Thread Rating:
  • 20 Vote(s) - 3.4 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Thriller দ্বিতীয় অঙ্ক by pinuram (Complete)
#13
ষষ্ঠ পর্বঃ আতঙ্কিত আর্তনাদ। (#3)

ঝিলামকে জোর করার ক্ষমতা নেই বুধাদিত্যর, তাই খাওয়ার প্রতি মন উঠে যায়। ঝিলাম ওর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য কোনোরকমে ভাত মাখতে শুরু করে।

ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিছু খেয়ে নাও, না হলে শরীর খারাপ করবে।”

ঝিলাম কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয়, “খেয়ে আর কি হবে। তোমার জন্য জল নিয়ে আসি, তুমি খাও।”

ঝিলাম জল আনতে চলে যায়। বুধাদিত্যের খাওয়া আর হয়না। ঝিলাম জলের গ্লাস হাতে এসে দেখে ভাত পরে আছে, বুধাদিত্য মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে। ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কি হল, খাও?”

বুধাদিত্য মাথা তুলে বলে, “না খিদে মরে গেছে আমার।”

ঝিলাম একটু কড়া গলায় ওকে আদেশ করে, “চুপচাপ খেয়ে নাও, আমার কথা চিন্তা করে কোন লাভ নেই তোমার।”

বুধাদিত্য চুপ করে কয়েক গ্রাস ভাত মুখে তোলে। ঝিলাম সেই দেখে একটু হেসে শোয়ার ঘরে ঢুকে যায়। ঝিলাম চলে যাওয়া মাত্রই বুধাদিত্য থালা নিয়ে উঠে পরে। রান্না ঘরে গিয়ে সব খাবার ডাস্টবিনে ঢেলে থালা সিঙ্কে রেখে দেয়। ফ্রিজ থেকে এক বোতল হুইস্কি আর বরফ বার করে। ফ্রিজের ওপরে ওর কাট গ্লাস সবসময়ে রাখা থাকে। সেই কাট গ্লাসে বরফ ঢেলে হুইস্কি ঢেলে নেয়। বোতল, বরফ আর গ্লাস নিয়ে সোফার ওপরে বসে পরে। সামনে টিভি চলছে, ডিস্কভারি চ্যানেলে সেই পুরানো সেরেঙ্গেটি। এক দল সিংহ একটি হরিণ ধরে তাকে খাবলে খুবলে খায়। বুধাদিত্য হুইস্কির গ্লাসে ছোটো ছোটো চুমুক দেয়।

ঠিক সেই সময়ে ঝিলাম ওর পাশের সোফার ওপরে এসে বসে। ঝিলামকে বসতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসে বুধাদিত্য। ঝিলাম কিছুক্ষণ ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে টিভির দিকে। ড্রয়িং রুমের মৃদু আলোতে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে ঝিলামের সুন্দর গোল মুখখানি অসামান্য বেদনায় মাখা। চোখ দুটি ফাঁকা ভাষা হীন, ঠোঁট দুটি শুকিয়ে গেছে, চোখের কোনে যেন একটু কালি পরে গেছে।

ঝিলাম ওর দিকে তাকিয়ে বেদনা ভরা চোখে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কি ছাইপাশ গেল বলতে পার? কি আছে এই মদে?”

বুধাদিত্যের গ্লাস হাতেই থেমে যায়, কি উত্তর দেবে। টিভির দিকে মুখ করে উত্তর দেয়, “জানি না কি আছে, তবে এর স্বাদ অন্য। তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।”

হটাত করে ঝিলাম বুধাদিত্যের সামনে রাখা মদের বোতল হাতে নিয়ে বলে, “আজ আমি খাব, দেখব কি নেশা আছে এই মদে। কত শান্তি পাও এই সব ছাইপাস গিলে।”

হকচকিয়ে যায় বুধাদিত্য আঁতকে ওঠে, “না তোমাকে খেতে দিতে পারিনা। তুমি খেও না ঝিলাম।”

ঝিলাম বোতল ঠোঁটের কাছে এনে রেগে দুঃখে গঙ্গিয়ে ওঠে, “কেন, আমি কেন খেতে পারিনা, তোমরা খেলে কিছু না, আমি খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”

বুধাদিত্য ওর হাত ধরে ফেলে, “তুমি খাওনি কোন দিন, তুমি খেওনা এই সব।”

ঝিলাম ওর হাতের কবল থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে, চেঁচিয়ে বলে, “সবকিছুর প্রথম বার বলে কিছু আছে। আজ আমি খাবো, আজ এর স্বাদ নিয়ে দেখতে চাই, কি মধু এই মদে।”

বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে পরে ঝিলামের সামনে। বোতলের ওপরে শক্ত করে ধরে থাকে। ঝিলাম দাঁড়িয়ে পরে ওর সামনে বোতল কিছুতেই ছাড়ে না। ওর মাথায় রক্ত চেপে গেছে। আজ যেন ঝিলামের দেহে দেবীর শক্তি ভর করে এসেছে। শক্ত করে ঠোঁটের কাছে ধরে থাকে বোতল। বুধাদিত্য একটানে বোতল ছিনিয়ে নেয়, ঝিলাম বোতল ধরতে গিয়ে ওর বুকের ওপরে পরে যায়।

ঝিলাম কেঁদে ফেলে, “তোমরা খেতে পার, তোমরা সব কিছু করতে পার আর আমি খেলে দোষ?”

বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে। বুকের মাঝে তোলপাড় হয়ে যায়, বুকের ওপরে টিশার্টএর কলার চেপে ধরে ঝিলাম। মাথা ঝিমঝিম করে বুধাদিত্যের। ছুঁড়ে ফেলে দেয় মদের বোতল, মেঝেতে পরে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে যায় কাঁচের বোতল, ছড়িয়ে পরে মদ আর কাঁচের টুকরো।

বুধাদিত্য ঝিলামকে নিচু গলায় বলে, “আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ঝিলাম, আজ থেকে আমি আর মদ ছোঁব না।”

কলার ছেড়ে মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, “যার প্রতিজ্ঞার অপেক্ষায় আমি, সে করে না কেন? বল আমাকে, উত্তর দাও।”

কি উত্তর দেবে বুধাদিত্য, তাও স্বান্তনা দেয় ঝিলামকে, “আমি কথা দিচ্ছি, সমীরকে আমি মদ খেতে বিরত করব।”

ঝিলাম চুপ করে হাঁটু মুড়ে নিজেকে গুটিয়ে সোফার ওপরে বসে পরে। খুব ক্লান্ত ঝিলাম, ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, কিন্তু বুকের মাঝে সমীরের চিন্তা। এখন জাগেনি, এখন চোখ খোলেনি। বুধাদিত্য ওর চোখমুখ দেখে বুঝে যায় যে ঝিলাম সমীরের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ঝিলামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতের ওপরে হাত রাখে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় ঝিলাম।

ঝিলামের ঠোঁট কেঁপে ওঠে, “ভালো হয়ে যাবে ত?”

বুধাদিত্য ম্লান হাসে, “আরে বাবা, কিছু হয়নি। শুধু মদ খেয়ে উলটে পরে আছে। দাঁড়াও আমি এক গ্লাস নুন জল বানিয়ে দিচ্ছি, তুমি ওকে খাইয়ে দাও, দেখবে সব মদ পেট থেকে হরহর করে বেড়িয়ে যাবে, শালা একদম ঠিক হয়ে যাবে।”

ঝিলাম কিছু বলেনা, চুপ করে বসে থাকে। বুধাদিত্য রান্না ঘরে ঢুকে নুন জল বানিয়ে ঝিলামের হাতে ধরিয়ে দেয়। ঝিলাম গ্লাস নিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য বালতি আনতে বাথরুমে ঢুকে পরে। ঝিলাম সমীরের মাথা কোলের ওপরে তুলে ধরে, কানেকানে মুখ খুলতে বলে। সমীর অচেতন, একটু নড়াচড়া করে ব্যাস। ঝিলাম ওর ঠোঁটের কাছে জলের গ্লাস ধরে, সমীর কোনোরকমে একটু ঠোঁট খোলে, ঝিলাম নুন জল ওর গলায় ঢেলে দেয়। নুন জল পেটে যাওয়ার কিছু পরে ওর শরীর কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি বালতি নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে। হরহর করে বমি করতে শুরু করে সমীর। কালো হলদে মদ আর কিছু খাবার বেড়িয়ে যায় পেট থেকে। ঝিলাম বারেবারে সমীরের মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। বুধাদিত্য জলের নিয়ে বোতল ঝিলামের হাতে ধরিয়ে দেয়। ঝিলাম আঁজলা করে জল নিয়ে সমীরের মুখে চোখে ছিটিয়ে দেয়। কিছু পরে সমীর শান্ত ছেলের মতন চুপ করে শুয়ে পরে ঝিলামের কোলে।

বুধাদিত্য ঝিলাম কে বলে, “ব্যাস, নো চিন্তা। এবারে একটু পরে দেখবে তোমার সমু ডারলিং চোখ খুলেছে।”

ঝিলাম ম্লান হেসে বলে, “চোখ খুল্লেই খেয়ে ফেলব আমি।”

হেসে ওঠে বুধাদিত্য, “পরে খেও, এখন একটু বিশ্রাম করো।”

ঝিলাম, “তুমি শুয়ে পড়ো, অনেক ধকল দিলাম তোমাকে।”

বুধাদিত্য, “না এমন কিছু ধকল দাওনি আমাকে। আমি ঠিক আছি।”

বুধাদিত্য বসার ঘরে চলে যায়, সোফার ওপরে বসে চুপ করে টিভি দেখে। ওদিকে ঘরের মধ্যে ঝিলাম সমীরের মাথার কাছে বসে থাকে চুপ করে। সমীর কিছু পরে চোখ খুলে ঝিলামের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে যে ঝিলাম ওর মুখের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। সমীর কাচুমাচু মুখ করে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে। ঝিলামের ফর্সা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। উলটো হাতে চোখ মুছে নেয়। বুধাদিত্য চুপ করে সোফা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

ঝিলাম সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন লাগছে তোমার শরীর?”

সমীরের গলা শুকিয়ে গেছে, ঝিলামের মুখ দেখে ওর নেশার ঘোর কেটে গেছে। মাথা নিচু করে বিছানার ওপরে উঠে বসে। ঝিলাম ওর চিবুকে হাত রেখে মুখ নিজের দিকে করে। ঝিমীর চোখ বন্ধ করে থাকে। ঝিলাম ওর গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেয়। চড়ের আওয়াজ সেই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সমীর চুপ করে বসে থাকে কিছু বলে না।

ঝিলাম সমীরের দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমাকে একটু বিষ দিতে পার না। খেয়ে মরে গেলে শান্তি পাবে।”

সমীর লাল চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “দয়া করে ক্ষমা করে দাও আমাকে। আমি মদের নেশায় কি করেছি কিছুই মনে নেই।” ওর পায়ের ওপরে ঝুঁকে পরে সমীর। ঝিলাম পা সরিয়ে নিয়ে চুলের মুঠি ধরে মাথা তুলে ধরে।
সমীরকে বলে, “ছিঃ পা ধরতে নেই।” ওর মুখখানি আঁজলা করে ধরে কাতর সুরে বলে, “কেন গেল ওই ছাইভস্ম? কি স্বাদ পাও ওর মধ্যে? আমি কি দেয়নি তোমাকে?”

