Thread Rating:
  • 20 Vote(s) - 3.4 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Thriller দ্বিতীয় অঙ্ক by pinuram (Complete)
#10
চতুর্থ পর্বঃ ছিন্ন টান। (#1)

সমীর মাঝে মধ্যে ফোন করে, কিছু কথা হয়। বুধাদিত্য শুক্রবার রাতে জানিয়ে দেয় যে ও ইটালি যাচ্ছে অফিসের টুরে, ফিরে এসে যোগাযোগ করবে। কিছুটা আসস্থ হয় বুধাদিত্য। মাস শেষ হতে এখন দুই সপ্তাহ বাকি, আর অক্টোবরের শুরুতেই সত্যি ইটালি আর জার্মানির টুর আছে। প্রায় একমাস সমীরের সাথে যোগাযোগ থাকবে না। সমীর ঝিলাম ভুলে যাবে বুধাদিত্যকে, বুধাদিত্যের অশান্ত মন শান্ত হয়ে যাবে। নিজের পুরানো অঙ্ক আবার গুনতে বসবে। সমীরের এসএমএস আসে মাঝে মধ্যে, “কোথায় আছিস?” “কেমন আছিস?” “কবে ফিরছিস?” শুরু দিকে প্রায় আসত এসএমএস মাঝে মধ্যে উত্তর দিত বুধাদিত্য। ইটালি যাওয়ার পরে আর উত্তর দেয় না। সমীরের খবর নেওয়া কমে যায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টান।

জার্মানি ঘুরে, ইটালি ঘুরে দেশে ফেরে, মনের মাঝে পুরানো শান্তি, পুরানো জীবন ফিরে পায়। আগমনীর সুর আকাশে বাতাসে। দিল্লীতে দুর্গা পুজোর আবহাওয়া ঠিক করে বোঝা যায় না। তবে কাল্কাজি, সিআর পার্কে অনেক বাঙালি থাকে তাই পুজো পুজো গন্ধ মাঝে মধ্যে নাকে ভেসে আসে। গতে বাঁধা বুধাদিত্যের জীবন প্রবাহ চলতে থাকে।

প্রায় পুজোতে মামাবাড়ি যায় বুধাদিত্য। মামিমাকে ফোন জানিয়ে দেয় যে ষষ্টির দিনে কোলকাতা পৌঁছে যাবে। রঞ্জনবাবু প্রমীলা দেবী, দুজনেই খুব খুশি। নির্ধারিত দিনে প্লেনে চেপে বুধাদিত্য কোলকাতা নামে। নামতেই যেন এক জন সমুদ্রের কবলে পরে যায়। গাড়ি আগে থেকেই বলা ছিল, গাড়ি নিয়ে সোজা পন্ডিতায় মামাবাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ি ঢুকতেই বুবাই ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পরে। বুবাই, অনিন্দিতাদির মেয়ে। অনিন্দিতাদির বর, সুব্রতদা, যাদবপুর কলজের প্রফেসার। মামা ভাগ্নিতে শুরু হয় তুমুল মারামারি, পেটাপিটি।

অনিন্দিতাদি, “হ্যাঁরে পাগলা, তুই কি এনেছিস এবারে আমার জন্য?”

জার্মানি থেকে দিদির জন্য একটা চামড়ার কোট কিনেছিল, সেটা হাতে ধরিয়ে দেয়। বুবাইয়ের জন্য রোম থেকে আনা একটা কথা বলা, গান করা পুতুল, সুব্রতদার জন্য এক কারটন ইটালিয়ান সিগারেট, মামার জন্য একটা শার্ট। মামিমার জন্য কিছু কিনতে পারেনি, করুন চোখে তাকিয়ে থাকে মামিমার দিকে।

বুধাদিত্য মামিমার দিকে তাকিয়ে বলে, “পমুসোনা তুমি ত স্কার্ট পরবেনা তাই তোমার জন্য কিছু আনতে পারিনি।” মামিমা কে আদর করে বুধাদিত্য পমুসোনা বলে ডাকে।

