06-07-2020, 09:49 AM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৩)
সেই সময়ে হাত খরচ বাবদ প্রতিদিনের বরাদ্দ ছিলো পাঁচ থেকে সাত টাকা। যদিও অনুসুয়ার বাড়িতে আর আমাদের বাড়িতে দুটো করে গাড়ি কিন্তু সেই গাড়ি আমাদের জন্যে নয়। ট্যাক্সি চাপার বাহুল্য আমাদের কপালে ছিলো না তাই বাসে চেপে যাওয়া হল কফি হাউসে। আমি বারেবারে আড় চোখে মধুছন্দার দিকে তাকাই। চশমার আড়ালে ওই দুই উজ্জ্বল চোখের থেকে চোখ ফেরানো বড় কঠিন। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনে পুজো তাই আকাশ বেশ পরিষ্কার আর সেই মৃদু রোদে ওর ত্বক যেন আর শত গুন ঝকমক করছে। মাঝে মাঝেই ওর চোখের সাথে আমার চোখ মিলে যেত আর ভুরু কুঁচকে মৃদু এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত আমার দিকে, "কি দেখছিস ওই ভাবে?"না, কোন উত্তর নেই আমার কাছে। কি করে বলি ওই দুই উজ্জ্বল চোখের হাতছানিতে ভেসে যাওয়ার কথা।
পুজোর গল্পে, গরমের ছুটিতে আমরা সবাই মিলে দেরাদুন মুসৌরি ঘুরতে গেছিলাম সেই গল্পে, কলেজের প্রফেসারদের মুন্ডপাত করা এই সবে কখন যে দুই ঘন্টা কেটে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দুই ঘন্টা টানা আড্ডা মেরে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পচা আর দেবু বাসে চেপে চলে গেল, ওদের বাড়ি বেলুড়। শ্যামলী সেই সময়ে থেকেই লুকিয়ে প্রেম করতো মেকানিকালের ফাইনাল ইয়ারের ঋতুরাজের সাথে। একটু পরে যথারীতি ঋতুরাজের বাইকে চেপে বাড়ি উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল শ্যামলী। আমার আর নবীনের বাড়ি ফেরার বিশেষ ইচ্ছে ছিলো না, ভেবেছিলাম হাওড়া ব্রিজের তলায় বসে একটু গাঁজার কলকেতে টান দেব। অনুসুয়াকে বললাম যে আমাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।
সেদিন আবার অনুসুয়ার মনে বান্ধবী প্রীতি জেগে ওঠে আর মধুছন্দাকে নিজের বাড়ি ডাকে। মধুছন্দার বাড়ি বেহালা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। প্রথমে বেশ ইতস্তত করে মধুছন্দা, সন্ধ্যে হলে কি করে বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে বলা নেই, মা চিন্তা করবে ইত্যাদি। অনুসুয়া ওকে বুঝিয়ে বলে যে বাড়ি গিয়ে ওর বাড়িতে একটা ফোন করে দিতে তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেই শুনলাম যে মধুছন্দা অনুর সাথে যাবে অমনি আমার কলকে সেবনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল। একসাথে এক বাসে যাওয়া যাবে সেই ভেবেই যেন মন নেচে উঠলো। নবীনকে বলে কয়ে রাজি করালাম যে গাঁজা অন্য দিনে টানা যাবে। অনুসুয়া আমার মনের অভিপ্রায় ধরে ফেলেছিলো আর তাই হেসে বললো চলে আসতে।
বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চারজনে, বারেবারে চার চোখ এক হলেই চোরা হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে মধুছন্দা। অনুসুয়া বললো যে অনেকক্ষণ ধরে আমরা দাঁড়িয়ে, একটা ট্যাক্সি করে গেলেই ভালো হয়। মধুছন্দার সাথে এক ট্যাক্সিতে যাবো, আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। নবীন মাথা চুলকে জমানো দশ টাকা বের করে দিল, সেই সাথে আমিও পাঁচটাকা বের করলাম। চারজনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে পঁচিশ কি ত্রিশ টাকা জমা হল। যথারীতি ট্যাক্সিতে চাপা হল, পেছনের সিটে অনুসুয়া, মধুছন্দা আর নবীন। আমি ইচ্ছে করেই আর পেছনের সিটে বসিনি, কিঞ্চিত দ্বিধায় কিঞ্চিত কাষ্ঠতায়। কফি হাউসে বসে যেমন আমাদের দুইজনের মধ্যে সরাসরি কোন কথাবার্তা হয়নি তেমনি ট্যাক্সিতেও হল না। মাঝে মধ্যে অনুসুয়ার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ, না বলি।
যেতে যেতে মধুছন্দা অনুকে প্রশ্ন করে, "তোদের বাড়ির মধ্যে তোদের এই মেলামেশা নিয়ে কোন অসুবিধে নেই?"
