13-06-2020, 03:25 PM
নবম পর্ব
আজ বউভাত।বিয়েতে যেমন উৎসাহ ছিল আজ সেই ভাব নেই। জানলার ধারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত মানুষের পথ চলা দেখছি। বাড়িতে দু-দুটো বউ সেখানেও ব্যস্ততা কিছুটা অন্য রকম।একদিন যে বাড়ীর সঙ্গে ছিল ওতপ্রোত সস্ম্পর্ক বিয়ের পর সে বাড়ী আজ আর পাঁচটা বাড়ীর মত ধরাছোয়ার বাইরে।ইচ্ছে হলেই যে কোনো ঘরে আমি ঢুকতে পারবো না।সময়মতো চা পাইনি বলে চোটপাট করতে পারবো না। ফাল্গুণী চাকরি করে না মৌমিতা চাকরি করে কিন্তু একজায়গায় দুজনে এক। ডান হাত উল্টে দেখলাম মন এখানে ঠোট রেখেছিল।মাথায় খালি দুষ্টু বুদ্ধি। কাল রাতে মেসেজ আসেনি। এভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে মেসেজ আসা।দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ চলে গেল একদিন ফিরে আসবে অতনু।সেই এক ঘেয়ে জীবন যাপন।দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল।
সকাল থেকে এ বাড়ীতে অশান্তি। পশুপতি শাড়ী কিনে এনেছেন।দুটো শাড়ী একই রকম। নির্মলাসুন্দরী বেকে বসেছেন তিনি যাবেন না,শরীর ভাল নেই।তনিমা হতাশ কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সবার সঙ্গে দেখা হবে আবার।সেই ছেলেটা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল।বৌদি বলছিল ছেলেটার নাম মণিশঙ্কর, দাদা নিশ্চয়ই চিনবে। তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বোউদির সঙ্গে কথা বলার আছিলায় তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিল বৌদি আলাপ করিয়ে দেবে। বৌদির উপর খবু রাগ হয়।একটা কথা মনে পড়তে হাসি পেল,বৌদি বলল ভুত মণিশঙ্কর ভুল ধরিয়ে দিল মেয়েরা ভুত নয় পেত্নী হয়। ভুত হয় ছেলেরা। সজলকে এখনই বাতিল করার দরকার নেই,বেশি প্রশ্রয় না দিলেই হল।
পশুপতি বউকে বোঝায়,দেখো কুটুম বলে কথা তুমি না গেলে ভাল দেখায় না। বউমার যাওয়া আর তোমার যাওয়া কি এক হল?
--দেখো আমাকে জ্বালাতন কোর নাতো?আমি কি বেড়াতে যাচ্ছি?বিয়ে বাড়ী যেমন তেমন গিয়ে হাজির হলেই হল?বউমা-আ-আ, শোনো।
আমি বেরিয়ে সামনে গিয়ে দাড়াতে নির্মলা সুন্দরী বললেন,তুমি বলছিলে না কদিন গিয়ে থাকবে?
--আমি একা যাবো না।
--অতনু নেই কে তোমায় নিয়ে যাবে বাছা?তুমি বলবে শাশুড়ীর শরীর ভাল না--।
--আমার শরীরও ভাল না মা।
--তোমার আবার কি হল দিব্যি তো চরে বেড়াচ্ছিলে? তুমি কি আমাকে জব্দ করতে চাও?
--আমার শরীরের সঙ্গে আপনার জব্দ হওয়ার কি হল?
--মুখে মুখে তর্ক করবে না বলে দিচ্ছি।পদ্ম ঠিকই বলেছিল মেনিমুখোরা তলে তলে বেশি শয়তান।
--বাইরের লোকের সঙ্গে বাড়ীর বউকে নিয়ে কথা বলতে লজ্জা করল না?
