25-02-2019, 12:50 PM
দিদানকে এড়িয়ে যেতে পারলেও মৌকে এড়ানো গেল না বা এড়িয়ে যাবার প্রশ্নই ছিল না। ‘তুমি একটু বোসো, চোখে মুখে জল দিয়ে আসছি এখুনি’ বলে অরিত্র উঠে গেছে। চোখে মুখে জল দেওয়াটা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তার সাথে নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরী করে নেবারও একটু সময়ের দরকার ছিল। সময়ের দরকার থাকলেও খুব একটা বেশী সময় নেওয়া যাবে না ভেবে ফিরে এসেছে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। মৌ কোলের উপরে হাতটা রেখে চুপ করে বসেছিল। অরিত্র ওর দিকে একবার তাকিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ফিরে এলো ওর পাশে। ওকে কাছে টেনে নিয়ে কিছূক্ষন চুপ করে বসে থাকলে...মৌ নিচু গলায় বলল...কই বললে না তো কি হয়েছে তোমার। অরিত্র আস্তে করে বলল...তোমাকে একটা কথা জানানোর ব্যাপারে ভাবছি কিন্তু পেরে উঠছি না।
- কি?
- আগে বলো, যা বলবো তুমি ছাড়া আর কেউ জানবে না...
কাউকে না জানানোর মতো কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে ও একটু অবাক হয়ে গিয়ে চুপ করে থাকার পর বলল...আচ্ছা...
ও আচ্ছা বললেও অরিত্র খুব ভালো করেই জানে শোনার পর ওর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে আর সেই অবস্থায় ওর পাশে থাকার কতটা দরকার আছে। ওকে নিবিড় ভাবে বুকে চেপে ধরে অনেকটা সময় নিয়ে একটু একটু করে যা জেনেছে বলা হয়ে গেছে। মৌ কথাগুলো শুনে কান্না আটকানোর চেস্টা করলেও পারলো না, গুমরে গুমরে বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। অরিত্র ওকে এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে চাইছিল না, মুখে কিছু না বলে যে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে থেকে অনেক বেশী সান্তনা দেওয়া যায় সেটা আরো একবার প্রমান হয়ে গেল আজ। এরকম একটা মর্মান্তিক খবর শোনার পরেও যে ও নিজেকে ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাতে পেরেছে সেটা আর কেউ না বুঝুক ও নিজে জানে। চুপচাপ আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, মৌ অস্ফুট গলায় বলল... আমি কিভাবে নেবো সেই ভেবে কি তুমি আগে বলোনি?
উত্তরটা হ্যাঁ শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আগের মতোই বলল... তুমি কিছু ভেবোনা আর এই নিয়ে..আমি চাইনা আমার জন্য সবার খুশী নষ্ট হোক, এমনিতেই আমাকে নিয়ে তোমার ...
ও কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে অরিত্র আস্তে করে বলল... কাজটা সোজা নয়, তবুও নিজেকে শক্ত করতে হবে মৌ...এখন তুমি আর একা নয়...
ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে ও জবাব দিয়েছে...জানি...
এরপর আর বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। চুপচাপ দুজনে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পর ও ফিরে গেছে। অরিত্র ওকে আরো কিছুটা সময় থাকতে বললে ও বলেছিল...চিন্তা করবে না,আমি ঠিক আছি। ওকে এখন একা থাকতে দেওয়াটা হয়তো ভালো হবে ভেবে আর জোর করেনি। মৌ চলে যাবার পরও অরিত্র শুতে যেতে পারেনি, চুপ করে বসে থেকে ভাবছিল ঠিক কি কি ঘটে গেছে এইটুকু সময়ে, কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেল কিনা... যেটাকে নিয়ে ওকে ভাবতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওর একটা কথা বারে বারে মনে আসছে... আমার জন্য তো রাতের অন্ধকার আছেই, ওইটুকু সময় আমি না হয় বাবার জন্য একটু কাঁদবো...
অরিত্র যতটা ভয় পেয়েছিল ঠিক তা হয়নি, ভেতরে যতই যন্ত্রনা থাকুক না কেন কাউকে সেটা একেবারেই বুঝতে দেয়নি ও। একমাত্র অরিত্রকে যেটুকু সময় একা পেতো সেই সময়টুকু ও চেস্টা করতো না স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করার। মাঝে একবার নিজের থেকেই অরিত্রকে বলেছিল...ভেবে আর কি করবো বলো...বাবা তো আর ফিরে আসবে না...
