03-07-2020, 11:42 AM
পর্ব এক। ডায়রির পাতা (#2-#2)
মুষলধার বর্ষা ওর রেনকোট কে হারিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ কাকভেজা করে ছাড়ল। বাড়িতে ঢোকার আগে একটা সিগারেট খেলে বড় ভালো হত, কিন্তু পকেট হাতড়ে দেখল যে সিগারেট প্যাকেট ভিজে চুপসা হয়ে গেছে। হরিদার দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিল, সেই সাথে একটা সিগারেট ধরাল অভি। শনিবারের দিন, শহরতলী এলাকা, এই বৃষ্টিতে দুপুরে রাস্তায় লোকজন বেশ কম। সবাই হয়ত বাড়িতে ইলিশ ভাজা আর সোনা মুগের খিচুড়ি খেতে ব্যাস্ত। সিগারেটটা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ির দিকে পা না বাড়ালে ওর কপালে অনেক দুঃখ।
বাইকে স্টারট দিতে যাবে ঠিক তখন ওর পিঠে এক থাবর দিল কেউ, “তুই শালা এইখানে সিগারেট মারছিস।” পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে ওর মামাত দাদা, অরিন্দম ছাতা মাথায় আর হাতে দইয়ের হাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
অভি হেসে বলে, “আরে ঝন্টুদা, তোরা কখন এলি?”
অভির পেছনে উঠে বসল ঝন্টু, বাইকে বসে উত্তর দিল, “এই একটু আগেই এসেছি, বাবা মা ও এসেছে।”
অভি ঘাড় বেকিয়ে শয়তানি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে, “মেরে দিল কা টুকরা আয়ি ক্যা? (আমার বুকের টুকরো কি এসেছে?)”
বাইকের পেছনে এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে দইয়ের হাড়ি নিয়ে বসতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ঝন্টুকে। তাও অভির মশকরার উত্তরে কপট ঝাঝিয়ে ওঠে, “শালা তুই নিজেরটা খুঁজে নে না, আমার পাতে এত নজর কেন তোর?”
বলেই দুই ভাই হাহা করে হেসে ফেলে। মামা নরেন্দ্রনাথের নৈহাটিতে খুব বড় কাপড়ের দোকান ধনী ব্যাবসায়ি, নৈহাটির নামকরা একজন ব্যাক্তি। অরিন্দম বিশেষ পড়াশুনা করেনি, কোনমতে স্নাতক হয়েই বাবার দোকানে বসে গিয়েছিল। অভির “দিল কা টুকরা” অর্থাৎ অরিন্দমের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী স্বাতিলেখার কথা হচ্ছিল। কলেজ শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেছে স্বাতিলেখার, অভির চেয়ে বয়সে দুই বছরের ছোট এবং সম্পর্কে বউদি তাই খুব পেছনে লাগে অভি। স্বাতিলেখা একটু মুখচোরা লাজুক স্বভাবের মেয়ে তার জন্য অভি আরো বেশি করে স্বাতিলেখার পেছনে লাগে। বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটাতে বড্ড কাদা, বারেবারে বাইকের চাকা ডুবে যায়, এমত অবস্থায় বাইক চালান খুব মুশকিল, তাও কোনোরকমে বাড়ি পউছাল দুইজনে।
মনামি বাইকের আওয়াজ শুনে বারান্দায় দৌড়ে এসে নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “মাগো, তোমার বাঁদর কাক ভেজা হয়ে এসেছে।”
ঝন্টু পেছন মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে, “আমিও কিন্তু এসেছি সেটা দেখতে পাচ্ছিস না?”
মনামি ঝন্টুর উদ্দেশ্যে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “ভাগ কুত্তা, তুই এই বেরিয়েছিস আর ভাই অনেক আগে বেড়িয়েছে।” অভির ভিজে চুলগুলো আরো এলোমেলো করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, “তুই না বড্ড শয়তান ছেলে জানিস।” দিদির দিকে একভাবে তাকিয়ে মাথা দুলায় অভি। “তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নে তারপরে অনেক কাজ আছে।”
বসার ঘরে ঢোকা মাত্রই চোখ গেল সোফার দিকে। জেঠু আর মামা বসে গম্ভীর আলোচনায় ব্যাস্ত। ওদের দেখতে পেয়ে প্রনবেশ বাবু গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন, “চাটুজ্যে বাবুর এখন সময় হল বাড়ি আসার? কবে তোর কান্ডজ্ঞান হবে বলত। কাজের নামে কিছু নেই সব সময়ে শুধু গায়ে হাওয়া...”
