30-06-2020, 11:32 AM
ত্রয়োদশ পর্বঃ পুনরুজ্জীবিত। (#1)
কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। দেবস্মিতা আর সুবিরবাবু ধানবাদ ফিরে গেছেন। বুধাদিত্য তাদের কথা দিয়েছে যে আগামি ছুটিতে ধানবাদ গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে। রঞ্জনবাবু আর প্রমীলাদেবীকে থেকে যেতে বলে, বলে যে কেদার বদ্রি ঘুরাতে নিয়ে যাবে। প্রমীলাদেবী জানান যে অনিন্দিতাদি নেপাল থেকে ফিরে এলে পরের বার সবাই মিলে যাওয়া যাবে।
ঝিলামের গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্যকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সমীর ওকে নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কোথাও একটা ঘুরতে যাবে। সমীর বুধাদিত্যকে জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচলের তাওয়াং উপত্যকা দিন পাঁচেকের জন্য ঘুরতে যাবে। সমীরের অনুরোধ রাখে বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওর পরিকল্পনা জানায়নি। ভেবেছিল যে স্বামী যখন তাঁর স্ত্রীকে ভালোবেসে একটা চমক দিতে চলেছে, তাহলে সেই আনন্দে বাধা দিয়ে তার লাভ নেই। সেই সাথে বুধাদিত্যের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে, পাঁচ দিনে অরুনাচল ঘুরে ফিরবে? সমীরকে জানিয়ে দেয় যে কোন রকম দুরাভিসন্ধি মাথায় রাখলে মেরে ফেলবে সমীরকে। সমীর হেসে জানায় যে ওর মাথায় কোন বাজে পরিকল্পনা নেই। তাও সমীরকে ঠিক ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না বুধাদিত্য। ঝিলামের হাসি মুখ দেখে সন্দেহের বীজ বুকের মধ্যে রেখে দেয়।
সকালে অফিস বের হবার আগে ঝিলাম জানায় যে রাতে নাকি ওর বেড়িয়ে যাবে। ঝিলাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য তৈরি, ব্যাগ ঘুছিয়ে নিয়েছে। কণ্ঠস্বরে একটু উদ্বেগের ছোঁয়া, বুধাদিত্য আসস্থ করে নিরুদ্বেগে বরের সাথে ঘুরতে যেতে, কিছু হলে বুধাদিত্য দেখে নেবে। রাতের বেলা ঝিলামের এস.এম.এস আসে, “আমরা বেড়িয়ে গেছি। ভালো থেক।” বুধাদিত্য সেই এস.এম.এস পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, ভালোবাসার পাত্রী “ঝিল্লি” তাঁর স্বামীর সাথে মনের আনন্দে ঘুরতে বেড়িয়ে গেছে। মোবাইলে ওর ছবি খুলে দেখে, বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে, ঝিলামকে এই জীবনে এই বুকের মধ্যে আর পাওয়া আর হল না। ঘুম আসেনা বুধাদিত্যের, চোখ বন্ধ করলেই ঝিলামের মিষ্টি মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরেছিল ঝিলাম, কিন্তু আটকাতে পারেনি বুধাদিত্য। বুকের ওপরে ওর ঠোঁটের পরশ এখনো লেগে। আলমারি খুলে ওর জামা মুখের ওপরে মেলে ধরে গায়ের গন্ধ বুকে টেনে নেয়।
ঘন্টা চারেক পরে আবার একটা এস.এম.এস, “আমারা গড়গঙ্গা পার হচ্ছি। জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তবে খুব খুশি আমি।” খবরটা পড়ে মাথা ঘুরে যায় বুধাদিত্যের, সমীর জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচল ঘুরতে যাবে। দিল্লী ছাড়ার চার ঘন্টা পরে, ঝিলাম গড়গঙ্গার কাছে কি করছে? সমীরের পরিকল্পনার সাথে অঙ্ক মেলাতে পারে না। ঝিলামকে একটা এস.এম.এস করে জিজ্ঞেস করে গাড়ির নাম্বার আর গাড়িতে কে কে আছে। পরের এস.এম.এসে’র কোন উত্তর না পেয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পরে বুধাদিত্য।
রাত প্রায় বারোটা বাজে, সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার কালীনাথকে ফোন করে ডেকে নেয়। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করে কারন, কোথায় যেতে হবে। বুধাদিত্য সংক্ষেপে জানায় যে গন্তব্য স্থলের ঠিক নেই তবে ঝিলাম বিপদে। কালীনাথ এতদিন বুধাদিত্যের সাথে থেকে বুঝে গেছে, যে সাহেবের জীবনে ঝিলাম মেমসাহেব খুব বড় স্থান দখল করে রেখেছে। দরজার তালা ভেঙ্গে সমীরের বাড়ি ঢোকে। সব ঘর তছনছ করে ফেলে, সমীরের দুরাভিসন্ধি ধরার জন্য। শেষ পর্যন্ত ওদের শোয়ার ঘরের বিছানার তলায় একটা বড় হলদে খামে দুটি প্লেনের টিকিট, সমীরের পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ, বেশ কয়েক হাজার ডলার পায়। প্লেনের টিকিট, একটা সমীরের নামে অন্যটা নন্দিতার নামে। তারিখ পনেরো দিন পরের, গন্তব্য স্থান, মরিশাস। তার মানে, ঝিলামকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চায় সমীর। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, পুরানো বন্ধু না শত্রু বলা ভালো, এক ভয়ঙ্কর ধূর্ত সমীর হয়ে ফিরে এসেছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের, ঝিলামের সাথে এত বড় বিশাস ঘাতকতা। ঝিলাম না জেনে হাসতে হাসতে বিপদের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে, সারা শরীর টানটান হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের। খাম’টা নিজের সাথে নিয়ে নেয়। ঝিলামকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেট জানার জন্য সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় কোন সুত্র যদি পায় কিন্তু তার চিনহ পায় না। মাথা চেপে বসে পরে, কেন মরতে সমীরের কথায় বিশ্বাস করে ঝিলামকে পাঠিয়েছিল। বড় অনুশোচনা হয় বুধাদিত্যের। একবারের জন্য মনে হয় নিজের মাথার মধ্যে পিস্তলের সব কটা গুলি নামিয়ে দিতে। দরজার শব্দে বাড়ির মালিক পৌঁছে যায় কি হচ্ছে দেখার জন্য। বুধাদিত্য তাঁকে ঝিলাম আর সমীরের কথা জিজ্ঞেস। বাড়ির মালিক জানায়, যে এই কদিনে ওদের বাড়িতে বাইরের লোক কেউ আসেনি। সমীরের আচরনে কোনোরকমে মনে হয়নি যে সমীর আর ঝিলামের মাঝে কোন দ্বন্দ আছে। দুজনে বেশ ভালোই ছিল এই কটা দিন। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে গেছে, সেই ব্যাপারে কিছু জানে কি না। উত্তরে বাড়ির মালিক বলেন যে, একটা সাদা সুমো ভাড়ার গাড়ি চেপে ওরা বেড়াতে বেড়িয়েছে, গাড়িতে দিল্লীর নাম্বার। কোথায় বেড়াতে গেছে কিছু বলে যায়নি সঠিক, তবে দিন পাঁচেক পরে ফিরবে বলে গেছে। বাড়ির দরজায় একটা নতুন তালা লাগিয়ে বেড়িয়ে পরে বুধাদিত্য।
চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এতক্ষণে ঝিলামকে নিয়ে অনেক দূর পার হয়ে গেছে সমীর। গা হাত পা জ্বলছে বুধাদিত্যের, রাগে থরথর কাঁপতে শুরু করে। সমীরকে একবার হাতের কাছে পেলে মেরে ফেলবে। ফুলের মতন সুন্দরী মেয়েটা মনে প্রানে স্বামীর কথায় বিশ্বাস করে আবার ফিরে যায়, সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয় ব্যাভিচারি ইতর সমীর। বুধাদিত্য ঝিলামকে ফোন করে, কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলে, উন্মাদ হয়ে ওঠে বুধাদিত্য। পিস্তল বের করে কোমরে গুঁজে নেয়। সাথে দুটো অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। কিছু দূর যাবার পরে কালীনাথকে পাশে বসতে বলে নিজেই গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, প্রথম গন্তব্যস্থল গড়গঙ্গা। বুকের মাঝে একটাই আশা এর মাঝে যেন ঝিলামকে আঘাত না করে। ঘন্টা আড়াইয়ের মধ্যে গড়গঙ্গা পৌঁছে যায়। দুই তিনটে ধাবা খোলা ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করে যে একটা সাদা সুমো গাড়ি থেমেছিল কিনা। একটা ধাবার লোক জানায় যে কয়েক ঘন্টা আগে একটা সাদা সুমো থেমেছিল তার ধাবায়। বুধাদিত্য মোবাইলে ঝিলামের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই গাড়িতে এই মহিলা ছিল কিনা? ধাবার লোক জানায় যে হ্যাঁ, ওই গাড়িতে ছবির ভদ্রমহিলা ছিলেন। গাড়িতে স্বামী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। সমীর ধাবার মালিকের কাছে মুরাদাবাদের রাস্তা আর আলমোড়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিল। সমীরের হাতে একটা উত্তরাখণ্ডের ম্যাপ ছিল। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ওদের দেখে কি কোন রকম সন্দেহ হয়েছিল ধাবার মালিকের? মাথা নাড়িয়ে বলে, না, এক নববিবাহিত দম্পতির মতন পরস্পরের সাথে হেসে খেলে গল্প করছিল। চোয়াল শক্ত করে সব তথ্য মাথার মধ্যে এঁকে নেয় বুধাদিত্য। মুরাদাবাদ পর্যন্ত পাগলের মতন গাড়ি চালায়, কিন্তু সেই সাদা সুমোর দেখা পাওয়া যায়না কিছুতেই। সে গাড়ি যে অনেক আগে বেড়িয়ে গেছে। ঝিলাম আর সমীর কে বারেবারে ফোনে ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুপরে দুটো ফোন সুইচ অফ বলে। প্রবল এক ঝড় বুকের রক্ত উথাল পাতাল করে তোলে। চোখের সামনে বারেবারে ঝিলাম এসে দাঁড়িয়ে পরে, কানে ভেসে আসে ঝিলামের মিষ্টি হাসি, রাঙ্গা পায়ের নুপুরের রিনিঝিনি সঙ্গীত, উচ্ছল তরঙ্গিণীর মধুর ঝঙ্কার।
কালীনাথ বারন করা সত্তেও বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে যায়। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে ভোরের দিকে নইনিতাল পৌঁছায়। নইনিতাল পেরিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখে সেখানে দাঁড়ায়। আলমোড়া যাবার একটাই রাস্তা, চা খাবার সময়ে দোকানিকে সমীরদের গাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। দোকানি জানায়, যে একটা সাদা সুমো কয়েক ঘন্টা আগে ওর দোকানে থেমেছিল। গাড়ির ভদ্রমহিলা বেশ হাসি খুশি ছিলেন, গাড়ির ভদ্রলোকের সাথে বেশ গল্প করছিলেন। দোকানি জানায় যে রাতে ওর দোকানের পেছনের হোটেলে রাত কাটিয়েছে। বুধাদিত্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল আবার। চোখে ঘুমে নেই, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে একটু ক্লান্তি ভর করে আসে শরীরে। কালীনাথ নিপুণ হাতে পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাতে শুরু করে। পাহাড়ি রাস্তায় একটু ধিরে ধিরে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি ধিরে ধিরে এঁকে বেঁকে, পাহাড়ের চড়াই উঠতে সুর করে। বেশ কিছু দূর যাবার পরে একটা গাড়ি ওদের পেছন থেকে হর্ন দেয়। কালীনাথ পেছনের গাড়িটাকে আগে যাবার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। পেছনের গাড়ি পাশ দিয়ে যাবার সময়ে গাড়ির ভেতরে আচমকা চোখ যায় বুধাদিত্যের। ভেতরে নন্দিতা আর একজন লোক বসে। মাথার মধ্যে সমীরের পরিকল্পনার ছবি আঁকতে শুরু করে দেয়। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে দুরাভিসন্ধির কুটিল জল্পনা কিছুটা পরিষ্কার দেখা দেয়, সেই ছবি দেখে বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের। বুধাদিত্য কালীনাথকে সামনের নন্দিতাদের গাড়ির পিছু নিতে বলে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করাতে বুধাদিত্য জানায় যে সামনের গাড়িতে সমীরের গার্লফ্রেন্ড নন্দিতা বসে। কালীনাথের বয়স হয়েছে, অনেক কিছু দেখেছে। বুধাদিত্যের ওই কথা শুনে সব বুঝে যায়।
দুপুরের কিছু আগে আলমোড়া পৌঁছে যায়। বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে একটা খাবারের হোটেলের সামনে নন্দিতাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে। বুধাদিত্য গাড়ি থেকে নামে না, নন্দিতা ওকে পুনেতে দেখেছিল, আবার দেখতে পেয়ে চিনতে পেরে যাবে, সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এখানে যদি দেখে তাহলে ওদের গাড়ির পিছু করতে পারবে না। কালীনাথ সেই গাড়ির ড্রাইভারের সাথে বন্ধুত্ত পাতিয়ে খবর নেয় যে নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি যাবে। বুধাদিত্য চুপ করে বসে কিছুক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করে পরবর্তী পদক্ষেপ। বেশ কয়েকটা সিগারেট জ্বলে যায়। মনে মনে ঠিক করে যে সমীরকে এখুনি যদি ধরে, তাহলে সমীর সব কিছু এড়িয়ে যাবে। এতক্ষণে ভালোবাসার প্রবল নাটক রচে, ঝিলামের নরম হৃদয় গলিয়ে নিজের করে নিয়েছে। সেই পর্দা এক ঝটকায় সরান একটু কঠিন হবে, তবে দেখা যাক কত নীচ পর্যন্ত নামতে পারে সমীর। কালীনাথ দুই কাপ চা নিয়ে আসে। চা খেতে খেতে বুধাধিত্যকে বলে, “সাহেব, একটু দূর থেকে গাড়ি ফলো করব। যখন কান পেয়ে গেছি, তাহলে মাথা পেতে দেরি হবে না। কানের পেছনে যাই।” কালীনাথ আরও জানাল যে কথাবার্তা শুনে মনে হল নন্দিতার সাথের লোক সমীরকেও চেনে। চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু, মুন্সিয়ারি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। পাহাড়ি রাস্তায় বিশেষ চৌমাথা আসেনা, তাই কালীনাথ আবার ঘোড়ার গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয়। নন্দিতাদের গাড়ি টপকে বুধাদিত্যের গাড়ি আগেই মুন্সিয়ারি পৌঁছে যায়।
