05-07-2020, 11:32 AM
পর্ব এক। ডায়রির পাতা (#1-#5)
সন্তোষ স্যারের কাছে অঙ্ক পড়তে যেত আকাশ এবং অভি। ঠিক অভির আগের ব্যাচে আকাশ। অভি ঠিক করল আকাশকে মারবে। সেদিন পড়ার নাম করে বেড়িয়ে ঠিক আকাশের পাড়ার মুখে বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোচিং শেষ করে সাইকেলে পাড়ায় ঢোকার মুখে অভি আর ওর বন্ধুরা ঘিরে ধরল আকাশকে। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই একটা থান ইট উঠিয়ে সাইকেল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। সাইকেল থেকে পড়ে যেতেই, আকাশ কে ঘিরে ধরে বেদম মারতে শুরু করে দেয়। পাশে যে ইটটা পড়েছিল সেটা দিয়ে আকাশের পায়ের ওপরে গায়ের সব শক্তি দিয়ে নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে পা ভেঙ্গে যায়, ব্যাথায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায় আকাশ। আসেপাশের লোকজন ছুটে না এলে সেদিন আকাশকে মেরেই ফেলত। মারামারি করে বীরদর্পে বাড়ি ফিরে আসে, দিদির চোখের জলের বদলা নিয়েছে। আকাশের বাবার কাছে সেই খবর পৌঁছে যায়। তৎক্ষণাৎ ছেলেকে নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি করিয়ে সোজা প্রনবেশ বাবুর বাড়ি পৌঁছে অভির কান্ড কারখানা জানিয়ে দেন। প্রনবেশ বাবু খুব রেগে যান ছেলের কান্ড কারখানা শুনে। কিন্তু যখন আসল ঘটনা স্ত্রীর কাছ থেকে আর কন্যের কাছ থেকে শোনেন তখন আকাশের বাবাকে শাসিয়ে দেন যে এই রকম অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেকে তাঁর পুত্র উচিত শিক্ষাই দিয়েছে। সব কথা জানার পরে প্রচন্ড আহত হন আকাশের বাবা, কিন্তু তাও বলেন যে ওইভাবে পা ভেঙ্গে দেওয়া উচিত হয়নি। আকাশের পায়ে মাল্টিপেল ফ্রাকচার হয়েছে, ছেলেটা হয়ত কোনদিন আর ঠিক ভাবে হাটতে পারবে না। প্রনবেশ বাবু ছেলের হয় ক্ষমা চেয়ে নিলেন আকাশের বাবার কাছে।
আকাশের বাবা চলে যাওয়ার পরে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “এইসব কিছু আমাকে কেন জানাস নি অথবা ওর বাবাকে কেন বলিস নি?”
অভি চুপ করে দাঁড়িয়ে নিচু কণ্ঠে জবাব দেয়, “দিদির সাথে যে ওই রকম করবে তাকে মেরে ফেলব।”
সেই শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন প্রনবেশ বাবু, “মেরে ফেলবি মানে?” বলেই বেল্ট খুলে বেদম মারতে শুরু করে দেন। পিঠে দাগ বসে যায় তাও চোখ থেকে এক ফোঁটা জল বের করে না। গুম মেরে দাঁড়িয়ে মার খেতে খেতে আবার বলে, “এবার ত শুধু পা ভেঙ্গেছি এরপর ওর মাথা ভেঙ্গে দেব।”
ভীষণ রেগে যান প্রনবেশ বাবু। “তোর আস্পর্ধা ত কম নয়, আবার মুখে মুখে কথা বলছিস?”