দীপাদেবী পেছন থেকে স্বামীর উদ্দেশ্যে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “আরে বাবা, ছেলেটা কাকভেজা হয়ে এসেছে আর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই তোমার জ্ঞান দেওয়া শুরু।” অভির উদ্দেশ্যে কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, “যা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফেল এই ভিজে জামা কাপড় পরে থাকলে আবার জ্বর আসবে।”
এমন সময়ে ওর কানে ভেসে আসে মধুর ছন্দের নুপুরের নিক্কন। অভি চোখ নাচিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে এই ধ্বনির আসল মালকিন কোথায়। মনামি দুষ্টুমি মাখানো হাসি দিয়ে নিজের ঘর দেখিয়ে দেয়। চুপিচুপি দিদির ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে লেখা জানালার বাইরে একভাবে তাকিয়ে পা নাচিয়ে এক মনে কোন এক অজানা সুর গুনগুন করে চলেছে। কচি গোলাপের মতন মিষ্টি দেখতে স্বাতিলেখা, এখন ওর নধর কচি দেহ থেকে বিয়ের গন্ধ ঠিক ভাবে যায়নি। অভির চকচকে চোখ দেখে ঝন্টু প্রমাদ গোনে, এই বুঝি ওর স্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পরল।
কারুর কিছু বলার আগেই অভি জামা খুলে চুপিসারে পেছন থেকে লেখা কে জড়িয়ে ধরে গেয়ে ওঠে, “তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত...”
অকস্মাত এই আক্রমনে কেঁপে ওঠে লেখা, ছটফটিয়ে ওঠে অভির কঠিন বাহুপাশে। কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি না সত্যি পারো বটে, ছাড় প্লিস ছাড়...”
ঝন্টু ততক্ষনে রান্নাঘরে দইয়ের ভাড় রেখে এসে গেছে। অভির দিকে দাঁত কিরমির করে তাকিয়ে বলে, “তুই শালা ছাড় আমার বউকে না হলে তোর টা কেটে দেব।”
হেসে ফেলে অভি, ঝন্টুর চোখে চোখ রেখে লেখার নরম ফরসা গালে নিজের দাড়ি না কামানো গাল ঘষে উত্যক্ত করে তোলে, “দেখ দেখ তোর বউ কেমন লাল হয়ে গেছে, তুইত শালা মাকাল ফল।”
মনামি ওদের কান্ড কারখানা দেখে হিহি করে হেসে ফেলে। দরজায় দাঁড়িয়ে দীপাদেবী ছেলের উদ্দেশ্যে বলে, “যা বাবা, তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নে” জেঠিমার গলা কানে যেতেই লেখাকে ছেড়ে দাঁড়ায় অভি। “এখন সবাই না খেয়ে বসে আছে।” ভীষণ লজ্জায় পরে যায় লেখা, এক দৌড়ে স্বামীর পেছনে লুকিয়ে যায়।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে জেঠিমার পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ভুরু নাচিয়ে দিদিকে নিজের ঘরে আসার জন্য ইশারা করে। মনামিও ভাইয়ের পেছন পেছন ওর ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ভিজে জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ভাই বোনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। কথায় কথায় অভি জানতে পারে, যে আজকে দিদিকে শিতাভ্র দেখতে আসবে না, শিতাভ্রর বাবা এবং আরো কয়েকজন অবিভাবক গোচরের লোক। দিদিভাই মুম্বাই থেকে দুই সপ্তাহ পরে আসবে, সেই সময়ে শিতাভ্র অফিসের ছুটি নিয়ে দি দুয়েকের জন্য এসে দেখা করে যাবে। মনামিকে নাকি ওদের আগে থেকেই পছন্দ, দশ বছর আগে শর্বাণীর বিয়ের সময় নাকি ওদের বাড়ির লোক ঠিক করে নিয়েছিল যে এই বাড়ি থেকেই বউমা আসবে। এবারের দেখতে আসাটা শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিক। গতকাল সারা রাত এক অজানা অনুভুতি নিয়ে ঘুমাতে পারেনি মনামি। বাথরুমে ঢুকে কোনমতে মাথায় দুমগ জল ঢেলে বেড়িয়ে এলো অভি। মাথা মুছতে মুছতে দিদির কথা শুনে যায়। অনেক দুরের এক অজানা অচেনা দিগন্ত, বুকের ধুকপুকানি মাঝে মাঝেই সেই অজানা দিগন্তের আভাস মনে করে থেমে