27-02-2019, 05:05 PM
বাঁধা চোখের জল
নবীন ভোরের নবীন ঊষা এক নতুন পরী আর অভি কে সাদর আহ্বান জানায়। দু’জনের মনে আর কোন পরিতাপ নেই। পরীর মুখের মিষ্টি হাসি আর উচ্ছলতা অভিকে যেন নিয়ে যায় এক নতুন দিগন্তে। দুপুরের খাওয়া একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে নেয় ওরা, এবারে ফেরার পালা। সারাটা রাস্তা দু’জনে এদিক ওদিকের গল্প, ভ্রমণের গল্প করে কাটিয়ে দেয়। বল্বিন্দার ফেরার সময়ে সেই একই রাস্তা ধরে, ফাগু থেকে চায়েল হয়ে ছোটো রাস্তা।
পরী ওকে জিজ্ঞেস করে, "কালকে তোমার ফেরার ফ্লাইট কটায়?"
অভি, "আমি যদি আজ রাতে শুরু করি তাহলে কাল সকালের মধ্যে দিল্লী পৌঁছে যাব, দেখি যদি সকালের ফ্লাইটটা ধরতে পারি তাহলে দুপুরের মধ্যে বাড়ি না পেলে দুপুরের ফ্লাইট ধরব।"
পরী, "এই দুমাসে তুমি আমার বাড়ি আসবে?"
অভি, "কেন আসব না, নিশ্চয় আসবো।"
পরী, "বাসন্তি পুজোর পরে আমাকে নিতে তুমি আসবে?"
অভি, "সেটা ঠিক বলতে পারছি না পরী। আমার ফাইনাল পরীক্ষা মে মাসের শেষে। তোমার ছোটো মা আমাকে ছারবে কি না সন্দেহ আছে।"
পরী, "ছোটো মা কে আমার প্রনাম জানাবে ত?"
অভি, "সোনা মেয়ে, আমাদের যে দেখা হয়নি সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন।"
পরী ওর গালে চিমটি কেটে বলে, "অঃ দেখ আমি ত এ সব গুলে খেয়েছিলাম। আমি ত ঘুরতে গেছি আমার বান্ধবীদের সাথে আর তুমি ত একা একা পাহাড়ে ঘুরে বেরাচ্ছ তাই না, দুষ্টু ছেলে?" তারপরে নাক কুঁচকে অভিকে খ্যাপানোর জন্য জিজ্ঞেস করে, "কি গো অভি, শীতের রাতে কাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছ তুমি?"
অভি ওর দিকে হেসে বলে, "তোমাকে একটা ভাল গল্প বানাতে হবে কল্যানির জন্য আর তোমার মায়ের আর ছোটো মা'র জন্য। সেটা ফেরার আগে ভেবে রেখ।"
পরী, "তাঁর জন্য ভাবতে হবে না। আমি খুব সুন্দর গল্প বলতে পারি ওদের কে এমন গল্প বলব যে ওরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।"
অভি, "হ্যাঁ তোমার গল্পের কথা আর তোমার মাথার বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।"
পরী, "ওই দেখ তোমাকে ত আমি একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি।"
অভি, "বাপরে আরও কিছু বলার বাকি আছে নাকি তোমার?"
পরী, "না বাবা না, তুমি না সবসময়ে খালি খালি ওই সব কথাই ভাবো। তোমার মৃগাঙ্কের কথা মনে আছে, সুব্রতদার বন্ধু, এক সময়ে ও হাথ ধুয়ে আমার পেছনে পরে ছিল জানো।"
অভি মাথা নাড়ায়, "হ্যাঁ জানি।"
পরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি জানলে কি করে?"
অভি, "মনে আছে বউভাতের আগের দিন রাতে তোমার ছোটো মা আর বাকিদের মধ্যে তুমুল বাকবিতন্ড লেগেছিল। সেদিন রাতে আমরা মদ খেয়েছিলাম আর মদের নেশায় মৃগাঙ্ক আমাদের ওর মনের কথা বলে ফেলেছিল।"
ওরা তাড়াতাড়ি ছ’টার মধ্যেই কাল্কা পৌঁছে যায়। কাল্কা পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। অভি বলবিন্দার কে দুরে গাড়ি রাখতে নির্দেশ দেয়, যাতে কারুর চোখে ওর গাড়ি না পরে। বলবিন্দার ওদের স্টেসানের সামনে নামিয়ে দিয়ে স্টেসান চত্তর থেকে বেশ কিছু দুরে গাড়ি দাঁড় করায়।
গাড়ি থেকে নেমে সব থেকে আগে অভি মাকে ফোন করে জানায় যে ও কাল্কা পৌঁছে গেছে, কাল সকালের মধ্যে ও দিল্লী পৌঁছতে পারলে সকালের ফ্লাইট ধরবে না হলে দুপুরের ফ্লাইট ধরে বাড়ি ফিরবে। তারপরে সুপ্রতিমদাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ফেরার পথে ওর সাথে আর দেখা হবে না কেননা অভি সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবে।
পরীর ব্যাগ হাতে নিয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করে স্টেসানের দিকে। সারাক্ষণ পরী অভির হাত নিজের হাতের মধ্যে করে রাখে, মনে হয় যেন ছারলেই যদি পালিয়ে যায় অভি। স্টেসানের গেটে এসে অভি পরীর ব্যাগ পরীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পরীর দু’চোখ ছলছল করে ওঠে।
অভি তর্জনী দিয়ে কপালে আলতো টোকা মেরে বলে, "বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন। তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও আর কল্যাণীদের সাথে দেখা করে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এস। আমি ওই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষা করব।"
শেষ বারের মতন দু’জনের আঙ্গুল এঁকে অপরকে ছুঁল। পরীর যেন পা আর চলছে না, অভি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনে, যতক্ষণ না পরী ওই গেটের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে গেল স্টেসানের ভিড়ে।
তিরিশ মিনিট যেন তিরিশটা বছর, অধির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে অভি, কখন ফিরে আসবে পরী। মনের মধ্যে এক অজানা আলোড়ন চলছে, ভেতরে কি হচ্ছে? কল্যানি ওকে কি জিজ্ঞেস করছে? পরী ওর বান্ধবীদের কে কি বলে বের হবে? আদৌ বের হতে পারবে কিনা? শেষ দেখা কি একবারের জন্য হবে না।
কিছুক্ষণ পরে অভি দেখতে পেল যে তিন জন মহিলা গেটের বাইরে হেঁটে আসছে, ভাল করে দেখে বুঝল যে ওর মধ্যে একজন পরী। অভির তৃষ্ণার্ত প্রানে যেন জল এল। আনমনে এদিক ওদিকে তাকাল পরী, একবার ওদের চারচোখ এক হল কিন্তু পরী ওর দিকে পাত্তা না দিয়ে আবার কল্যানির সাথে গল্প করতে শুরু করে দিল। ওই দেখে অভির বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা যেন দুমদুম করে বাজতে শুরু করে দিল। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে এল অভির, কি হতে চলেছে এবারে? আদৌ পরী ওর সাথে দেখা করবে ত?
