25-02-2019, 12:50 PM
- কেন...
- যদি কখোনো বুঝতে না পারি...
- ওকে বলবি সেটা...
- বলেছি...
- বুঝেছে?
- চুপ করে থেকে বলেছিল...
বাকি কথাটা আর শোনা হয়নি, বোনের ফোনটা বেজে উঠলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসে ফিসফিস করে দিদি বলেছে...এই নে...ফোন করেছে...
কোলকাতা থেকে সবার যাওয়ার জন্য দুটো মার্সিডিজ বেঞ্জের সুপার লাক্সারী এসি বাস বুক করা আছে। সাথে নিজেদের গাড়ী ছাড়াও আরো গোটা চারেক গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে কখন কি কাজে লাগে ভেবে। বাঁকুড়ার রাস্তায় মার্সিডিজ এর মতো বড় গাড়ী নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা থাকায় ওদিকের জন্য আছে তিনটে কার আর দুটো ছোট এসি বাস যাতে মামাবাড়ীর ওদিক থেকে সবাই ঠিকমতো যাওয়া আসা করতে পারে। দুটো হোটেল পুরো বুক করা আছে যাতে বিয়েতে যারা আসবে রাত্রে থেকে যেতে পারে। আজ বিয়ে, অরিত্ররা পৌঁছে গেছে দুপুর বারোটা নাগাদ। ওদিক থেকে ওরা চলে এসেছে আরো সকালে। বিকেল চারটে নাগাদ রুপসা মৌকে সাজানোর তদারকি করতে করতে দাদাভাই এর খোঁজে এসে ওর স্বভাব মতো পেছনে লেগে বলেছে... কি রে আর একবার দেখা করে এলি না যে? ওদিকে তো একজনের চোখ সারাক্ষন কাউকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। অরিত্র একাই ছিল, একটু আগে শুভ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সুপারভাইজারদের সাথে বসে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে গেছে। এক গাদা মেয়ে সারাক্ষন ঘিরে বসে থাকলে কি করে দেখা করতে যাবো বলাতে রুপসা হেসে ফেলে বলেছে বিয়ের দিনে কনেকে মেয়েরা ঘিরে থাকবে না তো কি তোকে ঘিরে থাকবে? তারপরেই একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল...দেখছি কি করা যায়। কিছুক্ষন পরেই রুপসার ফোন...দাদাভাই, এক্ষুনি চলে আয় ২১৫ নম্বর রুমে...কাউকে কিছু বলিস না বুঝলি...
ভেতরে শুধু মৌ আর রুপসা, ও আসতেই রুপসা কাছে এসে চুপি চুপি বলল... এই রুমটা অনেক কষ্টে ব্যাবস্থা করেছি বুঝলি...তোরা কথা বল...আমি একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসছি। কোথায় যাবি তুই, থাক না এখানে বলাতে রুপসা চোখ টিপে দিয়ে বলল... তুই সত্যি একটা বুদ্ধু। ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুপসা কেটে পড়লে অরিত্র মৌয়ের দিকে তাকালো... চুপ করে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে...এক পা এক পা করে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে গেলে ও মুখ তুলে তাকালো... একেই তো এত মিষ্টি মুখ, তার উপরে এত সুন্দর সাজিয়েছে যে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না... দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অরিত্র নিচু স্বরে বলল...এই, চলো...পালাই। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল... কোথায়? ‘চলো পালিয়ে গিয়ে কোনো মন্দীরে বিয়ে করে নি’ বলাতে মৌ সারা মুখে মিষ্টি হাসিতে ভরিয়ে নিয়ে বলল... কেন...আর দেরী সহ্য হচ্ছে না বুঝি? উত্তর এলো...কি করে সহ্য হবে...এখোনো ৫৫ ঘন্টার উপরে বাকি ...কি করে সময় কাটবে বলোতো? ও আর কি উত্তর দেবে, ওরও তো আর ভালো লাগছে না... নেহাত সবাই আছে সাথে আর তাই সময়টা কেটে যাচ্ছে... না হলে এক একটা মুহুর্ত এক একটা ঘন্টার সমান হয়ে যেত ভেবে মুখ টিপে হাসি ভরা মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে কিছু না বলে আর তাই দেখে একজনের ইচ্ছে হয়েছে সেই মিষ্টির কিছুটা শুষে নিতে...
বিয়ের আগে শেষ চুমু, এতো সহজ়ে কি ছাড়া যায় নাকি...মন ভরে নরম তুলতুলে ঠোঁট দুটো থেকে মিষ্টি হাসি শুষে নিতে নিতে সময়ের কথা কে মনে রাখতে চায়... নিজেকে ওর হাতে সঁপে দিয়েছে আর একজন, সে ভালো করেই জানে যত সময় না ও নিজে থেকে ছাড়বে কিছু করার নেই...আর এমনিতে ইচ্ছেও কি আছে নাকি ওর বুকের ভেতর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে... ইচ্ছে না থাকলেও এক সময় ছাড়তে হল, এতক্ষনে হয়তো সবাই খোঁজাখুজি শুরু করে দিয়েছে ওকে। মৌ ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেই অস্ফুট স্বরে বলল...দুষ্টু দাদার বিচ্ছু বোন। অরিত্র বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে ও হাসি মুখে বলল... এই জন্যই ছোড়দি কিছুতেই লিপস্টিক লাগাতে দিচ্ছিল না। তাই,তাহলে আর একবার? বলাতে ও হাসি মুখে আস্তে করে বলল... না বললে কি তুমি শুনবে?
বিয়ের কাজ শুরু হতে আর ঘন্টাখানেক বাকি আছে। বর কনে দুজনেই তৈরী হয়ে বসে আছে কখন ডাক আসে। অরিত্রর অফিস কলিগদের কেউ কেউ কনেকে বিয়ের আগেই দেখে এসে পেছনে লেগেছে। কেউ বলেছে...আর তো মনে হয়না অফিস আসবি তো অন্য কেউ বলেছে...এবার থেকে কি পার্মানেন্টলি বাড়িতে থেকেই কাজ করবি নাকি? একজন তো হাসতে হাসতে বলেই ফেলল...এমন বৌ ছেড়ে কোন আহাম্মক অফিস করে...আমি হলে তো চাকরী ছেড়ে দিয়ে বাড়ীতেই কিছু একটা খুলে ফেলতাম...
ওদিকে কনেকেও ঘিরে বসে সমান তালে নিজেদের ভেতরে মেয়েলী হাসি ঠাট্টা চলছে। শুভ বড়দির ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এসে মৌয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল...এই দেখো আমাদের নিতবরকে কেমন সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে এসেছি...তোমার কোন বোন একে বিয়ে করবে ঠিক করে ফেলো এখুনি, এমন ছেলে কিন্তু আর পাবে না। সত্যিই ওইটুকু বাচ্চাকে ধুতি পাঞ্জাবীতে ভীষন ফুটফুটে দেখাচ্ছে। মিষ্টি আর মামন দিদির পাশেই ছিল, কেউ কেউ ওদের ভেতরে কাউকে নিতবরের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে বলে মজা করলে দুজনেই এক সাথে রাজী হয়ে গেছে...মিষ্টি আবার এক কাঠি উপরে, বেশ মজা করে বলেই দিল ও বরকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে কলেজে দিয়ে আসবে রোজ আর দুষ্ঠুমি করলে ভালো করে ঠ্যঙ্গাবে...সবাই মিলে ওই শুনে এমন হাসাহাসি শুরু করেছে যে বেচারা নিতবর এতজন অচেনা লোকজনের মাঝে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মৌয়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফেললে কেউ একজন বলে ফেলল...ও মা, নিতবর তো দেখি মামীমাকেই বিয়ে করতে চাইছে...ইশ, কি হবে এবারে বেচারা মামার...
