27-02-2019, 03:53 PM
অপরিজ্ঞাত যাত্রা (#02)
বন্ধ চোখের সামনে শুধু মাত্র প্রেমিকার কাজল কালো আঁখি যুগল। বহুদিন পরে পরীকে বুকের কাছে পাবে, অধির হয়ে ওঠে অভি। ওর ঠোঁটে এখন লেগে আছে পরীর ঠোঁটের মিষ্টি ছোঁয়া, নাকে লেগে আছে পরীর গায়ের সুমিষ্ট সুবাস। যখনি হাসত পরী, ওর দু’গালে টোল পড়ত আর সেই টোল খাওয়া গাল দেখে পাগল হয়ে যেত অভি, বারে বারে মনে হত যেন ওই গালে চুমু খায়। মাঝে মাঝে যখন ওর চুলের গোছা গালের ওপরে খেলে বেড়াত তখন আঙ্গুল দিয়ে পরী ওই দুষ্টু চুলের গোছাটা কানের পাশে উঠিয়ে দিত। কত মিষ্টি দেখতে লাগত পরীকে। একবার নিজের কথা ভাবল অভি, গাল ভর্তি দাড়ি গোঁফ, চোখে চশমা, মাথায় কালো টুপি, চিনতে পারবেত পরী? হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই চিনে নেবে। এত শত ভাবতে ভাবতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল অভি।
বল্বিন্দার ওকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলে, "স্যারজি স্যারজি, ট্রেন এসে গেছে।"
চোখ মুখ ডলে উঠে পড়ল অভি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে যে, সকাল আটটা বাজে। মৃদু বকুনি দিল বল্বিন্দারকে, "কি যে কর বল্বিন্দার, আমাকে আগে জাগিয়ে দেবে ত।"
বল্বিন্দার, "স্যারজি আমরা ত রাত তিনটে নাগাদ কাল্কা পৌঁছে গেছিলাম। আপনি ঘুমাচ্ছেন দেখে আর আপনাকে উঠালাম না। স্টেসানে গিয়ে খোঁজ নিলাম যে ট্রেন লেট।"
অভি চোখে মুখে জল দিয়ে উঠে পড়ল। মাথায় কালো টুপি’টা পরে নিয়ে প্লাটফরমের দিকে পা বাড়াল। প্লাটফরমে ঢুকে লক্ষ্য করল যে পরী আর দু’জন মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে। উৎসুক নয়নে অভিকে খুঁজছে, কোথায় অভি, বলেছিল যে কাল্কা স্টেসানে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। একটা লম্বা সাদা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে পরী, একটু মোটা লাগছে দেখেত। চোখমুখ দেখে মনে হল যেন সারা রাত ঘুমোয় নি, চোখ দুটি ফোলা ফোলা। অভি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল পরীর দিকে। বুকের মাঝে ধুকপুকানি যেন শত গুন বেড়ে গেছে। ধরা পরে গেলে একদম কেলেঙ্কারি অবস্থা হয়ে যাবে। একটু পরে অভির দিকে তাকাল পরী, ওর চোখের দিকে তাকাতেই অভি ওর রুমাল টা বের করে ঠোঁটের সামনে ধরল। রুমাল দেখে পরীর মুখে যেন আর হাসি ধরে না। ধিরে ধিরে এগিয়ে এল অভির দিকে আর জড়িয়ে ধরল অভির হাত। ওর বান্ধবীরা আর তাদের স্বামিরা ওদের দিকে তাকাল।
অভি দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল, "আমি অর্জুন, বম্বে থাকেন ইন্দ্রানি বৌদি তাঁর দেওর। আমরা হয়ত আগে মিট করিনি তাই না।"
খুব গম্ভির আওয়াজে পরীকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার জার্নি কেমন গেল?"
