03-07-2020, 11:01 AM
পঞ্চম পরিচ্ছদ – মরুভুমি আর মরীচিকা
(#০১)
কোলকাতায় ফিরে মানসী, বড়দা আর বাকি ভাই বোন সবাই যা ছিল তাই। মানসীর দিন রাত সেই একই ভাবে কেটে যেতে থাকে। এই সময় বড়দার খেয়াল হয় বোনের বিয়ে না হয় দেওয়া যাচ্ছে না দু ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া উচিত। দুটো ভাই – একজন মানসীর বড় আর একজন মানসীর ছোটো। এক বছরের মধ্যেই দুই ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। পয়সা ওয়ালা ঘর কিন্তু কম লেখাপড়া জানা মেয়ে খুজলেন ভাইদের জন্য। বিয়ের ফাইনাল কথা বলতে উনি একাই যেতেন। ফাইনাল কথা মানে টাকার কথা। উনি মেয়ের বাবার কাছ থেকে এত লক্ষ টাকা নিলেন কিন্তু বাড়ীতে এসে সবাইকে বললেন ৫০ হাজার দেবে। বড়দা নিজের ভাইদের বিয়েতেও কমিশন নিলেন। সরকারি কর্মচারী – ৩০ বছরের অভ্যেস কি ভাবে ছাড়বেন !
মানসীর দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে কিছু পরিবর্তন আসে। এখন সৃজা ১২ এ পড়ে। ওর পেছনে খুব বেশী সময় লাগেনা। সকালে বা রাত্রে রান্না ঘরেও যেতে হয় না। রান্নার কাজ ওর বৌদি আর ভাইয়ের বৌ করে।
স্বপন তখন পাটনা থেকে দিল্লি চলে গেছে। মানসীর দাদার বিয়েতে স্বপন এসেছিলো কিন্তু ওর ভাইয়ের বিয়ের সময় আসতে পারে নি। তখন ফেসবুক বা মোবাইল কোনটাই ছিল না। ফলে দুই বন্ধুর কথা খুব কমই হত।
ওর ভায়ের বিয়েতে একটা ছেলে (আসলে লোক, ৪০ এর বেশী বয়েস) এসেছিলো। তার মানসীকে দেখে পছন্দ হয়। তিনি মানসীর ভায়ের বৌ দীপ্তিকে বলেন। দীপ্তি বড়দাকে বলে। মানসীও শোনে। বড়দা খুব একটা আগ্রহ দেখান না। এই সময়ে মানসী নিজে উদ্যোগ নেয় নিজের বিয়ের। ও দীপ্তর সাথে কথা বলে।
মানসী – দীপ্তি তোমার সেই লোকটা তোমার কে হয় ?
দীপ্তি – কোন লোকটা ?
মানসী – যার আমাকে দেখে পছন্দ হয়েছে ?
দীপ্তি – দেখা করবে তার সাথে ?
মানসী – আগে বল সে তোমার কে হয় ?
দীপ্তি – আমার এক বৌদির মাসতুতো দাদা।
মানসী – কি করে ?
দীপ্তি – দীপু দা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। ছেলে বিষ্ণুপুরে বোর্ডিং কলেজে পড়ে। একাই থাকে। মোটামুটি পয়সা আছে।
মানসী – আমি কথা বলতে চাই
দীপ্তি – চল নিয়ে যাব।
এরপর দীপ্তি ওর স্বভাব অনুসারে মানসীর পেছনে লাগে। দীপ্তিও মানসীকে রাঙ্গাদি বলেই ডাকতো।
দীপ্তি – রাঙা দি মনের মধ্যে একটু হাওয়া খেলছে ?
মানসী – হাওয়া খেলার কি আছে ?
দীপ্তি – না তোমার মুখে স্বপন ছাড়া আর কোন ছেলের কথা শুনিনি তো তাই।
মানসী – তুমি স্বপনকে দেখনি তাই এইরকম বলছ
দীপ্তি – শুনেছি ও তোমাকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরে
মানসী – হ্যাঁ ধরে তো, ও আমার বন্ধু। কি হয়েছে তাতে ?
