20-06-2020, 09:53 AM
রাতে বিছানায় শুয়ে সুধু সেই পুচকি অনুর মুখ বার বার। কেঁদে চলেছি, রজত বুঝতে পেরে টেনে নিল
.........ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে রজত একবার, সুধু একবার। এতদিন দেখার ইচ্ছা হয়নি, কিন্তু ওই গান “ ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল”, কার জন্য দ্বার খুলে রাখবো রজত? জানি দেখা মানে উন্মুক্ত দ্বার দেখিয়ে দেওয়া ঝড় কে, তবুও দেখতে ইচ্ছা করছে।দূর থেকে দেখতে যাব রজত?
......হ্যাঁ যাবে। আমারও ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে।ইচ্ছা করছে সম কে বলি “ নিয়ে আয় তোর গার্ল ফ্রেন্ড কে একদিন” কিন্তু ভয় সম? সে কি ভাবে নেবে সত্য কে?
.........আমরা কি সব প্রকাশ করে দেব সম এর কাছে
.........জানিনা সোমা। বুঝতে পারছিনা। কোথায় দাড়াবে আমাদের সম্পর্ক, যখন সম জানতে পারবে যে তার বাবা আর মা প্রতারক, আনফেথফুল, সম যদি আমাদের না থাকে, ও যদি অনুর ভাই হয়ে থাকতে চায়, তাহলে?
সমস্ত রাত জেগে কাটালাম। মনের আবেগকে শক্ত করে লাগাম পড়ালাম। ‘না, কিছুতেই সম কে জানতে দেব না। আমি এক সন্তান হারিয়েছি নিজের পাপে, সম কে হারাতে পারব না। সকালে রজতকে জানিয়ে দিলাম
......রজত, সম যদি ওকে এ বাড়িতে আনতে চায়, আমরা ‘না’ করে দেব। হাতে ধরে ঝড় কে স্বাগতম জানাব না। তবে আমি ওকে দেখব, যে করেই হোক, অন্তত একবার। আমি মনস্থির করে নিয়েছি।
সম এর কথায় বুঝতে পারি ওদের ৩ জনের মানে অনু, সম আর অনুর বন্ধু সন্দীপ বলে একটি ছেল্* খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রায় সময়েই দেখি ফোনে হি হি করছে। একদিন সকালে ৩ জন ওই সন্দীপ বলে ছেলেটির সাথে কোথায় বেরাতে গেল। সন্ধ্যা বেলায় ( এখানে অনেক্ষন আলো থাকে) বারান্দায় বসে কাকতালীয় ভাবে “ প্রথম আলো” সুনিল গাঙ্গুলির, পড়ছি।বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা ছোট গাড়ি এসে দাঁড়াল। আমার বারান্দার পর একটু বাগান, তারপর ফুট ২০ ফাকা যায়গা, তারপর রাস্তা। বারান্দা থেকে দেখতে পারছি একটি ছেলে গাড়ির স্টিয়ারিং এ, পাশে একটি মেয়ে। সম দরজা খুলে নেমেও হেসে হেসে কথা বলছে, কোথা থেকে এই সময় এক অবুঝ বাতাস কানে গেল গুনগুনিয়ে “ ওই যে অনু। সোমা অনু , তোর প্রথম সন্তান, তোর দ্বারে, দেখবি না”। মুহূর্তে হাওআয় উড়িয়ে দিলাম সব প্রতিজ্ঞা, “ দেখব। যা হবার হবে। আমার সন্তান আজ আমার দ্বারে, ফিরাব না তাকে, কি হবে দেখা যাবে, ও আমার অনু” প্রায় দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে সম কে ডেকে ওদের ভীতরে নিয়ে আসতে বললাম। সম অবাক হয়ে তাকাল, কেননা বাড়িতে কোন বন্ধুকে আনতে হলে পারমিসন নিয়ে নেয়, আর আজ মা নিজে এসে ডাকছে।
