27-02-2019, 05:31 PM
মেনকার রথ
সকালের রোদ বড় মিষ্টি, মৃদু মন্দ বাতাসে বইছে, বাতাসে ঠাণ্ডার লেশ নেই। সকালের খাওয়ার পরে বাড়ির মধ্যে যেন কান্নার আভাস ওঠে। পরী আর তাঁর ছোটো মা, দু’জনের চেহারায় ভারী বেদনার ছায়া। মা পরীকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে, পরী চুপ করে ব্যাগ গুছাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চোখের কোল মুছছে।
অভি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে কিছুক্ষণ, তারপরে মায়ের আর পরীর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলে, "এত দুঃখ কিসের জন্যে?"
দুজনেই অভির দিকে ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়, দুজনেই বাক্যহীন। মাকে বলল, "মা, তোমার পরী তোমাকে ছেড়ে ত যাচ্ছে না, এই বাসন্তি পুজোর পরে ও ত তোমার কাছেই আসছে। আর তুমি ত যখন ইচ্ছে দিদার বাড়ি যেতে পারো।"
মা অভির গালে আদর করে বলে, "বাবা, এখন বাবা হওনি ত তাই বলছ। বাবা মা হলে বুঝতে আমার কষ্ট।"
পরী মায়ের দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, "তুমি আমাকে কথা দিয়েছ যে কলেজের পরে আমাদের বাড়ি আসবে আমার সাথে দেখা করতে।"
মা পরীর মুখ আঁজলা করে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে বলল, "হ্যাঁ মা আমি তোর সাথে দেখা করতে যাব।"
সারা বাড়িতে যেন এক ব্যাথার ছায়া। মৈথিলীর আচরন আমুল বদলে গেছে কাল রাত্রের ঘটনার পরে। অভি যত বার ওর দিকে তাকায়, মৈথিলী ওর সাথে চোখ মেলায় না।
সুব্রত অভির কাছে এসে বলে, "মামা আসছি, আমাদের বাড়িতে এসো।"
অভি উত্তর দিল, "দিদাকে আমার প্রনাম দিও", পরীর দিকে তাকিয়ে সুব্রতকে বলল, "আর আমাকে যেতে ত হবেই।"
মা অভিকে ওদের কে বাস স্টান্ডে ছেড়ে আসতে বললেন, আর তারপরে অরুনিমাকে ওর বাড়ি ছেড়ে আসতে বললেন। অরুনিমা মায়ের কথা শুনে অভির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অভি আর পরী, দু’জনে নিরুপায়, সর্বসমক্ষে কেউ কাউকে ঠিক ভাবে বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারছে না। বড় ব্যাথা নিয়ে দুজনে একে অপরকে দেখে যায়। পরীর চোখ ছলছল, বাস এসে গেল।
শেষ পর্যন্ত পরী ওর কাছে এসে নিচু গলায় চোখ টিপে বলল, "ভাল ভাবে পড়াশুনা কোরো, তোমার জন্য না করলেও আমার জন্য ভালো রেসাল্ট কোরো, আর অপ্টিস্কের বইটা ভাল করে দেখবে।"
বাসে উঠে পড়ার আগে বাকিদের চোখ এড়িয়ে হটাত করে বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের ভিজিয়ে অভির গালে লাগিয়ে দিল। অভি হাত বাড়িয়ে পরীকে ছুঁতে চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে পরী বাসে উঠে পরে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে ওঠে অভির। নিজের গালে পরীর লালা লেগে, বড় মধুর সেই অনুভব। সুব্রতদের পেছনের সিটে জানালার ধারে বসে পরী, বাস ছেড়ে দেওয়ার আগে, বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে, ডগায় একটা আলতো চুমু খেয়ে অভির দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাস ছেড়ে দেয়, অভি ওর ছুঁড়ে দেওয়া চুমুটা হাওয়া থেকে টেনে নিয়ে পকেটের মধ্যে পুরে নেয়।
বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে অপ্টিস্কের বই খোলে। পরীর চোখ টেপার ইশারা, অভি নিশ্চিত যে পরী অপ্টিস্কের বইয়ের পাতায় কিছু রেখে গেছে। বইয়ের ভেতর পনের নাম্বার পাতায় খুব ছোটো অক্ষরে লেখা।
