27-02-2019, 02:31 PM
মেঘ রোদ্দুর (#01)
অভি বাস থেকে নামতেই ওর মা ওকে এককোনে ডেকে নিয়ে যায়। মায়ের ডাক শুনে অভির ত আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার যোগাড়। বুকের মাঝে এক ঝড় ওঠে, মা কি বুঝতে পেরে গেল নাকি ওর আর পরীর হৃদ্যতা?
মা অভিকে বললেন যে রাতের খাবার যেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় অভি, বরযাত্রী নিয়ে বাস ফিরে যাবে রাত এগারোটার মধ্যে। অভিকে জিজ্ঞেস করলেন যে ও কি করতে চায়, থাকতে চায় না বরযাত্রীর দের সাথে ফিরে যেতে চায়। ওর অনেক দিনের সখ বাঙালি বিয়ে দেখার, তাই অভি জানিয়ে দেয় যে ও রাতে থাকবে এবং পরের দিন বরের সাথে বাড়ি ফিরবে। মা সম্মতি দিয়ে দিলেন।
কনের বাড়িতে বরযাত্রী পৌঁছান মাত্রই চারদিকে হইহই রব উঠল, বর এসেছে বর এসেছে। বিয়ে বাড়ির ভিড়ে আবার অভি একা। এখানে পরীকে খোঁজা বোকামো। পরীর ছোটো দাদার বিয়ে আর সে মজা করবে না সেটা ভাবা উচিত নয়। ওই আত্মীয় সজ্জনের মাঝে পরী কোথাও হারিয়ে আছে। অভি বিয়ের মণ্ডপে একা বর, সুব্রতর সাথে বসে। ', মন্ত্র পরে চলেছে।
মাঝে মাঝে পরীর দেখা পায় অভি, এদিক ওদিক নাচা নাচি করছে, এমন দেখাচ্ছে যেন খুব ব্যাস্ত।
ওর অর্বাচীন ব্যাস্ততার মধ্যেই পরী একবার অভির কাছে আসে, অভির বুক ধুকপুক করছে, এই বুঝি কিছু বলে ফেলে। পরী ওর দিকে না তাকিয়েই বলে "এই কি গো, এই রকম গাধার মতন একা বসে কেন? এস না আমার সাথে।"
অভিও ওর দিকে তাকাতে পারছে না, গলা শুকিয়ে এসেছে অভির। তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিল, "না মানে, তোমার সাথে সবসময়ে মহিলারা থাকেন, আর মহিলাদের সঙ্গ আমার একটু অস্বস্তিকর।"
পরী, "ঠিক আছে তাহলে, একা একা বসে ঠাক এখানে। যাই হক জানিয়ে গেলাম যে ডিনার খেতে ভুলে যেও না যেন। সবাই কিন্তু খাবার পরে চলে যাবে, শুধু মাত্র সুব্রতদার কয়েক জন বন্ধুরা রাতে থাকবে।"
অভি, "আমি রাতে থাকছি, মা আমাকে পারমিসান দিয়ে দিয়েছে।"
পরী এতক্ষণ পরে কৌতূহলী চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকাল, "তুমি কি বলতে চাও যে আমিও রাতে থাকব?"
অভি, "সেটা তোমার ব্যাপার, পরী।"
পরী ওর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল, "ঠিক আছে, তোমাকে আমি দেখে নেব, আর তুমি অচিরেই জানতে পারবে আমি কি করতে পারি।" রেগে মেগে অখান থেকে চলে গেল পরী।
রাতের খাবার পরে বরযাত্রী ফিরে যাবার জন্য তৈরি। অভি ওদের সাথে বাসের কাছে দাঁড়িয়ে। পরী ফিরে যেতে নারাজ।
অভির মা বারংবার পরীকে বঝাতে চেষ্টা করে চলেছেন, "পরী, কোন মেয়েছেলেরা রাতে এই বাড়িতে থাকছে না। সেই মত অবস্থায় কিকরে তোমাকে আমি রেখে যাই বল। মাসিমা কি বলবে?"
