Thread Rating:
  • 17 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance রোদে ভেজা তিলোত্তমা Written By pinuram
#1
Heart 
                                        ১ম খন্ড

রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০১)



তুমি কি রোদে ভিজতে পারো? আমরা কিন্তু রোদে ভিজেছিলাম। সেসময়ে কলকাতা, কল্লোলিনী তিলোত্তমা ছিলো আজকের মতন ব্যাঙের ছাতা হয়ে যায়নি। ময়দানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে গঙ্গার জলো বাতাসে বুক ভরে উঠতো। আউট্ট্রাম ঘাট তখন বাঁধানো ছিলো না, গঙ্গার পাড়ে সোঁদা মাটির ওপরে বসে চিনে বাদাম কিনে চিবোতে চিবোতে দু পায়ের নিচে দোল খেত গঙ্গার জল। ভিক্টরিয়ায়র সামনে থেকে দোতলা বাসের সামনের সিটে চেপে সোজা শ্যামবাজার আসার একটা আলাদা মজা ছিলো। রাজাবাজার ট্রামডিপো থেকে দৌড়ে ট্রাম ধরে কলেজস্ট্রীট যাবার এক আলাদা আনন্দ ছিলো সেই সময়ে। মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের জায়গা নিল রকমারি কেক প্যাস্ট্রির দোকান। প্রেসিডেন্সির ঠিক সামনে ফুচকাওয়ালার হাতের ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা হত। বই কিনতে সবাই বই পাড়ায় যেত, আজকের দিনের মতন মোবাইলে ইন্টারনেট খুলে বই অর্ডার করতো না। বই পাড়ায় ঢুকলেই নতুন বইয়ের গন্ধ হারিয়ে গেছে আজ। কাকভোরে বাড়ির চাকর হরি কাকা বেরিয়ে পড়তো হাতে থলে নিয়ে দুধ আর রাজারহাটের ভেড়ি থেকে তুলে আনা রুই কাতলা শোল মাগুর কিনে আনতো। সেই কাঁচের বোতলের হরিণঘাটার দুধ হারিয়ে গেছে। আজ নিউটাউনের তলা থেকে সেই রুই কাতলার আর্তনাদ শয়ে শয়ে গাড়ির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেছে। মনে আছে সেবার বর্ষা কালে যদুবাবুর ঘাটে এক জেলের জালে এক জোড়া ইলিশ উঠেছিলো, একশো টাকা দাম চেয়েছিলো, খবরের কাগজে সেই ছবিও এসেছিলো। ছোটকাকা পরের দিন হেসে বাবাকে বলেছিলো - "তোমাকে বলেছিলাম এবারে এই গঙ্গায় ইলিশ উঠবে।" সেই ইলিশের আর দেখা মেলে না, সবুজ রঙের জল ধীরে ধীরে কালো রঙ নিয়েছে।

মনে আছে একবার দুর্গাপুর থেকে হাওড়া নেমে দেখি হাওড়া ব্রিজে বিশাল জ্যাম, হেঁটে হেঁটে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে চিতপুর রোডে এসে টানা রিক্সা ধরলাম শিয়ালদা আসার জন্য। আজ সেই টুং টাং বেজে ওঠা টানা রিক্সা হারিয়ে গেছে তার জায়গা নিয়েছে অসঙ্খ্য তিন চাকা ছোট ছোট আটো। বাতাসে শ্বাস নেওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন সময়ে খুব ভোরে ছোট পিসিমাকে নিয়ে শ্যামবাজারের মঙ্গলার হাটে যেতাম। ভোরে আলো ফোটার আগেই সেই হাট বসে যেত, দূর দূর থেকে লোকে আসতো কেনা বেচা করতে। ছোট পিসিমার টাকা থাকলেও একটা বাই ছিলো কমদামে ভালো জিনিস কেনার। পিসেমশাই আর বাবা খুব বকতো, তাও পিসিমা ছাড়তো না, মাসে একবার মঙ্গলার হাটে গিয়ে জামা কাপড় কেনা চাইই চাই। চলত গেঞ্জির দোকানির সাথে বচসা, দশ টাকায় দুটো গেঞ্জি। পিসিমা অনড়, কুড়ি টাকায় সাতখানা নিয়েই ছাড়তো। হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ মাথার মোড়ে চলে যেতাম। ঠিক কোনায় একটা চায়ের দোকান ছিলো, পিসিমা আমাকে চার আনা দিয়ে বলতো "যা পুটু, বাড়িতে তোর বাবা চা খেতে দেবে না ওই দোকানে খেয়ে আয়।" সেই চার আনায় এক খুড়ি ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের চুমুকের আনন্দ হারিয়ে গেছে সিসিডি, বারিস্তার মাঝে। পিসিমার সাথে সাথে সেই মঙ্গলার হাটের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। শনিবারের দুপুরে মা কাকিমা জেঠিমা উঠানে বসে রেডিওতে যাত্রাপালা শুনতো, "শনিবারের বারবেলা......" শয়ে শয়ে মাল্টিপ্লেক্স আর ডিশ টিভির আড়ালে সেই বারবেলা হারিয়ে গেছে। দুপুরে এক ফেরিওয়ালা আসতো ঠিক বাড়ির সামনে এসে হেঁকে যেত, "হরেক মাল পাঁচ সিকা....." বাড়ির মগ বালতি রুটি সেঁকার জালি সব ওর কাছ থেকেই কেনা হত। দু'কান আর্তনাদ করে আবার সেই ডাক শোনার জন্য, সেই আওয়াজ আজ হারিয়ে গেছে।