বেশ কিছু সময় আরও চলে গেল, অভি ওদের দিকে আর চোখে তাকিয়ে থাকে, পরী কি করছে। পরী আড় চোখে একবার অভির দিকে তাকাল, চাহনি যেন বলছে, "সোনা একটু অপেক্ষা করো।"
কল্যাণীদের সাথে গল্প করতে করতে পরী হটাত করে কল্যানিকে ওর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। ওরা সবাই অভির দিকে এগিয়ে এল। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে যেন ভুত দেখেছে। পরী ওর চোখের চাহনি দেখে হাসি থামাতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি টিকে প্রাণপণে বুকের ভেতরে চেপে দেয়। পরী ওর দিকে চোখ টিপে অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে, "আরে অভিমন্যু যে, এখানে কি করে?"
কল্যানি আর রানী ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যেন ওরা কোনো ভুত দেখেছে। পরীর ঠোঁটে ওর পুর নাম শুনে দাতে দাঁত চেপে নিজের হাসিটিকে সংবরণ করে। অভিকে পরী যেমন শিখিয়ে দিয়েছে ঠিক সেই রকম উত্তর দিতে হবে না হলে রানী রাগ করবেন।
অভি উত্তর দেয়, "শুক্রবার চণ্ডীগড়ে একটা ইন্টারভিউ ছিল, সেটা সেরে দেখলাম যে হাতে বেশ সময় আছে তাই সিমলা ঘুরতে চলে এলাম। এই এখন দিল্লী ফিরব তা মাঝ পথে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য এখানে চা খাওয়া।"
তারপরে পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "শুচিস্মিতা, তুমি এখানে কি করে?"
পরী হাসি চেপে নেয়, মনে মনে বুঝতে পারে যে যেহেতু ও ওর পুরো নাম ধরে ডেকেছে তাই অভিও ওর পুরো নাম নিয়েছে।
পরী কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কল্যানি ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিল, "আমরা সিমলা কুল্লু মানালি ঘুরতে এসেছিলাম আমাদের বরের সাথে আর শুচিস্মিতা ও আমাদের সাথে এসেছিল। আজ রাতে ফিরে যাচ্ছি।"
পরী কল্যানির দিকে কৃতজ্ঞ নিয়ে তাকাল। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক জন জানে যে কে কে মিথ্যে বলছে, তাও পরী আর অভি প্রাণপণে বুকের এক কোনে চেপে রাখে ফুটন্ত হাসি।
রানী অভি কে জিজ্ঞেস করল, "তুমি উলুপি ম্যাডামের ছেলে তাই না?"
মাথা নাড়ায় অভি, "হ্যাঁ।"
বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যায় অভির, রানী আর কল্যানী কি করে মাকে চেনে?
"তোমরা আমার মাকে চেন?"
কল্যানি উত্তর দেয়, "হ্যাঁ চিনি। আমরা ত সেই ছোটো বেলা থেকে বন্ধু, আমি আর পরী একই কলেজে পড়েছি যেখানে উলুপি ম্যাডাম পড়ান।"
পরী দেখল যে এবারে হয়ত ওরা অভিকে প্রশ্নের জালে জড়িয়ে ধরবে, ও কল্যাণী কে চুপ করতে বলে, "কি রে তুই, ওকে কি তোরা হিটলারের মতন প্রশ্ন জালে বিদ্ধ করবি নাকি?"
তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোমার হাতে কি একটু সময় আছে? তুমি কি আমাদের ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত থাকতে পারবে?"
রানী পরীকে বলে, "ও থাকতে যাবে কেন? ওর দেরি হয়ে যেতে পারে। আমাদের ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে সেই মাঝ রাত, ও কি করে অত সময় আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে? ওকে যেতে দে।"
পরী অল্প বিরক্তি হয়ে উঠল, অভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে রানী কে বলে, "আমার ছোটো মা’র ছেলে, অনেকদিন পরে এই অচেনা জায়গায় দেখা হয়েছে। আমি যা বলব ও তাই করবে।"
রানী ওর কথা শুনে মৃদু রেগে গেল, "যা ভালো বুঝিস তাই কর, আমি ত শুধু ওর ভালোর জন্যে বলছিলাম। ওর যদি কোনও অসুবিধে না থাকে তাহলে আমার কি অসুবিধে হতে পারে?"
অভির বুঝতে দেরি হল না যে পরী রানীর কথায় আঘাত পেয়েছে, তাই কথা ঘুরিয়ে ওদের কে জিজ্ঞেস করল যে ওদের বরেরা কোথায় গেছে। কল্যাণী উত্তর দিল যে ওদের অয়েটিং রুমে ব্যাগ দেখার দায়িত্ব দিয়ে দু’জনে মিলে কোথাও আড্ডা মারতে বেড়িয়েছে। পরী ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানিয়ে দিল যে, "আমাকে একা ফেলে যদি কোথাও যাও তাহলে দেখে নিও আমি কি করি।"
অভি ওর চোখের চাহনি দেখে ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় যে, "আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।"
কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে দিপঙ্কর আর রামানুজ উদয় হল। পরীকে দেখে দিপঙ্কর জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার, অর্জুন বাবুর সাথে হানিমুনে কোথায় কোথায় যাওয়া হয়েছিল?"
দিপঙ্করের কোথা শুনে পরীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কল্যানির দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে। কল্যাণী দিপঙ্করকে মৃদু ধাক্কা মেরে জানিয়ে দিল যে অভি ওখানে উপস্থিত। দিপঙ্কর অভিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। রামানুজ হাত বাড়িয়ে দিল অভির দিকে।
অভি ওদেরকে জিজ্ঞেস করল যে ওরা এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না কোথাও গিয়ে বসতে চায়। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল যে কোন রেস্টুরেনটে গিয়ে বসা যেতে পারে। সবাই রেস্তুরেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করে, পরী আর অভি বাকিদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। পরীর মুখ গম্ভির, বুকের কাছে হাত আড় করে নিজেকে সামলে নিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে অভির পাশাপাশি চুপ করে হাঁটতে থাকে।
পরীর মনের অবস্থা দেখে অভি একটু ঘাবড়ে যায় যে আবেগের বশে পরী কিছু না উলটোপালটা করে ফেলে। বুকটা টনটন করতে শুরু করে অভির, পরী এত কাছে থেকেও কত দুরে মনে হয়। সবার সম্মুখে ওকে জড়িয়ে সান্তনা দিতে পারছেনা অভি। বড় কষ্ট হয় পরীর ব্যাথিত চেহারা দেখে।
রেস্তুরেন্টে বসে সবাই গল্প করে কে কি রকম ভাবে ঘুরল। কিছু পরে অভি কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করল, "আমরা যখন এত খোলা মেলা হয়ে গেছি ত একটা কোথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?"