--ব-উ-মা।পশুপতি গর্জে উঠলেন।তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছো তখন থেকে লক্ষ্য করছি।যাও ঘরে যাও,তোমাদের কাউকে যেতে হবে না।
--আমি কি বাড়াবাড়ি করলাম? মা-ই তো বললেন আমাকে নিয়ে ওনার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন।
--আমাকে ঘাটিও না বলছি,পরশু রাতে যে পৌছে দিল ছেলেটি কে?
--বাবা ছেলেটা আমাদের সঙ্গে আসেনি।তনিমা বলল।
--তুমি চুপ করো।বড়দের মধ্যে কথা বলতে আসবে না।
আমি আর দাড়ালাম না,এরা খুব নোংরা যত কথা বলবো তত ক্লেদ উঠবে।বন্ধু,কিসের বন্ধু যদি না দেখতাম। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে কোথায় রামায়ণ মহাভারত পড়বে তা না লুকিয়ে লুকিয়ে পর্ণোগ্রাফির বই পড়ে।ঘরে এসে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে ফেললাম।
বাপের বাড়ী শ্বশুরবাড়ী কোনোটাই আজ নিজের বলে মনে হচ্ছে না।গভীর অন্ধকারে জোনাকির মত মিট মিট করে জ্বলছে একটি মুখ,অবজ্ঞা অবহেলায় আজও অম্লান। তাতেই আরো বেশি রাগ হয়, একটু মান-অপমান বোধও কি থাকতে নেই?কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যে বেলা। নির্মলা সুন্দরী বললেন,ভাত ঢাকা আছে খেয়ে নেও।
--আমার ক্ষিধে নেই।
--কি ব্যাপার বলতো?তোমার মতলবটা কি কোন রাগের প্রতিশোধ নিতে চাও বউমা?
--দোহাই আপনার,বিশ্বাস করুন আপনাদের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই।আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
নির্মলা সুন্দরী দমে গেলেন কি ভেবে যাবার আগে বললেন,শোনো বউমা তুমি শান্তিতে থাকো তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই শুধু একটা অনুরোধ নিজে যা করে বেড়াও আমার মেয়েটাকে তার সঙ্গে জড়িও না।
নির্মলাসুন্দরী চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবি কি সব বলে গেলেন উনি? তনিমাকে কিসের সঙ্গে জড়ালাম আমি? আমার বিয়ের আগে থেকেই সজলের সঙ্গে তনিমার আলাপ।খাটের উপর পড়ে থাকা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ বক্স খুললাম। নতুন কোনো মেসেজ নেই।রাত বাড়তে থাকে সবাই ব্যস্ত বিয়ে বাড়ীতে,ফাল্গুণী আর মৌমিতাকে সাজিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে।একে একে এসে তুলে দিচ্ছে তাদের হাতে উপহার।খুব অভিমাণ হয় কারো কি একবারও মনে হল না বাড়ীর একমাত্র মেয়ে মণিমালা বিয়েতে আসেনি। কেন এলনা গুরুতর কিছু ঘটতেও তো পারে। ফোন করে খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করল না কেউ? ছোড়দা বড়দা বউ পেয়ে সব ভুলে গেছে? না,কারো মনে রাখার দরকার নেই আমিও আর কাউকে মনে করতে চাইনে। যা আছে আমার কপালে তাই হবে।
উঠে রান্না ঘরে গিয়ে চা করছি নির্মলা সুন্দরী এসে জিজ্ঞেস করলেন,এত রাতে চা করছো,এ বেলাও কিছু খাবে না নাকি?
--আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা।
--ঠিক আছে ইচ্ছে না করলে থাক।খালি চা খেও না সঙ্গে মুড়ি বা বিস্কিট কিছু খেও।
সদয় ব্যবহার ভাল লাগে,জিজ্ঞেস করলাম,আপনি চা খাবেন?
--আমি? আচ্ছা দাও।কিছুক্ষণ পর চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করেন,আচ্ছা বউমা মেয়েটা এখনো ফিরল না কোথায় যেতে পারে বলতে পারো?
--তনিমা আপনাকে বলে যায় নি?
