27-02-2019, 08:41 PM
বীরের প্রত্যাবর্তন
কোমরের নিচে সজোর এক লাথির চোটে অভির ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে সামনে সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
সুপ্রতিমদা, "কিরে বোকা... উঠে পড়। সবাই ধাঙ্কার যাবার জন্য তৈরি আর আমাদের টিম লিডার নাক ডেকে ঘুমচ্ছে।"
অভি ঘুম চোখ রগড়ে সুপ্রতিমদাকে জিজ্ঞেস করে, "পরী কোথায়?"
সুপ্রতিমদা, "শালা, সারা রাত ধরে তুমি তোমার পেরেক গুঁজে যাবে আর ভাবছ যে সকাল বেলায় ও তোমার পাশে থাকবে? বোকা... ওঠ..."
মাথা চুলকে সুপ্রতিমদার দিকে হেসে বলে, "বোকা... তুই যেন হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলি, তুই কি পেরেক গুঁজিসনি মাখনের মধ্যে?"
দুজনেই হেসে ফেলে গত রাতের কথা ভেবে। সুপ্রতিমদা বলে, "পাঁচটা মেয়েই সকালে উঠে পরে, হাঁটতে গেছে স্পিতির দিকে।"
অভির গায়ে কোন কাপড় নেই, সুপ্রতমদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রতিমদা মেঝে থেকে অভির প্যান্ট তুলে ছুঁড়ে মারে অভির মুখের ওপরে। শয়তানি হেসে বলে, "উঠে পর এবারে বোকা... তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে, স্রে আটটা বাজে, এতক্ষণে মনে হয় মেয়েরা এসে গেছে।"
তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে স্নান সেরে, জামা কাপড় পরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে অভি। বাইরের ঘাসের বাগানের ওপরে টেবিল পেতে ওদের সকালের খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে হোটেলের ম্যানেজার। আজকে ওরা ধাঙ্কার মঠ ঘুরতে যাবে। খাবার টেবিলে পরীর দিকে তাকায় অভি, পরী ওর উল্টো দিকে রিতিকা আর অরুনার মাঝে বসে। পরনে দুধ সাদা একটা সালোয়ার কামিজ আর তাঁর ওপরে গাড় নীল রঙের কার্ডিগান। সকালে উঠে স্নান সেরে নেওয়া ওর অভ্যেস, সদ্য স্নাত পরীকে দেখতে ঠিক এক দুধ সাদা অপ্সরার মতন লাগছে। দুপাশের, সুন্দরী নারী দের এক জন যেন মহামায়া আরেক জন শকুন্তলা। পরী মেয়েদের সাথে গল্প করে আর মাঝে মাঝে অভির দিকে আর চোখের তাকিয়ে হাসে।
চেহারায় এক অধভুত সুন্দর লালিমার ছটা। ভুরু নাচিয়ে পরীর দিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছো, দুষ্টু সোনা?"
শয়তানি করে জিব বের করে অভি আর প্লেটে থাকা চাটনি চেটে নেয়। অভির শয়তানি হাসি আর প্লেট চাটা দেখে পরীর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ওকি বুঝাতে চাইছে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে পরীর মুখ।
অভি ইশারায় জানায়, "তোমার মধু ভারী মিষ্টি, বেবি!"
সকালের খাওয়া শেষে অভির পরীকে অনুরধ করে জিন্স পড়ার জন্য। পরী নারাজ, জিন্স পড়তে, বলে যে অতে নাকি শরীরের প্রত্যেক আঁকিবুঁকি ভালো করে বোঝা যায় তাই লজ্জা করে ওর। বুঝিয়ে উঠতে পারে না অভি যে ওই পোশাকে পরীকে খুব আকর্ষণীয় দেখাবে। ওর কথা শুনে লজ্জায় কান লাল হয়ে যায়।
রিতিকা পরীর কাছে এসে কানে কানে বলে, "তোমার ফিগার এত সুন্দর, তোমাকে জিন্স আর টপে মারাত্মক দেখতে লাগবে, সবাই দেখে পাগল হয়ে যাবে।"
পরী ফিসফিস করে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কি ইচ্ছে?"
ডান হাত কাঁধে রেখে পরীকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অভি, দুজনে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ঘড়ে ঢুকেই অভি পরীকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের লতি চুষে নেয় ঠোঁটের মাঝে।
পরী মোচর দিয়ে ককিয়ে বলে, "উফ, ছাড়ো ছাড়ো, এখন আর শয়তানি করোনা, ধাঙ্কার যেতে হবে, দেরি হয়ে যাবে।"
অভি পরীকে বাহুপাশ থেকে মুক্ত না করেই জিজ্ঞেস করে, "সকালে আমাকে একা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছিলে?"
পরী চোখ বন্ধ করে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয়, "তোমার চোখের দিকে তাকাতে আমার খুব লজ্জা করছিল, তাই আমি সকালে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাকিদের সাথে।"
পেটের ওপরে হাত চেপে, গালে গাল ঘষে কানে কানে বলে, "আই লাভ ইউ, পরী।"
পরী মৃদু সুরে ককিয়ে ওঠে, "ম্মম্মম্মম্মম... ছাড়ো আমাকে, না হলে কি করে জিন্স পড়ব?"
অভি পরীকে ছেড়ে দেয়, পরী আলমারি থেকে জিন্স আর মভ রঙের টপ বের করে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমে ঢোকার আগে অভির দিকে একটু বিরক্তি, একটু দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে জিব বের করে ভেঙ্গিয়ে দেয়। অভি ওর দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে যে ওকে জিন্সে আর চাপা টপে প্রচন্ড আকর্ষণীয় দেখাবে। অভির দিকে হাত তুলে চাঁটি মারার ইশারা করে পরী, "শয়তান কোথাকার।" দরজা বন্ধ করে দেয়।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে প্রেয়সীর অপেক্ষা করে। জিন্স আর টপ পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে পরী, পরীর সেই রুপ দেখে অভির মুখ হাঁ হয়ে যায়। সিগারেট টানা ভুলে নিস্পলক চোখে দেখতে থাকে পরীকে। কোমরের নিচে ত্বকের সাথে চেপে বসে জিন্সের মসৃণ কাপড়। কোমরের নিচের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন উন্মচিত, না, জিন্সের কাপড়ের পেছনে ঢাকা বটে, কিন্তু অভির চোখে যেন সেই কাপড় ফুঁরে সব কিছু দেখতে পায়। সামনে জানুমাঝে ছোটো চেন, যেন নারীসুখের দোরগোড়ার এক অধভুত অবয়াব ধারন করেছে। অভি যেন চোখ ফেরাতে পারেনা, পরীর দেহ পল্লব থেকে। পরনের টপ, পরীর শরীরে যেন দ্বিতীয় ত্বক, দেহের অবয়াব যেন অতি পুরাতন বালির ঘড়ির মতন।
মাথার ওপরে জাপানি পুতুলের মতন করে খোঁপা বাঁধা, খপার মধ্যে দুটি ছোটো ছোটো কাঠি গোঁজা। কানে মুক্তোর দুল, ঠোঁটে গাড় বাদামি রঙ, চোখের কোলে কাজল। সবমিলিয়ে পরীকে দেখে মনে হচ্ছে যে স্পিতির তীরে আগুন লাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে আজ।
অভি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পরীকে। অভির তপ্ত চোখের চাহনি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে অভির বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলে, "আমার না খুব লজ্জা করছে, সোনা। আমি বাইরে যাবো না।"
মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, "কেন বেবি?"