কল্যাণী ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, "হ্যাঁ।"
পরীর দিকে চোরা চাহনি তে দেখে কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করল, "এই অর্জুন টি কে?"
ওর প্রশ্ন শুনে কল্যাণী আর রানী একটু থমকে গেল, পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে দু’জনে মনের মধ্যে চলতে থাকে যে সঠিক উত্তর দেবে কি দেবে না। পরী হালকা মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে ওরা অভিমন্যু কে অর্জুনের কোথা বলতে পারে।
কল্যাণী, "সত্যি বলতে শুচিস্মিতা আমাদের কে অর্জুনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু ত জানায় নি তবে ওর মুখ থেকে যা শুনেছি তাতে মনে হল ও তোমার ইন্দ্রানি মাসির দেওর, পরীর খুঁজে পাওয়া ভালবাসার মানুষ। আমি ত এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে আমরা এত ভাল বান্ধবী তাও কেন আমাদের কাছ থেকে অর্জুনের কথা ও চেপে গেল।"
রানী পরী কে জিজ্ঞেস করল, "পরী কেই অর্জুনের কথা জিজ্ঞেস করতে দোষ কি।"
পরী অস্বাভাবিক ভাবে চুপ, বুকের মধ্যে যেন ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা ককিয়ে উঠছে বারে বারে। খুব ধির স্বরে উত্তর দিল, "আমরা দুজনে বেশ ভালো ঘুরেছি, ব্যাস এইটুকু এখন বলতে পারি। বাকি পরে শুনে নিস তোরা।"
গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কেটে যায়। দিপঙ্কর ঘড়ি দেখে, "আরে দশটা বাজে যে।"
ওরা রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্টেসানের দিকে পা বাড়ায়। পরী ওদের বলে যে ও কিছুক্ষণ আরও অভির সাথে কাটাতে চায়। কল্যাণী ওকে বাঁধা দেয় না। বাকিরা স্টেসানে ঢুকে পরে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে পরী আর অভি।
দুজনে চুপচাপ হাইওয়ের দিকে হাঁটতে থাকে। পরীর মুখের ওপরে ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথার ছবি। মাঝ রাস্তায় অভি ওকে দাঁড় করিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি হল এত চুপ করে কেন আছো?"
পরী ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলে, "তুমি চলে যাও।"
অভি ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে বুকের কাছে টেনে আনে। অভির হাতের ছোঁয়া পেয়ে পরী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে পরী। অভি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু পরীর কান্না আর থামতে চায় না।
কান্না ভেজা গলায় অভিকে বলে, "সোনা তুমি চলে যাও, প্লিস। এই ঠাণ্ডার রাতে আমার ট্রেন ছেড়ে দেবে আর তুমি একা একা স্টেসানে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই দৃশ্য আমার সহ্য হবে না, আমি ভেঙ্গে পড়ব অভি। আমাকে শান্ত করার জন্য আমার বান্ধবীরা আমার সাথে থাকবে কিন্তু তুমি? আমি চলে যাবার পরে তুমি কি করে থাকবে? আমি তোমার বুকের ওই ব্যাথা সহ্য করতে পারব না অভি, প্লিস তুমি এখুনি চলে যাও।"
অভি ওর মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে বলে, "আমার জন্য চিন্তা কোরোনা, আমি ঠিক থাকব।"
পরী, "না তুমি চলে যাও। তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়াবে সেই দেখে আমি আরও ভেঙ্গে পড়ব অভি, প্লিস চলে যাও।"
অভি, "ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়।"
অভি ওর চোখের জল মুছে ওকে শান্ত হয়ে অনুরধ করে। তারপরে ওরা দু’জনে স্টেসানের দিকে হাটা দেয়। স্টেসানের বাইরে এসে দেখে যে কল্যাণী আর রানী ওদের পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরীর চোখের পাতা ভিজে দেখে কল্যাণী উৎসুক হয়ে অভির দিকে তাকায়। অভি কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না, কিছুক্ষণ মাথা চুলকে উত্তর দেয় যে পরী ওর ছোটো মার কথা মনে করে মন খারাপ হয়েছে তাই চোখে জল।
কল্যাণী ওর কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। অভির দিকে একভাবে চেয়ে থাকে কল্যাণী। অভি বুক দুরদুর করে ওঠে, কল্যাণী কি কিছু বুঝতে পেরে গেছে? ওরা যা ভয় পাচ্ছিল সেটা ঘটে যায়। কল্যাণী অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "মনে হচ্ছে কিছু অঙ্ক আমি মেলাতে পারছি না।"
অভির দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, "আজ বিকেলে তোমাকে এখানে দেখে ঠিক অঙ্ক মেলে নি আমার। তোমার চশমা, ঠিক এই চশমা ছিল অর্জুনের চোখে তাই না। খুলে যদি বলি তাহলে অর্জুন নামে কেউ নেই, তুমি ছিলে শুচিস্মিতার সাথে। কি আমি ঠিক বলছি কি না?"
ওই কথা শুনে অভির মনে হল যেন কেউ ওর মাথার ওপরে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা যেকোনো সময়ে ফেটে বেড়িয়ে আসবে এমন জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে। পরী ওর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে, ওরা যে ধরা পরে গেছে। দু’চোখে বন্যা নামে, পরী ওর হাত শক্ত করে ধরে নেয়, কি হবে এবারে।
কল্যাণী পরীর মুখ দেখে সব বুঝতে পেরে যায়। পরীকে জিজ্ঞেস করে, "তোর সাথে অভিমন্যু ছিল তাই ত?"