অনু হেসে জবাব দেয়, "কি যে বলিস না তুই। আমাদের তিন বাড়ির মধ্যে অন্য এক যোগসুত্র আছে, নবীনের কাকিমা আমার ছোট মাসি হয়। আমার দাদা ডাক্তার, পুটুর বাবার ছাত্র। সেই ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি তিন জনে। একসাথে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে ওঠা বসা। পুটুর বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়া থেকে সেনেদের বাড়ির আম গাছ থেকে আম চুরি করে খাওয়া, সব একসাথে করেছি। শীত কালে ওর জেঠিমা ছাদের ওপরে আচার বানিয়ে রাখত আমি আর ওর ছোড়দি মিলে অর্ধেক আচার উড়িয়ে দিতাম।"
কলেজের কেউ জানতো না যে আমার বাড়ির নাম পুটু, সুতরাং মধুছন্দার প্রশ্ন, "এই পুটু কে?"
অনু আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, "পার্থর বাড়ির নাম পুটু, আবার কলেজে গিয়ে ঢাক পিটিয়ে দিস নে যেন।"
মধুছন্দা আমার দিকের পেছনে বসেছিলো, সামনে একটু ঝুঁকতেই ওর গায়ের গন্ধে কেমন যেন মাতাল হয়ে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "তোকে দেখে তো বোঝা যায় না যে তুই এত বাঁদর ছেলে?"
আমি হেসে জবাবে বললাম, "তুই মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিস না তাই জানতে পারিস নি।"
অনুসুয়ার হাত খানি হাতের মধ্যে নিয়ে লাজুক হেসে জবাব দেয়, "কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আর তোদের মধ্যে থাকলে স্বস্তি পাই তাই।"
অনুসুয়া ওকে বলে, “"এক কাজ করিস এইবারে, পুজোতে আমাদের এখানে চলে আসিস। এখানেই খাওয়া দাওয়া সবকিছু। সব থেকে বড় ব্যাপার, অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা এবারে মন্টু গুপ্ত আসতে পারে।"
মন্টু গুপ্তের কথা ঠিক কানে পৌঁছাল না মধুছন্দার, ওর মাথায় বাড়ি ফেরার চিন্তা ভর করে আসে। তাই অনুকে জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে আমি বাড়ি কি করে যাবো?"
অনু উত্তর দেয়, "সে নিয়ে তোর এতো চিন্তা করতে হবে না। নবীন না হয় পুটু তোকে দাদার বাইকে করে ছেড়ে আসবে।"
নবীনকে একটা গুঁতো মেরে অনু জিজ্ঞেস করে, "তোর মনে হয় সময় হবে না তাই তো? বাড়ি ফিরে তো টিউশানি করার আছে।"
বুঝলাম ইচ্ছে করেই অনুসুয়া আমার পথ পরিস্কার করে দিল, যাতে সন্ধ্যেবেলায় মধুছন্দাকে নিয়ে বাইকে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। বড় রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। অনু আর মধুছন্দা মিষ্টির দোকান থেকে বাঁক নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একবারের জন্য আমার মনে হল যেন মধুছন্দার ঠিক ইচ্ছে নেই অনুর বাড়ি যাওয়ার, থমকে গিয়ে কি আমার দিকে পেছন ঘুরে তাকিয়েছিলো না আমার চোখের ভুল?
