26-06-2020, 09:42 PM
(This post was last modified: 13-02-2021, 12:58 PM by kumdev. Edited 5 times in total. Edited 5 times in total.)
।।১৫।।
ফাগুনে কলমের আম গাছে বোউল ধরেছে। এমাসে ফারীহা বেগমের হায়েজ হয় নি।রাশেদ মিঞাকে ডাক্তার দেখাবার কথা বলেছেন। হায়েজ না হবার অন্য কারণও থাকতে পারে। তবু ক্ষিণ আশা মনের মধ্যে জোনাকের মত দপদপ করে। আমিনা লক্ষ্য করে ইদানীং বালু আসতেছে না। কি জানি কি হল, মেমসাহেবও উচ্চবাচ্য করেনা।আবদুল গাড়ি নিয়ে এলে আমিনা ছুটে গিয়ে দেখে বলা এসেছে কিনা?তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসে।কি সুন্দর ম্যাছেচ করতো মানুষটা।অপারে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়না।তার সঙ্গে আগের মত ব্যবহার করে না।কেমুন যেনি বদলায় গেছে।
বলদেব সকালে উঠে যোগাসন প্রাণায়াম করে স্নান সেরে অফিসে বেরিয়ে যায় রোজকারমত।অফিসে পৌছাতে বড়সাহেবের ঘরে ডাক পড়ে।রাশেদ সাহেব বুঝতে পারেন না ফারীহা এত ক্ষেপে উঠল কেন? কিছুকাল আগেও বলদার প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ।সুন্দরী বউয়ের মর্জি উড়িয়ে দেওয়ার মত হিম্মত আল্লা তারে দেয় নাই।তবু এই অপ্রিয় কাজটা তাকেই করতে হবে ভেবে খারাপ লাগে। সকালে প্রাণায়াম করার সময় মেমসাহেবের মুখটা মনে পড়েছিল।কতদিন দেখা হয় নাই।গেলেই খাওয়া বেশ ভাল কাটতো সাহেবের বাড়ী।
ডাক পেয়ে মনে হল আজ আবার যেতে বলবেন নাকি? সাহেবের ঘরে গিয়ে সালাম দিতে সাহেব বলেন, আসো বলদা।কেমন আছো?
--জ্বি ভালো।
রাশেদ সাহেব বলদার দিকে তাকাতে পারেন না।টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট নাড়া চাড়া করতে বললেন,সরকারী চাকরি বদলির চাকরি।আজ এখানে তো কাল সেখানে।
সাহেবের মুখ দেখে মনে হল সাহেবের হয়তো বদলি হয়ে গেছে।তাহলে ম্যাডামও চলে যাবেন।
--শোনো বলদা উপরলার হুকুম তোমার বদলি হয়ে গেছে। আজ রাতেই রওনা দেও।
--জ্বি।
--যাবার আগে জয়নালের সাথে দেখা করে যেও।আজ তোমার ছুটি তুমি যাও।বাসায় গিয়ে যাবার উদ্যোগ করো।
কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন।বলদেব কাগজপত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,সেলাম সাহেব।মেমসাহেবরে আমার সেলাম জানাবেন।
সব কথা শুনে জয়নাল কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবেন।রাশেদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তার বিবি হঠাৎ ক্ষেপলো কেন,বলদার বদলির জন্য উত্যক্ত করে--ব্যাপারটা বোঝেনা।অফিসের কাজে মেয়েমানুষের দখলদারি জয়নাল সাহেবের পছন্দ না। পুলিশি মন কি এক ধাধার সমাধান করতে চায়। সামনে বসা বলদেবকে আড়চোখে দেখে বলেন,তোমার সাথে মেম সাহেবের কিছু হইছিল?
--জ্বি তানার আমারে খুব পছন্দ। বাড়িতে গেলেই ভালমন্দ খাইতে দেয়।খুব দুঃখী মানুষ।
জয়নাল দারোগা অবাক হয়ে তাকায় বলদটা বলে কি? জিজ্ঞেস করেন,তুমি খুব সুখী মানুষ?