দুই বান্ধবী পরীর দিকে তাকিয়ে হতবাক, কে এই মানুষ, কেনই বা এর কথা এতদিন লুকিয়ে ছিল ওদের কাছ থেকে? পরী অভির দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে, ও কি জানত কে কোন অর্জুন আসবে ওকে নিতে। পরী হাসি থামাতে না পেরে একটা জোরে চিমটি কেটে দিল অভির হাতের ওপরে।
কথা বলে জানা গেল বান্ধবীদের নাম আর পরিচয়। একজনের নাম কল্যানি তার স্বামী দিপঙ্কর আরেক জনের নাম রানী তাঁর স্বামির নাম রামানুজ। দিপঙ্কর আর রামানুজ গ্রামে পারিবারিক ব্যাবসা করেন। অভি ওদের কে আসস্থ করে বলল যে পরী ওর সাথে ভাল থাকবে।
কল্যানি, "শুচিস্মিতা কাল সারা রাত ঘুময়নি। ওর মনের ভেতরে যেন খই ফুটছিল কখন তোমার সাথে দেখা হবে। যাই হক যেখানে তোমারা জাচ্ছ সেই জায়গাটার নাম কি? খুব রোম্যান্টিক তোমারা একা একা এক অজানা অচেনা জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছ। এক কাজ কর আমাদের সাথে ঘুরতে পার ত?"
রানী, "হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের সাথে চল।"
পরী দেখল এযে বড় বিপদ, "না না, অর্জুন নিশ্চয় কিছু না কিছু আগে থেকে ভেবে রেখেছে।" অভির বাজুতে চিমটি কেটে বলল, "আমাদেরত আগে থেকেই হোটেল বুক করা আছে, তাই না অর্জুন? আর দেরি কেন চলো না।"
পরীর ব্যাগ হাতে নিয়ে অভি স্টেসান থেকে বেড়িয়ে পড়ল, পেছন পেছন বাকিরাও ওদের সাথে এল। পরী, দুচোখে হাজার প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, প্রাণপণে বুকের মধ্যে জমে থাকা হাসি টিকে দাতে দাঁত পিষে চেপে ধরে আছে। কথা বার্তার মাঝে জানা গেল যে কল্যাণীদের আগে থেকেই হোটেল এবং গাড়ি ঠিক করা। দিপঙ্কর অভিকে জায়গার কথা জিজ্ঞেস করতে অভি জানাল যে ওরা চিতকুলে নামে একটা জায়গায় বেড়াতে যাবে। সিম্লার আগেই কান্দাঘাট নামে এক জায়গা থেকে ওরা অন্য রাস্তা নেবে না হলে ওদের সাথে সিমলা যেতে পারত। অভি ওদের জিজ্ঞেস করল যে ওরা কবে ফিরবে, সেই মতন আবার পরীকে স্টেসানে পৌঁছে দিতে হবে। দিপঙ্কর জানাল যে ওরা পরের রবিবার ট্রেন ধরবে, কল্যানি বার বার করে পরীকে বলে দিল যে যেখানেই যাক না কেন রবিবারের মধ্যে যেন কাল্কা পৌঁছে যায়। অভি ওদের আসস্থ করে উত্তর দিল যে ওদের বান্ধবী ঠিক হাতেই থাকবে ওর জন্যে যেন কেউ কোন চিন্তা না করে।
বল্বিন্দার পরীর ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রাখে। গাড়ি দেখে ওর সবাই একটু অবাক হয়ে যায়। অভি জানায় যে ও প্লেনে করে আগের দিন দুপুরে দিল্লী পৌঁছে রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে কাল্কা পৌঁছেছে।
রানী পরীকে একটু ধাক্কা মেরে বলে, "তুই ত মাইরি ডুবে ডুবে জল খাস। সারাটা রাস্তা আমাদের কিছুই জানালি না যে তোর অর্জুনের কাছে গাড়ি আছে।"
পরী অভির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে, ওই বা কি জানত কি নাম হবে, কোথায় যাবে, কি করে যাবে। কিছুই ত জানত না, তাই ত অধির ব্যাকুলতায় সারাটা রাত ঘুমায়নি, জেগে শুধু ভেবেছে অভির কথা।
বাকিদের বিদায় জানিয়ে ওরা গাড়িতে চেপে পড়ল। বল্বিন্দার পটু হাতে গাড়ি চালাচ্ছে। সিওয়ালিক পাহাড়ের সরু রাস্তা ধরে এঁকে বেকে গাড়ি চলেছে। পেছনে ওরা দুজনে বসে। গাড়িতে চেপেই পরী হাসিতে ফেটে পড়ল, যেন এতক্ষণ ওর বুকে ওর হাসি আর খুশি একসাথে জমা হয়ে একটা পাথর হয়েছিল।
পরী, "বাপরে বাপ, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে তুমি এইরকম করতে পার। তোমার চশমা কবে হল? এটা কি সত্যি না মিথ্যে চশমা? এত দাড়ি গোঁফ কেন? এগুল কি আসল না নকল?"