......ওদের নিয়ে ভীতরে এসো, এই তোমরা আমার বাড়ি এসো, একটু বসে যাও...রজত বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে। সারা শরীর কাঁপছে , বুকের শব্দ শুনতে পারছি, রক্তের গতি অসম্ভব ধ্রুত। বারান্দায় উঠে এসে বুঝলাম, চোখে জল, নিজেকে ঠিক রাখার জন্য আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রেলিং ধরলাম, সে নামল, খুব লম্বা, ৫ ফুট ৭-৮ ইঞ্চি হবে, জিন্স আর পোলো নেক গেঞ্জি গায়ে, পায়ে স্নিকার। নেমে চুলের ক্লিপ ঠিক করে নিল।ঠাসবুনট এক রাস কাল চুল পিঠে ছড়িয়ে, চোখ দুটো অনির মতো উজ্জ্বল। ২৫ বছর পর যে সৌম্যগন্ধা কে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলে চলে এসেছিলাম, সে আমার সামনে। যেন বলছে “ পারলে তোমার শিকড় কে অস্বিকার করতে“। সৌম্যগন্ধা আমার খোলা দ্বারে। মন মাতান হাসি হেসে
.........মা শিখিয়েছেন বন্ধুর মা, নিজের মা-এর মতন। আমি আপনাকে প্রনাম করতে চাই......অস্ফুট হ্যাঁ বেরল। প্রথম প্রনাম পেলাম আজ ২৫ বছর পর আমার প্রথম সন্তানের। চিবুক ধরে চুমু খেলাম ,রজত কে প্রনাম করতে আশীর্বাদ করল মাথায় হাত রেখে “ তোমার মঙ্গল হোক”। সন্দীপ হাত জরো করে নমস্কার করল। আচ্ছা অনু কি আমার চোখে জল দেখতে পেয়েছিল? ঘরে নিয়ে বসাতে মনে হোল, এত আলো কোথা থেকে এলো, এত উজ্জ্বল, এত রঙ্গিন কেন আজ আমার বাড়ি, বাতাস আজ খুসি খুসি কেন? আগে কোনদিন তো হয়নি। মিনিট ১৫ ছিল, একটু কেক আর ফল খেল। কেউ কেউ হাসলে মনে হয় সমস্ত ঘর হাসছে, অনুর হাসি সেইরকম। দু চোখ ভরে ওকে দেখছিলাম, যেটুকু সময় ছিল। সেন্স অফ হিউমার আছে। প্রথমে ইংরাজিতে কথা বলতে
......আনটি বাংলায় বলুন। সন্দীপের মা বাঙালি। বাংলা না জানলে কি প্রেম করা চলে...আবার সেই হাসি। প্রান চাইছিল দুই হাতে জড়িয়ে ধরি, মাথা বাধা দিল।
মহালয়ার ভোর বেলায় অনুর জন্ম, বাবা তাই নাম রেখেছিলেন “অহনা”। ঠিক করে নিলাম ওর জন্ম দিনে ওকে রেঁধে খাওয়াব। বুঝে গেছি ঝড় আসবেই, কিন্তু সে আসুক আমার সময়মত। কিন্তু সম যখন জানবে ওর বাবা আর মায়ের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অবৈধ, সমস্তটাই মিথ্যার ওপর দাড়িয়ে তখন কি হবে?
উত্তর জানিনা।
অহনা
সামার সেমিস্টার সুরু হয়েছে, আমি আর সন্দীপ হাঁটছি। রোজ হাটি আমরা ওই জায়গায়, শুনতে পেলাম পিছন থেকে কেউ ডাকছে। ঘুরে তাকাতে দেখি নিস্পাপ চেহারার একটি বছর ২২-২৩ এর ছেলে সুন্দর দেখতে, লম্বা,হাসি হাসি মুখ
......হাই, আমি সোমরাজ সেন, সম, বন্ধুত্ব করবে আমার সাথে...হাত বারিয়ে দিলাম
......আমি অহনা আর এ সন্দীপ
......অনা, আমি তোমায় ওই নামে ডাকব। আমার বাংলা উচ্চারণ ভাল না। এখানেই জন্মেছি আর বড় হয়েছি, তাই
