27-02-2019, 05:57 PM
অশ্রুহীন বিদায়
বি.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। বিগত দুমাস ধরে প্রেয়সী পরী যেন মা ধরিত্রির রুপ ধারন করেছিল। সর্বদা চোখে চোখে রেখেছিল অভিকে। ওকে নিজের ঘর ছেড়ে রাতের বেলায় বসার ঘরে পড়তে বসতে নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে চোখে চোখে রাখতে পারে। সেই কয়দিন পরী নিজেকে এক নিয়ন্ত্রিত মহিলা বানিয়ে তুলেছিল ঠিক তাঁর ছোটমায়ের মতন। অনেক রাত কেটে গেছে যে অভি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত আর পরী ওর মাথার নিচ থেকে বই নিয়ে গুছিয়ে রেখে দিত আর গায়ের ওপরে চাদর ঢেকে দিত। অনেক রাত কেটে গেছে, পরী ওর সামনে বসে এক নয় খবরের কাগজ পড়ত না হলে কোন উপন্যাস নিয়ে বসে থাকত। যাতে অভির ঘুম না পায় সেই জন্য সময়ে সময়ে কফি বানিয়ে আনত। কফি খাইয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিত, কিন্তু একবারের জন্যেও গায়ে হাত লাগাতে দিত না। অভি মাঝে মাঝেই বকা খেত অপটিক্সের বা মেকানিক্সের জন্য। মা প্রথম কয়েকদিন ওদের ওপরে একটু নজর রেখেছিলেন, মনে হয় মা কিছু আচ করেছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে পরী শুধু সামনে বসে উপন্যাস পরে আর টেবিলে কফির সরঞ্জাম তখন মায়ের সন্দেহ দূর হয়ে যায়। পরীর আর অভির ভেতরের কথা মা টের পায়না।
পরী সেই প্রথম রাতের চুম্বনের পরে নিজের চারদিকে এক উঁচু দেয়াল গড়ে তোলে, অভির সাধ্য ছিলনা সেই কঠিন দেয়াল টপকে প্রেয়সী পরীর কাছে পৌঁছানর, সামনে সবসময়ে যেন মাতৃময়ি মূর্তি শুচিস্মিতা দাঁড়িয়ে থাকত। পরী একেবারে বঞ্চিত করেনি অভিকে, মাঝে মাঝে সস্নেহে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিত কিম্বা ঘুম ঘুম পেলে মাথায় চাঁটি মেরে জাগিয়ে দিত কিম্বা রাতে ঘুম না আসলে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পারিয়ে দিত। অভির বুঝতে কষ্ট হয়না যে ওকে অনেক কিছু করতে হবে জীবনে যদি পরীকে নিজের করে নিতে হয়। এই পৃথিবী টাকা চেনে আর চেনে সামাজিক পদমর্যাদা, এই দুটি না পেলে অভি পরীকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না ওর কঠোর বাবা মায়ের শৃঙ্খলা থেকে। শেষ পর্যন্ত মা ধারিত্রি জয় লাভ করেন মেনকার কাছে।
দিনটা, 22শে মে, 2001. বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। অভি বসার ঘরে বসে টি.ভি. তে ওর প্রিয় সিনেমা "Gone with the wind" দেখছে। বাড়ির কারুর ইংরাজি সিনেমা বিশেষ পছন্দ নয় তাই অভি একা একা বসে সিনেমা দেখছিল। গ্রীষ্মকাল কোলকাতায় চেপচেপে গরম, মাথার ওপরের পাখা বনবন করে ঘুরছে। পরী মায়ের সাথে রান্না ঘরে কিছু কাজে ব্যাস্ত আর বাবা রাতের শোয়ার জন্য বিছানা তৈরি করছিলেন।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, তখন ফোন এল। বাবা ফোন তুলে কথা বললেন। কিছু পরে ফোন রেখে বাবা বসার ঘরে ঢুকলেন। বাবার থমথমে মুখ দেখে অভির বুকের মাঝে এক সংশয়ের উদ্রেক হয়। অভি বাবাকে জিজ্ঞেস করে যে কার ফোন এসেছিল।
বাবা, "ব্যানারজি কাকু তোকে এখুনি বেলে ভিউ ক্লিনিকে ডেকেছে।"
ব্যানারজি কাকু মানে অরুনার বাবার ফোন, সেই শুনে অভির আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। এক পলকের মধ্যে পুবালির কান্না ভেজা চোখের কথা মনে পরে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল অভি। পরী আর মা বাবার কথা শুনে রান্না ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে। পরী অভির দিকে তাকাল, অভির চোখ দেখে পরীর বুঝতে বাকি রইল না যে ঘটনা কি ঘটে গেছে।
কোনোরকমে জামা কাপড় পরে অভি বেড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত, এমন সময়ে বাবা অভিকে ডাক দিয়ে বললেন যে পরীও যেতে চায়। অভি মায়ের দিকে তাকাল, পরী জামাকাপড় পরে তৈরি যাবার জন্য। ও ওর ছোটমায়ের দিকে জল ভরা করুন চোখে তাকিয়ে অনুরধ করে অভির সাথে যাবার জন্য। মা পরীর চোখ দেখে বুঝলেন যে পরীকে আটকানো সম্ভব হবে না।
ট্যাক্সিতে পরীর কে জড়িয়ে ধরে থাকে অভি, পরীর অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না যে একটা বিশাল বড় ঝড় আকাশের কোনায় জমে এসেছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারটা নাগাদ ওরা নারসিং হোমে পৌঁছায়। ভেতরে ঢুকে দেখে ব্যানারজি কাকু, কাকিমা, পুবালির বাবা মা আর অরুনা দাঁড়িয়ে। পরীকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনা। পরী অরুনাকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
অভি ব্যানারজি কাকুর কাছে গিয়ে পুবালির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, বিকেল বেলা সবাই চা খেতে ব্যাস্ত ছিল। পুবালি নিজের ঘরে নিজের আলমারি গুছাতে ব্যাস্ত ছিল। আল্মারির মাথায় কোন জিনিস ছিল যার জন্য ও একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে সেটা নামাতে চেষ্টা করছিল। কোথা থেকে একটা মাকরসা দেখে পুবালি আঁতকে ওঠে আর টুল থেকে পরে যায়। আলমারির হাতল মাথায় লাগে আর নাক থেকে রক্ত বের হতে শুর হয়। প্রথমে পাশের ডাক্তার ডেকে রক্ত থামানর ব্যাবস্থা করে, কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। ডাক্তার রক্তের সাথে পুঁজ বের হতে দেখে পুবালিকে নারসিং হোমে ভরতি করতে বলেন। নারসিং হোমে নিয়ে আসা হয় পুবালিকে আর সঙ্গে সঙ্গে অপারেশান শুরু করে দেওয়া হয়।
