28-06-2020, 12:31 PM
দশম পর্বঃ নোনাধরা প্রাচীর। (#2)
বুধাদিত্য একদিন সমীরকে সোজাসুজি ফোনে জিজ্ঞেস করে হোটেল সাংরিলায় দেখা মেয়েটার কথা। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে সমীর। বুধাদিত্য চেপে ধরে সমীরকে কোন ঠাসা করে বলে দেয় যে সেদিন ঝিলামকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে। সমীর ধরা পরে যায়, বিকেলে দেখা করার কথা বলে। বিকেলে দেখা হয় দুই বন্ধুর। বুধাদিত্যকে সমীর জানায় যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ওদের বম্বের অফিসের একজন। বুধাদিত্য ঠিক মানতে পারে না, পাল্টা জিজ্ঞেস করে যে, যদি অফিস কলিগ হয়ে থাকে তাহলে কেন এত লুকোচুরি, কেন ঝিলামকে বলেছিল যে আহমেদাবাদ যাচ্ছে? সমীরের কাছে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকে না। বুধাদিত্য ওকে সাবধান করে দেয়, বলে যে, নারীসঙ্গ করছ কর, বুধাদিত্য নিজে কিছু কাল আগে পর্যন্ত অনেকের সাথে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরলে যেন একবার ভেবে দেখে সমীর, ঘরে একজন বউ আছে। সমীর চুপ করে ওর কথা শুনে যায়। শেষে জানায় যে শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক আছে সেই মেয়েটার সাথে। বুধাদিত্য জানতে চায় সেই মেয়েটার নাম আর ঠিকানা, সমীর এড়িয়ে যায়। বলে যে একদিনের দেখা, এত প্রশ্ন বাণে কেন জর্জরিত করছে? সব ভুলে এবার নতুন করে ঝিলামকে কাছে টেনে নেবে সমীর। বুধাদিত্য ওকে বাড়ি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতন সাবধান বানী দেয়।
সেদিনের পরে ঝিলামের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে। সমীর মাঝে মাঝেই আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, ঝিলামকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজারে বের হয়। ঝিলাম বেশ খুশি সমীরের আচরনে। ঝিলামের অফিসে হানা দেওয়া একটু কমে গেছে। আগে যেখানে পাঁচ দিনে চারদিন হানা দিয়ে আব্দার করত বাড়ি পৌঁছে দাও সেখানে আজকাল হয়ত দু’দিন অফিসে আসে। সমীর নতুন বাইক কিনেছে, মাঝে মাঝই ঝিলামকে কলেজ থেকে নিতে আসে। সমীর ঝিলামকে নিতে আসলে মাঝে মাঝে দু’জনে মিলে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে যায়। ঝিলামের মুখে হাসি দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আলমারি খুলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা সেই ইভিনিং ড্রেস টা দেখে আর ম্লান হাসে। মনের মধ্যে যে স্বপ্ন গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেটা হয়ত এই যাত্রায় আর সফল হবে না। সমীরের এই আচরনে বুধাদিত্যের ভাল লাগে তবে মনের কোনে একটু ব্যাথাও জাগে।
এক মাস কেটে যায়। সমীর আর ঝিলামের সাথে দেখা সাক্ষাৎ অনেক কমে যায়। ঝিলাম মাঝে সাঝে ফোন করে, খবরা খবর নেয়। বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায় ঝিলাম, মনে মনে বোঝে যে সমীরের সাথে নিশ্চয় বুধাদিত্য কথা বলেছে তাই সমীর বদলে গেছে।
দেশের খুব বড় একটা মোবাইল অপারেটারের সাথে মিটিং করতে একবার পুনে যায় বুধাদিত্য, দিন দুয়েকের কাজ। এবারে যাবার আগে ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোন কথা হয়না। রাতের বেলা কাজের শেষে একদিন বুধাদিত্য অফিসের বাকি লোকদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায় কাজের খুশিতে পার্টি দেবার জন্য। সেখানে সমীরের মুখোমুখি হয়। বুধাদিত্য প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায় সমীরকে দেখে, জিজ্ঞেস করে কি কারনে পুনেতে? যথারীতি সমীর এক উত্তর দেয় যে অফিসের কাজে এসেছে। রাতের বেলা ঝিলামকে ফোন করে জানতে পারে যে সমীর পুনে গেছে অফিসের কাজে। অনেকদিন পরে ঝিলাম ওর গলার আওয়াজ পেয়ে খুব খুশি হয়, জানায় যে সমীর অনেক বদলে গেছে নাকি। তবে আজকাল অফিসের কাজে হামেশাই বাইরে থাকে। একটু সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কিছু বলে না, শুধু জানায় যে সমীরের সাথে দেখা হয়েছে ওর। সেটা শুনে ঝিলাম একটু অবাক হয়ে যায়। বুধাদিত্যকে জানায় যে কিছু আগে নাকি সমীরের সাথে কথা হয়েছিল, কিন্তু ওদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে সমীর ওকে কিছুই জানায় নি। সমীরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে কোন হোটেলে উঠেছে না হলে একবার দেখা করে আসত বুধাদিত্য। ঝিলামের কথা শুনে ওর নাকে একটা সন্দেহের গন্ধ আসে। সমীর খুব বড় একটা খেলা খেলছে ঝিলামের সাথে।
