05-07-2020, 05:14 PM
পঞ্চম পরিচ্ছদ – মরুভুমি আর মরীচিকা
(#৯)
সেই বৌদি কিছুক্ষন উলটো পাল্টা কথা বলে আর পরে আসবে বলে চলে যায়। মানসী আর ভাস্কর আবার চুপ চাপ বসে থাকে। ওদের মধ্যে যে গল্প বাধা পরে গেছে সেটা আর শুরু হয় না। তারপর স্বপন আর নিহারিকা ফিরে আসে। স্বপন ভাস্করকে অনেক ধন্যবাদ দেয় ওর সময় দেবার জন্যে। একটু পরে স্বপন অফিস চলে যায়। নিহারিকা দেখে ওদের দুজনের জন্য যে ধোকলা রেখে গিয়েছিলো সেগুলো পড়েই আছে।
সারাদিন মানসী আর নিহারিকা বাড়িতেই থাকে। বিকাল চারটে নাগাদ ওরা দুজনে চা খাচ্ছিল তখন কলিং বেল বাজে। নিহারিকা দরজা খুলে দেখে ভাস্কর দাঁড়িয়ে।
নিহারিকা – কি ব্যাপার হটাত !
ভাস্কর – বৌদি একটু আপনার সাথে কথা বলব
নিহারিকা – এসো এসো ভেতর এসে বস আগে।
ভাস্কর ভেতরে এসে বসলে দু মিনিটের মধ্যে নিহারিকা চা করে এনে দেয়।
নিহারিকা – বল ভাই কি খবর
ভাস্কর – সকালে মানসীর সাথে কথা বলছিলাম তখন পাশের বাড়ির এক বৌদি এসে যাওয়ায় সে কথা আর বলা হয়নি।
নিহারিকা – সে কথা গুলো কালকে বললেই বা কি হত !
ভাস্কর – না বৌদি আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
মানসী – আমি গিয়ে টিভি দেখি
ভাস্কর – না না তোমার সামনে বলতে কোন অসুবিধা নেই।
মানসী – তাও একটু টিভি দেখি।
মানসী ভেতরে চলে যায়।
ভাস্কর – বৌদি আমার মানসীকে খুব ভালো লাগছে
নিহারিকা – ভালো কথা
ভাস্কর – কিন্তু আগে এগোতে সাহস পাচ্ছি না
নিহারিকা – কেন সাহস পাচ্ছো না ?
ভাস্কর – আমার কোন স্থায়ী ইনকাম নেই, বিয়ে তো দুরের কথা, বিয়ের কথা ভাবতেও ভয় লাগে।
নিহারিকা – এতে আমি কি করতে পারি বল
ভাস্কর – না মানে আমি একটু কিছু করতে পারলেই মানসীকে বিয়ে করতে চাই
নিহারিকা – হটাত তোমার এই ইচ্ছা হল কেন ? আর কেনই বা আমার রাঙ্গাদিকে পছন্দ হল ?
ভাস্কর – দেখুন বৌদি আমার কোন আয় নেই বলে কোন মেয়েই আমার সাথে কথা বলে না। আলাপ হতেই যখন জানতে পারে আমি বেকার, চলে যায়। আমিও আর কথা বলতে সাহস পাই না। একমাত্র মানসীই আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে।
নিহারিকা – দেখো তুমি আর রাঙ্গাদি একটু বাইরে ঘুরে আসো। কথা বল, তারপর দেখি কি করা যায়।
ভাস্কর – মানসীকে আমার সাথে বাইরে যেতে দেবেন ?
নিহারিকা - রাঙ্গাদি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি যে কোথাও যেতে কারো অনুমতি লাগবে ?
ভাস্কর – মানসী কি যাবে আমার সাথে ?
নিহারিকা ডাকে ওর রাঙ্গাদি কে আর বলে ভাস্কর ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়।
মানসী – এখানে বসেই তো কথা বলতে পারে। আমিতো বুঝতে পাড়ছি কি বলতে চায়
ভাস্কর – বুঝতে পাড়ছ ?