অভি বাড়িতে ফোন করে বাবা মাকে সব জানায়। বাবা খুব চিন্তিত কেননা ব্যানারজি কাকু বাবার বন্ধু। বাবা পরীকে আর অরুনাকে দেখার জন্য বলেন। অভি লক্ষ্য করে যে অয়েটিং হলের এক কোনায় সমুদ্রনীল দাঁড়িয়ে। অরুনার বাবা মা জানেন না সমুদ্রনীলের ব্যাপার তাই সমুদ্রনীল ওদের সামনে আসতে পারছিল না আর অরুনার সাথে দেখা করতে পারছিল না। অভি ধিরে ধিরে সমুদ্রনীলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ও ব্যাপার টা জানল কি করে। সমুদ্রনীল জানায় যে অরুনা ওকে ফোন করে জানিয়েছে, কিন্তু এখানে এসে বাড়ির সবাইকে দেখে ও আর অরুনার কাছে যেতে পারছে না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে অরুনাকে নিয়ে আসতে বলে। অরুনা অনেক আগেই সমুদ্রনীলকে লক্ষ্য করেছিল কিন্তু বাবা মায়ের জন্য কাছে যেতে পারেনি। পরী অরুনাকে নিয়ে ওদের কাছে আসে। অরুনা সমুদ্রনীল কে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে।
পরী অভিকে বলে, "এখান থেকে চলে এস, ওদের কে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও।"
অভি উত্তর দেয়, "তুই অরুনাকে একা ছেড়ে যেওনা, সেটা ঠিক হবে না। এখানে কেউ সমুদ্রনীলের কোথা এখনো জানেনা তাই ওকে একা ছেড়ে গেলে হিতে বিপরিত হতে দেরি হবে না। তুমি ওদের কাছেই থাক আমি যাই কাকুর কাছে।"
প্রত্যকে মুহূর্ত যেন এক এক বছর মনে হচ্ছিল অভির, সময় যেন আর কাটতে চায় না। উৎকণ্ঠায় সবাই দাঁড়িয়ে। পুবালির বাবা মা খুব চিন্তিত, তাদের একমাত্র মেয়ে আজ অপারেশান টেবিলে শুয়ে, প্রহর গুনছে।
সমুদ্রনীল কিছু পরে অভিকে ডেকে বলল যে ও সারা রাত হস্পিটালে থাকতে পারবে না কারন কেউ ওকে দেখে ফেললে অরুনা মুশকিলে পরে যেতে পারে। অভির সেই কথা ঠিক বলে মনে হল, অভি জানাল যে কিছু খবর থাকলে সমুদ্রনীল কে জানিয়ে দেবে। পরী অরুনার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে চেষ্টা করে।
ধরা গলায় পরী অরুনাকে সান্তনা দেয়, "আরে তুই এত কাঁদছিস কেন, পুবালির কিছু হবে না, চিন্তা নেই। শুধু নাক থেকে রক্ত পড়ছে সেটা অপারেশান করলে ঠিক হয়ে যাবে।"
অভি মনে মনে ভগবান কে ডেকে ওর মনের কথা জানায়, জানেনা ভগবান ওর কথা শুনলেন কিনা তাও শেষ বারের মতন হাত জোর করে প্রার্থনা জানায় তাঁর কাছে। ব্যানারজি কাকু সবাইকে এক বার জিজ্ঞেস করলেন যে কেউ চা খাবে কি না, কেউই অপারেশান থিয়েটারের সামনে থেকে নড়তে নারাজ। অভি পুবালির মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ওর মা জানালেন যে মেয়ের যতক্ষণ না কোন খবর আসছে ততক্ষণ তিনি নড়বেন না।
প্রায় সকাল চারটের সময়ে ডাক্তার বেড়িয়ে এল অপারেসান থিয়েটার থেকে। সবাই উন্মুখ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে, কি খব্র দেন ডাক্তার। অরুনা চোখ বন্ধ করে পরীর হাত শক্ত মুঠির মধ্যে ধরে বসে থাকে।
ডাক্তার জানালেন, "ব্রেনের সামনের দিকের ভেইন্স গুলো খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি ঠিক করার জন্য কিন্তু এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। পুবালি ধিরে ধরে কোমায় চলে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরা না পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। পরের বাহাত্তর ঘন্টা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা কিছু পরে ওকে আই.সি.ইউ তে নিয়ে যাব।"
পরীর দিকে তাকাল অভি, পরীর চোখে জল, অরুনা পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন পরী ওর শেষ সম্বল। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে অরুনার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পরী অরুনার পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে।
অরুনা ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে, তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঠোঁট জোড়া। ওর মুখে দেখে প্রায় ভেঙ্গে পরে অভি, কিন্তু ভাংলে চলবে না ওকে।
অরুনা ধরা গলায় অভির কাছে কাতর মিনতি করে, "একবার, একবার তুই আমার বোনকে ফিরিয়ে এনেছিলিস। কথা দে আবার ওকে ফিরিয়ে আনবি।"
দাতে দাঁত পিষে নিজেকে সামলে নেয় অভি।
পরী মৃদু বকুনি দেয় অরুনাকে, "কি যা তা বলছিস তুই, পুবালির কিছু হবে না। তুই ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবি আর কিছু দিনের মধ্যেই।" অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি গাধার মতন চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো?"
অরুনাকে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ব্যানারজি কাকু এসে জিজ্ঞেস করলেন যে ওরা বাড়ি যেতে চায় কিনা। অভি জানাল যে ও হস্পিটালে পুবালির বাবার সাথে থাকবে আর বাকি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।
পরী অভিকে বলে, "তোমার মনে হয় যে অরুনা এখান থেকে নড়বে?"
অরুনা দিকে তাকায় অভি, অরুনা মাথা নাড়ে, হসপিটাল থেকে যেতে নারাজ যতক্ষণ না পুবালি চোখ খুলে তাকায়। অভি পুবালির মায়ের কাছে যায়, মায়ের মন বাঁধ মানে না, তিনি কিছুতেই নড়বেন না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার দায়িত্ব যে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফেরা। আমি আর পুবালির বাবা এখানেই থাকছি। তোমরা স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে পরে এস। তুমিও সারা রাত জেগে, কিছুই খাওনি।"
পরী কেঁদে ওঠে, "আমাকে ত বলে দিলে, কিন্তু আমি কি করে পুবালির মাকে নিয়ে যাব সেটা একবার বলে দাও। ওই মায়ের একমাত্র মেয়ে যে আই.সি.ইউ তে।"
অভি পরীকে এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বলে, "প্লিস ওদের নিয়ে যাও এখান থেকে। আমি জানি কি ঘটবে।"
পরী হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির মুখের দিকে তাকায়, "কি বলতে চাও তুমি?"
অভি, "পুবালি আগে থেকে জানত যে ওর হাতে আর বেশি দিন নেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথা মনে আছে তোমার? আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল পুবালি? সেদিন ও আমাকে বলেছিল যে ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি যেন ওর হয়ে সমুদ্রনীলকে বলি অরুনাকে দেখতে।"
পরী অভির হাত শক্ত করে ধরে বলে, "তুমি আমাকে এত দিন এই কথা জানাও নি কেন?"