দীপা দেবী কিছুতেই শান্ত করতে পারেন না প্রনবেশ বাবুকে। “ছেলেটাকে কি তুমি মেরে ফেলবে নাকি? আচ্ছা বাবা ঘাট মানছি যে পা ভেঙ্গে দেওয়াটা ঠিক হয়নি কিন্তু তাই বলে মেয়েকে এমন করবে আর ও চুপ করে থাকবে।”
প্রনবেশ বাবু গর্জে ওঠেন, “আমি মরে গেছি নাকি? আমাকে বলতে পারত। আর তোমার মেয়ে, কলেজ যাওয়ার নাম করে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। লজ্জা শরম বলে কিছু নেই, পড়াশুনার নামে লবডঙ্কা। একজন প্রেম করে বেড়াচ্ছে আরেকজন গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে। তোমার আস্কারা পেয়ে দিনে দিনে দুটোতে বাঁদর হচ্ছে।”
ভাইকে ওইভাবে মার খেতে দেখে আর থাকতে পারে না মনামি, শেষ পর্যন্ত চেঁচিয়ে ওঠে, “ভাই যা করেছে ঠিক করেছে, তুমি হলে কি করতে, দুটো বকাঝকা দিতে আর কি। ভাইকে ছেড়ে দাও না হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
অবস্থার সামাল দিতে অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রনবেশ বাবুর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন অভিকে। সারা পিঠে বেল্টের দাগ কেটে বসে গেছে, চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার জোগার তাও এক ফোঁটা জল ফেলেনি। সারা রাত ধরে বড়মার কোলে মুখ লুকিয়ে পড়েছিল। ছেলের পিঠের সেই দগদগে দাগ দেখে সেই রাতে দীপাদেবী রান্নাও করেননি, বুক ভেঙ্গে গিয়েছিল অভির ব্যাথা দেখে। নিজেও খাননি কাউকে খেতেও দেননি। সারা রাত বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন ছেলেকে। মনামিও সেইরাতে ঘুমায়নি, সারা রাত বসে ভাইয়ের পিঠে নারকেল দিয়ে হলুদ বেটে মাখিয়ে দিয়েছিল।
আকাশ আর কোনদিন সোজা হয়ে হাটতে পারেনি, এখন ক্রাচ নিয়েই হাটে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয় অভির সাথে, দেখা হলেই মাথা নিচু করে এড়িয়ে যায়।
মনামি হেসে ফেলে, “সত্যি রে কি দিন ছিল সেইসব।”
দিদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। হেসে ফেলে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ রে, সত্যি রে বড্ড ভালো ছিল।”
ভাইয়ের রুক্ষ চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে, “তুই চাকরি কবে করবি?”
অভি উত্তর দেয়, “জানিস ত যা পাচ্ছি সব কোলকাতার বাইরে। তবে তোর বিয়ে হয়ে গেলে কোলকাতাতে যা চাকরি পাবো তাতেই ঢুকে যাবো।”
মনামি ভাইয়ের চুল টেনে বলে, “কপালে উল্কি আঁকার নতুন ডিজাইন দেখে রাখিস কিন্তু।”
মনামির বান্ধবী কেয়ার বিয়েতে, কপালে আঁকার জন্য অভির ডাক পড়েছিল। মাথা নাড়ায় অভি, “সে ত অবশ্যই এঁকে দেব তবে এই বার প্রফেশানাল বিউটিসিয়ান ডাকব, ওই কেয়াদির মতন নয়।”
মনামি উত্তর দেয়, “হুম, বউভাতে ঠিক ভাবে সাজাতে পারেনি তার চেয়ে লেখার বিয়েতে যে মেয়েটা সাজিয়েছিল অনেক ভালো সাজিয়েছিল, তাকেই ডাকব কি বলিস।”
মাথা দোলায় অভি, “হ্যাঁ রে মেয়েটা লেখাকে বিয়েতে এবং বোউভাতে দুই দিনই দারুন সাজিয়েছিল।”
বলতে বলতে লেখার বিউটিসিয়ান বান্ধবীর কথা মনে পরে গেল। দময়ন্তী ঘোষ, বারাসাতে বাড়ি, লেখার কলেজের বান্ধবী। মনামি অথবা লেখার মতন ফরসা না হলেও, কাঁচা গমের মতন রঙ, বেশ সুন্দরী, টানাটানা মিষ্টি চোখ জোড়া ভীষণ কথা বলে। লেখার মতন মুখ চোরা নয়, বেশ মিশুকে হাসিখুশি মেয়ে। ঝন্টুর বিয়ের সময়ে কাজের মধ্যে ভীষণ ভাবে ব্যাস্ত থাকায় দময়ন্তীর সাথে ঠিক ভাবে পরিচয় করতে পারেনি। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে চোখে চোখে অব্যাক্ত কিছু টুকরো শব্দ হয়ত ছড়িয়ে গিয়েছিল ওদের মাঝে, তবে সেটা ওই বোউভাতের দিন পর্যন্ত সীমিত ছিল। তারপরে কোনদিন অভি কোন রকম চেষ্টা করেনি দময়ন্তীর সাথে আলাপ পরিচয় করার।
ভুরু নাচিয়ে কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস ভাইকে করে, “কি রে শয়তান হারিয়ে গেলি নাকি রে? প্রেমট্রেম কবে করবি?”