মানসী – এখনও কি কচি খুকি আছি যে একটা ছেলে আমার সাথে কথা বলতে চায় তার কারন বুঝতে পারবো না !
নিহারিকা – সেই কথাগুলো চার দেওয়ালের মধ্যে না হয়ে খোলা আকাশের নিচে হলে বেশী ভালো লাগবে
মানসী – কোথায় যাব ? এখানে যাবার জায়গা কোথায় ?
নিহারিকা – কোন জায়গা নেই বলেই তো যেতে বলছি। রুবি হসপিটালের পাশ দিয়ে চলে যা অনেক বড় ফাঁকা মাঠ আসবে। তার চার পাশে অনেক ছোটো ছোটো জলা জমি আছে। তাতে অনেক পাখি আসে। ভালো লাগবে।
(ওই মাঠে এখন URBANA হাউসিং, কোলকাতার সব থেকে দামী ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। চার পাশের জলা জায়গা বিভিন্ন দালালরা বাড়ি বানাবার জন্যে বেআইনি ভাবে মাটি ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে। সেই পাখি গুলো কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে)
নিহারিকা আর ভাস্কর ঘুরতে যায়।
ভাস্কর – আমার তোমাকে খুব ভালো লেগেছে
মানসী – আমার মতো কালো কুৎসিত মেয়েকে ভালো কি করে লাগলো !
ভাস্কর – আমি আগেই বলেছি আমি গায়ের রঙ দেখি না
মানসী – তাও
ভাস্কর – তোমার কি আমাকে একটুও ভালো লাগে ?
মানসী – ভালো না লাগলে তোমার ডাকে সাড়া দেই !
ভাস্কর – আমি যদি তোমার সাথে হাত ধরে হাঁটতে চাই তবে কি তুমি রাগ করবে ?
মানসী – তুমি যদি আমার হাত না ধর তাতে রাগ করবো
দুজনে হাত ধরে এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। তখন ওই রাস্তায় লোক খুব কম চলা ফেরা করত। মানসী খেয়াল করে যে দু এক জন যাচ্ছে তারা সবাই ওদেরকে তাকিয়ে দেখছে। মানসী অবাক হয়ে যায়। কারন এতদিন ও একা একা কত জায়গায় যায়। কেউ কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যেও ওর দিকে তাকায় না। কিন্তু সেদিন ওর মনে হল সবাই ওকে দেখার জন্যেই রাস্তায় বেড়িয়েছে।
ভাস্কর – কি হল, চুপ করে কেন ?
মানসী ওকে বলে ও এতক্ষন কি খেয়াল করছিলো।
ভাস্কর – সেটা আমিও খেয়াল করছি। এতদিন আমাকে কোন মেয়ে তাকিয়ে দেখে নি। আজ অনেকেই দেখছে।
মানসী – আসলে এই পৃথিবীতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একসাথে থাকাটাই নিয়ম। তাই সবাই দেখছে
ভাস্কর – ভগবান ছেলে মেয়ে বানিয়েছেন সেই কথা মাথায় রেখে। আমরা এতদিন একা একা রাস্তা চলে অপরাধ করেছি।
মানসী – কিন্তু সেই অপরাধ আমাদের ইচ্ছাকৃত নয়
ভাস্কর – আমি যদি আমার লক্ষ্য খুঁজে না বেড় করতে পারি সেটা আমার অক্ষমতা।
মানসী – আমার মনে একটা কথা এসেছে সেটা বলি ?
ভাস্কর – অনুমতি কেন চাইছ ?
