Thread Rating:
  • 26 Vote(s) - 3.46 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance ভালবাসার রাজপ্রাসাদ Written By Pinuram
#59
না খেয়ে শেষ পর্যন্ত বিনিদ্র রজনী কাটায় অভি, সকালের দিকে ঘুম পায়। সকালেও কেউ ওকে ডাকতে আসেনা। অনেক দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে অভির, চোখ খুলে ঘড়ি দেখে, এত খনে বাবা মা কাজে বেড়িয়ে গেছেন। বাইরে তাকিয়ে দেখে, বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বাড়িতে শুধু অভি আর পরী, চুপচাপ নিচে নেমে লক্ষ্য করে যে নিজের ঘরের বিছানার ওপরে বসে পরী। জানালার বাইরে একমনে তাকিয়ে আছে আর জানালার বাইরে গাছের ওপরে বৃষ্টির জল পরা দেখছে। চুপ করে বসে, হাঁটু ভাঁজ করা, হাঁটুর ওপরে থুতনি রাখা, দু’চোখে অব্যাক্ত কোন বেদনা ছলকে পড়ছে। ধিরে ধিরে ওর পাসে গিয়ে বসে অভি। লক্ষ্য করে যে, গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। পরী নিজের খেয়ালে এতই মগ্ন ছিল যে বুঝতেই পারেনি যে অভি ওর পাসে এসে বসেছে। পরীর কাঁধে হাত রাখতেই পরী নিজের সম্বিৎ ফিরে পায়। জল ভরা লাল চোখে অভির দিকে তাকায়, সারা চেহারায় এক ব্যাথা ফুটে উঠেছে পরীর, বুকের ভেতরে যেন কোন বেদনা ওকে দুমড়ে মুচরে একাকার করে দিয়েছে।

অভি চিন্তিত হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে, তোমার?"

মাথা নাড়ায় পরী, "কিছু না।"

অভি, "ওইরকম ভাবে বসে আছো কেন?"

বুকের ভেতরে যেন দামামা বাজতে শুরু করেছে।

আবার মাথা নাড়ায় পরী, "কিছু হয়নি, বলছি তো।"

পায়ের দিকে তাকিয়ে বিছানার ওপরে নখ দিয়ে খোঁটে। দু’কাঁধে হাত রাখে অভি, পরীর হাঁটুর কাপড় চোখের জলে ভিজে উঠেছে।

বেদনার চাপা চিৎকার করে ওঠে অভির দিকে, "তোমরা সবাই স্বার্থপর। আমার আশেপাশের সব মানুষ স্বার্থপর।"

চুবুকে আঙুল দিয়ে মাথা তুলতে চেষ্টা করে অভি, ঘাড় শক্ত করে রাখে পরী। বার বার অনুরোধ করে, কি হয়েছে জানাতে, পরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, বাইরে অঝোরে শ্রাবনের ধারা।

শেষে ধরা গলায় বলে, "যখন ছোটো ছিলাম, আমাকে চন্দ্রানিদির কাপড় পড়তে হত। ওর বই আমাকে পড়তে হত। আমার জন্য কোনদিন নতুন বই কেনা হত না, আমি কোনদিন কোন নতুন জামা কাপড় পাইনি। মায়ের কাছে নতুন জামা চাইতেই মা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেন। বড় হলাম আমি, বড় বৌদি আমাদের বাড়ি এলেন। সেই প্রথম আমি পুজোর সময়ে নতুন জামা পাই, বড় বৌদি আমায় নতুন জামা কিনে দেয়। ইন্দ্রানিদি আর চন্দ্রানিদির বিয়ে হয়ে গেল। ওরাই আমাদের বাড়ির খরচ উঠাত। সুমন্তদা শুধু মাত্র এক চাষি, বাকি দুই দাদাও ছোটো ছোটো, কেউ তখন কোন টাকা অর্জন করে না। আমি বাড়ির ছোটো তাই সবাই নিজেদের মতামত আমার ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইত।"