অভি, "তুমি থামলে আমি কিছু বলতে পারি।"
পরী, "ঠিক আছে বাবা, আমি চুপ, তুমি বল।"
অভি ওকে পুর ট্রিপের পরিকল্পনা বলল, কি করে বাবা মাকে গল্প বলে বেড়ানোর ব্যাপারে রাজি করাল, কি করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করে গাড়ির ব্যাবস্থা করল, সব কিছু। সব শুনে পরী ওকে জড়িয়ে ধরে দাড়ি ওয়ালা গালে একটা চুমু খেল।
কিছু পরে গাড়ি কান্দাঘাট ছাড়িয়ে একটা ছোটো রাস্তা ধরে পাহাড় চরতে শুরু করল। চারপাশে উঁচু উঁচু পাইন, শাল, দেবদারুর বন। রাস্তা কুয়াশায় ঢাকা, বল্বিন্দার খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। আকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি এগতে থাকে, বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, গাড়িতে হিটার চালান।
পরী অভির বাঁ দিকে বসে ওর হাত খানি শক্ত করে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। একটা লম্বা সাদা জ্যাকেট গায়ে। বড় বড় চোখে জানালার বাইরে দেখছে। অভি ওর গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে একটু আদর করল।
পরী, "উম্মম্ম... আমি কোনদিন পাহাড় দেখিনি। আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। আমি এই ঘুম থেকে উঠতে চাই না, পাছে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।"
পরী অভির কাঁধে গাল ঘষে দেয়।
অভি, "এই দেখ আমি তোমার পাশেই আছি। এটা স্বপ্ন নয়, পরী, আমি সত্যি তোমার পাশে।"
অভি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে, গালে গাল ঘষে দেয় অভি।
পরী, "উম্মম্ম... দুষ্টু ছেলে, ছাড়ও ছাড়ো, ওইরকম ভাবে গাল ঘোসো না, তোমার দাড়িতে লাগছে।"
"ঠিক আছে বাবা, আমি দাড়ি কামিয়ে ফেলব খানে।" পরীর হাত হাতে নিয়ে ঠোঁটের কাছে এনে আঙ্গুলে চুমু খায়।
পরী, "উফফফ আমার যে কি ভালো লাগছে না... কি বলব" পরী অভির হাথ বুকের ওপরে চেপে ধরে বলে, "দেখো দেখ বুকের ভেতর টা কেমন জোরে জোরে ধুকপুক করছে।"
অভি দুষ্টুমি করে ওর বুকের ওপরে হাত বুলিয়ে দেয়। পরী মৃদু রেগে গিয়ে হাতের ওপরে একটা আলতো থাপ্পর মেরে বলে, "এই দুষ্টু ছেলে ছাড়ো।"
কিছু পরে বলে, "একটু ফ্রেস হতে পারলে ভাল হত।"
অভি, "ঠিক আছে, একটু পরে আমরা চায়েল পৌঁছে যাব সেখানে একটা রুম নিয়ে নেব। স্নান সেরে আবার বেড়িয়ে পড়ব।"
কিছু পরেই গাড়ি চায়েল পৌঁছে গেল। বল্বিন্দার গাড়ি থামিয়ে পরীকে বলল, "ভাভিজি চায়েল এসে গেছে।"
পরী বিশেষ হিন্দি বোঝেনা, তবে বল্বিন্দারের মুখে ভাভিজি কথাটা বুঝে গেল। অভিকে জিজ্ঞেস করল, "আমাকে ভাভিজি বলে ডাকছে কেন? আমার লজ্জা করছে।"
অভি, "আরে বাবা লজ্জা পেওনা। ও তোমাকে আমার সাথে দেখেছে ত ভাভি বলবে না ত কি বলবে। চিন্তা কোরও না, ও সুপ্রতিমদার অনেক দিনের ড্রাইভার, খুব বিশস্ত লোক।"
