছে আমি জড় বস্তু?"
আমি উত্তরে বললাম, "কলেজে তো সাত চড়ে রা করিস না।"
উত্তরে বললো, "আমি ওই রকম বেশি কথা বললে বাচাল বলে মনে হয়। তাই নিয়ে মামাবাড়িতে আমাকে সবাই নাক উঁচু বলে ভাবে। কিন্তু কি করার আছে বল?"
এর উত্তরে কিছু বলার নেই আমার। বেহালা, শখেরবাজার চলে এল, বড় রাস্তায় নামিয়ে দিতে হল ওকে বাড়ির সামনে যদি বাইক থেকে নামে তাহলে আবার পাড়ার কেউ দেখে ফেলতে পারে আর সেই নিয়ে কথা শোনা। আমিও বেশি জোর করলাম না ওকে। যাই হোক দুইজনের মধ্যের জড়তা একটু কেটেছে, আষাঢ়ের মেঘ কেটে শরতের পরশ লেগেছে। চলে যাবার আগে বেশ কিছুক্ষণ আমার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। কিছু শোনার অপেক্ষায় না কিছু বলার অপেক্ষায়?
আমি তাও আগ বাড়িয়ে বললাম, "এই টুকু ছেড়ে দিলে হতো না? রাত নটা বাজে একা একা যেতে পারবি তো?"
মিষ্টি হেসে জবাবে বললো, "এই টুকু যাবার ক্ষমতা আছে। এই সময়ে তোর সাথে বাড়ির সামনে নামলে অনেকের ভুরু কুঁচকাতে পারে। আর হ্যাঁ, কালোকে ইনরগ্যানিকের নোটস দিস তো।"
"ঠিক আছে" বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ না সাপের মতন বেনুনি দুলিয়ে ওই গলির বাঁকে হারিয়ে গেল মধুছন্দা।
১ম খন্ড সমাপ্ত
আমি বেশ কিছুক্ষন ওইখানে দাঁড়িয়ে মধুছন্দার অপরূপ মাধুর্য দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে গলা খাঁকড়ে জানান দিলাম যে সারথি প্রস্তুত। আমার চোখের রক্তিম আভা দেখেই মনে হয় মধুছন্দা বুঝতে পেরে গেছিলো যে আমি ওইখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করে গেছি। আমার গলার আওয়াজ শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসে শাড়ি ঠিক করে নিল সেই সাথে অনু নিজের বেশভূষা ঠিক করে নিল।
অনু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, "কি রে কখন এলি?"
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, "এই তো, এক্ষুনি এলাম।"
অনু আমাকে নিচে বসতে বললো আর বললো যে কিছুখনের মধ্যে মধুছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি কাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে আর সেই পূণ্য কর্মের জনেই আমার প্রত্যাবর্তন। নিচের বসার ঘরে বসে কাকিমার হাতের চা খেতে খেতে উৎকণ্ঠায় শুধু ঘড়ির দিকে দেখি, কখন যে মধুছন্দা বের হবে আর খালি রাস্তা দিয়ে আমরা দুইজনে বাইকে করে যাবো। দিদিদের নিয়ে বাইকে যাওয়া অথবা অনুকে নিয়ে বাইকে যাওয়া আলাদা কথা, সেই প্রথম সত্যিকারের কোন বান্ধবীকে বাইকে বসিয়ে যাওয়া ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার যোগাড়।
নিচে নেমেও যেন ওদের গল্প আর শেষ হয় না, কিছু বলতেও পারছি না শুধু মাত্র আড় চোখে দুইজনের দিকে মাঝে মাঝে তাকাই। পাঁচ মিনিট করতে করতে প্রায় আধা ঘন্টা পরে অনু মধুছন্দাকে ছাড়ল। বাইকের পেছনে বেশ আড়ষ্ট হয়ে একটু তফাৎ রেখে বসল। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে অনু আমাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে তবে ছাড়লো। আমাকে ইশারায় জানিয়ে দিল যে এর ঘুষ দিতে হবে। আমিও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম যে দিতে প্রস্তুত আমি।
গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত বেশ আস্তে আস্তে চালালাম, ইট পাতা রাস্তা বাইক নিয়ে চলা একটু মুশকিল। তাও বেশ সামলে চলতে হল কারন পেছনে যে বসে তাকে বেশি ঘাঁটানো যাবে না পাছে কি ভাবতে কি ভেবে বসে। বড় রাস্তায় বাইক চড়াতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। সিট ধরে বসে থাকা হাত খানি আমার ডান কাঁধে উঠে এল। খোঁপা খুলে এলো চুল আমার ঘাড়ের ওপরে এসে দোল খেতে লাগলো।
কিছু মনে হয় বললো, কারন আমার কাঁধের ওপরে থাবা বেশ জোড়ালো হয়ে গেল। গাড়ি একটু ধীরে করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ফিসফিস জড়ানো কণ্ঠে আমাকে একটু ধীরে চালাতে অনুরোধ করলো। আমার যেমন এই প্রথম কোন বান্ধবীকে নিয়ে বাইকে চাপা তেমনি মধুছন্দার সেই প্রথম কারুর সাথে বাইকে চাপা। দুইজনের মধ্যেই কেমন একটা আড়ষ্টভাব প্রতি নিয়ত ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠলাম।
কানে ভেসে এল দূর থেকে এক নারীর কণ্ঠস্বর, "তুই কি এর পরেও পড়াশুনা করবি না চাকরি করবি?"