দিদির কোলে মাথা গুঁজে বলে, “না রে ভাই সে গুড়ে বালি। দিমাগে অনেকে থাকে কিন্তু বুকের মাঝে কাউকে জায়গা দেব না।”
মনামি হেসে ফেলে, “আচ্ছা তাঁর মানে মাথায় কেউ আছে তাহলে।”
মাথা নাড়ায় অভি, সত্যি ওর জীবনে তেমন কেউ নেই। দময়ন্তী শুধু মাত্র সেই কটাদিন ওর মাথার মধ্যেই ছিল, বুকের মধ্যে ঠাই দেয়নি কোনমতে, “মাথায় থাকলে কি আর তুই জানতিস না নাকি।”
সত্যি কথা, এই সব ব্যাপারে মনামিকেই আগে জানাবে। মুচকি হেসে ভাইকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা বুঝলাম, তাহলে আমিই দিল্লী গিয়ে একটা সুন্দরী দেখে নিয়ে আসব।”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় অভি, “না রে দিদিভাই, পারব না। আমার সবকিছু বড়মা থেকে শুরু আর তোকে দিয়েই শেষ, এই দুজনার মাঝে আমি কাউকে আনছি না।” কথাটা শুনে কেঁদে ফেলে মনামি। “বাইরের লোক কি আর বুঝবে বড়মাকে, তোকে, আমাকে? কেউ বুঝবে না রে।”
ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলে, “আমি এই বিয়ে করব না। আমি কাল পাপাকে বলব দিল্লীতে আমি বিয়ে করব না। এই কোলকাতায় আমার জন্য যেন ছেলে খোঁজে।”
কান্না ভেজা কণ্ঠে দিদিকে বলে, “নারে না করিস নে। পাপা বড়মা দিদিভাই সবাই এই সম্বন্ধে ভীষণ খুশি। হয়ত শিতাভ্র ভালো ছেলেই হবে। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ একটা এডভেঞ্চার। তুই পা বাড়া আমি তোর পেছনে আছি।”
মনামি ভাইকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে, “তুই না একদম পাগল।”
মাঝ রাতে মাঝে মাঝে জল খেতে ওঠেন দীপাদেবী। ঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে বসে বসার ঘর থেকে আওয়াজ ভেসে আসতেই স্বচেতন হয়ে ওঠেন। চুপচাপ বসার ঘরে ঢুকে দেখে, মনামির কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অভি। ভাই আর বোনের এই টান দেখে চোখ দুটো জলে ভরে এলো। চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন তারপর চোখের কোল মুছতে মুছতে নিজের বিছানায় ফিরে গেলেন।
ডায়রির পাতা গুলো পাল্টাতে পাল্টাতে কখন যে সকাল হয়ে আসে তার খেয়াল থাকে না।