--জ্বি। যে দাওয়াত দেয় দুঃখ তার কাছে যায়।
উলটাপালটা কথা শুনে মাথা ধরে যায়। মজা করে জয়নাল সাহেব জিজ্ঞেস করেন, আমি কেমন মানুষ?মানুষরে পিটাই ঘুষ খাই--।
--জ্বি মানুষ কেউ খারাপ না--।
--তুমি সত্যিই বলদ। তোমার এই পরিবেশে থাকা উচিত না কিন্তু যাবেই বা কোথায়?
মনে মনে বলে বলদেব,সেই জানে-সেই জানে।এক ফকির তারে কথাটা শিখায়েছিল।
--তুমি এই চিঠিটা নিয়ে যাও।রিজানুররে এককথায় সবাই চিনবে।আজ রাতের গাড়িতে রওনা দিলে ভোরবেলা পৌছে যাবে।রিজানুররে আমার কথা বলবা।
বলদেব সেলাম করে বেরিয়ে গেল।দারোগা সাহেব অবাক হয়ে দেখেন,শোক নাই তাপ নাই কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ অভিযোগ নাই কি ধাতুতে আল্লাহ এরে গড়ছেন?
বলদেব ঝাড়া হাত-পা মানুষ জিনিসপত্রও তেমন কিছু নেই।একটা তোরঙ্গ বগলদাবা করে গাড়িতে চেপে বসে।আসমানে মেঘের মত মানুষের জীবন,তার ইচ্ছায় ভাসতে ভাসতে চলা।মেঘ জমে বৃষ্টি হয় আবার সুর্য ওঠে।এই জীবনের পথ,একদিন শেষ হবে পথ চলা।
ফাকা গাড়ি দেখতে দেখতে ভর্তি হয়ে গেল।তার সামনে সম্ভবত এক নব দম্পতি।দুইজনের বয়সের ফ্যারাক একটু বেশি। মিঞা সাহেব তাই বউরে আগলায়ে আগলায়ে রাখে,বলদেব মনে মনে হাসে।যে যাবার তারে আটকায় সাধ্য কার?কবিগুরুর 'যেতে নাহি দিব' কবিতাটা মনে পড়ল। গাড়ি চলতে শুরু করে।জানলা দিয়ে দেখে বাইরে গভীর অন্ধকার দূরে টিপটিপ করছে কিছু আলোক বিন্দু। বসে বসে ঘুমায় বলদেব।দাড়িয়ে দাড়িয়েও ঘুমাতে পারে।অভ্যাসে কি না হয়।শীত-শীত ভাব গায়ে জড়িয়ে নেয় কম্বলটা।এইটা রিজার্ভ করা কামরা না, বাঙ্কে মাল-পত্তর ঠাসা।একজন আর একজনের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায়।পায়ের কাছে একজন কাপড় বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে।বলদেব পা গুটিয়ে বসে।বলদেব নিজেকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাও? রেলের চাকায় শব্দ হয়, ঘুট ঘুট ঘট ঘট। বলদেবের মনে হয়,সেই জানে--সেই জানে --সেই জানে--সেই জানে। সামনের লোকটা কটমটিয়ে বলদেবের দিকে তাকিয়ে,বোঝার চেষ্টা করে তার বিবির দিক দেখছে কিনা।হাত দিয়ে বিবির ঘোমটা আরো টেনে দিল। মনে হয় নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ নিয়ে প্রথম প্রথম সবাই একটু অস্থির বো্ধের আদিখ্যেতা করে অনেকেই। পুরানো হবার পর নিজের বউ ছেড়ে অন্য বউয়ের দিকে নজর টানে।
ভোর হয় হয় বলদেব আসন করে বসে চোখ বুজে ধ্যান করে।সামনে বসা লোকটা বিরক্ত হয়,তার বিবির দিকে দেখার আগ্রহ নাই ।এই ব্যাপারটা তাকে আহত করে।লোকটি জিজ্ঞেস করে,আপনে কি করতেছেন?
