28-06-2020, 12:33 PM
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#2)
প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথম বার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশ মাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।
ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার ত কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”
ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসব।”
ঝিলাম, “চেন টা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেন না?”
বুধাদিত্য, “ছোটো বেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিল না।”
ঝিলামের মনে পরে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এস, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”
বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেড়িয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজি গুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় কলেজ যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচর কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলাম কে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।
ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসি তে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে ত আর এসি পাবো না।”
বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারব না আমি।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”
বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করব?”
ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”
বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেব।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেব বিকেলে আসতে। আমিও কলেজ থেকে ততক্ষণে ফিরে আসব, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেব।”
বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”
ঝিলাম, “কলেজ বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাব।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”
হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়ত ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যাক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পরে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অধভুত সুন্দর নরদান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধু মাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পরে থাকবে।
“কি হল এখন ঘুমাতে যাও নি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।
এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারত বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যাস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফা কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়ত পড়েছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়্*। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্ত সাজান দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাইসই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।
“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হল, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”
অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পরে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিয়, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙ্গে গেছে, একটা কিনতে পার না?” “স্টাডির টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছ? মরন আমার, আশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পরে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধোনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুরো, কালা মিরচ, জাবিত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল...”
বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”
ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলব, কাগজ টা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”
দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিস পত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙ্গানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাসে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেড়িয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিস পত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কাল্কাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে পরে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।
______________________________
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#3)
রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পরে যায়, মায়ের কথা মনে পরে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহ’কে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পরে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেলল।
ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”
ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহ’র ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”
ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”
ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”
কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”
ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চল, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।
ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জাওান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠ্যালা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”
ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন আছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যাক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজুরে পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।
ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এস, যাও।”
ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি... যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”
ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পরে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে।
ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”
বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার কলেজ যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাব, ব্যাস।”
বুধাদিত্যের গাড় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চল নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”
গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতা ময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সাড়ি সাড়ি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না... শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়েয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না... যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না...”
গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পরে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেড়িয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙ্গে যেত একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখেতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্থ বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপড়েনে।
কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোয়া ছাড়া আর কিছু নেই।
বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”
কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাঁধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পরে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।
প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথম বার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশ মাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।
ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার ত কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”
ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসব।”
ঝিলাম, “চেন টা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেন না?”
বুধাদিত্য, “ছোটো বেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিল না।”
ঝিলামের মনে পরে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এস, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”
বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেড়িয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজি গুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় কলেজ যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচর কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলাম কে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।
ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসি তে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে ত আর এসি পাবো না।”
বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারব না আমি।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”
বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করব?”
ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”
বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেব।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেব বিকেলে আসতে। আমিও কলেজ থেকে ততক্ষণে ফিরে আসব, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেব।”
বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”
ঝিলাম, “কলেজ বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাব।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”
হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়ত ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যাক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পরে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অধভুত সুন্দর নরদান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধু মাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পরে থাকবে।
“কি হল এখন ঘুমাতে যাও নি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।
এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারত বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যাস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফা কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়ত পড়েছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়্*। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্ত সাজান দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাইসই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।
“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হল, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”
অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পরে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিয়, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙ্গে গেছে, একটা কিনতে পার না?” “স্টাডির টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছ? মরন আমার, আশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পরে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধোনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুরো, কালা মিরচ, জাবিত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল...”
বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”
ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলব, কাগজ টা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”
দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিস পত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙ্গানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাসে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেড়িয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিস পত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কাল্কাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে পরে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।
______________________________
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#3)
রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পরে যায়, মায়ের কথা মনে পরে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহ’কে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পরে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেলল।
ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”
ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহ’র ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”
ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”
ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”
কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”
ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চল, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।
ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জাওান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠ্যালা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”
ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন আছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যাক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজুরে পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।
ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এস, যাও।”
ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি... যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”
ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পরে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে।
ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”
বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার কলেজ যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাব, ব্যাস।”
বুধাদিত্যের গাড় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চল নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”
গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতা ময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সাড়ি সাড়ি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না... শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়েয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না... যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা... কেন কিছু কথা বলো না...”
গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পরে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেড়িয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙ্গে যেত একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখেতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্থ বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপড়েনে।
কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোয়া ছাড়া আর কিছু নেই।
বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”
কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাঁধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পরে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।