--আমাকে কি কিছু বলে,সারাক্ষণ মোবাইল কানে কি যে বকবক করে কার সঙ্গে কে জানে। অতনুকে পইপই করে বলেছিলাম ওকে ঐসব দেওয়ার দরকার নেই তা কেউ শোনে আমার কথা?
শাশুড়ীর প্রতি মায়া হয় বললাম,চিন্তা করবেন না এখুনি চলে আসবে।বাস ট্রামের যা অবস্থা।
--চিন্তা করছি না, কি জানো ছেলে হলে ভাবতাম না মেয়েদের গায়ে ছাপ পড়ে যায়।
নির্মলাসুন্দরীকে এককাপ চা দিয়ে একটা বাটিতে মুড়ি আর চা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভাবতে থাকি ছাপ পড়ে ঠিকই আবার ছাপ তোলার নানা ওষুধ বেরিয়েছে বাজারে। পরক্ষণেই মনে পড়ল সঞ্চিতাদির কথা ,আমার দুসম্পর্কের দিদি।বিয়ের পর গর্ভবতী হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় চেক-আপের জন্য।তখন নাকি ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন,আগের সন্তান এ্যাবর্শন করিয়েছিলেন না নষ্ট হয়ে গেছিল?ব্যাস আসল ব্যাপার ফাঁস হতেই পত্রপাঠ বউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাপের বাড়ি।বাপ-মায়ের চোখে ঘুম নেই।এই অবস্থার মধ্যে সঙ্গীতাদি প্রসব করল ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা সে যাত্রা ক্ষমা করে দিয়ে সঞ্চিতাদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
একেই বলে ভাগ্য,ছাপ বাইরে মোছা গেলেও ভিতরে থেকে যায়।আমার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রেগন্যান্সি হয়নি তার আগেই রোধ করা হয়েছিল। মুখটা মনে পড়ল, মন তখন পাগল হয়ে গেছিল। মুড়ি চিবোতে বেশ লাগছে।তনিমা কোথায় গেল?সজলের সঙ্গে যায় নি তো?তনিমা আসল কথা জানে না,ওর ধারণা ওকে দেখেই মন এগিয়ে এসেছিল।ব্যাপারটা ভাবতে বেশ মজা লাগে।কত বয়স হবে তনিমার? খুব কম হলেও তিন-চার বছরের ছোট হবে আমার থেকে?
তনিমার গলা পাচ্ছি,মনে হচ্ছে তনিমা ফিরেছে।শাশুড়ী বলছেন,কি হল আবার?এবাড়ীতে দেখছি সবার ক্ষিধেতে অরুচি?
--জানো মা বৌদির বাপের বাড়ী হেভি সাজিয়েছে।
--তুই কি করে জানলি?
--ওদিকে একটা কাজে গেছিলাম দূর থেকে দেখলাম।
--একা একা অতদুর গেছিলি না আর কেউ সঙ্গে ছিল?
--কে আবার সঙ্গে থাকবে?তোমার যত বাজে কথা।বৌদি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
--জানিনা বাপু আজ সারাদিন কিছু খেল না,খানিক আগে চা করে নিয়ে গেল। অল্প একটু খা।
--ঠিক আছে খুব অল্প দেবে।কিছুক্ষণ নীরবতা শাশুড়ি সম্ভবত ভাত আনতে গেলেন।তনিমার গলা পাওয়া গেল,জানো মা দাদার অফিসের ম্যানেজার বোউদির দাদার বন্ধু।
--আগে তো শুনিনি,তুই এত খবর কোথায় পাস?
--আগে ইনফোসিসে ছিল,ইনফোসিস থেকে মোটা মাইনের অফার দিয়ে ওদের ব্যাঙ্গালোর অফিসের জন্য ডাকছে। কেন যাচ্ছে না জানো হি-হি-হি।
--এর মধ্যে হাসির কি হল?
--ফিঁয়াসেকে ছেড়ে যাবে না হি-হি-হি।
--সে আবার কি?