অভি, "আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওই কথা কাউকে জানাব না, তাই বলিনি।"
পরী, "আজ তাহলে সেই প্রতিজ্ঞা তুমি ভেঙ্গে দিলে? কি মানুষ তুমি?"
অভি, "পরী, আমি শুধু এই দুঃসময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চাইছি আর কিছু না।"
পরী অভিকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। ওকে সান্তনা দেবার মতন ভাষা খুঁজে পায়না অভি।
কিছু পরে পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি খুব শক্ত তাই না, কোন দিন চোখের জল ঝরাও না যে?"
অভি, "পরী, আমার এখন চোখের জল ঝরানোর মতন সময় নেই।"
পরী, "অরুনা আর পুবালির মাকে কি করে সামলাবে?"
অভি, "সময়ের সাথে সব কিছু সামলে নেয়, পরী। সময় খুব বড় মলমের কাজ করে।"
পরী অভির জামা ছেড়ে অরুনা আর পুবালির মায়ের কাছে গিয়ে বসে। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে পুবালির মায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পুবালির বাবা, ব্যানারজি কাকু অভির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অভি, "পুবালি এখন আই.সি.ইউ তে, সে মত অবস্থায় এখানে বসে থাকা টা বোকামো। আমি আর কাকু এখানে আছি, তুমি মেয়েদের নিয়ে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ি যাও, স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে চলে এস। এর মাঝে পুবালির জ্ঞান ফিরে এলে তোমাকে জানিয়ে দেব তুমি চলে এস।"
অভির কথায় পুবালির বাবা আর ব্যানারজি কাকু সায় দিলেন। ব্যানারজি বললেন যে যাবার পথে পরীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন। ব্যানারজি কাকু মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পরে সমুদ্রনীলকে ফোন করে ডেকে নিল অভি। পুবালি বাবা মাথা নিচু করে বসে, অভির কাছে টাকে সান্তনা দেবার মতন কোন ভাষা নেই। সময় যেন থেমে গেছে ওদের সামনে।
অভি বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ব্যানারজি কাকুর সাথে পরী বাড়ি ফিরছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন যে যদি পরী আবার নারসিং হোমে যেতে চায় তাহলে কি করবে? অভি জানাল যে যদি পরী আসতে চায় তাহলে ও বাবাকে ফোন করে দেবে আর বাবা যেন কোন গাড়ির বন্দবস্ত করে দেয় যাতে পরী নারসিং হোমে আসতে পারে। বাবা জানালেন যে তিনি ব্যানারজি কাকুর সাথে কথা বলে নেবেন পরীর যাওয়ার ব্যাপারে।
পরের ছয় ঘন্টা যেন ওদের কাছে ছয় যুগের মতন মনে হয়। অভি আর পুবালির বাবা অতি উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে থাকে কিছু ভাল খবরের জন্য। বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ, বাড়ির সবাই নারসিং হোম পৌঁছে যায়। অরুনাকে দেখতে না পেয়ে অরুনার দাদাকে অভি ওর কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, ব্যানারজি কাকু অরুনাকে নিয়ে অভিদের বাড়িতে গেছে পরীকে নিয়ে আসতে।
কিছু পরে অভি লক্ষ্য করে যে অরুনা আর পরী নার্সিং হোমে ঢুকছে, পেছনে ব্যানারজি কাকু। অরুনার মুখ থমথমে যেন ওর ওপর দিয়ে এখুনি বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে। পরী অভির কাছে এসে পুবালির খবর জিজ্ঞেস করে, অভি মাথা নাড়িয়ে জানায় যে এখন কোন খবর ডাক্তার জানায় নি। অরুনা ওর মায়ের পাশে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে, পরী অরুনার পাশে বসে যায়। অরুনা একবার পরীর দিকে তাকায় থমথমে চোখ নিয়ে।
ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, আই.সি.ইউ থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে এসে পুবালির বাবাকে ডাকেন। সবাই ডাক্তারের দিকে উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থাকে। শেষ খবর আসে, পুবালি ব্যানার্জি, এক নিস্পাপ ফুল, খুব লাজুক মেয়ে, জীবনে হয়ত একটা মাছিও মারেনি পুবালি, সেই মিষ্টি মেয়ে যে কোনদিন কলেজে কারুর সাথে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলেনি, ঝগড়া করা ত দুরে থাক। শুভঙ্কর ব্যানা+জি আর মালা ব্যানার্জির একমাত্র কন্যা সন্তান আর এই পৃথিবীতে নেই।
চাপা ক্রন্দনের রোল জেগে ওঠে চার পাশে। বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসে মায়ের বুক থেকে। পরীর চোখে জল, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে। অরুনা পরীকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে পরে থাকে।
অভি চোয়াল শক্ত করে, হাত মুঠি করে কপালে জোরে এক কিল মারে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে ভগবানের দিকে তাকিয়ে, "শেষ পর্যন্ত আমার কথা রাখলে না তুমি।" বার বার জিজ্ঞেস করে ভগবানকে "এই পৃথিবীতে অনেক দুস্করমিরা আছে, তাদের ছেড়ে কেন এক ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়ে কে কোলে ডেকে নিল? তোমার যদি সত্যি কান থাকে তাহলে তুমি আমার কাতর প্রার্থনা শুনতে পারতে, কিন্তু হায় বিধাতা, আমার প্রার্থনা শোনার কেউ নেই।"
পরী কিছু পরে অভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, "অরুনার দিকে তাকাও।"
অরুনার দিকে তাকায় অভি, অরুনা পাথরের মতন বসে নিস্পলক চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে। চেহারা ভাবলেশহীন, চোখে কোন ভাষা নেই, দু’চোখ যেন কাঁচের তৈরি।
বাবাকে ফোন করে খবর দেয় অভি, বাবা তখন অফিস থেকে বের হবেন। অভি বাবাকে সোজা নার্সিং হোমে এসে পরীকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য অনুরধ করল, "তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাও, এখানে থাকাটা ওর ঠিক হবে না। ভাগ্যের পরিহাস যা ঘটবার সেটা ত ঘটেই গেছে। ওকে বাড়ি নিয়ে যাও বাড়িতে মায়ের কাছে ঠিক থাকবে।"
বাবা জিজ্ঞেস করলেন অভিকে, "তোর কি খবর, কাল রাত থেকে ত কোথাও যাসনি। বাড়ি ফিরবি কখন?"