দু’চোখে অবিরাম শ্রাবনের ধারা বয়ে চলে পরীর, অভি ওর মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে যায়। বিরক্ত হয়ে পরী ওর হাত সরিয়ে দেয়। পরী থামে না, "আমি আরও বড় হলাম। কোনোরকমে আমার পড়াশুনা করান হল। দিদিরা আমার বিয়ের জন্য মেতে ওঠে। মা আর সুমন্তদা আমার বিয়ের কথা শুনে প্রথমে বাধা দেন। ইন্দ্রানিদি ওর দেওরের সাথে আমার বিয়ের ঠিক করে, আমি তখন ক্লাস টুয়েল্ভে পড়ি। শশাঙ্কদা বিয়েতে মত দেননা, আমাকে গ্রাজুয়েসানে ভর্তি করে দেন। গ্রাজুয়েসানের শেষ শশাঙ্কদা আমার বিয়ের ঠিক করে মেঘনা বউদির এক খুড়তুত ভাইয়ের সাথে। সারা জীবন সবাই মিলে আমার ওপরে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়, একবারের জন্য কেউ আমাকে আমার মনের কথা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমি কে? আমি কি একটা জ্যান্ত পুতুল নাকি? সবার কথা সারা জীবনভর আমাকে শুনে যেতে হবে? আমার নিজের কি কখন কোন মতামত থাকতে পারেনা? ছোটমাকে শেষ পর্যন্ত ডাকা হয় আর তুমি এলে আমার জীবনে। আজ তুমিও আমার ওপরে চেঁচিয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত। আমি কি তোমাদের সবার হাতে একটা কাঠের পুতুল নাকি? সবাই যা বলবে তাই আমাকে মেনে নিতে হবে। আমার নিজের কোন চাহিদা থাকতে পারেনা? ছোটবেলা থেকে দিদিরা, তারপরে দাদাদের, আর এখন তোমার কথা মানতে হবে আমাকে? আমার কি হৃদয় বলতে কিছু নেই? আমার কি নিজের কিছু ইচ্ছে থাকতে পারেনা, অভি?"

পরীকে কাছে টেনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ক্ষমা চায় অভি, "আমি দুঃখিত পরী, ক্ষমা করে দাও।"

অভিকে ঠেলে সরিয়ে দেয় পরী, "তারমানে তুমি যদি জানতে যে আমার খারাপ লাগবে তাহলে তুমি করতে না, তাই ত? তুমি নিজে থেকে একবারের জন্য ভেবে দেখেছ কি, যে আমি তোমার সাথে যখন ওই অজানা জায়গায় গেছিলাম তখন আমার মনের অবস্থা কি ছিল? একবারের জন্য নিজে ভেবেছ কি, যে তুমি অরুনিমার সাথে কি করছ, সেটা আমি জানতে পারলে আমার মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে? না, তুমি নিজে থেকে একবারের জন্যেও ভাবোনি। তোমাকে না বললে তুমি ভাবতে পার না, কেন? অভি কেন? তোমরা সবাই স্বার্থপর, শুধু নিজেদের কথাই ভাবো।"

কি বলবে অভি, ভাষা যেন গলার কাছে দুমড়ে আটকে থাকে, কোনোক্রমে উত্তর দেয়, "অরুনিমা একটা ভুল মাত্র, পরী।"

চিৎকার করে ওঠে পরী, "ও, ভুল। পুরুষ মানুষ ভুল করলে ভুল নয় সেটা পুরুষত্ব আর মেয়েরা করলে সেটা ছেনালিপনা, তাই না? কেন এইরকম আলাদা মনের ভাব, অভি?"

অভি পরীর মাথা বুকের ওপরে চেপে ধরে, ডুকরে কেঁদে ফেলে পরী, "পরী, প্লিস, ক্ষমা করে দাও, প্লিস। আমি প্রতিজ্ঞা করছি জীবনে কোনদিন আমি তোমাকে আঘাত করবো না। কখনই না, পরী। আমি তোমাকে সব দুঃখ কষ্ট থেকে অনেক অনেক দুরে রাখব, দুহাতে আগলে রাখবো তোমাকে।"