মহালয়ার পরেই পাড়ার কর্তারা ধর্না দিত কুমোরটুলিতে, কত দূর হল দুর্গা মায়ের মূর্তি। আজকের দুর্গা হারিয়ে গেছে কর্পোরেট কালোচারে, সেই টানাটানা চোখের মাতৃময়ী মূর্তির জায়গা নিয়েছে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। ষষ্টির বোধনের আগে মায়ের চক্ষু দান, তার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখ থাকত কাপড়ে ঢাকা। আমি, নবীন, পিতু, অনু, সুকন্যাদি, ছোড়দি সবাই রাত জেগে বসে থাকতাম, কখন নন্দন পাল এসে সেই চক্ষু দান করবে। বুড়ো নন্দন পালের সাথে সাথে সেই চক্ষু দানের অধির হয়ে বসে থাকা হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে পাড়ায় পাড়ায় পুজোর সময়ে গায়ক গায়িকারা আসতো, ষষ্টি থেকে বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে যেত। নন্দ কাকিমা, সেন কাকিমা, জ্যেঠিমা আর মায়ের হাতে রান্নার ভার পড়ত। একসাথে বসে পুজোর মাঠের ওপরে রঙ্গিন সামিয়ানার নিচে বসে পাত পেড়ে খাওয়া দাওয়া চলতো দশমী পর্যন্ত। আজ ভিড় হয় শয়ে শয়ে গজিয়ে ওঠা ৩৬ বালিগঞ্জ প্যালেস, ওহ ক্যালকাটা, ভজ হরিমান্না ইত্যাদি। মা জেঠিমার হাতের রান্না হারিয়ে গেছে এই বাঙ্গালির মুন্সিয়ানা বাঙালি রেস্টুরেন্টের মাঝে।