মানসী – তোমার হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে
ভাস্কর – আরে মনে এসেছে যখন বলেই ফেলো
মানসী – আমরা দুজনেই অবহেলিত। আমাকে ছেলেরা দেখে না আমি কালো বলে। সেই কলেজ জীবন থেকে দেখে আসছি। আর তোমাকে দেখে না তুমি বেকার বলে। তাই আমরা দুজনে এতো কাছাকাছি আসতে পেড়েছি।
ভাস্কর – এতে ভালো না লাগার বা রাগ করার কিছু নেই। এটা পুরো সত্যি কথা।
মানসী – সেই ছোটবেলায় একটা গল্পে পড়েছিলাম এক অন্ধ আর এক খোঁড়া এক সাথে কি ভাবে বেঁচে উঠেছিল।
ভাস্কর – সমাজের চোখে আমি অন্ধ আর তুমি খোঁড়া। তাই আমরা একসাথে পথ চললে সবাই অবাক হয়ে দেখছে।
মানসী – কিন্তু আসলে তো আমরা অন্ধ বা খোঁড়া নই।
ভাস্কর – সে তো আমি বললাম সমাজের চোখে। আমাদের নিজেদের কাছে আমরা স্বাভাবিক মানুষ।
মানসী – তা ঠিক। সমাজ আমাকে কালো বলে অবহেলা করে গেল। কালো বলে আর সবার সাথে পথ চলতে পারলাম না, তাই আমি খোঁড়া।
ভাস্কর – আর আমি কর্মজীবনের রাজনীতির লড়াইয়ে হেরে গেলাম। আমি পৃথিবীটাকে অনেক সরল ভেবেছিলাম। আশেপাশের সহকর্মী আর সংসারের কুটিলতা দেখতে পেলাম না। তাই আমি অন্ধ।
মানসী – আজকের পরে আমরা দেখিয়ে দেব এই অন্ধ আর খোঁড়া একসাথে কি কি করতে পারে।
সেদিন ওরা কিছু পড়েই বাড়ি ফিরে যায়। ভাস্কর মানসীকে পৌঁছাতে গেলে নিহারিকা ওকে ধোকলা খাইয়ে বাড়ি পাঠায়। রাত্রে মানসী স্বপনকে সব কথা বলে। স্বপন খুব খুশী হয়।
স্বপন – এতো দিনে আমার রাঙ্গাদি বড় হল
মানসী – বড় হয়েছি কিনা জানিনা শুধু আমার মনে হচ্ছে একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।
স্বপন – তুমি যে অন্ধ আর খোঁড়ার গল্প বললে, সেটাকে ম্যানেজমেন্টের ভাষায় “পরিপূরক পারদর্শিতা” বা “Complementary Skill” বলে। একটা টীমে বিভিন্ন কাজে পারদর্শী সদস্য রাখা হয়।
মানসী – হ্যাঁ, একটা ফুটবল দলে সবাই ফরোয়ার্ড বা সবাই গোলকিপার নয়।
স্বপন – কিন্তু আমরা বিয়ে করার সময় সেটা খেয়াল রাখি না। ডাক্তার সব সময় ডাক্তারকেই বিয়ে করতে চায়। বেশীর ভাগ ছেলে মেয়েই একই রকমের সাথী খোঁজে। আসলে স্বামী আর স্ত্রী যদি বিভিন্ন পেশার হয় সেটা বেশী ভালো হয়।
মানসী – ওইসব ছাড়ো। এখন বল আমি কি করব।
স্বপন – তুমি গিয়ে ভাস্করকে হামি খাও।
মানসী – যাঃ ইয়ার্কি করো না
স্বপন – তুমি যা ভালো মনে হয় তাই করো। আমি সব সময়েই তোমার সাথে আছি।
মানসী – বড়দাকে কি বলব ?