পরী ওর দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে তাকায়। সারা চেহারায় ফুটে ওঠে কাতর আবেদন।
কল্যাণী ওর মুখ দেখে মৃদু হেসে বলে, "চিন্তা নেই তোর। একথা কেউ জানবে না, পরী।"
ওরা সবাই মিলে অয়েটিং রুমের দিকে হাতা দিল। কল্যাণীর কথা শুনে দু’জনের বুকের ওপরে এতক্ষণ যে পাথর চাপা ছিল সেটা সরে যায়। অয়েটিং রুমে বসা, দিপঙ্কর আর রামানুজ ওদের দেখে একটু ঘাবড়ে যায়। রানী ওদের কে সব কথা বলে। কথা শুনে সবাই চুপ। অভির আর পরীর ধুকপুক করতে থাকে, কি হবে কি হবে।
রানী পরীর চিবুক আঙ্গুল দিয়ে নেড়ে হেসে বলে, "অরে মেয়ে চিন্তা করিস না। এই খবর আমাদের কাছে গোপনে থাকবে।"
সবাই মাথা নেড়ে সায় জানায় যে এই কথা ওরা কাউকে জানাবে না।
কল্যাণী পরীর পাশেই বসে ছিল, ওর জড়িয়ে ধরে বলল, "তুই এত চিন্তা করছিস কেন? ওকে ভালবাসিস বলে চিন্তা করছিস না তুই ওর চেয়ে বড় বলে চিন্তা করছিস। তুই সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে আর ও একটা বুদ্ধিমান ছেলে। তোরা একে অপরকে ভালবাসিস, এতে পাপ কোথায়? তুই ওর সম্পর্কের মাসি হস তাই ভয়? তোদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। ও তোর কে হয়? তোর মায়ের মামাত দিদির, সেজ মেয়ের ছেলে। তোদের সম্পর্ক অনেক অনেক দুরের, কেউ কাউকে চিন্তিস ও না। ওটা হয়েছে কেননা উলুপি ম্যাডাম তোর বাড়ির কাছের কলেজে পড়ান বলে তোদের পরিরবারে সাথে সম্পর্ক, তা না হলে তোরা কেউ কাউকে চিন্তস ও না।"
দিপঙ্কর অভির পিঠ চাপড়ে বলল, "ব্রাদার এত ভয় পাবার কি আছে? তুমি ত ভায়া আমার সব থেকে সুন্দরী শালি টাকে হাত করে নিলে আর তার সাথে একা একা কোন এক দুর্গম স্থানে ঘুরেও এলে। তোমার সাহসের বলিহারি।"
পরীর ওদের কে মন থেকে কৃতজ্ঞতা জানাল, "তোদের কি করে যে ধন্যবাদ জানাব আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না রে।"
রানী ওদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোরা দুটি শয়তান, সময় কেমন কাটালি?"
অভির দিকে চোখ মেরে জিজ্ঞেস করে, "তুমি আমার বান্ধবিকে বেশি ব্যাথা দাও নি ত?"
ওর কথা শুনে লজ্জায় পরীর মুখ লাল হয়ে গেল, অভির দিকে লাজুক মুখে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হেসে ফেলল পরী। পরীর পুনরায় হসি মুখ দেখে অভির মন থেকে চিন্তার পাথর সরে যায়।
কল্যাণী পরীর গাল টিপে জিজ্ঞেস করে, "তোরা তাহলে বেড়াতে গিয়ে অনেক মজা করেছিস তাই না? আমি তোর চোখের হাসি দেখে বুঝতে পেরে গেছি সুতরাং আমার কাছে লুকিয়ে বিশেষ লাভ হবে না, পরী।"
চিন্তার মেঘ কেটে গেছ, ওরা সবাই আবার ঘোরার গল্পে মেতে উঠল, কে কি রকম কোথায় কোথায় ঘুরেছে তাঁর বর্ণনা করতে শুরু করে দিল। পরীর মুখে চিতকুলের বর্ণনা শুনে ওরা চারজনে অভিভুত। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে থাকে ওর হাত। সময় খুব দ্রুত বয়ে চলে। স্টেসানের লাউডস্পিকারে ট্রেনের আগমনের ঘোষণা শুনে ওদের সময়ের কথা মনে পরে যায়।
দিপঙ্কর আর রামানুজ ট্রেনে উঠে ওদের সিটে নিজেদের ব্যাগ পত্র রাখে। পরী অভির হাত শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে প্লাটফরমের ওপরে, ওকে ছাড়তে একদম মন চাইছে না। অভি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কবে আবার দেখা হবে পরীর সাথে, কি করে ছেড়ে যাবে পরীকে। বুকের ভেতর টনটন করে ওঠে আসন্ন বিরহ বেদনায়। কল্যাণী পরীর কাঁধে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে ট্রেনে উঠতে। পরী অভির হাত ছাড়তে চায় না।
কান্না ভেজা চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমি তোমাকে বলেছিলাম তুমি চলে যাও, তুমি আমার কথা শুনলে না। আমি তোমাকে বলেছিলাম। আমি তোমাকে একা ফেলে কি করে যাব অভি। আমি তোমাকে বার বার বলেছিলাম চলে যেতে, অভি।"
কল্যাণী পরীকে জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। অভি ওর মুখ আঁজলা করে নিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে গালের অপরের জলের দাগ মুছিয়ে দেয়। গালে অভির হাতের পরশ পেয়ে আরও যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে পরী।
অভি, "প্লিস ছোটো বাচ্চার মতন কাঁদে না সোনা, আমি ঠিক আছি সোনা।"
কল্যাণী অভিকে জানায় যে ও পরীকে সামলে নেবে। অভি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে, বুকের ভেতরে বিরহের সুর বেজে ওঠে। ওর ভয় করে আবার যেন পরী অজ্ঞান না হয়ে যায়।
অভি, "আমি কথা দিচ্ছি যে এই দু’মাসে তোমার সাথে কিছু করে হক আমি দেখা করব।"
কল্যাণী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "দু’মাস অনেক লম্বা সময়।" মাথা নাড়ায় অভি, "হ্যাঁ কিন্তু কি করা যাবে।"
কল্যাণী পরীকে নিয়ে ট্রেনের দিকে হাটা লাগায়। কল্যাণী ট্রেনে উঠে পরে। অভি একমনে দেখতে থাকে পরীকে। এমন সময় কল্যাণীর হাত ছাড়িয়ে পরী ঘুরে দাঁড়ায়, আর দৌড়ে এসে অভির বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। অভি দুহাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পরীকে, যেন পৃথিবীর কোন শক্তি ওদের কে বিচ্ছিন্ন করেত না পারে। পরীর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে অভি। অভির বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে পরী।
ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। পরীকে কোন মতে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে। পরী দৌড়ে ওর বান্ধবীদের কাছে চলে যায়। ট্রেন ছেড়ে দেয়, পরী ওর দিকে জল ভরা চোখ আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কল্যাণী ওকে জড়িয়ে ধরে থাকে। পরী ওর ডান হাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে, তাঁর ডগায় একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে অভির দিকে ছুঁড়ে দেয়। অভি পরীর ছোড়া সেই চুমু টা লুফে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে।
অভি ডান হাতের তর্জনী উঠায় ইশারা করে "আই" তারপরে বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী মেলে ধরে, ইশারা করে "এল" শেষে মধ্যমা আর অনামিকা ফাঁক করে ইশারা করে "ইউ"।
ট্রেন ঘন কালো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় কিছুক্ষণে মধ্যেই। অভি একা দাঁড়িয়ে থাকে খালি প্লাটফরমের ওপরে, বুক টা হুহু করে ওঠে। বাকি রাস্তা ওকে একা একা ফিরতে হবে, সাথে থাকবে না পরী। পকেট থেকে রুমাল টি বের করে একবার পরীর গায়ের গন্ধ মুখে মেখে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
নবীন ভোরের নবীন ঊষা এক নতুন পরী আর অভি কে সাদর আহ্বান জানায়। দু’জনের মনে আর কোন পরিতাপ নেই। পরীর মুখের মিষ্টি হাসি আর উচ্ছলতা অভিকে যেন নিয়ে যায় এক নতুন দিগন্তে। দুপুরের খাওয়া একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে নেয় ওরা, এবারে ফেরার পালা। সারাটা রাস্তা দু’জনে এদিক ওদিকের গল্প, ভ্রমণের গল্প করে কাটিয়ে দেয়। বল্বিন্দার ফেরার সময়ে সেই একই রাস্তা ধরে, ফাগু থেকে চায়েল হয়ে ছোটো রাস্তা।
পরী ওকে জিজ্ঞেস করে, "কালকে তোমার ফেরার ফ্লাইট কটায়?"