______________________________
ত্রয়োদশ পর্বঃ পুনরুজ্জীবিত। (#2)
সন্ধ্যেবেলায় মুন্সিয়ারি পৌঁছায় বুধাধিত্য। সামনে তুষারে ঢাকা পাঁচমাথা পঞ্চচুলি দাঁড়িয়ে, তাঁর নিচে, পাহাড়ের কোলে খুব ছোটো শহর মুন্সিয়ারি। গরমের ছুটির জন্য সেই জায়গায় লোকের সমাগম, কিলবিল করছে পর্যটক, রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হোটেলে মানুষের ভিড়। বুধাদিত্যের চোখ সমীরকে খুঁজে বেড়ায় আর কালীনাথের চোখ সেই সাদা সুমো খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু চারপাশে সাদা রঙের ভাড়ার গাড়ির সমাগম। হতাস হয়ে যায় দুজনেই, এর মধ্যে কোন গাড়িটা সমীরদের বুঝে উঠতে পারেনা। কয়েকটা হোটেলে গিয়ে ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু বেশির ভাগ হোটেলের লোক যাত্রীদের নাম বলতে পরিচয় জানাতে নারাজ। কিছুপরে নন্দিতাদের গাড়ি দেখে আসস্থ হয় বুধাদিত্য, সমীর মুন্সিয়ারিতে আছে, অন্য কোথাও যায়নি। নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি ছাড়িয়ে একটু নিচের দিকে চলে যায়। কালীনাথ খবর নিয়ে আসে, যে নিচের দিকে কিছু ছোটো হোটেল আছে, সেখানে হয়ত সমীর ঝিলামকে নিয়ে উঠেছে।
ঘন কালো রাত নেমে আসে পাহাড়ের কোলে, সেই রাতের মধ্যে আর ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় বুধাদিত্য। কালীনাথ একাএকা নন্দিতাদের গাড়ির পেছনে যায়। বুধাদিত্য ইতিমধ্যে মুন্সিয়ারি শহর তদারকি করে আসে, দেখে আসে যে পুলিস আছে কিনা। বাজারের একদিকে একটা পুলিস পিকেট দেখে আসস্থ হয় বুধাদিত্য। কিছু হলে অন্তত পুলিস খবর পায়। কিন্তু কাছের শহর বলতে বাগেশ্বর বা আলমোড়া সেখান থেকে অনেক দুরে। সাহায্য আসতে অনেক দেরি হবে। কিছু পরে কালীনাথ এসে জানায় যে, নন্দিতাদের গাড়ি নিচের একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই হোটেলের আশেপাশের হোটেলের সামনে আরও বেশ কয়েকটা সাদা সুমো দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে সমীরের গাড়ি চেনা অসম্ভব।
কালীনাথ উদ্বেগের সাথে বুধাদিত্যকে বলে, “সাহেব, সমীর যদি মেমসাব কে রাতে মেরে ফেলে তাহলে?” বুধাদিত্য চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, সমীর এত কাঁচা কাজ করবেনা। সমীরকে ছোটো বেলা থেকে চেনে বুধাদিত্য, খুব নিখুঁত ভাবে নিজের কার্যসিদ্ধি করবে সমীর। সেই জন্য ঝিলামকে এত দুরে, এক পর্যটক ভর্তি জায়গায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। ভাবতে বসে যে সমীর ঝিলামকে কি ভাবে আক্রমন করতে পারে। মাথার সব শিরা উপশিরা জেগে ওঠে একসাথে, চঞ্চল হয়ে ওঠে গায়ের রক্ত। মুন্সিয়ারিতে মোবাইল ফোন চলছে না যে কাউকে খবর দেবে। সমীর বেশ নিখুঁত ফন্দি এঁটে ঝিলামকে বশ করেছে।
সারারাত কালীনাথ আর বুধাদিত্য পালা করে গাড়ির মধ্যে জেগে বসে থাকে। সকাল হলে কালীনাথ বুধাদিত্যের জন্য চা জল খাবার নিয়ে আসে। কোন রকমে হাত মুখ ধুয়ে চা জল খাবার খেয়ে গাড়ি অন্য জায়গায় নিয়ে যায় কালীনাথ। বুধাদিত্য পর্যটকদের সাথে মিশে যায়। কিছু পরে হোটেলের ভেতর থেকে নন্দিতা আর সাথের লোকটা ঘুরতে বের হয়। বুধাদিত্য আড় চোখে কালীনাথকে ওদের পিছু নিতে ইঙ্গিত করে। বুধাদিত্যের চোখ শুধু ঝিলাম আর সমীরকে খুঁজে বেড়ায়। প্রচন্ড বিদ্বেষে গায়ের রক্ত তরল লাভায় পরিনত হয়ে গেছে, এক বার হাতের নাগালে পেলে পিস্তলের গুলি মাথার মধ্যে পুরে দেবে।
কিছু পরে কালীনাথ বুধাদিত্যের কাঁধে হাত রাখে, কানেকানে জানায় যে নন্দিতা ফিরে এসেছে হোটেলে। কিন্তু ঝিলাম আর সমীরের দেখা পায়নি কালীনাথ। কিছু পরে হোটেল থেকে নন্দিতা আর সাথের লোক বেড়িয়ে এসে মুন্সিয়ারির দিকে না হেঁটে অন্যদিকে পা বাড়ায়। সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কালীনাথের সাথে ওরা নন্দিতার পিছু নেয়। বুকের মাঝে ধুকপুক বেড়ে ওঠে, মাথার রগ ফুলে ওঠে, কিছু একটা ভয়ঙ্কর ঘটতে চলেছে এই সুন্দর নির্মল পরিবেশে। বুধাদিত্য বাম পাশের পাহাড়ে উঠে যায়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, উঁচু উঁচু গাছের পেছন দিয়ে এগিয়ে নন্দিতাকে অনুসরণ করে। একবার যখন কান পেয়েছে, মাথা পেতে দেরি হবে না। নিচের রাস্তায় অনেক লোকজন, সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ঝরনা পেরিয়ে যায়। পিচের রাস্তা শেষ, মাটির একটা রাস্তা একদিকে নিচে নেমে গেছে, অন্যদিকে একটি সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সেই সরু পাথুরে রাস্তায় পর্যটকের ভিড় অনেক কম, কিছু সংখ্যক পর্যটক কোন একদিকে ট্রেকিঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বেশ কিছু দুরে এগিয়ে যায় বুধাদিত্য আর কালীনাথ। চারপাশে সবুজ ঝোপঝাড়, আর বড় বড় গাছ। মাথার ওপরে নীল আকাশ, আকাশে বাতাসে একটু ঠাণ্ডার আমেজ, আবহাওয়া বেশ মনোরম। ভেবে পায়না বুধাদিত্য, এই রকম মনোরম পরিবেশে একটা নৃশংস কোন ঘটনা ঘটবে। অনেকের হাতে ক্যামেরা, অনেকেই ছবি তুলছে, দুরে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চচুলির। হটাত বুধাদিত্যের চোখ পরে কিছু দুরে হেঁটে যাওয়া সমীর আর ঝিলামের দিকে। ঝিলামের মুখ বেশ হাসিখুশি। চেহারা দেখে বোঝা যায় যে সমীর ফিরে আসাতে আর ওকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কারনে ওর মনের আনন্দ বহুগুন বেড়ে গেছে। সমীর ঝিলামের সাথে গল্প করতে করতে ধিরে ধিরে ওকে খাদের ধারে নিয়ে যায়। সরু রাস্তার ওইপাসে গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে একটা সরু পাহাড়ি নদী।
বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের, আকাশ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলামের নাম ধরে, “ঝিল্লিরানী দাঁড়িয়ে যাও।”
সেই আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছায়না। সমীর ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে ওর কানেকানে কিছু বলে। ঝিলাম অবিশ্বাস্য বেদনা ভরা পাংশু চোখে সমীরের দিকে তাকায়। সমীর আলতো করে কুনুই দিয়ে ঝিলামকে ঠেলে দেয়।
ঝিলাম চিৎকার করে ওঠে, “শেষ পর্যন্ত তুমি... নাআআআআআ...” কথা শেষ করতে পারেনা, পা পিছলে খাদের মধ্যে পরে যায় ঝিলাম।