......সম, ওই বাংলাতেই চলবে বুঝলি। আমি তো ওই ভাঙ্গা বাংলাতেই প্রেম করছি। বল তোর কথা বল......সুরু হোল আমাদের বন্ধুত্ব। উফফ, কথা বলতে পারে বটে সম। অনর্গল বলে চলে, বেশিরভাগ সময় সম্পর্কের উষ্ণতা নিয়ে। সন্দীপ বলে যে সম যৌবনে পৌঁছেছে কিন্তু মনের দিক থেকে এখনও কিশোর। ভীষণ ছেলেমানুষি আছে ওর ব্যাবহারে। এখন রোজ ৩ জনে একসাথে হাটি আর সম কথা বলে। ওর খুব দুঃখ যে ওর কোন ভাই বা বোন নেই। এমনকি কোন কাজিন ভাই বোন ও নেই। কলকাতায় কোথায় ওর বাবা মা থাকতেন তাও নাকি তাদের মনে নেই। সে কি রে বাবা, এরকম কি হয় নাকি। কে জানে।সমের প্রশ্নর উত্তর দিতে দিতে আমার অবস্থা খারাপ। কাকা কি, জ্যাঠা, মামা কাদের বলে তাদের স্ত্রী দের কি বলে একাধিক ভাই বোন থাকলে কি বলে ডাকে, কাজিন ভাই বোন দের কি বলে ডাকে, এই সব হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু বলার ভঙ্গি এত মিষ্টি যে উত্তর না দিয়ে পারা যায়না। আর আমাকে দিয়ে রোজ একবার গাওয়াবেই “ ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল”। গানটাতে একটা মিষ্টি ছন্দ আছে, নাচের ছন্দ, তাই আমারও খুব ভাল লাগে। সম কলকাতায় যাবে ওর শিকড় খুঁজতে, মানে ওর পিতৃপুরুষ এর খোজে। কিন্তু ওর বাবা আর মা এই ব্যাপারে ওকে কোনরকম কিছু বলে না, ভাসা ভাসা উত্তর দেন। মনে হয় কিছু লুকোতে চান তারা। একদিন
......অনা, কলকাতায় হোটেলের কি রকম খরচা
......আমি তো কোনদিন কলকাতায় হোটেলে থাকিনি তাই বলতে পারবনা। ৫ তারা হোটেল আছে অনেক। একটা হোটেল জানি মাত্র একতারা হোটেল, বোর্ডার মাত্র ৫ জন আর খুব বেশি খরচা হবে বলে মনে হয়না
......তাও কি রকম খরচা হতে পারে
...... আজ রাতে মা-কে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে কাল জানাব......প্রথমে ধরতে পারেনি, তারপর আমাকে জড়িয়ে প্রাণখোলা হাসি। সম কে ভাল না বেসে পারা যায় না,এত নির্মল আর নিস্পাপ।
মা-কে সম এর কথা বলেছি, বাবা সব শুনে বলে উঠল “ বেশি ঘনিষ্ঠতার দরকার নেই, মেলামেশা না হলেই ভাল। বাবা যেন কি রকম হয়ে যাচ্ছে।
এর মাস ২-৩ পর এক সকালে সন্দীপের গাড়িতে ৩ জন বেড়াতে গেছি শহরের বাইরে একটু দূরে। যাওয়া আসায় প্রায় ২০০ কিলো মিটার। সমস্ত দিন সম বক বক করে গেছে আর সন্দীপের লেগ-পুলিং। ফেরার সময় “ মনে পরে রুবি রায়” গানের সুরে “ হুকো মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা” কথা লাগিয়ে গাইতে গাইতে ফেরা। সারা দিন হুল্লোড়। সম কে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসব, হাঠাৎ আমাদের সবাইকে অবাক করে সমের মা আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভিতরে। সমের মা-এর আন্তরিকতা আমায় হৃদয় স্পর্শ করেছে।খুব ভাল লেগেছে আমার ওনাকে, কেমন মা মা মতোন। খুব সুন্দরি ছিলেন একসময়, দেখলেই বোঝা যায়, খুব বেশি সময় বসিনি। কিন্তু আমি ওনাকে প্রনাম করতে, চোখে জল কেন ওনার?
এর কিছুদিন পর আমি আর সন্দীপ হাঁটছি, সম কোথা থেকে দৌড়ে এসে
.........অনা , মা তোমার সাথে কথা বলবে ......মোবাইল এগিয়ে দিল
.........হ্যাঁ, আনটি, বলুন
.........আহনা, তুমি আর সন্দীপ মহালয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা একটু আসবে আমাদের বাড়ি, আমরা একসাথে ডিনার করব?