অভি, "এখুনি কিছু বলতে পারছি না, দেখি কাল সকালে বাড়ি ফিরব।"
অভি পরীকে বলল, "তোমার বাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে আসছে, তাঁর সাথে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।"
পরী অভির কলার চেপে ধরে বলে, "আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।"
অভি, "বুঝতে চেষ্টা করও, পরী। আমার বাড়ি যাবার এখন কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সত্যি কথা বলতে এখন অনেক কাজ আছে এইখানে।"
পরী, "তাহলে আমি অরুনার সাথে থাকব।"
অভি, "না তুমি ওর সাথে থাকবে না।"
পরী চেঁচিয়ে ওঠে, "কেন?"
অভি, "কাল রাত থেকে অনেক কান্নাকাটি করেছ তুমি, আর নয়। তুমি যদি ওর সাথে ওদের বাড়িতে যাও, সেখানে গিয়েও আবার কান্নার রোল শুরু হবে, তাঁর থেকে ভালো কথা বলছি তুমি বাড়ি যাও। তুমি একটু বিশ্রাম নাও বাড়ি গিয়ে তোমার ছোটমায়ের কাছে।"
পরী চাপা স্বরে বলে, "অরুনাকে দেখেছ? চোখের পাতা পড়ছে না ওর, পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা। ও যদি না কাঁদে তাহলে খুব বড় আরেকটা বিপদ হবে। আমাকে ওর কাছে থাকতে দাও।"
অভি, "আমি দেখি কি করতে পারি, কিন্তু তুমি এখন বাড়ি যাবে। অরুনার সাথে ওর বাবা মা আছেন ওকে দেখার জন্য, এখানে আমি কিছু পরে ব্যাস্ত হয়ে যাব তখন তোমাকে দেখার কেউ থাকবে না।"
সবার সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দিল, অরুনা। ও যদি না কাঁদে বা কিছু না বলে তাহলে আরেক বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না।
কিছু পরে অভি আর অরুনার দাদা একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করে ফিরে এল। বাড়ির দিকে পুবালির শেষ যাত্রা।
পুবালির দেহ যখন ওদের সামনে আনা হয়, তখন অরুনা চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধিরে ধিরে পুবালির গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মনে হয় যেন ডাকছে পুবালিকে চোখ খোলার জন্য, কিন্তু ওর গলা থেকে কোন আওয়াজ বার হয় না। একবারের জন্যেও অরুনার চোখের পাতা পরে না বাঁ ঠোঁট কাপে না। নিস্পলক ভাবে চেয়ে থাকে পুবালির বন্ধ চোখের দিকে। ধিরে ধিরে পুবালির মুখের ওপরে ঝুঁকে পরে, কপালে ছোটো একটা চুমু খায় আর গলায় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। পাথরের মতন গলা জড়িয়ে পরে থাকে অরুনা। অরুনার এই ব্যাবহার দেখে সবার বুকের ভেতরে এক নতুন ভয় জাগে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে অরুনাকে উঠানোর জন্য। পরী অরুনার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ওর পিঠে হাত রাখে। পরীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে অরুনা ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে তাকায় পরীর দিকে। চোখে জল নেই, চেহারায় কোন বিকার নেই, অরুনা যেন এক পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। পরীর সাথে চুপ করে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসে পরে।
কিছু পরে বাবা পৌঁছে যান নারসিং হোমে আর পরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ব্যানার্জি কাকু বললেন যে এবারে ওদের বাড়ির দিকে যাত্রা করা উচিত।
বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল পুবালির দেহ। সাদা ফুলে আর মভ রঙের শাড়িতে সাজান হল পুবালিকে। পুর সময়াটা অরুনা চুপ করে পুবালির দেহের পাশে বসে থাকে। পুবালির প্রাণহীন হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে দেয়। দেখে মনে হয় যেন এই ওর বোন আবার জেগে উঠে ওর সাথে কথা বলবে। কিন্তু হায় বিধাতা, পুবালি যে চির নিদ্রায় মগ্ন।
বাড়ি থেকে যখন ওকে নিয়ে বের হবে সবাই, তখন অভি লক্ষ্য করে কলেজের বন্ধুদের। বিদায়ের শেষ ক্ষণ উপস্থিত। পুবালির অন্তিম যাত্রা। বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল জেগে ওঠে, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে অরুনার মা কেঁদে ওঠেন। কিন্তু অরুনা নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে পুবালির মুখের দিকে, চোখে জল নেই, অতি শিতল সেই চোখের চাহনি। অভি এবং বাকিরা পুবালিকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে আসে। অরুনা চুপ করে বাড়ির গেট পর্যন্ত ওদের সাথে আসে তারপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পুবালিকে গাড়িতে তোলা না হয়। তারপরে অরুনা ফিরে যায় বাড়ির মধ্যে, নিজের ঘরে ঢুকে পরে বিছানায় শুয়ে পরে। বাড়ির বেশির ভাগ মহিলাদের নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় না।
নিস্পাপ ফুলের কুঁড়ি, পুবালি ব্যানারজির নস্বর দেহ আগুনে জ্বলে পঞ্চভুতে বিলীন হয়ে যায়। সেইদিন অভি তাঁর জীবনের সবথেকে মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখের সামনে দেখে, স্নেহ ভরা বুকে নিয়ে এক পিতা তাঁর চোখের মণি একমাত্র কন্যের মুখাগ্নি করছেন। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায় অভি, যেন কোন পিতাকে তাঁর কন্যার মুখাগ্নি না করতে হয়।
সমুদ্রনীল আর অভি চুপচাপ দুজনে গঙ্গার তীরে বসে রাতের আকাশের তারা দেখতে থাকে।
সমুদ্রনীল অভিকে জিজ্ঞেস করে, "অরুনা যদি কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে কি হবে? ও ত পাগল হয়ে যাবে, আরও বড় কোন বিপদ ঘটবে।"
অভি, "তুই ওকে ভালোবাসিস, তোকেই কিছু করতে হবে।"
সমুদ্রনীল, "আমি কি করতে পারি, তুই ওকে আমার চেয়ে ভাল করে চিনিস। পুবালির পরে শুচিদি ওর সব থেকে কাছের মানুষ। যদি কিছু করতে পারিস সেটা তোরাই করতে পারিস।"
অভি চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে যে ওদের কেউ দেখছে কিনা। পরিবারের বাকি লোকজন, কিছু দুরে একটা ছাওনির তলায় বসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে অভি,