পরী মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, "কেন, তুমিও ত একসময়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসতে। তুমি অনুমতি দিলে ত আর কোন কথা থাকে না। প্লিস প্লিস প্লিস, আমাকে রাতে থাকতে দাও।"
মা শেষ পর্যন্ত পরীর আব্দারের কাছে মাথা নোয়াল। অভিকে কাছে ডেকে বলল, "এই ছেলে, পরী রাতে এখানে থাকবে। ওর দিকে নজর রাখিস। ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোকে আস্ত রাখব না।"
পরী রাতে থাকবে যেনে অভির মন খুশিতে ভরে উঠল। বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে ও পরীর খেয়াল রাখবে। পরী মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে বলল, "আমার সোনা দিদি – মা। আমি ভাল করে থাকব একদম দুষ্টুমি করব না।"
বরযাত্রী প্রস্থান করার পরে অভি আবার বিয়ের মন্ডপে গিয়ে বসে পড়ল। পরী আবার ভিড়ের মধ্যে কোথাও হারিয়ে গেল। অভি মাঝে মাঝেই দেখা পায় যে পরী ওর শালখানি গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর চলন দেখে অভির মনের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করে উঠল, মনে হচ্ছিল যেন এই উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আর ওই রাঙ্গা ঠোঁটে শত চুম্বন এঁকে দেয়।
ধিরে ধিরে রাত গভীর হতে থাকে। কনের বাড়ির অনেক লোকজন চলে গেছে। বরের বাড়ি থেকে শুধু সুব্রতর দুই বন্ধু, সুব্রতর বড় দা, সুমন্ত মামা আর অভি আর পরী। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে, ধিরে ধরে লগ্নের সময় ঘনিয়ে আসছে।
এর মধ্যে কোন এক সময়ে পরী চুপিচুপি এসে অভির পাশে এসে গা ঘেসে দাঁড়ায়। হাতের ওপর হাতের স্পর্শ, মাঝে মাঝে কোমল আঙ্গুলের ছোঁয়া। কিন্তু কেউই কারুর দিকে তাকায় না, দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে হোমের আগুনের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে।
এরই মাঝে একজন মহিলা এসে পরীকে জিজ্ঞেস করে যে ও শুতে যেতে চায় কিনা। বরযাত্রীর জন্য আলাদা করে রাতে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। পরী মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে ও শুতে যেতে চায় না।
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল যে একটু হাটা যেতে পারে কিনা। কিছু উত্তর না দিয়ে চুপচাপ অভির পাশে হাঁটতে শুরু করল পরী। দু’জনে অন্ধকার রাস্তা ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। শীতের রাত, নিজেকে গরম রাখার জন্য অভির শালটা গায়ের ওপরে জড়িয়ে রেখেছে। দুই হাত বুকের কাছে আড় করে, মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে অভির পাশে হেঁটে চলেছে। দুজনেই একদম চুপ কারুর মুখে কোন কথা নেই। এই নিস্তব্ধতা বড় হ্রদয় বিদারক হয়ে দাঁড়ায় দু’জনার পক্ষে। অভি ভাবতে থাকে যে কাউকে ত শুরু করতে হবে।
কিছু দোনামোনা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এত চুপ করে কেন পরী? কিছু কি হয়েছে?"
গলা কেঁপে ওঠে পরীর, "তুমি বলতে চাও যে কিছুই হয়নি।"
অভি, "আমি কি করলাম?"
পরী, "তুমি এই বলতে চাও যে তুমি কিছুই করনি। জান আমি যেন একটা বিদ্যুৎ ঝটকা খাই। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম সিটের ওপরে, নড়বার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি, আর তুমি বলছ যে তুমি কিছু কর নি?"
কাঁপা গলায় বলল অভি, "না মানে, হটাত করে কেন জানিনা খুব ইচ্ছে হল..."