বুকের ওপরে দাঁত দিয়ে আলতো কামর কেটে পরী বলে, "তোমার চোখ দুটি যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল, যেন আমার গায়ে কোন কাপড় নেই।"
ঠিক সেইসময়ে দরজায় টোকা মেরে রিতিকা ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। পরী আর অভিকে দৃঢ় আবেগের আলিঙ্গনে বদ্ধ থাকতে দেখে রিতিকা বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। পরী অভির বুক আলতো করে ঠেলে দিয়ে আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিতিকাকে জিজ্ঞেস করে যে কি খুঁজতে এসেছে।
রিতিকা পরীকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরে দৌড়ে গিয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে, "আমি ছেলে হলে নিশ্চয় তোমার প্রেমে পরে যেতাম।"
রিতিকা অভির দিকে চোখ টিপে বলে, "এক দিনের জন্য তোমার বউকে দেবে আমায়?"
রিতিকার দেহের গঠনও খুব সুন্দর আর কমনীয়। পরনে গাড় নীল রঙের আঁটো জিন্স আর সাদা শার্ট। অভি বেশ কিছুক্ষণ রিতিকার দিকে তাকিয়ে থাকে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবে চোখের সামনে এই দুই সুন্দরী আজ স্পিতির তীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
অভি পরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে বাম হাত নিজের হাতে নিয়ে ছোটো একটা চুমু খায়। তারপরে গেয়ে ওঠে,
"আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,
মম সরসীতে তব উজ্বল প্রভাত, বিম্বিত যেন লাজে,
আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,......"
পরীকে সঙ্গে নিয়ে রিতিকা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল, পেছন পেছন অভি। অরুনাও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক। অরুনা পরীর দিকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, "তুমি সত্যি পরী, শুচিদি। তুমি যা পর তাই তোমাকে মানায়।"
পরী নতুন বউয়ের মতন লজ্জা পেয়ে যায় অরুনার কথা শুনে।
সুপ্রতিমদা ওর কাছে এসে মৃদু সুরে বলে, "লজ্জাবতি লতা, গালের লালিমা বিয়ের রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখো। এখন প্রান খুলে আনন্দ কর, ডার্লিং।"
কল্যাণী আর রানীও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক, জীবনের প্রথম বার পরী অইরকমের পোশাক পড়েছে।
কিছুপরেই অভিরা ধাঙ্কার মঠের দিকে রওনা দেয়। গাড়ির চালক সুপ্রতিমদা, পাশে বসে রিতিকা। অরুনাকে নিয়ে পরী আর অভি পেছনে বসে।
কাজা থেকে ধাঙ্কার বেশ কিছু দুরে। ধাঙ্কার মঠ, উঁচু পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়ের অধিকাংশ ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে গেছে, পুরানো মঠের বেশির ভাগ অংশ খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। দূর থেকে সেই পাহাড় দেখলে মনে হয় যেন উঁচু এক উইয়ের ঢিবি। খুব কম বৌদ্ধ সাধু বসবাস করে পুরানো মঠে, একটি নতুন মঠ রাস্তার পাশে তৈরি করা হয়েছে। দুপুরের খাওয়া ওরা ধাঙ্কারে সেরে নেয়।
অভি আর সুপ্রতিমদা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার কে কাজার আগের রাস্তার খবর জিজ্ঞেস করে। ম্যানেজার জানায় যে কাজা ঠেলে লোসার নামক একটি গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি ভালো, তারপরে ঠিক রাস্তা বলে কিছু নেই। আগের রাস্তা পাথর, বালি আর ঝরনায় ঢাকা, সুউচ্চ হিমালয়ের বুক চিড়ে রাস্তা, খুব ভয়ঙ্কর আর অতিব সুন্দর। কাজা থেকে মানালি, আরাইশ কিলোমিটারের মতন আর পুর রাস্তা একদিনে পার করতে হবে। কারন মাঝপথে থাকার কোন জায়গা নেই, আছে শুধু পাহাড় আর গভীর খাদ। রাস্তার মাঝে প্রচুর চড়াই উতরাই আছে আর কুঞ্জুম পাস নামক একজায়াগয় চড়াই পনেরো হাজার ফিটের ওপরে।
সবাই অভির দিকে তাকায়, এমন কি পরীও তাকায়, যেন ওই রাস্তার জন্য অভি দায়ী।
মাথার ওপরে হাত ছুঁড়ে সবার মনে উৎসাহ জাগাতে চেঁচিয়ে বলে, "আরে বাবা, চিয়ার আপ। ভগবান তোমাদের একটা জীবন দিয়েছে, আনন্দ করও, খুশিতে মন ভরিয়ে নাও গুরু। যতক্ষণ অভিমন্যু সাথে আছে, তোমাদের কোন ভিয় নেই।"
অরুনা অভির দিকে চেঁচিয়ে বলে, "হ্যাঁ, সে কথা ত শুধু শুচিদির জন্য, বাকিদের কি?"
অরুনাকে ক্ষেপানোর জন্য অভি বলে, "তোকে না হয় এখান থেকে ছুঁড়ে সমুদ্র নীলের কোলে ফেলে দেব, তাহলে ত খুশি? এবারে হাস হাস..."