চায়েল পৌঁছে ওরা একটা হোটেল নিয়ে নিল। হোটেলের কামরায় ঢুকে অভি দুষ্টুমি করে পরীকে জিজ্ঞেস করে, "পরী, আতে সময় খুব কম। চলো না একসাথে দু’জনে বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নেই।"
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল পরী, মৃদু ধমক দিল অভিকে, "না... বদমাশ কি শখ এক লাত্থি মারব।"
স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওরা বেড়িয়ে পড়ল। পরীকে দেখতে একদম সদ্য ফোটা তাজা গোলাপের মতন দেখাচ্ছে। সাদা একটা আটো সালোয়ার পড়েছে, তাঁর ওপরে ওর সাদা জ্যাকেট, ঠিক যেন সাদা গোলাপ ফুল। দু’কানে দুটি মুক্তোর দুল, টলটল করে দুলছে। চায়েল ছাড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু। কুয়াশা কেটে হাল্কা রোদের আভাস দেখা দিল। শীতকালের সূর্য যেন চাঁদের আলো ছড়াচ্ছে। অভি দাড়ি গোঁফ কামিয়ে নিয়েছে যাতে পরীর চুম্বনে কোন কষ্ট না হয়। বল্বিন্দার নিপুন হাতে গাড়ি চালাচ্ছে, আঁকা বাঁকা পথ ধরে গাড়ি পাহাড়ে উঠছে।
পরী জিজ্ঞেস করল যে কতক্ষণ লাগবে চিতকুল পৌঁছতে, অভি মাথা নাড়াল, ঠিক জানে না। বল্বিন্দার ওদের কথা শুনে উত্তর দিল যে, হোটেলের ম্যানেজার কে ও জিজ্ঞেস করে রাস্তা যেনে নিয়েছে, আরও ঘন্টা দশেক লাগবে চিতকুল পৌঁছতে। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে ফাগু ছাড়িয়ে আবার এন.এইচ.22 ধরল।
পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে জানালার বাইরে অবাক হয়ে তাকিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে চলেছে। বাম হাতে অভি ওকে জড়িয়ে ধরে, পরী ওর হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছে।
কারুর মুখে কোন কথা নেই, দু’জনেই চুপ করে বসে একে ওপরের আদর খেয়ে চলেছে। কিছু পরে নারকান্ডা এল, তারপরে গাড়ি নিচে নামতে শুরু করল। কিছু দূর যাবার পরে গাড়ি একটা নদীর পাশ দিয়ে চলতে শুরু করল। পরী পাহাড়ি নদী দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।
"উম্ম... কি সুন্দর ছোট্ট নদী। কি নাম নদীটার" পরী অভি’কে জিজ্ঞেস করল।
অভি, "সম্ভবত সাটলুজ নদী।"
পরী, "মানে বাঙ্গালয় শতদ্রু তাই ত?"
অভি, "তাই হবে।"
পরী বল্বিন্দার কে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল, নদীর পাড়ে গিয়ে নদীর জল ছুঁতে চায়। অভি বলল যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা আর নদীর জল হিমের মতন হবে। পরী ওর কথায় কান দিলনা। জোর করে বল্বিন্দার কে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামা মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে এক দৌড়ে নদীর পাড়ে।
পরী ওর দিকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, "তুমি আসছ না আমি নদীতে ঝাপ দেব?"