যায়। ভেবেছিল এই শহরেই কোথাও বিয়ে হবে, বাড়ির কাছাকাছি থাকবে, যখন তখন বাড়ি এসে মাকে, ভাইকে জ্বালাতন করতে পারবে। ওর কোন অসুবিধে হলে ওর ভাই এক দৌড়ে ওর কাছে চলে যেতে পারবে। স্বপ্নেও ভাবেনি যে সবাইকে ছেড়ে একদিন এতদুর যেতে হবে। দিদির ছলছল চোখের ভাষা এক অব্যাক্ত বেদনা ডেকে আনে অভির বুকে। অভির চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই, সেটা দুইজনেই ভালোভাবে জানে। কথা গুলো বলার পর মনামির মনে হল যেন বুকের ওপর থেকে গত রাত থেকে যে ভারটা ছিল সেটা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে।
অভি দিদির দিকে এগিয়ে এসে কপালে কপাল ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরে, “চিন্তা করিস না, আমি আছি ত।”
“চিন্তা করিস না, আমি আছি ত” ছোট একটা বাক্য বুকে অনেক বল জুগিয়ে দেয়। সেই ছোটবেলা থেকে ভাই বোন একে অপরের সব কিছুতেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়মা’র কাছে মার খাওয়া থেকে, পাপার কাছে বকুনি খাওয়ার সময়, কিম্বা কলেজে কিছু হলে অথবা দিদিভাইয়ের সাথে ঝগড়া হওয়ার সময়ে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করে ওঠে মনামির, নাকের পাটা ফুলে ওঠে ভাইয়ের কথা শুনে। ম্লান ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বলে, “একটা বাজে, চল খেয়ে নিবি।”
ততক্ষনে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। মামা জেঠু ঝন্টুদা, সবাই খাবার টেবিলে বসে ছিল অভির অপেক্ষায়। এই বাড়ির নিয়ম, পুরুষের সাথে মহিলারা খেতে বসে না। পুরুষের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরেই মহিলারা খেতে বসেন। তবে অভি কোনদিন ওর জেঠুর সাথে খেতে বসত না, বরাবর দিদির সাথেই খেতে বসেছে। ওর জন্য বাকি সবাইকে অপেক্ষারত দেখে তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেল। খেতে খেতে জানতে পারল যে শিতাভ্রর বাড়ি থেকে ওর বাবা, কাকা আর এক মামা আসবেন মনামিকে দেখতে। খাওয়ার পরে অভির খুব ইচ্ছে ছিল দিদির সাথে, ঝন্টুদার সাথে, লেখার সাথে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারতে, কিন্তু জেঠুর ডাক পরাতে গুড়ে বালি পরে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষে জেঠু অভিকে বসার ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। প্রমাদ গুনল মনে মনে, মনামির বুক ও সমান তালে ঢিপঢিপ করতে শুরু করে দিল।
কাউচে বসে অভির দিকে তাকিয়ে প্রনবেশ বাবু বললেন, “দেখ বাবা, আমার বয়সে হয়েছে, এই সেপ্টেম্বরে আমি রিটায়ার করব, এইবার ত বাড়ির কথা একটু চিন্তা কর।” জেঠুর এই কণ্ঠস্বর এর আগে কোনদিন শোনেনি অভি। নির্বাক হয়ে গেল গুরু গম্ভীর মানুষটির ভেতরের মানুষটাকে দেখে। “বাড়ির একমাত্র ছেলে, এইবারে একটু দায় দায়িত্ব নেওয়া শুরু কর। বয়স ত কম হল না, পড়াশুনা কম করিস নি, জ্ঞান বুদ্ধি সবকিছুই আছে তোর কাছে।”
চুপ করে থাকে অভি, চাকরি করবে না সেটা একদম নয়। এইভাবে বসে থাকতে ওর নিজের ভালো লাগে না, কিন্তু যা চাকরির অফার আসে, সব কোলকাতার বাইরে, দিল্লী, না হয় ব্যাঙ্গালোর, না হয় পুনে, না হয় হায়দেরাবাদ। পাপাকে ছেড়ে, বড়মাকে ছেড়ে যেতে নারাজ।
অভি শুধু ছোট একটা উত্তর দেয়, “আচ্ছা ঠিক আছে, চাকরি খুঁজব।”
অভির উত্তর শুনে প্রনবেশ বাবু খানিকটা আসস্থ হন। কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে শুরু করেন, “মছলন্দপুরের জমিটা বিক্রি করে দেব ভাবছি। কাল একবার আমার সাথে মছলন্দপুর যাস।”
প্রশ্ন করে অভি, “কেন, ওটাতে ত বেশ আম বাগান আছে, হটাত বিক্রি করবে কেন?”