ঠিক করা হল যে বিকেলে কোথাও না বেড়িয়ে সবাই হোটেলে বিশ্রাম করবে, কাল খুব ভরে রওনা দেবে কাজা থেকে। ধাঙ্কার থেকে কাজা ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটে বেজে যায়। ফেরার পথে মেয়েরা দীপঙ্কর আর রামানুজ বাজারের কাছে নেমে গেল। অরুনা আর পরী জানাল যে ওরা বারিতে ফোন করতে চায়। অভি পরীকে বলল যে ওর ছোটমায়ের সাথে ও কথা বললেই হবে, পরী একটু বিরক্তি বোধ করে। রিতিকা আর বাকি মেয়েরা একটু কেনাকাটা করবে। ইনোভা ওদের জন্য রেখে সুপ্রতিমদা আর অভি হোটেলে ফিরে আসে।
কাজায় শেষ দিন। সূর্য ডোবার পরে, পরী অভিকে অনুরধ করে নদীতে ঘুরতে যেতে। অরুনা ওর ঘরে বসে রানী আর কল্যাণীর সাথে গল্প করছিল। পরী চাইছিল যে ওরা একটু একা একা ঘুরতে যাক, অভির ও একি অভিপ্রায়। হোটেলে থেকে বের হতে যাবে তখন রিতিকার সাথে দেখা, রিতিকা ওদের জিজ্ঞেস করাতে, পরী জানায় যে ওরা নদীর দিকে ঘুরতে যাচ্ছে আর রাতে খাওয়ার আগে ফিরবে। সেই শুনে রিতিকা সুপ্রতমদাকে ডাক দেয় আর অভিদের সঙ্গে বেড়িয়ে পরে। হোটেল থেকে বেশ দুরে নদী, সুপ্রতিমদা অতি সন্তর্পণে গাড়ি সেই পাথুরে রাস্তার ওপরে দিয়ে, নদী গর্ভে নামিয়ে দেয়।
সূর্য ডুবে গেছে, পশ্চিমের আকাশ কমলা রঙের। পায়ের তলায় কুলুকুলু বয়ে চলেছে স্পিতি নদী। কোথাও হাঁটু, কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত জল। নদী গর্ভ ছোটো ছোটো গোল গোল পাথরে ঢাকা। নদী অনেক চওড়া হলেও জল নেই তাতে, মাঝে মাঝে অতি সরু জলধারার রেখা।
দুই রমণীর পরনে জিন্স আর টপ, যেন ওদের নধর কমনীয় দেহ পল্লবের সাথে আঠার মতন সেটে। অভি আর সুপ্রতিমদা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে অল্প অল্প চুমুক দেয়। দুই কপোতের দুই প্রেয়সী জলে নেমে ঘুরে বেড়ায় আর জল নিয়ে খেলা করে। দূর থেকে অভি আর সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে। মনে হয় যেন জল ছেড়ে উঠে দুই সুন্দরী মৎস্যকন্যা ওদের সামনে কেলি করছে। কিছু পরে সুপ্রতিমদা নদীর তীরের দিকে গিয়ে কিছু কাঠ আর শুকনো ঝোপ ঝার উপড়ে নিয়ে আসে।অভি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দেয় যে আগুন জ্বালাবে, কেননা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে বাঁচতে হবে। আকাশের লালিমা ধিরে ধিরে কমে আসে, আস্তে আস্তে ওদের চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। স্পিতির গর্ভে শুধু মাত্র ওর চারজন, দুরে শহরের ছোটো ছোটো আলো দেখা যায়, মাথার ওপরে পরিষ্কার আকাশ।
সুপ্রতিমদা আগুন জ্বালায়, রিতিকা আর পরী গাড়ির বনেটের ওপরে বসে পরে। রিতিকার পাশে সুপ্রতিমদা ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে আর রিতিকা ওর গলা। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে, অভির হাত পরীর কোমরে। দুই জোড়া কপোত কপোতী প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। সবার দৃষ্টি দুরে পশ্চিমে উঁচু পাহাড়ের দিকে, দুরে বরফে ঢাকা পাহাড়।
রিতিকা উদাস সুরে বলে, "এখানে আসা উচিত হয়নি।"
গলা যেন একটু ধরে এসেছে ওর।
সুপ্রতিমদা ওকে জিজ্ঞেস করে, "কেন বেবি? সামনে ত খুব সুন্দর দৃশ্য।"
রিতিকা সুপ্রতিমদার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলে ওঠে, "কাল আমরা কাজা ছেড়ে চলে যাবো, আর আজ এই সুন্দর সূর্যাস্ত আমার বুকের ভেতরে কেন জানিনা উদাসিন ভাব এনে দিয়েছে, আমার খুব কান্না পাচ্ছে।"
অভি পরীর চোখের দিকে তাকায়, কি বলতে চায় প্রেয়সীর কাজল কালো আঁখি। পরী কাঁধে মাথা গুঁজে ধরা গলায় বলে, "এই কাজা যেন আমার জায়গা, এই সূর্যাস্ত আমার বুকের মাঝে এক অন্তহীন উদাসীনতা তৈরি করেছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, আমি হোটেলে ফিরে যেতে চাই।"
"হটাত করে কি হল এই সুন্দরী দুই নারীর হৃদয়ে?" অভি ভাবে। নারী মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ। নারী এই পৃথিবীকে জীবনের মলয় দিয়ে জিবন্ত করে তোলে, নারী হৃদয়ের স্নেহের পরশে এই পৃথিবী অপরূপ সুন্দর হয়ে ওঠে। ওদের প্রেয়সী সেই মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ, ওদের হৃদয়ে নারী স্নেহ মায়া মমতা আছে। ওরাই এই পৃথিবীর হৃদয় ঠিক মতন বুঝতে পারে, আর সেইজন্য সেই সন্ধায় ওদের চোখে জল।
অভি সুপ্রতিমদাকে বলে, "চল রে, হোটেলে ফিরে যাই। কাল সকাল সকাল উঠে আবার মানালির দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে, বিকেলের মধ্যে মানালি পৌছাতে হবে।"
সারা সন্ধ্যে দুই রমণী খুব চুপচাপ হয়ে যায়, বুকের মাঝে যেন কাজা ছেড়ে যাওয়ার বিরহ সুর বাজে।
পরদিন মঙ্গলবার, সকাল সকাল অভিরা বেড়িয়ে পরে কাজা থেকে। এবারে যেন এক নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। সবার মুখে একই কথা, রাস্তা কি রকম হবে। হোটেলের ম্যানেজার বার বার করে সাবধান করে দিয়েছে যে যে রাস্তা দিয়ে ওরা যাচ্ছে, সেই রাস্তা অতি জনবিরল, কিছু ঈগল পাখি আর গাধা বাঁ শেয়াল ছাড়া মানুষ জনের চিনহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওরা যেন কোথাও বেশি দেরি না করে, না হলে মানালি পৌছাতে রাত হয়ে গেলে মাঝ পথে তাকার কোন জায়গা পাবে না।
গাড়ির চালক অভি, পাশে যথারীতি পরী বসে। অরুনাকে মাঝখানে বসিয়ে পেছনে রিতিকা আর সুপ্রতিমদা। রিতিকা জিন্স পড়েছিল তাই পরীকেও অনুরধ করেছিল জিন্স পড়তে। পরী ধুসর রঙের জিন্স পরে, গায়ে ভারী সাদা জ্যাকেট। রিতিকা কে ওর হাল্কা নীল জিন্স আর লম্বা কালো জ্যাকেটে বেশ মানিয়ে গেছে।
অভি গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে আয়নায় অরুনার দিকে তাকায়। অরুনার মন বেশ হাল্কা, অনেক বিপদ অনেক বেদনা কাটিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছে। ওর মুখে সেই হাসি পুরানো হাসি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অভি। তবে সেই পুরান চঞ্চল অরুনা যেন এখন কোথাও লুকিয়ে আছে, সেই অরুনা যে কিনা অভিকে মারত, বোকত সেই অরুনাকে ফিরে পেতে এখন অনেক সময় লাগবে।
গাড়িতে সবাই বেশ গল্প গুজবে মেতে ওঠে। লোসার পর্যন্ত পিচের রাস্তা কিন্তু একটু এবর খাবর। লোসারের পুলিস চেক পোষ্ট পার করেই আর যেন রাস্তা নেই, রাস্তা যেন পাহাড়ের মাঝে কোথাও হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় ওদের সামনে এক পাথরে ঢাকা পথ। গাড়ি বারে বারে দোল খায়, একবার এদিক একবার ওদিকে বেঁকে যায় গাড়ি। অভির চোয়াল শক্ত, খুব ধিরে ধিরে গাড়ি চালায়। একদিকে উঁচু পাহাড়, একদিকে নেমে গেছে গভীর খাদ। এখানে মানুষ হারিয়ে গেলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। চারিদিকে ছড়িয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর হিমালয়, কোথাও পাহাড় থেকে ঝরনা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তার ওপরে, কোথাও পাহাড় ঝুরঝুরে হয়ে রাস্তার ওপরে ধসে যাচ্ছে। পথে মানুষের চিনহ মাত্র নেই, প্রাণী বলতে কিছু বন্য গাধা আর শেয়ালের দেখা পায়। মাথার ওপরে গাড় নীল আকাশ, কিছু ঈগল উড়ে বেড়ায় ওই নীল আকাশের বুকে। কিছু দুরে বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। সবাই হাঁ করে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে আর দেখে হিমালয়ের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। ওদের কেউ ভাবেনি যে হিমালয়কে এত কাছ থেকে ওরা কোনদিন দেখতে পাবে।