অনু আমাকে বললো, "এই, তুই সাতটা নাগাদ চলে আসিস ততক্ষণে দাদা বাড়ি ফিরে আসবে।"
আহ্লাদে আটখানা কি করে মানুষে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। বাড়ি ফিরে সময় যেন আর কাটে না। আমার ঘর তিনতলায়, খাটে শুয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বিকেলের কথা, ট্যাক্সিতে আসার কথা আর সাতটা কখন বাজবে সেই চিন্তায় ডুবে গেলাম। এর মাঝে বার দুই ছোট বোন এসে ডাক দিয়ে গেল, কারুর কথার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারুর কথাই মাথায় সেদিন আর ঢোকেনি। মাথায় শুধুমাত্র একটাই চিন্তা কখন সাতটা বাজবে আর আমি একদৌড়ে সোজা অনুর বাড়িতে যাবো। ঘড়ির কাটা পৌনে সাতটা ছুঁতে পারেনি কি জামা গলিয়ে জেঠিমাকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। মা কাকিমার হাতের সামনে পড়লে শত প্রশ্ন আমাদের সাত ভাই বোনেদের একমাত্র সম্বল জেঠিমা। জেঠিমা নিজে কলেজের গন্ডি পার হয়নি সেই একটা দুঃখ ছিলো তাই মা'কে আর কাকিমার পড়াশুনা করাতে ছাড়ায়নি। মা একটা মেয়েদের কলেজের হেডমিস্ট্রেস আর কাকিমা কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার। বাড়িতে দুই শিক্ষিকা থাকলে যা হয় বাড়িটাও কয়েদ খানার মতন মনে হয় তবে ওই জেঠিমার জন্য কয়েদখানা থেকে সব ভাই বোনেরা রেহাই পেয়ে যেতাম।
যাবার আগে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন, "বেশি রাত করিস নে, যেন তাহলে কিন্তু সামলাতে পারবো না।"
আমি বললাম, "আরে না না, বেশি রাত করবো না। তাড়াতাড়িই চলে আসবো।"
এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে অনুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির উঠানে মোটর সাইকেল দেখে বুঝতে পারলাম যে বিশ্বজিৎদা বাড়িতে আছে, তার মানে মধুছন্দাকে নিয়ে অনায়াসে বাইকে চেপে কালিন্দি থেকে বেহালা পাড়ি দেওয়া যাবে। মনের মধ্যে যেন উত্তম সুচিত্রার "এই পথ যদি না শেষ হয়....." বেজে উঠলো।
অনুর বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার তাই সোজা ওর ঘরে যেতে কোন অসুবিধে হলো না। পর্দা সরিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখালাম দুই বান্ধবী বিছানার ওপরে আধাশোয়া হয়ে গল্পে মশগুল।
মধুছন্দার পিঠ দরজার দিকে, উপুড় হয়ে বুকের নিচে একটা বালিশ দিয়ে শুয়ে। হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করার ফলে শাড়ির পাড় গুটিয়ে হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। ফর্সা পায়ের মসৃণ গুলি দেখে বুকের রক্তে হিল্লোল লেগে গেল। ক্ষুধার্ত বাঘের মতন লোলুপ দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইলাম ওই মসৃণ পায়ের গুলির দিকে। পাতলা শাড়ির পরতে ঢাকা নধর দেহ পল্লব যেন ঢেউ খেলে বিছানার ওপরে মেলে রয়েছে জল থেকে সদ্য ওঠা কোন এক অচিনপুরের জলপরী।