দীপ্তি – বাপরে কি এমন বন্ধু যে ওর বুকে তোমার বুক লাগিয়ে জড়িয়ে ধরতে হবে !
(দীপ্তি মানসীকে টিটকিরি দিচ্ছিল না, মজা করছিলো।)
মানসী – এবার স্বপন আসলে বলব তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, তখন দেখে নিও ওর বুকে কি আছে।
দীপ্তি – ছেলেদের বুকে চুল ছাড়া কিছুই থাকে না। ছেলেদের অন্য জায়গায় কিছু থাকে।
মানসী – ঠিক আছে তুমি সেটাই দেখে নিও।
দীপ্তি – তুমি দেখনি কোনদিন
মানসী – স্বপন আমার বন্ধু, নোংরামি করি না ওর সাথে। কিন্তু আমরা তোমার দীপুদাকে নিয়ে কথা বলছিলাম।
দীপ্তি – এখনই ইচ্ছা করছে নাকি ?
মানসী – হ্যাঁ ইচ্ছা করছে, তোর কি ?
অনেক ইয়ার্কি আর সিরিয়াস কথার মধ্যে দীপ্তি ব্যবস্থা করে মানসী আর দীপুদার দেখা করানোর।
সেই দক্ষিণেশ্বরেই দুজনে দেখা করে। প্রথম দেখায় মানসীর খারাপ লাগে না। সেই দীপুদাও মানসীকে পছন্দ করে। দীপুদা একবারও বলে না যে মানসী কালো। বরঞ্চ কথায় কথায় মানসীর প্রসংসা করে। ওর যে এতদিন বিয়ে হয়নি সে নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশও করে। মানসী আর দীপু তিন চারদিন বিভিন্ন জায়গায় দেখাও করে। দীপ্তি মানসীর পেছনে লাগতে শুরু করে দীপুদা ওকে হামি খেয়েছে কিনা। মানসী ভাবছিল স্বপনের সাথে কথা বলবে। এর পরে যেদিন মানসী আর দীপুর দেখা হয় তখন –
দীপু – কেমন আছে আমার রাঙা দিদি ?
মানসী – আপনিও আমাকে দিদি বলবেন ?
দীপু – যতদিন তুমি আমাকে ‘আপনি’ করে কথা বলবে, আমি তোমাকে দিদি বলব।
মানসী – বিয়ে হলে ‘তুমি’ করে কথা বলব।
তারপর ঘণ্টা খানেক কথা বলার পরে দীপু যা বলে তার সারাংশ হল –
দীপুর সারাদিন অফিসে কাটে। সকাল আটটায় বেরোয় আর সন্ধ্যে আটটা থেকে ন’ টার মধ্যে ফেরে। ও যতক্ষণ বাড়ীতে থাকবে ততক্ষন মানসী কোথাও যেতে পারবে না। বাড়ি ফিরে দীপু দু পেগ হুইস্কি খায়। সেই সময়টা মানসীকে দীপুর পাশে বসে থাকতে হবে। মানসীও যদি দীপুর সাথে হুইস্কি খায় তবে ওর বেশী ভাল লাগবে। আর রাত্রে ওর সাথে শুতে হবে। তা ছাড়া দীপুর জীবনে মানসীর কোন দরকার নেই।
আমি লেখক হিসাবে হয়তো ঠিক বোঝাতে পারলাম না। দীপুদা যা যা বলেছিল তাতে মানসীর কাছে এটা পরিস্কার হয় যে দীপুর একটা বৌ চাই না, ওর একটা ‘রাখেল’ আর 'টাইম পাস' চাই। বৌ বা সাথীর দরকার নেই। মানসী সেদিন ফিরে আসার পরে আর দেখা করতে যায়নি। দীপ্তিও আর কিছু বলেনি। বরঞ্চ ওরও খুব খারাপ লাগে এইরকম লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল বলে। মানসী বোঝে যে ও যেটাকে মরুদ্যান ভাবছিল সেটা আসলে মরীচিকা।
