04-07-2020, 03:14 PM
(This post was last modified: 02-03-2021, 09:24 PM by kumdev. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
।।৪৫।।
সকাল সকাল সাজগোজ করে তৈরী হন গুলনার এহসান। শালোয়ার কামিজ পরেছে কমলা রঙের,গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে। নাদিয়া বেগম বলেন,শাড়ি পরবি না?
— একটা পরলেই হল। আমি তো মডেলিং করতে যাইতেছি না।
— সব সময় ব্যাকা ব্যাকা কথা। সুজা করে কথা বললি কি দোষ হয়?
মাকে জড়িয়ে ধরে হামি দিলেন গুলনার।
— এইসব তোমার বাপের লগে করো,আমারে ভুলাইতে পারবা না।
— এই সপ্তায় আসবো না,ঘর-দোর গুছাইতে হবে। পরের সপ্তা থিকা আসুম।
— তুমার আর আসনের দরকার কি?
গুলনার মনে মনে মজা পায়। তিনি জানেন মায়ের মুখের কথা আর মনের কথা আলাদা। আগের দিন গোছগাছ করা ছিল। ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরোবার আগে মাকে বলেন,আসি?
— জাহান্নামে যাও।
কথাটা নিজের কানে যেতে চমকে ওঠেন নাদিয়া বেগম। ‘তোবা তোবা’ এ তিনি কি কইলেন। গুলনার বুঝতে পারেন মায়ের অবস্থা,ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আল্লাপাক মায়ের মনের কথা বুঝতে পারে।
এতবড় একটা বিপর্যয় মেয়েটাকে কাবু করতে পারে নাই নাদিয়াবেগমের কাছে এইটা একটা রহস্য। এই উৎসাহ উদ্দিপনা লোক দেখানো নয়তো?
— মন্টি তুই আমারে কিছু লুকাইস না,আমি তোর মা। মা হইলে বুঝবি আমার অবস্থা।
— মা না-হইয়াও বুঝি মা।
— ছাই বুঝস।
মামুন তাগাদা দিলেন,আপু দেরী হইয়া যায়।
— এইটা হইছে দিদির চামচা। নাদিয়া বেগম বলেন।
ড.মামুন নিজে ড্রাইভ করেন। দিদি তার অত প্রিয়,তার মনে সর্বদা একটা শঙ্কা দিদির জীবনটা না নষ্ট হয়ে যায়। ভদ্রলোক দেখতে সুন্দর কিন্তু সেটাই কি সব? এসব আলোচনা দিদির সঙ্গে করতে পারে না পাছে দিদি আহত হয়। মাকেও বলতে পারেনা দিদির কশম। তবে সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ড.মামুন চুপ করে বসে থাকবেন না।
রহিমা বেগম পরিবেশন করছিলেন।মুমতাজ ছেলেকে কলেজ থেকে নিয়ে এসে বলল,মা আপনে সরেন।
রহিমা বেগম হাত ধুয়ে বলদেবের পাশে বসে বললেন,বাজান অত রাত অবধি কি পড়ো?
--এইবার আমারে পরীক্ষায় বসতে হবে আর সময় নাই।লাজুক গলায় বলল বলদেব।
--ঠাকুর-পো দিদিমণিরে পাইয়া আমাগো ভুইলা যাবেন নাতো?
--ভাবিজান আপনে মায়েরে ভুলতে পারছেন?
--খাওনের সময় এইসব কিকথা?রহিমা বেগম বিরক্ত হন।
হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে আলাপ হল। ডাক্তার রিয়াজের পরিচয় জেনে খুব খাতির করলেন ভদ্রমহিলা। সামান্য আলাপে বুঝতে বাকী থাকে না জীবিকার জন্য নয় শখ করে চাকরি করছেন গুলনার এহসান। প্রথম দিন কলেজে গুলানারের ভালই কাটল। আগের কলেজ থেকে এই কলেজের মান অনেক ভাল। সম্ভবত রাজধানী শহরের লাগোয়া একটা কারণ হতে পারে। গুলনার আর তিনটি মেয়ে ছাড়া বাকীরা বিবাহিতা। অবশ্য একঅর্থে গুলনারও বিবাহিতাদের দলে পড়ে। মামুন পৌছে দিয়ে গেছে। সেই একমাত্র তার আস্তানা চেনে। পরশুদিন ছুটি স্থানীয় এক পরব উপলক্ষ্যে। অন্যান্য চাকরির তুলনায় কলেজে এই এক সুবিধা। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে আছে। ভোরবেলা বেরিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। টুকটাক দুই-একটা জিনিস আনার থাকলেও আসল লক্ষ্য তার দেব।নুসরত বেচারী একা পারুলখালা আছে নাকি কাজ ছেড়ে দিয়েছে।তার জন্য অনেক করেছে নুসরত।
সকাল সকাল এসে হাজির হয় যাতে নুসরত অফিস যাবার আগে ধরতে পারে। দরজায় তালা বন্ধ। কি ব্যাপার এর মধ্যেই নুসরত অফিস চলে গেল? বন্ধ দরজার সামনে *য় ঢাকা মহিলাকে দেখে স্থানীয় একজন মহিলা জিজ্ঞেস করে,কাউরে খুজেন?