শুভদৃষ্টির সময়ে রুপসা উঠে এসে হৈ চৈ করে উঠে বলল... এই মৌ চোখ সরাবে না একেবারে...ভালো করে ছবি তোলা হবে। অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে মনে মনে ভাবছিল আমাদের শুভদৃষ্টি তো সেদিনই হয়ে গেছে যেদিন বিকেলে পড়ন্ত সুর্যের কনে দেখা আলো মুখে নিয়ে তুমি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে...সেদিনই তো আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব দিয়ে বসেছিলাম। এই দাদাভাই, কি রে স্বপ্ন দেখছিস নাকি...চল হয়ে গেছে, আর তাকিয়ে থাকতে হবে না, পরে দেখিস আবার। রুপসার কথা শুনে সম্বিত ফিরে এল, পাশ থেকে পুবালী হাসি মুখে বলল... উঃ রুপসা...তুই ও না...কখন বলিস তাকিয়ে থাক আর কখন বলিস চোখ নামাতে...মাথা খারাপ করে দিবি নাকি ওদের...
প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাসর জাগার পর সবাই এক এক করে শুতে চলে গেছে। মামন আর মিষ্টি ওখানেই জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আর ওদেরকে ডাকা হয়নি শুতে যাবার জন্য। সবাই চলে যাবার পর রুপসা বিল্টুকে সাথে করে নিয়ে বেরিয়েছে। ওর নাকি একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতরে। এত সময় পরে দুজনে একা হতে পেরে আরো কাছাকাছি চলে এসেছে। মৌ অরিত্রকে কোলে মাথা রেখে শুতে বললে সে বলেছে আমিও তো ভাবছিলাম তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো...দুজনের চাওয়াটা রাখতে গিয়ে ওরা ঠিক করে নিয়েছে কিছুটা সময় করে এ ওর কোলে মাথা রেখে শোবে যাতে দুজনের ইচ্ছেটাই থাকে। প্রথমে যেহেতু মৌ বলেছে তাই অরিত্রকে শুতে হয়েছে ওর কোলে। কথা খুব একটা কিছু না বললেও চুপ করে এ ওর দিকে তাকিয়ে থাকাতেও যে কত সুখ সেটা ওরাই ভালো জানে। একটু পরে অরিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টিরা ঘুমোচ্ছে কিনা দেখে নিয়ে পাশ ফিরে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলে মৌ একটু ঝুঁকে এসে আস্তে করে বলেছে এই, ওরা যদি উঠে পড়ে? কোনো জবাব না দিয়ে নিজেকে আরো ওর বুকের কাছাকাছি নিয়ে এসে চুপ করে থেকে বোঝালো...উঠলে উঠুক, আমার এখন এভাবেই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। শুনবে না যখন আমি আর কি করবো, আমারও কি ভালো লাগছে না ভেবে ও নিজেই ওকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে আস্তে করে বলেছে...এবারে ঠিক আছে? উত্তরে শুধুমাত্র উমমম...আওয়াজে বোঝা গেল বলতে চাইছে তুলতুলে নরম স্পর্শে ও কতটা খুশী...এর থেকে বেশী কিছু চাওয়ার মতো হ্যাংলামি ও এখন করবেই না জানা ছিল, তবুও আরো একবার সেটাই বুঝে গিয়ে আর একজন চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থেকেছে একেবারে নিজের মতো করে পেয়ে যাওয়া ওর জীবনের সব থেকে দামী জিনিষটার দিকে...
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসি বিয়ে সারা হয়ে গেলে দুর্গাপুর থেকে ফিরে ভবানীপুরের বাড়ীতে এক প্রস্থ বরনের পালা ছিল। জেঠিমারা আগেই ফিরে এসে তৈরী হয়েছিল। সবকিছু মিটে গেলে মা বাবার ঘরে দুজনে মিলে গিয়ে মালা পরিয়ে প্রনাম করে এসেছে। ওই সময়টা ওদের সাথে কেউ ছিল না। ফিরে আসতে গিয়ে মৌয়ের ডাক শুনে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেলে হাতটা ধরে আলতো ভাবে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল...কই তুমি তো কিছু বললে না মা বাবাকে? কি বলবো বলে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে মৌ হাসি মুখে বলল...আগেকার দিনে সেই বলতো না যে মা, এই নাও তোমার বৌ এনে দিলাম। অরিত্র ওর কথা শুনে ওর হাত ধরে একটু দূরে সরে এসে আস্তে করে বলল...কে বলেছে তুমি আমার বৌ? তাহলে কি জিজ্ঞেস করাতে উত্তরের জায়গায় প্রশ্ন করা হয়েছে যারা প্রেম করে তাদের কে কি বলে? প্রশ্নটা শুনে একজন বুঝে গেছে ও কি বলতে চেয়েছে আর তাই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেছে সারা জীবনের জন্য? হু, তাছাড়া আবার কি বলে আরো কিছু বলতে গিয়েছিল অরিত্র, দরজার বাইরে কারুর পায়ের আওয়াজ পেয়ে থেমে গিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল...চলো...পরে বলব।
দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিয়ে সামান্য কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। বাড়ী এসে পৌঁছতেই রুপসা, মামন আর মিষ্টিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে চলে গেল এমন একটা ভাব করে যেন ওদের কত কাজ আছে। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে এলেও বাড়ী পৌঁছবার কিছুটা আগে ওদের চোখে চোখে ইশারায় কথা বলতে দেখে মৌ জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে। মিষ্টি ফিক করে হেসে ফেলে বলেছে ও, আমাদের গোপন ব্যাপার...বলা যাবেনা এখন। ওদের গোপন ব্যাপারটা কি বোঝা গেল একটু পরেই। বরন করার পর বাড়ীতে ঢুকতে যেতেই দেখা গেল ওরা তিন জনে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রুপসা অরিত্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল...বৌকে নিয়ে বাড়ীতে ঢুকতে দেবার আগে বোনকে কিছু দিতে হয় জানিস তো...না দিলে কিন্তু ঢুকতে দিচ্ছি না। অরিত্র ওর কথা শুনে মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে দিয়েছে আমি কেন দেব? যা কিছু খরচ সবই তো দাদু আর জেঠুদের দেওয়ার কথা। দাদাভাইয়ের না দেবার কারন শুনে রুপসা সজোরে মাথা নেড়ে বলল না না এটা নিয়ে কোনো কথাই হয়নি...তুই যাকে খুশী জিজ্ঞেস করে নিতে পারিস আমার কথা বিশ্বাস না হলে। অরিত্র এবারে হেসে ফেলে বলেছে আচ্ছা ঠিক আছে, সে না হয় তোকে কিছু দেওয়া যাবে কিন্তু মিষ্টি আর মামন আবার এখানে কেন? ওরা তো যতদুর জানা আছে যাকে আটকেছিস তার বোন...
- ও মা তুই কি রে দাদাভাই, পুরো বিয়েটাই তো মিলিয়ে মিশিয়ে হতে দেখলাম। কে যে কোন পক্ষের বোঝাই যায়নি...