সমীর ককিয়ে ওঠে, “না ঝিলাম, না, তোমার মধ্যে কোন খুত নেই। আমি দুঃখিত ঝিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও।” কেঁদে ফেলে সমীর। ঝিলাম ওকে দুহাতে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।

বুধাদিত্য চুপচাপ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসে। এবারে সমীর আর ঝিলামের মান অভিমানের পালা চলবে, তারপরে বাইবে প্রেমের ভেলা।

______________________________

সপ্তম পর্বঃ অন্তরদ্বন্দ। (#1)

বুধাদিত্য ইচ্ছে করেই ওদের থেকে দুরে চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ঝিলামের কাতর আর্তনাদ আবার করে সেই ছিন্ন বন্ধন বেঁধে নেয়। বুধাদিত্য চাইলেও যেন সমীরের কাছ থেকে দুরে যেতে পারে না। সমীর আর ঝিলাম পরের দিন বাড়ি ফিরে যায়। ওদের মনমালিন্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ঝিলামের প্রতি পাশবিক ক্ষুধার জ্বালা নিভে এক ভালোলাগা ভরে যায় বুধাদিত্যের বুকে।

পুজোতে কিছু উপহার দেওয়া হয়নি সমীর আর ঝিলামকে। ওই রাতের ঘটনার দুই দিন পরে, দুপুরে বেলা অফিস থেকে বেড়িয়ে বাজার চলে যায়। ঠাণ্ডার ভাব বাতাসে ভরে উঠেছে। লাজপত নগর মারকেট জনবহুল বাজার, নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। ঝিলামের জন্য একটা দামী সাদা ফারের জ্যাকেট কেনে আর সমীরের জন্য রেমন্ডসের সুট পিস কেনে। ঝিলামের আবার কিসান্থিমাম আর ডালিয়া বেশি পছন্দ, তাই খুঁজে খুঁজে সেই ফুলের তৈরি বড় তোড়া কিনে নেয়। মন মেজাজ বেশ খুশি, নিজের বিবেক ওকে অনেক শান্ত করে দিয়েছে।

ফোন না করেই ভেবেছিল আচমকা হাজির হবে ওদের দরজায়। ঠিক সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ওদের বাড়ি পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। হাতে উপহারের বাক্স আর ফুলের তোড়া নিয়ে। সেদিন আর মদের বোতল নিয়ে যায়নি। ঝিলামকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার পরে ফ্রিজ থেকে সব হুইস্কি আর ভদকার বোতল ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছিল। দশ বছরের পুরানো পাপের অভ্যেস এক ঝটকায় ঝিলাম ভেঙ্গে দিয়েছিল।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পরে বুধাদিত্য। ঘরের ভেতরে সমীরের জোর গলার আওয়াজ তার সাথে ঝিলামের গলার আওয়াজ ভেসে আসে।

সমীর, “এমনি সময়ে জিন্স, টপ, ক্যাপ্রি পড়তে তোমার খারাপ লাগে না। কিন্তু পার্টিতে আমি ওই ড্রেস পড়তে বলেছি তাই তোমার খারাপ লেগে গেল?”

ঝিলাম, “কি ড্রেস ছিল সেটা, ছিঃ একটা কাঁধ হীন পাছার নিচ পর্যন্ত ছোটো নীল রঙের ইভিনিং ড্রেস?”

সমীর, “দিল্লীর পার্টিতে ওই সব পরে যায় লোকে। কেন দেখনি ওখানে কি রকম সবাই পরে গেছিল? তার মধ্যে তুমি ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির মতন শাড়ি পরে। আমার যা লজ্জা করছিল সেই সময় বলে বুঝাতে পারব না।”

ঝিলাম, “কি বুঝতে পারি না আমি?”

সমীর, “দিল্লীর লোকেরা অনেক উদার চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকে তোমার মতন দুর্গাপুরের ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মতন মানসিকতা নয় ওদের। এখানে মানুষের চিন্তাধারা অনেক স্বাধীন।”

ঝিলাম, “ছোটো কাপড় জামা পরে, অর্ধ উলঙ্গ হয়ে যারতার সাথে নেচেকুদে, মদ গিলে ব্যাভিচার করাকে স্বাধীনতা বলে না। স্বাধীনতা শিক্ষাদিক্ষায় আসে, সমীর। উদার চিন্তাধারা শিক্ষাদিক্ষার ফলাফল।”

সমীর, “বেশি জ্ঞান দিয়ো না আমাকে। কি জানো তুমি, ছিলে ত ওই দুর্গাপুরে?”

ঝিলাম, “আমার শিক্ষা তোমার চেয়ে বেশি।”

সমীর, “তোমার মানসিকতা নিচ, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মতন। স্বাধীন চিন্তাধারা তোমার মধ্যে নেই।”

ঝিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক স্বাধীনতা দেখিয়ছ আমাকে। তুমি সারাদিন অফিসে থাক, আমি একা একা বাড়িতে পরে থাকি, চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ। একবার ভেবে দেখেছ কি সেই সব কথা?”