সেই সময়ে হাত খরচ বাবদ প্রতিদিনের বরাদ্দ ছিলো পাঁচ থেকে সাত টাকা। যদিও অনুসুয়ার বাড়িতে আর আমাদের বাড়িতে দুটো করে গাড়ি কিন্তু সেই গাড়ি আমাদের জন্যে নয়। ট্যাক্সি চাপার বাহুল্য আমাদের কপালে ছিলো না তাই বাসে চেপে যাওয়া হল কফি হাউসে। আমি বারেবারে আড় চোখে মধুছন্দার দিকে তাকাই। চশমার আড়ালে ওই দুই উজ্জ্বল চোখের থেকে চোখ ফেরানো বড় কঠিন। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনে পুজো তাই আকাশ বেশ পরিষ্কার আর সেই মৃদু রোদে ওর ত্বক যেন আর শত গুন ঝকমক করছে। মাঝে মাঝেই ওর চোখের সাথে আমার চোখ মিলে যেত আর ভুরু কুঁচকে মৃদু এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত আমার দিকে, "কি দেখছিস ওই ভাবে?"না, কোন উত্তর নেই আমার কাছে। কি করে বলি ওই দুই উজ্জ্বল চোখের হাতছানিতে ভেসে যাওয়ার কথা।
পুজোর গল্পে, গরমের ছুটিতে আমরা সবাই মিলে দেরাদুন মুসৌরি ঘুরতে গেছিলাম সেই গল্পে, কলেজের প্রফেসারদের মুন্ডপাত করা এই সবে কখন যে দুই ঘন্টা কেটে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দুই ঘন্টা টানা আড্ডা মেরে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পচা আর দেবু বাসে চেপে চলে গেল, ওদের বাড়ি বেলুড়। শ্যামলী সেই সময়ে থেকেই লুকিয়ে প্রেম করতো মেকানিকালের ফাইনাল ইয়ারের ঋতুরাজের সাথে। একটু পরে যথারীতি ঋতুরাজের বাইকে চেপে বাড়ি উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল শ্যামলী। আমার আর নবীনের বাড়ি ফেরার বিশেষ ইচ্ছে ছিলো না, ভেবেছিলাম হাওড়া ব্রিজের তলায় বসে একটু গাঁজার কলকেতে টান দেব। অনুসুয়াকে বললাম যে আমাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।
সেদিন আবার অনুসুয়ার মনে বান্ধবী প্রীতি জেগে ওঠে আর মধুছন্দাকে নিজের বাড়ি ডাকে। মধুছন্দার বাড়ি বেহালা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। প্রথমে বেশ ইতস্তত করে মধুছন্দা, সন্ধ্যে হলে কি করে বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে বলা নেই, মা চিন্তা করবে ইত্যাদি। অনুসুয়া ওকে বুঝিয়ে বলে যে বাড়ি গিয়ে ওর বাড়িতে একটা ফোন করে দিতে তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেই শুনলাম যে মধুছন্দা অনুর সাথে যাবে অমনি আমার কলকে সেবনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল। একসাথে এক বাসে যাওয়া যাবে সেই ভেবেই যেন মন নেচে উঠলো। নবীনকে বলে কয়ে রাজি করালাম যে গাঁজা অন্য দিনে টানা যাবে। অনুসুয়া আমার মনের অভিপ্রায় ধরে ফেলেছিলো আর তাই হেসে বললো চলে আসতে।
বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চারজনে, বারেবারে চার চোখ এক হলেই চোরা হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে মধুছন্দা। অনুসুয়া বললো যে অনেকক্ষণ ধরে আমরা দাঁড়িয়ে, একটা ট্যাক্সি করে গেলেই ভালো হয়। মধুছন্দার সাথে এক ট্যাক্সিতে যাবো, আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। নবীন মাথা চুলকে জমানো দশ টাকা বের করে দিল, সেই সাথে আমিও পাঁচটাকা বের করলাম। চারজনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে পঁচিশ কি ত্রিশ টাকা জমা হল। যথারীতি ট্যাক্সিতে চাপা হল, পেছনের সিটে অনুসুয়া, মধুছন্দা আর নবীন। আমি ইচ্ছে করেই আর পেছনের সিটে বসিনি, কিঞ্চিত দ্বিধায় কিঞ্চিত কাষ্ঠতায়। কফি হাউসে বসে যেমন আমাদের দুইজনের মধ্যে সরাসরি কোন কথাবার্তা হয়নি তেমনি ট্যাক্সিতেও হল না। মাঝে মধ্যে অনুসুয়ার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ, না বলি।
যেতে যেতে মধুছন্দা অনুকে প্রশ্ন করে, "তোদের বাড়ির মধ্যে তোদের এই মেলামেশা নিয়ে কোন অসুবিধে নেই?"