সবকিছু ঠিক করা হয়ে গেলে একদিন বিশ্বাস কাকু আর ল-ইয়ার মিঃ মুখার্জীকে সাথে নিয়ে যেতে হয়েছিল মায়ের সাথে দেখা করতে। বিল্টু আর মিষ্টি বাড়ী ছিল না, ওরা দিদি কোন সময়ে আসবে জানা থাকায় কাজ আছে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে একসাথে, তবে দুজনেই খুব চিন্তায় আছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই ভেবে। মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নিয়েছে ওরা কতদুর পৌঁছোলো। সবাই ভেবেছিল হঠাৎ মৌকে দেখে হয়তো উনি অবাক হবেন কিন্তু ওনাকে দেখে মনেই হয়নি তেমন কিছু হয়েছে...বা হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর সহজাত ক্ষমতাটা ওনার বড্ড বেশি। ওদেরকে বসার কথা বলে শুধু একটাই কথা বলেছেন...তুই যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে গেলি সেটা কি ঠিক হয়েছিল... আর ছিলিই বা কোথায় এতদিন? মৌ কথাটার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছে...তোমার সাথে কিছু দরকার আছে বলেই আমি এসেছি। মৌ দরকার আছে বলাতে কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হয়তো বোঝার চেস্টা করেছেন দরকারটা কি হতে পারে। কিছু একটা অনুমান করে ওদেরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলে মৌ এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো পুরোনো দিনের কথা ভাবছিল। তারপর কি মনে করে ভেতরে গিয়ে ওনাকে ডেকে আনলো, ও চাইছিল না হয়তো বেশী সময় দিতে, যা বলার বা করার তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। মিঃ মুখার্জী কথা শুরু করতে যেতেই উনি বললেন... আমাকে দুর্বল ভাবার কিন্তু কোনো কারন নেই... ভাববেন না আমি কিছু বুঝিনি। বেশ কিছুদিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। আমিও কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে কিডন্যাপের কেস করতে পারি। আপনাদের হয়তো জানা নেই যে আমার উপর মহলের সাথে ওঠাবসাটা কিছু কম নয়। এতটা বলে হয়তো উনি থামলেন প্রতিপক্ষের দিক থেকে কি সাড়া আসে সেটা জানার জন্য।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মৌ খুব একটা জোরে না হলেও বেশ দৃঢতার সাথে বলল...তোমার খেয়াল রাখা উচিত যে আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তুমি যা খুশি করো না কেন আমার বক্তব্যটাই কোর্ট মেনে নেবে আর তার থেকে বড় কথা বাবার ব্যাপারে তুমি যা করেছো তার কিছু হলেও প্রমান আমাদের কাছে আছে যখন আমরাও কি ছেড়ে দেবো ভেবেছো? যাকগে, ওসব কথা ছাড়ো, তোমার সাথে কোনোরকম ঝামেলা করার জন্য বা কিছু নিতে আমি আসিনি। আমি আজ এখানে এসেছি, যে কারনে তুমি আমাকে সরাতে চেয়েছিলে সেগুলো সব তোমাকে দিয়ে যেতে। আর কিছু বলবে?
ভদ্রমহিলার আর কি কি ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে না জানা থাকলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়ানো যায় সেটা বেশ ভালোই জানেন। সামান্য কয়েক মুহুর্ত মুখ নিচু করে বসে থাকার পর নিজেকে নিমেষের ভেতরে পালটে নিয়ে চোখে জল এনে বললেন...তুই আমাকে ভুল বুঝিস না মৌ, আমি কখোনো তোর খারাপ চাইনি...বিশ্বাস কর...যা কিছু করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি...তোর বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম...
মৌ চাইছিল না আর কথা বাড়াতে বা এটাও চাইছিল না পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিক...আর কেউ ওনাকে চিনুক বা না চিনুক, ও তো ভালোভাবেই চেনে। মা-কে থামিয়ে দিয়ে বলল...আমি কোনোকিছুই আর জানতে বা শুনতে চাই না। তুমি সত্যিই যদি আমার ভালো চাইতে তাহলে আমি চলে যাবার পর আর কিছু না করো বা না করো একটা মিসিং ডাইরি অন্তত করতে... যাই হোক,তুমি যা যা করেছো বা করতে চেয়েছিলে সেগুলো আমি আর এখানে সবার সামনে ওঠাতে চাই না। আমি তো সব কিছু দিতেই এসেছি, এখন আর ওসব কথা তুলে কিছু লাভ নেই। তবে, একটা কথা বলে যাচ্ছি...তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখলেও বিল্টু আর মিষ্টির সাথে আমার যোগাযোগ থাকছেই। আমি এখানে না এলেও ওরা যখন চাইবে আমার কাছে যাবে। তোমার যদি মনে হয় আমার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া উচিৎ তাহলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারো তবে আমি যখন সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু ভুলেও চেস্টা করবে না সেটা নিয়ে কিছু করার বা ভাবার...আর একটা কথাও বলে যাচ্ছি, তুমি আমার মা হতে পারোনি তাতে আমার আর বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই কিন্তু যদি এখন থেকে নিজের ছেলেমেয়ের কথা ভেবে অন্তত ওদের মা হওয়ার চেস্টা করতে পারো তো ভালো হয়। ধরে নাও, শুধুমাত্র ওদের দুজনের কথা ভেবেই আমি সবকিছু জেনেও বাবার ব্যাপারটা নিয়ে তোমার বিরুদ্ধে আইন আদালত করতে চাইছি না...