"মিস ইউ, ছোট্ট রাজকুমার। কল্যাণীর ফোন নাম্বার xxx-xxxx। ফোন কোরো, আমি অপেক্ষা করে থাকব।"
সেই একটা ছোটো লাইন অনেক কিছু অভির কাছে, সারা ঘরের মধ্যে যেন পরীর গন্ধ আর ছোঁয়া খুঁজে পেল অভি।
অরুনিমা ফিরে যাবার জন্য তৈরি। মা অভিকে বললেন যে ওদের বাড়ি গিয়ে যেন ওর ভদ্রতার খাতিরে ওর বাবা মায়ের সাথেও দেখা করে আসে।
ট্যাক্সি তে পাশাপাশি বসে, অভি অরুনিমার দিকে তাকাল। পরনে একটা হাঁটু পর্যন্ত সাদা জিন্স আর গাড় নীল রঙের টাইট টপ। জিন্স টা যেন অত্যধিক ভাবে ওর কোমরের নিচের অঙ্গের সাথে আঠার মতন লেপটে আছে আর টপের অবস্থাও সেই একি রকমের। গোলাপের কুঁড়ি যেন অভির পাশে বসে। মাঝে মাঝে অভির চোখ চলে যায় ওর ফুটন্ত শরীরের দিকে, অরুনিমা ওর পাশে বসে ওর দিকে আময়িক হাসে। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ চাপ, অভির মনে পরীর কাছ থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার বেদনা যেন এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল।
অরুনিমা, "তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ?"
অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "কই না ত।"
অরুনিমা, "তাহলে এত দিনে আমাকে ফোন কেন করলে না?"
অভি, "হুম, তোমার দেওয়া কাগজ টা আমার সুটের পকেটে ছিল, আর বিয়ে থেকে আসার পরে মা সুট টা ড্রাই ক্লিনিঙ্গে দিয়ে দিল তাই তারপরে কাগজ টা হারিয়ে গেল। কিন্তু..."
অরুনিমা, "কিন্তু কি?"
অভি, "কিন্তু তুমি আমার ফোনের অপেক্ষায় কেন ছিলে?"
অরুনিমা, "কেন ভদ্রতার খাতিরে কি একবার ফোন করতে নেই? তুমি কেমন ভদ্রলোক অভিমন্যু কেমন করে মহিলার মন জয় করতে হয় তাও জানো না?"
অভি মনে মনে বলে, "আমাকে শিখাতে যেও না, কেমন করে মেয়েদের মন জয় করতে হয়।"
অভি ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। অরুনিমা ওর পাশে সরে এসে বসল। কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে গেল, বাজুর সাথে ওর বাজু। দু’হাত কোলের ওপরে জড় করে রাখা। অরুনিমা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে, অভি ওই হাসি দেখে হেরে যায়।
অভি, "আচ্ছা বাবা তুমি জিতলে।"
অরুনিমার চোখে আহবানের মৃদুহাসি, "কি জিতলাম, শুধু একটা ফোন কল, তাও ভদ্রতার জন্য?"
অভি, "তুমি আমাকে চেন না, আমি কে, আমি কি।"
মিষ্টি হেসে অরুনিমা অভির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "সবকিছু কখন না কখন জীবনে প্রথম বার হয়, তাই না। আমাদের চেনা পরিচয় হতে দোষ কি? আমি অরুনিমা, আমাকে তুমি তুলি বলে ডেক।"
অভি ওর হাত হাতে নিয়ে করমর্দন করল। অরুনিমার যেন হাতটা টেনে নেওয়ার ইচ্ছে নেই, রেখে দেয় অভির হাতের ওপরে। অভির মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল, দেখা যাক এই সেদিনের মেয়ে কি করতে পারে। একটু অভিনয় করেই দেখা যাক, জল কত দূর গড়ায়।
অভি, "তুমি আমার নাম ভাল করে জানো।"
কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল, "তুলি আমি জানি তুমি গতকাল কেন আমার বাড়িতে এসেছিলে।"
অরুনিমা ধরা পরে গেছে এমন ভান করে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। অভির দৃষ্টি অরুনিমার ঠোঁটে, নাকে আর মুখের দিকে নিবদ্ধ।
অরুনিমা কিছুক্ষণ পরে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "কাল রাতে খাওয়ার সময়ে তুমি খুব চুপচাপ ছিলে, কেন কারন কি?"