আস্তে আস্তে মানসীর বিয়ের কথা সবাই ভুলেই গেল। মানসীর বাবা বড় ছেলেকে দু একবার বলেছিলেন। ছেলে দেখছি দেখব করে কাটিয়ে যায়। একসময় মানসীর বাবাও মারা যান। উনি মারা যাবার আগে বিটি রোডের ওপর একটা ছোটো শপিং কমপ্লেক্সে মানসীর নামে একটা দোকান ঘর রেখে যান। এই দোকান ঘর নিয়ে বড়দা কিছু করতে পারেননি। আসলে মানসীর বাবা মানসীকে দোকানটা দেবার আগে বড় ছেলেকে জানানও নি। মানসী একা একাই ওখানে ওর সুলগ্না বৌদির দেওয়া টাকা দিয়ে একটা বিউটি পার্লার খোলে। পার্লারের নাম রাখে “সুলগ্না”। অবশ্য বিউটি পার্লার খোলার পরে বড়দা অনেক দাদাগিরিও করে আর সাহায্যও করে।
মানসী প্রথমেই বিউটি পার্লারের সাজসজ্জার দিকে নজর দেয়। দেয়াল করে মুক্তো সাদা রঙের ওয়াসেবল রঙ দিয়ে। বড়দা বলেছিলেন সাদা রঙ না করতে। কিন্তু সেটা মানসী শোনেনি। ও বলেছিল সাদা রঙ নোংরা হলে প্রত্যেক সপ্তাহে পরিস্কার করতে হবে। সাদা দেয়ালের কোনায় কোনায় হাল্কা নীল রঙের সরু দাগ দিয়ে ফুলের আলপনা। আয়নার ফ্রেম গাঢ় গোলাপি রঙের। সব যন্ত্রপাতি হয় সাদা বা গোলাপি রঙের। আর যত মেটাল ফিটিংস সব পেতলের তৈরি। পার্লারে ঢুকেই মনে হয় মন্দিরের মতো পবিত্র জায়গায় এলাম। পার্লার সাজানোর পরে আসে সৌন্দর্য সুন্দরী ঠিক করার পালা।
স্বপনের সাথে ফোনে আলোচনা করে মানসী কিছু মাপকাঠি তৈরি করে। আর ওই তালিকা অনুযায়ী মেয়ে খোঁজে। ওর পছন্দের মেয়েদের বিশেষত্বর তালিকা –
১। গায়ের রঙ – যেকোনো, অতিরিক্ত ফর্সা চলবে না
২। চামড়ায় কোন অসুখ থাকা চলবে না।
৩। মুখে কোন ব্রণর দাগও চলবে না।
৪। শাড়ী পড়ে কাজে আসতে হবে।
৫। শাড়ী নাভির এক ইঞ্চির বেশী নিচে পড়া যাবে না।
৬। পরিস্কার বাংলায় কথা বলতে হবে
৭। পার্লারে যতক্ষণ থাকবে সবাইকে ওর পছন্দ করা চারটে নাম ব্যবহার করবে।
৮। মুখে কোন গন্ধ থাকা চলবে না
৯। দাঁতে দাগ বা ছোপ থাকা চলবে না
১০। চুল অন্ততঃ ১৪ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে।
এই তালিকা অনুযায়ী মেয়ে খুঁজে পেতে ২০ দিন সময় লাগে। সেই মেয়েদের বিউটিসিয়ান কোর্স করা থাকলেও মানসী নিজের পয়সা খরচ করে বিভিন্ন নামী পার্লারে গ্রাহক হিসাবে পাঠায় কে কিভাবে গ্রাহক পরিসেবা দেয় সেটা জানা আর বোঝার জন্য। একটা মেয়েকে বিশেষ ভাবে তৈরি করে চুলের যত্ন নেবার জন্য। তার নাম দেওয়া হয় “অলকা”। অলকা মানে যার খুব সুন্দর বেণী। যে মেয়েটাকে চোখের যত্ন নেবার জন্য তৈরি করা হয় তার নাম দেওয়া হয় “নয়নিকা”। যে মেয়েটা স্কিনের যত্ন নেবে তার নাম দেওয়া হয় “বর্ণিকা”। আর যে মেয়েটা শরীরের মেদ কমানোয় সাহায্য করবে বা বডি ম্যাসাজ করবে তার নাম দেওয়া হয় “লতিকা”।
এই সব করতে প্রায় দু মাস সময় লাগে। শুরুতে বড়দা অনেক কিছুতেই নাক গলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানসী শুধু স্বপনের সাথেই আলোচনা করে। চারটে মেয়ে ঠিক হয়ে যাবার পড়ে স্বপন একবার দিল্লি থেকে আসে ওই মেয়েদের “Customer Satisfaction” নিয়ে ট্রেনিং দিতে। কিভাবে সারভিস দিতে হয়, কি ভাবে কথা বলতে হয়, গ্রাহক রেগে গেলে তাকে কি ভাবে সামলাতে হয়। ট্রেনিঙের আগে স্বপন সবার সাথে কথা বলে।
মানসী – এই ট্রেনিং নিয়ে কি হবে ?