"তুমি আমার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ, আমার আঁকা, আমার কবিতা, আমার লেখা। তুমি আমার জীবনের সব থেকে ভাল বন্ধুর বোনকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ। তুমি আমার কাছ থেকে আর কি চাও? শেষ বারের জন্য তোমার সামনে প্রার্থনা করছি যে আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা। যদি সেটাও চলে যায় তাহলে আমি জানব যে এই জগতে ভগবান বলে কিছু নেই, আছে শুধু পাথরের এক মূর্তি। শুধু একবারের জন্য প্রমান কর যে তুমি সত্যি আছো।"
বি.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। বিগত দুমাস ধরে প্রেয়সী পরী যেন মা ধরিত্রির রুপ ধারন করেছিল। সর্বদা চোখে চোখে রেখেছিল অভিকে। ওকে নিজের ঘর ছেড়ে রাতের বেলায় বসার ঘরে পড়তে বসতে নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে চোখে চোখে রাখতে পারে। সেই কয়দিন পরী নিজেকে এক নিয়ন্ত্রিত মহিলা বানিয়ে তুলেছিল ঠিক তাঁর ছোটমায়ের মতন। অনেক রাত কেটে গেছে যে অভি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত আর পরী ওর মাথার নিচ থেকে বই নিয়ে গুছিয়ে রেখে দিত আর গায়ের ওপরে চাদর ঢেকে দিত। অনেক রাত কেটে গেছে, পরী ওর সামনে বসে এক নয় খবরের কাগজ পড়ত না হলে কোন উপন্যাস নিয়ে বসে থাকত। যাতে অভির ঘুম না পায় সেই জন্য সময়ে সময়ে কফি বানিয়ে আনত। কফি খাইয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিত, কিন্তু একবারের জন্যেও গায়ে হাত লাগাতে দিত না। অভি মাঝে মাঝেই বকা খেত অপটিক্সের বা মেকানিক্সের জন্য। মা প্রথম কয়েকদিন ওদের ওপরে একটু নজর রেখেছিলেন, মনে হয় মা কিছু আচ করেছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে পরী শুধু সামনে বসে উপন্যাস পরে আর টেবিলে কফির সরঞ্জাম তখন মায়ের সন্দেহ দূর হয়ে যায়। পরীর আর অভির ভেতরের কথা মা টের পায়না।
পরী সেই প্রথম রাতের চুম্বনের পরে নিজের চারদিকে এক উঁচু দেয়াল গড়ে তোলে, অভির সাধ্য ছিলনা সেই কঠিন দেয়াল টপকে প্রেয়সী পরীর কাছে পৌঁছানর, সামনে সবসময়ে যেন মাতৃময়ি মূর্তি শুচিস্মিতা দাঁড়িয়ে থাকত। পরী একেবারে বঞ্চিত করেনি অভিকে, মাঝে মাঝে সস্নেহে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিত কিম্বা ঘুম ঘুম পেলে মাথায় চাঁটি মেরে জাগিয়ে দিত কিম্বা রাতে ঘুম না আসলে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পারিয়ে দিত। অভির বুঝতে কষ্ট হয়না যে ওকে অনেক কিছু করতে হবে জীবনে যদি পরীকে নিজের করে নিতে হয়। এই পৃথিবী টাকা চেনে আর চেনে সামাজিক পদমর্যাদা, এই দুটি না পেলে অভি পরীকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না ওর কঠোর বাবা মায়ের শৃঙ্খলা থেকে। শেষ পর্যন্ত মা ধারিত্রি জয় লাভ করেন মেনকার কাছে।
দিনটা, 22শে মে, 2001. বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। অভি বসার ঘরে বসে টি.ভি. তে ওর প্রিয় সিনেমা "Gone with the wind" দেখছে। বাড়ির কারুর ইংরাজি সিনেমা বিশেষ পছন্দ নয় তাই অভি একা একা বসে সিনেমা দেখছিল। গ্রীষ্মকাল কোলকাতায় চেপচেপে গরম, মাথার ওপরের পাখা বনবন করে ঘুরছে। পরী মায়ের সাথে রান্না ঘরে কিছু কাজে ব্যাস্ত আর বাবা রাতের শোয়ার জন্য বিছানা তৈরি করছিলেন।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, তখন ফোন এল। বাবা ফোন তুলে কথা বললেন। কিছু পরে ফোন রেখে বাবা বসার ঘরে ঢুকলেন। বাবার থমথমে মুখ দেখে অভির বুকের মাঝে এক সংশয়ের উদ্রেক হয়। অভি বাবাকে জিজ্ঞেস করে যে কার ফোন এসেছিল।
বাবা, "ব্যানারজি কাকু তোকে এখুনি বেলে ভিউ ক্লিনিকে ডেকেছে।"
ব্যানারজি কাকু মানে অরুনার বাবার ফোন, সেই শুনে অভির আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। এক পলকের মধ্যে পুবালির কান্না ভেজা চোখের কথা মনে পরে গেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল অভি। পরী আর মা বাবার কথা শুনে রান্না ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে। পরী অভির দিকে তাকাল, অভির চোখ দেখে পরীর বুঝতে বাকি রইল না যে ঘটনা কি ঘটে গেছে।
কোনোরকমে জামা কাপড় পরে অভি বেড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত, এমন সময়ে বাবা অভিকে ডাক দিয়ে বললেন যে পরীও যেতে চায়। অভি মায়ের দিকে তাকাল, পরী জামাকাপড় পরে তৈরি যাবার জন্য। ও ওর ছোটমায়ের দিকে জল ভরা করুন চোখে তাকিয়ে অনুরধ করে অভির সাথে যাবার জন্য। মা পরীর চোখ দেখে বুঝলেন যে পরীকে আটকানো সম্ভব হবে না।
ট্যাক্সিতে পরীর কে জড়িয়ে ধরে থাকে অভি, পরীর অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না যে একটা বিশাল বড় ঝড় আকাশের কোনায় জমে এসেছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারটা নাগাদ ওরা নারসিং হোমে পৌঁছায়। ভেতরে ঢুকে দেখে ব্যানারজি কাকু, কাকিমা, পুবালির বাবা মা আর অরুনা দাঁড়িয়ে। পরীকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনা। পরী অরুনাকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
অভি ব্যানারজি কাকুর কাছে গিয়ে পুবালির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, বিকেল বেলা সবাই চা খেতে ব্যাস্ত ছিল। পুবালি নিজের ঘরে নিজের আলমারি গুছাতে ব্যাস্ত ছিল। আল্মারির মাথায় কোন জিনিস ছিল যার জন্য ও একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে সেটা নামাতে চেষ্টা করছিল। কোথা থেকে একটা মাকরসা দেখে পুবালি আঁতকে ওঠে আর টুল থেকে পরে যায়। আলমারির হাতল মাথায় লাগে আর নাক থেকে রক্ত বের হতে শুর হয়। প্রথমে পাশের ডাক্তার ডেকে রক্ত থামানর ব্যাবস্থা করে, কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। ডাক্তার রক্তের সাথে পুঁজ বের হতে দেখে পুবালিকে নারসিং হোমে ভরতি করতে বলেন। নারসিং হোমে নিয়ে আসা হয় পুবালিকে আর সঙ্গে সঙ্গে অপারেশান শুরু করে দেওয়া হয়।