সন্তোষ স্যারের কাছে অঙ্ক পড়তে যেত আকাশ এবং অভি। ঠিক অভির আগের ব্যাচে আকাশ। অভি ঠিক করল আকাশকে মারবে। সেদিন পড়ার নাম করে বেড়িয়ে ঠিক আকাশের পাড়ার মুখে বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোচিং শেষ করে সাইকেলে পাড়ায় ঢোকার মুখে অভি আর ওর বন্ধুরা ঘিরে ধরল আকাশকে। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই একটা থান ইট উঠিয়ে সাইকেল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। সাইকেল থেকে পড়ে যেতেই, আকাশ কে ঘিরে ধরে বেদম মারতে শুরু করে দেয়। পাশে যে ইটটা পড়েছিল সেটা দিয়ে আকাশের পায়ের ওপরে গায়ের সব শক্তি দিয়ে নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে পা ভেঙ্গে যায়, ব্যাথায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায় আকাশ। আসেপাশের লোকজন ছুটে না এলে সেদিন আকাশকে মেরেই ফেলত। মারামারি করে বীরদর্পে বাড়ি ফিরে আসে, দিদির চোখের জলের বদলা নিয়েছে। আকাশের বাবার কাছে সেই খবর পৌঁছে যায়। তৎক্ষণাৎ ছেলেকে নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি করিয়ে সোজা প্রনবেশ বাবুর বাড়ি পৌঁছে অভির কান্ড কারখানা জানিয়ে দেন। প্রনবেশ বাবু খুব রেগে যান ছেলের কান্ড কারখানা শুনে। কিন্তু যখন আসল ঘটনা স্ত্রীর কাছ থেকে আর কন্যের কাছ থেকে শোনেন তখন আকাশের বাবাকে শাসিয়ে দেন যে এই রকম অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেকে তাঁর পুত্র উচিত শিক্ষাই দিয়েছে। সব কথা জানার পরে প্রচন্ড আহত হন আকাশের বাবা, কিন্তু তাও বলেন যে ওইভাবে পা ভেঙ্গে দেওয়া উচিত হয়নি। আকাশের পায়ে মাল্টিপেল ফ্রাকচার হয়েছে, ছেলেটা হয়ত কোনদিন আর ঠিক ভাবে হাটতে পারবে না। প্রনবেশ বাবু ছেলের হয় ক্ষমা চেয়ে নিলেন আকাশের বাবার কাছে।
আকাশের বাবা চলে যাওয়ার পরে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “এইসব কিছু আমাকে কেন জানাস নি অথবা ওর বাবাকে কেন বলিস নি?”
অভি চুপ করে দাঁড়িয়ে নিচু কণ্ঠে জবাব দেয়, “দিদির সাথে যে ওই রকম করবে তাকে মেরে ফেলব।”
সেই শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন প্রনবেশ বাবু, “মেরে ফেলবি মানে?” বলেই বেল্ট খুলে বেদম মারতে শুরু করে দেন। পিঠে দাগ বসে যায় তাও চোখ থেকে এক ফোঁটা জল বের করে না। গুম মেরে দাঁড়িয়ে মার খেতে খেতে আবার বলে, “এবার ত শুধু পা ভেঙ্গেছি এরপর ওর মাথা ভেঙ্গে দেব।”
ভীষণ রেগে যান প্রনবেশ বাবু। “তোর আস্পর্ধা ত কম নয়, আবার মুখে মুখে কথা বলছিস?”