স্বপন – যা সত্যি তাই বলবে।
মানসী – বড়দাকে আমি বলতে পারবো না
স্বপন – সে আমি কথা শুরু করে দেব। আগে তোমাকে সব বলতে হবে।
মানসী – আচ্ছা।
ওই সপ্তাহের বাকি দিনগুলো রোজ দুজনে একসাথে বেড়াতে বেড় হয়। ওরা কিশোর কিশোরীর মতো প্রেম করে। ওদের মধ্যে যা কথা হয় সেগুলো লিখলে ওদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা হবে। তাই সেসব আর লিখছি না। স্বপন একদিন গিয়ে বড়দার সাথে দেখা করে সব জানায়। বড়দা বলেন উনি শনিবার বিকালে এসে ভাস্করের সাথে কথা বলবেন।
মানসী আর ভাস্করের প্রেম হয়তো চিরাচরিত প্রেমের ভাষায় প্রেম নয়। বন্যার জলে ভেসে যাওয়া দুই অসহায় প্রাণী যেমন একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, সেইরকমই ওরা দুজনেও জীবন স্রোতে ভেসে যেতে যেতে একে অন্যের আশ্রয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছিল। ওদের কাছে তথাকথিত প্রেমের পরিভাষার কোন মুল্য ছিল না। তবুও এটা প্রেম। ওদের একে অন্যকে না দেখতে পেলে মন কাঁদত না। কিন্তু তাও যখন সামনা সামনি আসতো ওদের মনে খুশীর হাওয়া বয়ে যেত। মান্না দের সেই গানটা এই রকম ছেলে মেয়েদের জন্যেই লেখা হয়েছিল।
আমার না যদি থাকে সুখ
তোমার আছে তুমি তা দেবে
তোমার গন্ধ হারা ফুল
আমার কাছে সুরভি নেবে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
জীবনে যা গৌরবো হয়
মনের নেই পরাজয়
চোখের স্মৃতির মনিদীপ
মনের আলোয় কভু কি নিভে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
দুজনেই দুজনাতে মুগ্ধ
দুজনের বুকে কত সুন্দর
দুজনের গীতালির ছন্দে
তন্ময় দুজনের অন্তর
এর কাছে স্বর্গ সুধার
বেশী আছে মুল্য কি আর
আমার দেবতা সেও তাই
প্রেমের কাঙ্গাল পেয়েছি ভেবে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
(#৯)
সেই বৌদি কিছুক্ষন উলটো পাল্টা কথা বলে আর পরে আসবে বলে চলে যায়। মানসী আর ভাস্কর আবার চুপ চাপ বসে থাকে। ওদের মধ্যে যে গল্প বাধা পরে গেছে সেটা আর শুরু হয় না। তারপর স্বপন আর নিহারিকা ফিরে আসে। স্বপন ভাস্করকে অনেক ধন্যবাদ দেয় ওর সময় দেবার জন্যে। একটু পরে স্বপন অফিস চলে যায়। নিহারিকা দেখে ওদের দুজনের জন্য যে ধোকলা রেখে গিয়েছিলো সেগুলো পড়েই আছে।
সারাদিন মানসী আর নিহারিকা বাড়িতেই থাকে। বিকাল চারটে নাগাদ ওরা দুজনে চা খাচ্ছিল তখন কলিং বেল বাজে। নিহারিকা দরজা খুলে দেখে ভাস্কর দাঁড়িয়ে।
নিহারিকা – কি ব্যাপার হটাত !
ভাস্কর – বৌদি একটু আপনার সাথে কথা বলব
নিহারিকা – এসো এসো ভেতর এসে বস আগে।
ভাস্কর ভেতরে এসে বসলে দু মিনিটের মধ্যে নিহারিকা চা করে এনে দেয়।
নিহারিকা – বল ভাই কি খবর
ভাস্কর – সকালে মানসীর সাথে কথা বলছিলাম তখন পাশের বাড়ির এক বৌদি এসে যাওয়ায় সে কথা আর বলা হয়নি।
নিহারিকা – সে কথা গুলো কালকে বললেই বা কি হত !