পরী যেন এর মধ্যে এডভেঞ্চারের গন্ধ পায়, অতি উতসাহে চেঁচিয়ে ওঠে, "উফ, কি মারাত্মক জায়গা। আমি এই জায়গার সাথে প্রেমে পরে গেছি অভি। আমার প্রেমিক সত্যি এক অসাধারন মানুষ, শুধু ওই পারে এই রকম জায়গা খুঁজে বের করতে।"
অরুনার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে রাস্তা আর আশপাশ দেখে, ভয়ার্ত চোখে অভিকে বলে, "এটা কি একটা ঘোরার জায়গা? মানুষ ছাড়, এমন কি পশু পাখীর দেখা মেলা ভার এখানে। তোর আর শুচিদির মতন পাগলদের জন্য এই জায়গা।"
অরুনার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, পরী ওকে অভয় দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদাকে বলে, "উফফ... সত্যি পাগল করে দেওয়া জায়গা এটা। তোমার বন্ধু যদি এখানে না নিয়ে আসতো তাহলে হয়ত আমরা কোনদিন এখানে আসতাম না, আর কোনদিন এই ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য দেখতেও পেতাম না। দূর থেকে হিমালয় দেখে চলে যেতাম। এর জন্য অভিকে আর পরীকে সত্যি ধ্যনাবাদ জানানো উচিত।"
সুপ্রতিমদা অভির দিকে মজা করে বলে ওঠে, "বোকা... কোথা থেকে এই রকম জায়গার খবর পেলি রে তুই? শালা আমার যদি কিছু হয়ে যায় এখানে তাহলে শালা রিতিকা মা হওয়ার আগেই বিধবা হয়ে যাবে রে।"
রিতিকা লজ্জায় সুপ্রতিমদার কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। পরী অভির কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে। গালে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই অভি ব্রেক কষে দেয়, নরম আঙ্গুলের স্পর্শ অভির মন বিচলিত করে দেয়, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। গাড়ি ব্রেক কষতেই সবাই ঝটকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পরে।
সুপ্রতিমদা পরীকে বলে, "ডারলিং, অভির গিয়ার বদলাতে যেওনা এখানে, আমরা কিন্তু পেছনে বসে আছি।"
পরী লজ্জায় লাল হয়ে যায় কিন্তু অভির গালে ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
আরও কিছু দূর চলার পরে অভির গাড়ি এক সমতল ফাঁকা জায়গায় চড়ে। কুঞ্জুম পাস, সমুদ্রতল থেকে পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে। চারপাশের দৃশ্য মন মুগ্ধ করে দেয়। চারপাশে বরফে ঢাকা উন্নত শৃঙ্গ, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের চারপাশে বয়ে চলেছে। একদিকে ছোটো একটি উঁচু ঢিপি, তার পরেই একটা বৌদ্ধ স্তুপ। কুঞ্জুম পাস পৌছাতে ওদের দুপুর এগারটা বেজে গেল। কুঞ্জুম পাস পৌঁছে, বৌদ্ধ স্তুপের কাছে এসে গাড়ি থামায় অভি, পেছনের গাড়িও এসে থামে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পরে।
গাড়ি থেকে নেমেই পরী দৌড়ে এসে অভির ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে, শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে। অভি ওর কোমরের নিচে হাত দিয়ে, আঁকড়ে ধরে পরীর শরীর আর টেনে মাটি থেকে হাওয়ায় উঠিয়ে দেয়। পরী ঝাপ দেয় উপরে আর মাথার ওপরে আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, "আই লাভ ইউ অভিমন্যু।"
পরীকে দেখে মনে যেন হিমালয়ের পাহাড়ি ঈগল পাখি তাঁর বিশাল দুই ডানা মেলে অভির কোলে দাঁড়িয়ে।
ওর আনন্দের চিৎকার শুনে সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকায়। অরুনা মৃদু হেসে বৌদ্ধ স্তুপের দিকে চলে যায়।
পরীর বুকে থেকে আনন্দের এক শ্বাস বেড়িয়ে আসে। মুখ নিচু করে দুহাতের তালুর মাঝে অভির মুখ আঁজলা করে ধরে গভীর চাহনি নিয়ে অভির চোখের দিকে তাকায়। পরীর উষ্ণ শ্বাস অভির সারা মুখের ওপরে বয়ে চলে। ঠোঁট লেগে থাকে মিষ্টি হাসি, চোখে প্রেমের জল চিকচিক করে। আলতো করে ঠোঁট ফাঁক করে মাথা নামিয়ে অভির ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে ঠোঁট। অনাবিল আনন্দে ভেসে যায় দুই প্রান।
রিতিকা ওদের দেখে খিলখিল করে হেসে অভিকে বলে, "প্রেমের জোয়ারে ভেসে এখানেই কিছু শুরু করে দিওনা যেন।"
চুম্বনের ফলে পরীর শ্বাস বর্ধিত হয়ে ওঠে কিন্তু রিতিকার কথা শুনে ওরা দুজনেই সম্বিৎ ফিরে পায়, ওদের চারপাশে লোকজন আছে যে, না হলে ওরা প্রেমের জোয়ারে ভেসেই যেত। পরীকে কোল থেকে নামিয়ে অভি রিতিকার দিকে শয়তানি হাসি দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদা কে বলে, "হানি, আমরা টেন্ট এনেছি তাই না? আজ রাতে আমরা এই খোলা, অন্তহীন শূন্যতার মাঝে থেকে যাই না কেন?"
পরী ওর কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে, অভিকে নিজের অভিপ্রায় জানায় যে ও রাতে এখানে থাকতে চায়। অভি আর সুপ্রতিমদা দুজনকেই বুঝাতে চেষ্টা করে যে ওই জায়গায় রাত কাটানো অসম্ভব ব্যাপার। কোথাও কিছু নেই, চারদিকে শুধু উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়। নিকটবর্তি লোকালয় লোসার প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে। ওদের কথা শুনে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতন রেগে ওঠে রিতিকা আর পরী।
কল্যাণী আর দীপঙ্কর জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। সুপ্রতিমদা রিতিকার চোখ দেখে আর আশেপাশের জায়গা দকেহে ঠিক করে উঠতে পারছে না, পরাজিত সৈনিকের মতন অভির দিকে তাকায়। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করে যে রাত ওরা কুঞ্জুম পাসে কাটাবে।
দীপঙ্কর আর রামানুজ অভির কাছে এসে জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। ওদের ট্রেনের টিকিট আগে থেকে কাঁটা আছে আর ওরা বাড়ি থেকে বলে বেড়িয়েছে যে ওরা বারো দিনের মতন ঘুরতে যাবে। অভি, পরী আর অরুনার হাতে অঢেল সময়, ওদের বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া নেই কেননা ওদের প্লেনের টিকিটে ফিরে যাবার দিন লেখা নেই। ওরা যে কোনদিন ফিরতে পারে।
কোমরের নিচে সজোর এক লাথির চোটে অভির ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে সামনে সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
সুপ্রতিমদা, "কিরে বোকা... উঠে পড়। সবাই ধাঙ্কার যাবার জন্য তৈরি আর আমাদের টিম লিডার নাক ডেকে ঘুমচ্ছে।"
অভি ঘুম চোখ রগড়ে সুপ্রতিমদাকে জিজ্ঞেস করে, "পরী কোথায়?"