— এইখানে নুসরত জাহান থাকে– -।
— জ্বি তিনি থাকতেন আর একজন দিদিমণিও থাকতেন। তানারা আর থাকেন না।
দ্রুত সিদ্ধান্ত করেন গুলনার ডিএমের অফিসে গেলেই সব মীমাংসা হয়। অটোরিক্সায় উঠে ডিএমের বাংলো বলতে ছুটে চলে অটো। ঢুকতে গিয়ে বাধা,একজন সিপাই জিজ্ঞেস করে, কার কাছে আসছেন?
এইটা ডিএমের বাংলো তার কলেজ না এতক্ষনে খেয়াল হয়। গুলনার বলেন,বলদেব সোম।
— ও বলদা? একটু দাড়ান।
সিপাইয়ের মুখে বলদা শুনে খারাপ লাগে। ততক্ষনে বলদেব এসে জিজ্ঞেস করে,ম্যাডাম আপনি কারে চান?
নিজের বিবিরে চেনে না এইটা সত্যি বলদা। মুখে নেকাব সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন গুলনার। বলে কিনা ‘কারে চান। ‘
বলদেব দ্রুত অফিসে ঢুকে গেল। গুলনার অবাক হলেন,তিনি ঠিক দেখছেন তো? হ্যা ঠিকই দেখেছেন,আবার আগের মত পায়জামা পরে অফিসে এসেছেন,আউলানো চুল। কিন্তু পালালেন কেন ধন্দ্বে পড়ে যান। নজরে পড়ল হাসি মুখে নুসরত আসছে।
— কে মন্টি-দি? সিপাইজি ওনাকে স্যর ডাকছেন।
সিপাইরা সালাম করে পথ করে দিল। গুলনার কাছে গিয়ে নুসরতকে জিজ্ঞেস করে,দেব পালালেন কেন? চিনতে পারে নাই?
নুসরত মুখ টিপে হেসে বলে,নিজের বিবিরে চিনবেন না অত বোকা উনি নন। খুশিতে খবর দিতে আসছে স্যরকে। গুলনারের ফর্সা মুখে লালচে আভা দেখা যায়।
— তুই এখন কোথায় থাকিস?
— তাড়াতাড়িতে তোমারে খবর দিতে পারিনি। একা একা ঐখানে ভয় করছিল। তারপর ম্যামকে বলতে উনি কাছেই একটা ওয়ান রুম ফ্লাটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ভাড়াটা একটু বেশি কিন্তু রাস্তার ধারে অফিসের কাছে। এসো ভিতরে এসো।
— যাচ্ছি। তুই দেবকে একবার ডেকে দে তো। গুলনার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
একটু পরে মুখ কাচুমাচু করে বলদেব বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকায়। গুলনার ডাকে,এদিকে আসেন। আপনের প্যাণ্ট কই?
— বাসায় আছে। নিয়ে আসবো?
— বাসায় থাকলে হবে? ভাত হাড়িতে থাকলে পেট ভরবে?
— সেইটা ঠিক বলছো। আমি ভাবলাম পিয়নের পার্ট পিয়নের সাজই ভাল। অফিসারের সাজ হলে অন্যেরা বিব্রত হতে পারে।
গুলনার কি বলবে একথার উওর ভেবে পান না। গভীর কথা কত সহজ ভাবে বলে দেব। মুখে স্মিত হাসি টেনে গুলনার বলেন,পিয়নের কাজ করতে হবে না,আমি ঠিক করেছি আজই আপনাকে নিয়ে যাবো।
— সব তুমি ঠিক করবে?
— তাহলে কে করবে, আপনের স্যর?
— আমি কি সেই কথা বললাম?