--লভার,লভার এখানে থাকে তাই ব্যাঙ্গালোর যাবে না।
খেয়েদেয়ে তনিমা দরজা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,বৌদি ঘুমিয়ে পড়েছো?
আমি সাড়া দিলাম না,রাত দুপুরে গপ্প করার মত মেজাজ আমার নেই।তনিমা এত কথা জানলো কি করে? কে ওকে এত খবর দিল? মনের সত্যিই কি কোনো প্রেমিকা আছে? বন্দনাকেও বলেছিল এ কথা।যদি সত্যিই কোনো প্রেমিকা থাকে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মোবাইলে টুং করে শব্দ হল। অনেকদিন বাঁচবে মন। মেসেজ খুলে দেখলাম,আজ কেন এলেনা?তোমার মন ভাল নেই সেদিনই বুঝেছিলাম।
যাক একজন তবু যাইনি বলে খবর নিল। পরমুহুর্তে প্রেমিকার কথা ভেবে পটপট টাইপ করি,তুমি কেন মেসেজ করো?মাথার বালিশের কাছে ফোন রেখে গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়লাম।টুং করে শব্দ হল,আবার কে? মেসেজ খুলে চোখের সামনে ধরলাম,আনন্দ পাই।সেদিন দুটো কথা বলে একটু ছুয়ে কি আনন্দ পেয়েছি তুমি জানোনা।
মোবাইল হাতে ধরে ভাবছি, দুটো কথা বলেই আনন্দ আর কিছু চাই না?আমি আবার টাইপ করি,কথা বলতে ইচ্ছে হলে ফোন করতে পারো।সেণ্ড বাটন টিপে দিয়ে মনে হল এটা কি ঠিক করলাম? ফোন বেজে উঠল খাল কেটে আমিই কুমীর ডেকে আনলাম। তাড়াতাড়ি ফোন কানে দিয়ে বলি,এত রাতে কি ব্যাপার?
--মণি অনেক রাত অবধি তোমার জন্য বিয়েবাড়ীতে ছিলাম,তুমি এলে না কেন?তোমার কি হয়েছে?
আমি কথা বলতে পারি না চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আবার বলল,মণি চুপ করে থেকো না,কি হয়েছে আমাকে বলো।
--মন আমি ভাল নে-ই।গলা ধরে আসে।
--বুঝেছি তোমাকে আর বলতে হবে না। মণি তুমি কাল তোমাদের বাড়ীর কাছে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পার্কে এসো,আমি তোমাকে নিজের চোখে একবার না দেখলে শান্তি পাবো না।
আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি বললাম,ফুচকা খাওয়াতে হবে।
মনের সঙ্গে এইটুকু কথা বলে বেশ হালকা বোধ হচ্ছে।সকাল থেকে বহন করছিলাম একটা দম চাপা কষ্ট,বুকে কফ জমলে যেমন হয় এখন সহজে নিশ্বাস নিতে পারছি। নিজেকে আর একা অসহায় বোধ হচ্ছে না।প্রেমিকার জন্য ব্যঙ্গালোর যাচ্ছে না জিজ্ঞেস করতে হবে কে সেই প্রেমিকা যার জন্য মোটা মাইনের অফার উড়িয়ে দিয়েছে।খালি চ্যাংড়ামি।আচ্ছা যদি বলে,আছে একজন প্রেমিকা?তাতে কি আমার মন খারাপ হবে? কেন মন খারাপের কি আছে বিয়ে করবে না চিরকাল আমাকে মেসেজ করে যাবে?আমি জিজ্ঞেস করবো,তকে বিয়ে করছে না কেন?একটা ভাবনা সংশোধন করতে হয়।একবার মনে হয়েছিল পদ্মরাণীর সঙ্গে কি আনন্দ পায় শাশুড়ী।এখন ম্পনে হচ্ছে ঐটাই সব নয় পরস্পর কথা বলা ছুয়ে থাকলেও অমলিন আনন্দ। চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে,ডুবে যায় নিবিড় অন্ধকারে।