সুপ্রতিমদা, "শালা, সারা রাত ধরে তুমি তোমার পেরেক গুঁজে যাবে আর ভাবছ যে সকাল বেলায় ও তোমার পাশে থাকবে? বোকা... ওঠ..."
মাথা চুলকে সুপ্রতিমদার দিকে হেসে বলে, "বোকা... তুই যেন হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলি, তুই কি পেরেক গুঁজিসনি মাখনের মধ্যে?"
দুজনেই হেসে ফেলে গত রাতের কথা ভেবে। সুপ্রতিমদা বলে, "পাঁচটা মেয়েই সকালে উঠে পরে, হাঁটতে গেছে স্পিতির দিকে।"
অভির গায়ে কোন কাপড় নেই, সুপ্রতমদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রতিমদা মেঝে থেকে অভির প্যান্ট তুলে ছুঁড়ে মারে অভির মুখের ওপরে। শয়তানি হেসে বলে, "উঠে পর এবারে বোকা... তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে, স্রে আটটা বাজে, এতক্ষণে মনে হয় মেয়েরা এসে গেছে।"
তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে স্নান সেরে, জামা কাপড় পরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে অভি। বাইরের ঘাসের বাগানের ওপরে টেবিল পেতে ওদের সকালের খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে হোটেলের ম্যানেজার। আজকে ওরা ধাঙ্কার মঠ ঘুরতে যাবে। খাবার টেবিলে পরীর দিকে তাকায় অভি, পরী ওর উল্টো দিকে রিতিকা আর অরুনার মাঝে বসে। পরনে দুধ সাদা একটা সালোয়ার কামিজ আর তাঁর ওপরে গাড় নীল রঙের কার্ডিগান। সকালে উঠে স্নান সেরে নেওয়া ওর অভ্যেস, সদ্য স্নাত পরীকে দেখতে ঠিক এক দুধ সাদা অপ্সরার মতন লাগছে। দুপাশের, সুন্দরী নারী দের এক জন যেন মহামায়া আরেক জন শকুন্তলা। পরী মেয়েদের সাথে গল্প করে আর মাঝে মাঝে অভির দিকে আর চোখের তাকিয়ে হাসে।
চেহারায় এক অধভুত সুন্দর লালিমার ছটা। ভুরু নাচিয়ে পরীর দিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছো, দুষ্টু সোনা?"
শয়তানি করে জিব বের করে অভি আর প্লেটে থাকা চাটনি চেটে নেয়। অভির শয়তানি হাসি আর প্লেট চাটা দেখে পরীর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ওকি বুঝাতে চাইছে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে পরীর মুখ।
অভি ইশারায় জানায়, "তোমার মধু ভারী মিষ্টি, বেবি!"
সকালের খাওয়া শেষে অভির পরীকে অনুরধ করে জিন্স পড়ার জন্য। পরী নারাজ, জিন্স পড়তে, বলে যে অতে নাকি শরীরের প্রত্যেক আঁকিবুঁকি ভালো করে বোঝা যায় তাই লজ্জা করে ওর। বুঝিয়ে উঠতে পারে না অভি যে ওই পোশাকে পরীকে খুব আকর্ষণীয় দেখাবে। ওর কথা শুনে লজ্জায় কান লাল হয়ে যায়।
রিতিকা পরীর কাছে এসে কানে কানে বলে, "তোমার ফিগার এত সুন্দর, তোমাকে জিন্স আর টপে মারাত্মক দেখতে লাগবে, সবাই দেখে পাগল হয়ে যাবে।"
পরী ফিসফিস করে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কি ইচ্ছে?"
ডান হাত কাঁধে রেখে পরীকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অভি, দুজনে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ঘড়ে ঢুকেই অভি পরীকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের লতি চুষে নেয় ঠোঁটের মাঝে।
পরী মোচর দিয়ে ককিয়ে বলে, "উফ, ছাড়ো ছাড়ো, এখন আর শয়তানি করোনা, ধাঙ্কার যেতে হবে, দেরি হয়ে যাবে।"
অভি পরীকে বাহুপাশ থেকে মুক্ত না করেই জিজ্ঞেস করে, "সকালে আমাকে একা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছিলে?"
পরী চোখ বন্ধ করে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয়, "তোমার চোখের দিকে তাকাতে আমার খুব লজ্জা করছিল, তাই আমি সকালে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাকিদের সাথে।"
পেটের ওপরে হাত চেপে, গালে গাল ঘষে কানে কানে বলে, "আই লাভ ইউ, পরী।"
পরী মৃদু সুরে ককিয়ে ওঠে, "ম্মম্মম্মম্মম... ছাড়ো আমাকে, না হলে কি করে জিন্স পড়ব?"
অভি পরীকে ছেড়ে দেয়, পরী আলমারি থেকে জিন্স আর মভ রঙের টপ বের করে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমে ঢোকার আগে অভির দিকে একটু বিরক্তি, একটু দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে জিব বের করে ভেঙ্গিয়ে দেয়। অভি ওর দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে যে ওকে জিন্সে আর চাপা টপে প্রচন্ড আকর্ষণীয় দেখাবে। অভির দিকে হাত তুলে চাঁটি মারার ইশারা করে পরী, "শয়তান কোথাকার।" দরজা বন্ধ করে দেয়।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে প্রেয়সীর অপেক্ষা করে। জিন্স আর টপ পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে পরী, পরীর সেই রুপ দেখে অভির মুখ হাঁ হয়ে যায়। সিগারেট টানা ভুলে নিস্পলক চোখে দেখতে থাকে পরীকে। কোমরের নিচে ত্বকের সাথে চেপে বসে জিন্সের মসৃণ কাপড়। কোমরের নিচের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন উন্মচিত, না, জিন্সের কাপড়ের পেছনে ঢাকা বটে, কিন্তু অভির চোখে যেন সেই কাপড় ফুঁরে সব কিছু দেখতে পায়। সামনে জানুমাঝে ছোটো চেন, যেন নারীসুখের দোরগোড়ার এক অধভুত অবয়াব ধারন করেছে। অভি যেন চোখ ফেরাতে পারেনা, পরীর দেহ পল্লব থেকে। পরনের টপ, পরীর শরীরে যেন দ্বিতীয় ত্বক, দেহের অবয়াব যেন অতি পুরাতন বালির ঘড়ির মতন।
মাথার ওপরে জাপানি পুতুলের মতন করে খোঁপা বাঁধা, খপার মধ্যে দুটি ছোটো ছোটো কাঠি গোঁজা। কানে মুক্তোর দুল, ঠোঁটে গাড় বাদামি রঙ, চোখের কোলে কাজল। সবমিলিয়ে পরীকে দেখে মনে হচ্ছে যে স্পিতির তীরে আগুন লাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে আজ।
অভি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পরীকে। অভির তপ্ত চোখের চাহনি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে অভির বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলে, "আমার না খুব লজ্জা করছে, সোনা। আমি বাইরে যাবো না।"
মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, "কেন বেবি?"