স্বপন – আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোলকাতার কোন বিউটি পার্লারের ছেলেরা বা মেয়েরা এই রকম কোন ট্রেনিং পায়নি। ওরা অনেকেই জানেনা কি ভাবে গ্রাহক সামলাতে হয়। তুমি দেখো আমার শেখানো রাস্তায় তোমার গ্রাহক অনেক অনেক সন্তুষ্ট থাকবে।
নয়নিকা – আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম “যে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায় সে কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না”।
স্বপন – একদম ঠিক। তবু এর মানে এই নয় যে সন্তুষ্ট না করতে পারলেই সে অসন্তুষ্ট হবে।
অলকা – সেটা আবার কিরকম কথা হল ?
স্বপন – ধর এক ভদ্রমহিলা তার কালো মেয়েকে নিয়ে এসে তোমাকে বলল ওকে ফর্সা করে দিতে। তুমি বললে যে তোমরা ওটা করতে পারবে না। কারন পৃথিবীতে এমন কোন ক্রীম বা অসুধ নেই যেটা খেলে বা লাগালে চামড়ার রঙ বরাবরের জন্য বদলে যাবে। সেই মহিলা তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না। আবার অসন্তুষ্টও হবে না। কিন্তু যদি তোমরা প্রথমদিন বলে যে ওনার মেয়ে ফর্সা হয়ে যাবে আর তিন মাস অনেক টাকা খরচ করানোর পড়ে বলবে এর বেশী কিছু হবে না, তখন গ্রাহক অসন্তুষ্ট হবে।
বর্ণিকা – একদম ঠিক কথা
স্বপন - সন্তুষ্ট গ্রাহক পাঁচটা নতুন গ্রাহক এনে দেবে। কিন্তু একটা অসন্তুষ্ট গ্রাহক ৫০ টা গ্রাহক কে তোমাদের থেকে দূরে সড়িয়ে দেবে।
লতিকা – কিন্তু ওই ‘ডেয়ার অ্যান্ড বাবলি’ ক্রীম যে এতো বিজ্ঞাপন দেয় ফর্সা হবার জন্য ? অনেক পার্লার বলে ফর্সা করে দেবে ?
স্বপন – দেখো আমি বিউটি এক্সপার্ট নই। কিন্তু আমি যতটা জানি ওই ক্রীম বা অন্যান্য যা কিছু আছে তাতে কিছু দিনের জন্য হয়তো একটু রঙের শেড বদলায়, পারমানেন্টলি কিছু হয় না। তবে আমি এটা শুধু উদাহরন হিসাবে বলেছি, তোমাদের বোঝানর জন্য। শুধু এটা মনে রাখবে গ্রাহক যা কিছু চাইবে তার ৫০% আমরা দিতে পারবো না।
নয়নিকা – তবে কি হবে ?
স্বপন – আমি সেটাই বোঝাবো। গ্রাহক বুঝতেও পারবেন না যে উনি যা চেয়েছিলএন তার ৫০% পান নি। ওনার মনে হবে ৯০% পেয়েছেন।
মানসী – কি করে ?