দীপা দেবী কিছুতেই শান্ত করতে পারেন না প্রনবেশ বাবুকে। “ছেলেটাকে কি তুমি মেরে ফেলবে নাকি? আচ্ছা বাবা ঘাট মানছি যে পা ভেঙ্গে দেওয়াটা ঠিক হয়নি কিন্তু তাই বলে মেয়েকে এমন করবে আর ও চুপ করে থাকবে।”
প্রনবেশ বাবু গর্জে ওঠেন, “আমি মরে গেছি নাকি? আমাকে বলতে পারত। আর তোমার মেয়ে, কলেজ যাওয়ার নাম করে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। লজ্জা শরম বলে কিছু নেই, পড়াশুনার নামে লবডঙ্কা। একজন প্রেম করে বেড়াচ্ছে আরেকজন গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে। তোমার আস্কারা পেয়ে দিনে দিনে দুটোতে বাঁদর হচ্ছে।”
ভাইকে ওইভাবে মার খেতে দেখে আর থাকতে পারে না মনামি, শেষ পর্যন্ত চেঁচিয়ে ওঠে, “ভাই যা করেছে ঠিক করেছে, তুমি হলে কি করতে, দুটো বকাঝকা দিতে আর কি। ভাইকে ছেড়ে দাও না হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
অবস্থার সামাল দিতে অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রনবেশ বাবুর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন অভিকে। সারা পিঠে বেল্টের দাগ কেটে বসে গেছে, চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার জোগার তাও এক ফোঁটা জল ফেলেনি। সারা রাত ধরে বড়মার কোলে মুখ লুকিয়ে পড়েছিল। ছেলের পিঠের সেই দগদগে দাগ দেখে সেই রাতে দীপাদেবী রান্নাও করেননি, বুক ভেঙ্গে গিয়েছিল অভির ব্যাথা দেখে। নিজেও খাননি কাউকে খেতেও দেননি। সারা রাত বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন ছেলেকে। মনামিও সেইরাতে ঘুমায়নি, সারা রাত বসে ভাইয়ের পিঠে নারকেল দিয়ে হলুদ বেটে মাখিয়ে দিয়েছিল।
আকাশ আর কোনদিন সোজা হয়ে হাটতে পারেনি, এখন ক্রাচ নিয়েই হাটে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয় অভির সাথে, দেখা হলেই মাথা নিচু করে এড়িয়ে যায়।
মনামি হেসে ফেলে, “সত্যি রে কি দিন ছিল সেইসব।”
দিদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। হেসে ফেলে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ রে, সত্যি রে বড্ড ভালো ছিল।”
ভাইয়ের রুক্ষ চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করে, “তুই চাকরি কবে করবি?”
অভি উত্তর দেয়, “জানিস ত যা পাচ্ছি সব কোলকাতার বাইরে। তবে তোর বিয়ে হয়ে গেলে কোলকাতাতে যা চাকরি পাবো তাতেই ঢুকে যাবো।”
মনামি ভাইয়ের চুল টেনে বলে, “কপালে উল্কি আঁকার নতুন ডিজাইন দেখে রাখিস কিন্তু।”
মনামির বান্ধবী কেয়ার বিয়েতে, কপালে আঁকার জন্য অভির ডাক পড়েছিল। মাথা নাড়ায় অভি, “সে ত অবশ্যই এঁকে দেব তবে এই বার প্রফেশানাল বিউটিসিয়ান ডাকব, ওই কেয়াদির মতন নয়।”
মনামি উত্তর দেয়, “হুম, বউভাতে ঠিক ভাবে সাজাতে পারেনি তার চেয়ে লেখার বিয়েতে যে মেয়েটা সাজিয়েছিল অনেক ভালো সাজিয়েছিল, তাকেই ডাকব কি বলিস।”
মাথা দোলায় অভি, “হ্যাঁ রে মেয়েটা লেখাকে বিয়েতে এবং বোউভাতে দুই দিনই দারুন সাজিয়েছিল।”
বলতে বলতে লেখার বিউটিসিয়ান বান্ধবীর কথা মনে পরে গেল। দময়ন্তী ঘোষ, বারাসাতে বাড়ি, লেখার কলেজের বান্ধবী। মনামি অথবা লেখার মতন ফরসা না হলেও, কাঁচা গমের মতন রঙ, বেশ সুন্দরী, টানাটানা মিষ্টি চোখ জোড়া ভীষণ কথা বলে। লেখার মতন মুখ চোরা নয়, বেশ মিশুকে হাসিখুশি মেয়ে। ঝন্টুর বিয়ের সময়ে কাজের মধ্যে ভীষণ ভাবে ব্যাস্ত থাকায় দময়ন্তীর সাথে ঠিক ভাবে পরিচয় করতে পারেনি। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে চোখে চোখে অব্যাক্ত কিছু টুকরো শব্দ হয়ত ছড়িয়ে গিয়েছিল ওদের মাঝে, তবে সেটা ওই বোউভাতের দিন পর্যন্ত সীমিত ছিল। তারপরে কোনদিন অভি কোন রকম চেষ্টা করেনি দময়ন্তীর সাথে আলাপ পরিচয় করার।
ভুরু নাচিয়ে কৌতুক স্বরে জিজ্ঞেস ভাইকে করে, “কি রে শয়তান হারিয়ে গেলি নাকি রে? প্রেমট্রেম কবে করবি?”