পায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে পরী, "চোখের সামনে সবকিছু কালো অন্ধকার হয়ে গেছিল। এমন টি মনে হয়েছিল যেন আমি বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে স্থাণুবৎ হয়ে গেছি।"
রাস্তার মাঝে পরীর কাঁধে হাত রেখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল অভি। মাথা নিচু করে পরীর মুখের দিকে তাকাল। তর্জনী দিয়ে পরীর চিবুক স্পর্শ করে উঁচু করে নিল ওর মুখ। পরীর দু’চোখ বন্ধ, অজানা এক আশঙ্কায় তিরতির করে কাপছে দু ঠোঁট। দু’চোখের বড়বড় পাতা কাপছে তার সাথে। গায়ের শালখানি আরও আস্টেপৃষ্টে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে ধরল পরী। অভির ঠোঁট ধিরে ধরে নেমে এল, পরীর লাল ঠোঁটের কাছে। প্রেয়সীর গরম নিঃশ্বাস সারা মুখের ওপরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন হাপর টানছে। এক অনাবিল প্রত্যাশায় বুক কাপছে পরীর, নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ছে আগুন। নাকে নাক ঠেকল প্রথমে। ডিসেম্বরের সেই শীতের রাতেও নাকের ডগায় ঘামের ফোঁটা অনুভব করল দু’জনেই। দুজনের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। ঠোঁটের মাঝে একচিলতে ব্যাবধান। এত কাছে আসার পরেও যেন সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছে না অভি, কোন কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে, কাজল কালো দুচোখ খুলল পরী। চোখে জল টলমল করছে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। অবশেষে দুজনের মাঝের নিস্তব্ধতা ভাঙলও পরী। অশ্রু ভরা নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলে উঠল, "না অভি না। আমি পারব না অভি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর যাও।"
কথাটা বলেই বিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল।
সেই শীতের রাতে একা অন্ধকার রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু তালুকদার। বড় একা মনে হল নিজেকে, মনে হল কেউ নেই তার পাশে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে খুব বড় এক টান দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, "আমি কে, আমি কি, কে এই অভিমন্যু?"
বুকের কোন এক কোণ থেকে উত্তর এল, "তুমি বিধ্বস্ত পরাজিত এক নাবিক!"
চোখে জল চলে এল অভির, নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করল যে চোখের জল সিগারেটের ধোঁয়ার জন্য এসেছে, কিন্তু পাপী মন মানতে চায় না সে কথা। অস্ফুট চিৎকার করে উঠল অভি, "না আমার কোন অধিকার নেই কাউকে আঘাত করার। শুচিস্মিতা কে আঘাত দেবার কোণ অধিকার আমার নেই।"
যা কিছু ঘটে চলেছে বা ঘটে গেছে তা হয়ত ঘটা উচিত হয়নি। ওরা কি কোন পাপ করেছে? এই সমাজ ওদের দুজনকে সাংসারিক জীবনের বন্ধনে হয়ত বাঁধতে দেবে না ওদের দুজন কে। কিছু সম্পর্ক এই সমাজের কাছে অপবিত্র।
মাথা নিচু করে এই সব ভাবতে ভাবতে বিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিল অভি। এক সময়ে দূর থেকে কেউ অভি কে ডাক দিল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল সুব্রতর কোণ একজন বন্ধু অভিকে বিয়ের মন্ডপে ডাকছে। বিয়ের পালা শেষ, সবাই খেতে বসবে তাই অভির খোঁজ পড়েছে।
বিয়ের মন্ডপে প্রবেশ করে অভি দেখতে পেল যে পরী মন্ডপের এক কোনায় চুপ করে বসে। থমথমে চোখ মুখ নিয়ে নিস্পলক দৃষ্টিতে এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে নিভে যাওয়া হোমের আগুনের দিকে। ফর্সা নাকের ডগা গোলাপের মতন লাল হয়ে উঠেছে। খানিক দূর থেকে অভি বুঝতে পারল যে ওর চোখের পাতা ভিজে, পিঠের ওঠা নামা দেখে বুঝতে পারল যে ফুঁফিয়ে ফুফিয়ে কঁদছে পরী।
বড় ধাক্কা খেল অভি, কেন পরী কাঁদছে? এত একদম ভাল কথা নয়, কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
অভি বাস থেকে নামতেই ওর মা ওকে এককোনে ডেকে নিয়ে যায়। মায়ের ডাক শুনে অভির ত আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার যোগাড়। বুকের মাঝে এক ঝড় ওঠে, মা কি বুঝতে পেরে গেল নাকি ওর আর পরীর হৃদ্যতা?