আজ বউভাত।বিয়েতে যেমন উৎসাহ ছিল আজ সেই ভাব নেই। জানলার ধারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত মানুষের পথ চলা দেখছি। বাড়িতে দু-দুটো বউ সেখানেও ব্যস্ততা কিছুটা অন্য রকম।একদিন যে বাড়ীর সঙ্গে ছিল ওতপ্রোত সস্ম্পর্ক বিয়ের পর সে বাড়ী আজ আর পাঁচটা বাড়ীর মত ধরাছোয়ার বাইরে।ইচ্ছে হলেই যে কোনো ঘরে আমি ঢুকতে পারবো না।সময়মতো চা পাইনি বলে চোটপাট করতে পারবো না। ফাল্গুণী চাকরি করে না মৌমিতা চাকরি করে কিন্তু একজায়গায় দুজনে এক। ডান হাত উল্টে দেখলাম মন এখানে ঠোট রেখেছিল।মাথায় খালি দুষ্টু বুদ্ধি। কাল রাতে মেসেজ আসেনি। এভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে মেসেজ আসা।দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ চলে গেল একদিন ফিরে আসবে অতনু।সেই এক ঘেয়ে জীবন যাপন।দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল।
সকাল থেকে এ বাড়ীতে অশান্তি। পশুপতি শাড়ী কিনে এনেছেন।দুটো শাড়ী একই রকম। নির্মলাসুন্দরী বেকে বসেছেন তিনি যাবেন না,শরীর ভাল নেই।তনিমা হতাশ কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সবার সঙ্গে দেখা হবে আবার।সেই ছেলেটা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল।বৌদি বলছিল ছেলেটার নাম মণিশঙ্কর, দাদা নিশ্চয়ই চিনবে। তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বোউদির সঙ্গে কথা বলার আছিলায় তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিল বৌদি আলাপ করিয়ে দেবে। বৌদির উপর খবু রাগ হয়।একটা কথা মনে পড়তে হাসি পেল,বৌদি বলল ভুত মণিশঙ্কর ভুল ধরিয়ে দিল মেয়েরা ভুত নয় পেত্নী হয়। ভুত হয় ছেলেরা। সজলকে এখনই বাতিল করার দরকার নেই,বেশি প্রশ্রয় না দিলেই হল।
পশুপতি বউকে বোঝায়,দেখো কুটুম বলে কথা তুমি না গেলে ভাল দেখায় না। বউমার যাওয়া আর তোমার যাওয়া কি এক হল?
--দেখো আমাকে জ্বালাতন কোর নাতো?আমি কি বেড়াতে যাচ্ছি?বিয়ে বাড়ী যেমন তেমন গিয়ে হাজির হলেই হল?বউমা-আ-আ, শোনো।
আমি বেরিয়ে সামনে গিয়ে দাড়াতে নির্মলা সুন্দরী বললেন,তুমি বলছিলে না কদিন গিয়ে থাকবে?
--আমি একা যাবো না।
--অতনু নেই কে তোমায় নিয়ে যাবে বাছা?তুমি বলবে শাশুড়ীর শরীর ভাল না--।
--আমার শরীরও ভাল না মা।
--তোমার আবার কি হল দিব্যি তো চরে বেড়াচ্ছিলে? তুমি কি আমাকে জব্দ করতে চাও?
--আমার শরীরের সঙ্গে আপনার জব্দ হওয়ার কি হল?
--মুখে মুখে তর্ক করবে না বলে দিচ্ছি।পদ্ম ঠিকই বলেছিল মেনিমুখোরা তলে তলে বেশি শয়তান।
--বাইরের লোকের সঙ্গে বাড়ীর বউকে নিয়ে কথা বলতে লজ্জা করল না?