বুকের ওপরে দাঁত দিয়ে আলতো কামর কেটে পরী বলে, "তোমার চোখ দুটি যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল, যেন আমার গায়ে কোন কাপড় নেই।"
ঠিক সেইসময়ে দরজায় টোকা মেরে রিতিকা ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। পরী আর অভিকে দৃঢ় আবেগের আলিঙ্গনে বদ্ধ থাকতে দেখে রিতিকা বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। পরী অভির বুক আলতো করে ঠেলে দিয়ে আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিতিকাকে জিজ্ঞেস করে যে কি খুঁজতে এসেছে।
রিতিকা পরীকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরে দৌড়ে গিয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে, "আমি ছেলে হলে নিশ্চয় তোমার প্রেমে পরে যেতাম।"
রিতিকা অভির দিকে চোখ টিপে বলে, "এক দিনের জন্য তোমার বউকে দেবে আমায়?"
রিতিকার দেহের গঠনও খুব সুন্দর আর কমনীয়। পরনে গাড় নীল রঙের আঁটো জিন্স আর সাদা শার্ট। অভি বেশ কিছুক্ষণ রিতিকার দিকে তাকিয়ে থাকে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবে চোখের সামনে এই দুই সুন্দরী আজ স্পিতির তীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
অভি পরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে বাম হাত নিজের হাতে নিয়ে ছোটো একটা চুমু খায়। তারপরে গেয়ে ওঠে,
"আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,
মম সরসীতে তব উজ্বল প্রভাত, বিম্বিত যেন লাজে,
আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,......"
পরীকে সঙ্গে নিয়ে রিতিকা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল, পেছন পেছন অভি। অরুনাও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক। অরুনা পরীর দিকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, "তুমি সত্যি পরী, শুচিদি। তুমি যা পর তাই তোমাকে মানায়।"
পরী নতুন বউয়ের মতন লজ্জা পেয়ে যায় অরুনার কথা শুনে।
সুপ্রতিমদা ওর কাছে এসে মৃদু সুরে বলে, "লজ্জাবতি লতা, গালের লালিমা বিয়ের রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখো। এখন প্রান খুলে আনন্দ কর, ডার্লিং।"
কল্যাণী আর রানীও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক, জীবনের প্রথম বার পরী অইরকমের পোশাক পড়েছে।
কিছুপরেই অভিরা ধাঙ্কার মঠের দিকে রওনা দেয়। গাড়ির চালক সুপ্রতিমদা, পাশে বসে রিতিকা। অরুনাকে নিয়ে পরী আর অভি পেছনে বসে।
কাজা থেকে ধাঙ্কার বেশ কিছু দুরে। ধাঙ্কার মঠ, উঁচু পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়ের অধিকাংশ ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে গেছে, পুরানো মঠের বেশির ভাগ অংশ খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। দূর থেকে সেই পাহাড় দেখলে মনে হয় যেন উঁচু এক উইয়ের ঢিবি। খুব কম বৌদ্ধ সাধু বসবাস করে পুরানো মঠে, একটি নতুন মঠ রাস্তার পাশে তৈরি করা হয়েছে। দুপুরের খাওয়া ওরা ধাঙ্কারে সেরে নেয়।
অভি আর সুপ্রতিমদা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার কে কাজার আগের রাস্তার খবর জিজ্ঞেস করে। ম্যানেজার জানায় যে কাজা ঠেলে লোসার নামক একটি গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি ভালো, তারপরে ঠিক রাস্তা বলে কিছু নেই। আগের রাস্তা পাথর, বালি আর ঝরনায় ঢাকা, সুউচ্চ হিমালয়ের বুক চিড়ে রাস্তা, খুব ভয়ঙ্কর আর অতিব সুন্দর। কাজা থেকে মানালি, আরাইশ কিলোমিটারের মতন আর পুর রাস্তা একদিনে পার করতে হবে। কারন মাঝপথে থাকার কোন জায়গা নেই, আছে শুধু পাহাড় আর গভীর খাদ। রাস্তার মাঝে প্রচুর চড়াই উতরাই আছে আর কুঞ্জুম পাস নামক একজায়াগয় চড়াই পনেরো হাজার ফিটের ওপরে।
সবাই অভির দিকে তাকায়, এমন কি পরীও তাকায়, যেন ওই রাস্তার জন্য অভি দায়ী।
মাথার ওপরে হাত ছুঁড়ে সবার মনে উৎসাহ জাগাতে চেঁচিয়ে বলে, "আরে বাবা, চিয়ার আপ। ভগবান তোমাদের একটা জীবন দিয়েছে, আনন্দ করও, খুশিতে মন ভরিয়ে নাও গুরু। যতক্ষণ অভিমন্যু সাথে আছে, তোমাদের কোন ভিয় নেই।"
অরুনা অভির দিকে চেঁচিয়ে বলে, "হ্যাঁ, সে কথা ত শুধু শুচিদির জন্য, বাকিদের কি?"
অরুনাকে ক্ষেপানোর জন্য অভি বলে, "তোকে না হয় এখান থেকে ছুঁড়ে সমুদ্র নীলের কোলে ফেলে দেব, তাহলে ত খুশি? এবারে হাস হাস..."