কণ্ঠস্বর নামিয়ে নিয়ে এলেন প্রনবেশ বাবু, “তোর দিদির বিয়ের একটা খরচা ত আছে। কিছু না চাইলেও, কিছু ত দিতেই হবে।”
চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল অভির, “পাপা, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? এখন ওরা ত দেখতেও আসেনি তার আগেই এত জল্পনা কল্পনা করে কি লাভ।”
ম্লান হাসি দিলেন প্রনবেশ বাবু, “তৈরি না থাকলে কি করে চলবে বল। বারাসাতে বিঘা পনেরো ধানা জমি, ঐ আম বাগান আর এই ভিটে বাড়ি ছাড়া আর ত কিছু নেই আমার।” কিছুক্ষন থেমে বললেন, “এরপর অনেক কাজ আছে, তোর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব আসবে সেইগুল নিতে চেষ্টা কর।” মাথা দুলিয়ে অভি জানিয়ে দিল, সব রকমের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। “আমি চোখ বোজার আগে এইযে জমি জমা গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে গুলোর ব্যাবস্থা করে যাবো। এমনিতেই তুই এই সব ব্যাপারে কোনদিন কিছু দেখিস নি তাই এইসব রেখে কি লাভ বল।”
অভি ক্ষুন্ন মনে উত্তর দেয়, “পড়াশুনা করতে বাইরে পাঠিয়ে দিলে না হলে এই মধ্যমগ্রামেই থাকতাম আর সবকিছু দেখাশোনা করতাম। আমি ত চাইনি পাপা বাইরে যেতে।”
মাথা দোলান প্রনবেশ বাবু, “তুই যখন বললি, তাহলে আজকে একটা কথা তোকে বলি।” খানিকক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভেবে আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি সরকারি চাকরি করি আর এই জমি জমা। তোর আর মনির মাথা পড়াশুনায় খুব ভালো, আমার খুব খারাপ লাগত যে হয়ত তোদের বেশি পড়াতে পারব না। তোর ইঞ্জিনিয়ারিং এমবিএ পড়ার টাকা আর মনির হাইয়ার পড়াশুনার সব টাকা কিন্তু দেবাশিস দিয়েছে।” বুক ভরে শ্বাস নিলেন প্রনবেশ বাবু, অনেকদিনের জমানো এই কথাটা বুক থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর অনেক হাল্কা বোধ করেন।
অভি কিছুক্ষন জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, “তোমার ভাই এই সবকিছু আমাকে অনেক আগেই বলেছে।” ওর দিকে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন প্রনবেশ বাবু। অভি থামেনা, “পাপা, আমি সব জানি অনেক কিছুই বুঝি।”
কাষ্ঠ হাসি হেসে উত্তর দিলেন, “তার মানে এই গোপন ব্যাপারটা আর গোপন নয়।”
অভি মাথা নাড়ায়, “না, এই সব ব্যাপার বড়মা জানে দিদিও জানে। আমরা সবাই সব কিছুই জানি, সবকিছুই বুঝি। কিন্তু কিছু ব্যাপারে আলোচনা না করাটা বাঞ্ছনীয় তাই আর কোনদিন সেইসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়না।” জেঠুর কাছে সরে এসে বলে, “তুমি পিএফ লোন নাও, আমি চাকরি করে সেই টাকা শোধ করে দেব কিন্তু জমি বিক্রি করোনা।”
বহু বছর পরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রনবেশ বাবু হেসে উত্তর দিলেন, “ছেলেটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেল।” একটু থেমে হেসে বলেন, “যা একটু রেস্ট নিয়ে নে, বিকেল ছ’টা নাগাদ ওরা আসবে। তুই ঝন্টুকে বলিস বাইক নিয়ে মোড়ের মাথায় চলে যেতে যদি ওরা বাড়ির রাস্তা ঠিক ভাবে না পায় তাই।”
আলোচনা শেষে সোফা ছেড়ে উঠে অভি উত্তর দেয়, “ঠিক আছে বলে দেব, তুমি এত চিন্তা কর না।”
প্রনবেশ বাবুও দাঁড়িয়ে পড়লেন ছেলের সাথে সাথে। কিছুক্ষন ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, আমাদের বংশের আরো এক মেয়ে আছে, তাদের কি খবর?” একরাশ প্রশ্ন নিয়ে জেঠূর দিকে তাকায়। “সেই দশ বছর আগে শর্বাণীর বিয়েতে ফাল্গুনী ওর মেয়েকে নিয়ে এসেছিল তারপরে ওদের কোন খবর নেই।”
মাথা নাড়াল অভি, “আমার কাছেও নেই। বুঝতেই পারছ, তোমার ভাইয়ের সাথে তেমন কোন কথাবার্তা অথবা আলোচনা কিছুই হয় না। তারপর আবার এই ছয় মাস আগের এই সব ঝামেলায় আমি আর কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।”
মাথা নাড়ালেন প্রনবেশ বাবু, “হুম... দেখিস যদি কোন খোঁজ খবর পাস, মনির বিয়েতে যদি আসতে পারে।”
মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল অভি, “আচ্ছা দেখব খানে কি করা যায়।”
মুষলধার বর্ষা ওর রেনকোট কে হারিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ কাকভেজা করে ছাড়ল। বাড়িতে ঢোকার আগে একটা সিগারেট খেলে বড় ভালো হত, কিন্তু পকেট হাতড়ে দেখল যে সিগারেট প্যাকেট ভিজে চুপসা হয়ে গেছে। হরিদার দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিল, সেই সাথে একটা সিগারেট ধরাল অভি। শনিবারের দিন, শহরতলী এলাকা, এই বৃষ্টিতে দুপুরে রাস্তায় লোকজন বেশ কম। সবাই হয়ত বাড়িতে ইলিশ ভাজা আর সোনা মুগের খিচুড়ি খেতে ব্যাস্ত। সিগারেটটা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ির দিকে পা না বাড়ালে ওর কপালে অনেক দুঃখ।
বাইকে স্টারট দিতে যাবে ঠিক তখন ওর পিঠে এক থাবর দিল কেউ, “তুই শালা এইখানে সিগারেট মারছিস।” পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে ওর মামাত দাদা, অরিন্দম ছাতা মাথায় আর হাতে দইয়ের হাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
অভি হেসে বলে, “আরে ঝন্টুদা, তোরা কখন এলি?”