বন্ধ চোখের সামনে শুধু মাত্র প্রেমিকার কাজল কালো আঁখি যুগল। বহুদিন পরে পরীকে বুকের কাছে পাবে, অধির হয়ে ওঠে অভি। ওর ঠোঁটে এখন লেগে আছে পরীর ঠোঁটের মিষ্টি ছোঁয়া, নাকে লেগে আছে পরীর গায়ের সুমিষ্ট সুবাস। যখনি হাসত পরী, ওর দু’গালে টোল পড়ত আর সেই টোল খাওয়া গাল দেখে পাগল হয়ে যেত অভি, বারে বারে মনে হত যেন ওই গালে চুমু খায়। মাঝে মাঝে যখন ওর চুলের গোছা গালের ওপরে খেলে বেড়াত তখন আঙ্গুল দিয়ে পরী ওই দুষ্টু চুলের গোছাটা কানের পাশে উঠিয়ে দিত। কত মিষ্টি দেখতে লাগত পরীকে। একবার নিজের কথা ভাবল অভি, গাল ভর্তি দাড়ি গোঁফ, চোখে চশমা, মাথায় কালো টুপি, চিনতে পারবেত পরী? হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই চিনে নেবে। এত শত ভাবতে ভাবতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল অভি।
বল্বিন্দার ওকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলে, "স্যারজি স্যারজি, ট্রেন এসে গেছে।"
চোখ মুখ ডলে উঠে পড়ল অভি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে যে, সকাল আটটা বাজে। মৃদু বকুনি দিল বল্বিন্দারকে, "কি যে কর বল্বিন্দার, আমাকে আগে জাগিয়ে দেবে ত।"
বল্বিন্দার, "স্যারজি আমরা ত রাত তিনটে নাগাদ কাল্কা পৌঁছে গেছিলাম। আপনি ঘুমাচ্ছেন দেখে আর আপনাকে উঠালাম না। স্টেসানে গিয়ে খোঁজ নিলাম যে ট্রেন লেট।"
অভি চোখে মুখে জল দিয়ে উঠে পড়ল। মাথায় কালো টুপি’টা পরে নিয়ে প্লাটফরমের দিকে পা বাড়াল। প্লাটফরমে ঢুকে লক্ষ্য করল যে পরী আর দু’জন মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে। উৎসুক নয়নে অভিকে খুঁজছে, কোথায় অভি, বলেছিল যে কাল্কা স্টেসানে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। একটা লম্বা সাদা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে পরী, একটু মোটা লাগছে দেখেত। চোখমুখ দেখে মনে হল যেন সারা রাত ঘুমোয় নি, চোখ দুটি ফোলা ফোলা। অভি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল পরীর দিকে। বুকের মাঝে ধুকপুকানি যেন শত গুন বেড়ে গেছে। ধরা পরে গেলে একদম কেলেঙ্কারি অবস্থা হয়ে যাবে। একটু পরে অভির দিকে তাকাল পরী, ওর চোখের দিকে তাকাতেই অভি ওর রুমাল টা বের করে ঠোঁটের সামনে ধরল। রুমাল দেখে পরীর মুখে যেন আর হাসি ধরে না। ধিরে ধিরে এগিয়ে এল অভির দিকে আর জড়িয়ে ধরল অভির হাত। ওর বান্ধবীরা আর তাদের স্বামিরা ওদের দিকে তাকাল।
অভি দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল, "আমি অর্জুন, বম্বে থাকেন ইন্দ্রানি বৌদি তাঁর দেওর। আমরা হয়ত আগে মিট করিনি তাই না।"
খুব গম্ভির আওয়াজে পরীকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার জার্নি কেমন গেল?"