‘হ্যাঁ বুঝেছি’ বলে অরিত্র পার্স থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করে রুপসার হাতে দিয়ে বলল এই নে, ভাগ করে নিস...
এক টাকার কয়েন, তাও আবার তিন ভাগ করতে হবে শুনে ওরা তিন জনে হইচই করে উঠলে অরিত্র মুখটা শুকনো করে বলল আমার আর বেশী কিছু দেবার ক্ষমতা নেই এখন...বুঝলি। বুঝতেই পারছিস, এখন অনেক খরচের ব্যাপার আছে...
ওদের ভাই বোনের কান্ড দেখে সবার হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। রুপসা মৌয়ের হাত ধরে হাসি মুখে বলল...দেখলে তো তোমার বরটা কি হাড় কিপ্পুস...যাকগে, কি আর করা যাবে...চলে এসো...
দেখতে দেখতে আরো একটা দিন কেটে গেছে, আজ বৌভাত। আকাশের মুখ দুপুরের পর থেকে গোমড়া হয়ে থাকলেও বৃষ্টি এসে আর ঝামেলা পাকায়নি। দিদান বলে দিয়েছিল ওদের দুজনকে আজ এক সাথেই খেতে হবে। এমনিতে বর্ষাকাল আর এই ধরনের অনুষ্টান বাড়ীতে শেষের দিকে খেতে বসার জন্য বড্ড অপেক্ষা করতে হয়, তার জন্য হয়তো ন-টার ভেতরেই নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে যাওয়ায় ওদিকটা মিটিয়ে নিয়ে রুপসা তাড়া লাগিয়েছে যাতে দশটার ভেতরে ওদের খাওয়া হয়ে যায়। ওর আবার ফিরে গিয়ে বৌদির পেছনে অনেক সময় দিতে হবে। এমনিতে অসুবিধা ছিল না, সময় মতো সবকিছু যাতে সেরে ফেলা যায় তার জন্য বসিয়ে খাওয়াবার সাথে সাথে অনেকটা জায়গা জুড়ে বুফেরও ব্যাবস্থা থাকায় কাউকে আর অপেক্ষা বা খেতে বসার জন্য হুড়োহুড়ি করতে হয়নি। একেবারে প্রায় নিঁখুত ব্যাবস্থার জন্য পুরো বাহবাটা শুভরই পাওনা ছিল। শুভকে যারা চেনে তারা আবার মজা করে ওকে বলে গেছে তাদের ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে যদি ও দায়িত্ব নিতে পারে।
ওদের খাওয়া হয়ে গেলে রুপসা মৌকে নিয়ে ফিরে এসেছে, সমস্ত মেকআপ নিজের হাতে তুলে দিয়ে আবার নতুন করে সাজিয়েছে। সেই বিকেলের বাসি মেকআপ নাকি চলবে না। নতুন করে সাজালেও এবারে আর বেশী কিছু করেনি। যতটা সম্ভব হাল্কা ভাবে সাজিয়ে দিয়ে বলেছে ‘ বড্ড যেন সাজানো সাজানো লাগছিল, এখন বেশ ফ্রেস দেখাচ্ছে। মৌ গা ভর্তি গয়না খুলে ফেলতে চাইলে রুপসা কানে কানে বলেছে উঁ হুঁ এখন নয়, ওগুলো তোমার বর নিজের হাতে এক এক করে খুলবে। ছোড়দি কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে ও লজ্জা পেয়ে রুপসার হাতে ছোট্ট করে একটা চিমটি কেটে বলেছে উমমম ছোড়দি, তুমি না একটা যাচ্ছেতাই। রুপসা ওর কথায় হেসে ফেলে নিচু গলায় আরো একবার পেছনে লেগে বলেছে যাচ্ছেতাই যা হবার তা তো শুরু হবে আজ রাত থেকে...বুঝেছো...এতদিন কিছু করেনি বলে কি ভেবেছো আজ ছেড়ে দেবে...
ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও অরিত্র বৌভাতের ওখানেই ছিল। সব কিছু সামলে দিয়ে ও ফিরে এলে রুপসা তাড়া লাগিয়েছে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আসার জন্য। ফটো তোলার ব্যাপার আছে সবার সাথে। ফটো তোলার পর এক এক করে বড়দের প্রনাম করে আশীর্বাদ নেওয়া হয়ে গেলে রুপসা মিষ্টি আর মামনকে সাথে নিয়ে শুতে গেছে। যাবার আগে কানে কানে বলেছে ‘এই, মৌ…কাল সকালে কিন্তু আমাকে সব ব’লা চাই। ভাগ্যিস মিষ্টি আর মামন একটু দূরে ছিল, ওরা শুনতে পেলে যে কি হোতো কে জানে। সেই কখন থেকে ছোড়দি থেকে থেকেই পেছনে লেগে যাচ্ছে, বারে বারে ও লজ্জা পাচ্ছে দেখে যেন ওর পেছনে লাগা আরো বেড়ে যাচ্ছে দেখে ও আর এবারে লজ্জা পায়নি, নিজেও ওর পেছনে লেগে বলেছে ‘ইস, আমি কেন বলতে যাবো? তুমি তোমার হার্ট থ্রবকে জিজ্ঞেস করে নিও সে তার ফুলশয্যার রাতে কি কি করেছে...
অরিত্র স্নানে গেছে একটু আগে। এখন আর ওদের ঘরে কেউ নেই। মৌ চুপ করে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু আগেই এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘরের মৃদু আলো তেরছা ভাবে মাধবীলতার ভেজা পাতা গুলোর উপরে পড়ায় কি সজীব আর প্রানবন্ত দেখাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা হাওয়া এসে ভেজা পাতাগুলোর সাথে সাথে গাছটাকে কি কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে? ওর শরীরের মৃদু কাঁপুনিও কি একই রকম নয়? আর একটু পরেই একজন আসবে…ওকে মন প্রান ভরে আদর করবে…ওকেও করতে হবে অনেক অনেক আদর। মনে পড়ে গেল দিদির ফিসফিসিয়ে বলা ছোট্ট দুটো কথা…’লেগেছিল’…ভালো। সেদিন লজ্জায় আর বেশী কিছু জিজ্ঞেস পারেনি দিদিকে কিন্তু এইটুকু বুঝেছিল…ভালো লাগাটা কতোটা সুখের হলে ওইভাবে কেউ বলতে পারে। ভাবতে গিয়ে লজ্জায় যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল…ও যদি আলো না নেভাতে চায়…যদি বলে আমি তোমাকে দেখবো…তাহলে? ভাবতেই পারছিল না কি হবে। আচ্ছা ঠিক আছে, যদি না চায় তো তাই হোক…আজ না হয় কাল তো ও দেখবেই…তাই না? তারপরেই মনে হয়েছে, ইশ, না...আজ কিছুতেই নয়, ও হয়তো চাইবে কিন্তু বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় কথা রাখবে। চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজের মনে নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন ও ফিরে এসেছে বুঝতে পারেনি, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করেছে ‘আমার মৌমি সোনা কি এত ভাবছে…জানতে পারি’?
- উমম…পারো…
- ব’লো...
- তোমার কথা...
- কি?
- উঁ হুঁ...বলবো না...
- তাই?
- হু...আচ্ছা তুমি আমাকে কি বলে ডাকলে জেনো?
- মৌ-মি...
- আচ্ছা...
- কেন বলোতো?
- কি জানি...
- তোমাকে তো সবাই মৌ নামে ডাকে...তাই না...
- হু...
- ওই নামে শুধু আমি ডাকবো তোমাকে...