--ব-উ-মা।পশুপতি গর্জে উঠলেন।তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছো তখন থেকে লক্ষ্য করছি।যাও ঘরে যাও,তোমাদের কাউকে যেতে হবে না।
--আমি কি বাড়াবাড়ি করলাম? মা-ই তো বললেন আমাকে নিয়ে ওনার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন।
--আমাকে ঘাটিও না বলছি,পরশু রাতে যে পৌছে দিল ছেলেটি কে?
--বাবা ছেলেটা আমাদের সঙ্গে আসেনি।তনিমা বলল।
--তুমি চুপ করো।বড়দের মধ্যে কথা বলতে আসবে না।
আমি আর দাড়ালাম না,এরা খুব নোংরা যত কথা বলবো তত ক্লেদ উঠবে।বন্ধু,কিসের বন্ধু যদি না দেখতাম। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে কোথায় রামায়ণ মহাভারত পড়বে তা না লুকিয়ে লুকিয়ে পর্ণোগ্রাফির বই পড়ে।ঘরে এসে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে ফেললাম।
বাপের বাড়ী শ্বশুরবাড়ী কোনোটাই আজ নিজের বলে মনে হচ্ছে না।গভীর অন্ধকারে জোনাকির মত মিট মিট করে জ্বলছে একটি মুখ,অবজ্ঞা অবহেলায় আজও অম্লান। তাতেই আরো বেশি রাগ হয়, একটু মান-অপমান বোধও কি থাকতে নেই?কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যে বেলা। নির্মলা সুন্দরী বললেন,ভাত ঢাকা আছে খেয়ে নেও।
--আমার ক্ষিধে নেই।
--কি ব্যাপার বলতো?তোমার মতলবটা কি কোন রাগের প্রতিশোধ নিতে চাও বউমা?
--দোহাই আপনার,বিশ্বাস করুন আপনাদের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই।আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
নির্মলা সুন্দরী দমে গেলেন কি ভেবে যাবার আগে বললেন,শোনো বউমা তুমি শান্তিতে থাকো তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই শুধু একটা অনুরোধ নিজে যা করে বেড়াও আমার মেয়েটাকে তার সঙ্গে জড়িও না।
নির্মলাসুন্দরী চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবি কি সব বলে গেলেন উনি? তনিমাকে কিসের সঙ্গে জড়ালাম আমি? আমার বিয়ের আগে থেকেই সজলের সঙ্গে তনিমার আলাপ।খাটের উপর পড়ে থাকা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ বক্স খুললাম। নতুন কোনো মেসেজ নেই।রাত বাড়তে থাকে সবাই ব্যস্ত বিয়ে বাড়ীতে,ফাল্গুণী আর মৌমিতাকে সাজিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে।একে একে এসে তুলে দিচ্ছে তাদের হাতে উপহার।খুব অভিমাণ হয় কারো কি একবারও মনে হল না বাড়ীর একমাত্র মেয়ে মণিমালা বিয়েতে আসেনি। কেন এলনা গুরুতর কিছু ঘটতেও তো পারে। ফোন করে খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করল না কেউ? ছোড়দা বড়দা বউ পেয়ে সব ভুলে গেছে? না,কারো মনে রাখার দরকার নেই আমিও আর কাউকে মনে করতে চাইনে। যা আছে আমার কপালে তাই হবে।
উঠে রান্না ঘরে গিয়ে চা করছি নির্মলা সুন্দরী এসে জিজ্ঞেস করলেন,এত রাতে চা করছো,এ বেলাও কিছু খাবে না নাকি?
--আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা।
--ঠিক আছে ইচ্ছে না করলে থাক।খালি চা খেও না সঙ্গে মুড়ি বা বিস্কিট কিছু খেও।
সদয় ব্যবহার ভাল লাগে,জিজ্ঞেস করলাম,আপনি চা খাবেন?
--আমি? আচ্ছা দাও।কিছুক্ষণ পর চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করেন,আচ্ছা বউমা মেয়েটা এখনো ফিরল না কোথায় যেতে পারে বলতে পারো?
--তনিমা আপনাকে বলে যায় নি?