— তবে আপনে কি বললেন?
— তুমিই সব ঠিক করবে। হয়েছে?
ডিএম সাহেবা বেরিয়ে আসতে ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। গুলনার লাজুক হেসে বললেন, সালাম ম্যডাম।
— আলেকুম সালাম,জীবনের সব কথা কি আজই সেরে নেবেন। ভিতরে আসেন।
ডিএম সাহেবার ঘরে ঢোকে সবাই।সুলতান সাহেব চোখবড় করে তাকিয়ে থাকেন। জেনিফার আলম নিজের জায়গায় বসে জিজ্ঞেস করেন,তারপর বলুন নতুন কলেজ কেমন লাগছে?
— খুব ভালো– আপনি আমার জন্য যা করেছেন কোনদিন ভুলবো না।
— একি মনের কথা নাকি সৌজন্য? কথাটা বলে জেনিফার হেসে উঠলেন।
গুলনার মাথা নীচু করে বসে থাকেন। জেনিফার বলেন,আরে না না ঠাট্টা করলাম। তা ম্যাডাম বলুকে এখানেই ফেলে রেখে যাবেন?
— জ্বি না, আজই নিয়ে যাবো বলে এসেছি।
— আজই? জেনিফারের মুখ ম্লান হয়ে গেল। তারপর বলদেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলু দাঁড়িয়ে কেন? তৈরী হয়ে নেও।
— আমি তৈরী স্যর।
— তোমার আম্মুরে বলবে না? এই পোষাকে শ্বশুর বাড়ি গেলে তানার মান থাকবে?
— সে কথাটাই আমি ভাবতেছি। অফিস থেকে ফিরে আম্মুকে কথাটা বলা উচিত।
— ফিরে না,এখনি যাও। রেডি হয়ে নুসরত বেগমের ফ্লাটে চলে এসো।
বলদেব বেরিয়ে গেল,সেদিকে তাকিয়ে থেকে জেনিফার আলম বলেন,যেন নিজেকে নিজেই বলছেন,সবাই নিজের ভাল চায়,নিজের কথা ভাবে। অন্যের কথা ভাবার ফুরসত নাই তাদের। আর এই মানুষটা অন্যের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথা ভাবার সময়ই পায়না। জানেন গুলনার, * দের বিশ্বাস গঙ্গার পানিতে শরীর পবিত্র হয়। সত্য-মিথ্যা জানিনা কিন্তু বলতে পারি এই মানুষটার সঙ্গ পেলে বাঁচার আশ্বাস ফিরে পাই।
ম্লান হাসি ফোটে জেনিফারের ঠোটে। তারপর উদাসভাবে বলেন,বলুর সঙ্গে আর দেখা হবে না। দোয়া করি আল্লাপাক আপনাদের সুখী করুক। আপনি ফিরে গিয়ে ওকে দিয়ে একটা চিঠি লিখে পাঠাবেন ডিএমকে এ্যাড্রেস করে চাকরি করবে না। পাওনা গণ্ডা কিছু থাকলে আমি পাঠিয়ে দেবো।
— জ্বি। গুলনার বলেন,ডিএম সাহেবার মুখে দেবের প্রশংসা তার শুনতে ভাল লাগে না। এই জন্যই তিনি সাত তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছেন।
নুসরতের ফ্লাট গুলনারের পছন্দ হয়। ছোট বেশ খোলামেলা। দেওয়ালে হেলানো রয়েছে তানপুরাটা। নুসরত জিজ্ঞেস করে, মন্টি-দি খালাম্মা শুনে কি বললেন?
— কি বলবে? মায়েরা যা করে– খুব কাঁদল। চাকরি করতেই দিতে চাইছিল না। বাপির চেষ্টায় শেষে সম্ভব হয়। বাইরে কে যেন কড়া নাড়ছে? মনে হয় দেব আসছেন?
নুসরত উঠে দরজা ঘেষে জিজ্ঞেস করে,কে-এ-এ?
বাইরে থেকে মহিলা কণ্ঠের সাড়া এল,আমরা দরজা খোলো।
না,এতো ডিএম সাহেবা না। তাহলে আবার কে এল? গুলনারের সঙ্গে চোখাচুখি হতে গুলনার উঠে জিজ্ঞেস করে, কে কারে চান?