- আচ্ছা...
- নামটা কেমন বললে না তো...
- ভালো তো...আমারই নামের কিছুটা...
- হু...
- সবার সামনে কি বলে ডাকবে?
- আগের মতোই...
- আচ্ছা...
বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে দুজনে মিলে জানলার একেবারে কাছে চলে গেছে...চুপ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে যখনই হাওয়ার ঝাপটার সাথে বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখে মুখে পড়েছে...শিউরে উঠে কে কার গায়ে ঘেঁষে গিয়ে অকারনে হেসেছে বোঝেনি। শুধু বৃষ্টি দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হওয়া নাকি আজ একেবারের জন্য দুজনে কাছাকাছি আসার খুশিতে নিজেদেরকে ভরিয়ে তোলা তা ওরাই জানে। নিজেরাই জানে না কত সময় চলে গেছে। শুধু সময়ের কথা কেন আজ বাকি কিছু নিয়েও ভাবার নেই। মন যা চাইছে তাই আজ ওরা করে যাবে। মন ভরে গেলে তারপরে না হয় শরীরের কথা ভাবা যাবে, তাড়ার কি আছে...এই রাত তো শুধু দুজনার। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, একজনের হাত ধরে কেউ জানলার বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে সেও নিজেও হাত এগিয়ে দিয়েছে। দুজনে মিলে বৃষ্টির ফোঁটায় হাত ভিজিয়ে নিতে নিতে কখোনো এ ওর মুখে জলের ছিটে দিয়েছে। তাতে কেউ ‘এই... ভীষন ঠান্ডা’ বললে অন্যজন হাসিমুখে কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে নিজের উষ্ণতায় তাকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। তারপরেই একজনের ইচ্ছে হয়েছে একটু অন্য রকমের দুষ্টুমি করার...পেছন থেকে আগের মতোই বুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছে চোখ বুজে থাকতে। চোখ বুজে চুপ করে ওর বুকের ভেতরে থেকে বোঝার চেস্টা করেছে ও কি করতে চাইছে কিন্তু পারেনি হয়তো। ওদিকে অন্যজন হাত ভরে বরফ ঠান্ডা বৃষ্টির জল নিয়ে এসে এক এক ফোঁটা করে ওর গালের পাশে ফেলতে শুরু করেছে। ও ঘাড় কাত করে বুকের উপরে মাথা রেখে থাকায় সেই জলের ধারা গালের উপর থেকে গলার পাশ দিয়ে গড়িয়ে চলে গেছে আস্তে আস্তে আরো নীচে...আঁচলের আড়ালে... বুকের আরো গভীরে। ঠান্ডা লাগলেও ও তখোনো চোখ বুজে থেকে শিউরে উঠতে উঠতে মন প্রান ভরে চেয়েছে ওর দুষ্টুমি উপভোগ করতে। যখন আর পেরে ওঠেনি তখন কোমরে বেড়ী করে রাখা ওর হাতে হাত চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিতে নিতে অস্ফুট স্বরে বলেছে...এই, আর না...
রাত আস্তে আস্তে বাড়ছে। দুষ্টুমি শেষ তখনকার মতো, এবারে ওকে দুহাতে করে কোলে তুলে নিয়ে এসে শুইয়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে একজন বলেছে ‘খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে...
- তাই?
- হু...
- আলোটা নিভিয়ে দেবে?
- কেন …লজ্জা করছে?
চোখে চোখ রেখে অস্ফুট স্বরে উত্তর এসেছে ‘জানি না…
- অস্বস্তি?
- উঁ হুঁ…অন্য কিছু…
- আচ্ছা...
আলো নেভানো হয়ে গেলে ও ফিরে এসেছে। চুপ করে বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে মৌ ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল ‘এই…শুনছো’…
- উঁ…ব’লো...
- চুপ করে আছো...
- এমনি… ভালো লাগছে…
- তাই?
- হু, তোমার ঘুম পাচ্ছে না তো?
- উঁ হুঁ…
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ…অরিত্র ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে থেকে বলল… তুমি একদিন জিজ্ঞেস করে ছিলে না ‘আমি কেন এমন...কেন কাছে আসতে চাইতাম না...
- হু…
- শুনবে?
- আজ থাক… পরে...
- কেন?
- এখন তো কাছে আছো...নাই বা জানলাম এখুনি...
- আচ্ছা...
- তুমি আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না… আমাকে কেউ হ্যাঁ বলিয়েছে কিনা?
- হু...
- শুনবে?
- বলো...
- রাগ করবে না তো?
- উঁ হু… আমি কি আমার সোনার উপর রাগ করতে পারি…তাও আবার আজ এইদিনে?
- ঠিক তো?
- হঁ...
- তোমার ডাইরিটা...
- কি?
- লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি পুরোটাই… ওখান থেকেই তো জেনেছিলাম তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো…
- তাই কি সেদিন আমার কাছে এসেছিলে?
- উ হু…
- তাহলে?
- জানো তো, ওখান থেকে ফিরে আসার পরেও অনেকবারই ভেবেছি চলে যাবো কোনো মেয়েদের হোস্টেলে… কিন্তু তোমাদের এত ভালোবাসা ছেড়ে যেতে হবে ভেবে কান্না পেয়ে যেত। আবার তোমাকেও বলতে না পেরে আরো খারাপ লাগতো… কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না… তারপর ভাবলাম…তুমি তো ভালোবাসতে কিন্তু জানি না এখোনো তাই কিনা…তাই ভেবেছিলাম যদি তুমি দাদুদের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাও…তাহলে আমি কষ্ট হলেও চলে যাবার একটা কারন খুঁজে পাবো...
অরিত্র ওর আস্তে আস্তে করে সময় নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল... আমাকে তো বলতে পারতে…
- আমি তো নিজেই পিছিয়ে গিয়েছিলাম… তারপর সবকিছু বোঝার পরও তোমাকে এড়িয়ে যেতাম আগের কথা ভেবে…কিভাবে আবার বলবো তোমাকে যে আমি আবার ফিরতে চাই…
- তা ঠিক...
- তুমি যদি না সেদিন নিজের থেকেই বলতে তাহলে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতো…
- আমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিল, আমিও তো পারিনি..
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ। কি যেন ভাবতে গিয়ে মৌ জিজ্ঞেস করল এই, তুমি এখন আর ডাইরী লেখো না?
- হু...লিখি তো...
- নতুন ডাইরী?
- উঁ হু...ল্যাপটপে...ভেবেছিলাম, পুরোনোটা পেয়ে গেলে...
- ইশ, ফেরৎ দিয়ে দিলে তোমাকে আর এত কষ্ট করতে হতো না...
- ঠিক আছে, সময় করে ও আমি লিখে নেবো...
আবার কিছুটা বিরতি, ওই নিয়েই হয়তো ভাবছিল দুজনে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অরিত্র বলল...ভাগ্যিস ডাইরি লেখার অভ্যেসটা ছিল...তাই না...
- হু...না হলে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতো...
- সেটাই...
- ভাবলেই না আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এখোনো...
- আমারও
- কাল সকালে তোমাকে ডাইরিটা দেবো...কেমন
- কোথায় আছে ডাইরিটা?
- লুকিয়ে রেখেছি...ভেবেছিলাম তোমাকে বলার পরই ফেরৎ দেবো...
- আচ্ছা...
- জানো তো, আমিও এখন লিখি...
- আমাকে পড়তে দেবে না?