--আমাকে কি কিছু বলে,সারাক্ষণ মোবাইল কানে কি যে বকবক করে কার সঙ্গে কে জানে। অতনুকে পইপই করে বলেছিলাম ওকে ঐসব দেওয়ার দরকার নেই তা কেউ শোনে আমার কথা?
শাশুড়ীর প্রতি মায়া হয় বললাম,চিন্তা করবেন না এখুনি চলে আসবে।বাস ট্রামের যা অবস্থা।
--চিন্তা করছি না, কি জানো ছেলে হলে ভাবতাম না মেয়েদের গায়ে ছাপ পড়ে যায়।
নির্মলাসুন্দরীকে এককাপ চা দিয়ে একটা বাটিতে মুড়ি আর চা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভাবতে থাকি ছাপ পড়ে ঠিকই আবার ছাপ তোলার নানা ওষুধ বেরিয়েছে বাজারে। পরক্ষণেই মনে পড়ল সঞ্চিতাদির কথা ,আমার দুসম্পর্কের দিদি।বিয়ের পর গর্ভবতী হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় চেক-আপের জন্য।তখন নাকি ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন,আগের সন্তান এ্যাবর্শন করিয়েছিলেন না নষ্ট হয়ে গেছিল?ব্যাস আসল ব্যাপার ফাঁস হতেই পত্রপাঠ বউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাপের বাড়ি।বাপ-মায়ের চোখে ঘুম নেই।এই অবস্থার মধ্যে সঙ্গীতাদি প্রসব করল ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা সে যাত্রা ক্ষমা করে দিয়ে সঞ্চিতাদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
একেই বলে ভাগ্য,ছাপ বাইরে মোছা গেলেও ভিতরে থেকে যায়।আমার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রেগন্যান্সি হয়নি তার আগেই রোধ করা হয়েছিল। মুখটা মনে পড়ল, মন তখন পাগল হয়ে গেছিল। মুড়ি চিবোতে বেশ লাগছে।তনিমা কোথায় গেল?সজলের সঙ্গে যায় নি তো?তনিমা আসল কথা জানে না,ওর ধারণা ওকে দেখেই মন এগিয়ে এসেছিল।ব্যাপারটা ভাবতে বেশ মজা লাগে।কত বয়স হবে তনিমার? খুব কম হলেও তিন-চার বছরের ছোট হবে আমার থেকে?
তনিমার গলা পাচ্ছি,মনে হচ্ছে তনিমা ফিরেছে।শাশুড়ী বলছেন,কি হল আবার?এবাড়ীতে দেখছি সবার ক্ষিধেতে অরুচি?
--জানো মা বৌদির বাপের বাড়ী হেভি সাজিয়েছে।
--তুই কি করে জানলি?
--ওদিকে একটা কাজে গেছিলাম দূর থেকে দেখলাম।
--একা একা অতদুর গেছিলি না আর কেউ সঙ্গে ছিল?
--কে আবার সঙ্গে থাকবে?তোমার যত বাজে কথা।বৌদি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
--জানিনা বাপু আজ সারাদিন কিছু খেল না,খানিক আগে চা করে নিয়ে গেল। অল্প একটু খা।
--ঠিক আছে খুব অল্প দেবে।কিছুক্ষণ নীরবতা শাশুড়ি সম্ভবত ভাত আনতে গেলেন।তনিমার গলা পাওয়া গেল,জানো মা দাদার অফিসের ম্যানেজার বোউদির দাদার বন্ধু।
--আগে তো শুনিনি,তুই এত খবর কোথায় পাস?
--আগে ইনফোসিসে ছিল,ইনফোসিস থেকে মোটা মাইনের অফার দিয়ে ওদের ব্যাঙ্গালোর অফিসের জন্য ডাকছে। কেন যাচ্ছে না জানো হি-হি-হি।
--এর মধ্যে হাসির কি হল?
--ফিঁয়াসেকে ছেড়ে যাবে না হি-হি-হি।
--সে আবার কি?
