Thread Rating:
  • 17 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance রোদে ভেজা তিলোত্তমা Written By pinuram
#4
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০২)

আজও মনে হয় এই যেন গতকালের কথা। আমি আর নবীন একটু তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে বেরোবো ভেবেছিলাম, প্রিয়াতে "গুরুদক্ষিণা" দেখতে যাবার কথা। পচা, দেবু আর অনুসুয়াকে জানানো হয়নি, ওরা জানতে পারলে আর আস্ত রাখবে না আমাদের। আসল কথা, সেদিন নবীনের ছোট মামা ওকে দশ টাকা দিয়েছিলো, আর সেই টাকাতেই ওই সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা।

নামতে গিয়েই সিঁড়িতে মধুছন্দার সাথে ধাক্কা খেলাম। এমনিতে খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে মধুছন্দা, কিন্তু একবার খোঁচা মারলে যেন বোলতার চাকের মতন তেড়ে ওঠে। পড়াশুনায় বরাবর ভালো, গত দুই বছরে মেয়েদের মধ্যে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবীনার মতন ঝাঁঝিয়ে উঠলো মধুছন্দা, "কি রে, দেখে চলতে পারিস না? ঠ্যালা দিয়ে মেরে দিবি নাকি?"

বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে আমাকে দেখে মুখ চুপসে গেল, কেন জানি না। উজ্জ্বল ত্বকের সাথে সেদিনের হালকা গোলাপি শাড়িটা বেশ মানিয়েছিলো। টিকালো নাকের ওপরে চশমাটা একটু ঠেলে দিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো কিছু উত্তরের জন্য। ওই চোখের আগুনের পেছনে উত্তরের উতসুকতা দেখেছিলাম কিন্তু গলা শুকিয়ে এসেছিলো ওই চাহনি দেখে। কেমিস্ট্রি ল্যাবের সব কেমিক্যাল যেন আমার মাথার ওপরে কেউ ঢেলে দিয়েছিলো বলে মনে হয়।

মাথা চুলকে বিড়বিড় করে কিছু বলার আগেই নবীন ওর ওপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "এই সিঁড়ি তোর কেনা নাকি যে সারা সিঁড়ি জ্যাম করে নামছিস? মুটকি শ্যামলীকে দ্যাখ, ওই তো সিঁড়ির অর্ধেক জায়গা নিয়ে নামে, বাকিরা নামবে কি করে?"

বলতে বলতে ঝগড়া লেগে যায় নবীন আর শ্যামলীর মধ্যে, "আমি অন্তত তোর মতন হাড়গিলে নই, আমার বাবা খেতে পড়তে দেয়। তোকে দেখে মনে হয় যেন একটা হ্যাঙ্গারে একটা শার্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।"

নবীন একটু রোগা গঠনের, শ্যামলীর ওই উক্তির পরে আরো রেগে ওঠে নবীন, "তোর বাপ কি তোকে হাতির খোরাক দেয়?"

পাশেই দাঁড়িয়ে অনুসুয়া, সঙ্গে সঙ্গে নবীনের কলার ধরে বলে, "একদম বাপ তুলে কথা বলবি না। ওর বাপ ওকে কি খেতে দেয় না দেয় তাতে তোর দেখার কি দরকার।"

আমি নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, "অনু প্লিস এখন ছাড়, সিনেমা দেখতে যাবো দেরি হয়ে যাচ্ছে।"

সঙ্গে সঙ্গে মধুছন্দার চেহারার আদল বদলে গেল, বড় বড় চোখ করে উৎসুক হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন করে, "কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা, কি সিনেমা?"

ওই বড় বড় চোখ দুটো দেখলেই আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠতো। মিচকি হেসে উত্তরে বলেই ফেললাম, "প্রিয়াতে গুরুদক্ষিণা চলছে, দেখতে যাবি?"