......হ্যাঁ যাব। আপনি এত সুন্দর ভাবে ডাকছেন আর আমরা যাব না? নিশ্চয়ই যাব
আনটি সেদিন এলাহি আয়োজন করেছিলেন। লুচি, মাংস, ছোলার ডাল, চিংড়ির মালাইকার্* বেগুন ভাঁজা, পাঁপড় চাটনি পায়েস। অতসব খেয়ে পায়েস খেতে চাইছিলাম না, “ ঠিক আছে, ২ চামচ খাও”, খেতে হোল। মহিলা রাধেন ভাল। উনিও সেদিন উপোষ করে ছিলেন। এক সাথে খেলাম সবাই। অনেক কথা হোল, খুব আন্তরিক ব্যাবহার। ফেরার সময় সন্দীপ গাড়িতে কোন কথা বলছে না, সব কথার উত্তর হ্যাঁ, হু এই ভাবে যেন এরিয়ে যাচ্ছে
......কি হোল চুপ করে যে, কি ব্যাপার?
......কিছু না, রাত হয়েছে তাই সাবধানে চালাচ্ছি......বাড়ির সামনে এসে দরজা খুলে নামতে যাব
.....অনু, ধর্মরাজ, প্রথম পাণ্ডব কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “ কোন কথা বলতে নেই”, উত্তর টা কি বলত, মনে পরছেনা
.....অনু, ধর্মরাজ, প্রথম পাণ্ডব কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “ কোন কথা বলতে নেই”, উত্তর টা কি বলত, মনে পরছেনা
......অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে নেই। এত রাতে এই হেঁয়ালির মানে কি সন্দীপ
......আরে না না, রাগ করনা। এমনি মনে হোল তাই। গুড নাইট......মনটা খারাপ হয়ে গেল। সন্দীপটা যা তা। ঘরে ঢুকে স্পাই ক্যাম চালু করে মা-কে সব বললাম। মা খুটিয়ে খুটিয়ে রান্না কিরকম জানল। সুধু বাবা সমানে “ বেশি মেলামেশার দরকার নেই” বলে গেল। বাবার বিয়ে টা এইবার দিতেই হবে......হি হি হি।
১০ দিন পর এখানে দশেরার একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে, সব ভারতীয় সাজগোজ করে যায়। আমি সাজতে বসলাম। সেইদিন সম এর মা একটা লাল রঙের শাড়ি পরে ছিলেন, খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমিও একটা ওই রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউস পরলাম। ওনার মতো খোপা করে কাধের কাছে এলিয়ে দিয়ে মনে হোল একটা টিপ লাগাই তো।লাল রঙের টিপ লাগিয়ে আয়নায় তাকিয়ে চমকে গেলাম। এ কে? এ আমি কাকে দেখছি, এ তো সমের মা, তার মানে?অবশ হয়ে বিছানায় বসে আয়নায় তাকিয়ে একে একে মনে পড়ল। আমার জন্মদিন বলে ওই দিন উপোষ করে ছিলেন, জোর করে পায়েস খাওয়ানো, প্রথম দিন প্রনাম করতে চোখে জল, বাবার না না, সন্দীপের হেঁয়ালি। আগুন জলে উঠল সমস্ত শরীরে। সারা জীবনের মতো আমাদের পরিবারকে অসম্মানের মুখে ঠেলে, বাবার জীবন তছ নছ করে উনি মাতৃস্নেহ দেখাচ্ছেন। এর উত্তর আমি দেব। পাশে রাখা মোবাইল বেজে যাচ্ছে, সন্দীপের ফোন, সব খুলে হাতে চোখ ধেকে ডুকরে উঠলাম রাগে অপমানে। সন্দীপ একটু পরেই ঘরে এসে
......অনু কি হয়েছে?
......অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে নেই, তাই না সন্দীপ...চুপ করে থেকে
......আমি প্রথম দিনই বুঝেছিলাম। তোমাদের দুজনকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে। তোমার একটু সময় লাগল......সন্দীপকে আঁকড়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলাম। দুজনের কোথাও যাওয়া হোল না। ক্যামেরা চালু করে
......মা, সে।
......কে সে, কার কথা বলছিস অনু?