— মন্টি আমি,দরজা খোলো।
গুলনার সরে গিয়ে নুসরতকে দরজা খুলতে ইশারা করেন। নুসরত দরজা খুলতে রহিমা বেগম ঢুকলেন,পিছনে দেব– একেবারে সাহেব।পোশাকের সঙ্গে বেমানান বগলদাবা করে একটা টিনের বাক্স।
গুলনার বেগমের রাগ হয় আবার হাসি পায়। কিছু বলার আগে একরাশ হেসে বলদেব বলে,আম্মু সাজায়ে দিয়েছে।
গুলনার হাসি চেপে রহিমা বেগমকে কদম বুসি করেন। সেই সঙ্গে নুসরতও। চিবুক স্পর্শ করে মনে মনে দোয়া করেন রহিমাবেগম। তারপর সোফায় বসে বলেন,শোনো মা, বলা আজকালকার মানুষের মত চালাক-চতুর না। অন্য রকম– পানির মত অর মন। তোমার পরে ভরসা করে দিলাম। ইচ্ছা ছিল চিরকাল আমার কাছে রেখে দেব। বলা বলে আম্মু ইচ্ছারে বেশী প্রশ্রয় দিতে নাই তাইলে মঙ্গল হয়না।
গুলনার জিজ্ঞেস করেন,এই বাক্সে কি আছে?
--আমার জরুরী জিনিসপ্ত্র।
--খোলেন দেখি জরুরী কি কি আছে?
গুলনার বাক্স হতে বই দরকারী কাগজ পত্র বের করে নিজের ট্রলি ব্যাগে ভরে বললেন,বাক্স নিতে হবে না।
ডিএম সাহেবা এসে তাগাদা দিলেন,আসুন গাড়ি এসে গেছে। ওরা নীচে নেমে এল। সায়েদ এসেছে মাকে নিয়ে যাবে। নীচে নেমে রহিমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,আচ্ছা মা তোমার বাপে কি করেন?
— আমি উনারে চিনি। ঢাকার রিয়াজডাক্তারের মেয়ে। উত্তর দিল সায়েদ।
— তুই চিনিস নাকি?
— না চিনিনা,উনার নাম সবাই জানে– নামকরা ডাক্তার। সায়েদ বলে।
বলদেব রহিমা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাড়াতে রহিমা বেগম বুকে চেপে ধরেন।জেনিফার অবাক হয়ে দেখেন বলু তো মহিলার নিজের ছেলে নয় রক্ত সম্পর্কেরও কেউ নয় তাহলে এত মায়া?এক সময় ব্লুকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, এই বেটা নিজে কান্দে না,সবাইরে কাঁদায়। রহিমা বেগমের গলা ধরে আসে।
গাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে। প্লাট ফর্মে বেশ ভীড়। জেনিফার আলমের কাছে এসে বলদেব বলে,স্যর আসি?
— দরকার পড়লে যোগাযোগ করবে। আমি ঢাকায় গেলে দেখা হবে। ট্রেন ঢুকতে একহাতে বাধার সৃষ্টি করে গুলনারকে উঠতে সাহায্য করে বলদেব। কে একজন ঝেঝে ওঠে,আরে মিঞা হাত সরান না। উঠতে দিবেন তো?
গুলনার উঠে জায়গা পেয়ে যায়। বলদেব উঠে দ্রুত গুলনারের পাশে বসে পড়ে। ট্রেন ছেড়েদিল। গুলনার দেবের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে হাসেন। বিবির গায়ে কারও ছোয়া লাগতে দেবে না।
ফ্লাটে পৌছাল তখন রাত প্রায় সাড়ে-নটা। গুলনার টাকা দিয়ে বলেন,নীচে হোটেল আছে দুইজনের খাবার নিয়ে আসেন।
সুন্দর করে বলদেবের বিছানা করে দিলেন। অন্য ঘরে নিজের বিছানা করলেন। আজ থেকে শুরু হল স্বামী-স্ত্রীর নতুন জীবন। রাতের খাবার খেয়ে গুলনার বলেন,আপন এইখানে শোবেন আর আমি পাশের ঘরে।
— আমি তোমারে দেখতে পাবো না?
— যতক্ষন জাগনো থাকবেন দেখতে পাবেন। আপনে শুয়ে পড়েন।
বলদেব শুয়ে পড়ে,গুলনার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়। হঠাৎ নজরে পড়ে বদেবের চোখ থেকে পানি পড়ে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,কাদছেন কেন?