ঠিক শুনতে পারিনি ওর কথা তাই জিজ্ঞেস করলাম, "কি বলছিস?"
মধুছন্দা জিজ্ঞেস করলো, "তুই কি এম টেক করবি না এর পরে চাকরি করবি?"
উত্তরে বললাম, "না রে এখুনি চাকরি করার কোন মতলব নেই আমার। বি টেক করার পরে এম টেক, পি এইচ ডি রিসার্চ যা আছে সব করব আর বাড়ির অন্ন ধ্বংস করব। বাবা জেঠার এত পয়সা খাবে কে? তুই কি করবি?"
মিহি কণ্ঠে উত্তর এলো, "না রে, এই ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যন্ত আমার দৌড় এর পরে আমাকে চাকরি করতে হবে। মা অনেক কষ্টে এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর টাকা যোগাড় করেছে। এর পরে বাড়ির দায়িত্ত, ছোট ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ত আমাকেই সামলাতে হবে। দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, বাড়িতে টাকা দেয় না।"
বুঝতে পারলাম যে মধুছন্দার বাবা গত হয়েছেন, কণ্ঠে একটা না বলা অব্যক্ত বেদনা ফুটে উঠলো ওর, বেশ কিছু দূর দুইজনেই চুপচাপ থাকলাম।
গাড়ির গোঁগোঁ আওয়াজ বড় একঘেয়ে লাগছিলো তাই আবার আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "পুজোতে আমাদের এখানে আসবি? আমাদের এখানে যাত্রা নাটক হয়"
উদাসিন কণ্ঠের উত্তর, "জানি না রে। ভাবছিলাম মামাবাড়ি যাবো, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।"
প্রশ্ন করলাম, "তোর মামাবাড়ি কোথায়?"
উত্তর এলো, "জলপাইগুড়ি।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুই নাটক যাত্রা পালা এই সব দেখিস?"
উত্তরে জানালো, "নাহ সেই সময় কোথায় আমার। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে একগাদা টিউশন থাকে নিজের পড়াশুনা থাকে এই সবে সময় চলে যায়।২
প্রশ্ন করলাম, "আজকে টিউশন ছিলো না?"
উত্তর এলো, "তোর আর অনুর টানাটানিতে আজকে আর হল না, শনিবার ওদের পড়িয়ে দেব খানে।"
সেই সময়ে মেয়েদের সামনে গোঁফে তা দিয়ে সিগারেট খাওয়া খুব বড় ব্যাপার। মনের এক কোনে সেই অভিপ্রায় জেগে উঠলো তাই বাইক দাঁড় করালাম একটা পানের দোকানের সামনে। বাইক থামাতেই মধুছন্দা কারন জিজ্ঞেস করলো, আমি জানালাম যে একটা সিগারেট ধরাবো। পকেটে দুটি চারমিনার পরে আছে একটা বের করে ধরাতে যাবো তখন মধুছন্দা আমাকে চারমিনার খেতে বারন করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি হল, তুই ও কি আমাকে সিগারেট খেতে দিবি না?"
হেসে জবাব দিল, "আমি না বললে তুই শুনবি না, তবে ওই সাদা কাগজে মোড়া বিড়ি ধরাস না, ওর গন্ধ বড় বিটকেল। এই নে এক টাকা, অন্য কোন সিগারেট নিয়ে আয়।"
আমার চক্ষু চড়ক গাছ, "তুই আমাকে সিগারেট খাবার পয়সা দিবি!"
হেসে জবাব দিল, "জানি জানি তোদের বরাদ্দ বাবদ কত হাত খরচ। আজকে পার্স ঝেড়ে পাঁচ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়েছিস, তোর পকেটে কোন পয়সা নেই সেটা জানা আছে।"
অনু আর ছোড়দি আমার ব্যাঙ্ক কিন্তু সেই কথাও যে অনু ওকে বলে দেবে সেটা ভাবিনি। আমি মনে মনে অনুর মুন্ডপাত করলাম কিন্তু ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিগারেট খাব সেটা ঠিক মনে ধরলো না। তাই ওই চারমিনার ধরালাম।
ওর একটু অভিমান হলো আর অভিমানিনী কণ্ঠে আমাকে বললো, "অনুর কাছ থেকে টাকা নিতে তোর বাধে না, তাহলে আমার কাছ থেকে কেন বাধে?"