মা হারা ছেলে বাড়ি ফিরেছে, প্রমীলা দেবীর চোখে জল। বছরে এই কটা দিনের জন্য কোলে ফিরে আসে। মামিমা আলতো একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলেন, “বিকেল বেলা গরিয়া হাটে গিয়ে আমার জন্য জামদানি কিনে আনবি।”

বুধাদিত্য গালে মামিমার স্নেহের চড় খেয়ে মাথা দুলিয়ে বলে, “ওকে পমুসোনা তোমার জন্য সব কিছু কিনে দেব।”

সুব্রতদা খাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করে, “কিরে ব্যাটা কবে বিয়ে করবি, বুড় হয়ে যাবি তারপরে?”

অনিন্দিতাদি মুখ শুকনো করে বলে, “পিসি বলে কি আমাকে কেউ ডাকবে না?”

বুধাদিত্য হাসে, চুপ করে খেয়ে চলে। বুবাই বায়না ধরে, “আমি এবারে মামুর সাথে দিল্লী যাবো।”

বুধাদিত্য বুবাইকে জানায়, “একটু বড় হয়ে নে, মাকে ছেড়ে তাকতে পারলে আমি আর তুই মিলে আলস্কা যাবো। ওই যে ডিস্কভারি চ্যানেলে দেখিস, নরদান লাইটস, সেই দেখাব তোকে।”

বুবাইের চেহারায় খুশির ঝলক, “কিন্তু মামু সেত বড় হলে যাবো। এবারে আমি কিন্তু তোমার সাথে যাবো দিল্লী।” মায়ের দিকে তাকিয়ে মিনতি করে বলে বুবাই, “মাম্মা, প্লিস আমি মামুর সাথে দিল্লী যাবো।”

অনিন্দিতাদি বুবাইকে বলে, “রাতে কিন্তু মা থাকবে না, তখন যেন মায়ের কাছে যাবো বলে কাঁদিস না।”

বুবাই বুক ফুলিয়ে বলে, “আমি বড় হয়ে গেছি, ক্লাস থ্রি তে পড়ি।” বুবাইয়ের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে।

রাতের বেলা ছাদে বসে সুব্রতদা আর বুধাদিত্য বেশ আয়েস করে ড্রিঙ্কস করছিল। এমন সময়ে অনিন্দিতাদি ছাদে আসে। অনিন্দিতাদিকে দেখে বুধাদিত্য হকচকিয়ে যায়।


অনিন্দিতাদি ওকে আসস্থ করে, “বড় হয়েছিস, বড় ম্যানেজার, তা ড্রিঙ্কস নিতে ক্ষতি নেই, তবে একটু মেপে খাস।”

বুধাদিত্য হেসে ওর পেটান শরীর দেখিয়ে বলে, “ড্রিঙ্কসের সাথে মাঝে মধ্যে ব্যায়াম হয়ে যায়, তাই বেঁচে আছি।”

অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “দিনে দিনে সাঙ্ঘাতিক চেহারা বানিয়ে ফেলেছিস। তারপরেও কপালে মেয়ে জুটল না?”

হেসে ফেলে বুধাদিত্য, সুব্রতদার দিকে চোখ টিপে বলে, “বউয়ের কি দরকার, বরযাত্রী পেয়ে যাই।”

অনিন্দিতাদি ওর কথার মানে বুঝতে পেরে যায়। মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “বুধি ভালো নয় রে। প্লিস ছেড়ে দে অইসব আর একটা সরল জীবনে ফিরে আয়।”

বুধাদিত্য, “তুমি প্লিস ড্রিঙ্কস করার সময়ে জ্ঞান দিয় না।”

অনিন্দিতাদি কিছু থেমে বলে, “মায়ের কাছে শুনলাম যে গত মাসে নাকি সুবির পিসেমশায় ফোন করেছিলেন?”

বুধাদিত্য গম্ভির হয়ে যায়। ফোনের কথা এতদিনে মন থেকে মুছে গিয়েছিল, অনিন্দিতাদির কথা শুনে সেই কথা আবার মনে পরে যায়। গ্লাসের বাকি পানিয়টুকু গলায় ঢেলে দিদির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ করেছিল।”

অনিন্দিতাদি, “কি ব্যাপার? এতদিন পরে?”