স্বপন – সেটাই আমি আগামি দু দিনে বোঝাবো। তোমাদের সাথে কথা বলার পরে গ্রাহকের চাহিদাই বদলে যাবে। আগে যা যা চাইছিলেন তোমাদের সাথে কথা বলার পরে তোমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব শুধু সেইগুলোই চাইবেন।
(#০১)
কোলকাতায় ফিরে মানসী, বড়দা আর বাকি ভাই বোন সবাই যা ছিল তাই। মানসীর দিন রাত সেই একই ভাবে কেটে যেতে থাকে। এই সময় বড়দার খেয়াল হয় বোনের বিয়ে না হয় দেওয়া যাচ্ছে না দু ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া উচিত। দুটো ভাই – একজন মানসীর বড় আর একজন মানসীর ছোটো। এক বছরের মধ্যেই দুই ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। পয়সা ওয়ালা ঘর কিন্তু কম লেখাপড়া জানা মেয়ে খুজলেন ভাইদের জন্য। বিয়ের ফাইনাল কথা বলতে উনি একাই যেতেন। ফাইনাল কথা মানে টাকার কথা। উনি মেয়ের বাবার কাছ থেকে এত লক্ষ টাকা নিলেন কিন্তু বাড়ীতে এসে সবাইকে বললেন ৫০ হাজার দেবে। বড়দা নিজের ভাইদের বিয়েতেও কমিশন নিলেন। সরকারি কর্মচারী – ৩০ বছরের অভ্যেস কি ভাবে ছাড়বেন !
মানসীর দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে কিছু পরিবর্তন আসে। এখন সৃজা ১২ এ পড়ে। ওর পেছনে খুব বেশী সময় লাগেনা। সকালে বা রাত্রে রান্না ঘরেও যেতে হয় না। রান্নার কাজ ওর বৌদি আর ভাইয়ের বৌ করে।
স্বপন তখন পাটনা থেকে দিল্লি চলে গেছে। মানসীর দাদার বিয়েতে স্বপন এসেছিলো কিন্তু ওর ভাইয়ের বিয়ের সময় আসতে পারে নি। তখন ফেসবুক বা মোবাইল কোনটাই ছিল না। ফলে দুই বন্ধুর কথা খুব কমই হত।
ওর ভায়ের বিয়েতে একটা ছেলে (আসলে লোক, ৪০ এর বেশী বয়েস) এসেছিলো। তার মানসীকে দেখে পছন্দ হয়। তিনি মানসীর ভায়ের বৌ দীপ্তিকে বলেন। দীপ্তি বড়দাকে বলে। মানসীও শোনে। বড়দা খুব একটা আগ্রহ দেখান না। এই সময়ে মানসী নিজে উদ্যোগ নেয় নিজের বিয়ের। ও দীপ্তর সাথে কথা বলে।
মানসী – দীপ্তি তোমার সেই লোকটা তোমার কে হয় ?
দীপ্তি – কোন লোকটা ?
মানসী – যার আমাকে দেখে পছন্দ হয়েছে ?
দীপ্তি – দেখা করবে তার সাথে ?
মানসী – আগে বল সে তোমার কে হয় ?
দীপ্তি – আমার এক বৌদির মাসতুতো দাদা।
মানসী – কি করে ?
দীপ্তি – দীপু দা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। ছেলে বিষ্ণুপুরে বোর্ডিং কলেজে পড়ে। একাই থাকে। মোটামুটি পয়সা আছে।
মানসী – আমি কথা বলতে চাই
দীপ্তি – চল নিয়ে যাব।
এরপর দীপ্তি ওর স্বভাব অনুসারে মানসীর পেছনে লাগে। দীপ্তিও মানসীকে রাঙ্গাদি বলেই ডাকতো।
দীপ্তি – রাঙা দি মনের মধ্যে একটু হাওয়া খেলছে ?
মানসী – হাওয়া খেলার কি আছে ?
দীপ্তি – না তোমার মুখে স্বপন ছাড়া আর কোন ছেলের কথা শুনিনি তো তাই।
মানসী – তুমি স্বপনকে দেখনি তাই এইরকম বলছ
দীপ্তি – শুনেছি ও তোমাকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরে
মানসী – হ্যাঁ ধরে তো, ও আমার বন্ধু। কি হয়েছে তাতে ?
দীপ্তি – বাপরে কি এমন বন্ধু যে ওর বুকে তোমার বুক লাগিয়ে জড়িয়ে ধরতে হবে !