কি করে ওকে বুঝাই, অনুসুয়া আর ওর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু আমার বান্ধবী, আমার দিদি, আমার বোন আমার অনেক কিছু, আর মধুছন্দা এখন পর্যন্ত ঠিক কোন পর্যায় এসেছে সেটার ঠিক নেই।
আমি হেসে জবাব দিলাম, "আজকে ট্যাক্সিতে তোর টাকাও গেছে, কালো তোর পয়সায় আমাকে সিগারেট খাওয়াস।"
উত্তরে বললো, "না অনু আমাকে পয়সা দিতে দেয়নি।" ঘড়ির দিকে দেখে আমাকে বললো, "এবারে একটু তাড়াতাড়ি চল, বাড়িতে মা একা চিন্তা করবে।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "মাসিমাকে ফোন করে দিয়েছিস তাহলে এত চিন্তা কেন?"
আমার মাথার পেছনে আলতো চাঁটি মেরে জবাব দিল, "তাই বলে কি এই কোলকাতার রাস্তায় তোর সাথে রাত কাটাবো?"
আমি ওকে হেসে বললাম, "এবারে বুঝলি তোর আর অনুর মধ্যের তফাৎ। আমি নবীন অনু যদি কোথাও এক রাত কাটিয়ে আসি অথবা এক বিছানায় শুয়ে থাকি তাহলেও ঘুম ছাড়া গল্প ছাড়া কিছু হবার নেই অথবা কেউ আমাদের দিকে আঙ্গুল পর্যন্ত তুলবে না।"
আমি বাইকে বসে পড়লাম, এবারে আগের সেই জড়তা ভাব কাটিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বসল। ওই চাঁপার কলি আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্ত প্রবাহ শত গুন বেরে গেল। বাইক চালিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে গান বেজে উঠলো।
আমি ওকে বললাম, "মামাবাড়ি না গেলে চলে আসিস আমাদের এখানে। অনু তো থাকবেই, তোর কোন অসুবিধে হবে না।"
মৃদু হেসে উত্তর দিল, "হ্যাঁ অনু থাকবে, ভয় তো আর ওকে নিয়ে নয়। ভয় অতি অচেনা একটা বাঁদরকে নিয়ে। হঠাৎ করে যদি আমাকে খামচে দেয় তাহলে কি হবে?"
এই মস্করার একটা যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আর হচ্ছে না। আমি ওকে বললাম, "বাঁদর কে খোঁচালে তবেই বাঁদর কামড়ায়, হঠাৎ করে কোন জড় বস্তুর ওপরে বাঁদর আচমকা হামলা করতে যাবে কেন?"
খোঁচাটা বেশ হয়েছে তাই খিল খিল করে হেসে বলে, "কে বলেছে আমি জড় বস্তু?"
আমি উত্তরে বললাম, "কলেজে তো সাত চড়ে রা করিস না।"
উত্তরে বললো, "আমি ওই রকম বেশি কথা বললে বাচাল বলে মনে হয়। তাই নিয়ে মামাবাড়িতে আমাকে সবাই নাক উঁচু বলে ভাবে। কিন্তু কি করার আছে বল?"
এর উত্তরে কিছু বলার নেই আমার। বেহালা, শখেরবাজার চলে এল, বড় রাস্তায় নামিয়ে দিতে হল ওকে বাড়ির সামনে যদি বাইক থেকে নামে তাহলে আবার পাড়ার কেউ দেখে ফেলতে পারে আর সেই নিয়ে কথা শোনা। আমিও বেশি জোর করলাম না ওকে। যাই হোক দুইজনের মধ্যের জড়তা একটু কেটেছে, আষাঢ়ের মেঘ কেটে শরতের পরশ লেগেছে। চলে যাবার আগে বেশ কিছুক্ষণ আমার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। কিছু শোনার অপেক্ষায় না কিছু বলার অপেক্ষায়?
আমি তাও আগ বাড়িয়ে বললাম, "এই টুকু ছেড়ে দিলে হতো না? রাত নটা বাজে একা একা যেতে পারবি তো?"
মিষ্টি হেসে জবাবে বললো, "এই টুকু যাবার ক্ষমতা আছে। এই সময়ে তোর সাথে বাড়ির সামনে নামলে অনেকের ভুরু কুঁচকাতে পারে। আর হ্যাঁ, কালোকে ইনরগ্যানিকের নোটস দিস তো।"
"ঠিক আছে" বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ না সাপের মতন বেনুনি দুলিয়ে ওই গলির বাঁকে হারিয়ে গেল মধুছন্দা।
১ম খন্ড সমাপ্ত
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!