......সেই মহিলা, যে আমাদের পরিবার কে চরম অসম্মান করেছেন
......অ...নু......আরতনাদ করে উঠল মা
.........সমের মা। আমি সেই জন্যই মিশতে না করেছিলাম......নিম্ন স্বর শোনা গেল বাবার। আরও কিছু কথা হবার পর বন্ধ করলাম ক্যামেরা। মা বাবা কাকু আমাকে পই পই করে সাবধান করেছে, যেন সমের মনে কোন আঘাত না দি। সম নিষ্পাপ, নির্মল।
.........ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে রজত একবার, সুধু একবার। এতদিন দেখার ইচ্ছা হয়নি, কিন্তু ওই গান “ ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল”, কার জন্য দ্বার খুলে রাখবো রজত? জানি দেখা মানে উন্মুক্ত দ্বার দেখিয়ে দেওয়া ঝড় কে, তবুও দেখতে ইচ্ছা করছে।দূর থেকে দেখতে যাব রজত?
......হ্যাঁ যাবে। আমারও ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে।ইচ্ছা করছে সম কে বলি “ নিয়ে আয় তোর গার্ল ফ্রেন্ড কে একদিন” কিন্তু ভয় সম? সে কি ভাবে নেবে সত্য কে?
.........আমরা কি সব প্রকাশ করে দেব সম এর কাছে
.........জানিনা সোমা। বুঝতে পারছিনা। কোথায় দাড়াবে আমাদের সম্পর্ক, যখন সম জানতে পারবে যে তার বাবা আর মা প্রতারক, আনফেথফুল, সম যদি আমাদের না থাকে, ও যদি অনুর ভাই হয়ে থাকতে চায়, তাহলে?
সমস্ত রাত জেগে কাটালাম। মনের আবেগকে শক্ত করে লাগাম পড়ালাম। ‘না, কিছুতেই সম কে জানতে দেব না। আমি এক সন্তান হারিয়েছি নিজের পাপে, সম কে হারাতে পারব না। সকালে রজতকে জানিয়ে দিলাম
......রজত, সম যদি ওকে এ বাড়িতে আনতে চায়, আমরা ‘না’ করে দেব। হাতে ধরে ঝড় কে স্বাগতম জানাব না। তবে আমি ওকে দেখব, যে করেই হোক, অন্তত একবার। আমি মনস্থির করে নিয়েছি।
সম এর কথায় বুঝতে পারি ওদের ৩ জনের মানে অনু, সম আর অনুর বন্ধু সন্দীপ বলে একটি ছেল্* খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রায় সময়েই দেখি ফোনে হি হি করছে। একদিন সকালে ৩ জন ওই সন্দীপ বলে ছেলেটির সাথে কোথায় বেরাতে গেল। সন্ধ্যা বেলায় ( এখানে অনেক্ষন আলো থাকে) বারান্দায় বসে কাকতালীয় ভাবে “ প্রথম আলো” সুনিল গাঙ্গুলির, পড়ছি।বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা ছোট গাড়ি এসে দাঁড়াল। আমার বারান্দার পর একটু বাগান, তারপর ফুট ২০ ফাকা যায়গা, তারপর রাস্তা। বারান্দা থেকে দেখতে পারছি একটি ছেলে গাড়ির স্টিয়ারিং এ, পাশে একটি মেয়ে। সম দরজা খুলে নেমেও হেসে হেসে কথা বলছে, কোথা থেকে এই সময় এক অবুঝ বাতাস কানে গেল গুনগুনিয়ে “ ওই যে অনু। সোমা অনু , তোর প্রথম সন্তান, তোর দ্বারে, দেখবি না”। মুহূর্তে হাওআয় উড়িয়ে দিলাম সব প্রতিজ্ঞা, “ দেখব। যা হবার হবে। আমার সন্তান আজ আমার দ্বারে, ফিরাব না তাকে, কি হবে দেখা যাবে, ও আমার অনু” প্রায় দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে সম কে ডেকে ওদের ভীতরে নিয়ে আসতে বললাম। সম অবাক হয়ে তাকাল, কেননা বাড়িতে কোন বন্ধুকে আনতে হলে পারমিসন নিয়ে নেয়, আর আজ মা নিজে এসে ডাকছে।