ঠিক করা হল যে বিকেলে কোথাও না বেড়িয়ে সবাই হোটেলে বিশ্রাম করবে, কাল খুব ভরে রওনা দেবে কাজা থেকে। ধাঙ্কার থেকে কাজা ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটে বেজে যায়। ফেরার পথে মেয়েরা দীপঙ্কর আর রামানুজ বাজারের কাছে নেমে গেল। অরুনা আর পরী জানাল যে ওরা বারিতে ফোন করতে চায়। অভি পরীকে বলল যে ওর ছোটমায়ের সাথে ও কথা বললেই হবে, পরী একটু বিরক্তি বোধ করে। রিতিকা আর বাকি মেয়েরা একটু কেনাকাটা করবে। ইনোভা ওদের জন্য রেখে সুপ্রতিমদা আর অভি হোটেলে ফিরে আসে।
কাজায় শেষ দিন। সূর্য ডোবার পরে, পরী অভিকে অনুরধ করে নদীতে ঘুরতে যেতে। অরুনা ওর ঘরে বসে রানী আর কল্যাণীর সাথে গল্প করছিল। পরী চাইছিল যে ওরা একটু একা একা ঘুরতে যাক, অভির ও একি অভিপ্রায়। হোটেলে থেকে বের হতে যাবে তখন রিতিকার সাথে দেখা, রিতিকা ওদের জিজ্ঞেস করাতে, পরী জানায় যে ওরা নদীর দিকে ঘুরতে যাচ্ছে আর রাতে খাওয়ার আগে ফিরবে। সেই শুনে রিতিকা সুপ্রতমদাকে ডাক দেয় আর অভিদের সঙ্গে বেড়িয়ে পরে। হোটেল থেকে বেশ দুরে নদী, সুপ্রতিমদা অতি সন্তর্পণে গাড়ি সেই পাথুরে রাস্তার ওপরে দিয়ে, নদী গর্ভে নামিয়ে দেয়।
সূর্য ডুবে গেছে, পশ্চিমের আকাশ কমলা রঙের। পায়ের তলায় কুলুকুলু বয়ে চলেছে স্পিতি নদী। কোথাও হাঁটু, কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত জল। নদী গর্ভ ছোটো ছোটো গোল গোল পাথরে ঢাকা। নদী অনেক চওড়া হলেও জল নেই তাতে, মাঝে মাঝে অতি সরু জলধারার রেখা।
দুই রমণীর পরনে জিন্স আর টপ, যেন ওদের নধর কমনীয় দেহ পল্লবের সাথে আঠার মতন সেটে। অভি আর সুপ্রতিমদা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে অল্প অল্প চুমুক দেয়। দুই কপোতের দুই প্রেয়সী জলে নেমে ঘুরে বেড়ায় আর জল নিয়ে খেলা করে। দূর থেকে অভি আর সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে। মনে হয় যেন জল ছেড়ে উঠে দুই সুন্দরী মৎস্যকন্যা ওদের সামনে কেলি করছে। কিছু পরে সুপ্রতিমদা নদীর তীরের দিকে গিয়ে কিছু কাঠ আর শুকনো ঝোপ ঝার উপড়ে নিয়ে আসে।অভি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দেয় যে আগুন জ্বালাবে, কেননা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে বাঁচতে হবে। আকাশের লালিমা ধিরে ধিরে কমে আসে, আস্তে আস্তে ওদের চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। স্পিতির গর্ভে শুধু মাত্র ওর চারজন, দুরে শহরের ছোটো ছোটো আলো দেখা যায়, মাথার ওপরে পরিষ্কার আকাশ।
সুপ্রতিমদা আগুন জ্বালায়, রিতিকা আর পরী গাড়ির বনেটের ওপরে বসে পরে। রিতিকার পাশে সুপ্রতিমদা ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে আর রিতিকা ওর গলা। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে, অভির হাত পরীর কোমরে। দুই জোড়া কপোত কপোতী প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। সবার দৃষ্টি দুরে পশ্চিমে উঁচু পাহাড়ের দিকে, দুরে বরফে ঢাকা পাহাড়।
রিতিকা উদাস সুরে বলে, "এখানে আসা উচিত হয়নি।"
গলা যেন একটু ধরে এসেছে ওর।
সুপ্রতিমদা ওকে জিজ্ঞেস করে, "কেন বেবি? সামনে ত খুব সুন্দর দৃশ্য।"
রিতিকা সুপ্রতিমদার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলে ওঠে, "কাল আমরা কাজা ছেড়ে চলে যাবো, আর আজ এই সুন্দর সূর্যাস্ত আমার বুকের ভেতরে কেন জানিনা উদাসিন ভাব এনে দিয়েছে, আমার খুব কান্না পাচ্ছে।"
অভি পরীর চোখের দিকে তাকায়, কি বলতে চায় প্রেয়সীর কাজল কালো আঁখি। পরী কাঁধে মাথা গুঁজে ধরা গলায় বলে, "এই কাজা যেন আমার জায়গা, এই সূর্যাস্ত আমার বুকের মাঝে এক অন্তহীন উদাসীনতা তৈরি করেছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, আমি হোটেলে ফিরে যেতে চাই।"
"হটাত করে কি হল এই সুন্দরী দুই নারীর হৃদয়ে?" অভি ভাবে। নারী মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ। নারী এই পৃথিবীকে জীবনের মলয় দিয়ে জিবন্ত করে তোলে, নারী হৃদয়ের স্নেহের পরশে এই পৃথিবী অপরূপ সুন্দর হয়ে ওঠে। ওদের প্রেয়সী সেই মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ, ওদের হৃদয়ে নারী স্নেহ মায়া মমতা আছে। ওরাই এই পৃথিবীর হৃদয় ঠিক মতন বুঝতে পারে, আর সেইজন্য সেই সন্ধায় ওদের চোখে জল।
অভি সুপ্রতিমদাকে বলে, "চল রে, হোটেলে ফিরে যাই। কাল সকাল সকাল উঠে আবার মানালির দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে, বিকেলের মধ্যে মানালি পৌছাতে হবে।"
সারা সন্ধ্যে দুই রমণী খুব চুপচাপ হয়ে যায়, বুকের মাঝে যেন কাজা ছেড়ে যাওয়ার বিরহ সুর বাজে।
পরদিন মঙ্গলবার, সকাল সকাল অভিরা বেড়িয়ে পরে কাজা থেকে। এবারে যেন এক নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। সবার মুখে একই কথা, রাস্তা কি রকম হবে। হোটেলের ম্যানেজার বার বার করে সাবধান করে দিয়েছে যে যে রাস্তা দিয়ে ওরা যাচ্ছে, সেই রাস্তা অতি জনবিরল, কিছু ঈগল পাখি আর গাধা বাঁ শেয়াল ছাড়া মানুষ জনের চিনহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওরা যেন কোথাও বেশি দেরি না করে, না হলে মানালি পৌছাতে রাত হয়ে গেলে মাঝ পথে তাকার কোন জায়গা পাবে না।
গাড়ির চালক অভি, পাশে যথারীতি পরী বসে। অরুনাকে মাঝখানে বসিয়ে পেছনে রিতিকা আর সুপ্রতিমদা। রিতিকা জিন্স পড়েছিল তাই পরীকেও অনুরধ করেছিল জিন্স পড়তে। পরী ধুসর রঙের জিন্স পরে, গায়ে ভারী সাদা জ্যাকেট। রিতিকা কে ওর হাল্কা নীল জিন্স আর লম্বা কালো জ্যাকেটে বেশ মানিয়ে গেছে।
অভি গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে আয়নায় অরুনার দিকে তাকায়। অরুনার মন বেশ হাল্কা, অনেক বিপদ অনেক বেদনা কাটিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছে। ওর মুখে সেই হাসি পুরানো হাসি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অভি। তবে সেই পুরান চঞ্চল অরুনা যেন এখন কোথাও লুকিয়ে আছে, সেই অরুনা যে কিনা অভিকে মারত, বোকত সেই অরুনাকে ফিরে পেতে এখন অনেক সময় লাগবে।