অভি, "আমি যদি আজ রাতে শুরু করি তাহলে কাল সকালের মধ্যে দিল্লী পৌঁছে যাব, দেখি যদি সকালের ফ্লাইটটা ধরতে পারি তাহলে দুপুরের মধ্যে বাড়ি না পেলে দুপুরের ফ্লাইট ধরব।"
পরী, "এই দুমাসে তুমি আমার বাড়ি আসবে?"
অভি, "কেন আসব না, নিশ্চয় আসবো।"
পরী, "বাসন্তি পুজোর পরে আমাকে নিতে তুমি আসবে?"
অভি, "সেটা ঠিক বলতে পারছি না পরী। আমার ফাইনাল পরীক্ষা মে মাসের শেষে। তোমার ছোটো মা আমাকে ছারবে কি না সন্দেহ আছে।"
পরী, "ছোটো মা কে আমার প্রনাম জানাবে ত?"
অভি, "সোনা মেয়ে, আমাদের যে দেখা হয়নি সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন।"
পরী ওর গালে চিমটি কেটে বলে, "অঃ দেখ আমি ত এ সব গুলে খেয়েছিলাম। আমি ত ঘুরতে গেছি আমার বান্ধবীদের সাথে আর তুমি ত একা একা পাহাড়ে ঘুরে বেরাচ্ছ তাই না, দুষ্টু ছেলে?" তারপরে নাক কুঁচকে অভিকে খ্যাপানোর জন্য জিজ্ঞেস করে, "কি গো অভি, শীতের রাতে কাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছ তুমি?"
অভি ওর দিকে হেসে বলে, "তোমাকে একটা ভাল গল্প বানাতে হবে কল্যানির জন্য আর তোমার মায়ের আর ছোটো মা'র জন্য। সেটা ফেরার আগে ভেবে রেখ।"
পরী, "তাঁর জন্য ভাবতে হবে না। আমি খুব সুন্দর গল্প বলতে পারি ওদের কে এমন গল্প বলব যে ওরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।"
অভি, "হ্যাঁ তোমার গল্পের কথা আর তোমার মাথার বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।"
পরী, "ওই দেখ তোমাকে ত আমি একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি।"
অভি, "বাপরে আরও কিছু বলার বাকি আছে নাকি তোমার?"
পরী, "না বাবা না, তুমি না সবসময়ে খালি খালি ওই সব কথাই ভাবো। তোমার মৃগাঙ্কের কথা মনে আছে, সুব্রতদার বন্ধু, এক সময়ে ও হাথ ধুয়ে আমার পেছনে পরে ছিল জানো।"
অভি মাথা নাড়ায়, "হ্যাঁ জানি।"
পরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি জানলে কি করে?"
অভি, "মনে আছে বউভাতের আগের দিন রাতে তোমার ছোটো মা আর বাকিদের মধ্যে তুমুল বাকবিতন্ড লেগেছিল। সেদিন রাতে আমরা মদ খেয়েছিলাম আর মদের নেশায় মৃগাঙ্ক আমাদের ওর মনের কথা বলে ফেলেছিল।"
ওরা তাড়াতাড়ি ছ’টার মধ্যেই কাল্কা পৌঁছে যায়। কাল্কা পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। অভি বলবিন্দার কে দুরে গাড়ি রাখতে নির্দেশ দেয়, যাতে কারুর চোখে ওর গাড়ি না পরে। বলবিন্দার ওদের স্টেসানের সামনে নামিয়ে দিয়ে স্টেসান চত্তর থেকে বেশ কিছু দুরে গাড়ি দাঁড় করায়।
গাড়ি থেকে নেমে সব থেকে আগে অভি মাকে ফোন করে জানায় যে ও কাল্কা পৌঁছে গেছে, কাল সকালের মধ্যে ও দিল্লী পৌঁছতে পারলে সকালের ফ্লাইট ধরবে না হলে দুপুরের ফ্লাইট ধরে বাড়ি ফিরবে। তারপরে সুপ্রতিমদাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ফেরার পথে ওর সাথে আর দেখা হবে না কেননা অভি সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবে।
পরীর ব্যাগ হাতে নিয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করে স্টেসানের দিকে। সারাক্ষণ পরী অভির হাত নিজের হাতের মধ্যে করে রাখে, মনে হয় যেন ছারলেই যদি পালিয়ে যায় অভি। স্টেসানের গেটে এসে অভি পরীর ব্যাগ পরীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পরীর দু’চোখ ছলছল করে ওঠে।
অভি তর্জনী দিয়ে কপালে আলতো টোকা মেরে বলে, "বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন। তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও আর কল্যাণীদের সাথে দেখা করে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এস। আমি ওই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষা করব।"
শেষ বারের মতন দু’জনের আঙ্গুল এঁকে অপরকে ছুঁল। পরীর যেন পা আর চলছে না, অভি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনে, যতক্ষণ না পরী ওই গেটের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে গেল স্টেসানের ভিড়ে।
তিরিশ মিনিট যেন তিরিশটা বছর, অধির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে অভি, কখন ফিরে আসবে পরী। মনের মধ্যে এক অজানা আলোড়ন চলছে, ভেতরে কি হচ্ছে? কল্যানি ওকে কি জিজ্ঞেস করছে? পরী ওর বান্ধবীদের কে কি বলে বের হবে? আদৌ বের হতে পারবে কিনা? শেষ দেখা কি একবারের জন্য হবে না।
কিছুক্ষণ পরে অভি দেখতে পেল যে তিন জন মহিলা গেটের বাইরে হেঁটে আসছে, ভাল করে দেখে বুঝল যে ওর মধ্যে একজন পরী। অভির তৃষ্ণার্ত প্রানে যেন জল এল। আনমনে এদিক ওদিকে তাকাল পরী, একবার ওদের চারচোখ এক হল কিন্তু পরী ওর দিকে পাত্তা না দিয়ে আবার কল্যানির সাথে গল্প করতে শুরু করে দিল। ওই দেখে অভির বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা যেন দুমদুম করে বাজতে শুরু করে দিল। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে এল অভির, কি হতে চলেছে এবারে? আদৌ পরী ওর সাথে দেখা করবে ত?