--লভার,লভার এখানে থাকে তাই ব্যাঙ্গালোর যাবে না।
খেয়েদেয়ে তনিমা দরজা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,বৌদি ঘুমিয়ে পড়েছো?
আমি সাড়া দিলাম না,রাত দুপুরে গপ্প করার মত মেজাজ আমার নেই।তনিমা এত কথা জানলো কি করে? কে ওকে এত খবর দিল? মনের সত্যিই কি কোনো প্রেমিকা আছে? বন্দনাকেও বলেছিল এ কথা।যদি সত্যিই কোনো প্রেমিকা থাকে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মোবাইলে টুং করে শব্দ হল। অনেকদিন বাঁচবে মন। মেসেজ খুলে দেখলাম,আজ কেন এলেনা?তোমার মন ভাল নেই সেদিনই বুঝেছিলাম।
যাক একজন তবু যাইনি বলে খবর নিল। পরমুহুর্তে প্রেমিকার কথা ভেবে পটপট টাইপ করি,তুমি কেন মেসেজ করো?মাথার বালিশের কাছে ফোন রেখে গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়লাম।টুং করে শব্দ হল,আবার কে? মেসেজ খুলে চোখের সামনে ধরলাম,আনন্দ পাই।সেদিন দুটো কথা বলে একটু ছুয়ে কি আনন্দ পেয়েছি তুমি জানোনা।
মোবাইল হাতে ধরে ভাবছি, দুটো কথা বলেই আনন্দ আর কিছু চাই না?আমি আবার টাইপ করি,কথা বলতে ইচ্ছে হলে ফোন করতে পারো।সেণ্ড বাটন টিপে দিয়ে মনে হল এটা কি ঠিক করলাম? ফোন বেজে উঠল খাল কেটে আমিই কুমীর ডেকে আনলাম। তাড়াতাড়ি ফোন কানে দিয়ে বলি,এত রাতে কি ব্যাপার?
--মণি অনেক রাত অবধি তোমার জন্য বিয়েবাড়ীতে ছিলাম,তুমি এলে না কেন?তোমার কি হয়েছে?
আমি কথা বলতে পারি না চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আবার বলল,মণি চুপ করে থেকো না,কি হয়েছে আমাকে বলো।
--মন আমি ভাল নে-ই।গলা ধরে আসে।
--বুঝেছি তোমাকে আর বলতে হবে না। মণি তুমি কাল তোমাদের বাড়ীর কাছে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পার্কে এসো,আমি তোমাকে নিজের চোখে একবার না দেখলে শান্তি পাবো না।
আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি বললাম,ফুচকা খাওয়াতে হবে।
মনের সঙ্গে এইটুকু কথা বলে বেশ হালকা বোধ হচ্ছে।সকাল থেকে বহন করছিলাম একটা দম চাপা কষ্ট,বুকে কফ জমলে যেমন হয় এখন সহজে নিশ্বাস নিতে পারছি। নিজেকে আর একা অসহায় বোধ হচ্ছে না।প্রেমিকার জন্য ব্যঙ্গালোর যাচ্ছে না জিজ্ঞেস করতে হবে কে সেই প্রেমিকা যার জন্য মোটা মাইনের অফার উড়িয়ে দিয়েছে।খালি চ্যাংড়ামি।আচ্ছা যদি বলে,আছে একজন প্রেমিকা?তাতে কি আমার মন খারাপ হবে? কেন মন খারাপের কি আছে বিয়ে করবে না চিরকাল আমাকে মেসেজ করে যাবে?আমি জিজ্ঞেস করবো,তকে বিয়ে করছে না কেন?একটা ভাবনা সংশোধন করতে হয়।একবার মনে হয়েছিল পদ্মরাণীর সঙ্গে কি আনন্দ পায় শাশুড়ী।এখন ম্পনে হচ্ছে ঐটাই সব নয় পরস্পর কথা বলা ছুয়ে থাকলেও অমলিন আনন্দ। চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে,ডুবে যায় নিবিড় অন্ধকারে।