অভি বাড়িতে ফোন করে বাবা মাকে সব জানায়। বাবা খুব চিন্তিত কেননা ব্যানারজি কাকু বাবার বন্ধু। বাবা পরীকে আর অরুনাকে দেখার জন্য বলেন। অভি লক্ষ্য করে যে অয়েটিং হলের এক কোনায় সমুদ্রনীল দাঁড়িয়ে। অরুনার বাবা মা জানেন না সমুদ্রনীলের ব্যাপার তাই সমুদ্রনীল ওদের সামনে আসতে পারছিল না আর অরুনার সাথে দেখা করতে পারছিল না। অভি ধিরে ধিরে সমুদ্রনীলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ও ব্যাপার টা জানল কি করে। সমুদ্রনীল জানায় যে অরুনা ওকে ফোন করে জানিয়েছে, কিন্তু এখানে এসে বাড়ির সবাইকে দেখে ও আর অরুনার কাছে যেতে পারছে না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে অরুনাকে নিয়ে আসতে বলে। অরুনা অনেক আগেই সমুদ্রনীলকে লক্ষ্য করেছিল কিন্তু বাবা মায়ের জন্য কাছে যেতে পারেনি। পরী অরুনাকে নিয়ে ওদের কাছে আসে। অরুনা সমুদ্রনীল কে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে।
পরী অভিকে বলে, "এখান থেকে চলে এস, ওদের কে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও।"
অভি উত্তর দেয়, "তুই অরুনাকে একা ছেড়ে যেওনা, সেটা ঠিক হবে না। এখানে কেউ সমুদ্রনীলের কোথা এখনো জানেনা তাই ওকে একা ছেড়ে গেলে হিতে বিপরিত হতে দেরি হবে না। তুমি ওদের কাছেই থাক আমি যাই কাকুর কাছে।"
প্রত্যকে মুহূর্ত যেন এক এক বছর মনে হচ্ছিল অভির, সময় যেন আর কাটতে চায় না। উৎকণ্ঠায় সবাই দাঁড়িয়ে। পুবালির বাবা মা খুব চিন্তিত, তাদের একমাত্র মেয়ে আজ অপারেশান টেবিলে শুয়ে, প্রহর গুনছে।
সমুদ্রনীল কিছু পরে অভিকে ডেকে বলল যে ও সারা রাত হস্পিটালে থাকতে পারবে না কারন কেউ ওকে দেখে ফেললে অরুনা মুশকিলে পরে যেতে পারে। অভির সেই কথা ঠিক বলে মনে হল, অভি জানাল যে কিছু খবর থাকলে সমুদ্রনীল কে জানিয়ে দেবে। পরী অরুনার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে চেষ্টা করে।
ধরা গলায় পরী অরুনাকে সান্তনা দেয়, "আরে তুই এত কাঁদছিস কেন, পুবালির কিছু হবে না, চিন্তা নেই। শুধু নাক থেকে রক্ত পড়ছে সেটা অপারেশান করলে ঠিক হয়ে যাবে।"
অভি মনে মনে ভগবান কে ডেকে ওর মনের কথা জানায়, জানেনা ভগবান ওর কথা শুনলেন কিনা তাও শেষ বারের মতন হাত জোর করে প্রার্থনা জানায় তাঁর কাছে। ব্যানারজি কাকু সবাইকে এক বার জিজ্ঞেস করলেন যে কেউ চা খাবে কি না, কেউই অপারেশান থিয়েটারের সামনে থেকে নড়তে নারাজ। অভি পুবালির মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ওর মা জানালেন যে মেয়ের যতক্ষণ না কোন খবর আসছে ততক্ষণ তিনি নড়বেন না।
প্রায় সকাল চারটের সময়ে ডাক্তার বেড়িয়ে এল অপারেসান থিয়েটার থেকে। সবাই উন্মুখ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে, কি খব্র দেন ডাক্তার। অরুনা চোখ বন্ধ করে পরীর হাত শক্ত মুঠির মধ্যে ধরে বসে থাকে।
ডাক্তার জানালেন, "ব্রেনের সামনের দিকের ভেইন্স গুলো খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি ঠিক করার জন্য কিন্তু এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। পুবালি ধিরে ধরে কোমায় চলে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরা না পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। পরের বাহাত্তর ঘন্টা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা কিছু পরে ওকে আই.সি.ইউ তে নিয়ে যাব।"
পরীর দিকে তাকাল অভি, পরীর চোখে জল, অরুনা পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন পরী ওর শেষ সম্বল। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে অরুনার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পরী অরুনার পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে।
অরুনা ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে, তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঠোঁট জোড়া। ওর মুখে দেখে প্রায় ভেঙ্গে পরে অভি, কিন্তু ভাংলে চলবে না ওকে।
অরুনা ধরা গলায় অভির কাছে কাতর মিনতি করে, "একবার, একবার তুই আমার বোনকে ফিরিয়ে এনেছিলিস। কথা দে আবার ওকে ফিরিয়ে আনবি।"
দাতে দাঁত পিষে নিজেকে সামলে নেয় অভি।
পরী মৃদু বকুনি দেয় অরুনাকে, "কি যা তা বলছিস তুই, পুবালির কিছু হবে না। তুই ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবি আর কিছু দিনের মধ্যেই।" অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি গাধার মতন চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো?"
অরুনাকে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ব্যানারজি কাকু এসে জিজ্ঞেস করলেন যে ওরা বাড়ি যেতে চায় কিনা। অভি জানাল যে ও হস্পিটালে পুবালির বাবার সাথে থাকবে আর বাকি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।
পরী অভিকে বলে, "তোমার মনে হয় যে অরুনা এখান থেকে নড়বে?"
অরুনা দিকে তাকায় অভি, অরুনা মাথা নাড়ে, হসপিটাল থেকে যেতে নারাজ যতক্ষণ না পুবালি চোখ খুলে তাকায়। অভি পুবালির মায়ের কাছে যায়, মায়ের মন বাঁধ মানে না, তিনি কিছুতেই নড়বেন না।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার দায়িত্ব যে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফেরা। আমি আর পুবালির বাবা এখানেই থাকছি। তোমরা স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে পরে এস। তুমিও সারা রাত জেগে, কিছুই খাওনি।"
পরী কেঁদে ওঠে, "আমাকে ত বলে দিলে, কিন্তু আমি কি করে পুবালির মাকে নিয়ে যাব সেটা একবার বলে দাও। ওই মায়ের একমাত্র মেয়ে যে আই.সি.ইউ তে।"
অভি পরীকে এক কোনায় নিয়ে গিয়ে বলে, "প্লিস ওদের নিয়ে যাও এখান থেকে। আমি জানি কি ঘটবে।"
পরী হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির মুখের দিকে তাকায়, "কি বলতে চাও তুমি?"
অভি, "পুবালি আগে থেকে জানত যে ওর হাতে আর বেশি দিন নেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথা মনে আছে তোমার? আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল পুবালি? সেদিন ও আমাকে বলেছিল যে ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি যেন ওর হয়ে সমুদ্রনীলকে বলি অরুনাকে দেখতে।"
পরী অভির হাত শক্ত করে ধরে বলে, "তুমি আমাকে এত দিন এই কথা জানাও নি কেন?"