সমীর, “কেন ভাবিনা, নিশ্চয় ভাবি।”

ঝিলাম, “কি ভাবো? আমি পুজোতে বাড়ি যাবো বলেছিলাম, নিয়ে যাওনি। দুর্গাপুজোর দিনে একটা দিন ছুটি নিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, নিয়ে যাওনি। আমি অষ্টমীর দিন সেজেগুজে তোমার জন্য পথ চেয়ে বসেছিলাম, তুমি এলে রাত দশ’টায়, মদে ডুবে।”

সমীর, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি, সেইদিন আমার অনেক কাজ ছিল তাই দেরি হয়ে গেছিল।”

ঝিলাম, “তোমার সব কথা আমাকে মেনে নিতে হয়। তুমি আমার কোন কথা মানো শুনি? তুমি মদ খাবে, আমি কিছু বলতে পারব না। তোমার ইচ্ছে মতন আমাকে কাপড় পড়তে হবে, আমি কিছু বলতে পারব না।”

সমীর, “কি চাও তুমি, আমি চাকরি ছেড়ে তোমার সামনে পুতল হয়ে বসে থাকি। গত ছয় মাসে শুধু ছয় সাতবারের জন্য বাইরে গেছি, তাও আবার এক রাতের জন্য। তোমার জ্বালায় ফিরে আসতে হয় আমাকে। আমার কেরিয়ারে কত বড় ধাক্কা সেটা তুমি বুঝতে পার না।”

ঝিলাম, “তোমাকে বাড়িতে বসতে ত বলিনি আমি। আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে বললে, তুমি কোন এক বাহানা দেখাও প্রতি ছুটির দিনে। আমি কি এখানে শুধু তোমার সাথে শুতে এসেছি? শুধু মাত্র বিছানা গরম করার জন্য আমাকে বিয়ে করেছ?”

সমীর, “সারা সপ্তাহ কাজে ডুবে আর ইচ্ছে থাকে না আমার তাই বের হই না।”

ঝিলাম, “মদ গেলার সময়ে তোমার অফিস থেকে দেরি হয় না, আমি একটু ঘুরতে যাবো বললে তোমার দেরি হয়।”

সমীর, “তোমাকে দুর্গাপুরে রেখে এলে ভালো হত।”

ঝিলাম, “তুমি জানো যে আমার যাবার জায়গা নেই তাই বারেবারে আমাকে দুর্গাপুরের কথা বল। আমার বাবার পয়সার অত জোর নেই, তাই আমার ওপরে তুমি জোর খাটাতে পার।”

সমীর, “মায়ের কথা শুনে বিয়ে করেছিলাম। বিয়েতে কি দিয়েছে তোমার বাবা?”

ঝিলাম, “আর কি দেবে, আর কি চাইতে?”

সমীর, “এক লাখ টাকা ও দিতে পারল না।”

ঝিলাম, “কেন? খাট, বিছানা, টিভি, ফ্রিজ সব কিছু বাবা কিনে দিয়েছে তারপরেও তোমার চাই?”

সমীর, “বলেছিল এক লাখ দেবে শেষ পর্যন্ত পঁচাত্তর হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়।”

ঝিলাম, “কেন? তোমাকে তার মেয়ে দিয়েছেন, সেই মেয়েকে পড়িয়েছেন, সেটার দাম কি তুমি আমার বাবাকে দিয়েছ? তুমি আবার স্বাধীনচেতার কথা বল? ছিঃ তোমার লজ্জা করে না এই সব কথা বলতে?”

সমীর, “তোমাকে নিয়ে আর পারা যায়না।”

ঝিলাম, “তুমি আমাকে এগিয়ে যেতে দাও নি। আমি কোলকাতায় থাকতেই তোমাকে বলেছিলাম যে আমাকে চাকরি করতে দাও, করতে দাওনি? কেন সেই সময়ে তোমার বউ বাইরে যাবে বলে খুব গায়ে লেগেছিল? আর যখন তুমি অন্য মেয়েদের দেখ, তখন তাদের স্বামীদের বা ভাইদের গায়ে লাগে কি লাগে না সেটা ভাব না ত?”

সমীর, “তুমি চাকরি করবে? তোমাকে আমি দুর্গাপুরে পাঠিয়ে দেব এবারে।”

ঝিলাম, “আমি কোথাও যাবো না। বিয়ে করে এনেছ যখন তখন আমার সব দায়িত্ব তোমার।”

সমীর, “তোমার জেদ আর রাগের জন্য আমি মদ খাই, আমার মাথার ঠিক থাকে না।”

ঝিলাম, “হ্যাঁ তাত বলবেই এখন। গত আড়াই বছরে কতটুকু নজর দিয়েছ আমার প্রতি? কোলকাতায় থাকতে তুমি একটু আধটু মদ খেতে আমি কিছু বলতাম না। এখানে এসে একটু বেড়ে যায় তাও আমি কিছু বলিনি। কিন্তু শেষের কয়েক মাস ধরে তুমি যা শুরু করেছ সেটা সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তুমি কিনা অন্য একজনের সাথে, আর সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হল? তার থেকে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল।”

সমীর, “তুমি কি দিয়েছ আমাকে? এতদিনে একটা বাচ্চার মা হতে পারলে না।”

ঝিলাম কেঁদে ফেলে, “শুধু কি আমার দোষ দেখ? গত বছরে একটা মিস্ক্যারেজ হয়েছে, অনেকের হয়, তাই বলে কি শুধু আমার দোষ? তুমিও ত ডাক্তার দেখাবে না।”

সমীর, “আমার কি হয়েছে? আমার কিছু হয়নি।”

ঝিলাম, “বললেই হয়ে যাবে? ওই ত তোমার মুরদ। কত বার বলেছি, আমার গায়নকলজিস্ট ও বলেছিল তোমাকে স্পারম কাউন্ট করাতে আর তার ওষুধ খেতে তুমি শুনেছিলে?”