(দীপ্তি মানসীকে টিটকিরি দিচ্ছিল না, মজা করছিলো।)
মানসী – এবার স্বপন আসলে বলব তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, তখন দেখে নিও ওর বুকে কি আছে।
দীপ্তি – ছেলেদের বুকে চুল ছাড়া কিছুই থাকে না। ছেলেদের অন্য জায়গায় কিছু থাকে।
মানসী – ঠিক আছে তুমি সেটাই দেখে নিও।
দীপ্তি – তুমি দেখনি কোনদিন
মানসী – স্বপন আমার বন্ধু, নোংরামি করি না ওর সাথে। কিন্তু আমরা তোমার দীপুদাকে নিয়ে কথা বলছিলাম।
দীপ্তি – এখনই ইচ্ছা করছে নাকি ?
মানসী – হ্যাঁ ইচ্ছা করছে, তোর কি ?
অনেক ইয়ার্কি আর সিরিয়াস কথার মধ্যে দীপ্তি ব্যবস্থা করে মানসী আর দীপুদার দেখা করানোর।
সেই দক্ষিণেশ্বরেই দুজনে দেখা করে। প্রথম দেখায় মানসীর খারাপ লাগে না। সেই দীপুদাও মানসীকে পছন্দ করে। দীপুদা একবারও বলে না যে মানসী কালো। বরঞ্চ কথায় কথায় মানসীর প্রসংসা করে। ওর যে এতদিন বিয়ে হয়নি সে নিয়ে অনেক দুঃখ প্রকাশও করে। মানসী আর দীপু তিন চারদিন বিভিন্ন জায়গায় দেখাও করে। দীপ্তি মানসীর পেছনে লাগতে শুরু করে দীপুদা ওকে হামি খেয়েছে কিনা। মানসী ভাবছিল স্বপনের সাথে কথা বলবে। এর পরে যেদিন মানসী আর দীপুর দেখা হয় তখন –
দীপু – কেমন আছে আমার রাঙা দিদি ?
মানসী – আপনিও আমাকে দিদি বলবেন ?
দীপু – যতদিন তুমি আমাকে ‘আপনি’ করে কথা বলবে, আমি তোমাকে দিদি বলব।
মানসী – বিয়ে হলে ‘তুমি’ করে কথা বলব।
তারপর ঘণ্টা খানেক কথা বলার পরে দীপু যা বলে তার সারাংশ হল –
দীপুর সারাদিন অফিসে কাটে। সকাল আটটায় বেরোয় আর সন্ধ্যে আটটা থেকে ন’ টার মধ্যে ফেরে। ও যতক্ষণ বাড়ীতে থাকবে ততক্ষন মানসী কোথাও যেতে পারবে না। বাড়ি ফিরে দীপু দু পেগ হুইস্কি খায়। সেই সময়টা মানসীকে দীপুর পাশে বসে থাকতে হবে। মানসীও যদি দীপুর সাথে হুইস্কি খায় তবে ওর বেশী ভাল লাগবে। আর রাত্রে ওর সাথে শুতে হবে। তা ছাড়া দীপুর জীবনে মানসীর কোন দরকার নেই।
আমি লেখক হিসাবে হয়তো ঠিক বোঝাতে পারলাম না। দীপুদা যা যা বলেছিল তাতে মানসীর কাছে এটা পরিস্কার হয় যে দীপুর একটা বৌ চাই না, ওর একটা ‘রাখেল’ আর 'টাইম পাস' চাই। বৌ বা সাথীর দরকার নেই। মানসী সেদিন ফিরে আসার পরে আর দেখা করতে যায়নি। দীপ্তিও আর কিছু বলেনি। বরঞ্চ ওরও খুব খারাপ লাগে এইরকম লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল বলে। মানসী বোঝে যে ও যেটাকে মরুদ্যান ভাবছিল সেটা আসলে মরীচিকা।
আস্তে আস্তে মানসীর বিয়ের কথা সবাই ভুলেই গেল। মানসীর বাবা বড় ছেলেকে দু একবার বলেছিলেন। ছেলে দেখছি দেখব করে কাটিয়ে যায়। একসময় মানসীর বাবাও মারা যান। উনি মারা যাবার আগে বিটি রোডের ওপর একটা ছোটো শপিং কমপ্লেক্সে মানসীর নামে একটা দোকান ঘর রেখে যান। এই দোকান ঘর নিয়ে বড়দা কিছু করতে পারেননি। আসলে মানসীর বাবা মানসীকে দোকানটা দেবার আগে বড় ছেলেকে জানানও নি। মানসী একা একাই ওখানে ওর সুলগ্না বৌদির দেওয়া টাকা দিয়ে একটা বিউটি পার্লার খোলে। পার্লারের নাম রাখে “সুলগ্না”। অবশ্য বিউটি পার্লার খোলার পরে বড়দা অনেক দাদাগিরিও করে আর সাহায্যও করে।