- যদি কখোনো বুঝতে না পারি...
- ওকে বলবি সেটা...
- বলেছি...
- বুঝেছে?
- চুপ করে থেকে বলেছিল...
বাকি কথাটা আর শোনা হয়নি, বোনের ফোনটা বেজে উঠলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসে ফিসফিস করে দিদি বলেছে...এই নে...ফোন করেছে...
কোলকাতা থেকে সবার যাওয়ার জন্য দুটো মার্সিডিজ বেঞ্জের সুপার লাক্সারী এসি বাস বুক করা আছে। সাথে নিজেদের গাড়ী ছাড়াও আরো গোটা চারেক গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে কখন কি কাজে লাগে ভেবে। বাঁকুড়ার রাস্তায় মার্সিডিজ এর মতো বড় গাড়ী নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা থাকায় ওদিকের জন্য আছে তিনটে কার আর দুটো ছোট এসি বাস যাতে মামাবাড়ীর ওদিক থেকে সবাই ঠিকমতো যাওয়া আসা করতে পারে। দুটো হোটেল পুরো বুক করা আছে যাতে বিয়েতে যারা আসবে রাত্রে থেকে যেতে পারে। আজ বিয়ে, অরিত্ররা পৌঁছে গেছে দুপুর বারোটা নাগাদ। ওদিক থেকে ওরা চলে এসেছে আরো সকালে। বিকেল চারটে নাগাদ রুপসা মৌকে সাজানোর তদারকি করতে করতে দাদাভাই এর খোঁজে এসে ওর স্বভাব মতো পেছনে লেগে বলেছে... কি রে আর একবার দেখা করে এলি না যে? ওদিকে তো একজনের চোখ সারাক্ষন কাউকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। অরিত্র একাই ছিল, একটু আগে শুভ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সুপারভাইজারদের সাথে বসে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে গেছে। এক গাদা মেয়ে সারাক্ষন ঘিরে বসে থাকলে কি করে দেখা করতে যাবো বলাতে রুপসা হেসে ফেলে বলেছে বিয়ের দিনে কনেকে মেয়েরা ঘিরে থাকবে না তো কি তোকে ঘিরে থাকবে? তারপরেই একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল...দেখছি কি করা যায়। কিছুক্ষন পরেই রুপসার ফোন...দাদাভাই, এক্ষুনি চলে আয় ২১৫ নম্বর রুমে...কাউকে কিছু বলিস না বুঝলি...
ভেতরে শুধু মৌ আর রুপসা, ও আসতেই রুপসা কাছে এসে চুপি চুপি বলল... এই রুমটা অনেক কষ্টে ব্যাবস্থা করেছি বুঝলি...তোরা কথা বল...আমি একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসছি। কোথায় যাবি তুই, থাক না এখানে বলাতে রুপসা চোখ টিপে দিয়ে বলল... তুই সত্যি একটা বুদ্ধু। ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুপসা কেটে পড়লে অরিত্র মৌয়ের দিকে তাকালো... চুপ করে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে...এক পা এক পা করে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে গেলে ও মুখ তুলে তাকালো... একেই তো এত মিষ্টি মুখ, তার উপরে এত সুন্দর সাজিয়েছে যে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না... দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অরিত্র নিচু স্বরে বলল...এই, চলো...পালাই। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল... কোথায়? ‘চলো পালিয়ে গিয়ে কোনো মন্দীরে বিয়ে করে নি’ বলাতে মৌ সারা মুখে মিষ্টি হাসিতে ভরিয়ে নিয়ে বলল... কেন...আর দেরী সহ্য হচ্ছে না বুঝি? উত্তর এলো...কি করে সহ্য হবে...এখোনো ৫৫ ঘন্টার উপরে বাকি ...কি করে সময় কাটবে বলোতো? ও আর কি উত্তর দেবে, ওরও তো আর ভালো লাগছে না... নেহাত সবাই আছে সাথে আর তাই সময়টা কেটে যাচ্ছে... না হলে এক একটা মুহুর্ত এক একটা ঘন্টার সমান হয়ে যেত ভেবে মুখ টিপে হাসি ভরা মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে কিছু না বলে আর তাই দেখে একজনের ইচ্ছে হয়েছে সেই মিষ্টির কিছুটা শুষে নিতে...
বিয়ের আগে শেষ চুমু, এতো সহজ়ে কি ছাড়া যায় নাকি...মন ভরে নরম তুলতুলে ঠোঁট দুটো থেকে মিষ্টি হাসি শুষে নিতে নিতে সময়ের কথা কে মনে রাখতে চায়... নিজেকে ওর হাতে সঁপে দিয়েছে আর একজন, সে ভালো করেই জানে যত সময় না ও নিজে থেকে ছাড়বে কিছু করার নেই...আর এমনিতে ইচ্ছেও কি আছে নাকি ওর বুকের ভেতর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে... ইচ্ছে না থাকলেও এক সময় ছাড়তে হল, এতক্ষনে হয়তো সবাই খোঁজাখুজি শুরু করে দিয়েছে ওকে। মৌ ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেই অস্ফুট স্বরে বলল...দুষ্টু দাদার বিচ্ছু বোন। অরিত্র বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে ও হাসি মুখে বলল... এই জন্যই ছোড়দি কিছুতেই লিপস্টিক লাগাতে দিচ্ছিল না। তাই,তাহলে আর একবার? বলাতে ও হাসি মুখে আস্তে করে বলল... না বললে কি তুমি শুনবে?
বিয়ের কাজ শুরু হতে আর ঘন্টাখানেক বাকি আছে। বর কনে দুজনেই তৈরী হয়ে বসে আছে কখন ডাক আসে। অরিত্রর অফিস কলিগদের কেউ কেউ কনেকে বিয়ের আগেই দেখে এসে পেছনে লেগেছে। কেউ বলেছে...আর তো মনে হয়না অফিস আসবি তো অন্য কেউ বলেছে...এবার থেকে কি পার্মানেন্টলি বাড়িতে থেকেই কাজ করবি নাকি? একজন তো হাসতে হাসতে বলেই ফেলল...এমন বৌ ছেড়ে কোন আহাম্মক অফিস করে...আমি হলে তো চাকরী ছেড়ে দিয়ে বাড়ীতেই কিছু একটা খুলে ফেলতাম...
ওদিকে কনেকেও ঘিরে বসে সমান তালে নিজেদের ভেতরে মেয়েলী হাসি ঠাট্টা চলছে। শুভ বড়দির ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এসে মৌয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল...এই দেখো আমাদের নিতবরকে কেমন সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে এসেছি...তোমার কোন বোন একে বিয়ে করবে ঠিক করে ফেলো এখুনি, এমন ছেলে কিন্তু আর পাবে না। সত্যিই ওইটুকু বাচ্চাকে ধুতি পাঞ্জাবীতে ভীষন ফুটফুটে দেখাচ্ছে। মিষ্টি আর মামন দিদির পাশেই ছিল, কেউ কেউ ওদের ভেতরে কাউকে নিতবরের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে বলে মজা করলে দুজনেই এক সাথে রাজী হয়ে গেছে...মিষ্টি আবার এক কাঠি উপরে, বেশ মজা করে বলেই দিল ও বরকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে কলেজে দিয়ে আসবে রোজ আর দুষ্ঠুমি করলে ভালো করে ঠ্যঙ্গাবে...সবাই মিলে ওই শুনে এমন হাসাহাসি শুরু করেছে যে বেচারা নিতবর এতজন অচেনা লোকজনের মাঝে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মৌয়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফেললে কেউ একজন বলে ফেলল...ও মা, নিতবর তো দেখি মামীমাকেই বিয়ে করতে চাইছে...ইশ, কি হবে এবারে বেচারা মামার...