অনু হেসে জবাব দেয়, "কি যে বলিস না তুই। আমাদের তিন বাড়ির মধ্যে অন্য এক যোগসুত্র আছে, নবীনের কাকিমা আমার ছোট মাসি হয়। আমার দাদা ডাক্তার, পুটুর বাবার ছাত্র। সেই ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি তিন জনে। একসাথে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে ওঠা বসা। পুটুর বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়া থেকে সেনেদের বাড়ির আম গাছ থেকে আম চুরি করে খাওয়া, সব একসাথে করেছি। শীত কালে ওর জেঠিমা ছাদের ওপরে আচার বানিয়ে রাখত আমি আর ওর ছোড়দি মিলে অর্ধেক আচার উড়িয়ে দিতাম।"
কলেজের কেউ জানতো না যে আমার বাড়ির নাম পুটু, সুতরাং মধুছন্দার প্রশ্ন, "এই পুটু কে?"
অনু আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, "পার্থর বাড়ির নাম পুটু, আবার কলেজে গিয়ে ঢাক পিটিয়ে দিস নে যেন।"
মধুছন্দা আমার দিকের পেছনে বসেছিলো, সামনে একটু ঝুঁকতেই ওর গায়ের গন্ধে কেমন যেন মাতাল হয়ে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "তোকে দেখে তো বোঝা যায় না যে তুই এত বাঁদর ছেলে?"
আমি হেসে জবাবে বললাম, "তুই মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিস না তাই জানতে পারিস নি।"
অনুসুয়ার হাত খানি হাতের মধ্যে নিয়ে লাজুক হেসে জবাব দেয়, "কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আর তোদের মধ্যে থাকলে স্বস্তি পাই তাই।"
অনুসুয়া ওকে বলে, “"এক কাজ করিস এইবারে, পুজোতে আমাদের এখানে চলে আসিস। এখানেই খাওয়া দাওয়া সবকিছু। সব থেকে বড় ব্যাপার, অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা এবারে মন্টু গুপ্ত আসতে পারে।"
মন্টু গুপ্তের কথা ঠিক কানে পৌঁছাল না মধুছন্দার, ওর মাথায় বাড়ি ফেরার চিন্তা ভর করে আসে। তাই অনুকে জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে আমি বাড়ি কি করে যাবো?"
অনু উত্তর দেয়, "সে নিয়ে তোর এতো চিন্তা করতে হবে না। নবীন না হয় পুটু তোকে দাদার বাইকে করে ছেড়ে আসবে।"
নবীনকে একটা গুঁতো মেরে অনু জিজ্ঞেস করে, "তোর মনে হয় সময় হবে না তাই তো? বাড়ি ফিরে তো টিউশানি করার আছে।"
বুঝলাম ইচ্ছে করেই অনুসুয়া আমার পথ পরিস্কার করে দিল, যাতে সন্ধ্যেবেলায় মধুছন্দাকে নিয়ে বাইকে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। বড় রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। অনু আর মধুছন্দা মিষ্টির দোকান থেকে বাঁক নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একবারের জন্য আমার মনে হল যেন মধুছন্দার ঠিক ইচ্ছে নেই অনুর বাড়ি যাওয়ার, থমকে গিয়ে কি আমার দিকে পেছন ঘুরে তাকিয়েছিলো না আমার চোখের ভুল?