বলদেব হেসে বলে,কাদি না। মায়ের কথা মনে পড়ল। আমার মাও এইভাবে ঘুম পাড়াতো।
গুলনারের বুকে শীতল শিহরন অনুভুত হয়।
সকাল সকাল সাজগোজ করে তৈরী হন গুলনার এহসান। শালোয়ার কামিজ পরেছে কমলা রঙের,গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে। নাদিয়া বেগম বলেন,শাড়ি পরবি না?
— একটা পরলেই হল। আমি তো মডেলিং করতে যাইতেছি না।
— সব সময় ব্যাকা ব্যাকা কথা। সুজা করে কথা বললি কি দোষ হয়?
মাকে জড়িয়ে ধরে হামি দিলেন গুলনার।
— এইসব তোমার বাপের লগে করো,আমারে ভুলাইতে পারবা না।
— এই সপ্তায় আসবো না,ঘর-দোর গুছাইতে হবে। পরের সপ্তা থিকা আসুম।
— তুমার আর আসনের দরকার কি?
গুলনার মনে মনে মজা পায়। তিনি জানেন মায়ের মুখের কথা আর মনের কথা আলাদা। আগের দিন গোছগাছ করা ছিল। ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরোবার আগে মাকে বলেন,আসি?
— জাহান্নামে যাও।
কথাটা নিজের কানে যেতে চমকে ওঠেন নাদিয়া বেগম। ‘তোবা তোবা’ এ তিনি কি কইলেন। গুলনার বুঝতে পারেন মায়ের অবস্থা,ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আল্লাপাক মায়ের মনের কথা বুঝতে পারে।
এতবড় একটা বিপর্যয় মেয়েটাকে কাবু করতে পারে নাই নাদিয়াবেগমের কাছে এইটা একটা রহস্য। এই উৎসাহ উদ্দিপনা লোক দেখানো নয়তো?
— মন্টি তুই আমারে কিছু লুকাইস না,আমি তোর মা। মা হইলে বুঝবি আমার অবস্থা।
— মা না-হইয়াও বুঝি মা।
— ছাই বুঝস।
মামুন তাগাদা দিলেন,আপু দেরী হইয়া যায়।
— এইটা হইছে দিদির চামচা। নাদিয়া বেগম বলেন।
ড.মামুন নিজে ড্রাইভ করেন। দিদি তার অত প্রিয়,তার মনে সর্বদা একটা শঙ্কা দিদির জীবনটা না নষ্ট হয়ে যায়। ভদ্রলোক দেখতে সুন্দর কিন্তু সেটাই কি সব? এসব আলোচনা দিদির সঙ্গে করতে পারে না পাছে দিদি আহত হয়। মাকেও বলতে পারেনা দিদির কশম। তবে সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ড.মামুন চুপ করে বসে থাকবেন না।
রহিমা বেগম পরিবেশন করছিলেন।মুমতাজ ছেলেকে কলেজ থেকে নিয়ে এসে বলল,মা আপনে সরেন।
রহিমা বেগম হাত ধুয়ে বলদেবের পাশে বসে বললেন,বাজান অত রাত অবধি কি পড়ো?
--এইবার আমারে পরীক্ষায় বসতে হবে আর সময় নাই।লাজুক গলায় বলল বলদেব।
--ঠাকুর-পো দিদিমণিরে পাইয়া আমাগো ভুইলা যাবেন নাতো?
--ভাবিজান আপনে মায়েরে ভুলতে পারছেন?
--খাওনের সময় এইসব কিকথা?রহিমা বেগম বিরক্ত হন।
হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে আলাপ হল। ডাক্তার রিয়াজের পরিচয় জেনে খুব খাতির করলেন ভদ্রমহিলা। সামান্য আলাপে বুঝতে বাকী থাকে না জীবিকার জন্য নয় শখ করে চাকরি করছেন গুলনার এহসান। প্রথম দিন কলেজে গুলানারের ভালই কাটল। আগের কলেজ থেকে এই কলেজের মান অনেক ভাল। সম্ভবত রাজধানী শহরের লাগোয়া একটা কারণ হতে পারে। গুলনার আর তিনটি মেয়ে ছাড়া বাকীরা বিবাহিতা। অবশ্য একঅর্থে গুলনারও বিবাহিতাদের দলে পড়ে। মামুন পৌছে দিয়ে গেছে। সেই একমাত্র তার আস্তানা চেনে। পরশুদিন ছুটি স্থানীয় এক পরব উপলক্ষ্যে। অন্যান্য চাকরির তুলনায় কলেজে এই এক সুবিধা। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে আছে। ভোরবেলা বেরিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। টুকটাক দুই-একটা জিনিস আনার থাকলেও আসল লক্ষ্য তার দেব।নুসরত বেচারী একা পারুলখালা আছে নাকি কাজ ছেড়ে দিয়েছে।তার জন্য অনেক করেছে নুসরত।
সকাল সকাল এসে হাজির হয় যাতে নুসরত অফিস যাবার আগে ধরতে পারে। দরজায় তালা বন্ধ। কি ব্যাপার এর মধ্যেই নুসরত অফিস চলে গেল? বন্ধ দরজার সামনে *য় ঢাকা মহিলাকে দেখে স্থানীয় একজন মহিলা জিজ্ঞেস করে,কাউরে খুজেন?
