28-06-2020, 12:35 PM
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#1)
ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমে ছুটি পরে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তাঁর উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।
ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”
বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”
অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”
বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, ত হানিমুনে যাচ্ছ নাকি?”
অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”
বুধাদিত্য, “চলে এস এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাব তোমাকে।”
অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”
বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এস।”
অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।” কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য। অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার ত ঠিক ভাবে কথা বলা উচিত অনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিক ভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছ বলতে পার? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়ি’টাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।” রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”
অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।” অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের কলেজে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়ত পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।
মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়ত সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পরে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।
দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”
বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”
দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হত।”
বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”
দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করব কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”
বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”
দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যাস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হত।”
দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাব। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসব বাপ্পাকে।”
শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকব। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবক কে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অধভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।
গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”
মাথা নারে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”
বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”
কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”
দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”
বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বস, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”
বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”
Continued......
______________________________
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#2)
দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বস আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।” কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।
বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”
মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্ন করে খাওয়াব। বল কি খাবে।”
বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।” দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।” বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাব, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছ, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”
বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাব।”
দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহ কে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”
দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।
দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পার।”
বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ এখানে?”
দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করব না কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”
দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহ কে কত টুকু চেন?”
বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহ কে চেন?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এই টুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”
দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে আমি মিস্টার গুহ’কে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষা’দির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বল, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহ’কে চেন? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।
বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহ’কে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পরে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহ’কে ছিনিয়ে নিয়েছ।”
বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।
দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহ’র সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে, ঠিক মঞ্জুষা দি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকত। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকো তে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলামনা।”
বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহ’র। পরে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হত, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজন কে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহ’র বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পরাশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নারসিং পড়িয়ে ছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হত, সবাই যেন আমার দেহ’টাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ;., করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হস্পিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”
“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পরে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হস্পিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আরথ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যাবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কস্ট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নারসিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যাবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”
“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহ’র পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিনহ খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষা’দির চিনহ বা তোমার কোন চিনহ ছিল না।”
বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে, তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের আছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসত, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হত, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহ’র প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেক কে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহ’র বিছানায় পরে মদে চুড়। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে যেত। শুধু ভগবান কে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হত যে একদিন হয়ত নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”
পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহ টাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাঁধা দিত আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহ’র কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহ এতই বদনাম ছিলেন যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখত। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিলনা, অগিত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”
ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমে ছুটি পরে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তাঁর উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।
ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”
বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”
অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”
বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, ত হানিমুনে যাচ্ছ নাকি?”
অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”
বুধাদিত্য, “চলে এস এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাব তোমাকে।”
অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”
বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এস।”
অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।” কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য। অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার ত ঠিক ভাবে কথা বলা উচিত অনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিক ভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছ বলতে পার? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়ি’টাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।” রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”
অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।” অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের কলেজে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়ত পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।
মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়ত সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পরে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।
দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”
বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”
দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হত।”
বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”
দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করব কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”
বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”
দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যাস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হত।”
দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাব। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসব বাপ্পাকে।”
শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকব। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবক কে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অধভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।
গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”
মাথা নারে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”
বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”
কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”
দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”
বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বস, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”
বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”
Continued......
______________________________
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#2)
দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বস আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।” কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।
বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”
মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্ন করে খাওয়াব। বল কি খাবে।”
বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।” দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।” বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাব, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছ, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”
বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাব।”
দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহ কে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”
দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।
দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পার।”
বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ এখানে?”
দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করব না কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”
দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহ কে কত টুকু চেন?”
বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহ কে চেন?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এই টুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”
দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে আমি মিস্টার গুহ’কে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষা’দির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বল, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহ’কে চেন? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।
বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহ’কে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পরে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহ’কে ছিনিয়ে নিয়েছ।”
বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।
দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহ’র সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে, ঠিক মঞ্জুষা দি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকত। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকো তে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলামনা।”
বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহ’র। পরে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হত, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজন কে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহ’র বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পরাশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নারসিং পড়িয়ে ছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হত, সবাই যেন আমার দেহ’টাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ;., করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হস্পিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”
“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পরে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হস্পিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আরথ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যাবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কস্ট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নারসিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যাবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”
“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহ’র পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিনহ খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষা’দির চিনহ বা তোমার কোন চিনহ ছিল না।”
বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে, তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের আছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসত, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হত, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহ’র প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেক কে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহ’র বিছানায় পরে মদে চুড়। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে যেত। শুধু ভগবান কে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হত যে একদিন হয়ত নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”
পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহ টাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাঁধা দিত আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহ’র কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহ এতই বদনাম ছিলেন যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখত। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিলনা, অগিত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”