মা অভিকে বললেন যে রাতের খাবার যেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় অভি, বরযাত্রী নিয়ে বাস ফিরে যাবে রাত এগারোটার মধ্যে। অভিকে জিজ্ঞেস করলেন যে ও কি করতে চায়, থাকতে চায় না বরযাত্রীর দের সাথে ফিরে যেতে চায়। ওর অনেক দিনের সখ বাঙালি বিয়ে দেখার, তাই অভি জানিয়ে দেয় যে ও রাতে থাকবে এবং পরের দিন বরের সাথে বাড়ি ফিরবে। মা সম্মতি দিয়ে দিলেন।
কনের বাড়িতে বরযাত্রী পৌঁছান মাত্রই চারদিকে হইহই রব উঠল, বর এসেছে বর এসেছে। বিয়ে বাড়ির ভিড়ে আবার অভি একা। এখানে পরীকে খোঁজা বোকামো। পরীর ছোটো দাদার বিয়ে আর সে মজা করবে না সেটা ভাবা উচিত নয়। ওই আত্মীয় সজ্জনের মাঝে পরী কোথাও হারিয়ে আছে। অভি বিয়ের মণ্ডপে একা বর, সুব্রতর সাথে বসে। ', মন্ত্র পরে চলেছে।
মাঝে মাঝে পরীর দেখা পায় অভি, এদিক ওদিক নাচা নাচি করছে, এমন দেখাচ্ছে যেন খুব ব্যাস্ত।
ওর অর্বাচীন ব্যাস্ততার মধ্যেই পরী একবার অভির কাছে আসে, অভির বুক ধুকপুক করছে, এই বুঝি কিছু বলে ফেলে। পরী ওর দিকে না তাকিয়েই বলে "এই কি গো, এই রকম গাধার মতন একা বসে কেন? এস না আমার সাথে।"
অভিও ওর দিকে তাকাতে পারছে না, গলা শুকিয়ে এসেছে অভির। তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিল, "না মানে, তোমার সাথে সবসময়ে মহিলারা থাকেন, আর মহিলাদের সঙ্গ আমার একটু অস্বস্তিকর।"
পরী, "ঠিক আছে তাহলে, একা একা বসে ঠাক এখানে। যাই হক জানিয়ে গেলাম যে ডিনার খেতে ভুলে যেও না যেন। সবাই কিন্তু খাবার পরে চলে যাবে, শুধু মাত্র সুব্রতদার কয়েক জন বন্ধুরা রাতে থাকবে।"
অভি, "আমি রাতে থাকছি, মা আমাকে পারমিসান দিয়ে দিয়েছে।"
পরী এতক্ষণ পরে কৌতূহলী চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকাল, "তুমি কি বলতে চাও যে আমিও রাতে থাকব?"
অভি, "সেটা তোমার ব্যাপার, পরী।"
পরী ওর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল, "ঠিক আছে, তোমাকে আমি দেখে নেব, আর তুমি অচিরেই জানতে পারবে আমি কি করতে পারি।" রেগে মেগে অখান থেকে চলে গেল পরী।
রাতের খাবার পরে বরযাত্রী ফিরে যাবার জন্য তৈরি। অভি ওদের সাথে বাসের কাছে দাঁড়িয়ে। পরী ফিরে যেতে নারাজ।
অভির মা বারংবার পরীকে বঝাতে চেষ্টা করে চলেছেন, "পরী, কোন মেয়েছেলেরা রাতে এই বাড়িতে থাকছে না। সেই মত অবস্থায় কিকরে তোমাকে আমি রেখে যাই বল। মাসিমা কি বলবে?"