পরেরদিন ভাগ্যবশত সমীরের সাথে একটা চাইনিজ রেস্তুরেন্টে দেখা হয় বুধাদিত্যের। এবারে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে ওর সাথে সেই মেয়েটা যাকে ও হোটেল শাংরিলতে দেখেছে। সমীরের ওপরে যা সন্দেহ করেছিল সেটা চোখে দেখে প্রতীত হয় যে সমীর অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে নিজের মোবাইলে। একটা ভিডিও তুলে নেয়, যেখানে সমীর বেশ গা এলিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে গল্প করছে, কাঁটা চমচে নুডুলস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বেশ হাত ধরে আছে সমীরের, দেখে মনে হল ওদের প্রেম অনেক গভীর খাদে বয়ে চলেছে। চোখের সামনে ঝিলামের চেহারা ভেসে ওঠে। খাবার পরে বুধাদিত্য সোজা ওদের টেবিলে যায় আর সমীরের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সমীর ওকে দেখে ভুত দেখার মতন থমকে যায়। এবারে হাতেনাতে ধরা পরে গেছে সমীর। পাশে বসা মেয়েটা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। বুধাদিত্য সমীরকে বাইরে ডাকে কিছু কথা বলার জন্য।
বাইরে যেতেই বুধাদিত্য সমীরকে চেপে ধরে, “কি ব্যাপার একটু খোলসা করে জানা আমাকে।”
সমীর একটু রেগে যায় ওর কথায়, “তোর সব ব্যাপারে মাথা গলাবার কি দরকার। আমি আমার জীবন নিয়ে কি করব না করব সেটা তোকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখের সামনে ঝিলামের হাসি মাখানো মিষ্টি মুখ ভেসে ওঠে। সমীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে ঝিলাম। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরকে বলে, “তোদের দুজনকে দেখে ত মনে হয় না যে তোদের সম্পর্ক শুধু মাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকেও তুই ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?”
সমীর প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়, “না রে, তোকে বলেছিলাম ত, এই ব্যাস ফ্লারটিং, শালা আর কি, এক রাত ব্যাস কাম খালাস।”
বুধাদিত্য, “এটা এক রাতের ব্যাপার নয় সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে সমীর। এই মেয়ে হোটেল শাংরিলাতে ছিল, এই মেয়ে হয়ত কাল তোর সাথে ছিল।”
সমীর কিছু বলতে যাবার আগেই বুধাদিত্যের সব সন্দেহ দূর করে মেয়েটা সমীরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে সমু, এনি প্রবলেম?”
বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর, যাক কানে শুনে সন্দেহের ভিত অনেক মজবুত হয়ে গেছে। সমীর মেয়েটাকে ভেতরে যেতে বলে। ওকে বলে যে অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই একটু কথা বলেই টেবিলে ফিরে যাবে। মেয়েটা একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায় একবার সমীরের মুখের দিকে তাকায়, তারপরে চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যেতেই সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “ঝিলাম যা চায় সেটা ও পেয়ে গেছে। আমি আমার জীবনে কি করছি না করছি সেটা ওর দেখার দরকার নেই।”
বুধাদিত্য, “সমীর, ঝিলাম তোর বিয়ে কর বউ, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি তোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না, ছেলে হয়েছিস যখন তখন যে শালা এদিকে ওদিকে মুখ মারবি সেটা আর নতুন কি? কিন্তু শালা মুখ মারতে গিয়ে প্রেমে পড়বি আর বাড়িতে বউ একা থাকবে?”
সমীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরে জিজ্ঞেস করে রাতে খালি আছে কিনা? বুধাদিত্য নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় আর বলে রাতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। বিস্তারিত ভাবে কথা বলতে চায় সমীর ওর সাথে। রাতে সমীর ওর হোটেলের ঘরে আসে। বুধাদিত্য ওকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করে যে দুজনে একসাথে এক রুমে থাকছে কি না। মাথা দুলিয়ে মেনে নেয় সমীর, যে মেয়েটা আর সমীর এক রুমে আছে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বুধাদিত্য কারন জানতে চায়, কেন সমীর ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সমীরের সাথে কথাবার্তা টেপ করার জন্য চুপিচুপি মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য।
সমীর বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “আগেও তোকে জানিয়েছিলাম ঝিলামের কথা। জানিনা তোর মনে আছে কি না। চাকরি পাওয়ার পরে ঝিলাম যে আরও বদলে যাবে সেটা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ও সুন্দরী, ও ভীষণ আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি ও ভীষণ জেদি আর বদরাগী। চাকরি পাওয়ার পরে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবসময়ে। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, কলেজে বেড়িয়ে যায় আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। রাতে আমার দেরি হয় ফিরতে, সেই নিয়ে ওর কথা শুনতে হয়। ওর কথা সারে আট’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত নিয়ম কানুন মেনে চলা বড় কঠিন। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই দুই, তিন মাসে। জোর করে গাড়ি কেনার জন্য, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বাইক কিনি। আজকাল আবার আমার পয়সার হিসাব চায়। কই, আমি’ত ওর চাকরির পয়সার হিসাব চাই না? আমার আতে লাগে যখন আমার খরচ খরচার ওপরে হাত লাগাতে চায়।”
বুধাদিত্য চুপচাপ শুনে যায়। সমীর বলে চলে, “আজকাল জানিস আর আমাদের সেক্স হয়না। কোলকাতায় থাকাকালীন ঝিলাম উদ্দাম ছিল, প্রচন্ড উচ্ছল ছিল, সেই ঝিলাম অনেক বদলে গেছে। আমি বাড়ি ফিরি, ঝিলাম ঘুম চোখে দরজা খুলে আমার জন্য খাবার গরম করে শুতে চলে যায়। আমি চুপচাপ ওকে না ঘাটিয়ে নিজের খাবার খাই। এমত অবস্থায় আর কি একসাথে থাকা যায়? তুই জানিস না, এই দিল্লী এসেই ওর একটা মিস্ক্যারেজ হয়েছিল। তারপরে আমাদের শারীরিক সম্বন্ধ অনেক কমে যায়। আমাকে দোষ দেয় যে আমার নাকি স্পারম কাউন্ট কম।”
বুধাদিত্য, “তুই কি সে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলি কোনদিন?”
সমীর, “না আমার কিছু হয়নি, ওর মা হবার ক্ষমতা নেই। ওর গাইনি দেখে বলেছিল যে ওর গর্ভাশয়ে কিছু সমস্যা আছে।”
বুধাদিত্য, “দ্যাখ, আমি সেসব বিশেষ জানি না, তবে আমার মনে হয় তোর একবার ডাক্তার দেখান উচিত। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে একটা মিস্ক্যারেজের পরে একটা মেয়ের মনে বড় আঘাত লাগে, সেই আঘাত কাটতে একটু সময় লাগে। তুই কি সেই সময় টুকু ঝিলামকে দিয়েছিস?”
সমীর চুপ করে থাকে, বুধাদিত্যের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঝিলামের দিকে তারপরে হয়ত আর ফিরেও তাকায়নি ঠিক ভাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে বম্বের সেই মেয়েটার কথা। বুধাদিত্য দু’টো সিগারেট জ্বালায়, একটা সমীরকে দেয়। সমীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, “বম্বে অফিসে নন্দিতার সাথে দেখা।” মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, অবশেষে সমীরের জীবনের নতুন নারীর নাম জানা গেল, নন্দিতা। সমীর বলে চলে, “এক বিকেলে মিটিঙ্গের পরে আমার মাথায় এই সব চিন্তা ভাবনা ঘোরে, আমি খুব ড্রিঙ্ক করি। আর ড্রিঙ্কের বশে নন্দিতাকে মনের কথা বলে দেই, সেদিন রাতে দু’জনে আমার রুমে এসে পাগলের মতন সহবাস করেছিলাম। আমি তারপরে ওর প্রতি ঝুঁকে যাই। নন্দিতাকে ফেলে দেওয়ার এখন উপায় নেই। আমি সেইজন্য নন্দিতাকে দিল্লীতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিকে ঝিলাম, একদিকে নন্দিতা। একজন কে ছাড়তে পারিনা বাড়ির চাপে, আত্মীয় সজ্জনের চাপে, অন্যজনকে ছাড়তে পারিনা কেননা মন মানে না।”
সব কথা বলে সমীর চুপ করে থাকে। বুধাদিত্যের কান লাল হয়ে যায় সব কথা শুনে, জিজ্ঞেস করে সমীরকে, “কি করতে চাস তুই? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এই রকম দুই নৌকায় পা দিয়ে ত চলা যায় না।”
সমীর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, “মাঝে মাঝে মনে হয় ডিভোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু ওর পরিবার, আমার পরিবার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, এমন কি ঝিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ঝিলাম, অনেক বার করেছিল। আমি ঝিলামকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এক সবল পুরুষ, যেকোনো নারীকে সঙ্গমের সুখ দিতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নন্দিতাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি ঝিলামের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না কোনদিন। ও আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না কোনদিন। আমি কোথায় কি করছি, না করছি সেটা ওর জেনে দরকার নেই। আমিও দেখতে যাবো না ও কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে রাত কাটাচ্ছে।”
ঝিলামের মতন মিষ্টি, পবিত্র মেয়ের নামে ওই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যায় বুধাদিত্য। মনে হয় এক থাবরে মাথা ফাটিয়ে দেয় সমীরের, গর্জে ওঠে বুধাদিত্য, “ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছে? ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেছে? ঝিলামের নামে এই কথা বলার আগে তোর বুকে একবারের জন্য বাঁধল না? তোকে বুকে আগলে বাঁচিয়ে এনেছে আর তুই মাদা... শালা শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত, বউয়ের নামে এত জঘন্য অপবাদ দিলি?”
সমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “সারা জীবন ধরে কি আমাকে সেই এক কথা শুনাতে চাস? ঝিলামের প্রতি তোর অত দরদ কিসের বোকা... তুই কি আমার বউয়ের সাথে শুয়েছিস?”
রাগে কাঁপতে শুরু করে বুধাদিত্য, কান মাথা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে দেয়। সত্যি ওর বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝিলাম বসবাস। যদিও ঝিলাম সেই কথা এখন জানেনা জানলেও হয়ত এই জানে যে বুধাদিত্যের মনে কোন পাপ নেই। মনকে শক্ত করে বেঁধে নেয় বুধাদিত্য, হৃদয়ের টান যেন চোখে না এসে যায়। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “মাদার... কুত্তারবাচ্চা, এই কথা বলতে তোর একবার বাধল না? গত ছয় বছর পরে তোদের পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, দিল্লীতে আমার নিজের বলতে কেউ আছে। আজ আমার বুকের সেই আশা সেই ভালোবাসা খানখান করে দিলি তুই।” সমীররে মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। সমীর মনেপ্রানে জানে যে বুধাদিত্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সেই রাতে। চুপ করে থাকে, সমীর, বুধাদিত্য গর্জে ওঠে, “বেড়িয়ে যা শালা, বোকা... এখুনি বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে। মাদা... একবার ভেবেছিলাম তোদের থেকে দুরে চলে যাব, কিন্তু যাবো না এবারে। তোর জ্বলানো এই আগুনের খেলার আমি শেষ দেখে যাব। ঝিলামের চুলের ডগা যদি এই আগুন ছোঁয়, কথা দিচ্ছি, তুই শালা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবি না।”
সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পরে, রাগে, দুঃখে দুচোখ লাল হয়ে গেছে ওর। রোষ ভরা নয়নে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি, আর তুই যদি আমাদের মাঝে আসিস তাহলে সেই আগুনে তোকে জ্বালিয়ে দেব।” সমীর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, বুধাদিত্য হাতের মুঠি শক্ত করে চেয়ারে বসে থাকে। ভীষণ রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয়, একবার মনে হয় সমীরকে খুন করে ওর কবল থেকে ঝিলামকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ওকে আইনের চোখে, ঝিলামের চোখে নিচ, ঘৃণ্য অপরাধী বলে প্রমানিত করবে। মাথা কাজ করে না বুধাদিত্যের।
______________________________
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#1)
M
কাজের চাপ ভীষণ ভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরা খবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্ম কাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হল, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে কলেজে এসেছে কিন্তু কলেজ করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেড়িয়ে পরে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।
ঝিলাম কলেজের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙ্গার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পরে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হল যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙ্গুলের নখ খোটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পার আমায়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”
ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুড় হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়ত সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।
দুচোখে অঝোর ধারায় জল পরে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পরে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।
চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার কলেজে পৌঁছে দিয়ে এস।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বল, আবার কলেজে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেব।”
চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে কলেজে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হল জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।
অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুড়িয়ে নিয়ে আবার কলেজে ফিরে যেতে হয়। কলেজের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, কলেজ শেষ হলেই অফিসে চলে এস।”
ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পরে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।
ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। কলেজ থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”
ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করব আর, এর পর থেকে একাই হয়ত কাটাতে হবে।”
সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না কর তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকব।”
উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যাক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।
সময়ের খেয়াল পরে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছ?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পার নি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।
বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাটা দেয়। ঝিলামের চুরিদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পরে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত...” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পর মারতে যায়। থাপ্পরটা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অধভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরাজায় থাপ্পর মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।
বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”
বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই ত কাপড় পরে আছো বেশ ত লাগছে। একে গাড়িতে ত যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছ, একটু ত বসবে নাকি?”
বুধাদিত্য, “সে’ত ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি... ঠিক আছে চল।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের কলেজের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙ্গুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতা ময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন করে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।
Continued....