......ওদের নিয়ে ভীতরে এসো, এই তোমরা আমার বাড়ি এসো, একটু বসে যাও...রজত বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে। সারা শরীর কাঁপছে , বুকের শব্দ শুনতে পারছি, রক্তের গতি অসম্ভব ধ্রুত। বারান্দায় উঠে এসে বুঝলাম, চোখে জল, নিজেকে ঠিক রাখার জন্য আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রেলিং ধরলাম, সে নামল, খুব লম্বা, ৫ ফুট ৭-৮ ইঞ্চি হবে, জিন্স আর পোলো নেক গেঞ্জি গায়ে, পায়ে স্নিকার। নেমে চুলের ক্লিপ ঠিক করে নিল।ঠাসবুনট এক রাস কাল চুল পিঠে ছড়িয়ে, চোখ দুটো অনির মতো উজ্জ্বল। ২৫ বছর পর যে সৌম্যগন্ধা কে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলে চলে এসেছিলাম, সে আমার সামনে। যেন বলছে “ পারলে তোমার শিকড় কে অস্বিকার করতে“। সৌম্যগন্ধা আমার খোলা দ্বারে। মন মাতান হাসি হেসে
.........মা শিখিয়েছেন বন্ধুর মা, নিজের মা-এর মতন। আমি আপনাকে প্রনাম করতে চাই......অস্ফুট হ্যাঁ বেরল। প্রথম প্রনাম পেলাম আজ ২৫ বছর পর আমার প্রথম সন্তানের। চিবুক ধরে চুমু খেলাম ,রজত কে প্রনাম করতে আশীর্বাদ করল মাথায় হাত রেখে “ তোমার মঙ্গল হোক”। সন্দীপ হাত জরো করে নমস্কার করল। আচ্ছা অনু কি আমার চোখে জল দেখতে পেয়েছিল? ঘরে নিয়ে বসাতে মনে হোল, এত আলো কোথা থেকে এলো, এত উজ্জ্বল, এত রঙ্গিন কেন আজ আমার বাড়ি, বাতাস আজ খুসি খুসি কেন? আগে কোনদিন তো হয়নি। মিনিট ১৫ ছিল, একটু কেক আর ফল খেল। কেউ কেউ হাসলে মনে হয় সমস্ত ঘর হাসছে, অনুর হাসি সেইরকম। দু চোখ ভরে ওকে দেখছিলাম, যেটুকু সময় ছিল। সেন্স অফ হিউমার আছে। প্রথমে ইংরাজিতে কথা বলতে
......আনটি বাংলায় বলুন। সন্দীপের মা বাঙালি। বাংলা না জানলে কি প্রেম করা চলে...আবার সেই হাসি। প্রান চাইছিল দুই হাতে জড়িয়ে ধরি, মাথা বাধা দিল।
মহালয়ার ভোর বেলায় অনুর জন্ম, বাবা তাই নাম রেখেছিলেন “অহনা”। ঠিক করে নিলাম ওর জন্ম দিনে ওকে রেঁধে খাওয়াব। বুঝে গেছি ঝড় আসবেই, কিন্তু সে আসুক আমার সময়মত। কিন্তু সম যখন জানবে ওর বাবা আর মায়ের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অবৈধ, সমস্তটাই মিথ্যার ওপর দাড়িয়ে তখন কি হবে?
উত্তর জানিনা।
অহনা
সামার সেমিস্টার সুরু হয়েছে, আমি আর সন্দীপ হাঁটছি। রোজ হাটি আমরা ওই জায়গায়, শুনতে পেলাম পিছন থেকে কেউ ডাকছে। ঘুরে তাকাতে দেখি নিস্পাপ চেহারার একটি বছর ২২-২৩ এর ছেলে সুন্দর দেখতে, লম্বা,হাসি হাসি মুখ
......হাই, আমি সোমরাজ সেন, সম, বন্ধুত্ব করবে আমার সাথে...হাত বারিয়ে দিলাম
......আমি অহনা আর এ সন্দীপ
......অনা, আমি তোমায় ওই নামে ডাকব। আমার বাংলা উচ্চারণ ভাল না। এখানেই জন্মেছি আর বড় হয়েছি, তাই