বুধাদিত্য, “জানিনা।”

অনিন্দিতাদি, “যা একবার ধানবাদে। দেখা করে আয়।”

বুধাদিত্য হাতের গ্লাস চেপে ধরে চিবিয়ে অনিন্দিতাদির কথার উত্তর দেয়, “তোমার খুব দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি? নিজে যাও না তাহলে, আমাকে টানছ কেন?”

অনিন্দিতাদি ওর মাথায় হাত রেখে বলে, “বুধাদিত্য, একটু শান্ত হ। বুঝতে চেষ্টা কর, তোর বাবা, হয়ত গরম রক্তের ফলে একসময়ে অনেক কিছু করে ফেলেছেন। এখন বয়স হয়েছে হয়ত মনের মধ্যে পরিতাপ এসেছে। একবার দেখা করে আয়।”

বুধাদিত্য দিদির হাত মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে পরে। ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, “তুমি এসে সব নেশার গুবলেট করে দিলে।”

অনিন্দিতাদি ওকে শান্ত করে বলে, “বুধি, একবার দেখা করতে দোষ কি?”

বুধাদিত্য উত্তর দেয়, “ঠিক আছে। দেখা করব খানে, মামিকে বল জানিয়ে দিতে যে দশমীর পরের দিন আমি ধানবাদ যাবো।”

পুজোর কটা দিন হইহুল্লর, আনন্দে কেটে যায়। ঠিক দশমীর দিনে প্রমীলাদেবী ধানবাদ ফোন করে বুধাদিত্যের বাবা, সুবিরবাবুকে জানিয়ে দেন যে তাঁর ছেলে পরেরদিন ধানবাদ যাবে তাঁর সাথে দেখা করতে। বুধাদিত্য পেছনে দাঁড়িয়ে মামিমার কথা শোনে, কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার অভিপ্রায় জাগে না।

পরেরদিন সকাল বেলা ব্লাক ডায়মন্ডে বেড়িয়ে পরে ধানবাদের উদ্দেশ্যে। যাত্রা শুরু করার সময়ে ফেরার টিকিট কিনে রেখেছিল। ট্রেন যত ধানবাদের কাছে এগিয়ে যায়, বুধাদিত্যের বুক টনটন করে ওঠে। ব্যান্ডেল পেরিয়ে গেল, বর্ধমান পেরিয়ে গেল। দুর্গাপুরে এসে ট্রেন দাঁড়ায়। দুর্গাপুর আসতেই বুধাদিত্যের হটাত ঝিলামের কথা মনে পরে যায়। চোখের সামনে হটাত করে ভেসে আসে ঝিলামের নগ্ন দেহপল্লব। মাথা ঝাঁকিয়ে সেই দৃশ্য দূর করে দেয়। তারপরে ভেসে ওঠে ঝিলামের মিষ্টি মুখ, ঠোঁটে লেগে মিষ্টি হাসি। দুর থেকে কানে ভেসে আসে ঝিলামের মধুর কন্ঠস্বর। সেই রাতে বেড়িয়ে যাবার আগে ঝিলাম মৃদু সুরে অনুরোধ করেছিল বুধাদিত্যকে, যেন অফিস পৌঁছে ফোন করে। কিন্তু বুধাদিত্য ফোন করেনি। তারপরে আর দেখা হয়নি ঝিলামের সাথে। প্রায় তিরিশ দিন হয়ে গেছে, সমীরের সাথেও কথা হয়নি। কেমন আছে সমীর, কেমন আছে ঝিলাম? জানতে বড় ইচ্ছে করে। হটাত বুকের পাঁজর বাঁধা দেয়, ঝিলাম পরস্ত্রী, মুখ তুলে দেখা পাপ। বুধাদিত্যের জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে সব বিস্নেস উইথ প্লেসার। একমাত্র আয়েশা আলাদা, ওর প্রতি বুধাদিত্যর হৃদয় একটু নরম, একটু টান। রোহিতের লাস্যময়ী বউ, আয়েশা, ওর আগের কম্পানির একাউন্টসে কাজ করে। আয়েশা ধরা দেয় ওর ডাকে, মাছের মতন বুধাদিত্যের ছিপে এসে গেঁথে যায়। না ঝিলাম সেই মেয়ে নয়, ঝিলাম অন্য মাটির তৈরি। আয়েশা আর ঝিলামের মধ্যে আকাশ পাতালের পার্থক্য। আয়েশা উচ্ছল তরঙ্গিণী, ঝিলাম শান্ত গভীর সমুদ্র।