--প্রাণায়াম।
--সেইটা করলে কি হয়।
--মন শান্ত হয়।
লোকটির মনে হয় তার বউরে দেখে মন অশান্ত হয়েছে।জিজ্ঞেস করে, কারে দেখে মন অশান্ত হল?
--মন অশান্ত হলে কোনো কাজ ভালভাবে করা যায়না।
--আপনে কি সাধু-ফকির?মনে হতেছে * ?
--যার যা মনে হয় আমি তাই।
--আমার মনে হয় আপনে একটা আস্তো পাগল।
--জ্বি।এইটা আপনের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
--ব্যক্তিগত মানে?
--শোনেন একটা গল্প বলি,এক সাধুমহারাজ বলছিল।এক যুবতী হরিণী বনে ঘুরতে ছিল। হরিণী মানে মেয়ে হরিণ।
--হ্যা-হ্যা বুঝছি।
--তারে দেখে এক হরিণের মনে প্রেমের উদয় হল।ঝোপের মধ্যে ছিল বাঘ ,তার চোখ হিংসায় জ্বলে উঠল।আঃ কি সুন্দর গোস্ত !আমাদের দেখাটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।একই জিনিস এক-একজন এক-এক রকম দেখে।
--আপনে মশায় ম্যালা বকতে পারেন।আমি বেশি কতা ভালবাসিনা। লোকটি গম্ভীর হয়ে যায়।তার বিবি ঘোমটার ফাক দিয়ে বলদেবকে জুলজুল করে দেখে।
বলদেব বলে, আপনি জ্ঞানী মানুষ।জ্ঞানী মানুষরা বলে, বলার কিছু নাই।অনেক কিছু দেখার আছে শোনার আছে।
স্বামীকে জ্ঞানী বলায় তার বিবি ফিক করে হেসে ফেলে।বিবির বেয়াদপিতে লোকটি তাকিয়ে চোখ পাকায়।
ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে।জানলায় জানলায় হাক পাড়ছে "ছা গরম।" বলদেব বুঝতে পারে স্টেশন এসে গেছে তাকে নামতে হবে।প্লাটফরমে লোকজন কম।দিনের আলো ফুটেছে। রিক্সার প্যাকপুক শব্দে মুখর স্টেশন চত্বর। স্টেশন ছেড়ে বেরোতে একটা রিক্সাওলা এগিয়ে আসে।
বলদেব জিজ্ঞেস করে,ভাইসাব রিজানুর সাহেবের বাড়ি চিনেন?
রিক্সাওলা অন্যদের জিজ্ঞেস করে,এ্যাই রিজানুর কেডা চিনিস?
--দারোগা সাহেব।
রিক্সাওলা ঘুরে তাকিয়ে বলে, সেইটা আগে বলতে কি হইছিল,দারোগাবাড়ি যাইবেন? উঠেন।
--কোথায়?
--কোথায় আবার? রিক্সায়?
--ভাই আপনে বাড়িটা দেখায়ে দেন।
--কেমন মানুষ আপনে? বউনি হয় নাই,সকালবেলায় টাইম বরবাদ করলেন?
--আপনের বউনি হয়নাই? আমি বুঝতে পারিনি,আপনে এই এক টাকাটা রাখেন।
রিক্সাওলার মুখে কথা সরেনা।আজব মানুষের পাল্লায় পড়ছে। ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, আমারে ভিখিরি ঠাউরাইলেন নাকি?