— এইখানে নুসরত জাহান থাকে– -।
— জ্বি তিনি থাকতেন আর একজন দিদিমণিও থাকতেন। তানারা আর থাকেন না।
দ্রুত সিদ্ধান্ত করেন গুলনার ডিএমের অফিসে গেলেই সব মীমাংসা হয়। অটোরিক্সায় উঠে ডিএমের বাংলো বলতে ছুটে চলে অটো। ঢুকতে গিয়ে বাধা,একজন সিপাই জিজ্ঞেস করে, কার কাছে আসছেন?
এইটা ডিএমের বাংলো তার কলেজ না এতক্ষনে খেয়াল হয়। গুলনার বলেন,বলদেব সোম।
— ও বলদা? একটু দাড়ান।
সিপাইয়ের মুখে বলদা শুনে খারাপ লাগে। ততক্ষনে বলদেব এসে জিজ্ঞেস করে,ম্যাডাম আপনি কারে চান?
নিজের বিবিরে চেনে না এইটা সত্যি বলদা। মুখে নেকাব সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন গুলনার। বলে কিনা ‘কারে চান। ‘
বলদেব দ্রুত অফিসে ঢুকে গেল। গুলনার অবাক হলেন,তিনি ঠিক দেখছেন তো? হ্যা ঠিকই দেখেছেন,আবার আগের মত পায়জামা পরে অফিসে এসেছেন,আউলানো চুল। কিন্তু পালালেন কেন ধন্দ্বে পড়ে যান। নজরে পড়ল হাসি মুখে নুসরত আসছে।
— কে মন্টি-দি? সিপাইজি ওনাকে স্যর ডাকছেন।
সিপাইরা সালাম করে পথ করে দিল। গুলনার কাছে গিয়ে নুসরতকে জিজ্ঞেস করে,দেব পালালেন কেন? চিনতে পারে নাই?
নুসরত মুখ টিপে হেসে বলে,নিজের বিবিরে চিনবেন না অত বোকা উনি নন। খুশিতে খবর দিতে আসছে স্যরকে। গুলনারের ফর্সা মুখে লালচে আভা দেখা যায়।
— তুই এখন কোথায় থাকিস?
— তাড়াতাড়িতে তোমারে খবর দিতে পারিনি। একা একা ঐখানে ভয় করছিল। তারপর ম্যামকে বলতে উনি কাছেই একটা ওয়ান রুম ফ্লাটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ভাড়াটা একটু বেশি কিন্তু রাস্তার ধারে অফিসের কাছে। এসো ভিতরে এসো।
— যাচ্ছি। তুই দেবকে একবার ডেকে দে তো। গুলনার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
একটু পরে মুখ কাচুমাচু করে বলদেব বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকায়। গুলনার ডাকে,এদিকে আসেন। আপনের প্যাণ্ট কই?
— বাসায় আছে। নিয়ে আসবো?
— বাসায় থাকলে হবে? ভাত হাড়িতে থাকলে পেট ভরবে?
— সেইটা ঠিক বলছো। আমি ভাবলাম পিয়নের পার্ট পিয়নের সাজই ভাল। অফিসারের সাজ হলে অন্যেরা বিব্রত হতে পারে।
গুলনার কি বলবে একথার উওর ভেবে পান না। গভীর কথা কত সহজ ভাবে বলে দেব। মুখে স্মিত হাসি টেনে গুলনার বলেন,পিয়নের কাজ করতে হবে না,আমি ঠিক করেছি আজই আপনাকে নিয়ে যাবো।
— সব তুমি ঠিক করবে?
— তাহলে কে করবে, আপনের স্যর?
— আমি কি সেই কথা বললাম?
— তবে আপনে কি বললেন?