শত চিন্তা ভর করে আসে বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে। কখন যে ট্রেন ধানবাদ পৌঁছে যায় ঠিক ঠাহর হয়না। সূর্য মাথার ওপরে। মামিমা ওকে বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। স্টেশানে নেমে একটা অটো করে লিখিত ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বুক ঢিপঢিপ করে, চোদ্দ বছর পরে বাবার সাথে দেখা হবে। কি বলবে, কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, যদি থাকনে সাথে, তাহলে তিনি কেমন ভাবে ওকে নেবে? কি ভাববে ওকে দেখে? না বুধাদিত্য জানিয়ে দেবে যে, তাদের সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরাতে আসেনি। এসেছে শুধু মাত্র বাবার ডাক শুনে নাহলে কোনদিন আসত না। ভুলেই গেছিল যে ওর বাবা জীবিত।

অটো একটা বিশাল দুতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। এই বাড়িতে ওর জন্ম হয়নি। ছোটোবেলায় মনে আছে, কোলইন্ডিয়ার কোয়াটারে থাকত ওরা। বাড়ির সামনে একটা ব্রাসের নামের ফলক তাতে বড় বড় হরফে লেখা “মঞ্জুষা মন্দির”। নাম পড়েই বুক কেঁপে গেল বুধাদিত্যের। বুধাদিত্যের মায়ের নাম মঞ্জুষা। ব্রাসের নামের ফলকে হাত ছোঁয়ায় বুধাদিত্য। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ওর, কি মনে করে মায়ের নামে বাড়ির নাম রেখেছে মিস্টার সুবির গুহ? বিশাল লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। সামনে একটা ছোটো বাগান, অনেক ফুলের গাছ। কয়েকটা সিঁড়ি চড়ে বাড়ির সামনের দুই পাল্লার ভারী কাঠের দরজা। কোথা থেকে একটা লোক দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল কাকে চাই। বুধাদিত্য উত্তর দিল যে বাড়ির মালিক কে খুঁজছে।

চাকরটা দরজা খুলে দিতেই, বিশাল হল ঘরে পা রাখে বুধাদিত্য। পায়ের নিচে, চকচকে শ্বেত পাথরের মেঝে, মাথার ওপরে একটা ঝাড় লণ্ঠন, দেয়ালে বেশ কিছু দামী পেন্টিং ঝুলছে। একপাশের দেয়ালে বিশাল একটা কাঁচের আলমারি, প্রচুর বই ঠাসা। লোকটা ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে ভেতরে চলে যায়। কিছু পরে বেড়িয়ে আসেন এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা, বয়স প্রায় সাইত্রিস কি আটত্রিস। পরনের শাড়ি আর সিঁথিতে একটু সিঁদুর, দেখে বোঝা গেল যে তিনি এই বাড়ির রাজ্ঞী। চোখে মুখে আভিজাত্যের ছাপ, ঠোঁটে মিষ্টি আময়িক হাসি, মাথা ভর্তি ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, ঘাড়ের কাছে আলতো হাত খোঁপায় বাঁধা, শরীরের ঘঠন ভারী সুন্দর, গায়ের রঙ উজ্জ্বল। ভদ্রমহিলা বুধাদিত্যকে দেখে হাত জোর করে বসতে বলে। দাঁড়িয়ে থাকা লোককে আদেশ দেয় সরবত বানিয়ে আনতে। গলার স্বর শুনে মনে হল মধুর ঝঙ্কার। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল বুধাদিত্যের, তাহলে এই মোহিনী নারীর রপে মুগ্ধ হয়ে মিস্টার সুবির গুহ বশীভূত হয়েছেন, সত্যি ভদ্রমহিলার রুপের কাছে যে কেউ বশ মেনে যাবে।