গাড়িতে সবাই বেশ গল্প গুজবে মেতে ওঠে। লোসার পর্যন্ত পিচের রাস্তা কিন্তু একটু এবর খাবর। লোসারের পুলিস চেক পোষ্ট পার করেই আর যেন রাস্তা নেই, রাস্তা যেন পাহাড়ের মাঝে কোথাও হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় ওদের সামনে এক পাথরে ঢাকা পথ। গাড়ি বারে বারে দোল খায়, একবার এদিক একবার ওদিকে বেঁকে যায় গাড়ি। অভির চোয়াল শক্ত, খুব ধিরে ধিরে গাড়ি চালায়। একদিকে উঁচু পাহাড়, একদিকে নেমে গেছে গভীর খাদ। এখানে মানুষ হারিয়ে গেলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। চারিদিকে ছড়িয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর হিমালয়, কোথাও পাহাড় থেকে ঝরনা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তার ওপরে, কোথাও পাহাড় ঝুরঝুরে হয়ে রাস্তার ওপরে ধসে যাচ্ছে। পথে মানুষের চিনহ মাত্র নেই, প্রাণী বলতে কিছু বন্য গাধা আর শেয়ালের দেখা পায়। মাথার ওপরে গাড় নীল আকাশ, কিছু ঈগল উড়ে বেড়ায় ওই নীল আকাশের বুকে। কিছু দুরে বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। সবাই হাঁ করে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে আর দেখে হিমালয়ের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। ওদের কেউ ভাবেনি যে হিমালয়কে এত কাছ থেকে ওরা কোনদিন দেখতে পাবে।
পরী যেন এর মধ্যে এডভেঞ্চারের গন্ধ পায়, অতি উতসাহে চেঁচিয়ে ওঠে, "উফ, কি মারাত্মক জায়গা। আমি এই জায়গার সাথে প্রেমে পরে গেছি অভি। আমার প্রেমিক সত্যি এক অসাধারন মানুষ, শুধু ওই পারে এই রকম জায়গা খুঁজে বের করতে।"
অরুনার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে রাস্তা আর আশপাশ দেখে, ভয়ার্ত চোখে অভিকে বলে, "এটা কি একটা ঘোরার জায়গা? মানুষ ছাড়, এমন কি পশু পাখীর দেখা মেলা ভার এখানে। তোর আর শুচিদির মতন পাগলদের জন্য এই জায়গা।"
অরুনার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, পরী ওকে অভয় দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদাকে বলে, "উফফ... সত্যি পাগল করে দেওয়া জায়গা এটা। তোমার বন্ধু যদি এখানে না নিয়ে আসতো তাহলে হয়ত আমরা কোনদিন এখানে আসতাম না, আর কোনদিন এই ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য দেখতেও পেতাম না। দূর থেকে হিমালয় দেখে চলে যেতাম। এর জন্য অভিকে আর পরীকে সত্যি ধ্যনাবাদ জানানো উচিত।"
সুপ্রতিমদা অভির দিকে মজা করে বলে ওঠে, "বোকা... কোথা থেকে এই রকম জায়গার খবর পেলি রে তুই? শালা আমার যদি কিছু হয়ে যায় এখানে তাহলে শালা রিতিকা মা হওয়ার আগেই বিধবা হয়ে যাবে রে।"
রিতিকা লজ্জায় সুপ্রতিমদার কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। পরী অভির কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে। গালে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই অভি ব্রেক কষে দেয়, নরম আঙ্গুলের স্পর্শ অভির মন বিচলিত করে দেয়, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। গাড়ি ব্রেক কষতেই সবাই ঝটকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পরে।
সুপ্রতিমদা পরীকে বলে, "ডারলিং, অভির গিয়ার বদলাতে যেওনা এখানে, আমরা কিন্তু পেছনে বসে আছি।"
পরী লজ্জায় লাল হয়ে যায় কিন্তু অভির গালে ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
আরও কিছু দূর চলার পরে অভির গাড়ি এক সমতল ফাঁকা জায়গায় চড়ে। কুঞ্জুম পাস, সমুদ্রতল থেকে পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে। চারপাশের দৃশ্য মন মুগ্ধ করে দেয়। চারপাশে বরফে ঢাকা উন্নত শৃঙ্গ, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের চারপাশে বয়ে চলেছে। একদিকে ছোটো একটি উঁচু ঢিপি, তার পরেই একটা বৌদ্ধ স্তুপ। কুঞ্জুম পাস পৌছাতে ওদের দুপুর এগারটা বেজে গেল। কুঞ্জুম পাস পৌঁছে, বৌদ্ধ স্তুপের কাছে এসে গাড়ি থামায় অভি, পেছনের গাড়িও এসে থামে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পরে।
গাড়ি থেকে নেমেই পরী দৌড়ে এসে অভির ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে, শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে। অভি ওর কোমরের নিচে হাত দিয়ে, আঁকড়ে ধরে পরীর শরীর আর টেনে মাটি থেকে হাওয়ায় উঠিয়ে দেয়। পরী ঝাপ দেয় উপরে আর মাথার ওপরে আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, "আই লাভ ইউ অভিমন্যু।"
পরীকে দেখে মনে যেন হিমালয়ের পাহাড়ি ঈগল পাখি তাঁর বিশাল দুই ডানা মেলে অভির কোলে দাঁড়িয়ে।
ওর আনন্দের চিৎকার শুনে সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকায়। অরুনা মৃদু হেসে বৌদ্ধ স্তুপের দিকে চলে যায়।
পরীর বুকে থেকে আনন্দের এক শ্বাস বেড়িয়ে আসে। মুখ নিচু করে দুহাতের তালুর মাঝে অভির মুখ আঁজলা করে ধরে গভীর চাহনি নিয়ে অভির চোখের দিকে তাকায়। পরীর উষ্ণ শ্বাস অভির সারা মুখের ওপরে বয়ে চলে। ঠোঁট লেগে থাকে মিষ্টি হাসি, চোখে প্রেমের জল চিকচিক করে। আলতো করে ঠোঁট ফাঁক করে মাথা নামিয়ে অভির ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে ঠোঁট। অনাবিল আনন্দে ভেসে যায় দুই প্রান।
রিতিকা ওদের দেখে খিলখিল করে হেসে অভিকে বলে, "প্রেমের জোয়ারে ভেসে এখানেই কিছু শুরু করে দিওনা যেন।"
চুম্বনের ফলে পরীর শ্বাস বর্ধিত হয়ে ওঠে কিন্তু রিতিকার কথা শুনে ওরা দুজনেই সম্বিৎ ফিরে পায়, ওদের চারপাশে লোকজন আছে যে, না হলে ওরা প্রেমের জোয়ারে ভেসেই যেত। পরীকে কোল থেকে নামিয়ে অভি রিতিকার দিকে শয়তানি হাসি দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদা কে বলে, "হানি, আমরা টেন্ট এনেছি তাই না? আজ রাতে আমরা এই খোলা, অন্তহীন শূন্যতার মাঝে থেকে যাই না কেন?"
পরী ওর কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে, অভিকে নিজের অভিপ্রায় জানায় যে ও রাতে এখানে থাকতে চায়। অভি আর সুপ্রতিমদা দুজনকেই বুঝাতে চেষ্টা করে যে ওই জায়গায় রাত কাটানো অসম্ভব ব্যাপার। কোথাও কিছু নেই, চারদিকে শুধু উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়। নিকটবর্তি লোকালয় লোসার প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে। ওদের কথা শুনে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতন রেগে ওঠে রিতিকা আর পরী।
কল্যাণী আর দীপঙ্কর জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। সুপ্রতিমদা রিতিকার চোখ দেখে আর আশেপাশের জায়গা দকেহে ঠিক করে উঠতে পারছে না, পরাজিত সৈনিকের মতন অভির দিকে তাকায়। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করে যে রাত ওরা কুঞ্জুম পাসে কাটাবে।
দীপঙ্কর আর রামানুজ অভির কাছে এসে জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। ওদের ট্রেনের টিকিট আগে থেকে কাঁটা আছে আর ওরা বাড়ি থেকে বলে বেড়িয়েছে যে ওরা বারো দিনের মতন ঘুরতে যাবে। অভি, পরী আর অরুনার হাতে অঢেল সময়, ওদের বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া নেই কেননা ওদের প্লেনের টিকিটে ফিরে যাবার দিন লেখা নেই। ওরা যে কোনদিন ফিরতে পারে।