বুকের কাপড় দু’হাতে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় অভির বুক। পরীর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে অভি, "দেখ, আর কেঁদো না, নাহলে এবারে আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব। একটি বারের জন্য হাসও, পরী। দেখ, আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে কোনদিন কিছু করতে বলব না, তোমাকে জিন্স পড়তে বলব না, তোমাকে ইংরাজি সিনেমা দেখতেও বলব না। যেখানে তোমার ইচ্ছে হবে না সেই জায়গায় পর্যন্ত যাবো না আমি।"

ওর কথা শুনে চোখের জল মুছে তাকায় অভির দিকে, "কে বলেছে তোমাকে যে আমি জিন্স পড়তে ভালোবাসি না? আমি তোমার জন্য কাজাতে পড়েছিলাম না।"

পরীর মুখে হাসি দেখে অভি স্বস্তির শ্বাস নেয়, "যাক বাবা, বাঁচালে। তা দুপুরে কি রান্না করেছ?"

পরী বিছানার ওপরে ঠেলে ফেলে দেয় অভিকে, "সকাল থেকে এত মন খারাপ ছিল যে রান্না ঘরে ঢুকতে মন করেনি তাই কিছুই রান্না করিনি। ছোটমা বাবু চলে যাওয়ার পরে এখানে বসে বসে শুধু বৃষ্টি দেখেছি। খুব একা মনে হচ্ছিল তখন, জানো।"

অভি ওর হাত ধরে টান দেয় আর পরী ওর বুকের ওপরে পরে যায়, "কে বলেছে তুমি একা? আমি আছি যে তোমার সাথে।"

অভির বুকের ওপরে হাত রেখে, থুতনি রাখে বুকের ওপরে, ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে পরী। অভি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে শক্ত করে। অভি চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে, "সিনেমা দেখতে যাবে?"

বুকের ওপরে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, "মাথা খারাপ নাকি, তোমার সাথে আবার সিনেমা দেখতে যাওয়া। রান্না করতে হবে না? দুপুরে খাবে কি?" কোনোরকমে অভির দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।

অভি বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, জানালার সামনের জামরুল গাছের পাতায় টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়ছে, সামনের কার্নিশে একটা চরুই পাখি জুবুথুবু হয়ে বসে, মাঝে মাঝে পাখা ঝেরে গায়ের জল শুকিয়ে নিচ্ছে। অভি বুকের ওপরে হাত বোলায়, ঠিক যেখানে ওর প্রেয়সী আদর করে চাঁটি মেরে গেছে, মনে হয় যেন সেই নরম আঙ্গুলের ছোঁয়া এখন লেগে।

"এই এখন পরে পরে কি ভাবছ? খাবার তৈরি, চলে এসো।"

খাবার ঘর থেকে পরী ওকে ডাক দেয়।

খাবার ঘরে ঢুকে পরীকে বলে, "আমি এখন স্নান করিনি, বেবি।"

কাছে এসে পেছনে আদর করে এক লাথি মেরে বলে, "তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এস, খিদেতে আমার পেট জ্বলছে।"

অভি ওর পেছনে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, "আমি কিন্তু তোমার পেছনে লাথি মারব না, অমন রসাল মন্ড একেবারে কামড়ে খেয়ে নেব।"

খিলখিল করে হেসে ফেলে পরী, অভিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় বাথরুমের ভেতরে।

বাবার আদেশ অনুসারে কিছুদিন পরে অভি ব্যাঙ্কিং পরীক্ষার আর অন্য কিছু সরকারি চাকুরির পরীক্ষার ফর্ম কেনার জন্য বারি থেকে বের হবার উদ্যোগ করে। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ গুমোট বেঁধে, যেকোনো সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। কোলকাতায় একবার বৃষ্টি নামলে ধরতে অনেক সময় লাগে। এমন সময়ে পরী এসে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যাচ্ছে ও। অভি জানায় যে কলেজস্ট্রিট যাবে ফর্ম কেনার জন্য, পরী ও ওর সাথে বের হবার জন্য জেদ ধরে।

অভি ওকে বুঝিয়ে বলে, "দেখ, আকাশ গুমোট বেঁধে বৃষ্টি যেকোনো সময়ে নামতে পারে। তুমি বাড়িতে থাক, আমি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসব।"