বুধাদিত্য একদিন সমীরকে সোজাসুজি ফোনে জিজ্ঞেস করে হোটেল সাংরিলায় দেখা মেয়েটার কথা। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে সমীর। বুধাদিত্য চেপে ধরে সমীরকে কোন ঠাসা করে বলে দেয় যে সেদিন ঝিলামকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে। সমীর ধরা পরে যায়, বিকেলে দেখা করার কথা বলে। বিকেলে দেখা হয় দুই বন্ধুর। বুধাদিত্যকে সমীর জানায় যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ওদের বম্বের অফিসের একজন। বুধাদিত্য ঠিক মানতে পারে না, পাল্টা জিজ্ঞেস করে যে, যদি অফিস কলিগ হয়ে থাকে তাহলে কেন এত লুকোচুরি, কেন ঝিলামকে বলেছিল যে আহমেদাবাদ যাচ্ছে? সমীরের কাছে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকে না। বুধাদিত্য ওকে সাবধান করে দেয়, বলে যে, নারীসঙ্গ করছ কর, বুধাদিত্য নিজে কিছু কাল আগে পর্যন্ত অনেকের সাথে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরলে যেন একবার ভেবে দেখে সমীর, ঘরে একজন বউ আছে। সমীর চুপ করে ওর কথা শুনে যায়। শেষে জানায় যে শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক আছে সেই মেয়েটার সাথে। বুধাদিত্য জানতে চায় সেই মেয়েটার নাম আর ঠিকানা, সমীর এড়িয়ে যায়। বলে যে একদিনের দেখা, এত প্রশ্ন বাণে কেন জর্জরিত করছে? সব ভুলে এবার নতুন করে ঝিলামকে কাছে টেনে নেবে সমীর। বুধাদিত্য ওকে বাড়ি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতন সাবধান বানী দেয়।
সেদিনের পরে ঝিলামের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে। সমীর মাঝে মাঝেই আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, ঝিলামকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজারে বের হয়। ঝিলাম বেশ খুশি সমীরের আচরনে। ঝিলামের অফিসে হানা দেওয়া একটু কমে গেছে। আগে যেখানে পাঁচ দিনে চারদিন হানা দিয়ে আব্দার করত বাড়ি পৌঁছে দাও সেখানে আজকাল হয়ত দু’দিন অফিসে আসে। সমীর নতুন বাইক কিনেছে, মাঝে মাঝই ঝিলামকে কলেজ থেকে নিতে আসে। সমীর ঝিলামকে নিতে আসলে মাঝে মাঝে দু’জনে মিলে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে যায়। ঝিলামের মুখে হাসি দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আলমারি খুলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা সেই ইভিনিং ড্রেস টা দেখে আর ম্লান হাসে। মনের মধ্যে যে স্বপ্ন গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেটা হয়ত এই যাত্রায় আর সফল হবে না। সমীরের এই আচরনে বুধাদিত্যের ভাল লাগে তবে মনের কোনে একটু ব্যাথাও জাগে।
এক মাস কেটে যায়। সমীর আর ঝিলামের সাথে দেখা সাক্ষাৎ অনেক কমে যায়। ঝিলাম মাঝে সাঝে ফোন করে, খবরা খবর নেয়। বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায় ঝিলাম, মনে মনে বোঝে যে সমীরের সাথে নিশ্চয় বুধাদিত্য কথা বলেছে তাই সমীর বদলে গেছে।
দেশের খুব বড় একটা মোবাইল অপারেটারের সাথে মিটিং করতে একবার পুনে যায় বুধাদিত্য, দিন দুয়েকের কাজ। এবারে যাবার আগে ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোন কথা হয়না। রাতের বেলা কাজের শেষে একদিন বুধাদিত্য অফিসের বাকি লোকদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায় কাজের খুশিতে পার্টি দেবার জন্য। সেখানে সমীরের মুখোমুখি হয়। বুধাদিত্য প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায় সমীরকে দেখে, জিজ্ঞেস করে কি কারনে পুনেতে? যথারীতি সমীর এক উত্তর দেয় যে অফিসের কাজে এসেছে। রাতের বেলা ঝিলামকে ফোন করে জানতে পারে যে সমীর পুনে গেছে অফিসের কাজে। অনেকদিন পরে ঝিলাম ওর গলার আওয়াজ পেয়ে খুব খুশি হয়, জানায় যে সমীর অনেক বদলে গেছে নাকি। তবে আজকাল অফিসের কাজে হামেশাই বাইরে থাকে। একটু সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কিছু বলে না, শুধু জানায় যে সমীরের সাথে দেখা হয়েছে ওর। সেটা শুনে ঝিলাম একটু অবাক হয়ে যায়। বুধাদিত্যকে জানায় যে কিছু আগে নাকি সমীরের সাথে কথা হয়েছিল, কিন্তু ওদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে সমীর ওকে কিছুই জানায় নি। সমীরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে কোন হোটেলে উঠেছে না হলে একবার দেখা করে আসত বুধাদিত্য। ঝিলামের কথা শুনে ওর নাকে একটা সন্দেহের গন্ধ আসে। সমীর খুব বড় একটা খেলা খেলছে ঝিলামের সাথে।