দীর্ঘশ্বাস ছারল অভি, "মা আর পরীকে কাঁদতে দেখে মন একটু খারাপ হয়ে গেছিল তাই চুপচাপ ছিলাম আমি।"
অরুনিমার পরের প্রশ্ন বান অভিকে বিঁধে দিল, "কাল রাতে তোমার ঘর থেকে ফেরার পরে চুরনিদি খুব চুপচাপ ছিল? কি ব্যাপার।"
অভি অরুনিমার চোখের দিকে তাকাল, বুঝতে চেষ্টা করল যে অরুনিমা কি জানে গত কাল রাতের ঘটনা। গম্ভির আওয়াজে উত্তর দিল, "ওকে জিজ্ঞেস করে নিও, আমি কি করে বলব।"
অরুনিমা নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল, "আমি আমার দিদি কে চিনি।"
অভি অবাক হয়ে গেল উত্তর শুনে, এবারে ওর কি কর্তব্য। অরুনিমা বলল, "আমার বড়দি, আমি বিগত আঠার বছর ধরে চুরনিদি কে চিনি।"
চিবুকে হাত রেখে ভাবতে শুরু করে অভি, দুই বোনে মিলে কি করতে চলেছে। ট্যাক্সি তখন শিয়ালদা রেল স্টেসান পার করে এ.যে.সি বোস রোড ধরে এগোচ্ছে।
অরুনিমা, "গত পাঁচ বছরে আমি চুরচনিদি কে খুব ভাল ভাবে চিনেছি, বিশেষ করে সুব্রত জিজুর সাথে দেখা হওয়ার পরে। আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যাবধান থাকতে পারে, চুরনিদি পঁচিশ আর আমি উনিশ কিন্তু আমরা দুজনে খুব কাছের মানুষ। আমার দিদি সত্যি খুব মিষ্টি আর সুন্দরী আর জিজুর ত কথাই আলাদা। ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালবাসে।"
না অভি ওর কথার কোন মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছে না, কি বলতে চাইছে অরুনিমা।
অরুনিমা, "ওরা দুজনেই আমার সম্পর্কের ব্যাপারে খুব চিন্তিত, ওরা চাইত যে এমন কারুর সাথে আমার সম্পর্ক হোক যে ওদেরও খুব কাছের আর চেনা জানা লোক হবে।"
অভি এতক্ষণে কিছু বুঝে উঠতে পারল, "আচ্ছা তাই আমাকে নিয়ে টানাটানি।"
গাল লাল হয়ে গেল অরুনিমার, হেসে ফেলল, "হ্যাঁ তাই।"
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি তোমার দিদির ব্যপারে আর কিছু বলতে চাও আমাকে?"