--আচ্ছা ঠিক আছে একটাকায় যতদুর যাওয়া যায় নিয়া চলেন।
রিক্সাওলা আপাদ মস্তক দেখে বলল,উঠেন।
বলদেব ঊঠতে ছুটে চলে রিক্সা।রাস্তার দু-ধারে খা-খা করছে মাঠ,জনবসতি নাই বললে চলে।
ফাগুনে কলমের আম গাছে বোউল ধরেছে। এমাসে ফারীহা বেগমের হায়েজ হয় নি।রাশেদ মিঞাকে ডাক্তার দেখাবার কথা বলেছেন। হায়েজ না হবার অন্য কারণও থাকতে পারে। তবু ক্ষিণ আশা মনের মধ্যে জোনাকের মত দপদপ করে। আমিনা লক্ষ্য করে ইদানীং বালু আসতেছে না। কি জানি কি হল, মেমসাহেবও উচ্চবাচ্য করেনা।আবদুল গাড়ি নিয়ে এলে আমিনা ছুটে গিয়ে দেখে বলা এসেছে কিনা?তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসে।কি সুন্দর ম্যাছেচ করতো মানুষটা।অপারে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়না।তার সঙ্গে আগের মত ব্যবহার করে না।কেমুন যেনি বদলায় গেছে।
বলদেব সকালে উঠে যোগাসন প্রাণায়াম করে স্নান সেরে অফিসে বেরিয়ে যায় রোজকারমত।অফিসে পৌছাতে বড়সাহেবের ঘরে ডাক পড়ে।রাশেদ সাহেব বুঝতে পারেন না ফারীহা এত ক্ষেপে উঠল কেন? কিছুকাল আগেও বলদার প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ।সুন্দরী বউয়ের মর্জি উড়িয়ে দেওয়ার মত হিম্মত আল্লা তারে দেয় নাই।তবু এই অপ্রিয় কাজটা তাকেই করতে হবে ভেবে খারাপ লাগে। সকালে প্রাণায়াম করার সময় মেমসাহেবের মুখটা মনে পড়েছিল।কতদিন দেখা হয় নাই।গেলেই খাওয়া বেশ ভাল কাটতো সাহেবের বাড়ী।
ডাক পেয়ে মনে হল আজ আবার যেতে বলবেন নাকি? সাহেবের ঘরে গিয়ে সালাম দিতে সাহেব বলেন, আসো বলদা।কেমন আছো?
--জ্বি ভালো।
রাশেদ সাহেব বলদার দিকে তাকাতে পারেন না।টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট নাড়া চাড়া করতে বললেন,সরকারী চাকরি বদলির চাকরি।আজ এখানে তো কাল সেখানে।
সাহেবের মুখ দেখে মনে হল সাহেবের হয়তো বদলি হয়ে গেছে।তাহলে ম্যাডামও চলে যাবেন।
--শোনো বলদা উপরলার হুকুম তোমার বদলি হয়ে গেছে। আজ রাতেই রওনা দেও।
--জ্বি।
--যাবার আগে জয়নালের সাথে দেখা করে যেও।আজ তোমার ছুটি তুমি যাও।বাসায় গিয়ে যাবার উদ্যোগ করো।
কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন।বলদেব কাগজপত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,সেলাম সাহেব।মেমসাহেবরে আমার সেলাম জানাবেন।
সব কথা শুনে জয়নাল কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবেন।রাশেদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তার বিবি হঠাৎ ক্ষেপলো কেন,বলদার বদলির জন্য উত্যক্ত করে--ব্যাপারটা বোঝেনা।অফিসের কাজে মেয়েমানুষের দখলদারি জয়নাল সাহেবের পছন্দ না। পুলিশি মন কি এক ধাধার সমাধান করতে চায়। সামনে বসা বলদেবকে আড়চোখে দেখে বলেন,তোমার সাথে মেম সাহেবের কিছু হইছিল?
--জ্বি তানার আমারে খুব পছন্দ। বাড়িতে গেলেই ভালমন্দ খাইতে দেয়।খুব দুঃখী মানুষ।
জয়নাল দারোগা অবাক হয়ে তাকায় বলদটা বলে কি? জিজ্ঞেস করেন,তুমি খুব সুখী মানুষ?