বিষাদের ছায়া নেমে আসে পরীর চেহারায়, "সারাদিন একা একা বারি বসে কি করব আমি? কোথাও যেতে পারিনা। আমি যদি তোমার সাথে যাই তাহলে তোমার কি অসুবিধে হবে? আমাকে আজ পর্যন্ত কলেজ স্ট্রীট নিয়ে গেলে না।"

অভি ওর বিষণ্ণ চেহারা দেখে শেষ পর্যন্ত মত দেয়, "ঠিক আছে বাবা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।"

তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বেড়িয়ে এল পরী, দেখে মনে হল যেন কোলকাতার রাস্তায় আগুন ধরাবে। গাড় নীল রঙের স্কার্ট, জানু পর্যন্ত চেপে বসা তাঁর নিচে ঘাগরার মতন ফুলে উঠেছে। পরনের কাপড় চেপে বসে পরীর কোমরের নিচের অংশ যেন ফুটে বেড়িয়েছে। গায়ে আঁটো গোলাপি জামা, গলায় গাড় নীল স্টোল, নিজের অপরূপ যৌবন ঢেকে রাখার জন্য গায়ের ওপরে জড়িয়ে নিয়েছে। মাথার চুল একপাসে সিথে করে আঁচড়ান, ঘাড়ের কাছে আলতো এক খোঁপায় বাঁধা। কানে দুটি ক্রিস্টালের লম্বা দুল। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অভি, ওর গাড় বাদামি রঙের ঠোঁটের দিকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ওই মধুর ঠোঁট জোড়া।

অভির চোখে ভালবাসার তীব্র চাহনি দেখে লাজুক হেসে বলে, "দেখছ কি ওইরকম ভাবে?"

অভি কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন, "যেতেই হবে, তুমি ত মেরে ফেললে আমাকে, পরী।"

লজ্জা পেয়ে যায় অভির কথা শুনে, "উফ, বাবা, আর পারি না। চাবি নাও, তালা দাও আর তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পরো।"

কলেজ স্ট্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা পরীক্ষার জন্য কিছু বই আর চাকরির ফর্ম কেনে। সেটা পরী প্রথম বার কলেজ স্ট্রীট যাওয়া, আসে পাশের শত শত বইয়ের দোকান দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ও। সরু সরু রাস্তা, তাঁর ভেতরেও বইয়ের দোকান দেখে অবাক হয়ে যায়। ওদিকে আকাশে মেঘ বেশ একটু জমে আসে। পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, কত বইয়ের দোকান হবে এখানে? ওকে উত্যক্ত করার জন্য অভি উত্তর দেয় যে প্রায় আট হাজার ছয়শ বাইশ খানা বইয়ের দোকান।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে, "সত্যি, তুমি গুনেছ?"

অভি হাসি চাপতে পারেনা, "বিশ্বাস করছ না ত, ঠিক আছে গুনে দেখ তাহলে।"

তখন পরী বুঝতে পারে যে অভি ওকে বোকা বানিয়েছে আর সেই রাস্তার মাঝেই ছাতা পেটা শুরু করে অভিকে, "শয়তান ছেলে আমার বোকা বানানো হচ্ছে।"

বাঁ হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে, "আহ, দারুন, না না তুমি বোকা নও। তুমি কি করে আমার কথা বিশ্বাস করে নিলে সেটাই প্রশ্ন।"

ফর্ম কেনা শেষ, ও অভিকে জিজ্ঞেস করে, "ফর্ম কেনা হয়ে গেছে ত, এখন কি করা যায়?"

অভি জিজ্ঞেস করে, "কফি হাউস যাবে?"

পরী, "না গো, আমি তোমার ওই অরুনা বাঁ সমুদ্রনীলের মতন আতেল নই গো।"

ঠিক সেই সময়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, আর কোলকাতার বৃষ্টি, একেবারে মুষলধারে নেমে আসে ওদের ওপরে। ঠিক সেই সময়ে বউবাজারের দিক থেকে একটা ট্রাম আসতে দেখে ওরা। পরী ট্রামের দিকে দেখিয়ে অভিকে বলে চড়ে যেতে। অভির জন্য না দাঁড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্রামে লাফিয়ে উঠে পরে আর অভির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। অগত্যা অভি দৌড় লাগিয়ে পরীর পেছন পেছন ট্রামে চড়ে যায়। পরীর ওই বাচ্চা সুলভ আচরন দেখে অভির মনে দোলা লাগে।

ট্রামে উঠে ওর গালে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, "কোন ধারনা আছে কি এই ট্রাম কোথায় যাচ্ছে?"