বেশ কিছু সময় আরও চলে গেল, অভি ওদের দিকে আর চোখে তাকিয়ে থাকে, পরী কি করছে। পরী আড় চোখে একবার অভির দিকে তাকাল, চাহনি যেন বলছে, "সোনা একটু অপেক্ষা করো।"
কল্যাণীদের সাথে গল্প করতে করতে পরী হটাত করে কল্যানিকে ওর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। ওরা সবাই অভির দিকে এগিয়ে এল। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে যেন ভুত দেখেছে। পরী ওর চোখের চাহনি দেখে হাসি থামাতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি টিকে প্রাণপণে বুকের ভেতরে চেপে দেয়। পরী ওর দিকে চোখ টিপে অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে, "আরে অভিমন্যু যে, এখানে কি করে?"
কল্যানি আর রানী ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যেন ওরা কোনো ভুত দেখেছে। পরীর ঠোঁটে ওর পুর নাম শুনে দাতে দাঁত চেপে নিজের হাসিটিকে সংবরণ করে। অভিকে পরী যেমন শিখিয়ে দিয়েছে ঠিক সেই রকম উত্তর দিতে হবে না হলে রানী রাগ করবেন।
অভি উত্তর দেয়, "শুক্রবার চণ্ডীগড়ে একটা ইন্টারভিউ ছিল, সেটা সেরে দেখলাম যে হাতে বেশ সময় আছে তাই সিমলা ঘুরতে চলে এলাম। এই এখন দিল্লী ফিরব তা মাঝ পথে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য এখানে চা খাওয়া।"
তারপরে পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "শুচিস্মিতা, তুমি এখানে কি করে?"
পরী হাসি চেপে নেয়, মনে মনে বুঝতে পারে যে যেহেতু ও ওর পুরো নাম ধরে ডেকেছে তাই অভিও ওর পুরো নাম নিয়েছে।
পরী কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কল্যানি ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিল, "আমরা সিমলা কুল্লু মানালি ঘুরতে এসেছিলাম আমাদের বরের সাথে আর শুচিস্মিতা ও আমাদের সাথে এসেছিল। আজ রাতে ফিরে যাচ্ছি।"
পরী কল্যানির দিকে কৃতজ্ঞ নিয়ে তাকাল। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক জন জানে যে কে কে মিথ্যে বলছে, তাও পরী আর অভি প্রাণপণে বুকের এক কোনে চেপে রাখে ফুটন্ত হাসি।
রানী অভি কে জিজ্ঞেস করল, "তুমি উলুপি ম্যাডামের ছেলে তাই না?"
মাথা নাড়ায় অভি, "হ্যাঁ।"
বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যায় অভির, রানী আর কল্যানী কি করে মাকে চেনে?
"তোমরা আমার মাকে চেন?"
কল্যানি উত্তর দেয়, "হ্যাঁ চিনি। আমরা ত সেই ছোটো বেলা থেকে বন্ধু, আমি আর পরী একই কলেজে পড়েছি যেখানে উলুপি ম্যাডাম পড়ান।"
পরী দেখল যে এবারে হয়ত ওরা অভিকে প্রশ্নের জালে জড়িয়ে ধরবে, ও কল্যাণী কে চুপ করতে বলে, "কি রে তুই, ওকে কি তোরা হিটলারের মতন প্রশ্ন জালে বিদ্ধ করবি নাকি?"
তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোমার হাতে কি একটু সময় আছে? তুমি কি আমাদের ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত থাকতে পারবে?"
রানী পরীকে বলে, "ও থাকতে যাবে কেন? ওর দেরি হয়ে যেতে পারে। আমাদের ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে সেই মাঝ রাত, ও কি করে অত সময় আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে? ওকে যেতে দে।"
পরী অল্প বিরক্তি হয়ে উঠল, অভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে রানী কে বলে, "আমার ছোটো মা’র ছেলে, অনেকদিন পরে এই অচেনা জায়গায় দেখা হয়েছে। আমি যা বলব ও তাই করবে।"
রানী ওর কথা শুনে মৃদু রেগে গেল, "যা ভালো বুঝিস তাই কর, আমি ত শুধু ওর ভালোর জন্যে বলছিলাম। ওর যদি কোনও অসুবিধে না থাকে তাহলে আমার কি অসুবিধে হতে পারে?"
অভির বুঝতে দেরি হল না যে পরী রানীর কথায় আঘাত পেয়েছে, তাই কথা ঘুরিয়ে ওদের কে জিজ্ঞেস করল যে ওদের বরেরা কোথায় গেছে। কল্যাণী উত্তর দিল যে ওদের অয়েটিং রুমে ব্যাগ দেখার দায়িত্ব দিয়ে দু’জনে মিলে কোথাও আড্ডা মারতে বেড়িয়েছে। পরী ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানিয়ে দিল যে, "আমাকে একা ফেলে যদি কোথাও যাও তাহলে দেখে নিও আমি কি করি।"
অভি ওর চোখের চাহনি দেখে ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় যে, "আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।"
কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে দিপঙ্কর আর রামানুজ উদয় হল। পরীকে দেখে দিপঙ্কর জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার, অর্জুন বাবুর সাথে হানিমুনে কোথায় কোথায় যাওয়া হয়েছিল?"
দিপঙ্করের কোথা শুনে পরীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কল্যানির দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে। কল্যাণী দিপঙ্করকে মৃদু ধাক্কা মেরে জানিয়ে দিল যে অভি ওখানে উপস্থিত। দিপঙ্কর অভিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। রামানুজ হাত বাড়িয়ে দিল অভির দিকে।
অভি ওদেরকে জিজ্ঞেস করল যে ওরা এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না কোথাও গিয়ে বসতে চায়। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল যে কোন রেস্টুরেনটে গিয়ে বসা যেতে পারে। সবাই রেস্তুরেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করে, পরী আর অভি বাকিদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। পরীর মুখ গম্ভির, বুকের কাছে হাত আড় করে নিজেকে সামলে নিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে অভির পাশাপাশি চুপ করে হাঁটতে থাকে।
পরীর মনের অবস্থা দেখে অভি একটু ঘাবড়ে যায় যে আবেগের বশে পরী কিছু না উলটোপালটা করে ফেলে। বুকটা টনটন করতে শুরু করে অভির, পরী এত কাছে থেকেও কত দুরে মনে হয়। সবার সম্মুখে ওকে জড়িয়ে সান্তনা দিতে পারছেনা অভি। বড় কষ্ট হয় পরীর ব্যাথিত চেহারা দেখে।
রেস্তুরেন্টে বসে সবাই গল্প করে কে কি রকম ভাবে ঘুরল। কিছু পরে অভি কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করল, "আমরা যখন এত খোলা মেলা হয়ে গেছি ত একটা কোথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?"