দুই বান্ধবী পরীর দিকে তাকিয়ে হতবাক, কে এই মানুষ, কেনই বা এর কথা এতদিন লুকিয়ে ছিল ওদের কাছ থেকে? পরী অভির দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে, ও কি জানত কে কোন অর্জুন আসবে ওকে নিতে। পরী হাসি থামাতে না পেরে একটা জোরে চিমটি কেটে দিল অভির হাতের ওপরে।
কথা বলে জানা গেল বান্ধবীদের নাম আর পরিচয়। একজনের নাম কল্যানি তার স্বামী দিপঙ্কর আরেক জনের নাম রানী তাঁর স্বামির নাম রামানুজ। দিপঙ্কর আর রামানুজ গ্রামে পারিবারিক ব্যাবসা করেন। অভি ওদের কে আসস্থ করে বলল যে পরী ওর সাথে ভাল থাকবে।
কল্যানি, "শুচিস্মিতা কাল সারা রাত ঘুময়নি। ওর মনের ভেতরে যেন খই ফুটছিল কখন তোমার সাথে দেখা হবে। যাই হক যেখানে তোমারা জাচ্ছ সেই জায়গাটার নাম কি? খুব রোম্যান্টিক তোমারা একা একা এক অজানা অচেনা জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছ। এক কাজ কর আমাদের সাথে ঘুরতে পার ত?"
রানী, "হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের সাথে চল।"
পরী দেখল এযে বড় বিপদ, "না না, অর্জুন নিশ্চয় কিছু না কিছু আগে থেকে ভেবে রেখেছে।" অভির বাজুতে চিমটি কেটে বলল, "আমাদেরত আগে থেকেই হোটেল বুক করা আছে, তাই না অর্জুন? আর দেরি কেন চলো না।"
পরীর ব্যাগ হাতে নিয়ে অভি স্টেসান থেকে বেড়িয়ে পড়ল, পেছন পেছন বাকিরাও ওদের সাথে এল। পরী, দুচোখে হাজার প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, প্রাণপণে বুকের মধ্যে জমে থাকা হাসি টিকে দাতে দাঁত পিষে চেপে ধরে আছে। কথা বার্তার মাঝে জানা গেল যে কল্যাণীদের আগে থেকেই হোটেল এবং গাড়ি ঠিক করা। দিপঙ্কর অভিকে জায়গার কথা জিজ্ঞেস করতে অভি জানাল যে ওরা চিতকুলে নামে একটা জায়গায় বেড়াতে যাবে। সিম্লার আগেই কান্দাঘাট নামে এক জায়গা থেকে ওরা অন্য রাস্তা নেবে না হলে ওদের সাথে সিমলা যেতে পারত। অভি ওদের জিজ্ঞেস করল যে ওরা কবে ফিরবে, সেই মতন আবার পরীকে স্টেসানে পৌঁছে দিতে হবে। দিপঙ্কর জানাল যে ওরা পরের রবিবার ট্রেন ধরবে, কল্যানি বার বার করে পরীকে বলে দিল যে যেখানেই যাক না কেন রবিবারের মধ্যে যেন কাল্কা পৌঁছে যায়। অভি ওদের আসস্থ করে উত্তর দিল যে ওদের বান্ধবী ঠিক হাতেই থাকবে ওর জন্যে যেন কেউ কোন চিন্তা না করে।
বল্বিন্দার পরীর ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রাখে। গাড়ি দেখে ওর সবাই একটু অবাক হয়ে যায়। অভি জানায় যে ও প্লেনে করে আগের দিন দুপুরে দিল্লী পৌঁছে রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে কাল্কা পৌঁছেছে।
রানী পরীকে একটু ধাক্কা মেরে বলে, "তুই ত মাইরি ডুবে ডুবে জল খাস। সারাটা রাস্তা আমাদের কিছুই জানালি না যে তোর অর্জুনের কাছে গাড়ি আছে।"
পরী অভির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে, ওই বা কি জানত কি নাম হবে, কোথায় যাবে, কি করে যাবে। কিছুই ত জানত না, তাই ত অধির ব্যাকুলতায় সারাটা রাত ঘুমায়নি, জেগে শুধু ভেবেছে অভির কথা।
বাকিদের বিদায় জানিয়ে ওরা গাড়িতে চেপে পড়ল। বল্বিন্দার পটু হাতে গাড়ি চালাচ্ছে। সিওয়ালিক পাহাড়ের সরু রাস্তা ধরে এঁকে বেকে গাড়ি চলেছে। পেছনে ওরা দুজনে বসে। গাড়িতে চেপেই পরী হাসিতে ফেটে পড়ল, যেন এতক্ষণ ওর বুকে ওর হাসি আর খুশি একসাথে জমা হয়ে একটা পাথর হয়েছিল।
পরী, "বাপরে বাপ, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে তুমি এইরকম করতে পার। তোমার চশমা কবে হল? এটা কি সত্যি না মিথ্যে চশমা? এত দাড়ি গোঁফ কেন? এগুল কি আসল না নকল?"