অভির পেছনে উঠে বসল ঝন্টু, বাইকে বসে উত্তর দিল, “এই একটু আগেই এসেছি, বাবা মা ও এসেছে।”
অভি ঘাড় বেকিয়ে শয়তানি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে, “মেরে দিল কা টুকরা আয়ি ক্যা? (আমার বুকের টুকরো কি এসেছে?)”
বাইকের পেছনে এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে দইয়ের হাড়ি নিয়ে বসতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ঝন্টুকে। তাও অভির মশকরার উত্তরে কপট ঝাঝিয়ে ওঠে, “শালা তুই নিজেরটা খুঁজে নে না, আমার পাতে এত নজর কেন তোর?”
বলেই দুই ভাই হাহা করে হেসে ফেলে। মামা নরেন্দ্রনাথের নৈহাটিতে খুব বড় কাপড়ের দোকান ধনী ব্যাবসায়ি, নৈহাটির নামকরা একজন ব্যাক্তি। অরিন্দম বিশেষ পড়াশুনা করেনি, কোনমতে স্নাতক হয়েই বাবার দোকানে বসে গিয়েছিল। অভির “দিল কা টুকরা” অর্থাৎ অরিন্দমের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী স্বাতিলেখার কথা হচ্ছিল। কলেজ শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেছে স্বাতিলেখার, অভির চেয়ে বয়সে দুই বছরের ছোট এবং সম্পর্কে বউদি তাই খুব পেছনে লাগে অভি। স্বাতিলেখা একটু মুখচোরা লাজুক স্বভাবের মেয়ে তার জন্য অভি আরো বেশি করে স্বাতিলেখার পেছনে লাগে। বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটাতে বড্ড কাদা, বারেবারে বাইকের চাকা ডুবে যায়, এমত অবস্থায় বাইক চালান খুব মুশকিল, তাও কোনোরকমে বাড়ি পউছাল দুইজনে।
মনামি বাইকের আওয়াজ শুনে বারান্দায় দৌড়ে এসে নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “মাগো, তোমার বাঁদর কাক ভেজা হয়ে এসেছে।”
ঝন্টু পেছন মুচকি হাসি দিয়ে বলে ওঠে, “আমিও কিন্তু এসেছি সেটা দেখতে পাচ্ছিস না?”
মনামি ঝন্টুর উদ্দেশ্যে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “ভাগ কুত্তা, তুই এই বেরিয়েছিস আর ভাই অনেক আগে বেড়িয়েছে।” অভির ভিজে চুলগুলো আরো এলোমেলো করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, “তুই না বড্ড শয়তান ছেলে জানিস।” দিদির দিকে একভাবে তাকিয়ে মাথা দুলায় অভি। “তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নে তারপরে অনেক কাজ আছে।”
বসার ঘরে ঢোকা মাত্রই চোখ গেল সোফার দিকে। জেঠু আর মামা বসে গম্ভীর আলোচনায় ব্যাস্ত। ওদের দেখতে পেয়ে প্রনবেশ বাবু গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন, “চাটুজ্যে বাবুর এখন সময় হল বাড়ি আসার? কবে তোর কান্ডজ্ঞান হবে বলত। কাজের নামে কিছু নেই সব সময়ে শুধু গায়ে হাওয়া...”