অভি, "আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওই কথা কাউকে জানাব না, তাই বলিনি।"
পরী, "আজ তাহলে সেই প্রতিজ্ঞা তুমি ভেঙ্গে দিলে? কি মানুষ তুমি?"
অভি, "পরী, আমি শুধু এই দুঃসময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চাইছি আর কিছু না।"
পরী অভিকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। ওকে সান্তনা দেবার মতন ভাষা খুঁজে পায়না অভি।
কিছু পরে পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি খুব শক্ত তাই না, কোন দিন চোখের জল ঝরাও না যে?"
অভি, "পরী, আমার এখন চোখের জল ঝরানোর মতন সময় নেই।"
পরী, "অরুনা আর পুবালির মাকে কি করে সামলাবে?"
অভি, "সময়ের সাথে সব কিছু সামলে নেয়, পরী। সময় খুব বড় মলমের কাজ করে।"
পরী অভির জামা ছেড়ে অরুনা আর পুবালির মায়ের কাছে গিয়ে বসে। অভি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে পুবালির মায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। পুবালির বাবা, ব্যানারজি কাকু অভির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অভি, "পুবালি এখন আই.সি.ইউ তে, সে মত অবস্থায় এখানে বসে থাকা টা বোকামো। আমি আর কাকু এখানে আছি, তুমি মেয়েদের নিয়ে ব্যানারজি কাকুর সাথে বাড়ি যাও, স্নান সেরে খেয়ে দেয়ে চলে এস। এর মাঝে পুবালির জ্ঞান ফিরে এলে তোমাকে জানিয়ে দেব তুমি চলে এস।"
অভির কথায় পুবালির বাবা আর ব্যানারজি কাকু সায় দিলেন। ব্যানারজি বললেন যে যাবার পথে পরীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন। ব্যানারজি কাকু মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পরে সমুদ্রনীলকে ফোন করে ডেকে নিল অভি। পুবালি বাবা মাথা নিচু করে বসে, অভির কাছে টাকে সান্তনা দেবার মতন কোন ভাষা নেই। সময় যেন থেমে গেছে ওদের সামনে।
অভি বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ব্যানারজি কাকুর সাথে পরী বাড়ি ফিরছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন যে যদি পরী আবার নারসিং হোমে যেতে চায় তাহলে কি করবে? অভি জানাল যে যদি পরী আসতে চায় তাহলে ও বাবাকে ফোন করে দেবে আর বাবা যেন কোন গাড়ির বন্দবস্ত করে দেয় যাতে পরী নারসিং হোমে আসতে পারে। বাবা জানালেন যে তিনি ব্যানারজি কাকুর সাথে কথা বলে নেবেন পরীর যাওয়ার ব্যাপারে।
পরের ছয় ঘন্টা যেন ওদের কাছে ছয় যুগের মতন মনে হয়। অভি আর পুবালির বাবা অতি উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে থাকে কিছু ভাল খবরের জন্য। বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ, বাড়ির সবাই নারসিং হোম পৌঁছে যায়। অরুনাকে দেখতে না পেয়ে অরুনার দাদাকে অভি ওর কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, ব্যানারজি কাকু অরুনাকে নিয়ে অভিদের বাড়িতে গেছে পরীকে নিয়ে আসতে।
কিছু পরে অভি লক্ষ্য করে যে অরুনা আর পরী নার্সিং হোমে ঢুকছে, পেছনে ব্যানারজি কাকু। অরুনার মুখ থমথমে যেন ওর ওপর দিয়ে এখুনি বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে। পরী অভির কাছে এসে পুবালির খবর জিজ্ঞেস করে, অভি মাথা নাড়িয়ে জানায় যে এখন কোন খবর ডাক্তার জানায় নি। অরুনা ওর মায়ের পাশে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে, পরী অরুনার পাশে বসে যায়। অরুনা একবার পরীর দিকে তাকায় থমথমে চোখ নিয়ে।
ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, আই.সি.ইউ থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে এসে পুবালির বাবাকে ডাকেন। সবাই ডাক্তারের দিকে উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থাকে। শেষ খবর আসে, পুবালি ব্যানার্জি, এক নিস্পাপ ফুল, খুব লাজুক মেয়ে, জীবনে হয়ত একটা মাছিও মারেনি পুবালি, সেই মিষ্টি মেয়ে যে কোনদিন কলেজে কারুর সাথে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলেনি, ঝগড়া করা ত দুরে থাক। শুভঙ্কর ব্যানা+জি আর মালা ব্যানার্জির একমাত্র কন্যা সন্তান আর এই পৃথিবীতে নেই।
চাপা ক্রন্দনের রোল জেগে ওঠে চার পাশে। বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসে মায়ের বুক থেকে। পরীর চোখে জল, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে। অরুনা পরীকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে পরে থাকে।
অভি চোয়াল শক্ত করে, হাত মুঠি করে কপালে জোরে এক কিল মারে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে ভগবানের দিকে তাকিয়ে, "শেষ পর্যন্ত আমার কথা রাখলে না তুমি।" বার বার জিজ্ঞেস করে ভগবানকে "এই পৃথিবীতে অনেক দুস্করমিরা আছে, তাদের ছেড়ে কেন এক ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়ে কে কোলে ডেকে নিল? তোমার যদি সত্যি কান থাকে তাহলে তুমি আমার কাতর প্রার্থনা শুনতে পারতে, কিন্তু হায় বিধাতা, আমার প্রার্থনা শোনার কেউ নেই।"
পরী কিছু পরে অভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, "অরুনার দিকে তাকাও।"
অরুনার দিকে তাকায় অভি, অরুনা পাথরের মতন বসে নিস্পলক চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে। চেহারা ভাবলেশহীন, চোখে কোন ভাষা নেই, দু’চোখ যেন কাঁচের তৈরি।
বাবাকে ফোন করে খবর দেয় অভি, বাবা তখন অফিস থেকে বের হবেন। অভি বাবাকে সোজা নার্সিং হোমে এসে পরীকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য অনুরধ করল, "তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাও, এখানে থাকাটা ওর ঠিক হবে না। ভাগ্যের পরিহাস যা ঘটবার সেটা ত ঘটেই গেছে। ওকে বাড়ি নিয়ে যাও বাড়িতে মায়ের কাছে ঠিক থাকবে।"
বাবা জিজ্ঞেস করলেন অভিকে, "তোর কি খবর, কাল রাত থেকে ত কোথাও যাসনি। বাড়ি ফিরবি কখন?"