--জ্বি। যে দাওয়াত দেয় দুঃখ তার কাছে যায়।
উলটাপালটা কথা শুনে মাথা ধরে যায়। মজা করে জয়নাল সাহেব জিজ্ঞেস করেন, আমি কেমন মানুষ?মানুষরে পিটাই ঘুষ খাই--।
--জ্বি মানুষ কেউ খারাপ না--।
--তুমি সত্যিই বলদ। তোমার এই পরিবেশে থাকা উচিত না কিন্তু যাবেই বা কোথায়?
মনে মনে বলে বলদেব,সেই জানে-সেই জানে।এক ফকির তারে কথাটা শিখায়েছিল।
--তুমি এই চিঠিটা নিয়ে যাও।রিজানুররে এককথায় সবাই চিনবে।আজ রাতের গাড়িতে রওনা দিলে ভোরবেলা পৌছে যাবে।রিজানুররে আমার কথা বলবা।
বলদেব সেলাম করে বেরিয়ে গেল।দারোগা সাহেব অবাক হয়ে দেখেন,শোক নাই তাপ নাই কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ অভিযোগ নাই কি ধাতুতে আল্লাহ এরে গড়ছেন?
বলদেব ঝাড়া হাত-পা মানুষ জিনিসপত্রও তেমন কিছু নেই।একটা তোরঙ্গ বগলদাবা করে গাড়িতে চেপে বসে।আসমানে মেঘের মত মানুষের জীবন,তার ইচ্ছায় ভাসতে ভাসতে চলা।মেঘ জমে বৃষ্টি হয় আবার সুর্য ওঠে।এই জীবনের পথ,একদিন শেষ হবে পথ চলা।
ফাকা গাড়ি দেখতে দেখতে ভর্তি হয়ে গেল।তার সামনে সম্ভবত এক নব দম্পতি।দুইজনের বয়সের ফ্যারাক একটু বেশি। মিঞা সাহেব তাই বউরে আগলায়ে আগলায়ে রাখে,বলদেব মনে মনে হাসে।যে যাবার তারে আটকায় সাধ্য কার?কবিগুরুর 'যেতে নাহি দিব' কবিতাটা মনে পড়ল। গাড়ি চলতে শুরু করে।জানলা দিয়ে দেখে বাইরে গভীর অন্ধকার দূরে টিপটিপ করছে কিছু আলোক বিন্দু। বসে বসে ঘুমায় বলদেব।দাড়িয়ে দাড়িয়েও ঘুমাতে পারে।অভ্যাসে কি না হয়।শীত-শীত ভাব গায়ে জড়িয়ে নেয় কম্বলটা।এইটা রিজার্ভ করা কামরা না, বাঙ্কে মাল-পত্তর ঠাসা।একজন আর একজনের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায়।পায়ের কাছে একজন কাপড় বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে।বলদেব পা গুটিয়ে বসে।বলদেব নিজেকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাও? রেলের চাকায় শব্দ হয়, ঘুট ঘুট ঘট ঘট। বলদেবের মনে হয়,সেই জানে--সেই জানে --সেই জানে--সেই জানে। সামনের লোকটা কটমটিয়ে বলদেবের দিকে তাকিয়ে,বোঝার চেষ্টা করে তার বিবির দিক দেখছে কিনা।হাত দিয়ে বিবির ঘোমটা আরো টেনে দিল। মনে হয় নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ নিয়ে প্রথম প্রথম সবাই একটু অস্থির বো্ধের আদিখ্যেতা করে অনেকেই। পুরানো হবার পর নিজের বউ ছেড়ে অন্য বউয়ের দিকে নজর টানে।
ভোর হয় হয় বলদেব আসন করে বসে চোখ বুজে ধ্যান করে।সামনে বসা লোকটা বিরক্ত হয়,তার বিবির দিকে দেখার আগ্রহ নাই ।এই ব্যাপারটা তাকে আহত করে।লোকটি জিজ্ঞেস করে,আপনে কি করতেছেন?