অরুনিমা, "আগে তুমি বলো যে গতকাল রাতে কি হয়েছে? চুরনিদি কেন চুপ ছিল কিন্তু ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল যে মনের মধ্যে খই ফুটছে? তুমি যদি আমাকে বলো তাহলে আমি জানাব চুরনিদির ব্যাপারে।"
"হুম তাহলে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে, সাপ আর বেজির খেলা। দেখা যাক এই খেলায় কে যেতে আর কে হারে" আপনমনে বলল অভি, "আমি সাধারন বাঙালি ছেলে নই যা তুমি ভাবছ। আমি কিন্তু আগুনে ঝাপ দেবার জন্য সবসময়ে তৎপর, সুতরাং আমার সাথে খেলার আগে যাচাই করে নেবে একটু যে আগুনের খেলা কার সাথে খেলছ।"
না, অভি অরুনিমাকে সাবধান করে নি, নিজের মনে বলেছে। দাতে দাঁত পিষে অরুনিমাকে গম্ভির স্বরে উত্তর দিল, "এত জানার ইচ্ছে থাকলে তোমার চুরনিদিকে জিজ্ঞেস করে নিও।"
গাড়ি ঢাকুরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অভির আর ইচ্ছে করল না যে অরুনিমার বাড়িতে যায়, তাই ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "যদি কিছু মনে না কর তাহলে আজ আর তোমার বাড়ি যাব না, তোমাকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আমি ফিরে যাব।"
একটা দুষ্টুমিষ্টি হাসি হেসে অরুনিমা বলে, "তুমি যদি আমার বাড়ি না আস তাহলে আমি তোমার মাকে ফোন করে বলে দেব যে তুমি আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছো। সেটা কি ভাল হবে?"
উত্তরে অভি হেসে বলে, "ব্লাকমেল করছ আমাকে?"
"দেখা যাক কি হয়, হাত না পুড়লে হল।" মনে মনে ভাবল অভি।
বাড়িতে গিয়ে ছাড়তে হল অরুনিমাকে, দেখা করতে হল অরুনিমার বাবা মায়ের সাথে। অরুনিমার পরিবার বেশ সচ্ছল আর রুচিসম্পন্ন। চা খেতে খেতে গল্পের মাঝে জানা গেল যে অরুনিমার এক ভাই, আরুনাভ ক্লাস এইটে পড়ে। অরুনিমার বাবা রাইটারসে চাকরি করেন আর মা গৃহবধু। মৈথিলী অরুনিমার জেঠুর মেয়ে, কলেজের পড়াশুনা ঢাকুরিয়া থেকে করেছে আর সেই সময়ে তুলি আর চুরনি এঁকে ওপরের কাছাকাছি এসেছে। চুরনি তুলি কে নাকি খুব ভালবাসে।
সকালের রোদ বড় মিষ্টি, মৃদু মন্দ বাতাসে বইছে, বাতাসে ঠাণ্ডার লেশ নেই। সকালের খাওয়ার পরে বাড়ির মধ্যে যেন কান্নার আভাস ওঠে। পরী আর তাঁর ছোটো মা, দু’জনের চেহারায় ভারী বেদনার ছায়া। মা পরীকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে, পরী চুপ করে ব্যাগ গুছাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চোখের কোল মুছছে।
অভি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে কিছুক্ষণ, তারপরে মায়ের আর পরীর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলে, "এত দুঃখ কিসের জন্যে?"
দুজনেই অভির দিকে ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়, দুজনেই বাক্যহীন। মাকে বলল, "মা, তোমার পরী তোমাকে ছেড়ে ত যাচ্ছে না, এই বাসন্তি পুজোর পরে ও ত তোমার কাছেই আসছে। আর তুমি ত যখন ইচ্ছে দিদার বাড়ি যেতে পারো।"
মা অভির গালে আদর করে বলে, "বাবা, এখন বাবা হওনি ত তাই বলছ। বাবা মা হলে বুঝতে আমার কষ্ট।"
পরী মায়ের দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, "তুমি আমাকে কথা দিয়েছ যে কলেজের পরে আমাদের বাড়ি আসবে আমার সাথে দেখা করতে।"
মা পরীর মুখ আঁজলা করে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে বলল, "হ্যাঁ মা আমি তোর সাথে দেখা করতে যাব।"