সমীর, “না আমার স্পারম কাউন্ট ঠিক আছে।”

ঝিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ জানা আছে, দু মিনিটে নেতিয়ে পড়ে যে মানুষ সে আবার বড় বড় কথা বলে। আমি বলে তোমার সাথে টিকে আছি, অন্য মেয়ে হলে এতদিনে ছেড়ে চলে যেত।”

সমীর, “হ্যাঁ যাও, আর আমি তাহলে বেঁচে যাই।”

ঝিলাম, “আমি সত্যি বলছি, গলায় দড়ি দিয়ে এবারে আত্মহত্যা করব।”

বাইরে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্য কলিং বেল বাজাতে ভুলে গেল। ভেতরে তুমুল ঝগড়া চলছে, এই ভীষণ ঝড়ের মধ্যে ওর ঢোকা উচিত কি না তাই ভাবছিল। কিন্তু শেষ বাক্য ওকে নাড়িয়ে দেয়, ঝিলামের গলা শুনে মনে হল রাগের বশে হয়ত কোন উল্টো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে। ঝিলামের এই দুরাবস্থা বুধাদিত্য সহ্য করতে পারেনা। মনে হয় এখুনি সমীরের মাথার ঘুলি ভেঙ্গে দেয়। প্রথম বার মনে হয়েছিল যে চলে যায় কিন্তু ঝিলামের কান্না শুনে মনে হয় দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পরে। বুধাদিত্যের শরীর রাগে কেঁপে ওঠে। চোয়াল চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে। ভেতরের থেকে ভেসে আসা আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। কোন সারা শব্দ নেই, বুধাদিত্য দ্বিতীয় বার দরজায় ধাক্কা মারে। সমীর এসে দরজা খুলে দিল। ঝিলামের চোখে জল, সারা মুখ লাল, বিধ্বস্ত পরাজিত এক নারী, জীবন যুদ্ধে হেরে গেছে সবকিছু। চুরিদারের ওড়না গলায় জড়িয়ে ফাঁসে বাঁধা, তার মানে ঝিলাম সত্যি নিজেকে সমীরের সামনে শেষ করে দিত আর সমীর শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত।

বুধাদিত্য এমন ভান করল যেন কিছু জানেনা, কিছুই শোনেনি। বুধাদিত্য হেসে সমীরকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ব্রাদার, ভাবলাম তোদের পুজোতে কিছু দেওয়া হয়নি তাই নিয়ে এলাম।” ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি ব্যাপার, গলায় ঠাণ্ডা লেগেছে নাকি? ওড়নাটা মাফ্লারের মতন পরে আছো।”

ঝিলামের চোখ ছলছল, চোখ মুখ থমথমে। বুধাদিত্যের কথা শুনে, চোখ মুছে অতি কষ্টে একটু হাসি নিয়ে আসে ঠোঁটে। সমীরের চোখমুখ লাল, জড়িয়ে ধরার সময়ে অনুভব করেছিল যে সমীরের গা গরম, প্রচন্ড ক্রোধের ফলাফল।

বুধাদিত্যে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দেখ তোমার জন্য ক্রিসান্থিমাম এনেছি, এবারে হাসো একটু।”

ঝিলাম কোনরকমে ঠোঁটে হাসি টানতে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। মুখ চেপে দৌড়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। সমীরের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায় বুধাদিত্য। ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।

সমীর চেপে যায় ওদের ঝগড়ার কথা, থমথমে ভারী গলায় বলে, “কিছু না রে। তুই ভেতরে আয়। আর হ্যাঁ এই সব কি পাগলামি করেছিস?”

বুধাদিত্য, “আরে বাপ্স, কিছুই করিনি। নে ধর, আর ঝিলামকে ডাক।”

সমীরের মুখ থমথমে, বুধাদিত্য তার কারন জানে, তাও না জানার ভান করে সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে তোরা ঝগড়া করেছিস নাকি?”

বুধাদিত্য সোফার ওপরে বসে পরে, সামনে সমীর। সমীর মাথা নিচু করে ভারী গলায় বলে, “হ্যাঁ একটু মনমালিন্য হয়ে গেছে। একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।” বুধাদিত্যর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, ঝিলামের চোখে জল যেন আর সহ্য করতে পারছেনা। কিন্তু বাইরের লোক, তাই ওদের স্বামী-স্ত্রীর বাক বিতন্ডের মধ্যে আসতে চায়না। সমীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে কিছু এনেছিস আজ? মাথা ঝিমঝিম করছে, একটু খেলে ভালো হত।”

ঝিলাম ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পায় ওদের কথা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মদের সাথে সাথে আমাকে মেরে ফেলে আমার রক্ত গিলে নাও, তবে তোমার মনে শান্তি হবে।”

সমীর মাথা বিরক্তিতে মাথা নাড়ায়, চিৎকার করে ওঠে, “চুপ করে থাক তুমি, একটা কথা বলবে না।”

বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে যায়, হাতের মুঠি শক্ত হয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রনে রাখে। গম্ভির স্বরে সমীরকে বলে, “না আমি আজ কোন মদের বোতল আনিনি। ড্রিঙ্ক করা এক প্রকার ছেড়ে দিয়েছি।”

একটু যেন অবাক হয়ে যায় সমীর, বুধাদিত্যের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, “কি ব্যাপার তুই মদ ছেড়ে দিয়েছিস?”

বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “তোর সেইদিনের পরে শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল।”

সমীর ঝাঁঝিয়ে ওঠে ওর দিকে, “তুই আর জ্ঞান দিতে আসিস না প্লিস।”

ঝিলাম বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। সমীরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, “ও ছিল বলে এই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছ। ও না থাকলে ওখানে মরে পরে থাকতে আর আমি ওখানে আত্মহত্যা করতাম।”

মাথা নিচু করে বসে থাকে সমীর। বুধাদিত্য বুক ভরে এক শ্বাস নেয়, এই ঝড় দুরন্ত গতি ধারন করেছে, না থামালে ভবিষ্যতে অনেক বড় আকার ধারন করবে। ওর আনা উপহারের প্যাকেট গুলো সোফার ওপরে পরে, কেউ খুলে পর্যন্ত দেখেনি। ঝিলামের দিকে তাকায় বুধাদিত্য, চোখে দুটি ছলছল, নাকের ডগা লাল, সারা মুখ লাল, কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে গেছে।

আবহাওয়ার সামাল দিতে ঝিলামকে বলে বুধাদিত্য, “এক গ্লাস জল দেবে ত, এত খুঁজে খুঁজে বিশেষ করে তোমার জন্য ক্রিসান্থিমাম এনে দিলাম, আর এক গ্লাস জল পাবো না?”


সপ্তম পর্বঃ অন্তরদ্বন্দ। (#2)

ঝিলাম ওর কথা শুনে লজ্জিত হয়ে হাল্কা হেসে ফেলে। সেই হাসি দেখে বুধাদিত্য সমীরকে বলে, “ওই দেখ ঝিলাম হেসেছে, এবারে মিটমাট কর। চল কোথাও যাই, আজ রাতে আর বাড়িতে খাবার বানাস না।”

সমীর, “না আমার আর কিছু মন করছে না।”

বুধাদিত্য, “আচ্ছা, ঠিক আছে যেতে হবে না। কি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া? আমাকে জানাতে কি কোন বাধা আছে?”

ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে, “আমি একটা চাকরি করব। আমার জন্য একটা চাকরি খুঁজে দেবে তুমি?”

সমীর চুপ করে বসে থাকে, ঝিলামের কথার উত্তর দেয় না। বুধাদিত্য সমীরের কাঁধ নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার? চাকরি করতে চায় বাধা দিচ্ছিস কেন?”

সমীর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “চাকরি করতে চায় ঝিলাম, কিন্তু...”

বুধাদিত্য, “ঝিলাম চাকরি করবে, সেট খুব ভালো কথা। তাতে তোর আপত্তি কেন?”

সমীর, “না মানে আমার আপত্তি নেই, নিজে চাকরি খুঁজে করতে পারলে করুক।” ওর গলার স্বরে প্রবল দ্বন্দের প্রতিধ্বনি।

বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে যায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য আবার বলে, “নে অনেক কথা কাটাকাটি করেছিস, এবারে জামা কাপড় পরে নে। চল বাইরে কোথাও যাই, ভালো লাগবে। দেখ ঘরের আবহাওয়া গুমোট মনে হচ্ছে আমার। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।” ঝিলামকে বলে, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নাও। আজ আমার তরফ থেকে ডিনার।”

ঝিলাম ওকে বলে, “না আমি যাবো না ওর সাথে।”

বুধাদিত্য দেখল যে প্রচন্ড বিগড়ে গেছে ঝিলাম। সত্যি সমীর যা করেছে তারপরে ওকে ক্ষমা করে দেওয়া একটু মুশকিল। বুধাদিত্য ঝিলামের দিকে নরম স্বরে বলে, “ঠিক আছে ওর সাথে যেতে হবে না। তুমি আমার সাথে চল, তাহলে হবে ত। মনে করে নিও যে গাড়িতে শুধু তুমি আর আমি ব্যাস আর কেউ নেই।”

বুধাদিত্য নেহেরু প্লেসে একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্ট, অহঃ ক্যালক্যাটা, ফোন করে তিন জনের জন্য একটা টেবিল বুক করে নিল। সমীরের মুখ দেখে মনে হল সেখানে আগে গেছে। বুধাদিত্য আর কথা বাড়াল না, কিছু জিজ্ঞেস করল না সে বিষয়ে। সমীর মুখ কাচুমাচু করে বসে ঝিলামের দিকে তাকায়, ঝিলাম বুধাদিত্যের দিকে একটু হাসি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। সমীর কিছু পরে উঠে চলে যায় জামা কাপড় পড়তে। কিছু পরে সমীর আর ঝিলাম তৈরি হয়ে বেড়িয়ে আসে। ঝিলামের পরনে বেশ সুন্দর একটি সালোয়ার। বিশেষ কিছু সাজগোজ করেনি কারন মাথা এখন গরম। সমীর একটা জিন্স আর শার্ট পরে বেড়িয়ে আসে। বুধাদিত্য ওদের নিয়ে বেড়িয়ে পরে।

গাড়িতে সমীর বুধাদিত্যের সাথে সামনের সিটে বসে, পেছনে ঝিলাম। কারুর মুখে কোন কথা নেই, এই নিস্তব্ধতা এক বিশাল ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছু করে হোক এই অবস্থার সামাল দেওয়া উচিত, ভাবতে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলামের চোখ যে বড় ডাকে, ঝিলামের চোখে যেন জল দেখতে পারেনা বুধাদিত্য। ওই কাজল কালো চোখে জল দেখলেই বুধাদিত্যের বুক বড় কেঁপে ওঠে। আয়েশার পরে আরও এক নারীর প্রতি ওর বুকের মাঝে টান ধরেছে, এক প্রশান্ত ভালোলাগা’র টান। কিন্তু দু’জনেই ওর হতে পারেনা। কেন ওর বুকে কোন অবিবাহিতা জোটে না? রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি চেয়ারে সমীর আর ঝিলামকে বসিয়ে দেয়, ওদের সামনের চেয়ারে বুধাদিত্য। দিল্লীর বেশ নামকরা বাঙালি রেস্টুরেন্ট, ওঃ ক্যালক্যাটা।

বুধাদিত্য মজা করে সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, এই রকম চুপ করে বসে থাকবি নাকি? কিছু বল, ঝড়ের পরে’ত বৃষ্টি হওয়া উচিত রে বোকা...”