কল্যাণী ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, "হ্যাঁ।"
পরীর দিকে চোরা চাহনি তে দেখে কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করল, "এই অর্জুন টি কে?"
ওর প্রশ্ন শুনে কল্যাণী আর রানী একটু থমকে গেল, পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে দু’জনে মনের মধ্যে চলতে থাকে যে সঠিক উত্তর দেবে কি দেবে না। পরী হালকা মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে ওরা অভিমন্যু কে অর্জুনের কোথা বলতে পারে।
কল্যাণী, "সত্যি বলতে শুচিস্মিতা আমাদের কে অর্জুনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু ত জানায় নি তবে ওর মুখ থেকে যা শুনেছি তাতে মনে হল ও তোমার ইন্দ্রানি মাসির দেওর, পরীর খুঁজে পাওয়া ভালবাসার মানুষ। আমি ত এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে আমরা এত ভাল বান্ধবী তাও কেন আমাদের কাছ থেকে অর্জুনের কথা ও চেপে গেল।"
রানী পরী কে জিজ্ঞেস করল, "পরী কেই অর্জুনের কথা জিজ্ঞেস করতে দোষ কি।"
পরী অস্বাভাবিক ভাবে চুপ, বুকের মধ্যে যেন ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা ককিয়ে উঠছে বারে বারে। খুব ধির স্বরে উত্তর দিল, "আমরা দুজনে বেশ ভালো ঘুরেছি, ব্যাস এইটুকু এখন বলতে পারি। বাকি পরে শুনে নিস তোরা।"
গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কেটে যায়। দিপঙ্কর ঘড়ি দেখে, "আরে দশটা বাজে যে।"
ওরা রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্টেসানের দিকে পা বাড়ায়। পরী ওদের বলে যে ও কিছুক্ষণ আরও অভির সাথে কাটাতে চায়। কল্যাণী ওকে বাঁধা দেয় না। বাকিরা স্টেসানে ঢুকে পরে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে পরী আর অভি।
দুজনে চুপচাপ হাইওয়ের দিকে হাঁটতে থাকে। পরীর মুখের ওপরে ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথার ছবি। মাঝ রাস্তায় অভি ওকে দাঁড় করিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি হল এত চুপ করে কেন আছো?"
পরী ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলে, "তুমি চলে যাও।"
অভি ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে বুকের কাছে টেনে আনে। অভির হাতের ছোঁয়া পেয়ে পরী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে পরী। অভি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু পরীর কান্না আর থামতে চায় না।
কান্না ভেজা গলায় অভিকে বলে, "সোনা তুমি চলে যাও, প্লিস। এই ঠাণ্ডার রাতে আমার ট্রেন ছেড়ে দেবে আর তুমি একা একা স্টেসানে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই দৃশ্য আমার সহ্য হবে না, আমি ভেঙ্গে পড়ব অভি। আমাকে শান্ত করার জন্য আমার বান্ধবীরা আমার সাথে থাকবে কিন্তু তুমি? আমি চলে যাবার পরে তুমি কি করে থাকবে? আমি তোমার বুকের ওই ব্যাথা সহ্য করতে পারব না অভি, প্লিস তুমি এখুনি চলে যাও।"
অভি ওর মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে বলে, "আমার জন্য চিন্তা কোরোনা, আমি ঠিক থাকব।"
পরী, "না তুমি চলে যাও। তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়াবে সেই দেখে আমি আরও ভেঙ্গে পড়ব অভি, প্লিস চলে যাও।"
অভি, "ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়।"
অভি ওর চোখের জল মুছে ওকে শান্ত হয়ে অনুরধ করে। তারপরে ওরা দু’জনে স্টেসানের দিকে হাটা দেয়। স্টেসানের বাইরে এসে দেখে যে কল্যাণী আর রানী ওদের পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরীর চোখের পাতা ভিজে দেখে কল্যাণী উৎসুক হয়ে অভির দিকে তাকায়। অভি কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না, কিছুক্ষণ মাথা চুলকে উত্তর দেয় যে পরী ওর ছোটো মার কথা মনে করে মন খারাপ হয়েছে তাই চোখে জল।
কল্যাণী ওর কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। অভির দিকে একভাবে চেয়ে থাকে কল্যাণী। অভি বুক দুরদুর করে ওঠে, কল্যাণী কি কিছু বুঝতে পেরে গেছে? ওরা যা ভয় পাচ্ছিল সেটা ঘটে যায়। কল্যাণী অভির দিকে তাকিয়ে বলে, "মনে হচ্ছে কিছু অঙ্ক আমি মেলাতে পারছি না।"
অভির দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, "আজ বিকেলে তোমাকে এখানে দেখে ঠিক অঙ্ক মেলে নি আমার। তোমার চশমা, ঠিক এই চশমা ছিল অর্জুনের চোখে তাই না। খুলে যদি বলি তাহলে অর্জুন নামে কেউ নেই, তুমি ছিলে শুচিস্মিতার সাথে। কি আমি ঠিক বলছি কি না?"
ওই কথা শুনে অভির মনে হল যেন কেউ ওর মাথার ওপরে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা যেকোনো সময়ে ফেটে বেড়িয়ে আসবে এমন জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে। পরী ওর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে, ওরা যে ধরা পরে গেছে। দু’চোখে বন্যা নামে, পরী ওর হাত শক্ত করে ধরে নেয়, কি হবে এবারে।
কল্যাণী পরীর মুখ দেখে সব বুঝতে পেরে যায়। পরীকে জিজ্ঞেস করে, "তোর সাথে অভিমন্যু ছিল তাই ত?"