শুভদৃষ্টির সময়ে রুপসা উঠে এসে হৈ চৈ করে উঠে বলল... এই মৌ চোখ সরাবে না একেবারে...ভালো করে ছবি তোলা হবে। অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে মনে মনে ভাবছিল আমাদের শুভদৃষ্টি তো সেদিনই হয়ে গেছে যেদিন বিকেলে পড়ন্ত সুর্যের কনে দেখা আলো মুখে নিয়ে তুমি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে...সেদিনই তো আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব দিয়ে বসেছিলাম। এই দাদাভাই, কি রে স্বপ্ন দেখছিস নাকি...চল হয়ে গেছে, আর তাকিয়ে থাকতে হবে না, পরে দেখিস আবার। রুপসার কথা শুনে সম্বিত ফিরে এল, পাশ থেকে পুবালী হাসি মুখে বলল... উঃ রুপসা...তুই ও না...কখন বলিস তাকিয়ে থাক আর কখন বলিস চোখ নামাতে...মাথা খারাপ করে দিবি নাকি ওদের...
প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাসর জাগার পর সবাই এক এক করে শুতে চলে গেছে। মামন আর মিষ্টি ওখানেই জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আর ওদেরকে ডাকা হয়নি শুতে যাবার জন্য। সবাই চলে যাবার পর রুপসা বিল্টুকে সাথে করে নিয়ে বেরিয়েছে। ওর নাকি একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতরে। এত সময় পরে দুজনে একা হতে পেরে আরো কাছাকাছি চলে এসেছে। মৌ অরিত্রকে কোলে মাথা রেখে শুতে বললে সে বলেছে আমিও তো ভাবছিলাম তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো...দুজনের চাওয়াটা রাখতে গিয়ে ওরা ঠিক করে নিয়েছে কিছুটা সময় করে এ ওর কোলে মাথা রেখে শোবে যাতে দুজনের ইচ্ছেটাই থাকে। প্রথমে যেহেতু মৌ বলেছে তাই অরিত্রকে শুতে হয়েছে ওর কোলে। কথা খুব একটা কিছু না বললেও চুপ করে এ ওর দিকে তাকিয়ে থাকাতেও যে কত সুখ সেটা ওরাই ভালো জানে। একটু পরে অরিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টিরা ঘুমোচ্ছে কিনা দেখে নিয়ে পাশ ফিরে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলে মৌ একটু ঝুঁকে এসে আস্তে করে বলেছে এই, ওরা যদি উঠে পড়ে? কোনো জবাব না দিয়ে নিজেকে আরো ওর বুকের কাছাকাছি নিয়ে এসে চুপ করে থেকে বোঝালো...উঠলে উঠুক, আমার এখন এভাবেই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। শুনবে না যখন আমি আর কি করবো, আমারও কি ভালো লাগছে না ভেবে ও নিজেই ওকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে আস্তে করে বলেছে...এবারে ঠিক আছে? উত্তরে শুধুমাত্র উমমম...আওয়াজে বোঝা গেল বলতে চাইছে তুলতুলে নরম স্পর্শে ও কতটা খুশী...এর থেকে বেশী কিছু চাওয়ার মতো হ্যাংলামি ও এখন করবেই না জানা ছিল, তবুও আরো একবার সেটাই বুঝে গিয়ে আর একজন চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থেকেছে একেবারে নিজের মতো করে পেয়ে যাওয়া ওর জীবনের সব থেকে দামী জিনিষটার দিকে...
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসি বিয়ে সারা হয়ে গেলে দুর্গাপুর থেকে ফিরে ভবানীপুরের বাড়ীতে এক প্রস্থ বরনের পালা ছিল। জেঠিমারা আগেই ফিরে এসে তৈরী হয়েছিল। সবকিছু মিটে গেলে মা বাবার ঘরে দুজনে মিলে গিয়ে মালা পরিয়ে প্রনাম করে এসেছে। ওই সময়টা ওদের সাথে কেউ ছিল না। ফিরে আসতে গিয়ে মৌয়ের ডাক শুনে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেলে হাতটা ধরে আলতো ভাবে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল...কই তুমি তো কিছু বললে না মা বাবাকে? কি বলবো বলে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে মৌ হাসি মুখে বলল...আগেকার দিনে সেই বলতো না যে মা, এই নাও তোমার বৌ এনে দিলাম। অরিত্র ওর কথা শুনে ওর হাত ধরে একটু দূরে সরে এসে আস্তে করে বলল...কে বলেছে তুমি আমার বৌ? তাহলে কি জিজ্ঞেস করাতে উত্তরের জায়গায় প্রশ্ন করা হয়েছে যারা প্রেম করে তাদের কে কি বলে? প্রশ্নটা শুনে একজন বুঝে গেছে ও কি বলতে চেয়েছে আর তাই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেছে সারা জীবনের জন্য? হু, তাছাড়া আবার কি বলে আরো কিছু বলতে গিয়েছিল অরিত্র, দরজার বাইরে কারুর পায়ের আওয়াজ পেয়ে থেমে গিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল...চলো...পরে বলব।
দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিয়ে সামান্য কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। বাড়ী এসে পৌঁছতেই রুপসা, মামন আর মিষ্টিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে চলে গেল এমন একটা ভাব করে যেন ওদের কত কাজ আছে। সারা রাস্তা গল্প করতে করতে এলেও বাড়ী পৌঁছবার কিছুটা আগে ওদের চোখে চোখে ইশারায় কথা বলতে দেখে মৌ জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে। মিষ্টি ফিক করে হেসে ফেলে বলেছে ও, আমাদের গোপন ব্যাপার...বলা যাবেনা এখন। ওদের গোপন ব্যাপারটা কি বোঝা গেল একটু পরেই। বরন করার পর বাড়ীতে ঢুকতে যেতেই দেখা গেল ওরা তিন জনে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রুপসা অরিত্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল...বৌকে নিয়ে বাড়ীতে ঢুকতে দেবার আগে বোনকে কিছু দিতে হয় জানিস তো...না দিলে কিন্তু ঢুকতে দিচ্ছি না। অরিত্র ওর কথা শুনে মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে দিয়েছে আমি কেন দেব? যা কিছু খরচ সবই তো দাদু আর জেঠুদের দেওয়ার কথা। দাদাভাইয়ের না দেবার কারন শুনে রুপসা সজোরে মাথা নেড়ে বলল না না এটা নিয়ে কোনো কথাই হয়নি...তুই যাকে খুশী জিজ্ঞেস করে নিতে পারিস আমার কথা বিশ্বাস না হলে। অরিত্র এবারে হেসে ফেলে বলেছে আচ্ছা ঠিক আছে, সে না হয় তোকে কিছু দেওয়া যাবে কিন্তু মিষ্টি আর মামন আবার এখানে কেন? ওরা তো যতদুর জানা আছে যাকে আটকেছিস তার বোন...
- ও মা তুই কি রে দাদাভাই, পুরো বিয়েটাই তো মিলিয়ে মিশিয়ে হতে দেখলাম। কে যে কোন পক্ষের বোঝাই যায়নি...
‘হ্যাঁ বুঝেছি’ বলে অরিত্র পার্স থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করে রুপসার হাতে দিয়ে বলল এই নে, ভাগ করে নিস...