______________________________
চতুর্থ পর্বঃ ছিন্ন টান। (#2)

ভদ্রমহিলা ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বলেন, “মিস্টার গুহ গাড়ি নিয়ে স্টেশানে গেছেন, দেখা হয়নি? আমি ফোন করে দেখি।”

বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “না আমার সাথে কারুর দেখা হয়নি।”

ভদ্রমহিলা ফোন করতে যাবেন ঠিক এমন সময়ে দরজা ঠেলে সুবিরবাবু ঘরে ঢোকেন। বুধাদিত্যকে দেখে ঠিক কি বলবেন, কি করবেন ভেবে পায় না। চশ্মার পেছনে ছোটো ছোটো চোখ দুটি জলে ভরে আসে। বুধাদিত্য সুবিরবাবুর দিকে দু পা এগিয়ে যায়। ভদ্রমহিলা সুবিরবাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত রাখেন। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করেন সামনে এগিয়ে যেতে। বুধাদিত্য ডান হাত বাড়িয়ে দেয়, ওর বাবা হাত টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বুধাদিত্যের, আচমকা এত প্রেম উথলে পড়ছে, ঠিক মেনে নিতে কষ্ট হয় বুধাদিত্যের। জড়সড় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে নিজেকে ধিরে ধিরে বাহুপাশ থেকে মুক্ত করে।

ভারী গলায় জিজ্ঞেস করে সুবিরবাবুকে, “কেমন আছো?”

সুবিরবাবু উত্তর দেন, “এই বেঁচে আছি।” ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলেন, “দেবস্মিতা না থাকলে হয়ত মারা যেতাম।”

বুধাদিত্য জানতে পারল যে পিতার নতুন ভার্যার নাম দেবস্মিতা। যেমন নাম তেমনি দেবীর মতন দেখতে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবার দেখে নিল বুধাদিত্য। সুবিরবাবু জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “বস দাঁড়িয়ে কেন? তোমার খবর শুনি।”

ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে সুবিরবাবুর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “আমি খুব ভালো আছি। আমাকে কেন ডেকেছ তাই বল?”

সুবিরবাবু ওর সামনের সোফায় বসে পড়েন, সুবিরবাবুর কাঁধের ওপরে হাত রেখে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন দেবস্মিতা। সুবিরবাবু ওকে বলেন, “বাবা হই তোমার, আমার সাথে দেখা করতে নেই?”

বুধাদিত্য ভারী গলায় উত্তর দেয়, “গত উনত্রিশ বছরে, আমি হাতের কড় গুনে বলতে পারি তুমি আমার কাছে কটা দিন ছিলে।”

দেবস্মিতা সুবিরবাবুর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলেন, “মিস্টার গুহ, তোমাকে বলেছিলাম...” দেবস্মিতার হাবভাব দেখে মনে হয় সুবিরবাবু সম্পূর্ণ তাঁর বশীভূত, আঙ্গুলি হেলনে ওঠেন আর আঙ্গুলি হেলনে বসেন।

কি বলেছিল দেবস্মিতা? বুধাদিত্যকে বাড়িতে না ডাকার জন্য? দেবস্মিতার দিকে চোয়াল শক্ত চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। দেবস্মিতা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে যায় যে বুধাদিত্যের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। দেবস্মিতা ওখান থেকে সরে যায়। বুধাদিত্য আর সুবিরবাবু সামনা সামনি সোফায় বসে পরে। বুধাদিত্যের ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছেনা, শুধু মাত্র মামিমার বারংবার বলার জন্য আসা। গা হাত পা চিড়বিড় করে জ্বলতে থাকে ওর। বেশ ছিল নিজের জীবনে নিজের মতন, একটা ডাকে সবকিছু বদলে গেল বলে মনে হল। ঘৃণা আর রোষে গায়ের রক্ত ফুটছে, বাবার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। বারেবারে মনে হয় যে দেবস্মিতা মিস্টার সুবির গুহকে ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে এদিক ওদিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

সুবির বাবুর চোখ ছলছল, ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। এত দিন পরে দেখা, কি জিজ্ঞেস করবেন জানেনা। তাও কিছু পরে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার শরীর স্বাস্থ ভালো আছে?”