বাড়ির পেয়ারা গাছে পেয়ারা হতো, গলির মুখের সেনদের আম গাছে আম হতো, তার পাশের বাড়ির নন্দদের বাড়িতে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ ছিলো। আজ সেই সবুজে ঢাকা পাতা ভরা গাছ গুলো নেই, ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা রক্ত মাংসহীন সারি সারি বহুতল দাঁড়িয়ে। নীল আকাশ দেখা বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কল্লোলিনীর বুকে। সে সময়ে আগমনীর সুরের আগেই বৃষ্টি থেমে যেত, আজকের দিনের গ্লোবাল ওয়ারমিং তখন এই কল্লোলিনীকে ছুঁতে পারে নি। শরতের নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াতো, আজকের দিনের মতন কালো বরষার মেঘের ঘনঘটা ছিলো না। পুজোর বাজার করতে মা মাসি পিসিরা সবাই এক না হয় শ্যামবাজার না হয় হাতিবাগান না হয় গড়িয়াহাট যেত আজকের দিনের ব্যাঙের ছাতার মতন গজানো এক হাজার এক শপিং মলে যেত না। বিয়ের শাড়ি কিনতে সবাই কলেজ স্ট্রীট যেত। ধীরে ধীরে জামা কাপড়ের দোকান বুটিক হয়ে গেল, নাপিত হয়ে গেল হেয়ার ড্রেসার, আর দরজি গুলো ফ্যাশন ডিজাইনারের তকমা লাগিয়ে নিল গায়ে। স্কুলের ছোট ছেলেরা ছাড়া কেউ হাফ প্যান্ট পরে বাইরে বের হত না। ছোট মেয়েদের ফ্রক হাঁটু পর্যন্ত থাকলেও বড় মেয়েদের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা থাকতো। বিয়ের পরে মেয়েরা সে সময়ে জিন্স প্যান্ট পরে বের হতো না খুব একটা, বের হলেও সবার চক্ষু লজ্জা বলে একটা ভাব থাকতো মনের মধ্যে। বরের সাথে দূর দেশে ভ্রমনে গিয়ে হাফ প্যান্ট পরার শখ, জিন্স প্যান্ট পরার শখ মিটাতো বাঙালি মেয়েরা। আজকের মতন পাছার একটু নিচে এসে তাদের স্কার্ট থেমে যেত না। ছেলেরা বাড়িতে লুঙ্গি ছেড়ে বারমুডা পরা শুরু করে দিল, এমন কি বাজারে যেতে হলেও বারমুডা হাফ প্যান্ট। সেই চেক কাটা সাদা কালো নীল রঙের লুঙ্গি হারিয়ে গেল। আজ কাউকে লুঙ্গি পড়তে দেখে লোকে নিম্নবিত্তের মানুষ বলে। বসিরহাটের লাল সাদা ডোরা কাটা গামছার জায়গা নিল রকমারি রঙের তোয়ালে। ছেলেদের জিন্স নিচে নেমে এসে পাছার খাজের নিচে, দুই হাতে, কাঁধে পিঠে রঙ বেরঙের উল্কি আকা। মেয়েদের স্কার্ট দুধ খাওয়া বাচ্চার প্যান্টের চেয়ে একটু ছোট, ঝুঁকলেই দেখা যায় সত্যি কিছু পরেছে নিচে না একদম খালি।

কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ে আমি, দেবু আর পচা মিলে খান্নার কাছে একটা গলির মধ্যের মদের দোকান থেকে মদ কিনে খেয়েছিলাম। ভয়ে সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারিনি তিন বন্ধু, বরানগরের কাছে কুটির ঘাটের পোড়ো মন্দিরের চাতালে ঘুমিয়ে কাটিয়ে ছিলাম। সকালো বেলায় ওই গঙ্গার ঘাটে হাত মুখ ধুয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। সে সময়ে মোবাইল ছিলো না তাই মিথ্যে বলতে বিশেষ অসুবিধে হতো না, সবাই সমস্বরে বলেছিলাম শিবপুরের সমরের বাড়িতে রাতে ছিলাম। আজকের কোলকাতা বাড়িতে বসে মদ গেলে, শহরের আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে বার আর মদের দোকান। মদ খাওয়া আজকের কলকাতার আধুনিকতা বড়লোকি মুন্সিয়ানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা ছেলে একসাথে বসে মদ খায় আজকের কল্লোলিনীর বুকে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ত, বাপরে, বিরাট বড় অপরাধ বলে মনে করা হতো! প্রেম যে লুকিয়ে চুরিয়ে করিনি সে নয়, সবাই একটু আধটু করেছে তবে হাতে হাত দিয়ে বাড়ির আগের স্টপেজ পর্যন্ত দৌড় ছিলো সেই সময়ে, পাছে পাড়ার কেউ দেখে নেয় আর বাবার কানে খবর চলে যায়। আজকের কল্লোলিনী হাতে হাত কেন, কোমরে হাত দিয়ে বাড়ির নিচে ছেড়ে গালে চুমু খেয়ে বলে, "ডার্লিং, রাতে কাপড় খুলে জেগে থেকো আমি ফোন করবো।" ঘুলঘুলির মতন ফ্লাটের, এক চিলতে বারান্দা দিয়ে কেউ দেখলো কি দেখলো না, সেই নিয়ে এই কোলকাতার কোন মাথা ব্যাথা অথবা ভ্রূক্ষেপ নেই।

""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !! Sad

[+] 4 users Like Kolir kesto's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
রোদে ভেজা তিলোত্তমা Written By pinuram - by Kolir kesto - 05-07-2020, 11:14 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)