খিলখিল করে হেসে দেয় পরী, "না একদম নয়। জেনে কি হবে তুমি আছো ত আমার সাথে, ব্যাস।"

কন্ডাক্টার কে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে যে ট্রাম শ্যাম্বাজার যাবে। হাতিবাগানের কাছে এসে গেছে ট্রাম। পরী বাইরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "এই নামো নামো নামো..."

অবাক হয়ে যায় অভি, "কেন কি হল?"

পরী অভির জামা টেনে ধরে বাইরে দেখায়, "দেখ, দর্পণে হটাত বৃষ্টি চলছে, চলো না দেখি।"

অভি নাক কুঁচকে বলে, "ধুর বাবা, বাংলা সিনেমা।"

অভির হাত ধরে টেনে কন্ডাক্টার কে ট্রাম থামাতে বলে, "অ দাদা দারান।" অভিকে বলে, "চলো না, প্লিস। তুমি যদি আমাকে এই সিনেমা দেখাও তাহলে আমি তোমার সাথে ওই চাই পাশ ইংরাজি সিনেমা দেখতে যাব। কি নাম সেই ইংরাজি মুভি টার।"

মুখ বেঁকায় অভি, "সিন্ডলারস লিস্ট।"

পরী, "আচ্ছা বাবা, যারই লিস্ট হোক, আমি দেখতে যাবো, কথা দিচ্ছি। যতক্ষণ তুমি পাশে আছো ততক্ষণ আমার কোন চিন্তা নেই।"

শেষ পর্যন্ত আকাশের বৃষ্টি আর প্রান প্রেয়সীর দৌলতে অভিকে বাংলা সিনেমা, "হটাত বৃষ্টি" দেখতে হয়। সিনেমা দেখে বাইরে বেড়িয়ে দেখে যে আকাশ কালো, বৃষ্টির ধারা অবিরাম ঝরে চলেছে, আর বৃষ্টির চোটে কোলকাতার রাস্তা ঘাটের কথা আর নাই বাঁ জানানো হল আলাদা করে। চারদিকে জলে থই থই। ওদের কাছে একটা ফোল্ডিং ছাতা, মুষলধার বৃষ্টি বাগ মানেনা, কিন্তু দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ধরার অপেক্ষা করার জো নেই। বাবা মা বাড়ি পৌঁছানর আগে বাড়ি পৌছাতে হবে না হলে, আবার কখন আগ্নেয়গিরি ফেটে লাভা নির্গত হবে তাঁর নেই ঠিক। বৃষ্টি তে ভিজে গেছে পরী আর গায়ের কাপড় খুব বাজে ভাবে ত্বকের সাথে লেপটে রয়েছে। চারিদিকে হায়নার চোখের আড়াল করে ছাতা দিয়ে পরীকে আগলে রাখে অভি। গায়ে স্টোল টা ভালো করে জড়িয়ে নিতে বলে। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি চেপে বাড়ি ফেরে।

বাড়ি ফিরে দেখে যে বাবা বাড়ি পৌঁছে গেছেন। বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যায় শতগুন। বাবা জিজ্ঞেস করাতে অভি উত্তর দেয় যে, পরীক্ষার ফর্ম কিনতে কলেজ স্ট্রীট গেছিল। বাকি উত্তর পরী দেয় যে, রাস্তায় অরুনার সাথে দেখা হয়ে যায় তাই দেরি হয়ে যায় ওদের। কিছু পরে কাপড় বদলে নিচে এসে দেখে যে মা বাড়ি ফিরে এসেছেন। পরী ঘন ঘন হাচি দিচ্ছে। মা পরীকে জিজ্ঞেস করে যে কেন এত হাচি দিছে। পরী জানিয়ে দেয় যে ওরা কলেজ স্ট্রীট গেছিল অভির ফর্ম কন্তে সেখানে অরুনার সাথে দেখা হয়ে যায় তাই দেরি হয় আর সেই সময়ে বৃষ্টি নামে আর ওরা ভিজে যায়। মা শাল এনে ওর গায়ে জড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে যে মেয়ের গায়ে জ্বর।