এক টাকার কয়েন, তাও আবার তিন ভাগ করতে হবে শুনে ওরা তিন জনে হইচই করে উঠলে অরিত্র মুখটা শুকনো করে বলল আমার আর বেশী কিছু দেবার ক্ষমতা নেই এখন...বুঝলি। বুঝতেই পারছিস, এখন অনেক খরচের ব্যাপার আছে...
ওদের ভাই বোনের কান্ড দেখে সবার হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। রুপসা মৌয়ের হাত ধরে হাসি মুখে বলল...দেখলে তো তোমার বরটা কি হাড় কিপ্পুস...যাকগে, কি আর করা যাবে...চলে এসো...
দেখতে দেখতে আরো একটা দিন কেটে গেছে, আজ বৌভাত। আকাশের মুখ দুপুরের পর থেকে গোমড়া হয়ে থাকলেও বৃষ্টি এসে আর ঝামেলা পাকায়নি। দিদান বলে দিয়েছিল ওদের দুজনকে আজ এক সাথেই খেতে হবে। এমনিতে বর্ষাকাল আর এই ধরনের অনুষ্টান বাড়ীতে শেষের দিকে খেতে বসার জন্য বড্ড অপেক্ষা করতে হয়, তার জন্য হয়তো ন-টার ভেতরেই নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে যাওয়ায় ওদিকটা মিটিয়ে নিয়ে রুপসা তাড়া লাগিয়েছে যাতে দশটার ভেতরে ওদের খাওয়া হয়ে যায়। ওর আবার ফিরে গিয়ে বৌদির পেছনে অনেক সময় দিতে হবে। এমনিতে অসুবিধা ছিল না, সময় মতো সবকিছু যাতে সেরে ফেলা যায় তার জন্য বসিয়ে খাওয়াবার সাথে সাথে অনেকটা জায়গা জুড়ে বুফেরও ব্যাবস্থা থাকায় কাউকে আর অপেক্ষা বা খেতে বসার জন্য হুড়োহুড়ি করতে হয়নি। একেবারে প্রায় নিঁখুত ব্যাবস্থার জন্য পুরো বাহবাটা শুভরই পাওনা ছিল। শুভকে যারা চেনে তারা আবার মজা করে ওকে বলে গেছে তাদের ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে যদি ও দায়িত্ব নিতে পারে।
ওদের খাওয়া হয়ে গেলে রুপসা মৌকে নিয়ে ফিরে এসেছে, সমস্ত মেকআপ নিজের হাতে তুলে দিয়ে আবার নতুন করে সাজিয়েছে। সেই বিকেলের বাসি মেকআপ নাকি চলবে না। নতুন করে সাজালেও এবারে আর বেশী কিছু করেনি। যতটা সম্ভব হাল্কা ভাবে সাজিয়ে দিয়ে বলেছে ‘ বড্ড যেন সাজানো সাজানো লাগছিল, এখন বেশ ফ্রেস দেখাচ্ছে। মৌ গা ভর্তি গয়না খুলে ফেলতে চাইলে রুপসা কানে কানে বলেছে উঁ হুঁ এখন নয়, ওগুলো তোমার বর নিজের হাতে এক এক করে খুলবে। ছোড়দি কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে ও লজ্জা পেয়ে রুপসার হাতে ছোট্ট করে একটা চিমটি কেটে বলেছে উমমম ছোড়দি, তুমি না একটা যাচ্ছেতাই। রুপসা ওর কথায় হেসে ফেলে নিচু গলায় আরো একবার পেছনে লেগে বলেছে যাচ্ছেতাই যা হবার তা তো শুরু হবে আজ রাত থেকে...বুঝেছো...এতদিন কিছু করেনি বলে কি ভেবেছো আজ ছেড়ে দেবে...
ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও অরিত্র বৌভাতের ওখানেই ছিল। সব কিছু সামলে দিয়ে ও ফিরে এলে রুপসা তাড়া লাগিয়েছে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আসার জন্য। ফটো তোলার ব্যাপার আছে সবার সাথে। ফটো তোলার পর এক এক করে বড়দের প্রনাম করে আশীর্বাদ নেওয়া হয়ে গেলে রুপসা মিষ্টি আর মামনকে সাথে নিয়ে শুতে গেছে। যাবার আগে কানে কানে বলেছে ‘এই, মৌ…কাল সকালে কিন্তু আমাকে সব ব’লা চাই। ভাগ্যিস মিষ্টি আর মামন একটু দূরে ছিল, ওরা শুনতে পেলে যে কি হোতো কে জানে। সেই কখন থেকে ছোড়দি থেকে থেকেই পেছনে লেগে যাচ্ছে, বারে বারে ও লজ্জা পাচ্ছে দেখে যেন ওর পেছনে লাগা আরো বেড়ে যাচ্ছে দেখে ও আর এবারে লজ্জা পায়নি, নিজেও ওর পেছনে লেগে বলেছে ‘ইস, আমি কেন বলতে যাবো? তুমি তোমার হার্ট থ্রবকে জিজ্ঞেস করে নিও সে তার ফুলশয্যার রাতে কি কি করেছে...
অরিত্র স্নানে গেছে একটু আগে। এখন আর ওদের ঘরে কেউ নেই। মৌ চুপ করে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু আগেই এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘরের মৃদু আলো তেরছা ভাবে মাধবীলতার ভেজা পাতা গুলোর উপরে পড়ায় কি সজীব আর প্রানবন্ত দেখাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা হাওয়া এসে ভেজা পাতাগুলোর সাথে সাথে গাছটাকে কি কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে? ওর শরীরের মৃদু কাঁপুনিও কি একই রকম নয়? আর একটু পরেই একজন আসবে…ওকে মন প্রান ভরে আদর করবে…ওকেও করতে হবে অনেক অনেক আদর। মনে পড়ে গেল দিদির ফিসফিসিয়ে বলা ছোট্ট দুটো কথা…’লেগেছিল’…ভালো। সেদিন লজ্জায় আর বেশী কিছু জিজ্ঞেস পারেনি দিদিকে কিন্তু এইটুকু বুঝেছিল…ভালো লাগাটা কতোটা সুখের হলে ওইভাবে কেউ বলতে পারে। ভাবতে গিয়ে লজ্জায় যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল…ও যদি আলো না নেভাতে চায়…যদি বলে আমি তোমাকে দেখবো…তাহলে? ভাবতেই পারছিল না কি হবে। আচ্ছা ঠিক আছে, যদি না চায় তো তাই হোক…আজ না হয় কাল তো ও দেখবেই…তাই না? তারপরেই মনে হয়েছে, ইশ, না...আজ কিছুতেই নয়, ও হয়তো চাইবে কিন্তু বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় কথা রাখবে। চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজের মনে নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন ও ফিরে এসেছে বুঝতে পারেনি, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করেছে ‘আমার মৌমি সোনা কি এত ভাবছে…জানতে পারি’?
- উমম…পারো…
- ব’লো...
- তোমার কথা...
- কি?
- উঁ হুঁ...বলবো না...
- তাই?
- হু...আচ্ছা তুমি আমাকে কি বলে ডাকলে জেনো?
- মৌ-মি...
- আচ্ছা...
- কেন বলোতো?
- কি জানি...
- তোমাকে তো সবাই মৌ নামে ডাকে...তাই না...
- হু...
- ওই নামে শুধু আমি ডাকবো তোমাকে...