পরী ওর দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে তাকায়। সারা চেহারায় ফুটে ওঠে কাতর আবেদন।
কল্যাণী ওর মুখ দেখে মৃদু হেসে বলে, "চিন্তা নেই তোর। একথা কেউ জানবে না, পরী।"
ওরা সবাই মিলে অয়েটিং রুমের দিকে হাতা দিল। কল্যাণীর কথা শুনে দু’জনের বুকের ওপরে এতক্ষণ যে পাথর চাপা ছিল সেটা সরে যায়। অয়েটিং রুমে বসা, দিপঙ্কর আর রামানুজ ওদের দেখে একটু ঘাবড়ে যায়। রানী ওদের কে সব কথা বলে। কথা শুনে সবাই চুপ। অভির আর পরীর ধুকপুক করতে থাকে, কি হবে কি হবে।
রানী পরীর চিবুক আঙ্গুল দিয়ে নেড়ে হেসে বলে, "অরে মেয়ে চিন্তা করিস না। এই খবর আমাদের কাছে গোপনে থাকবে।"
সবাই মাথা নেড়ে সায় জানায় যে এই কথা ওরা কাউকে জানাবে না।
কল্যাণী পরীর পাশেই বসে ছিল, ওর জড়িয়ে ধরে বলল, "তুই এত চিন্তা করছিস কেন? ওকে ভালবাসিস বলে চিন্তা করছিস না তুই ওর চেয়ে বড় বলে চিন্তা করছিস। তুই সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে আর ও একটা বুদ্ধিমান ছেলে। তোরা একে অপরকে ভালবাসিস, এতে পাপ কোথায়? তুই ওর সম্পর্কের মাসি হস তাই ভয়? তোদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। ও তোর কে হয়? তোর মায়ের মামাত দিদির, সেজ মেয়ের ছেলে। তোদের সম্পর্ক অনেক অনেক দুরের, কেউ কাউকে চিন্তিস ও না। ওটা হয়েছে কেননা উলুপি ম্যাডাম তোর বাড়ির কাছের কলেজে পড়ান বলে তোদের পরিরবারে সাথে সম্পর্ক, তা না হলে তোরা কেউ কাউকে চিন্তস ও না।"
দিপঙ্কর অভির পিঠ চাপড়ে বলল, "ব্রাদার এত ভয় পাবার কি আছে? তুমি ত ভায়া আমার সব থেকে সুন্দরী শালি টাকে হাত করে নিলে আর তার সাথে একা একা কোন এক দুর্গম স্থানে ঘুরেও এলে। তোমার সাহসের বলিহারি।"
পরীর ওদের কে মন থেকে কৃতজ্ঞতা জানাল, "তোদের কি করে যে ধন্যবাদ জানাব আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না রে।"
রানী ওদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোরা দুটি শয়তান, সময় কেমন কাটালি?"
অভির দিকে চোখ মেরে জিজ্ঞেস করে, "তুমি আমার বান্ধবিকে বেশি ব্যাথা দাও নি ত?"
ওর কথা শুনে লজ্জায় পরীর মুখ লাল হয়ে গেল, অভির দিকে লাজুক মুখে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হেসে ফেলল পরী। পরীর পুনরায় হসি মুখ দেখে অভির মন থেকে চিন্তার পাথর সরে যায়।
কল্যাণী পরীর গাল টিপে জিজ্ঞেস করে, "তোরা তাহলে বেড়াতে গিয়ে অনেক মজা করেছিস তাই না? আমি তোর চোখের হাসি দেখে বুঝতে পেরে গেছি সুতরাং আমার কাছে লুকিয়ে বিশেষ লাভ হবে না, পরী।"
চিন্তার মেঘ কেটে গেছ, ওরা সবাই আবার ঘোরার গল্পে মেতে উঠল, কে কি রকম কোথায় কোথায় ঘুরেছে তাঁর বর্ণনা করতে শুরু করে দিল। পরীর মুখে চিতকুলের বর্ণনা শুনে ওরা চারজনে অভিভুত। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে থাকে ওর হাত। সময় খুব দ্রুত বয়ে চলে। স্টেসানের লাউডস্পিকারে ট্রেনের আগমনের ঘোষণা শুনে ওদের সময়ের কথা মনে পরে যায়।
দিপঙ্কর আর রামানুজ ট্রেনে উঠে ওদের সিটে নিজেদের ব্যাগ পত্র রাখে। পরী অভির হাত শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে প্লাটফরমের ওপরে, ওকে ছাড়তে একদম মন চাইছে না। অভি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কবে আবার দেখা হবে পরীর সাথে, কি করে ছেড়ে যাবে পরীকে। বুকের ভেতর টনটন করে ওঠে আসন্ন বিরহ বেদনায়। কল্যাণী পরীর কাঁধে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে ট্রেনে উঠতে। পরী অভির হাত ছাড়তে চায় না।
কান্না ভেজা চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমি তোমাকে বলেছিলাম তুমি চলে যাও, তুমি আমার কথা শুনলে না। আমি তোমাকে বলেছিলাম। আমি তোমাকে একা ফেলে কি করে যাব অভি। আমি তোমাকে বার বার বলেছিলাম চলে যেতে, অভি।"
কল্যাণী পরীকে জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। অভি ওর মুখ আঁজলা করে নিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে গালের অপরের জলের দাগ মুছিয়ে দেয়। গালে অভির হাতের পরশ পেয়ে আরও যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে পরী।
অভি, "প্লিস ছোটো বাচ্চার মতন কাঁদে না সোনা, আমি ঠিক আছি সোনা।"
কল্যাণী অভিকে জানায় যে ও পরীকে সামলে নেবে। অভি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে, বুকের ভেতরে বিরহের সুর বেজে ওঠে। ওর ভয় করে আবার যেন পরী অজ্ঞান না হয়ে যায়।
অভি, "আমি কথা দিচ্ছি যে এই দু’মাসে তোমার সাথে কিছু করে হক আমি দেখা করব।"
কল্যাণী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "দু’মাস অনেক লম্বা সময়।" মাথা নাড়ায় অভি, "হ্যাঁ কিন্তু কি করা যাবে।"
কল্যাণী পরীকে নিয়ে ট্রেনের দিকে হাটা লাগায়। কল্যাণী ট্রেনে উঠে পরে। অভি একমনে দেখতে থাকে পরীকে। এমন সময় কল্যাণীর হাত ছাড়িয়ে পরী ঘুরে দাঁড়ায়, আর দৌড়ে এসে অভির বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। অভি দুহাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পরীকে, যেন পৃথিবীর কোন শক্তি ওদের কে বিচ্ছিন্ন করেত না পারে। পরীর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে অভি। অভির বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে পরী।
ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। পরীকে কোন মতে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে। পরী দৌড়ে ওর বান্ধবীদের কাছে চলে যায়। ট্রেন ছেড়ে দেয়, পরী ওর দিকে জল ভরা চোখ আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কল্যাণী ওকে জড়িয়ে ধরে থাকে। পরী ওর ডান হাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে, তাঁর ডগায় একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে অভির দিকে ছুঁড়ে দেয়। অভি পরীর ছোড়া সেই চুমু টা লুফে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে।
অভি ডান হাতের তর্জনী উঠায় ইশারা করে "আই" তারপরে বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী মেলে ধরে, ইশারা করে "এল" শেষে মধ্যমা আর অনামিকা ফাঁক করে ইশারা করে "ইউ"।
ট্রেন ঘন কালো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় কিছুক্ষণে মধ্যেই। অভি একা দাঁড়িয়ে থাকে খালি প্লাটফরমের ওপরে, বুক টা হুহু করে ওঠে। বাকি রাস্তা ওকে একা একা ফিরতে হবে, সাথে থাকবে না পরী। পকেট থেকে রুমাল টি বের করে একবার পরীর গায়ের গন্ধ মুখে মেখে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।