ভাস্কর – না বৌদি আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
মানসী – আমি গিয়ে টিভি দেখি
ভাস্কর – না না তোমার সামনে বলতে কোন অসুবিধা নেই।
মানসী – তাও একটু টিভি দেখি।
মানসী ভেতরে চলে যায়।
ভাস্কর – বৌদি আমার মানসীকে খুব ভালো লাগছে
নিহারিকা – ভালো কথা
ভাস্কর – কিন্তু আগে এগোতে সাহস পাচ্ছি না
নিহারিকা – কেন সাহস পাচ্ছো না ?
ভাস্কর – আমার কোন স্থায়ী ইনকাম নেই, বিয়ে তো দুরের কথা, বিয়ের কথা ভাবতেও ভয় লাগে।
নিহারিকা – এতে আমি কি করতে পারি বল
ভাস্কর – না মানে আমি একটু কিছু করতে পারলেই মানসীকে বিয়ে করতে চাই
নিহারিকা – হটাত তোমার এই ইচ্ছা হল কেন ? আর কেনই বা আমার রাঙ্গাদিকে পছন্দ হল ?
ভাস্কর – দেখুন বৌদি আমার কোন আয় নেই বলে কোন মেয়েই আমার সাথে কথা বলে না। আলাপ হতেই যখন জানতে পারে আমি বেকার, চলে যায়। আমিও আর কথা বলতে সাহস পাই না। একমাত্র মানসীই আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে।
নিহারিকা – দেখো তুমি আর রাঙ্গাদি একটু বাইরে ঘুরে আসো। কথা বল, তারপর দেখি কি করা যায়।
ভাস্কর – মানসীকে আমার সাথে বাইরে যেতে দেবেন ?
নিহারিকা - রাঙ্গাদি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি যে কোথাও যেতে কারো অনুমতি লাগবে ?
ভাস্কর – মানসী কি যাবে আমার সাথে ?
নিহারিকা ডাকে ওর রাঙ্গাদি কে আর বলে ভাস্কর ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়।
মানসী – এখানে বসেই তো কথা বলতে পারে। আমিতো বুঝতে পাড়ছি কি বলতে চায়
ভাস্কর – বুঝতে পাড়ছ ?
মানসী – এখনও কি কচি খুকি আছি যে একটা ছেলে আমার সাথে কথা বলতে চায় তার কারন বুঝতে পারবো না !
নিহারিকা – সেই কথাগুলো চার দেওয়ালের মধ্যে না হয়ে খোলা আকাশের নিচে হলে বেশী ভালো লাগবে
মানসী – কোথায় যাব ? এখানে যাবার জায়গা কোথায় ?
নিহারিকা – কোন জায়গা নেই বলেই তো যেতে বলছি। রুবি হসপিটালের পাশ দিয়ে চলে যা অনেক বড় ফাঁকা মাঠ আসবে। তার চার পাশে অনেক ছোটো ছোটো জলা জমি আছে। তাতে অনেক পাখি আসে। ভালো লাগবে।
(ওই মাঠে এখন URBANA হাউসিং, কোলকাতার সব থেকে দামী ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। চার পাশের জলা জায়গা বিভিন্ন দালালরা বাড়ি বানাবার জন্যে বেআইনি ভাবে মাটি ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে। সেই পাখি গুলো কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে)
নিহারিকা আর ভাস্কর ঘুরতে যায়।
ভাস্কর – আমার তোমাকে খুব ভালো লেগেছে
মানসী – আমার মতো কালো কুৎসিত মেয়েকে ভালো কি করে লাগলো !
ভাস্কর – আমি আগেই বলেছি আমি গায়ের রঙ দেখি না
মানসী – তাও
ভাস্কর – তোমার কি আমাকে একটুও ভালো লাগে ?
মানসী – ভালো না লাগলে তোমার ডাকে সাড়া দেই !
ভাস্কর – আমি যদি তোমার সাথে হাত ধরে হাঁটতে চাই তবে কি তুমি রাগ করবে ?