ঝিলাম উত্তর দেয়, “একটু বুঝিয়ে বল তোমার বন্ধুকে, আমাকে একদম দেখে না।”

বুধাদিত্য ঝিলামকে বলল, “তুমি চাকরি করতে চাও?” মনের কোনে এক প্রবল ইচ্ছে জাগে, ঝিলামকে সমীরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিজের করে নিতে। খুব ভারী পাথর দিয়ে বুকের মাঝে চেপে রাখে সেই প্রবল অনুভুতি।

ঝিলাম মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। সমীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ঠিক আছে আমি মত দিচ্ছি তুমি চাকরি করতে পার। কিন্তু আমি কাউকে চিনি না, আমি কিছু সাহায্য করতে পারব না কিন্তু।”

বুধাদিত্য সমীরকে বলে, “রাগ এখনো কমেনি তোর? ঝিলামের পাশে একটু চেপে বস’ত একটা সুন্দর ছবি তুলি তোদের। শালা আমার কাছে তোদের কোন ছবি নেই। একটু জড়িয়ে ধর ঝিলামকে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ঝিলামের কাঁধে কাঁধ দিয়ে একটু ঠেলে দেয় সমীর। ঝিলাম কপট রাগ দেখিয়ে হেসে বলে, “ন্যাকামো ছাড়ো, অনেক হয়েছে।”

বুধাদিত্য ওর মোবাইল বের করে ওদের একটা ছবি তোলে। ইচ্ছে করেই শুধু মাত্র ঝিলামের আরও একটা ছবি তোলে। বুধাদিত্য অর্ডার দিল ডাব চিংড়ি আর ভাপা ইলিশ। ঝিলামের জিবে যেন জল চলে এল, একটু হেসে বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায়। বুধাদিত্য খাওয়ার সময়ে জানায় যে ঝিলামের জন্য চাকরি খুঁজে দেবে। গল্প করতে করতে স্বামী স্ত্রীর মাঝের বরফ খানিকটা গলে যায়। সেই দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে, বিশেষ করে ভালো লাগে ঝিলামের গালের লালিমা, দুটি বড় চোখের ভাষা আর ঠোঁটের হাসি। ফিরে এসেছে ঝিলাম, খুব খুশি বুধাদিত্য। কিন্তু সেই খুশি চেহারায় আনতে দেয় না। খাওয়ার সময়ে সমীর মজা করে বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে মদ ছাড়ার কারন। বুধাদিত্য কপট হেসে সমীরকে উত্তর দেয় যে একজনের কথায় মদ ছেড়ে দিয়েছে। উত্তরটা ধরতে পারে ঝিলাম, মৃদু মাথা নাড়ায়। বুধাদিত্য চোখের ইঙ্গিতে ঝিলামের অভিবাদন স্বীকার করে।

খাওয়ার পরে ওদের পৌঁছে দেয় বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে বুধাদিত্য দুই জনকে এক সাথে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে, ওর ছোঁয়ায় শুধু মাত্র বন্ধুসুলভ অনুভুতি। এই প্রথম বার ঝিলামের কোমল দেহপল্লব বাঁধা পরে বুধাদিত্যের পেশি বহুল বাজুর মাঝে, একটুখানি কুঁকড়ে যায় ঝিলাম।

বুধাদিত্য ওদের বলে, “তোরা দুজন এই ভাবে মারামারি করলে আমি কোথায় যাই বলত? প্লিস করিস না। আর ঝিলাম, শেষবারের মতন ক্ষমা করে দাও সমীরকে। আর সমীর তুই কথা দে ঝিলামকে যে আর কোনদিন মদ খাবি না।”

ঝিলাম ম্লান হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “আমি কি ইচ্ছে করে ঝগড়া করেছি?”

সমীর মৃদু মাথা দুলিয়ে জানায় যে ও পরিতপ্ত, ভবিষ্যতে আর মদ খাবে না। সোফার ওপরে পরে আছে উপহারের প্যাকেট। বুধাদিত্য প্যাকেট গুলো ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ওদের ভালো লেগেছে কিনা। সমীর প্যাকেট খুলে অবাক, এত দামী সুট পিস। সাদা ধবধবে ফারের জ্যাকেট দেখে ঝিলামের মুখে হাসি ধরেনা। ঝিলাম জানায় যে ছোটো বেলা থেকে ওর খুব শখ ছিল ওই রকম একটা জ্যাকেট পাওয়ার। ঝিলামের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সমীর সামনে না থাকলে বুধাদিত্যকে জড়িয়ে ধরত। ঝিলামের ঠোঁটের মিষ্টি হসি বুধাদিত্যকে আবার মাতাল করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ ওদের বাড়িতে বসে বুধাদিত্য খুশি মনে বারি ফিরে আসে।

ভিশাল সিনহার স্ত্রী, শমিতা, ডি.পি.এস ইস্ট অফ কৈলাস, জুনিয়ার সেক্সসান, কলেজে অঙ্কের টিচার। বুধাদিত্য ভিশালের সাথে কথা বলে। ভিশাল জানায় যে এই ব্যাপারে বুধাদিত্য যেন শমিতার সাথে বিস্তারিত কথা বলে, এই সব ব্যাপারে ওর কোন হাত নেই। একদিন বুধাদিত্য ভিশালের বাড়ি গিয়ে ঝিলামের চাকরির ব্যাপারে কথা বলে আসে। শমিতা জানায় যে বুধাদিত্য যেন ওকে ঝিলামের প্রোফাইল মেইল করে দেয়।