দীপাদেবী পেছন থেকে স্বামীর উদ্দেশ্যে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “আরে বাবা, ছেলেটা কাকভেজা হয়ে এসেছে আর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই তোমার জ্ঞান দেওয়া শুরু।” অভির উদ্দেশ্যে কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, “যা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফেল এই ভিজে জামা কাপড় পরে থাকলে আবার জ্বর আসবে।”
এমন সময়ে ওর কানে ভেসে আসে মধুর ছন্দের নুপুরের নিক্কন। অভি চোখ নাচিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে এই ধ্বনির আসল মালকিন কোথায়। মনামি দুষ্টুমি মাখানো হাসি দিয়ে নিজের ঘর দেখিয়ে দেয়। চুপিচুপি দিদির ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে লেখা জানালার বাইরে একভাবে তাকিয়ে পা নাচিয়ে এক মনে কোন এক অজানা সুর গুনগুন করে চলেছে। কচি গোলাপের মতন মিষ্টি দেখতে স্বাতিলেখা, এখন ওর নধর কচি দেহ থেকে বিয়ের গন্ধ ঠিক ভাবে যায়নি। অভির চকচকে চোখ দেখে ঝন্টু প্রমাদ গোনে, এই বুঝি ওর স্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পরল।
কারুর কিছু বলার আগেই অভি জামা খুলে চুপিসারে পেছন থেকে লেখা কে জড়িয়ে ধরে গেয়ে ওঠে, “তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত...”
অকস্মাত এই আক্রমনে কেঁপে ওঠে লেখা, ছটফটিয়ে ওঠে অভির কঠিন বাহুপাশে। কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি না সত্যি পারো বটে, ছাড় প্লিস ছাড়...”
ঝন্টু ততক্ষনে রান্নাঘরে দইয়ের ভাড় রেখে এসে গেছে। অভির দিকে দাঁত কিরমির করে তাকিয়ে বলে, “তুই শালা ছাড় আমার বউকে না হলে তোর টা কেটে দেব।”
হেসে ফেলে অভি, ঝন্টুর চোখে চোখ রেখে লেখার নরম ফরসা গালে নিজের দাড়ি না কামানো গাল ঘষে উত্যক্ত করে তোলে, “দেখ দেখ তোর বউ কেমন লাল হয়ে গেছে, তুইত শালা মাকাল ফল।”
মনামি ওদের কান্ড কারখানা দেখে হিহি করে হেসে ফেলে। দরজায় দাঁড়িয়ে দীপাদেবী ছেলের উদ্দেশ্যে বলে, “যা বাবা, তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নে” জেঠিমার গলা কানে যেতেই লেখাকে ছেড়ে দাঁড়ায় অভি। “এখন সবাই না খেয়ে বসে আছে।” ভীষণ লজ্জায় পরে যায় লেখা, এক দৌড়ে স্বামীর পেছনে লুকিয়ে যায়।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে জেঠিমার পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ভুরু নাচিয়ে দিদিকে নিজের ঘরে আসার জন্য ইশারা করে। মনামিও ভাইয়ের পেছন পেছন ওর ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ভিজে জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ভাই বোনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। কথায় কথায় অভি জানতে পারে, যে আজকে দিদিকে শিতাভ্র দেখতে আসবে না, শিতাভ্রর বাবা এবং আরো কয়েকজন অবিভাবক গোচরের লোক। দিদিভাই মুম্বাই থেকে দুই সপ্তাহ পরে আসবে, সেই সময়ে শিতাভ্র অফিসের ছুটি নিয়ে দি দুয়েকের জন্য এসে দেখা করে যাবে। মনামিকে নাকি ওদের আগে থেকেই পছন্দ, দশ বছর আগে শর্বাণীর বিয়ের সময় নাকি ওদের বাড়ির লোক ঠিক করে নিয়েছিল যে এই বাড়ি থেকেই বউমা আসবে। এবারের দেখতে আসাটা শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিক। গতকাল সারা রাত এক অজানা অনুভুতি নিয়ে ঘুমাতে পারেনি মনামি। বাথরুমে ঢুকে কোনমতে মাথায় দুমগ জল ঢেলে বেড়িয়ে এলো অভি। মাথা মুছতে মুছতে দিদির কথা শুনে যায়। অনেক দুরের এক অজানা অচেনা দিগন্ত, বুকের ধুকপুকানি মাঝে মাঝেই সেই অজানা দিগন্তের আভাস মনে করে থেমে