অভি, "এখুনি কিছু বলতে পারছি না, দেখি কাল সকালে বাড়ি ফিরব।"
অভি পরীকে বলল, "তোমার বাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে আসছে, তাঁর সাথে তুমি বাড়ি ফিরে যাও।"
পরী অভির কলার চেপে ধরে বলে, "আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।"
অভি, "বুঝতে চেষ্টা করও, পরী। আমার বাড়ি যাবার এখন কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সত্যি কথা বলতে এখন অনেক কাজ আছে এইখানে।"
পরী, "তাহলে আমি অরুনার সাথে থাকব।"
অভি, "না তুমি ওর সাথে থাকবে না।"
পরী চেঁচিয়ে ওঠে, "কেন?"
অভি, "কাল রাত থেকে অনেক কান্নাকাটি করেছ তুমি, আর নয়। তুমি যদি ওর সাথে ওদের বাড়িতে যাও, সেখানে গিয়েও আবার কান্নার রোল শুরু হবে, তাঁর থেকে ভালো কথা বলছি তুমি বাড়ি যাও। তুমি একটু বিশ্রাম নাও বাড়ি গিয়ে তোমার ছোটমায়ের কাছে।"
পরী চাপা স্বরে বলে, "অরুনাকে দেখেছ? চোখের পাতা পড়ছে না ওর, পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা। ও যদি না কাঁদে তাহলে খুব বড় আরেকটা বিপদ হবে। আমাকে ওর কাছে থাকতে দাও।"
অভি, "আমি দেখি কি করতে পারি, কিন্তু তুমি এখন বাড়ি যাবে। অরুনার সাথে ওর বাবা মা আছেন ওকে দেখার জন্য, এখানে আমি কিছু পরে ব্যাস্ত হয়ে যাব তখন তোমাকে দেখার কেউ থাকবে না।"
সবার সামনে এক নতুন সমস্যা দেখা দিল, অরুনা। ও যদি না কাঁদে বা কিছু না বলে তাহলে আরেক বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না।
কিছু পরে অভি আর অরুনার দাদা একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করে ফিরে এল। বাড়ির দিকে পুবালির শেষ যাত্রা।
পুবালির দেহ যখন ওদের সামনে আনা হয়, তখন অরুনা চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধিরে ধিরে পুবালির গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মনে হয় যেন ডাকছে পুবালিকে চোখ খোলার জন্য, কিন্তু ওর গলা থেকে কোন আওয়াজ বার হয় না। একবারের জন্যেও অরুনার চোখের পাতা পরে না বাঁ ঠোঁট কাপে না। নিস্পলক ভাবে চেয়ে থাকে পুবালির বন্ধ চোখের দিকে। ধিরে ধিরে পুবালির মুখের ওপরে ঝুঁকে পরে, কপালে ছোটো একটা চুমু খায় আর গলায় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। পাথরের মতন গলা জড়িয়ে পরে থাকে অরুনা। অরুনার এই ব্যাবহার দেখে সবার বুকের ভেতরে এক নতুন ভয় জাগে। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে অরুনাকে উঠানোর জন্য। পরী অরুনার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ওর পিঠে হাত রাখে। পরীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে অরুনা ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে তাকায় পরীর দিকে। চোখে জল নেই, চেহারায় কোন বিকার নেই, অরুনা যেন এক পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। পরীর সাথে চুপ করে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসে পরে।
কিছু পরে বাবা পৌঁছে যান নারসিং হোমে আর পরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ব্যানার্জি কাকু বললেন যে এবারে ওদের বাড়ির দিকে যাত্রা করা উচিত।
বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল পুবালির দেহ। সাদা ফুলে আর মভ রঙের শাড়িতে সাজান হল পুবালিকে। পুর সময়াটা অরুনা চুপ করে পুবালির দেহের পাশে বসে থাকে। পুবালির প্রাণহীন হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে দেয়। দেখে মনে হয় যেন এই ওর বোন আবার জেগে উঠে ওর সাথে কথা বলবে। কিন্তু হায় বিধাতা, পুবালি যে চির নিদ্রায় মগ্ন।
বাড়ি থেকে যখন ওকে নিয়ে বের হবে সবাই, তখন অভি লক্ষ্য করে কলেজের বন্ধুদের। বিদায়ের শেষ ক্ষণ উপস্থিত। পুবালির অন্তিম যাত্রা। বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল জেগে ওঠে, অরুনাকে জড়িয়ে ধরে অরুনার মা কেঁদে ওঠেন। কিন্তু অরুনা নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে পুবালির মুখের দিকে, চোখে জল নেই, অতি শিতল সেই চোখের চাহনি। অভি এবং বাকিরা পুবালিকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে আসে। অরুনা চুপ করে বাড়ির গেট পর্যন্ত ওদের সাথে আসে তারপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পুবালিকে গাড়িতে তোলা না হয়। তারপরে অরুনা ফিরে যায় বাড়ির মধ্যে, নিজের ঘরে ঢুকে পরে বিছানায় শুয়ে পরে। বাড়ির বেশির ভাগ মহিলাদের নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় না।
নিস্পাপ ফুলের কুঁড়ি, পুবালি ব্যানারজির নস্বর দেহ আগুনে জ্বলে পঞ্চভুতে বিলীন হয়ে যায়। সেইদিন অভি তাঁর জীবনের সবথেকে মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখের সামনে দেখে, স্নেহ ভরা বুকে নিয়ে এক পিতা তাঁর চোখের মণি একমাত্র কন্যের মুখাগ্নি করছেন। ভগবানের কাছে কাতর আবেদন জানায় অভি, যেন কোন পিতাকে তাঁর কন্যার মুখাগ্নি না করতে হয়।
সমুদ্রনীল আর অভি চুপচাপ দুজনে গঙ্গার তীরে বসে রাতের আকাশের তারা দেখতে থাকে।
সমুদ্রনীল অভিকে জিজ্ঞেস করে, "অরুনা যদি কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে কি হবে? ও ত পাগল হয়ে যাবে, আরও বড় কোন বিপদ ঘটবে।"
অভি, "তুই ওকে ভালোবাসিস, তোকেই কিছু করতে হবে।"
সমুদ্রনীল, "আমি কি করতে পারি, তুই ওকে আমার চেয়ে ভাল করে চিনিস। পুবালির পরে শুচিদি ওর সব থেকে কাছের মানুষ। যদি কিছু করতে পারিস সেটা তোরাই করতে পারিস।"
অভি চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে যে ওদের কেউ দেখছে কিনা। পরিবারের বাকি লোকজন, কিছু দুরে একটা ছাওনির তলায় বসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে অভি,
"তুমি আমার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ, আমার আঁকা, আমার কবিতা, আমার লেখা। তুমি আমার জীবনের সব থেকে ভাল বন্ধুর বোনকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ। তুমি আমার কাছ থেকে আর কি চাও? শেষ বারের জন্য তোমার সামনে প্রার্থনা করছি যে আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা। যদি সেটাও চলে যায় তাহলে আমি জানব যে এই জগতে ভগবান বলে কিছু নেই, আছে শুধু পাথরের এক মূর্তি। শুধু একবারের জন্য প্রমান কর যে তুমি সত্যি আছো।"