বুধাদিত্য মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ভালো আছে।” আবার চুপ।

ঠিক সেই সময়ে দেবস্মিতা একটা বড় ট্রেতে কোল্ড ড্রিঙ্কস, একটা প্লেটে লুচি ভাজা আর আলুরদম, তিনটে বাটিতে তিন রকমের মিষ্টি। বুধাদিত্য খাবারের সাজ দেখে মনেমনে হাসে। এদের আদিখ্যেতার বলিহারি, এত ধাক্কা দেওয়ার পরে এবারে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারতে চায় নাকি।

বুধাদিত্য ভদ্রতার খাতিরে বলে, “এত আমি খাইনা, কিছু উঠিয়ে নিয়ে গেলে ভালো হয়।”

দেবস্মিতা নরম সুরে হেসে বলে, “এমন কিছু বানানো হয়নি। এই সব খাওয়া যায়।” দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে ঠিক কি বলে সম্বধন করবে ভেবে পায়না, ভাব বাচ্যে কথাবার্তা হয়।

সেন্টার টেবিলের ওপরে ট্রে রেখে সুবরবাবুর পাশে বসে পড়েন। বুধাদিত্যর রাগে দুঃখে খিধে মরে গেছে। উত্তর হাতড়ায় মনের অলগলিতে, কেন ডেকেছে? শুধু মাত্র কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে বাকি গুলো সরিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যায়, কিন্তু বুধাদিত্যের শক্ত চোয়াল দেখে কিছু বলতে সাহস পায়না।

দেবস্মিতা নরম সুরে বুধাদিত্যকে বলেন, “অনেক দূর থেকে আসা হয়েছে, বেশ ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিলে ভালো হয়। খাবার তৈরি আমি খাবার বাড়ছি।” সুবিরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওঠ এখন, খাওয়ার আগের ওষুধ খেয়ে নাও। খাওয়ার টেবিলে বাকি কথা হবে আর তারপরে সময় আছে ত। সময় মতন না খেলে তোমার ব্লাড সুগার বেড়ে যাবে।”

দেবস্মিতার গলার আওয়াজ শুনে ক্ষণিকের জন্য বিদ্বেষ ভুলে যায় বুধাদিত্য। চাকর ওকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়। বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই একটা ছোটো ছেলের সাথে দেখা হয়। একটু নাদুসনুদুস গোলগাল খুব মিষ্টি দেখতে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল। গাল দুটি টোপাটোপা, দেবস্মিতার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, যদি জানত যে একটা বাচ্চা ছেলে আছে তাহলে কিছু হয়ত হাতে করে আনত সেই বাচ্চা ছেলেটার জন্য। কিন্তু কেউ জানেনা এই ছেলেটার কথা।

বুধাদিত্য সেই বাচ্চার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে। বাচ্চাছেলে একবার বুধাদিত্যের দিকে তাকায় তারপরে মায়ের মুখের দিকে তাকায়।

দেবস্মিতা বাচ্চাকে এগিয়ে যেতে বলে, “বড়রা ডাকলে যেতে হয়, কত বার বলেছি। যাও হ্যান্ডশেক করো। তোমার দাদা হয়।”

বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “দাদাদের মুছ থাকে না, কাকুদের গারিমুছ থাকে।”

বুধাদিত্য ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, সাথে সাথে দেবস্মিতাও হেসে ফেলে।

বুধাদিত্য ওকে নাম জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কি?”

বাচ্চাটা উত্তর দেয়, “পাপ্পাতিত্ত।”

বুধাদিত্য বুঝতে পারেনা নামের মানে মাথা নাড়ায়, “কি?”