যায়। ভেবেছিল এই শহরেই কোথাও বিয়ে হবে, বাড়ির কাছাকাছি থাকবে, যখন তখন বাড়ি এসে মাকে, ভাইকে জ্বালাতন করতে পারবে। ওর কোন অসুবিধে হলে ওর ভাই এক দৌড়ে ওর কাছে চলে যেতে পারবে। স্বপ্নেও ভাবেনি যে সবাইকে ছেড়ে একদিন এতদুর যেতে হবে। দিদির ছলছল চোখের ভাষা এক অব্যাক্ত বেদনা ডেকে আনে অভির বুকে। অভির চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই, সেটা দুইজনেই ভালোভাবে জানে। কথা গুলো বলার পর মনামির মনে হল যেন বুকের ওপর থেকে গত রাত থেকে যে ভারটা ছিল সেটা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে।
অভি দিদির দিকে এগিয়ে এসে কপালে কপাল ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরে, “চিন্তা করিস না, আমি আছি ত।”
“চিন্তা করিস না, আমি আছি ত” ছোট একটা বাক্য বুকে অনেক বল জুগিয়ে দেয়। সেই ছোটবেলা থেকে ভাই বোন একে অপরের সব কিছুতেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়মা’র কাছে মার খাওয়া থেকে, পাপার কাছে বকুনি খাওয়ার সময়, কিম্বা কলেজে কিছু হলে অথবা দিদিভাইয়ের সাথে ঝগড়া হওয়ার সময়ে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করে ওঠে মনামির, নাকের পাটা ফুলে ওঠে ভাইয়ের কথা শুনে। ম্লান ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বলে, “একটা বাজে, চল খেয়ে নিবি।”
ততক্ষনে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। মামা জেঠু ঝন্টুদা, সবাই খাবার টেবিলে বসে ছিল অভির অপেক্ষায়। এই বাড়ির নিয়ম, পুরুষের সাথে মহিলারা খেতে বসে না। পুরুষের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরেই মহিলারা খেতে বসেন। তবে অভি কোনদিন ওর জেঠুর সাথে খেতে বসত না, বরাবর দিদির সাথেই খেতে বসেছে। ওর জন্য বাকি সবাইকে অপেক্ষারত দেখে তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেল। খেতে খেতে জানতে পারল যে শিতাভ্রর বাড়ি থেকে ওর বাবা, কাকা আর এক মামা আসবেন মনামিকে দেখতে। খাওয়ার পরে অভির খুব ইচ্ছে ছিল দিদির সাথে, ঝন্টুদার সাথে, লেখার সাথে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারতে, কিন্তু জেঠুর ডাক পরাতে গুড়ে বালি পরে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষে জেঠু অভিকে বসার ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। প্রমাদ গুনল মনে মনে, মনামির বুক ও সমান তালে ঢিপঢিপ করতে শুরু করে দিল।
কাউচে বসে অভির দিকে তাকিয়ে প্রনবেশ বাবু বললেন, “দেখ বাবা, আমার বয়সে হয়েছে, এই সেপ্টেম্বরে আমি রিটায়ার করব, এইবার ত বাড়ির কথা একটু চিন্তা কর।” জেঠুর এই কণ্ঠস্বর এর আগে কোনদিন শোনেনি অভি। নির্বাক হয়ে গেল গুরু গম্ভীর মানুষটির ভেতরের মানুষটাকে দেখে। “বাড়ির একমাত্র ছেলে, এইবারে একটু দায় দায়িত্ব নেওয়া শুরু কর। বয়স ত কম হল না, পড়াশুনা কম করিস নি, জ্ঞান বুদ্ধি সবকিছুই আছে তোর কাছে।”
চুপ করে থাকে অভি, চাকরি করবে না সেটা একদম নয়। এইভাবে বসে থাকতে ওর নিজের ভালো লাগে না, কিন্তু যা চাকরির অফার আসে, সব কোলকাতার বাইরে, দিল্লী, না হয় ব্যাঙ্গালোর, না হয় পুনে, না হয় হায়দেরাবাদ। পাপাকে ছেড়ে, বড়মাকে ছেড়ে যেতে নারাজ।
অভি শুধু ছোট একটা উত্তর দেয়, “আচ্ছা ঠিক আছে, চাকরি খুঁজব।”
অভির উত্তর শুনে প্রনবেশ বাবু খানিকটা আসস্থ হন। কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে শুরু করেন, “মছলন্দপুরের জমিটা বিক্রি করে দেব ভাবছি। কাল একবার আমার সাথে মছলন্দপুর যাস।”
প্রশ্ন করে অভি, “কেন, ওটাতে ত বেশ আম বাগান আছে, হটাত বিক্রি করবে কেন?”