পরী মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, "কেন, তুমিও ত একসময়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসতে। তুমি অনুমতি দিলে ত আর কোন কথা থাকে না। প্লিস প্লিস প্লিস, আমাকে রাতে থাকতে দাও।"
মা শেষ পর্যন্ত পরীর আব্দারের কাছে মাথা নোয়াল। অভিকে কাছে ডেকে বলল, "এই ছেলে, পরী রাতে এখানে থাকবে। ওর দিকে নজর রাখিস। ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোকে আস্ত রাখব না।"
পরী রাতে থাকবে যেনে অভির মন খুশিতে ভরে উঠল। বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে ও পরীর খেয়াল রাখবে। পরী মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে বলল, "আমার সোনা দিদি – মা। আমি ভাল করে থাকব একদম দুষ্টুমি করব না।"
বরযাত্রী প্রস্থান করার পরে অভি আবার বিয়ের মন্ডপে গিয়ে বসে পড়ল। পরী আবার ভিড়ের মধ্যে কোথাও হারিয়ে গেল। অভি মাঝে মাঝেই দেখা পায় যে পরী ওর শালখানি গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর চলন দেখে অভির মনের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করে উঠল, মনে হচ্ছিল যেন এই উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আর ওই রাঙ্গা ঠোঁটে শত চুম্বন এঁকে দেয়।
ধিরে ধিরে রাত গভীর হতে থাকে। কনের বাড়ির অনেক লোকজন চলে গেছে। বরের বাড়ি থেকে শুধু সুব্রতর দুই বন্ধু, সুব্রতর বড় দা, সুমন্ত মামা আর অভি আর পরী। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে, ধিরে ধরে লগ্নের সময় ঘনিয়ে আসছে।
এর মধ্যে কোন এক সময়ে পরী চুপিচুপি এসে অভির পাশে এসে গা ঘেসে দাঁড়ায়। হাতের ওপর হাতের স্পর্শ, মাঝে মাঝে কোমল আঙ্গুলের ছোঁয়া। কিন্তু কেউই কারুর দিকে তাকায় না, দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে হোমের আগুনের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে।
এরই মাঝে একজন মহিলা এসে পরীকে জিজ্ঞেস করে যে ও শুতে যেতে চায় কিনা। বরযাত্রীর জন্য আলাদা করে রাতে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। পরী মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে ও শুতে যেতে চায় না।
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল যে একটু হাটা যেতে পারে কিনা। কিছু উত্তর না দিয়ে চুপচাপ অভির পাশে হাঁটতে শুরু করল পরী। দু’জনে অন্ধকার রাস্তা ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। শীতের রাত, নিজেকে গরম রাখার জন্য অভির শালটা গায়ের ওপরে জড়িয়ে রেখেছে। দুই হাত বুকের কাছে আড় করে, মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে অভির পাশে হেঁটে চলেছে। দুজনেই একদম চুপ কারুর মুখে কোন কথা নেই। এই নিস্তব্ধতা বড় হ্রদয় বিদারক হয়ে দাঁড়ায় দু’জনার পক্ষে। অভি ভাবতে থাকে যে কাউকে ত শুরু করতে হবে।
কিছু দোনামোনা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এত চুপ করে কেন পরী? কিছু কি হয়েছে?"
গলা কেঁপে ওঠে পরীর, "তুমি বলতে চাও যে কিছুই হয়নি।"
অভি, "আমি কি করলাম?"
পরী, "তুমি এই বলতে চাও যে তুমি কিছুই করনি। জান আমি যেন একটা বিদ্যুৎ ঝটকা খাই। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম সিটের ওপরে, নড়বার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি, আর তুমি বলছ যে তুমি কিছু কর নি?"
কাঁপা গলায় বলল অভি, "না মানে, হটাত করে কেন জানিনা খুব ইচ্ছে হল..."