- আচ্ছা...
- নামটা কেমন বললে না তো...
- ভালো তো...আমারই নামের কিছুটা...
- হু...
- সবার সামনে কি বলে ডাকবে?
- আগের মতোই...
- আচ্ছা...
বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে দুজনে মিলে জানলার একেবারে কাছে চলে গেছে...চুপ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে যখনই হাওয়ার ঝাপটার সাথে বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখে মুখে পড়েছে...শিউরে উঠে কে কার গায়ে ঘেঁষে গিয়ে অকারনে হেসেছে বোঝেনি। শুধু বৃষ্টি দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হওয়া নাকি আজ একেবারের জন্য দুজনে কাছাকাছি আসার খুশিতে নিজেদেরকে ভরিয়ে তোলা তা ওরাই জানে। নিজেরাই জানে না কত সময় চলে গেছে। শুধু সময়ের কথা কেন আজ বাকি কিছু নিয়েও ভাবার নেই। মন যা চাইছে তাই আজ ওরা করে যাবে। মন ভরে গেলে তারপরে না হয় শরীরের কথা ভাবা যাবে, তাড়ার কি আছে...এই রাত তো শুধু দুজনার। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, একজনের হাত ধরে কেউ জানলার বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে সেও নিজেও হাত এগিয়ে দিয়েছে। দুজনে মিলে বৃষ্টির ফোঁটায় হাত ভিজিয়ে নিতে নিতে কখোনো এ ওর মুখে জলের ছিটে দিয়েছে। তাতে কেউ ‘এই... ভীষন ঠান্ডা’ বললে অন্যজন হাসিমুখে কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে নিজের উষ্ণতায় তাকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। তারপরেই একজনের ইচ্ছে হয়েছে একটু অন্য রকমের দুষ্টুমি করার...পেছন থেকে আগের মতোই বুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছে চোখ বুজে থাকতে। চোখ বুজে চুপ করে ওর বুকের ভেতরে থেকে বোঝার চেস্টা করেছে ও কি করতে চাইছে কিন্তু পারেনি হয়তো। ওদিকে অন্যজন হাত ভরে বরফ ঠান্ডা বৃষ্টির জল নিয়ে এসে এক এক ফোঁটা করে ওর গালের পাশে ফেলতে শুরু করেছে। ও ঘাড় কাত করে বুকের উপরে মাথা রেখে থাকায় সেই জলের ধারা গালের উপর থেকে গলার পাশ দিয়ে গড়িয়ে চলে গেছে আস্তে আস্তে আরো নীচে...আঁচলের আড়ালে... বুকের আরো গভীরে। ঠান্ডা লাগলেও ও তখোনো চোখ বুজে থেকে শিউরে উঠতে উঠতে মন প্রান ভরে চেয়েছে ওর দুষ্টুমি উপভোগ করতে। যখন আর পেরে ওঠেনি তখন কোমরে বেড়ী করে রাখা ওর হাতে হাত চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিতে নিতে অস্ফুট স্বরে বলেছে...এই, আর না...
রাত আস্তে আস্তে বাড়ছে। দুষ্টুমি শেষ তখনকার মতো, এবারে ওকে দুহাতে করে কোলে তুলে নিয়ে এসে শুইয়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে একজন বলেছে ‘খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে...
- তাই?
- হু...
- আলোটা নিভিয়ে দেবে?
- কেন …লজ্জা করছে?
চোখে চোখ রেখে অস্ফুট স্বরে উত্তর এসেছে ‘জানি না…
- অস্বস্তি?
- উঁ হুঁ…অন্য কিছু…
- আচ্ছা...
আলো নেভানো হয়ে গেলে ও ফিরে এসেছে। চুপ করে বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে মৌ ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল ‘এই…শুনছো’…
- উঁ…ব’লো...
- চুপ করে আছো...
- এমনি… ভালো লাগছে…
- তাই?
- হু, তোমার ঘুম পাচ্ছে না তো?
- উঁ হুঁ…
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ…অরিত্র ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে থেকে বলল… তুমি একদিন জিজ্ঞেস করে ছিলে না ‘আমি কেন এমন...কেন কাছে আসতে চাইতাম না...
- হু…
- শুনবে?
- আজ থাক… পরে...
- কেন?
- এখন তো কাছে আছো...নাই বা জানলাম এখুনি...
- আচ্ছা...
- তুমি আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না… আমাকে কেউ হ্যাঁ বলিয়েছে কিনা?
- হু...
- শুনবে?
- বলো...
- রাগ করবে না তো?
- উঁ হু… আমি কি আমার সোনার উপর রাগ করতে পারি…তাও আবার আজ এইদিনে?
- ঠিক তো?
- হঁ...
- তোমার ডাইরিটা...
- কি?
- লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি পুরোটাই… ওখান থেকেই তো জেনেছিলাম তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো…
- তাই কি সেদিন আমার কাছে এসেছিলে?
- উ হু…
- তাহলে?
- জানো তো, ওখান থেকে ফিরে আসার পরেও অনেকবারই ভেবেছি চলে যাবো কোনো মেয়েদের হোস্টেলে… কিন্তু তোমাদের এত ভালোবাসা ছেড়ে যেতে হবে ভেবে কান্না পেয়ে যেত। আবার তোমাকেও বলতে না পেরে আরো খারাপ লাগতো… কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না… তারপর ভাবলাম…তুমি তো ভালোবাসতে কিন্তু জানি না এখোনো তাই কিনা…তাই ভেবেছিলাম যদি তুমি দাদুদের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাও…তাহলে আমি কষ্ট হলেও চলে যাবার একটা কারন খুঁজে পাবো...
অরিত্র ওর আস্তে আস্তে করে সময় নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল... আমাকে তো বলতে পারতে…
- আমি তো নিজেই পিছিয়ে গিয়েছিলাম… তারপর সবকিছু বোঝার পরও তোমাকে এড়িয়ে যেতাম আগের কথা ভেবে…কিভাবে আবার বলবো তোমাকে যে আমি আবার ফিরতে চাই…
- তা ঠিক...
- তুমি যদি না সেদিন নিজের থেকেই বলতে তাহলে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতো…
- আমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিল, আমিও তো পারিনি..
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ। কি যেন ভাবতে গিয়ে মৌ জিজ্ঞেস করল এই, তুমি এখন আর ডাইরী লেখো না?
- হু...লিখি তো...
- নতুন ডাইরী?
- উঁ হু...ল্যাপটপে...ভেবেছিলাম, পুরোনোটা পেয়ে গেলে...
- ইশ, ফেরৎ দিয়ে দিলে তোমাকে আর এত কষ্ট করতে হতো না...
- ঠিক আছে, সময় করে ও আমি লিখে নেবো...
আবার কিছুটা বিরতি, ওই নিয়েই হয়তো ভাবছিল দুজনে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অরিত্র বলল...ভাগ্যিস ডাইরি লেখার অভ্যেসটা ছিল...তাই না...
- হু...না হলে হয়তো অন্য কিছু হতে পারতো...
- সেটাই...
- ভাবলেই না আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এখোনো...
- আমারও
- কাল সকালে তোমাকে ডাইরিটা দেবো...কেমন
- কোথায় আছে ডাইরিটা?
- লুকিয়ে রেখেছি...ভেবেছিলাম তোমাকে বলার পরই ফেরৎ দেবো...
- আচ্ছা...
- জানো তো, আমিও এখন লিখি...
- আমাকে পড়তে দেবে না?