— তুমিই সব ঠিক করবে। হয়েছে?
ডিএম সাহেবা বেরিয়ে আসতে ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। গুলনার লাজুক হেসে বললেন, সালাম ম্যডাম।
— আলেকুম সালাম,জীবনের সব কথা কি আজই সেরে নেবেন। ভিতরে আসেন।
ডিএম সাহেবার ঘরে ঢোকে সবাই।সুলতান সাহেব চোখবড় করে তাকিয়ে থাকেন। জেনিফার আলম নিজের জায়গায় বসে জিজ্ঞেস করেন,তারপর বলুন নতুন কলেজ কেমন লাগছে?
— খুব ভালো– আপনি আমার জন্য যা করেছেন কোনদিন ভুলবো না।
— একি মনের কথা নাকি সৌজন্য? কথাটা বলে জেনিফার হেসে উঠলেন।
গুলনার মাথা নীচু করে বসে থাকেন। জেনিফার বলেন,আরে না না ঠাট্টা করলাম। তা ম্যাডাম বলুকে এখানেই ফেলে রেখে যাবেন?
— জ্বি না, আজই নিয়ে যাবো বলে এসেছি।
— আজই? জেনিফারের মুখ ম্লান হয়ে গেল। তারপর বলদেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলু দাঁড়িয়ে কেন? তৈরী হয়ে নেও।
— আমি তৈরী স্যর।
— তোমার আম্মুরে বলবে না? এই পোষাকে শ্বশুর বাড়ি গেলে তানার মান থাকবে?
— সে কথাটাই আমি ভাবতেছি। অফিস থেকে ফিরে আম্মুকে কথাটা বলা উচিত।
— ফিরে না,এখনি যাও। রেডি হয়ে নুসরত বেগমের ফ্লাটে চলে এসো।
বলদেব বেরিয়ে গেল,সেদিকে তাকিয়ে থেকে জেনিফার আলম বলেন,যেন নিজেকে নিজেই বলছেন,সবাই নিজের ভাল চায়,নিজের কথা ভাবে। অন্যের কথা ভাবার ফুরসত নাই তাদের। আর এই মানুষটা অন্যের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথা ভাবার সময়ই পায়না। জানেন গুলনার, * দের বিশ্বাস গঙ্গার পানিতে শরীর পবিত্র হয়। সত্য-মিথ্যা জানিনা কিন্তু বলতে পারি এই মানুষটার সঙ্গ পেলে বাঁচার আশ্বাস ফিরে পাই।
ম্লান হাসি ফোটে জেনিফারের ঠোটে। তারপর উদাসভাবে বলেন,বলুর সঙ্গে আর দেখা হবে না। দোয়া করি আল্লাপাক আপনাদের সুখী করুক। আপনি ফিরে গিয়ে ওকে দিয়ে একটা চিঠি লিখে পাঠাবেন ডিএমকে এ্যাড্রেস করে চাকরি করবে না। পাওনা গণ্ডা কিছু থাকলে আমি পাঠিয়ে দেবো।
— জ্বি। গুলনার বলেন,ডিএম সাহেবার মুখে দেবের প্রশংসা তার শুনতে ভাল লাগে না। এই জন্যই তিনি সাত তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছেন।
নুসরতের ফ্লাট গুলনারের পছন্দ হয়। ছোট বেশ খোলামেলা। দেওয়ালে হেলানো রয়েছে তানপুরাটা। নুসরত জিজ্ঞেস করে, মন্টি-দি খালাম্মা শুনে কি বললেন?
— কি বলবে? মায়েরা যা করে– খুব কাঁদল। চাকরি করতেই দিতে চাইছিল না। বাপির চেষ্টায় শেষে সম্ভব হয়। বাইরে কে যেন কড়া নাড়ছে? মনে হয় দেব আসছেন?
নুসরত উঠে দরজা ঘেষে জিজ্ঞেস করে,কে-এ-এ?
বাইরে থেকে মহিলা কণ্ঠের সাড়া এল,আমরা দরজা খোলো।
না,এতো ডিএম সাহেবা না। তাহলে আবার কে এল? গুলনারের সঙ্গে চোখাচুখি হতে গুলনার উঠে জিজ্ঞেস করে, কে কারে চান?