সারা বাড়িতে যেন এক ব্যাথার ছায়া। মৈথিলীর আচরন আমুল বদলে গেছে কাল রাত্রের ঘটনার পরে। অভি যত বার ওর দিকে তাকায়, মৈথিলী ওর সাথে চোখ মেলায় না।
সুব্রত অভির কাছে এসে বলে, "মামা আসছি, আমাদের বাড়িতে এসো।"
অভি উত্তর দিল, "দিদাকে আমার প্রনাম দিও", পরীর দিকে তাকিয়ে সুব্রতকে বলল, "আর আমাকে যেতে ত হবেই।"
মা অভিকে ওদের কে বাস স্টান্ডে ছেড়ে আসতে বললেন, আর তারপরে অরুনিমাকে ওর বাড়ি ছেড়ে আসতে বললেন। অরুনিমা মায়ের কথা শুনে অভির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অভি আর পরী, দু’জনে নিরুপায়, সর্বসমক্ষে কেউ কাউকে ঠিক ভাবে বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারছে না। বড় ব্যাথা নিয়ে দুজনে একে অপরকে দেখে যায়। পরীর চোখ ছলছল, বাস এসে গেল।
শেষ পর্যন্ত পরী ওর কাছে এসে নিচু গলায় চোখ টিপে বলল, "ভাল ভাবে পড়াশুনা কোরো, তোমার জন্য না করলেও আমার জন্য ভালো রেসাল্ট কোরো, আর অপ্টিস্কের বইটা ভাল করে দেখবে।"
বাসে উঠে পড়ার আগে বাকিদের চোখ এড়িয়ে হটাত করে বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের ভিজিয়ে অভির গালে লাগিয়ে দিল। অভি হাত বাড়িয়ে পরীকে ছুঁতে চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে পরী বাসে উঠে পরে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে ওঠে অভির। নিজের গালে পরীর লালা লেগে, বড় মধুর সেই অনুভব। সুব্রতদের পেছনের সিটে জানালার ধারে বসে পরী, বাস ছেড়ে দেওয়ার আগে, বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে, ডগায় একটা আলতো চুমু খেয়ে অভির দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাস ছেড়ে দেয়, অভি ওর ছুঁড়ে দেওয়া চুমুটা হাওয়া থেকে টেনে নিয়ে পকেটের মধ্যে পুরে নেয়।
বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে অপ্টিস্কের বই খোলে। পরীর চোখ টেপার ইশারা, অভি নিশ্চিত যে পরী অপ্টিস্কের বইয়ের পাতায় কিছু রেখে গেছে। বইয়ের ভেতর পনের নাম্বার পাতায় খুব ছোটো অক্ষরে লেখা।
"মিস ইউ, ছোট্ট রাজকুমার। কল্যাণীর ফোন নাম্বার xxx-xxxx। ফোন কোরো, আমি অপেক্ষা করে থাকব।"
সেই একটা ছোটো লাইন অনেক কিছু অভির কাছে, সারা ঘরের মধ্যে যেন পরীর গন্ধ আর ছোঁয়া খুঁজে পেল অভি।
অরুনিমা ফিরে যাবার জন্য তৈরি। মা অভিকে বললেন যে ওদের বাড়ি গিয়ে যেন ওর ভদ্রতার খাতিরে ওর বাবা মায়ের সাথেও দেখা করে আসে।
ট্যাক্সি তে পাশাপাশি বসে, অভি অরুনিমার দিকে তাকাল। পরনে একটা হাঁটু পর্যন্ত সাদা জিন্স আর গাড় নীল রঙের টাইট টপ। জিন্স টা যেন অত্যধিক ভাবে ওর কোমরের নিচের অঙ্গের সাথে আঠার মতন লেপটে আছে আর টপের অবস্থাও সেই একি রকমের। গোলাপের কুঁড়ি যেন অভির পাশে বসে। মাঝে মাঝে অভির চোখ চলে যায় ওর ফুটন্ত শরীরের দিকে, অরুনিমা ওর পাশে বসে ওর দিকে আময়িক হাসে। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ চাপ, অভির মনে পরীর কাছ থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার বেদনা যেন এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল।
অরুনিমা, "তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ?"
অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "কই না ত।"
অরুনিমা, "তাহলে এত দিনে আমাকে ফোন কেন করলে না?"