......সম, ওই বাংলাতেই চলবে বুঝলি। আমি তো ওই ভাঙ্গা বাংলাতেই প্রেম করছি। বল তোর কথা বল......সুরু হোল আমাদের বন্ধুত্ব। উফফ, কথা বলতে পারে বটে সম। অনর্গল বলে চলে, বেশিরভাগ সময় সম্পর্কের উষ্ণতা নিয়ে। সন্দীপ বলে যে সম যৌবনে পৌঁছেছে কিন্তু মনের দিক থেকে এখনও কিশোর। ভীষণ ছেলেমানুষি আছে ওর ব্যাবহারে। এখন রোজ ৩ জনে একসাথে হাটি আর সম কথা বলে। ওর খুব দুঃখ যে ওর কোন ভাই বা বোন নেই। এমনকি কোন কাজিন ভাই বোন ও নেই। কলকাতায় কোথায় ওর বাবা মা থাকতেন তাও নাকি তাদের মনে নেই। সে কি রে বাবা, এরকম কি হয় নাকি। কে জানে।সমের প্রশ্নর উত্তর দিতে দিতে আমার অবস্থা খারাপ। কাকা কি, জ্যাঠা, মামা কাদের বলে তাদের স্ত্রী দের কি বলে একাধিক ভাই বোন থাকলে কি বলে ডাকে, কাজিন ভাই বোন দের কি বলে ডাকে, এই সব হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু বলার ভঙ্গি এত মিষ্টি যে উত্তর না দিয়ে পারা যায়না। আর আমাকে দিয়ে রোজ একবার গাওয়াবেই “ ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল”। গানটাতে একটা মিষ্টি ছন্দ আছে, নাচের ছন্দ, তাই আমারও খুব ভাল লাগে। সম কলকাতায় যাবে ওর শিকড় খুঁজতে, মানে ওর পিতৃপুরুষ এর খোজে। কিন্তু ওর বাবা আর মা এই ব্যাপারে ওকে কোনরকম কিছু বলে না, ভাসা ভাসা উত্তর দেন। মনে হয় কিছু লুকোতে চান তারা। একদিন
......অনা, কলকাতায় হোটেলের কি রকম খরচা
......আমি তো কোনদিন কলকাতায় হোটেলে থাকিনি তাই বলতে পারবনা। ৫ তারা হোটেল আছে অনেক। একটা হোটেল জানি মাত্র একতারা হোটেল, বোর্ডার মাত্র ৫ জন আর খুব বেশি খরচা হবে বলে মনে হয়না
......তাও কি রকম খরচা হতে পারে
...... আজ রাতে মা-কে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে কাল জানাব......প্রথমে ধরতে পারেনি, তারপর আমাকে জড়িয়ে প্রাণখোলা হাসি। সম কে ভাল না বেসে পারা যায় না,এত নির্মল আর নিস্পাপ।
মা-কে সম এর কথা বলেছি, বাবা সব শুনে বলে উঠল “ বেশি ঘনিষ্ঠতার দরকার নেই, মেলামেশা না হলেই ভাল। বাবা যেন কি রকম হয়ে যাচ্ছে।
এর মাস ২-৩ পর এক সকালে সন্দীপের গাড়িতে ৩ জন বেড়াতে গেছি শহরের বাইরে একটু দূরে। যাওয়া আসায় প্রায় ২০০ কিলো মিটার। সমস্ত দিন সম বক বক করে গেছে আর সন্দীপের লেগ-পুলিং। ফেরার সময় “ মনে পরে রুবি রায়” গানের সুরে “ হুকো মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা” কথা লাগিয়ে গাইতে গাইতে ফেরা। সারা দিন হুল্লোড়। সম কে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসব, হাঠাৎ আমাদের সবাইকে অবাক করে সমের মা আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভিতরে। সমের মা-এর আন্তরিকতা আমায় হৃদয় স্পর্শ করেছে।খুব ভাল লেগেছে আমার ওনাকে, কেমন মা মা মতোন। খুব সুন্দরি ছিলেন একসময়, দেখলেই বোঝা যায়, খুব বেশি সময় বসিনি। কিন্তু আমি ওনাকে প্রনাম করতে, চোখে জল কেন ওনার?
এর কিছুদিন পর আমি আর সন্দীপ হাঁটছি, সম কোথা থেকে দৌড়ে এসে
.........অনা , মা তোমার সাথে কথা বলবে ......মোবাইল এগিয়ে দিল
.........হ্যাঁ, আনটি, বলুন
.........আহনা, তুমি আর সন্দীপ মহালয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা একটু আসবে আমাদের বাড়ি, আমরা একসাথে ডিনার করব?