অনুসুয়া প্রায় আমাকে তেড়ে মারতে আসে, "কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হচ্ছে? দাঁড়া কাকিমাকে বলে দেব।"

আমার আর নবীনের ওপরে অনুসুয়ার একটু বেশি জোর খাটে। এক পাড়ায় আমাদের বাড়ি, ছোট বেলা থেকে এক কলেজে পড়েছি তিনজনে। নবীনের ছোট কাকিমা অনুসুয়ার ছোট মাসি হয়, ওদিকে অনুসুয়ার বাবা আর আমার জেঠুর গলায় গলায় বন্ধুত্ত, দুইজনে ক্যালকাটা পোর্টট্রাস্টে কাস্টমসে চাকরি করেন। বছর পাঁচেক আগে অনুসুয়ার বড়দা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছে, আমার বাবাও ডাক্তার আর বিশ্বজিৎদা বাবার খুব প্রিয় ছাত্র। সব মিলিয়ে তিন বাড়ির মধ্যে অবাধ যাতায়াত। আমাদের বাড়ি আর অনুসুয়ার বাড়ি একান্নবর্তি পরিবার, জেঠা বাবা কাকা সবাই একসাথে থাকে। পুজো পালা পার্বণে একসাথে খাওয়া দাওয়া এমনকি দুই বছর অন্তর বেড়াতে গেলেও একসাথে দল বেঁধে যাওয়া হয়। এক বাস লোক ভর্তি করে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ আলদা।

পেছন থেকে পচা মানে পরাশর চেচিয়ে ওঠে, “"শালা, তোরা দু'জনে নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিলি?"

নবীন চেঁচিয়ে ওঠে আমার দিকে, "মুটকি যখন আমার কলার ধরলো তখন মুখে বুলি ফোটেনি। আর যেই ন্যাকা সুরে ডাক দিল, কি সিনেমা অমনি সুর পালটে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবি? বাড়ি চল শালা, তোর গাঁড়ে আস্ত শাল না ঢুকিয়েছি আমার নামে কুত্তা পুষিস!"

অনুসুয়া কাছে এগিয়ে মিচকি হেসে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, "কি রে পুটু, কিছু চলছে নাকি?"

আমি মাথা নেড়ে জানালাম কি বলছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না, যদিও সব কিছু জলের মতন ঘোলাটে আমার সামনে। অনু একবার আমার মুখের দিকে তাকায়, একবার মধুছন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে দেয়। মধুছন্দার কান লাল হয়ে যায় সেই চোরা হাসি দেখে।

ওদিকে দেখলাম এ যে বড় বেগতিক নবীনকে কিছুতেই খোঁচানো যাবে না। সেই মদ খাওয়ার দিনে আমাদের দেখে ফেলেছিলো, সেই থেকে আমাকে আর পচাকে ব্লাকমেল করে রোজ এক প্যাকেট চারমিনার কেনে। লুকিয়ে চুরিয়ে বিড়ি সিগারেট খাওয়ার অপরাধ সেইসময়ে মার্জনা করে দিতেন বাড়ির বড়রা। কিন্তু মদ গেলা, গাঁজা টানা নৈব চ নৈব চ, একবার বাবা জেঠার কানে কথা গেলে পিঠের ছাল গুটিয়ে খোল বানিয়ে তবে ছাড়বে। ভাগ্য ভালো যে সেই মদের কথা অনুসুয়ার কানে যায়নি না হলে আমরা আর আস্ত থাকতাম না। তখন আমাদের ক্ষমতা ওই বিড়ি থেকে চারমিনার পর্যন্ত ছিলো তাই নবীন ওর ওপরে কোনোদিন ওঠেনি।

ওদিকে শ্যামলী আর অনুসুয়া বেঁকে বসে, দেবাশিসের সাথে কিছুতেই সিনেমা দেখতে যাবে না। বেশ কয়েকদিন আগে দেবাশিস অনুসুয়াকে ডাকতে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে আর তাতে ওর শাড়ির আঁচল একটু খসে যায়। ধুন্ধুমার কান্ড শুধু ঘটতে বাকি ছিলো সেইদিন যদি না ওই মধুছন্দা এসে মধ্যস্থতা করতো, শ্যামলী আর অনুসুয়া মিলে দেবুর কাপড় খুলিয়ে ছেড়ে দিত।