অভি, "হুম, তোমার দেওয়া কাগজ টা আমার সুটের পকেটে ছিল, আর বিয়ে থেকে আসার পরে মা সুট টা ড্রাই ক্লিনিঙ্গে দিয়ে দিল তাই তারপরে কাগজ টা হারিয়ে গেল। কিন্তু..."
অরুনিমা, "কিন্তু কি?"
অভি, "কিন্তু তুমি আমার ফোনের অপেক্ষায় কেন ছিলে?"
অরুনিমা, "কেন ভদ্রতার খাতিরে কি একবার ফোন করতে নেই? তুমি কেমন ভদ্রলোক অভিমন্যু কেমন করে মহিলার মন জয় করতে হয় তাও জানো না?"
অভি মনে মনে বলে, "আমাকে শিখাতে যেও না, কেমন করে মেয়েদের মন জয় করতে হয়।"
অভি ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। অরুনিমা ওর পাশে সরে এসে বসল। কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে গেল, বাজুর সাথে ওর বাজু। দু’হাত কোলের ওপরে জড় করে রাখা। অরুনিমা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে, অভি ওই হাসি দেখে হেরে যায়।
অভি, "আচ্ছা বাবা তুমি জিতলে।"
অরুনিমার চোখে আহবানের মৃদুহাসি, "কি জিতলাম, শুধু একটা ফোন কল, তাও ভদ্রতার জন্য?"
অভি, "তুমি আমাকে চেন না, আমি কে, আমি কি।"
মিষ্টি হেসে অরুনিমা অভির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "সবকিছু কখন না কখন জীবনে প্রথম বার হয়, তাই না। আমাদের চেনা পরিচয় হতে দোষ কি? আমি অরুনিমা, আমাকে তুমি তুলি বলে ডেক।"
অভি ওর হাত হাতে নিয়ে করমর্দন করল। অরুনিমার যেন হাতটা টেনে নেওয়ার ইচ্ছে নেই, রেখে দেয় অভির হাতের ওপরে। অভির মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল, দেখা যাক এই সেদিনের মেয়ে কি করতে পারে। একটু অভিনয় করেই দেখা যাক, জল কত দূর গড়ায়।
অভি, "তুমি আমার নাম ভাল করে জানো।"
কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল, "তুলি আমি জানি তুমি গতকাল কেন আমার বাড়িতে এসেছিলে।"
অরুনিমা ধরা পরে গেছে এমন ভান করে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। অভির দৃষ্টি অরুনিমার ঠোঁটে, নাকে আর মুখের দিকে নিবদ্ধ।
অরুনিমা কিছুক্ষণ পরে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "কাল রাতে খাওয়ার সময়ে তুমি খুব চুপচাপ ছিলে, কেন কারন কি?"
দীর্ঘশ্বাস ছারল অভি, "মা আর পরীকে কাঁদতে দেখে মন একটু খারাপ হয়ে গেছিল তাই চুপচাপ ছিলাম আমি।"
অরুনিমার পরের প্রশ্ন বান অভিকে বিঁধে দিল, "কাল রাতে তোমার ঘর থেকে ফেরার পরে চুরনিদি খুব চুপচাপ ছিল? কি ব্যাপার।"
অভি অরুনিমার চোখের দিকে তাকাল, বুঝতে চেষ্টা করল যে অরুনিমা কি জানে গত কাল রাতের ঘটনা। গম্ভির আওয়াজে উত্তর দিল, "ওকে জিজ্ঞেস করে নিও, আমি কি করে বলব।"
অরুনিমা নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল, "আমি আমার দিদি কে চিনি।"
অভি অবাক হয়ে গেল উত্তর শুনে, এবারে ওর কি কর্তব্য। অরুনিমা বলল, "আমার বড়দি, আমি বিগত আঠার বছর ধরে চুরনিদি কে চিনি।"
চিবুকে হাত রেখে ভাবতে শুরু করে অভি, দুই বোনে মিলে কি করতে চলেছে। ট্যাক্সি তখন শিয়ালদা রেল স্টেসান পার করে এ.যে.সি বোস রোড ধরে এগোচ্ছে।