......হ্যাঁ যাব। আপনি এত সুন্দর ভাবে ডাকছেন আর আমরা যাব না? নিশ্চয়ই যাব
আনটি সেদিন এলাহি আয়োজন করেছিলেন। লুচি, মাংস, ছোলার ডাল, চিংড়ির মালাইকার্* বেগুন ভাঁজা, পাঁপড় চাটনি পায়েস। অতসব খেয়ে পায়েস খেতে চাইছিলাম না, “ ঠিক আছে, ২ চামচ খাও”, খেতে হোল। মহিলা রাধেন ভাল। উনিও সেদিন উপোষ করে ছিলেন। এক সাথে খেলাম সবাই। অনেক কথা হোল, খুব আন্তরিক ব্যাবহার। ফেরার সময় সন্দীপ গাড়িতে কোন কথা বলছে না, সব কথার উত্তর হ্যাঁ, হু এই ভাবে যেন এরিয়ে যাচ্ছে
......কি হোল চুপ করে যে, কি ব্যাপার?
......কিছু না, রাত হয়েছে তাই সাবধানে চালাচ্ছি......বাড়ির সামনে এসে দরজা খুলে নামতে যাব
.....অনু, ধর্মরাজ, প্রথম পাণ্ডব কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “ কোন কথা বলতে নেই”, উত্তর টা কি বলত, মনে পরছেনা
.....অনু, ধর্মরাজ, প্রথম পাণ্ডব কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “ কোন কথা বলতে নেই”, উত্তর টা কি বলত, মনে পরছেনা
......অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে নেই। এত রাতে এই হেঁয়ালির মানে কি সন্দীপ
......আরে না না, রাগ করনা। এমনি মনে হোল তাই। গুড নাইট......মনটা খারাপ হয়ে গেল। সন্দীপটা যা তা। ঘরে ঢুকে স্পাই ক্যাম চালু করে মা-কে সব বললাম। মা খুটিয়ে খুটিয়ে রান্না কিরকম জানল। সুধু বাবা সমানে “ বেশি মেলামেশার দরকার নেই” বলে গেল। বাবার বিয়ে টা এইবার দিতেই হবে......হি হি হি।
১০ দিন পর এখানে দশেরার একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে, সব ভারতীয় সাজগোজ করে যায়। আমি সাজতে বসলাম। সেইদিন সম এর মা একটা লাল রঙের শাড়ি পরে ছিলেন, খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমিও একটা ওই রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউস পরলাম। ওনার মতো খোপা করে কাধের কাছে এলিয়ে দিয়ে মনে হোল একটা টিপ লাগাই তো।লাল রঙের টিপ লাগিয়ে আয়নায় তাকিয়ে চমকে গেলাম। এ কে? এ আমি কাকে দেখছি, এ তো সমের মা, তার মানে?অবশ হয়ে বিছানায় বসে আয়নায় তাকিয়ে একে একে মনে পড়ল। আমার জন্মদিন বলে ওই দিন উপোষ করে ছিলেন, জোর করে পায়েস খাওয়ানো, প্রথম দিন প্রনাম করতে চোখে জল, বাবার না না, সন্দীপের হেঁয়ালি। আগুন জলে উঠল সমস্ত শরীরে। সারা জীবনের মতো আমাদের পরিবারকে অসম্মানের মুখে ঠেলে, বাবার জীবন তছ নছ করে উনি মাতৃস্নেহ দেখাচ্ছেন। এর উত্তর আমি দেব। পাশে রাখা মোবাইল বেজে যাচ্ছে, সন্দীপের ফোন, সব খুলে হাতে চোখ ধেকে ডুকরে উঠলাম রাগে অপমানে। সন্দীপ একটু পরেই ঘরে এসে
......অনু কি হয়েছে?
......অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে নেই, তাই না সন্দীপ...চুপ করে থেকে
......আমি প্রথম দিনই বুঝেছিলাম। তোমাদের দুজনকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে। তোমার একটু সময় লাগল......সন্দীপকে আঁকড়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলাম। দুজনের কোথাও যাওয়া হোল না। ক্যামেরা চালু করে
......মা, সে।
......কে সে, কার কথা বলছিস অনু?
......সেই মহিলা, যে আমাদের পরিবার কে চরম অসম্মান করেছেন
......অ...নু......আরতনাদ করে উঠল মা
.........সমের মা। আমি সেই জন্যই মিশতে না করেছিলাম......নিম্ন স্বর শোনা গেল বাবার। আরও কিছু কথা হবার পর বন্ধ করলাম ক্যামেরা। মা বাবা কাকু আমাকে পই পই করে সাবধান করেছে, যেন সমের মনে কোন আঘাত না দি। সম নিষ্পাপ, নির্মল।