— মন্টি আমি,দরজা খোলো।
গুলনার সরে গিয়ে নুসরতকে দরজা খুলতে ইশারা করেন। নুসরত দরজা খুলতে রহিমা বেগম ঢুকলেন,পিছনে দেব– একেবারে সাহেব।পোশাকের সঙ্গে বেমানান বগলদাবা করে একটা টিনের বাক্স।
গুলনার বেগমের রাগ হয় আবার হাসি পায়। কিছু বলার আগে একরাশ হেসে বলদেব বলে,আম্মু সাজায়ে দিয়েছে।
গুলনার হাসি চেপে রহিমা বেগমকে কদম বুসি করেন। সেই সঙ্গে নুসরতও। চিবুক স্পর্শ করে মনে মনে দোয়া করেন রহিমাবেগম। তারপর সোফায় বসে বলেন,শোনো মা, বলা আজকালকার মানুষের মত চালাক-চতুর না। অন্য রকম– পানির মত অর মন। তোমার পরে ভরসা করে দিলাম। ইচ্ছা ছিল চিরকাল আমার কাছে রেখে দেব। বলা বলে আম্মু ইচ্ছারে বেশী প্রশ্রয় দিতে নাই তাইলে মঙ্গল হয়না।
গুলনার জিজ্ঞেস করেন,এই বাক্সে কি আছে?
--আমার জরুরী জিনিসপ্ত্র।
--খোলেন দেখি জরুরী কি কি আছে?
গুলনার বাক্স হতে বই দরকারী কাগজ পত্র বের করে নিজের ট্রলি ব্যাগে ভরে বললেন,বাক্স নিতে হবে না।
ডিএম সাহেবা এসে তাগাদা দিলেন,আসুন গাড়ি এসে গেছে। ওরা নীচে নেমে এল। সায়েদ এসেছে মাকে নিয়ে যাবে। নীচে নেমে রহিমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,আচ্ছা মা তোমার বাপে কি করেন?
— আমি উনারে চিনি। ঢাকার রিয়াজডাক্তারের মেয়ে। উত্তর দিল সায়েদ।
— তুই চিনিস নাকি?
— না চিনিনা,উনার নাম সবাই জানে– নামকরা ডাক্তার। সায়েদ বলে।
বলদেব রহিমা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাড়াতে রহিমা বেগম বুকে চেপে ধরেন।জেনিফার অবাক হয়ে দেখেন বলু তো মহিলার নিজের ছেলে নয় রক্ত সম্পর্কেরও কেউ নয় তাহলে এত মায়া?এক সময় ব্লুকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, এই বেটা নিজে কান্দে না,সবাইরে কাঁদায়। রহিমা বেগমের গলা ধরে আসে।
গাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে। প্লাট ফর্মে বেশ ভীড়। জেনিফার আলমের কাছে এসে বলদেব বলে,স্যর আসি?
— দরকার পড়লে যোগাযোগ করবে। আমি ঢাকায় গেলে দেখা হবে। ট্রেন ঢুকতে একহাতে বাধার সৃষ্টি করে গুলনারকে উঠতে সাহায্য করে বলদেব। কে একজন ঝেঝে ওঠে,আরে মিঞা হাত সরান না। উঠতে দিবেন তো?
গুলনার উঠে জায়গা পেয়ে যায়। বলদেব উঠে দ্রুত গুলনারের পাশে বসে পড়ে। ট্রেন ছেড়েদিল। গুলনার দেবের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে হাসেন। বিবির গায়ে কারও ছোয়া লাগতে দেবে না।
ফ্লাটে পৌছাল তখন রাত প্রায় সাড়ে-নটা। গুলনার টাকা দিয়ে বলেন,নীচে হোটেল আছে দুইজনের খাবার নিয়ে আসেন।
সুন্দর করে বলদেবের বিছানা করে দিলেন। অন্য ঘরে নিজের বিছানা করলেন। আজ থেকে শুরু হল স্বামী-স্ত্রীর নতুন জীবন। রাতের খাবার খেয়ে গুলনার বলেন,আপন এইখানে শোবেন আর আমি পাশের ঘরে।
— আমি তোমারে দেখতে পাবো না?
— যতক্ষন জাগনো থাকবেন দেখতে পাবেন। আপনে শুয়ে পড়েন।
বলদেব শুয়ে পড়ে,গুলনার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়। হঠাৎ নজরে পড়ে বদেবের চোখ থেকে পানি পড়ে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,কাদছেন কেন?
বলদেব হেসে বলে,কাদি না। মায়ের কথা মনে পড়ল। আমার মাও এইভাবে ঘুম পাড়াতো।
গুলনারের বুকে শীতল শিহরন অনুভুত হয়।