তালে বেতালে ঝগড়া কথা কাটাকাটিতে সেদিন আর সিনেমা দেখা হলো না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে বাঁচিয়ে অনু প্রস্তাব দিল কফিহাউসে যাওয়ার। মেয়েদের দলের মধ্যে আর ছেলেদের দলের মধ্যে ওই একমাত্র যোগসূত্র। যেমন কথা তেমনি কাজ, বাসে চেপে সেই যাদবপুর থেকে সোজা কলেজ স্ট্রিট। মাঝে মধ্যেই একটা ঝগড়া লাগতো। এক না হয় পচার সাথে শ্যামলীর না হয় দেবুর সাথে অনুসুয়ার, আমাকে আর নবীনকে সামাল দিতে হতো, আর মধুছন্দা চুপচাপ একদিকে দাঁড়িয়ে মিচকি হাসতো ওদের কান্ডকারখানা দেখে। কলেজের বাইরে হোক কি ভেতরে হোক, বিশেষ মিশুকে না হলেও ওকে সবসময়ে সঙ্গে রাখত অনুসুয়া। তবে আমাদের ঝগড়াঝাটি কোনোদিন কলেজ চৌহিদ্দির বাইরে যায়নি, কলেজের গেটের বাইরে এই সাত জনের এক অন্য রুপ। তার মূলে অবশ্য আমি আর অনুসুয়া, কিছু না কিছু করে সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম। দেবু, অনুসুয়ার সাথে আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে ওস্তাদ, জানে শুধু ঝগড়ার মাধ্যমে ওর সাথে কথা বলতে পারবে কিন্তু মনের কথা বলার সময়ে ওর হাঁটু কাঁপতো। মাঝে মাঝেই আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো ওই সুন্দরী অনুসুয়ার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। গতবারে স্বরস্বতী পুজোর সময়ে একটা ছোট হাতির দাঁতের লকেট কিনেছিলো ভেবেছিলো অনুসুয়াকে দেবে। শেষ পর্যন্ত নিজে হাতে দিতে পারলো না, আমার হাত দিয়েই দেওয়া করিয়েছিলো। সেই হাতির দাঁতের লকেট পেয়ে বড় বড় চোখে কটমট করে তাকিয়েছিলো অনুসুয়া।

আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, "কেন তোর এত রাগ ওর ওপরে একবার খুলে বলতো?"

অনুর উত্তর, "দূর শালা, সবসময়ে কেমন ভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।"

আমি বললাম, "কেন তাকাবে না বল? তুই ক্লাসের সেরা সুন্দরী, তোর দিকে সবার নজর। আর আমাদের ব্যাচে কটা মেয়ে বলতো? কড় গুনে সাতজন।"

ঠোঁট উলটে নাক বেঁকিয়ে হেসে বলে, "খুব সুন্দর হয়েছে লকেটটা ওকে বলে দিস। আর হ্যাঁ, তুই কবে কাকে দিচ্ছিস এই রকম একটা লকেট?"

আমি উত্তরে জিজ্ঞেস করি, "কাকে দেওয়া যায় বলত এই রকম লকেট? তোকে একটা দিলে কেমন হয়?"

ঠোঁট কামড়ে উত্তর দেয় অনুসুয়া, "আমাকেই দিস একটা, তোর হয়ে মধুছন্দাকে দিয়ে দেবো।"

বর্তমানে অনুসুয়া, দেবুর অফিস ফেরার পথ চেয়ে অধির আগ্রহে বসে থাকে, সেই গল্প আলাদা। সে নিয়ে পরে অবশ্য আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি প্যারিসে দেবুর বাড়িতে বসে। পচা এখন বোর্দে থাকে, মাঝে মাঝেই হানা দেয় দেবুর বাড়িতে। সময় পেলেই নবীন ফ্লাইট ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে চলে আসে দেবুর বাড়িতে। দামী চুরুটের পাতা ছিঁড়ে সেই কল্লোলিনীর চারমিনারের স্বাদ খুঁজতে চেষ্টা করি সবাই। একসাথে বসলেই শ্যামলীকে ফোন করা হয় আর ওন্টারিও থেকে ফোনে আমাদের মুন্ডপাত করে। কোন কোন মাসে লন্ডনের ব্রিক লেনে আমার বাড়িতে আড্ডা বসে। কখনো থেমসের জল দেখে, অথবা রাইন, অথবা গারননের জল দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যাই সবাই, সবার বুকে যে গঙ্গা আঁকা সেই মাধুর্য নেই এই জলে।

""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !! Sad

[+] 1 user Likes Kolir kesto's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: রোদে ভেজা তিলোত্তমা Written By pinuram - by Kolir kesto - 06-07-2020, 09:46 AM



Users browsing this thread: 4 Guest(s)