সমীর কপট চিৎকার করে সাহায্যের জন্য নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বুধাদিত্য মাটি থেকে একটা বড় পাথর নিয়ে সমীরের পা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হটাত পায়ের ওপরে পাথরের মার খেয়ে সমীর টাল সামলাতে পারেনা। ঝিলামের সাথেসাথে সমীর খাদের ভেতরে গড়িয়ে পরে যায়। চেঁচামেচি শুনে সবাই ছুটে আসে। বুধাদিত্য আর কালীনাথ পাহাড় বেয়ে নিচে দিকে নেমে আসে। বুধদিত্য রোষকষিত চোখে একবার নন্দিতার দিকে তাকায়, সেই ভীষণ চোখের চাহনি দেখে নন্দিতার শরীরের রক্ত জল হয়ে যায়।
বুধাদিত্য কিছু না ভেবেই খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যায় নিচের দিকে। কিছু দুরে নিচে একটা পাথরে আটকা পরে থাকে ঝিলামের দেহ। মাথা ফেটে গেছে, চেহারা রক্তাক্ত, ঘাড় একদিকে কাত, ঝিলামের ক্ষত বিক্ষত দেহ কাঁপতে থাকে। আরও কিছু নিচের দিকে একটা ছোটো ঝোপের ডাল ধরে ঝুলে রয়েছে সমীর। রাগে ঘৃণায় দুচোখ থেকে রক্ত বেড়িয়ে আসার যোগাড় বুধাদিত্যের। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায়, ঝিলামকে কেড়ে নিও না। ঝিলামকে পাথরের উপর থেকে তুলে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। বুকের ওপরে পিষে মিলিয়ে নেয় ওর রক্তাত শরীর, বুকের কাছে কান পেতে শোনে ওর হৃদয়ের ধুকপুক। ঝিলাম বহু কষ্টে দুচোখ মেলে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়। ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। রক্তাক্ত হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যের জামা খামচে ধরে, ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মুখ গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। গায়ের জামা খুলে ঝিলামের মাথায় বেঁধে দেয়, রক্তক্ষরণ কিছুটা কমে যায়। বুকের কাছে জড়িয়ে ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে কপালে ঠোঁট চেপে ধরে ক্ষমা চায়।
বুধাদিত্য সমীরের দিকে তাকায়। খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ার সময়ে সমীরের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হয়, হাত পা কেটে রক্ত বের হয়। রক্তাক্ত সমীর বুধাদিত্যের দিকে মিনতি ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে সাহায্যের ভিক্ষা চায়।
বুধাদিত্যের মাথা গরম হয়ে যায়, চাপা গর্জন করে ওঠে সমীরের দিকে, “তুই ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়েটাকে মেরে ফেলার উপক্রম করবি সেটা ভাবতে পারিনি। তুই পাপী, এই জগতে তোর বেঁচে থেকে লাভ নেই। আজ তুই নন্দিতার জন্য ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস, কাল তুই অন্য কোন মেয়ের জন্য নন্দিতার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পিছপা হবি না। বেঁচে থাকার চেয়ে তোর মরাই ভালো।”
সমীরের আঁকড়ে থাকা ঝোপের গোড়াতে জুতো দিয়ে মারে বুধাধিত্য। ঝোপ উপড়ে যায়, সাথে সাথে সমীর সেই খাদের ভেতরে গড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য কপট চেঁচিয়ে ওঠে, সাহায্যের হাত বারিয়েও যেন বাচাতে পারে না। ওপরের সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, ততক্ষণে সমীরের প্রাণহীন দেহ নিচের পাহাড়ি নদী গ্রাস করে নেয়। ততক্ষণে কালীনাথ আর কয়েকজন স্থানিয় লোক নেমে আসে দড়ি বেয়ে। সবার অলক্ষ্যে কালীনাথ বুধাদিত্যের পেছন থেকে পিস্তল বের করে লুকিয়ে ফেলে।
ঝিলামের রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহ বুকের কাছে জড়িয়ে উপরে উঠে আসে। চারপাশে লোকের ভিড় জমে যায়। সবার চোখের সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কেউ কেউ বলে যে একটু অসাবধানতার জন্য এই রকম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে। পুলিস পিকেট থেকে পুলিস এসে যায়। বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনার কথা। বুধাদিত্য জানায় যে দম্পতিকে বুধাদিত্য চেনে। এরা দিল্লী থেকে এখানে ঘুরতে আসে। অসাবধানতার বশে দুজনে খাদে পরে যায়, স্বামী প্রান হারিয়েছে এবং স্ত্রী গুরতর আহত। সাব ইন্সপেক্টার আখিলেশ আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সবাই মোটামুটি এক কথাই জানায় যা তারা চোখে দেখেছে। পুলিস সবার কথামত রিপোর্ট লিখে ফেলে। বুধাদিত্যকে জানায় যে লোক নামিয়ে খাদ থেকে সমীরের দেহ উদ্ধার করতে কিছু সময় লাগবে। বুধাদিত্য জানায় যে আগে আহত ঝিলামের কিছু ব্যাবস্থ করতে। শুধু মাত্র বুধাদিত্য আর নন্দিতা জানে এই দুর্ঘটনা কতটা কপট মস্তিষ্কের অভিসন্ধি। নন্দিতা সেই ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলে। সেই কান্না বুধাদিত্যের মন গলাতে পারে না, একবার ভাবে সব সত্যি বলে নন্দিতাকে ধরিয়ে দেয়, কিন্তু একবার ভাবে যে, নন্দিতা বেঁচে গেছে সেটাই বড়। এই পৃথিবীর বুক থেকে একটা ধূর্ত লোকে কমিয়ে দিতে পেরেছে।
মুন্সিয়ারির ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া হয় ঝিলামকে। ডাক্তার ঝিলামকে পরীক্ষা করে জানায় মাথার আঘাত গুরুতর। এত উপর থেকে পড়ার ফলে হয়ত মাথার ভেতরে আঘাত লাগতে পারে, সিটি স্ক্যান করতে হবে আর সেইজন্য এখুনি ঝিলামকে নিয়ে আলমোড়া যেতে হবে। রক্তক্ষরণ থামানর জন্য মাথায় স্টিচ করে দেন আর হাত পায়ের কাটায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।
সাব ইন্সপেক্টর অখিলেশ কে সাথে নিয়ে বুধাদিত্য রওনা দেয় আলমোড়ার দিকে। বুধাদিত্যের কোলে অজ্ঞান ঝিলাম। দু’হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকে। বারেবারে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গোলাপি গাল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের কোনে কালো হয়ে গেছে। ঠোঁট কেটে গেছে, লাল ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে গোলাপি। নরম ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট নামিয়ে ছোটো একটা চুমু খায় বুধাদিত্য। কেন সমীরের কথায় বিশ্বাস করে বুকের পাঁজর কেটে পাঠিয়ে দিয়েছিল ঝিলামকে? কালীনাথ উন্মাদ হয়ে গেছে, মেমসাহেবের প্রান যেন ওর স্টিয়ারিরঙ্গের ওপরে নির্ভর। মুন্সিয়ারি থেকে আলমোড়া অনেকটা পথ। সামনে পুলিসের জিপ, পেছনে বুধাদিত্যের ইনোভা পাহাড়ের গা বেয়ে ধেয়ে চলে।
কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। দেবস্মিতা আর সুবিরবাবু ধানবাদ ফিরে গেছেন। বুধাদিত্য তাদের কথা দিয়েছে যে আগামি ছুটিতে ধানবাদ গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে। রঞ্জনবাবু আর প্রমীলাদেবীকে থেকে যেতে বলে, বলে যে কেদার বদ্রি ঘুরাতে নিয়ে যাবে। প্রমীলাদেবী জানান যে অনিন্দিতাদি নেপাল থেকে ফিরে এলে পরের বার সবাই মিলে যাওয়া যাবে।
ঝিলামের গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্যকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সমীর ওকে নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কোথাও একটা ঘুরতে যাবে। সমীর বুধাদিত্যকে জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচলের তাওয়াং উপত্যকা দিন পাঁচেকের জন্য ঘুরতে যাবে। সমীরের অনুরোধ রাখে বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওর পরিকল্পনা জানায়নি। ভেবেছিল যে স্বামী যখন তাঁর স্ত্রীকে ভালোবেসে একটা চমক দিতে চলেছে, তাহলে সেই আনন্দে বাধা দিয়ে তার লাভ নেই। সেই সাথে বুধাদিত্যের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে, পাঁচ দিনে অরুনাচল ঘুরে ফিরবে? সমীরকে জানিয়ে দেয় যে কোন রকম দুরাভিসন্ধি মাথায় রাখলে মেরে ফেলবে সমীরকে। সমীর হেসে জানায় যে ওর মাথায় কোন বাজে পরিকল্পনা নেই। তাও সমীরকে ঠিক ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না বুধাদিত্য। ঝিলামের হাসি মুখ দেখে সন্দেহের বীজ বুকের মধ্যে রেখে দেয়।
সকালে অফিস বের হবার আগে ঝিলাম জানায় যে রাতে নাকি ওর বেড়িয়ে যাবে। ঝিলাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য তৈরি, ব্যাগ ঘুছিয়ে নিয়েছে। কণ্ঠস্বরে একটু উদ্বেগের ছোঁয়া, বুধাদিত্য আসস্থ করে নিরুদ্বেগে বরের সাথে ঘুরতে যেতে, কিছু হলে বুধাদিত্য দেখে নেবে। রাতের বেলা ঝিলামের এস.এম.এস আসে, “আমরা বেড়িয়ে গেছি। ভালো থেক।” বুধাদিত্য সেই এস.এম.এস পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, ভালোবাসার পাত্রী “ঝিল্লি” তাঁর স্বামীর সাথে মনের আনন্দে ঘুরতে বেড়িয়ে গেছে। মোবাইলে ওর ছবি খুলে দেখে, বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে, ঝিলামকে এই জীবনে এই বুকের মধ্যে আর পাওয়া আর হল না। ঘুম আসেনা বুধাদিত্যের, চোখ বন্ধ করলেই ঝিলামের মিষ্টি মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরেছিল ঝিলাম, কিন্তু আটকাতে পারেনি বুধাদিত্য। বুকের ওপরে ওর ঠোঁটের পরশ এখনো লেগে। আলমারি খুলে ওর জামা মুখের ওপরে মেলে ধরে গায়ের গন্ধ বুকে টেনে নেয়।
ঘন্টা চারেক পরে আবার একটা এস.এম.এস, “আমারা গড়গঙ্গা পার হচ্ছি। জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তবে খুব খুশি আমি।” খবরটা পড়ে মাথা ঘুরে যায় বুধাদিত্যের, সমীর জানিয়েছিল যে ঝিলামকে নিয়ে অরুনাচল ঘুরতে যাবে। দিল্লী ছাড়ার চার ঘন্টা পরে, ঝিলাম গড়গঙ্গার কাছে কি করছে? সমীরের পরিকল্পনার সাথে অঙ্ক মেলাতে পারে না। ঝিলামকে একটা এস.এম.এস করে জিজ্ঞেস করে গাড়ির নাম্বার আর গাড়িতে কে কে আছে। পরের এস.এম.এসে’র কোন উত্তর না পেয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পরে বুধাদিত্য।
রাত প্রায় বারোটা বাজে, সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার কালীনাথকে ফোন করে ডেকে নেয়। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করে কারন, কোথায় যেতে হবে। বুধাদিত্য সংক্ষেপে জানায় যে গন্তব্য স্থলের ঠিক নেই তবে ঝিলাম বিপদে। কালীনাথ এতদিন বুধাদিত্যের সাথে থেকে বুঝে গেছে, যে সাহেবের জীবনে ঝিলাম মেমসাহেব খুব বড় স্থান দখল করে রেখেছে। দরজার তালা ভেঙ্গে সমীরের বাড়ি ঢোকে। সব ঘর তছনছ করে ফেলে, সমীরের দুরাভিসন্ধি ধরার জন্য। শেষ পর্যন্ত ওদের শোয়ার ঘরের বিছানার তলায় একটা বড় হলদে খামে দুটি প্লেনের টিকিট, সমীরের পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ, বেশ কয়েক হাজার ডলার পায়। প্লেনের টিকিট, একটা সমীরের নামে অন্যটা নন্দিতার নামে। তারিখ পনেরো দিন পরের, গন্তব্য স্থান, মরিশাস। তার মানে, ঝিলামকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চায় সমীর। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, পুরানো বন্ধু না শত্রু বলা ভালো, এক ভয়ঙ্কর ধূর্ত সমীর হয়ে ফিরে এসেছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের, ঝিলামের সাথে এত বড় বিশাস ঘাতকতা। ঝিলাম না জেনে হাসতে হাসতে বিপদের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে, সারা শরীর টানটান হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের। খাম’টা নিজের সাথে নিয়ে নেয়। ঝিলামকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেট জানার জন্য সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় কোন সুত্র যদি পায় কিন্তু তার চিনহ পায় না। মাথা চেপে বসে পরে, কেন মরতে সমীরের কথায় বিশ্বাস করে ঝিলামকে পাঠিয়েছিল। বড় অনুশোচনা হয় বুধাদিত্যের। একবারের জন্য মনে হয় নিজের মাথার মধ্যে পিস্তলের সব কটা গুলি নামিয়ে দিতে। দরজার শব্দে বাড়ির মালিক পৌঁছে যায় কি হচ্ছে দেখার জন্য। বুধাদিত্য তাঁকে ঝিলাম আর সমীরের কথা জিজ্ঞেস। বাড়ির মালিক জানায়, যে এই কদিনে ওদের বাড়িতে বাইরের লোক কেউ আসেনি। সমীরের আচরনে কোনোরকমে মনে হয়নি যে সমীর আর ঝিলামের মাঝে কোন দ্বন্দ আছে। দুজনে বেশ ভালোই ছিল এই কটা দিন। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে গেছে, সেই ব্যাপারে কিছু জানে কি না। উত্তরে বাড়ির মালিক বলেন যে, একটা সাদা সুমো ভাড়ার গাড়ি চেপে ওরা বেড়াতে বেড়িয়েছে, গাড়িতে দিল্লীর নাম্বার। কোথায় বেড়াতে গেছে কিছু বলে যায়নি সঠিক, তবে দিন পাঁচেক পরে ফিরবে বলে গেছে। বাড়ির দরজায় একটা নতুন তালা লাগিয়ে বেড়িয়ে পরে বুধাদিত্য।
চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এতক্ষণে ঝিলামকে নিয়ে অনেক দূর পার হয়ে গেছে সমীর। গা হাত পা জ্বলছে বুধাদিত্যের, রাগে থরথর কাঁপতে শুরু করে। সমীরকে একবার হাতের কাছে পেলে মেরে ফেলবে। ফুলের মতন সুন্দরী মেয়েটা মনে প্রানে স্বামীর কথায় বিশ্বাস করে আবার ফিরে যায়, সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয় ব্যাভিচারি ইতর সমীর। বুধাদিত্য ঝিলামকে ফোন করে, কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলে, উন্মাদ হয়ে ওঠে বুধাদিত্য। পিস্তল বের করে কোমরে গুঁজে নেয়। সাথে দুটো অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। কিছু দূর যাবার পরে কালীনাথকে পাশে বসতে বলে নিজেই গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, প্রথম গন্তব্যস্থল গড়গঙ্গা। বুকের মাঝে একটাই আশা এর মাঝে যেন ঝিলামকে আঘাত না করে। ঘন্টা আড়াইয়ের মধ্যে গড়গঙ্গা পৌঁছে যায়। দুই তিনটে ধাবা খোলা ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করে যে একটা সাদা সুমো গাড়ি থেমেছিল কিনা। একটা ধাবার লোক জানায় যে কয়েক ঘন্টা আগে একটা সাদা সুমো থেমেছিল তার ধাবায়। বুধাদিত্য মোবাইলে ঝিলামের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই গাড়িতে এই মহিলা ছিল কিনা? ধাবার লোক জানায় যে হ্যাঁ, ওই গাড়িতে ছবির ভদ্রমহিলা ছিলেন। গাড়িতে স্বামী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। সমীর ধাবার মালিকের কাছে মুরাদাবাদের রাস্তা আর আলমোড়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিল। সমীরের হাতে একটা উত্তরাখণ্ডের ম্যাপ ছিল। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ওদের দেখে কি কোন রকম সন্দেহ হয়েছিল ধাবার মালিকের? মাথা নাড়িয়ে বলে, না, এক নববিবাহিত দম্পতির মতন পরস্পরের সাথে হেসে খেলে গল্প করছিল। চোয়াল শক্ত করে সব তথ্য মাথার মধ্যে এঁকে নেয় বুধাদিত্য। মুরাদাবাদ পর্যন্ত পাগলের মতন গাড়ি চালায়, কিন্তু সেই সাদা সুমোর দেখা পাওয়া যায়না কিছুতেই। সে গাড়ি যে অনেক আগে বেড়িয়ে গেছে। ঝিলাম আর সমীর কে বারেবারে ফোনে ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুপরে দুটো ফোন সুইচ অফ বলে। প্রবল এক ঝড় বুকের রক্ত উথাল পাতাল করে তোলে। চোখের সামনে বারেবারে ঝিলাম এসে দাঁড়িয়ে পরে, কানে ভেসে আসে ঝিলামের মিষ্টি হাসি, রাঙ্গা পায়ের নুপুরের রিনিঝিনি সঙ্গীত, উচ্ছল তরঙ্গিণীর মধুর ঝঙ্কার।
কালীনাথ বারন করা সত্তেও বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে যায়। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে ভোরের দিকে নইনিতাল পৌঁছায়। নইনিতাল পেরিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখে সেখানে দাঁড়ায়। আলমোড়া যাবার একটাই রাস্তা, চা খাবার সময়ে দোকানিকে সমীরদের গাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। দোকানি জানায়, যে একটা সাদা সুমো কয়েক ঘন্টা আগে ওর দোকানে থেমেছিল। গাড়ির ভদ্রমহিলা বেশ হাসি খুশি ছিলেন, গাড়ির ভদ্রলোকের সাথে বেশ গল্প করছিলেন। দোকানি জানায় যে রাতে ওর দোকানের পেছনের হোটেলে রাত কাটিয়েছে। বুধাদিত্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল আবার। চোখে ঘুমে নেই, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে একটু ক্লান্তি ভর করে আসে শরীরে। কালীনাথ নিপুণ হাতে পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাতে শুরু করে। পাহাড়ি রাস্তায় একটু ধিরে ধিরে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি ধিরে ধিরে এঁকে বেঁকে, পাহাড়ের চড়াই উঠতে সুর করে। বেশ কিছু দূর যাবার পরে একটা গাড়ি ওদের পেছন থেকে হর্ন দেয়। কালীনাথ পেছনের গাড়িটাকে আগে যাবার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। পেছনের গাড়ি পাশ দিয়ে যাবার সময়ে গাড়ির ভেতরে আচমকা চোখ যায় বুধাদিত্যের। ভেতরে নন্দিতা আর একজন লোক বসে। মাথার মধ্যে সমীরের পরিকল্পনার ছবি আঁকতে শুরু করে দেয়। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে দুরাভিসন্ধির কুটিল জল্পনা কিছুটা পরিষ্কার দেখা দেয়, সেই ছবি দেখে বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের। বুধাদিত্য কালীনাথকে সামনের নন্দিতাদের গাড়ির পিছু নিতে বলে। কালীনাথ জিজ্ঞেস করাতে বুধাদিত্য জানায় যে সামনের গাড়িতে সমীরের গার্লফ্রেন্ড নন্দিতা বসে। কালীনাথের বয়স হয়েছে, অনেক কিছু দেখেছে। বুধাদিত্যের ওই কথা শুনে সব বুঝে যায়।
দুপুরের কিছু আগে আলমোড়া পৌঁছে যায়। বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে একটা খাবারের হোটেলের সামনে নন্দিতাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে। বুধাদিত্য গাড়ি থেকে নামে না, নন্দিতা ওকে পুনেতে দেখেছিল, আবার দেখতে পেয়ে চিনতে পেরে যাবে, সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এখানে যদি দেখে তাহলে ওদের গাড়ির পিছু করতে পারবে না। কালীনাথ সেই গাড়ির ড্রাইভারের সাথে বন্ধুত্ত পাতিয়ে খবর নেয় যে নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি যাবে। বুধাদিত্য চুপ করে বসে কিছুক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করে পরবর্তী পদক্ষেপ। বেশ কয়েকটা সিগারেট জ্বলে যায়। মনে মনে ঠিক করে যে সমীরকে এখুনি যদি ধরে, তাহলে সমীর সব কিছু এড়িয়ে যাবে। এতক্ষণে ভালোবাসার প্রবল নাটক রচে, ঝিলামের নরম হৃদয় গলিয়ে নিজের করে নিয়েছে। সেই পর্দা এক ঝটকায় সরান একটু কঠিন হবে, তবে দেখা যাক কত নীচ পর্যন্ত নামতে পারে সমীর। কালীনাথ দুই কাপ চা নিয়ে আসে। চা খেতে খেতে বুধাধিত্যকে বলে, “সাহেব, একটু দূর থেকে গাড়ি ফলো করব। যখন কান পেয়ে গেছি, তাহলে মাথা পেতে দেরি হবে না। কানের পেছনে যাই।” কালীনাথ আরও জানাল যে কথাবার্তা শুনে মনে হল নন্দিতার সাথের লোক সমীরকেও চেনে। চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু, মুন্সিয়ারি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। পাহাড়ি রাস্তায় বিশেষ চৌমাথা আসেনা, তাই কালীনাথ আবার ঘোড়ার গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয়। নন্দিতাদের গাড়ি টপকে বুধাদিত্যের গাড়ি আগেই মুন্সিয়ারি পৌঁছে যায়।