দিদির কোলে মাথা গুঁজে বলে, “না রে ভাই সে গুড়ে বালি। দিমাগে অনেকে থাকে কিন্তু বুকের মাঝে কাউকে জায়গা দেব না।”
মনামি হেসে ফেলে, “আচ্ছা তাঁর মানে মাথায় কেউ আছে তাহলে।”
মাথা নাড়ায় অভি, সত্যি ওর জীবনে তেমন কেউ নেই। দময়ন্তী শুধু মাত্র সেই কটাদিন ওর মাথার মধ্যেই ছিল, বুকের মধ্যে ঠাই দেয়নি কোনমতে, “মাথায় থাকলে কি আর তুই জানতিস না নাকি।”
সত্যি কথা, এই সব ব্যাপারে মনামিকেই আগে জানাবে। মুচকি হেসে ভাইকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা বুঝলাম, তাহলে আমিই দিল্লী গিয়ে একটা সুন্দরী দেখে নিয়ে আসব।”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় অভি, “না রে দিদিভাই, পারব না। আমার সবকিছু বড়মা থেকে শুরু আর তোকে দিয়েই শেষ, এই দুজনার মাঝে আমি কাউকে আনছি না।” কথাটা শুনে কেঁদে ফেলে মনামি। “বাইরের লোক কি আর বুঝবে বড়মাকে, তোকে, আমাকে? কেউ বুঝবে না রে।”
ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলে, “আমি এই বিয়ে করব না। আমি কাল পাপাকে বলব দিল্লীতে আমি বিয়ে করব না। এই কোলকাতায় আমার জন্য যেন ছেলে খোঁজে।”
কান্না ভেজা কণ্ঠে দিদিকে বলে, “নারে না করিস নে। পাপা বড়মা দিদিভাই সবাই এই সম্বন্ধে ভীষণ খুশি। হয়ত শিতাভ্র ভালো ছেলেই হবে। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ একটা এডভেঞ্চার। তুই পা বাড়া আমি তোর পেছনে আছি।”
মনামি ভাইকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে, “তুই না একদম পাগল।”
মাঝ রাতে মাঝে মাঝে জল খেতে ওঠেন দীপাদেবী। ঘুম চোখে বিছানা থেকে উঠে বসে বসার ঘর থেকে আওয়াজ ভেসে আসতেই স্বচেতন হয়ে ওঠেন। চুপচাপ বসার ঘরে ঢুকে দেখে, মনামির কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অভি। ভাই আর বোনের এই টান দেখে চোখ দুটো জলে ভরে এলো। চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন তারপর চোখের কোল মুছতে মুছতে নিজের বিছানায় ফিরে গেলেন।
ডায়রির পাতা গুলো পাল্টাতে পাল্টাতে কখন যে সকাল হয়ে আসে তার খেয়াল থাকে না।