অরুনিমা, "গত পাঁচ বছরে আমি চুরচনিদি কে খুব ভাল ভাবে চিনেছি, বিশেষ করে সুব্রত জিজুর সাথে দেখা হওয়ার পরে। আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যাবধান থাকতে পারে, চুরনিদি পঁচিশ আর আমি উনিশ কিন্তু আমরা দুজনে খুব কাছের মানুষ। আমার দিদি সত্যি খুব মিষ্টি আর সুন্দরী আর জিজুর ত কথাই আলাদা। ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালবাসে।"
না অভি ওর কথার কোন মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছে না, কি বলতে চাইছে অরুনিমা।
অরুনিমা, "ওরা দুজনেই আমার সম্পর্কের ব্যাপারে খুব চিন্তিত, ওরা চাইত যে এমন কারুর সাথে আমার সম্পর্ক হোক যে ওদেরও খুব কাছের আর চেনা জানা লোক হবে।"
অভি এতক্ষণে কিছু বুঝে উঠতে পারল, "আচ্ছা তাই আমাকে নিয়ে টানাটানি।"
গাল লাল হয়ে গেল অরুনিমার, হেসে ফেলল, "হ্যাঁ তাই।"
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি তোমার দিদির ব্যপারে আর কিছু বলতে চাও আমাকে?"
অরুনিমা, "আগে তুমি বলো যে গতকাল রাতে কি হয়েছে? চুরনিদি কেন চুপ ছিল কিন্তু ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল যে মনের মধ্যে খই ফুটছে? তুমি যদি আমাকে বলো তাহলে আমি জানাব চুরনিদির ব্যাপারে।"
"হুম তাহলে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে, সাপ আর বেজির খেলা। দেখা যাক এই খেলায় কে যেতে আর কে হারে" আপনমনে বলল অভি, "আমি সাধারন বাঙালি ছেলে নই যা তুমি ভাবছ। আমি কিন্তু আগুনে ঝাপ দেবার জন্য সবসময়ে তৎপর, সুতরাং আমার সাথে খেলার আগে যাচাই করে নেবে একটু যে আগুনের খেলা কার সাথে খেলছ।"
না, অভি অরুনিমাকে সাবধান করে নি, নিজের মনে বলেছে। দাতে দাঁত পিষে অরুনিমাকে গম্ভির স্বরে উত্তর দিল, "এত জানার ইচ্ছে থাকলে তোমার চুরনিদিকে জিজ্ঞেস করে নিও।"
গাড়ি ঢাকুরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অভির আর ইচ্ছে করল না যে অরুনিমার বাড়িতে যায়, তাই ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "যদি কিছু মনে না কর তাহলে আজ আর তোমার বাড়ি যাব না, তোমাকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আমি ফিরে যাব।"
একটা দুষ্টুমিষ্টি হাসি হেসে অরুনিমা বলে, "তুমি যদি আমার বাড়ি না আস তাহলে আমি তোমার মাকে ফোন করে বলে দেব যে তুমি আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছো। সেটা কি ভাল হবে?"
উত্তরে অভি হেসে বলে, "ব্লাকমেল করছ আমাকে?"
"দেখা যাক কি হয়, হাত না পুড়লে হল।" মনে মনে ভাবল অভি।
বাড়িতে গিয়ে ছাড়তে হল অরুনিমাকে, দেখা করতে হল অরুনিমার বাবা মায়ের সাথে। অরুনিমার পরিবার বেশ সচ্ছল আর রুচিসম্পন্ন। চা খেতে খেতে গল্পের মাঝে জানা গেল যে অরুনিমার এক ভাই, আরুনাভ ক্লাস এইটে পড়ে। অরুনিমার বাবা রাইটারসে চাকরি করেন আর মা গৃহবধু। মৈথিলী অরুনিমার জেঠুর মেয়ে, কলেজের পড়াশুনা ঢাকুরিয়া থেকে করেছে আর সেই সময়ে তুলি আর চুরনি এঁকে ওপরের কাছাকাছি এসেছে। চুরনি তুলি কে নাকি খুব ভালবাসে।