পায়ের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে পরী, "চোখের সামনে সবকিছু কালো অন্ধকার হয়ে গেছিল। এমন টি মনে হয়েছিল যেন আমি বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে স্থাণুবৎ হয়ে গেছি।"
রাস্তার মাঝে পরীর কাঁধে হাত রেখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল অভি। মাথা নিচু করে পরীর মুখের দিকে তাকাল। তর্জনী দিয়ে পরীর চিবুক স্পর্শ করে উঁচু করে নিল ওর মুখ। পরীর দু’চোখ বন্ধ, অজানা এক আশঙ্কায় তিরতির করে কাপছে দু ঠোঁট। দু’চোখের বড়বড় পাতা কাপছে তার সাথে। গায়ের শালখানি আরও আস্টেপৃষ্টে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে ধরল পরী। অভির ঠোঁট ধিরে ধরে নেমে এল, পরীর লাল ঠোঁটের কাছে। প্রেয়সীর গরম নিঃশ্বাস সারা মুখের ওপরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন হাপর টানছে। এক অনাবিল প্রত্যাশায় বুক কাপছে পরীর, নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ছে আগুন। নাকে নাক ঠেকল প্রথমে। ডিসেম্বরের সেই শীতের রাতেও নাকের ডগায় ঘামের ফোঁটা অনুভব করল দু’জনেই। দুজনের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। ঠোঁটের মাঝে একচিলতে ব্যাবধান। এত কাছে আসার পরেও যেন সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছে না অভি, কোন কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে, কাজল কালো দুচোখ খুলল পরী। চোখে জল টলমল করছে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। অবশেষে দুজনের মাঝের নিস্তব্ধতা ভাঙলও পরী। অশ্রু ভরা নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলে উঠল, "না অভি না। আমি পারব না অভি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর যাও।"
কথাটা বলেই বিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল।
সেই শীতের রাতে একা অন্ধকার রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু তালুকদার। বড় একা মনে হল নিজেকে, মনে হল কেউ নেই তার পাশে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে খুব বড় এক টান দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, "আমি কে, আমি কি, কে এই অভিমন্যু?"
বুকের কোন এক কোণ থেকে উত্তর এল, "তুমি বিধ্বস্ত পরাজিত এক নাবিক!"
চোখে জল চলে এল অভির, নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করল যে চোখের জল সিগারেটের ধোঁয়ার জন্য এসেছে, কিন্তু পাপী মন মানতে চায় না সে কথা। অস্ফুট চিৎকার করে উঠল অভি, "না আমার কোন অধিকার নেই কাউকে আঘাত করার। শুচিস্মিতা কে আঘাত দেবার কোণ অধিকার আমার নেই।"
যা কিছু ঘটে চলেছে বা ঘটে গেছে তা হয়ত ঘটা উচিত হয়নি। ওরা কি কোন পাপ করেছে? এই সমাজ ওদের দুজনকে সাংসারিক জীবনের বন্ধনে হয়ত বাঁধতে দেবে না ওদের দুজন কে। কিছু সম্পর্ক এই সমাজের কাছে অপবিত্র।
মাথা নিচু করে এই সব ভাবতে ভাবতে বিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিল অভি। এক সময়ে দূর থেকে কেউ অভি কে ডাক দিল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল সুব্রতর কোণ একজন বন্ধু অভিকে বিয়ের মন্ডপে ডাকছে। বিয়ের পালা শেষ, সবাই খেতে বসবে তাই অভির খোঁজ পড়েছে।
বিয়ের মন্ডপে প্রবেশ করে অভি দেখতে পেল যে পরী মন্ডপের এক কোনায় চুপ করে বসে। থমথমে চোখ মুখ নিয়ে নিস্পলক দৃষ্টিতে এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে নিভে যাওয়া হোমের আগুনের দিকে। ফর্সা নাকের ডগা গোলাপের মতন লাল হয়ে উঠেছে। খানিক দূর থেকে অভি বুঝতে পারল যে ওর চোখের পাতা ভিজে, পিঠের ওঠা নামা দেখে বুঝতে পারল যে ফুঁফিয়ে ফুফিয়ে কঁদছে পরী।
বড় ধাক্কা খেল অভি, কেন পরী কাঁদছে? এত একদম ভাল কথা নয়, কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।