অভির দিকে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোর কোন জ্ঞান বুদ্ধি নেই। মেয়েটার শেষ পর্যন্ত জ্বর হয়েছে।"

অভি হাঁ, পরীর জ্বর হয়েছে তার জন্য মা ওকে দায়ী করছেন, ঠিক বুঝতে পারে না। বাবা নিজের ঘর থেকে বলেন, "হাদা ছেলেটা, এই বৃষ্টিতে পরীকে নিয়ে কলেজ স্ট্রীট যাবার কি দরকার ছিল।"

অভি, "ছাতা নিয়ে গেছিলাম আমরা।"

মা রেগে মেগে বলেন, "ওকে নিয়ে যাবার কি দরকার ছিল তোর?"

ওর সামনে ছোটো মা অভিকে বকুনি দিচ্ছে, ছোটোমায়ের কথা শুনে পরীর মনে বড় আঘাত লাগে। পরী অভির পখ নিয়ে ছোটমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অভি আঙুল নাড়িয়ে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করে। পরী ব্যাথা ভরা চাহনি দেয় অভির দিকে। পরীকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে অভিকে ডাক্তারের কাছে নাম লেখাতে বলে।

বাবার বন্ধু, বাড়ির ডাক্তার, রাতে পরীকে দেখে যান আর কিছু ওষুধ লিখে দেন। বলেন যে কিছু না শুধু একটু সর্দি জ্বর হয়েছে, কিন্তু মেয়ের জ্বর দেখে পরীর ছোটমা অতি বিচলিত হয়ে ওঠেন। অভি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে শুধু মাত্র একটু সর্দি জ্বর হয়েছে, অতে চিন্তা করার কিছু নেই, কিন্তু মায়ের মন মানেনা। রাত বেড়ে চলে, পরীর জ্বর বেড়ে যায়। দরজার ফাঁক থেকে দেখে যে পরী জ্বরের তাপে কাঁপছে আর মা ঠায় ওর মাথার কাছে বসে জল দিয়ে কপাল ধুয়ে দিচ্ছেন। সারা রাত জ্বরের বেদনায় কাতরায় পরী, মাথার কাছে মা বসে থাকেন, চিন্তায় ঘুম আসেনা, ওদিকে বসার ঘরে জেগে বসে অনুতপ্ত অভি, দু’চোখে ঘুম নেই। সকালের দিকে পরীর জ্বর কমে আর একটু ঘুমাতে পারে পরী। ওদিকে অভি শুধু মাত্র দূর থেকে দেখে ব্যাথায় কাতরানো হৃদয়কে, মায়ের সামনে ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বোলানোর উপায় পর্যন্ত নেই।

সকাল বেলায় মা অভিকে বলেন যে, পরীর জ্বর একটু কমেছে, মা কলেজ যাচ্ছেন, অভি যেন সারাদিন বাড়িতেই থাকে। অভিকে না বললেও পরীকে ছেড়ে ও কোথাও যেত না। বাবা মা চলে যাওয়ার পরে, পরীর ঘরে ঢোকে। আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা। পাশে বসে ঝুঁকে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে এক ভাবে চেয়ে থাকে। আদর করে গালে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। গালের লালিমা যেন নেই, একরাতের জ্বরে যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। গায়ে জ্বর না থাকলেও, বিছানা ছেড়ে ওঠবার শক্তি টুকু ছিলনা ওর। চুপ করে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়, নিজের খাবার কথা ভুলে গিয়ে। মা আদেশ দিয়ে গেছেন সময় মতন ওষুধ খাওয়াতে পরীকে। বিছানা ছেড়ে উঠে ওর জন্য খাবার আনতে যায়, আর হাতে টান পরে। ঘুরে দেখে পরী ওর দিকে তাকিয়ে কষ্টে হেসে মৃদু সুরে বলে, "একটু বসে যাও।"
Like Reply


Messages In This Thread
RE: ভালবাসার রাজপ্রাসাদ Written By Pinuram - by sorbobhuk - 27-02-2019, 08:59 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)