মানসী প্রথমেই বিউটি পার্লারের সাজসজ্জার দিকে নজর দেয়। দেয়াল করে মুক্তো সাদা রঙের ওয়াসেবল রঙ দিয়ে। বড়দা বলেছিলেন সাদা রঙ না করতে। কিন্তু সেটা মানসী শোনেনি। ও বলেছিল সাদা রঙ নোংরা হলে প্রত্যেক সপ্তাহে পরিস্কার করতে হবে। সাদা দেয়ালের কোনায় কোনায় হাল্কা নীল রঙের সরু দাগ দিয়ে ফুলের আলপনা। আয়নার ফ্রেম গাঢ় গোলাপি রঙের। সব যন্ত্রপাতি হয় সাদা বা গোলাপি রঙের। আর যত মেটাল ফিটিংস সব পেতলের তৈরি। পার্লারে ঢুকেই মনে হয় মন্দিরের মতো পবিত্র জায়গায় এলাম। পার্লার সাজানোর পরে আসে সৌন্দর্য সুন্দরী ঠিক করার পালা।
স্বপনের সাথে ফোনে আলোচনা করে মানসী কিছু মাপকাঠি তৈরি করে। আর ওই তালিকা অনুযায়ী মেয়ে খোঁজে। ওর পছন্দের মেয়েদের বিশেষত্বর তালিকা –
১। গায়ের রঙ – যেকোনো, অতিরিক্ত ফর্সা চলবে না
২। চামড়ায় কোন অসুখ থাকা চলবে না।
৩। মুখে কোন ব্রণর দাগও চলবে না।
৪। শাড়ী পড়ে কাজে আসতে হবে।
৫। শাড়ী নাভির এক ইঞ্চির বেশী নিচে পড়া যাবে না।
৬। পরিস্কার বাংলায় কথা বলতে হবে
৭। পার্লারে যতক্ষণ থাকবে সবাইকে ওর পছন্দ করা চারটে নাম ব্যবহার করবে।
৮। মুখে কোন গন্ধ থাকা চলবে না
৯। দাঁতে দাগ বা ছোপ থাকা চলবে না
১০। চুল অন্ততঃ ১৪ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে।
এই তালিকা অনুযায়ী মেয়ে খুঁজে পেতে ২০ দিন সময় লাগে। সেই মেয়েদের বিউটিসিয়ান কোর্স করা থাকলেও মানসী নিজের পয়সা খরচ করে বিভিন্ন নামী পার্লারে গ্রাহক হিসাবে পাঠায় কে কিভাবে গ্রাহক পরিসেবা দেয় সেটা জানা আর বোঝার জন্য। একটা মেয়েকে বিশেষ ভাবে তৈরি করে চুলের যত্ন নেবার জন্য। তার নাম দেওয়া হয় “অলকা”। অলকা মানে যার খুব সুন্দর বেণী। যে মেয়েটাকে চোখের যত্ন নেবার জন্য তৈরি করা হয় তার নাম দেওয়া হয় “নয়নিকা”। যে মেয়েটা স্কিনের যত্ন নেবে তার নাম দেওয়া হয় “বর্ণিকা”। আর যে মেয়েটা শরীরের মেদ কমানোয় সাহায্য করবে বা বডি ম্যাসাজ করবে তার নাম দেওয়া হয় “লতিকা”।
এই সব করতে প্রায় দু মাস সময় লাগে। শুরুতে বড়দা অনেক কিছুতেই নাক গলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানসী শুধু স্বপনের সাথেই আলোচনা করে। চারটে মেয়ে ঠিক হয়ে যাবার পড়ে স্বপন একবার দিল্লি থেকে আসে ওই মেয়েদের “Customer Satisfaction” নিয়ে ট্রেনিং দিতে। কিভাবে সারভিস দিতে হয়, কি ভাবে কথা বলতে হয়, গ্রাহক রেগে গেলে তাকে কি ভাবে সামলাতে হয়। ট্রেনিঙের আগে স্বপন সবার সাথে কথা বলে।
মানসী – এই ট্রেনিং নিয়ে কি হবে ?