অভি, "তুমি থামলে আমি কিছু বলতে পারি।"
পরী, "ঠিক আছে বাবা, আমি চুপ, তুমি বল।"
অভি ওকে পুর ট্রিপের পরিকল্পনা বলল, কি করে বাবা মাকে গল্প বলে বেড়ানোর ব্যাপারে রাজি করাল, কি করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করে গাড়ির ব্যাবস্থা করল, সব কিছু। সব শুনে পরী ওকে জড়িয়ে ধরে দাড়ি ওয়ালা গালে একটা চুমু খেল।
কিছু পরে গাড়ি কান্দাঘাট ছাড়িয়ে একটা ছোটো রাস্তা ধরে পাহাড় চরতে শুরু করল। চারপাশে উঁচু উঁচু পাইন, শাল, দেবদারুর বন। রাস্তা কুয়াশায় ঢাকা, বল্বিন্দার খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। আকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি এগতে থাকে, বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, গাড়িতে হিটার চালান।
পরী অভির বাঁ দিকে বসে ওর হাত খানি শক্ত করে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। একটা লম্বা সাদা জ্যাকেট গায়ে। বড় বড় চোখে জানালার বাইরে দেখছে। অভি ওর গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে একটু আদর করল।
পরী, "উম্মম্ম... আমি কোনদিন পাহাড় দেখিনি। আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। আমি এই ঘুম থেকে উঠতে চাই না, পাছে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।"
পরী অভির কাঁধে গাল ঘষে দেয়।
অভি, "এই দেখ আমি তোমার পাশেই আছি। এটা স্বপ্ন নয়, পরী, আমি সত্যি তোমার পাশে।"
অভি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে, গালে গাল ঘষে দেয় অভি।
পরী, "উম্মম্ম... দুষ্টু ছেলে, ছাড়ও ছাড়ো, ওইরকম ভাবে গাল ঘোসো না, তোমার দাড়িতে লাগছে।"
"ঠিক আছে বাবা, আমি দাড়ি কামিয়ে ফেলব খানে।" পরীর হাত হাতে নিয়ে ঠোঁটের কাছে এনে আঙ্গুলে চুমু খায়।
পরী, "উফফফ আমার যে কি ভালো লাগছে না... কি বলব" পরী অভির হাথ বুকের ওপরে চেপে ধরে বলে, "দেখো দেখ বুকের ভেতর টা কেমন জোরে জোরে ধুকপুক করছে।"
অভি দুষ্টুমি করে ওর বুকের ওপরে হাত বুলিয়ে দেয়। পরী মৃদু রেগে গিয়ে হাতের ওপরে একটা আলতো থাপ্পর মেরে বলে, "এই দুষ্টু ছেলে ছাড়ো।"
কিছু পরে বলে, "একটু ফ্রেস হতে পারলে ভাল হত।"
অভি, "ঠিক আছে, একটু পরে আমরা চায়েল পৌঁছে যাব সেখানে একটা রুম নিয়ে নেব। স্নান সেরে আবার বেড়িয়ে পড়ব।"
কিছু পরেই গাড়ি চায়েল পৌঁছে গেল। বল্বিন্দার গাড়ি থামিয়ে পরীকে বলল, "ভাভিজি চায়েল এসে গেছে।"
পরী বিশেষ হিন্দি বোঝেনা, তবে বল্বিন্দারের মুখে ভাভিজি কথাটা বুঝে গেল। অভিকে জিজ্ঞেস করল, "আমাকে ভাভিজি বলে ডাকছে কেন? আমার লজ্জা করছে।"
অভি, "আরে বাবা লজ্জা পেওনা। ও তোমাকে আমার সাথে দেখেছে ত ভাভি বলবে না ত কি বলবে। চিন্তা কোরও না, ও সুপ্রতিমদার অনেক দিনের ড্রাইভার, খুব বিশস্ত লোক।"