কণ্ঠস্বর নামিয়ে নিয়ে এলেন প্রনবেশ বাবু, “তোর দিদির বিয়ের একটা খরচা ত আছে। কিছু না চাইলেও, কিছু ত দিতেই হবে।”
চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল অভির, “পাপা, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? এখন ওরা ত দেখতেও আসেনি তার আগেই এত জল্পনা কল্পনা করে কি লাভ।”
ম্লান হাসি দিলেন প্রনবেশ বাবু, “তৈরি না থাকলে কি করে চলবে বল। বারাসাতে বিঘা পনেরো ধানা জমি, ঐ আম বাগান আর এই ভিটে বাড়ি ছাড়া আর ত কিছু নেই আমার।” কিছুক্ষন থেমে বললেন, “এরপর অনেক কাজ আছে, তোর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব আসবে সেইগুল নিতে চেষ্টা কর।” মাথা দুলিয়ে অভি জানিয়ে দিল, সব রকমের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। “আমি চোখ বোজার আগে এইযে জমি জমা গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে গুলোর ব্যাবস্থা করে যাবো। এমনিতেই তুই এই সব ব্যাপারে কোনদিন কিছু দেখিস নি তাই এইসব রেখে কি লাভ বল।”
অভি ক্ষুন্ন মনে উত্তর দেয়, “পড়াশুনা করতে বাইরে পাঠিয়ে দিলে না হলে এই মধ্যমগ্রামেই থাকতাম আর সবকিছু দেখাশোনা করতাম। আমি ত চাইনি পাপা বাইরে যেতে।”
মাথা দোলান প্রনবেশ বাবু, “তুই যখন বললি, তাহলে আজকে একটা কথা তোকে বলি।” খানিকক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভেবে আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি সরকারি চাকরি করি আর এই জমি জমা। তোর আর মনির মাথা পড়াশুনায় খুব ভালো, আমার খুব খারাপ লাগত যে হয়ত তোদের বেশি পড়াতে পারব না। তোর ইঞ্জিনিয়ারিং এমবিএ পড়ার টাকা আর মনির হাইয়ার পড়াশুনার সব টাকা কিন্তু দেবাশিস দিয়েছে।” বুক ভরে শ্বাস নিলেন প্রনবেশ বাবু, অনেকদিনের জমানো এই কথাটা বুক থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর অনেক হাল্কা বোধ করেন।
অভি কিছুক্ষন জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, “তোমার ভাই এই সবকিছু আমাকে অনেক আগেই বলেছে।” ওর দিকে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন প্রনবেশ বাবু। অভি থামেনা, “পাপা, আমি সব জানি অনেক কিছুই বুঝি।”
কাষ্ঠ হাসি হেসে উত্তর দিলেন, “তার মানে এই গোপন ব্যাপারটা আর গোপন নয়।”
অভি মাথা নাড়ায়, “না, এই সব ব্যাপার বড়মা জানে দিদিও জানে। আমরা সবাই সব কিছুই জানি, সবকিছুই বুঝি। কিন্তু কিছু ব্যাপারে আলোচনা না করাটা বাঞ্ছনীয় তাই আর কোনদিন সেইসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়না।” জেঠুর কাছে সরে এসে বলে, “তুমি পিএফ লোন নাও, আমি চাকরি করে সেই টাকা শোধ করে দেব কিন্তু জমি বিক্রি করোনা।”
বহু বছর পরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রনবেশ বাবু হেসে উত্তর দিলেন, “ছেলেটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেল।” একটু থেমে হেসে বলেন, “যা একটু রেস্ট নিয়ে নে, বিকেল ছ’টা নাগাদ ওরা আসবে। তুই ঝন্টুকে বলিস বাইক নিয়ে মোড়ের মাথায় চলে যেতে যদি ওরা বাড়ির রাস্তা ঠিক ভাবে না পায় তাই।”
আলোচনা শেষে সোফা ছেড়ে উঠে অভি উত্তর দেয়, “ঠিক আছে বলে দেব, তুমি এত চিন্তা কর না।”
প্রনবেশ বাবুও দাঁড়িয়ে পড়লেন ছেলের সাথে সাথে। কিছুক্ষন ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, আমাদের বংশের আরো এক মেয়ে আছে, তাদের কি খবর?” একরাশ প্রশ্ন নিয়ে জেঠূর দিকে তাকায়। “সেই দশ বছর আগে শর্বাণীর বিয়েতে ফাল্গুনী ওর মেয়েকে নিয়ে এসেছিল তারপরে ওদের কোন খবর নেই।”
মাথা নাড়াল অভি, “আমার কাছেও নেই। বুঝতেই পারছ, তোমার ভাইয়ের সাথে তেমন কোন কথাবার্তা অথবা আলোচনা কিছুই হয় না। তারপর আবার এই ছয় মাস আগের এই সব ঝামেলায় আমি আর কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।”
মাথা নাড়ালেন প্রনবেশ বাবু, “হুম... দেখিস যদি কোন খোঁজ খবর পাস, মনির বিয়েতে যদি আসতে পারে।”
মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল অভি, “আচ্ছা দেখব খানে কি করা যায়।”