______________________________
ত্রয়োদশ পর্বঃ পুনরুজ্জীবিত। (#2)
সন্ধ্যেবেলায় মুন্সিয়ারি পৌঁছায় বুধাধিত্য। সামনে তুষারে ঢাকা পাঁচমাথা পঞ্চচুলি দাঁড়িয়ে, তাঁর নিচে, পাহাড়ের কোলে খুব ছোটো শহর মুন্সিয়ারি। গরমের ছুটির জন্য সেই জায়গায় লোকের সমাগম, কিলবিল করছে পর্যটক, রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হোটেলে মানুষের ভিড়। বুধাদিত্যের চোখ সমীরকে খুঁজে বেড়ায় আর কালীনাথের চোখ সেই সাদা সুমো খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু চারপাশে সাদা রঙের ভাড়ার গাড়ির সমাগম। হতাস হয়ে যায় দুজনেই, এর মধ্যে কোন গাড়িটা সমীরদের বুঝে উঠতে পারেনা। কয়েকটা হোটেলে গিয়ে ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু বেশির ভাগ হোটেলের লোক যাত্রীদের নাম বলতে পরিচয় জানাতে নারাজ। কিছুপরে নন্দিতাদের গাড়ি দেখে আসস্থ হয় বুধাদিত্য, সমীর মুন্সিয়ারিতে আছে, অন্য কোথাও যায়নি। নন্দিতাদের গাড়ি মুন্সিয়ারি ছাড়িয়ে একটু নিচের দিকে চলে যায়। কালীনাথ খবর নিয়ে আসে, যে নিচের দিকে কিছু ছোটো হোটেল আছে, সেখানে হয়ত সমীর ঝিলামকে নিয়ে উঠেছে।
ঘন কালো রাত নেমে আসে পাহাড়ের কোলে, সেই রাতের মধ্যে আর ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় বুধাদিত্য। কালীনাথ একাএকা নন্দিতাদের গাড়ির পেছনে যায়। বুধাদিত্য ইতিমধ্যে মুন্সিয়ারি শহর তদারকি করে আসে, দেখে আসে যে পুলিস আছে কিনা। বাজারের একদিকে একটা পুলিস পিকেট দেখে আসস্থ হয় বুধাদিত্য। কিছু হলে অন্তত পুলিস খবর পায়। কিন্তু কাছের শহর বলতে বাগেশ্বর বা আলমোড়া সেখান থেকে অনেক দুরে। সাহায্য আসতে অনেক দেরি হবে। কিছু পরে কালীনাথ এসে জানায় যে, নন্দিতাদের গাড়ি নিচের একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই হোটেলের আশেপাশের হোটেলের সামনে আরও বেশ কয়েকটা সাদা সুমো দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে সমীরের গাড়ি চেনা অসম্ভব।
কালীনাথ উদ্বেগের সাথে বুধাদিত্যকে বলে, “সাহেব, সমীর যদি মেমসাব কে রাতে মেরে ফেলে তাহলে?” বুধাদিত্য চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, সমীর এত কাঁচা কাজ করবেনা। সমীরকে ছোটো বেলা থেকে চেনে বুধাদিত্য, খুব নিখুঁত ভাবে নিজের কার্যসিদ্ধি করবে সমীর। সেই জন্য ঝিলামকে এত দুরে, এক পর্যটক ভর্তি জায়গায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। ভাবতে বসে যে সমীর ঝিলামকে কি ভাবে আক্রমন করতে পারে। মাথার সব শিরা উপশিরা জেগে ওঠে একসাথে, চঞ্চল হয়ে ওঠে গায়ের রক্ত। মুন্সিয়ারিতে মোবাইল ফোন চলছে না যে কাউকে খবর দেবে। সমীর বেশ নিখুঁত ফন্দি এঁটে ঝিলামকে বশ করেছে।
সারারাত কালীনাথ আর বুধাদিত্য পালা করে গাড়ির মধ্যে জেগে বসে থাকে। সকাল হলে কালীনাথ বুধাদিত্যের জন্য চা জল খাবার নিয়ে আসে। কোন রকমে হাত মুখ ধুয়ে চা জল খাবার খেয়ে গাড়ি অন্য জায়গায় নিয়ে যায় কালীনাথ। বুধাদিত্য পর্যটকদের সাথে মিশে যায়। কিছু পরে হোটেলের ভেতর থেকে নন্দিতা আর সাথের লোকটা ঘুরতে বের হয়। বুধাদিত্য আড় চোখে কালীনাথকে ওদের পিছু নিতে ইঙ্গিত করে। বুধাদিত্যের চোখ শুধু ঝিলাম আর সমীরকে খুঁজে বেড়ায়। প্রচন্ড বিদ্বেষে গায়ের রক্ত তরল লাভায় পরিনত হয়ে গেছে, এক বার হাতের নাগালে পেলে পিস্তলের গুলি মাথার মধ্যে পুরে দেবে।
কিছু পরে কালীনাথ বুধাদিত্যের কাঁধে হাত রাখে, কানেকানে জানায় যে নন্দিতা ফিরে এসেছে হোটেলে। কিন্তু ঝিলাম আর সমীরের দেখা পায়নি কালীনাথ। কিছু পরে হোটেল থেকে নন্দিতা আর সাথের লোক বেড়িয়ে এসে মুন্সিয়ারির দিকে না হেঁটে অন্যদিকে পা বাড়ায়। সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কালীনাথের সাথে ওরা নন্দিতার পিছু নেয়। বুকের মাঝে ধুকপুক বেড়ে ওঠে, মাথার রগ ফুলে ওঠে, কিছু একটা ভয়ঙ্কর ঘটতে চলেছে এই সুন্দর নির্মল পরিবেশে। বুধাদিত্য বাম পাশের পাহাড়ে উঠে যায়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, উঁচু উঁচু গাছের পেছন দিয়ে এগিয়ে নন্দিতাকে অনুসরণ করে। একবার যখন কান পেয়েছে, মাথা পেতে দেরি হবে না। নিচের রাস্তায় অনেক লোকজন, সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ঝরনা পেরিয়ে যায়। পিচের রাস্তা শেষ, মাটির একটা রাস্তা একদিকে নিচে নেমে গেছে, অন্যদিকে একটি সরু রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সেই সরু পাথুরে রাস্তায় পর্যটকের ভিড় অনেক কম, কিছু সংখ্যক পর্যটক কোন একদিকে ট্রেকিঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বেশ কিছু দুরে এগিয়ে যায় বুধাদিত্য আর কালীনাথ। চারপাশে সবুজ ঝোপঝাড়, আর বড় বড় গাছ। মাথার ওপরে নীল আকাশ, আকাশে বাতাসে একটু ঠাণ্ডার আমেজ, আবহাওয়া বেশ মনোরম। ভেবে পায়না বুধাদিত্য, এই রকম মনোরম পরিবেশে একটা নৃশংস কোন ঘটনা ঘটবে। অনেকের হাতে ক্যামেরা, অনেকেই ছবি তুলছে, দুরে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চচুলির। হটাত বুধাদিত্যের চোখ পরে কিছু দুরে হেঁটে যাওয়া সমীর আর ঝিলামের দিকে। ঝিলামের মুখ বেশ হাসিখুশি। চেহারা দেখে বোঝা যায় যে সমীর ফিরে আসাতে আর ওকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কারনে ওর মনের আনন্দ বহুগুন বেড়ে গেছে। সমীর ঝিলামের সাথে গল্প করতে করতে ধিরে ধিরে ওকে খাদের ধারে নিয়ে যায়। সরু রাস্তার ওইপাসে গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে একটা সরু পাহাড়ি নদী।
বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের, আকাশ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলামের নাম ধরে, “ঝিল্লিরানী দাঁড়িয়ে যাও।”
সেই আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছায়না। সমীর ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে ওর কানেকানে কিছু বলে। ঝিলাম অবিশ্বাস্য বেদনা ভরা পাংশু চোখে সমীরের দিকে তাকায়। সমীর আলতো করে কুনুই দিয়ে ঝিলামকে ঠেলে দেয়।
ঝিলাম চিৎকার করে ওঠে, “শেষ পর্যন্ত তুমি... নাআআআআআ...” কথা শেষ করতে পারেনা, পা পিছলে খাদের মধ্যে পরে যায় ঝিলাম।