চায়েল পৌঁছে ওরা একটা হোটেল নিয়ে নিল। হোটেলের কামরায় ঢুকে অভি দুষ্টুমি করে পরীকে জিজ্ঞেস করে, "পরী, আতে সময় খুব কম। চলো না একসাথে দু’জনে বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নেই।"
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল পরী, মৃদু ধমক দিল অভিকে, "না... বদমাশ কি শখ এক লাত্থি মারব।"
স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওরা বেড়িয়ে পড়ল। পরীকে দেখতে একদম সদ্য ফোটা তাজা গোলাপের মতন দেখাচ্ছে। সাদা একটা আটো সালোয়ার পড়েছে, তাঁর ওপরে ওর সাদা জ্যাকেট, ঠিক যেন সাদা গোলাপ ফুল। দু’কানে দুটি মুক্তোর দুল, টলটল করে দুলছে। চায়েল ছাড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু। কুয়াশা কেটে হাল্কা রোদের আভাস দেখা দিল। শীতকালের সূর্য যেন চাঁদের আলো ছড়াচ্ছে। অভি দাড়ি গোঁফ কামিয়ে নিয়েছে যাতে পরীর চুম্বনে কোন কষ্ট না হয়। বল্বিন্দার নিপুন হাতে গাড়ি চালাচ্ছে, আঁকা বাঁকা পথ ধরে গাড়ি পাহাড়ে উঠছে।
পরী জিজ্ঞেস করল যে কতক্ষণ লাগবে চিতকুল পৌঁছতে, অভি মাথা নাড়াল, ঠিক জানে না। বল্বিন্দার ওদের কথা শুনে উত্তর দিল যে, হোটেলের ম্যানেজার কে ও জিজ্ঞেস করে রাস্তা যেনে নিয়েছে, আরও ঘন্টা দশেক লাগবে চিতকুল পৌঁছতে। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে ফাগু ছাড়িয়ে আবার এন.এইচ.22 ধরল।
পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে জানালার বাইরে অবাক হয়ে তাকিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে চলেছে। বাম হাতে অভি ওকে জড়িয়ে ধরে, পরী ওর হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছে।
কারুর মুখে কোন কথা নেই, দু’জনেই চুপ করে বসে একে ওপরের আদর খেয়ে চলেছে। কিছু পরে নারকান্ডা এল, তারপরে গাড়ি নিচে নামতে শুরু করল। কিছু দূর যাবার পরে গাড়ি একটা নদীর পাশ দিয়ে চলতে শুরু করল। পরী পাহাড়ি নদী দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।
"উম্ম... কি সুন্দর ছোট্ট নদী। কি নাম নদীটার" পরী অভি’কে জিজ্ঞেস করল।
অভি, "সম্ভবত সাটলুজ নদী।"
পরী, "মানে বাঙ্গালয় শতদ্রু তাই ত?"
অভি, "তাই হবে।"
পরী বল্বিন্দার কে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল, নদীর পাড়ে গিয়ে নদীর জল ছুঁতে চায়। অভি বলল যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা আর নদীর জল হিমের মতন হবে। পরী ওর কথায় কান দিলনা। জোর করে বল্বিন্দার কে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামা মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে এক দৌড়ে নদীর পাড়ে।
পরী ওর দিকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, "তুমি আসছ না আমি নদীতে ঝাপ দেব?"