দেবস্মিতা ওর দিকে হেসে বলে, “বাপ্পাদিত্য” দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যকে বলে, “খাওয়ার পরে বেশ গল্প করবে। চল খেতে হবে।”

খাওয়ার টেবিলে বসে দেখল সে এক এলাহি ব্যাপারের আয়োজন করা হয়েছে। কাঁসার থালায় খেতে দিয়েছে দেবস্মিতা। টেবিলে পাতা দুটি থালা, একটি সুবির বাবুর অন্যটি বুধাদিত্যের জন্য। দুজনের থালা মুখমুখি বসানো। দেবস্মিতা অন্য একটি থালায় খাবার নিয়ে বাপ্পাদিত্যকে কোলে বসিয়ে খাওয়াতে শুরু করেন। আর ওদের খাওয়ার তদারকি করেন। চুপ করে খাওয়া শুরু হয়, কারুর মুখে বিশেষ কথা নেই, শুধু মাত্র দেবস্মিতা চাকরদের বলে খাবার নিয়ে আসতে বলেন, পরিবেশন নিজের হাতেই করেন।

খাওয়ার সময়ে বুধাদিত্য প্রশ্ন করে বাবাকে, “তোমার শরীর কেমন আছে?”

সুবির বাবু অনেকক্ষণ পরে ছেলের মুখে প্রশ্ন শুনে খুশি হন, “হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি দিল্লীতে কি করো?”

বুধাদিত্য কাষ্ঠ হেসে বলে, “চাকরি করি আবার কি করব।”

সুবিরবাবু একটু আহত হন ওর উত্তরের গড়ন দেখে, পাশে বসে দেবস্মিতা মৃদু মাথা নাড়ায় সুবির বাবুর দিকে। বুধাদিত্য লক্ষ্য করে সেই ইঙ্গিত। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে সুবির বাবুকে, “আরো তিন চার বছর আছে তোমার চাকরির তাই না?”

সুবিরবাবু উত্তর দেন, “না, বছর চারেক আগে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছি। এখন বাড়িতেই থাকি আর নিজের একটা কম্পানি খুলেছি সেটা একটু দেখি।” দেবস্মিতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “ওই দেখে, ওই সব আমি নিমিত্ত মাত্র।” দেবস্মিতা লাজুক হাসে আর ছেলে খাওয়ায়।

বুধাদিত্য, “ভালো কথা। এই বাড়ি আগে ছিল না, কত বছর হল এই বাড়ির?”

সুবিরবাবু, “বছর বারো হয়েছে মনে হয়।” দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বারো বছর কি?” দেবস্মিতা আলতো মাথা নাড়িয়ে জানায় যে বারো বছর হয়েছে বাড়ির।

বুধাদিত্যের চোখ এড়ায় না যে সুবিরবাবু পদেপদে দেবস্মিতার হাত ধরে চলে। ভদ্রমহিলা সুবিরবাবুকে তাঁর মানে বশীভূত করে রেখেছে। হুম, তাহলে হটাত এমন ভাবে ডাকা কেন? অঙ্ক কিছুই মেলাতে পারছেনা বুধাদিত্য।
খাওয়া শেষ, দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যকে নিয়ে উপরের তলায় চলে যান। সুবিরবাবু আর বুধাদিত্য দু’জনে চুপচাপ বসার ঘরে বসে থাকেন। কি জিজ্ঞেস করবে, দুজনের বুকের মাঝে সহস্র প্রশ্ন, কিন্তু ঠিক কি বলে শুরু করবে সেটা ভেবে কূলকিনারা পায় না দুজনে। এমন সময়ে দেবস্মিতা নেমে আসেন, এসে দেখেন যে দুই জনে চুপ চাপ বসে। সুবিরবাবু পেপারে মাথা ডুবিয়ে, বুধাদিত্য চুপ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে।

দেবস্মিতা সুবিরবাবুকে একটু ভারী গলায় বলেন, “কি হল, তোমরা চুপ করে বসে কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম কথা বলতে?”

সুবিরবাবু কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কি জিজ্ঞেস করব কিছু বুঝে পাচ্ছিনা।”

বুধাদিত্য চিবয়ে উত্তর দেয়, “এইত দেখে গেলাম তোমাদের সুখী সংসার। ব্যাস আবার কি চাই।”

সুবিরবাবু, “প্রতি বছর পুজোতে আস কোলকাতায়?”