সমীরের সাথে একদিন কথা হয় এই ব্যাপারে। সমীর একটু মনক্ষুণ্ণ, ঝিলামের চাকরির ব্যাপারে। কিন্তু ঝিলামের দৃঢ় সঙ্কল্পের সামনে মাথা নত করে দেয় সমীর। বুধাদিত্য এক বিকেলে সমীরের বাড়ি গিয়ে ঝিলামের সাথে বসে ওর কারিকুলাম ভিটা বানিয়ে ফেলে। বুধাদিত্য ঝিলামকে জানায় যে ওর ইংরাজি উচ্চারন প্রচন্ড বাঙালি ঘেঁষা, সেটা আগে ঠিক করতে হবে। সমীরকে অনুরোধ করে যে ঝিলামকে একটা ইংরাজি স্পিকিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিতে। সমীররে অনিচ্ছে থাকা স্বত্তেও ঝিলামের দৃঢ়তার জন্য শেষ পর্যন্ত ওকে ইংরাজি স্পিকিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। বুধাদিত্য প্রতিদিন ফোন করে সমীরের কাছ থেকে ঝিলামের খবর নেয়। ঝিলামের সাথে প্রতি রাতে কথা হয় বুধাদিত্যের। বুধাদিত্যের মনের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে, বারেবারে মনে হয় ঝিলাম ওর অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। এইকদিনে ওদের সাথে বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয়না বটে কিন্তু প্রায় প্রতিদিন ওদের সাথে কথা হয়। বুধাদিত্য কোনদিন ঝিলামকে একা ফোন করেনা, যখনি করে সমীরের ফোনে ফোন করে আর তারপরে ঝিলামের সাথে কথা বলে। বুধাদিত্য কোনদিন নিজের মনের ভালোবাসা ওদের বুঝতে দেয়না, সবসময়ে অতি প্রিয় বন্ধুসুলভ আচরন করে যায়। মনপ্রান ঝুঁকে যায় ঝিলামের দিকে কিন্তু বিবেকের কাছে হার মেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখে বুধাদিত্য।

একদিন বিকেলে অফিস থেকে বেড়িয়ে খুব ঝিলামের কথা মনে পরে যায় বুধাদিত্যের। অহেতুক কোন সমস্যায় জড়াতে চায়না তাই সমীরকে ফোন করে বুধাদিত্য। সমীরকে বলে যে ওদের বাড়ি আসছে, সেই শুনে সমীর একটু চেপে যায়, বলে বাইরে দেখা করেতে, বুধাদিত্যের সাথে ওর কিছু কথা আছে। বাড়িতে থাকলে ঝিলামের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারবেনা। অনেকদিন বুধাদিত্যের সাথে সামনা সামনি দেখা হয়নি। সমীরের সাথে বিকেলে দেখা করে। সমীর একটু মনক্ষুণ্ণ যে ঝিলাম ঘরের বাইরে পা রেখেছে।

সমীর, “তোকে সত্যি কথাটা বলি। আমি বিয়ে করেছিলাম রুপে মুগ্ধ হয়ে। এত সুন্দরী আর প্রানবন্ত মেয়ে, যে আমি প্রথম দেখাতেই প্রেমে পরে গেছিলাম।” বুধাদিত্য যেদিন প্রথম ঝিলামকে দেখে সেদিনই ওর খিধে চাগিয়ে ওঠে, কিন্তু পরে সেই খিধে মরে এক অন্য ভালোলাগায় বুক ভরে যায়।

সমীর বলতে থাকে, “বিয়ের পরে বেশ কয়েকবার বার বলে যে ও চাকরি করবে। আমার মনের কোনায় হিংসে ভাব জাগে, একে ভীষণ সুন্দরী তার ওপরে চাকরি করতে গেলে যদি আমার হাত ছাড়া হয়ে যায় বউ, সেই ভেবে আমি ওকে চাকরি করতে বারন করি। কোলকাতায় থাকতে ওর বেশ কয়েকজন কলেজের বন্ধুদের সাথে আবার করে দেখা হয়, তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ছেলেও ছিল। কেউ কেউ দুর্গাপুর, বর্ধমান ছেড়ে কোলকাতায় চাকরির খোঁজে এসে গেছে। ঝিলাম খুব প্রানবন্ত খোলামেলা মনের মেয়ে, আমার খুব হিংসে হত যখন ওর বন্ধুরা আমার বাড়িতে আসত। আমি মাঝে মাঝে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম যে ঝিলাম বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। সত্যি বলছি তোকে, আমি সহ্য করতে পারিনি ওর হাসি। আমার ধারনা সুন্দরী বউ আমার পেছনে অন্য কারুর সাথে প্রেম করছে। একদিন খুব ঝগড়া হয় এই নিয়ে। ঝিলাম খুব জেদি মেয়ে, আমার কথা মানে না। আমি ওকে দুর্গাপুর পাঠিয়ে দিলাম একদিন। আমার মনে হয়েছিল যে দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। বাবা মায়ের কথা শুনে আমি আবার ঝিলামকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। ঝিলাম আমাকে বলে যে কোন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রাখবে না। আমি চাকরি বদলে দিল্লী চলে আসি, শুধু ওকে বেঁধে রাখার জন্য।”

বেঁধে রাখার কথা শুনে বুধাদিত্যের মনে হয় যে সমীরের গালে সজোরে এক থাপ্পর কষিয়ে দেয়। গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের তাও ওর কথা চুপ করে শুনে যায়।
[+] 1 user Likes pnigpong's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: দ্বিতীয় অঙ্ক (কালেক্টেড) - by pnigpong - 27-06-2020, 09:15 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)