মানসী – তুমি যদি আমার হাত না ধর তাতে রাগ করবো
দুজনে হাত ধরে এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। তখন ওই রাস্তায় লোক খুব কম চলা ফেরা করত। মানসী খেয়াল করে যে দু এক জন যাচ্ছে তারা সবাই ওদেরকে তাকিয়ে দেখছে। মানসী অবাক হয়ে যায়। কারন এতদিন ও একা একা কত জায়গায় যায়। কেউ কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যেও ওর দিকে তাকায় না। কিন্তু সেদিন ওর মনে হল সবাই ওকে দেখার জন্যেই রাস্তায় বেড়িয়েছে।
ভাস্কর – কি হল, চুপ করে কেন ?
মানসী ওকে বলে ও এতক্ষন কি খেয়াল করছিলো।
ভাস্কর – সেটা আমিও খেয়াল করছি। এতদিন আমাকে কোন মেয়ে তাকিয়ে দেখে নি। আজ অনেকেই দেখছে।
মানসী – আসলে এই পৃথিবীতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একসাথে থাকাটাই নিয়ম। তাই সবাই দেখছে
ভাস্কর – ভগবান ছেলে মেয়ে বানিয়েছেন সেই কথা মাথায় রেখে। আমরা এতদিন একা একা রাস্তা চলে অপরাধ করেছি।
মানসী – কিন্তু সেই অপরাধ আমাদের ইচ্ছাকৃত নয়
ভাস্কর – আমি যদি আমার লক্ষ্য খুঁজে না বেড় করতে পারি সেটা আমার অক্ষমতা।
মানসী – আমার মনে একটা কথা এসেছে সেটা বলি ?
ভাস্কর – অনুমতি কেন চাইছ ?
মানসী – তোমার হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে
ভাস্কর – আরে মনে এসেছে যখন বলেই ফেলো
মানসী – আমরা দুজনেই অবহেলিত। আমাকে ছেলেরা দেখে না আমি কালো বলে। সেই কলেজ জীবন থেকে দেখে আসছি। আর তোমাকে দেখে না তুমি বেকার বলে। তাই আমরা দুজনে এতো কাছাকাছি আসতে পেড়েছি।
ভাস্কর – এতে ভালো না লাগার বা রাগ করার কিছু নেই। এটা পুরো সত্যি কথা।
মানসী – সেই ছোটবেলায় একটা গল্পে পড়েছিলাম এক অন্ধ আর এক খোঁড়া এক সাথে কি ভাবে বেঁচে উঠেছিল।
ভাস্কর – সমাজের চোখে আমি অন্ধ আর তুমি খোঁড়া। তাই আমরা একসাথে পথ চললে সবাই অবাক হয়ে দেখছে।
মানসী – কিন্তু আসলে তো আমরা অন্ধ বা খোঁড়া নই।
ভাস্কর – সে তো আমি বললাম সমাজের চোখে। আমাদের নিজেদের কাছে আমরা স্বাভাবিক মানুষ।
মানসী – তা ঠিক। সমাজ আমাকে কালো বলে অবহেলা করে গেল। কালো বলে আর সবার সাথে পথ চলতে পারলাম না, তাই আমি খোঁড়া।
ভাস্কর – আর আমি কর্মজীবনের রাজনীতির লড়াইয়ে হেরে গেলাম। আমি পৃথিবীটাকে অনেক সরল ভেবেছিলাম। আশেপাশের সহকর্মী আর সংসারের কুটিলতা দেখতে পেলাম না। তাই আমি অন্ধ।
মানসী – আজকের পরে আমরা দেখিয়ে দেব এই অন্ধ আর খোঁড়া একসাথে কি কি করতে পারে।
সেদিন ওরা কিছু পড়েই বাড়ি ফিরে যায়। ভাস্কর মানসীকে পৌঁছাতে গেলে নিহারিকা ওকে ধোকলা খাইয়ে বাড়ি পাঠায়। রাত্রে মানসী স্বপনকে সব কথা বলে। স্বপন খুব খুশী হয়।
স্বপন – এতো দিনে আমার রাঙ্গাদি বড় হল