স্বপন – আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোলকাতার কোন বিউটি পার্লারের ছেলেরা বা মেয়েরা এই রকম কোন ট্রেনিং পায়নি। ওরা অনেকেই জানেনা কি ভাবে গ্রাহক সামলাতে হয়। তুমি দেখো আমার শেখানো রাস্তায় তোমার গ্রাহক অনেক অনেক সন্তুষ্ট থাকবে।
নয়নিকা – আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম “যে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায় সে কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না”।
স্বপন – একদম ঠিক। তবু এর মানে এই নয় যে সন্তুষ্ট না করতে পারলেই সে অসন্তুষ্ট হবে।
অলকা – সেটা আবার কিরকম কথা হল ?
স্বপন – ধর এক ভদ্রমহিলা তার কালো মেয়েকে নিয়ে এসে তোমাকে বলল ওকে ফর্সা করে দিতে। তুমি বললে যে তোমরা ওটা করতে পারবে না। কারন পৃথিবীতে এমন কোন ক্রীম বা অসুধ নেই যেটা খেলে বা লাগালে চামড়ার রঙ বরাবরের জন্য বদলে যাবে। সেই মহিলা তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না। আবার অসন্তুষ্টও হবে না। কিন্তু যদি তোমরা প্রথমদিন বলে যে ওনার মেয়ে ফর্সা হয়ে যাবে আর তিন মাস অনেক টাকা খরচ করানোর পড়ে বলবে এর বেশী কিছু হবে না, তখন গ্রাহক অসন্তুষ্ট হবে।
বর্ণিকা – একদম ঠিক কথা
স্বপন - সন্তুষ্ট গ্রাহক পাঁচটা নতুন গ্রাহক এনে দেবে। কিন্তু একটা অসন্তুষ্ট গ্রাহক ৫০ টা গ্রাহক কে তোমাদের থেকে দূরে সড়িয়ে দেবে।
লতিকা – কিন্তু ওই ‘ডেয়ার অ্যান্ড বাবলি’ ক্রীম যে এতো বিজ্ঞাপন দেয় ফর্সা হবার জন্য ? অনেক পার্লার বলে ফর্সা করে দেবে ?
স্বপন – দেখো আমি বিউটি এক্সপার্ট নই। কিন্তু আমি যতটা জানি ওই ক্রীম বা অন্যান্য যা কিছু আছে তাতে কিছু দিনের জন্য হয়তো একটু রঙের শেড বদলায়, পারমানেন্টলি কিছু হয় না। তবে আমি এটা শুধু উদাহরন হিসাবে বলেছি, তোমাদের বোঝানর জন্য। শুধু এটা মনে রাখবে গ্রাহক যা কিছু চাইবে তার ৫০% আমরা দিতে পারবো না।
নয়নিকা – তবে কি হবে ?
স্বপন – আমি সেটাই বোঝাবো। গ্রাহক বুঝতেও পারবেন না যে উনি যা চেয়েছিলএন তার ৫০% পান নি। ওনার মনে হবে ৯০% পেয়েছেন।
মানসী – কি করে ?
স্বপন – সেটাই আমি আগামি দু দিনে বোঝাবো। তোমাদের সাথে কথা বলার পরে গ্রাহকের চাহিদাই বদলে যাবে। আগে যা যা চাইছিলেন তোমাদের সাথে কথা বলার পরে তোমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব শুধু সেইগুলোই চাইবেন।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!