সমীর কপট চিৎকার করে সাহায্যের জন্য নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বুধাদিত্য মাটি থেকে একটা বড় পাথর নিয়ে সমীরের পা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হটাত পায়ের ওপরে পাথরের মার খেয়ে সমীর টাল সামলাতে পারেনা। ঝিলামের সাথেসাথে সমীর খাদের ভেতরে গড়িয়ে পরে যায়। চেঁচামেচি শুনে সবাই ছুটে আসে। বুধাদিত্য আর কালীনাথ পাহাড় বেয়ে নিচে দিকে নেমে আসে। বুধদিত্য রোষকষিত চোখে একবার নন্দিতার দিকে তাকায়, সেই ভীষণ চোখের চাহনি দেখে নন্দিতার শরীরের রক্ত জল হয়ে যায়।
বুধাদিত্য কিছু না ভেবেই খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যায় নিচের দিকে। কিছু দুরে নিচে একটা পাথরে আটকা পরে থাকে ঝিলামের দেহ। মাথা ফেটে গেছে, চেহারা রক্তাক্ত, ঘাড় একদিকে কাত, ঝিলামের ক্ষত বিক্ষত দেহ কাঁপতে থাকে। আরও কিছু নিচের দিকে একটা ছোটো ঝোপের ডাল ধরে ঝুলে রয়েছে সমীর। রাগে ঘৃণায় দুচোখ থেকে রক্ত বেড়িয়ে আসার যোগাড় বুধাদিত্যের। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায়, ঝিলামকে কেড়ে নিও না। ঝিলামকে পাথরের উপর থেকে তুলে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। বুকের ওপরে পিষে মিলিয়ে নেয় ওর রক্তাত শরীর, বুকের কাছে কান পেতে শোনে ওর হৃদয়ের ধুকপুক। ঝিলাম বহু কষ্টে দুচোখ মেলে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়। ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। রক্তাক্ত হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যের জামা খামচে ধরে, ঝিলাম ওর বুকের ওপরে মুখ গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। গায়ের জামা খুলে ঝিলামের মাথায় বেঁধে দেয়, রক্তক্ষরণ কিছুটা কমে যায়। বুকের কাছে জড়িয়ে ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে কপালে ঠোঁট চেপে ধরে ক্ষমা চায়।
বুধাদিত্য সমীরের দিকে তাকায়। খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ার সময়ে সমীরের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হয়, হাত পা কেটে রক্ত বের হয়। রক্তাক্ত সমীর বুধাদিত্যের দিকে মিনতি ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে সাহায্যের ভিক্ষা চায়।
বুধাদিত্যের মাথা গরম হয়ে যায়, চাপা গর্জন করে ওঠে সমীরের দিকে, “তুই ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়েটাকে মেরে ফেলার উপক্রম করবি সেটা ভাবতে পারিনি। তুই পাপী, এই জগতে তোর বেঁচে থেকে লাভ নেই। আজ তুই নন্দিতার জন্য ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস, কাল তুই অন্য কোন মেয়ের জন্য নন্দিতার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পিছপা হবি না। বেঁচে থাকার চেয়ে তোর মরাই ভালো।”
সমীরের আঁকড়ে থাকা ঝোপের গোড়াতে জুতো দিয়ে মারে বুধাধিত্য। ঝোপ উপড়ে যায়, সাথে সাথে সমীর সেই খাদের ভেতরে গড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য কপট চেঁচিয়ে ওঠে, সাহায্যের হাত বারিয়েও যেন বাচাতে পারে না। ওপরের সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, ততক্ষণে সমীরের প্রাণহীন দেহ নিচের পাহাড়ি নদী গ্রাস করে নেয়। ততক্ষণে কালীনাথ আর কয়েকজন স্থানিয় লোক নেমে আসে দড়ি বেয়ে। সবার অলক্ষ্যে কালীনাথ বুধাদিত্যের পেছন থেকে পিস্তল বের করে লুকিয়ে ফেলে।
ঝিলামের রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহ বুকের কাছে জড়িয়ে উপরে উঠে আসে। চারপাশে লোকের ভিড় জমে যায়। সবার চোখের সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কেউ কেউ বলে যে একটু অসাবধানতার জন্য এই রকম ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে। পুলিস পিকেট থেকে পুলিস এসে যায়। বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনার কথা। বুধাদিত্য জানায় যে দম্পতিকে বুধাদিত্য চেনে। এরা দিল্লী থেকে এখানে ঘুরতে আসে। অসাবধানতার বশে দুজনে খাদে পরে যায়, স্বামী প্রান হারিয়েছে এবং স্ত্রী গুরতর আহত। সাব ইন্সপেক্টার আখিলেশ আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সবাই মোটামুটি এক কথাই জানায় যা তারা চোখে দেখেছে। পুলিস সবার কথামত রিপোর্ট লিখে ফেলে। বুধাদিত্যকে জানায় যে লোক নামিয়ে খাদ থেকে সমীরের দেহ উদ্ধার করতে কিছু সময় লাগবে। বুধাদিত্য জানায় যে আগে আহত ঝিলামের কিছু ব্যাবস্থ করতে। শুধু মাত্র বুধাদিত্য আর নন্দিতা জানে এই দুর্ঘটনা কতটা কপট মস্তিষ্কের অভিসন্ধি। নন্দিতা সেই ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলে। সেই কান্না বুধাদিত্যের মন গলাতে পারে না, একবার ভাবে সব সত্যি বলে নন্দিতাকে ধরিয়ে দেয়, কিন্তু একবার ভাবে যে, নন্দিতা বেঁচে গেছে সেটাই বড়। এই পৃথিবীর বুক থেকে একটা ধূর্ত লোকে কমিয়ে দিতে পেরেছে।
মুন্সিয়ারির ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া হয় ঝিলামকে। ডাক্তার ঝিলামকে পরীক্ষা করে জানায় মাথার আঘাত গুরুতর। এত উপর থেকে পড়ার ফলে হয়ত মাথার ভেতরে আঘাত লাগতে পারে, সিটি স্ক্যান করতে হবে আর সেইজন্য এখুনি ঝিলামকে নিয়ে আলমোড়া যেতে হবে। রক্তক্ষরণ থামানর জন্য মাথায় স্টিচ করে দেন আর হাত পায়ের কাটায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।
সাব ইন্সপেক্টর অখিলেশ কে সাথে নিয়ে বুধাদিত্য রওনা দেয় আলমোড়ার দিকে। বুধাদিত্যের কোলে অজ্ঞান ঝিলাম। দু’হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকে। বারেবারে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গোলাপি গাল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের কোনে কালো হয়ে গেছে। ঠোঁট কেটে গেছে, লাল ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে গোলাপি। নরম ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট নামিয়ে ছোটো একটা চুমু খায় বুধাদিত্য। কেন সমীরের কথায় বিশ্বাস করে বুকের পাঁজর কেটে পাঠিয়ে দিয়েছিল ঝিলামকে? কালীনাথ উন্মাদ হয়ে গেছে, মেমসাহেবের প্রান যেন ওর স্টিয়ারিরঙ্গের ওপরে নির্ভর। মুন্সিয়ারি থেকে আলমোড়া অনেকটা পথ। সামনে পুলিসের জিপ, পেছনে বুধাদিত্যের ইনোভা পাহাড়ের গা বেয়ে ধেয়ে চলে।