বুধাদিত্য, “প্রতি বছর আসি, তবে সময় অনুযায়ী। কোন বছর পুজোতে কোন বছর শীতকালে।”

ঘড়ি দেখে বুধাদিত্য, বসার বিশেষ মন নেই আর। চোখের সামনে ওর ভাঙ্গা বাড়ির ওপরে সুখের অট্টালিকা দেখে দুঃখে আর বিদ্বেষে গাঁ রিরি করে। কোন কথা বলতে ইচ্ছে করেনা বুধাদিত্যের।

দেবস্মিতা নিজেই হেসে আবহাওয়ার সামাল দিয়ে বলে, “রাতে কি খাবে তাই বল।”

বুধাদিত্য কাষ্ঠ হেসে সুবিরবাবুকে জানায়, “না আমি রাতে থাকছি না। বিকেলে ব্লাকে ফিরে যাবো আমি।”

দেবস্মিতা আর সুবিরবাবু আহত হয়ে যান, ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। সুবিরবাবু জিজ্ঞেস করেন, “এতদিন পরে এসেছ, একটি রাত থেকে যাবে না।”

বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে ম্লান হেসে বলে, “না বেড়িয়ে পরি, অনেক দূর যেতে হবে, অনেকটা পথ একা একা হাটা বাকি। তুমি বেঁচে আছো জেনে খুশি, আমি বেঁচে আছি সেটা জেনে তুমিও খুশি।”

সুবিরবাবুর শরীর কেঁপে ওঠে, হাত বাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেন। দেবস্মিতার চোখ ছলছল করে ওঠে এক অজানা আশঙ্কায়। বুধাদিত্য ওদের দিকে তাকিয়ে হাত জোর করে বিদায় নেয়।

দেবস্মিতা শেষ চেষ্টা করে বুধাদিত্যকে আটকে রাখার জন্য, “ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি আছে, একটু বসে গেলে ভালো হত। মিস্টার গুহ, গাড়ি করে ছেড়ে দেবেন।”

বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “এতটা পথ আমি একা একা হেঁটে পাড় করেছি, বাকি রাস্তা একা হেঁটে পাড় করতে পারব, আমার জন্য চিন্তা না করাই ভালো।”

বুধাদিত্য আর দাঁড়ায় না, চোখে দুঃখের জল, রাগের জল মিলেমিশে একাকার। কান লাল হয়ে গেছে এতক্ষণ এই সুন্দর সুবাসিত অট্টালিকার পাকের মধ্যে জড়িয়ে পরে। নিজেই দরজা খুলে বাড়ির বাইরে পা রাখে। বিশাল লোহার গেট খুলে বেড়িয়ে আসার আগে শেষ বারের মতন ব্রাসের নামের ফলকের দিকে তাকায়। মায়ের নাম বেশ জ্বলজ্বল করছে ওই ফলকে। ডুকরে কেঁদে ওঠে প্রান, কিন্তু চোখ শুকিয়ে রাখে বুধাদিত্য।

মামাবাড়ি ফিরে পরের দিন প্লেনে চেপে নিজের কর্ম জীবনে ফিরে আসে। প্রমীলা দেবী, অনিন্দিতাদি বারবার জানতে চায় কি কথা হয়েছে ওর বাবার সাথে। চুপ করে থাকে বুধাদিত্য, এক বারের জন্যেও মুখ খোলেনা। বুকের পাষাণ বুকের মাঝে বয়ে নিয়ে ফিরে আসে। নিজের জীবন আবার গুছিয়ে নেয় কিছুদিনের মধ্যেই। ফিরে আসে কিছুদিনের মধ্যেই সেই পুরাতন বুধাদিত্য; কাজে, মদে ডুবিয়ে দেয় নিজেকে।

______________________________
[+] 1 user Likes pnigpong's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: দ্বিতীয় অঙ্ক (কালেক্টেড) - by pnigpong - 27-06-2020, 09:06 AM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)