পরেরদিন ভাগ্যবশত সমীরের সাথে একটা চাইনিজ রেস্তুরেন্টে দেখা হয় বুধাদিত্যের। এবারে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে ওর সাথে সেই মেয়েটা যাকে ও হোটেল শাংরিলতে দেখেছে। সমীরের ওপরে যা সন্দেহ করেছিল সেটা চোখে দেখে প্রতীত হয় যে সমীর অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে নিজের মোবাইলে। একটা ভিডিও তুলে নেয়, যেখানে সমীর বেশ গা এলিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে গল্প করছে, কাঁটা চমচে নুডুলস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বেশ হাত ধরে আছে সমীরের, দেখে মনে হল ওদের প্রেম অনেক গভীর খাদে বয়ে চলেছে। চোখের সামনে ঝিলামের চেহারা ভেসে ওঠে। খাবার পরে বুধাদিত্য সোজা ওদের টেবিলে যায় আর সমীরের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সমীর ওকে দেখে ভুত দেখার মতন থমকে যায়। এবারে হাতেনাতে ধরা পরে গেছে সমীর। পাশে বসা মেয়েটা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। বুধাদিত্য সমীরকে বাইরে ডাকে কিছু কথা বলার জন্য।
বাইরে যেতেই বুধাদিত্য সমীরকে চেপে ধরে, “কি ব্যাপার একটু খোলসা করে জানা আমাকে।”
সমীর একটু রেগে যায় ওর কথায়, “তোর সব ব্যাপারে মাথা গলাবার কি দরকার। আমি আমার জীবন নিয়ে কি করব না করব সেটা তোকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখের সামনে ঝিলামের হাসি মাখানো মিষ্টি মুখ ভেসে ওঠে। সমীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে ঝিলাম। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরকে বলে, “তোদের দুজনকে দেখে ত মনে হয় না যে তোদের সম্পর্ক শুধু মাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকেও তুই ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?”
সমীর প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়, “না রে, তোকে বলেছিলাম ত, এই ব্যাস ফ্লারটিং, শালা আর কি, এক রাত ব্যাস কাম খালাস।”
বুধাদিত্য, “এটা এক রাতের ব্যাপার নয় সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে সমীর। এই মেয়ে হোটেল শাংরিলাতে ছিল, এই মেয়ে হয়ত কাল তোর সাথে ছিল।”
সমীর কিছু বলতে যাবার আগেই বুধাদিত্যের সব সন্দেহ দূর করে মেয়েটা সমীরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে সমু, এনি প্রবলেম?”
বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর, যাক কানে শুনে সন্দেহের ভিত অনেক মজবুত হয়ে গেছে। সমীর মেয়েটাকে ভেতরে যেতে বলে। ওকে বলে যে অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই একটু কথা বলেই টেবিলে ফিরে যাবে। মেয়েটা একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায় একবার সমীরের মুখের দিকে তাকায়, তারপরে চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যেতেই সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “ঝিলাম যা চায় সেটা ও পেয়ে গেছে। আমি আমার জীবনে কি করছি না করছি সেটা ওর দেখার দরকার নেই।”
বুধাদিত্য, “সমীর, ঝিলাম তোর বিয়ে কর বউ, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি তোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না, ছেলে হয়েছিস যখন তখন যে শালা এদিকে ওদিকে মুখ মারবি সেটা আর নতুন কি? কিন্তু শালা মুখ মারতে গিয়ে প্রেমে পড়বি আর বাড়িতে বউ একা থাকবে?”
সমীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরে জিজ্ঞেস করে রাতে খালি আছে কিনা? বুধাদিত্য নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় আর বলে রাতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। বিস্তারিত ভাবে কথা বলতে চায় সমীর ওর সাথে। রাতে সমীর ওর হোটেলের ঘরে আসে। বুধাদিত্য ওকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করে যে দুজনে একসাথে এক রুমে থাকছে কি না। মাথা দুলিয়ে মেনে নেয় সমীর, যে মেয়েটা আর সমীর এক রুমে আছে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বুধাদিত্য কারন জানতে চায়, কেন সমীর ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সমীরের সাথে কথাবার্তা টেপ করার জন্য চুপিচুপি মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য।
সমীর বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “আগেও তোকে জানিয়েছিলাম ঝিলামের কথা। জানিনা তোর মনে আছে কি না। চাকরি পাওয়ার পরে ঝিলাম যে আরও বদলে যাবে সেটা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ও সুন্দরী, ও ভীষণ আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি ও ভীষণ জেদি আর বদরাগী। চাকরি পাওয়ার পরে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবসময়ে। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, কলেজে বেড়িয়ে যায় আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। রাতে আমার দেরি হয় ফিরতে, সেই নিয়ে ওর কথা শুনতে হয়। ওর কথা সারে আট’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত নিয়ম কানুন মেনে চলা বড় কঠিন। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই দুই, তিন মাসে। জোর করে গাড়ি কেনার জন্য, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বাইক কিনি। আজকাল আবার আমার পয়সার হিসাব চায়। কই, আমি’ত ওর চাকরির পয়সার হিসাব চাই না? আমার আতে লাগে যখন আমার খরচ খরচার ওপরে হাত লাগাতে চায়।”
বুধাদিত্য চুপচাপ শুনে যায়। সমীর বলে চলে, “আজকাল জানিস আর আমাদের সেক্স হয়না। কোলকাতায় থাকাকালীন ঝিলাম উদ্দাম ছিল, প্রচন্ড উচ্ছল ছিল, সেই ঝিলাম অনেক বদলে গেছে। আমি বাড়ি ফিরি, ঝিলাম ঘুম চোখে দরজা খুলে আমার জন্য খাবার গরম করে শুতে চলে যায়। আমি চুপচাপ ওকে না ঘাটিয়ে নিজের খাবার খাই। এমত অবস্থায় আর কি একসাথে থাকা যায়? তুই জানিস না, এই দিল্লী এসেই ওর একটা মিস্ক্যারেজ হয়েছিল। তারপরে আমাদের শারীরিক সম্বন্ধ অনেক কমে যায়। আমাকে দোষ দেয় যে আমার নাকি স্পারম কাউন্ট কম।”
বুধাদিত্য, “তুই কি সে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলি কোনদিন?”
সমীর, “না আমার কিছু হয়নি, ওর মা হবার ক্ষমতা নেই। ওর গাইনি দেখে বলেছিল যে ওর গর্ভাশয়ে কিছু সমস্যা আছে।”
বুধাদিত্য, “দ্যাখ, আমি সেসব বিশেষ জানি না, তবে আমার মনে হয় তোর একবার ডাক্তার দেখান উচিত। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে একটা মিস্ক্যারেজের পরে একটা মেয়ের মনে বড় আঘাত লাগে, সেই আঘাত কাটতে একটু সময় লাগে। তুই কি সেই সময় টুকু ঝিলামকে দিয়েছিস?”
সমীর চুপ করে থাকে, বুধাদিত্যের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঝিলামের দিকে তারপরে হয়ত আর ফিরেও তাকায়নি ঠিক ভাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে বম্বের সেই মেয়েটার কথা। বুধাদিত্য দু’টো সিগারেট জ্বালায়, একটা সমীরকে দেয়। সমীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, “বম্বে অফিসে নন্দিতার সাথে দেখা।” মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, অবশেষে সমীরের জীবনের নতুন নারীর নাম জানা গেল, নন্দিতা। সমীর বলে চলে, “এক বিকেলে মিটিঙ্গের পরে আমার মাথায় এই সব চিন্তা ভাবনা ঘোরে, আমি খুব ড্রিঙ্ক করি। আর ড্রিঙ্কের বশে নন্দিতাকে মনের কথা বলে দেই, সেদিন রাতে দু’জনে আমার রুমে এসে পাগলের মতন সহবাস করেছিলাম। আমি তারপরে ওর প্রতি ঝুঁকে যাই। নন্দিতাকে ফেলে দেওয়ার এখন উপায় নেই। আমি সেইজন্য নন্দিতাকে দিল্লীতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিকে ঝিলাম, একদিকে নন্দিতা। একজন কে ছাড়তে পারিনা বাড়ির চাপে, আত্মীয় সজ্জনের চাপে, অন্যজনকে ছাড়তে পারিনা কেননা মন মানে না।”
সব কথা বলে সমীর চুপ করে থাকে। বুধাদিত্যের কান লাল হয়ে যায় সব কথা শুনে, জিজ্ঞেস করে সমীরকে, “কি করতে চাস তুই? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এই রকম দুই নৌকায় পা দিয়ে ত চলা যায় না।”
সমীর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, “মাঝে মাঝে মনে হয় ডিভোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু ওর পরিবার, আমার পরিবার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, এমন কি ঝিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ঝিলাম, অনেক বার করেছিল। আমি ঝিলামকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এক সবল পুরুষ, যেকোনো নারীকে সঙ্গমের সুখ দিতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নন্দিতাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি ঝিলামের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না কোনদিন। ও আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না কোনদিন। আমি কোথায় কি করছি, না করছি সেটা ওর জেনে দরকার নেই। আমিও দেখতে যাবো না ও কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে রাত কাটাচ্ছে।”
ঝিলামের মতন মিষ্টি, পবিত্র মেয়ের নামে ওই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যায় বুধাদিত্য। মনে হয় এক থাবরে মাথা ফাটিয়ে দেয় সমীরের, গর্জে ওঠে বুধাদিত্য, “ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছে? ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেছে? ঝিলামের নামে এই কথা বলার আগে তোর বুকে একবারের জন্য বাঁধল না? তোকে বুকে আগলে বাঁচিয়ে এনেছে আর তুই মাদা... শালা শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত, বউয়ের নামে এত জঘন্য অপবাদ দিলি?”
সমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “সারা জীবন ধরে কি আমাকে সেই এক কথা শুনাতে চাস? ঝিলামের প্রতি তোর অত দরদ কিসের বোকা... তুই কি আমার বউয়ের সাথে শুয়েছিস?”
রাগে কাঁপতে শুরু করে বুধাদিত্য, কান মাথা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে দেয়। সত্যি ওর বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝিলাম বসবাস। যদিও ঝিলাম সেই কথা এখন জানেনা জানলেও হয়ত এই জানে যে বুধাদিত্যের মনে কোন পাপ নেই। মনকে শক্ত করে বেঁধে নেয় বুধাদিত্য, হৃদয়ের টান যেন চোখে না এসে যায়। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “মাদার... কুত্তারবাচ্চা, এই কথা বলতে তোর একবার বাধল না? গত ছয় বছর পরে তোদের পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, দিল্লীতে আমার নিজের বলতে কেউ আছে। আজ আমার বুকের সেই আশা সেই ভালোবাসা খানখান করে দিলি তুই।” সমীররে মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। সমীর মনেপ্রানে জানে যে বুধাদিত্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সেই রাতে। চুপ করে থাকে, সমীর, বুধাদিত্য গর্জে ওঠে, “বেড়িয়ে যা শালা, বোকা... এখুনি বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে। মাদা... একবার ভেবেছিলাম তোদের থেকে দুরে চলে যাব, কিন্তু যাবো না এবারে। তোর জ্বলানো এই আগুনের খেলার আমি শেষ দেখে যাব। ঝিলামের চুলের ডগা যদি এই আগুন ছোঁয়, কথা দিচ্ছি, তুই শালা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবি না।”
সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পরে, রাগে, দুঃখে দুচোখ লাল হয়ে গেছে ওর। রোষ ভরা নয়নে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি, আর তুই যদি আমাদের মাঝে আসিস তাহলে সেই আগুনে তোকে জ্বালিয়ে দেব।” সমীর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, বুধাদিত্য হাতের মুঠি শক্ত করে চেয়ারে বসে থাকে। ভীষণ রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয়, একবার মনে হয় সমীরকে খুন করে ওর কবল থেকে ঝিলামকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ওকে আইনের চোখে, ঝিলামের চোখে নিচ, ঘৃণ্য অপরাধী বলে প্রমানিত করবে। মাথা কাজ করে না বুধাদিত্যের।
______________________________
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#1)
M
কাজের চাপ ভীষণ ভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরা খবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্ম কাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হল, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে কলেজে এসেছে কিন্তু কলেজ করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেড়িয়ে পরে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।
ঝিলাম কলেজের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙ্গার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পরে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হল যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙ্গুলের নখ খোটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পার আমায়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”
ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুড় হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়ত সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।
দুচোখে অঝোর ধারায় জল পরে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পরে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।
চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার কলেজে পৌঁছে দিয়ে এস।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বল, আবার কলেজে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেব।”
চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে কলেজে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হল জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।
অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুড়িয়ে নিয়ে আবার কলেজে ফিরে যেতে হয়। কলেজের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, কলেজ শেষ হলেই অফিসে চলে এস।”
ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পরে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।
ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। কলেজ থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”
ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করব আর, এর পর থেকে একাই হয়ত কাটাতে হবে।”
সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না কর তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকব।”
উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যাক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।
সময়ের খেয়াল পরে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছ?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পার নি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।
বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাটা দেয়। ঝিলামের চুরিদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পরে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত...” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পর মারতে যায়। থাপ্পরটা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অধভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরাজায় থাপ্পর মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।
বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”
বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই ত কাপড় পরে আছো বেশ ত লাগছে। একে গাড়িতে ত যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছ, একটু ত বসবে নাকি?”
বুধাদিত্য, “সে’ত ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি... ঠিক আছে চল।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের কলেজের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙ্গুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতা ময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন করে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।
Continued....