অনু আমাকে বললো, "এই, তুই সাতটা নাগাদ চলে আসিস ততক্ষণে দাদা বাড়ি ফিরে আসবে।"
আহ্লাদে আটখানা কি করে মানুষে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। বাড়ি ফিরে সময় যেন আর কাটে না। আমার ঘর তিনতলায়, খাটে শুয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বিকেলের কথা, ট্যাক্সিতে আসার কথা আর সাতটা কখন বাজবে সেই চিন্তায় ডুবে গেলাম। এর মাঝে বার দুই ছোট বোন এসে ডাক দিয়ে গেল, কারুর কথার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারুর কথাই মাথায় সেদিন আর ঢোকেনি। মাথায় শুধুমাত্র একটাই চিন্তা কখন সাতটা বাজবে আর আমি একদৌড়ে সোজা অনুর বাড়িতে যাবো। ঘড়ির কাটা পৌনে সাতটা ছুঁতে পারেনি কি জামা গলিয়ে জেঠিমাকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। মা কাকিমার হাতের সামনে পড়লে শত প্রশ্ন আমাদের সাত ভাই বোনেদের একমাত্র সম্বল জেঠিমা। জেঠিমা নিজে কলেজের গন্ডি পার হয়নি সেই একটা দুঃখ ছিলো তাই মা'কে আর কাকিমার পড়াশুনা করাতে ছাড়ায়নি। মা একটা মেয়েদের কলেজের হেডমিস্ট্রেস আর কাকিমা কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার। বাড়িতে দুই শিক্ষিকা থাকলে যা হয় বাড়িটাও কয়েদ খানার মতন মনে হয় তবে ওই জেঠিমার জন্য কয়েদখানা থেকে সব ভাই বোনেরা রেহাই পেয়ে যেতাম।
যাবার আগে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন, "বেশি রাত করিস নে, যেন তাহলে কিন্তু সামলাতে পারবো না।"
আমি বললাম, "আরে না না, বেশি রাত করবো না। তাড়াতাড়িই চলে আসবো।"
এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে অনুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির উঠানে মোটর সাইকেল দেখে বুঝতে পারলাম যে বিশ্বজিৎদা বাড়িতে আছে, তার মানে মধুছন্দাকে নিয়ে অনায়াসে বাইকে চেপে কালিন্দি থেকে বেহালা পাড়ি দেওয়া যাবে। মনের মধ্যে যেন উত্তম সুচিত্রার "এই পথ যদি না শেষ হয়....." বেজে উঠলো।
অনুর বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার তাই সোজা ওর ঘরে যেতে কোন অসুবিধে হলো না। পর্দা সরিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখালাম দুই বান্ধবী বিছানার ওপরে আধাশোয়া হয়ে গল্পে মশগুল।
মধুছন্দার পিঠ দরজার দিকে, উপুড় হয়ে বুকের নিচে একটা বালিশ দিয়ে শুয়ে। হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করার ফলে শাড়ির পাড় গুটিয়ে হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। ফর্সা পায়ের মসৃণ গুলি দেখে বুকের রক্তে হিল্লোল লেগে গেল। ক্ষুধার্ত বাঘের মতন লোলুপ দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইলাম ওই মসৃণ পায়ের গুলির দিকে। পাতলা শাড়ির পরতে ঢাকা নধর দেহ পল্লব যেন ঢেউ খেলে বিছানার ওপরে মেলে রয়েছে জল থেকে সদ্য ওঠা কোন এক অচিনপুরের জলপরী।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!