--প্রাণায়াম।
--সেইটা করলে কি হয়।
--মন শান্ত হয়।
লোকটির মনে হয় তার বউরে দেখে মন অশান্ত হয়েছে।জিজ্ঞেস করে, কারে দেখে মন অশান্ত হল?
--মন অশান্ত হলে কোনো কাজ ভালভাবে করা যায়না।
--আপনে কি সাধু-ফকির?মনে হতেছে * ?
--যার যা মনে হয় আমি তাই।
--আমার মনে হয় আপনে একটা আস্তো পাগল।
--জ্বি।এইটা আপনের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
--ব্যক্তিগত মানে?
--শোনেন একটা গল্প বলি,এক সাধুমহারাজ বলছিল।এক যুবতী হরিণী বনে ঘুরতে ছিল। হরিণী মানে মেয়ে হরিণ।
--হ্যা-হ্যা বুঝছি।
--তারে দেখে এক হরিণের মনে প্রেমের উদয় হল।ঝোপের মধ্যে ছিল বাঘ ,তার চোখ হিংসায় জ্বলে উঠল।আঃ কি সুন্দর গোস্ত !আমাদের দেখাটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।একই জিনিস এক-একজন এক-এক রকম দেখে।
--আপনে মশায় ম্যালা বকতে পারেন।আমি বেশি কতা ভালবাসিনা। লোকটি গম্ভীর হয়ে যায়।তার বিবি ঘোমটার ফাক দিয়ে বলদেবকে জুলজুল করে দেখে।
বলদেব বলে, আপনি জ্ঞানী মানুষ।জ্ঞানী মানুষরা বলে, বলার কিছু নাই।অনেক কিছু দেখার আছে শোনার আছে।
স্বামীকে জ্ঞানী বলায় তার বিবি ফিক করে হেসে ফেলে।বিবির বেয়াদপিতে লোকটি তাকিয়ে চোখ পাকায়।
ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে।জানলায় জানলায় হাক পাড়ছে "ছা গরম।" বলদেব বুঝতে পারে স্টেশন এসে গেছে তাকে নামতে হবে।প্লাটফরমে লোকজন কম।দিনের আলো ফুটেছে। রিক্সার প্যাকপুক শব্দে মুখর স্টেশন চত্বর। স্টেশন ছেড়ে বেরোতে একটা রিক্সাওলা এগিয়ে আসে।
বলদেব জিজ্ঞেস করে,ভাইসাব রিজানুর সাহেবের বাড়ি চিনেন?
রিক্সাওলা অন্যদের জিজ্ঞেস করে,এ্যাই রিজানুর কেডা চিনিস?
--দারোগা সাহেব।
রিক্সাওলা ঘুরে তাকিয়ে বলে, সেইটা আগে বলতে কি হইছিল,দারোগাবাড়ি যাইবেন? উঠেন।
--কোথায়?
--কোথায় আবার? রিক্সায়?
--ভাই আপনে বাড়িটা দেখায়ে দেন।
--কেমন মানুষ আপনে? বউনি হয় নাই,সকালবেলায় টাইম বরবাদ করলেন?
--আপনের বউনি হয়নাই? আমি বুঝতে পারিনি,আপনে এই এক টাকাটা রাখেন।
রিক্সাওলার মুখে কথা সরেনা।আজব মানুষের পাল্লায় পড়ছে। ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, আমারে ভিখিরি ঠাউরাইলেন নাকি?
--আচ্ছা ঠিক আছে একটাকায় যতদুর যাওয়া যায় নিয়া চলেন।
রিক্সাওলা আপাদ মস্তক দেখে বলল,উঠেন।
বলদেব ঊঠতে ছুটে চলে রিক্সা।রাস্তার দু-ধারে খা-খা করছে মাঠ,জনবসতি নাই বললে চলে।