মানসী – বড় হয়েছি কিনা জানিনা শুধু আমার মনে হচ্ছে একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।
স্বপন – তুমি যে অন্ধ আর খোঁড়ার গল্প বললে, সেটাকে ম্যানেজমেন্টের ভাষায় “পরিপূরক পারদর্শিতা” বা “Complementary Skill” বলে। একটা টীমে বিভিন্ন কাজে পারদর্শী সদস্য রাখা হয়।
মানসী – হ্যাঁ, একটা ফুটবল দলে সবাই ফরোয়ার্ড বা সবাই গোলকিপার নয়।
স্বপন – কিন্তু আমরা বিয়ে করার সময় সেটা খেয়াল রাখি না। ডাক্তার সব সময় ডাক্তারকেই বিয়ে করতে চায়। বেশীর ভাগ ছেলে মেয়েই একই রকমের সাথী খোঁজে। আসলে স্বামী আর স্ত্রী যদি বিভিন্ন পেশার হয় সেটা বেশী ভালো হয়।
মানসী – ওইসব ছাড়ো। এখন বল আমি কি করব।
স্বপন – তুমি গিয়ে ভাস্করকে হামি খাও।
মানসী – যাঃ ইয়ার্কি করো না
স্বপন – তুমি যা ভালো মনে হয় তাই করো। আমি সব সময়েই তোমার সাথে আছি।
মানসী – বড়দাকে কি বলব ?
স্বপন – যা সত্যি তাই বলবে।
মানসী – বড়দাকে আমি বলতে পারবো না
স্বপন – সে আমি কথা শুরু করে দেব। আগে তোমাকে সব বলতে হবে।
মানসী – আচ্ছা।
ওই সপ্তাহের বাকি দিনগুলো রোজ দুজনে একসাথে বেড়াতে বেড় হয়। ওরা কিশোর কিশোরীর মতো প্রেম করে। ওদের মধ্যে যা কথা হয় সেগুলো লিখলে ওদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা হবে। তাই সেসব আর লিখছি না। স্বপন একদিন গিয়ে বড়দার সাথে দেখা করে সব জানায়। বড়দা বলেন উনি শনিবার বিকালে এসে ভাস্করের সাথে কথা বলবেন।
মানসী আর ভাস্করের প্রেম হয়তো চিরাচরিত প্রেমের ভাষায় প্রেম নয়। বন্যার জলে ভেসে যাওয়া দুই অসহায় প্রাণী যেমন একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, সেইরকমই ওরা দুজনেও জীবন স্রোতে ভেসে যেতে যেতে একে অন্যের আশ্রয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছিল। ওদের কাছে তথাকথিত প্রেমের পরিভাষার কোন মুল্য ছিল না। তবুও এটা প্রেম। ওদের একে অন্যকে না দেখতে পেলে মন কাঁদত না। কিন্তু তাও যখন সামনা সামনি আসতো ওদের মনে খুশীর হাওয়া বয়ে যেত। মান্না দের সেই গানটা এই রকম ছেলে মেয়েদের জন্যেই লেখা হয়েছিল।
আমার না যদি থাকে সুখ
তোমার আছে তুমি তা দেবে
তোমার গন্ধ হারা ফুল
আমার কাছে সুরভি নেবে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
জীবনে যা গৌরবো হয়
মনের নেই পরাজয়
চোখের স্মৃতির মনিদীপ
মনের আলোয় কভু কি নিভে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
দুজনেই দুজনাতে মুগ্ধ
দুজনের বুকে কত সুন্দর
দুজনের গীতালির ছন্দে
তন্ময় দুজনের অন্তর
এর কাছে স্বর্গ সুধার
বেশী আছে মুল্য কি আর
আমার দেবতা সেও তাই
প্রেমের কাঙ্গাল পেয়েছি ভেবে
এরই নাম প্রেম, এরই নাম প্রেম
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!