বিল্টু আর মিষ্টির কথা শুনে ভদ্রমহিলা হয়তো বোঝার চেস্টা করছিলেন তাহলে কি নিজের ছেলে মেয়েও পর হয়ে যাবে? ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে মৌ পরিস্কার করে বলে দিয়েছে ওরা ভাইবোন দিদির সাথে যোগাযোগ রাখলে যেন ওদেরকে কিছু না বলা হয় আর ওদেরকে যদি কিছু বলা হয় তাহলে তার ফল খারাপ ছাড়া ভালো হবে না। দরকার হলে ও আজই পাড়ার সবাইকে জানিয়ে দেবে কি কি ঘটেছে এতদিন ধরে আর মা যেন মনে রাখে যে ঊনার উপর মহলে যেমন ওঠাবসা আছে তেমন আর কারুর নেই সেটা ভুলেও না ভাবতে।
যে মেয়েকে নিজের খুশী মতো এত বছর চালানো হলেও কোনোদিন মুখ ফুটে একটাও কথা বলেনি কোনোদিন, সেই মেয়ের মুখে এত বড় বড় কথা শুনেও আর সাহস হয়নি কোনো কথা বলার বা তিন তিন জন অপরিতিত মানুষের সামনে বসে ওইটুকু মেয়ের কাছে হেরে এইভাবে যাওয়াটা হয়তো সহ্য হচ্ছিল না। মুখ নীচু করে উঠে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেছেন আমি ভেতরে আছি, কি করতে হবে বল, করে দেবো।
তারপরের ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক ভাবে মিটে গেছে একটার পর একটা। অরিত্র বিল্টুকে ফোন করে বাড়ী আসতে বলে দেবার পর ওরা ফিরে এসেছে। ওরা দুজনেই একটু ভয়ে ভয়ে ফিরে আসার পর যখন দেখলো যে মায়ের সেই রুপ আর দেখা যাচ্ছে না, তখন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে মিলে সবার জন্য ওদের বুদ্ধিমতো আতিথেয়তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। এদিকে কাগজপত্রের কাজ করতে করতে মিষ্টিকে নিয়ে মৌ ভেতরে গিয়ে ওর একান্ত নিজস্ব কিছু জিনিষ বা দরকারী কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছে। সব কিছু মিটে গেলে আর এক মুহুর্তও মৌ ওখানে থাকতে চাইছিল না। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে ছটপট করছে কখন বেরিয়ে আসবে, তবে তার আগে ভাইবোনকে মায়ের সামনেই বার বার করে বলে দিয়েছে ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওরা যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর বিয়ের কয়েক দিন আগে যেমন আসার কথা বলা আছে সেইমতো চলে আসে বা তেমন যদি ওরা মনে করে তাহলে বললেই দাদা অফিস থেকে ফেরার পথে চলে আসতে পারে ওদেরকে তুলে নিতে।
ফেরার সময় মিঃ মুখার্জী আর বিশ্বাস কাকু শ্যমবাজারে নেমে গেলেন নিজেদের কিছু কাজ থাকায়। অস্বাভাবিক ভাবে আজ যেন রাস্তায় গাড়ীর ভীড় তেমন নেই। মৌ চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেও অরিত্র মৌয়ের হঠাৎ করে পালটে যাওয়াটা বা যেভাবে ও একটার পর একটা কথা বলে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবছিল। ও হঠাৎ করে যা যা করে ফেলেছে সেগুলো কোনোভাবেই ওর স্বভাবের সাথে খাপ খায়না। কোনোভাবেই মেলাতে না পেরে পরে ওর সাথে কথা বলবে ভেবে খেয়াল করল বেশ কিছুটা সময় ধরে ও কোনো কথা বলেনি...তারপরই ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছুই হয়তো দেখছে না, পাথরের মতো বসে থেকে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। ড্রাইভারকে সাবধানে গাড়ী চালাতে বলে অরিত্র ওর পাশে সরে গিয়ে হাতের উপরে হাতটা রাখলে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। এত সময় নিঃশব্দে কেঁদে গেলেও আর পারলো না নিজেকে আটকে রাখতে। ওর সবথেকে কাছের যে আছে তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারলে তো মনটা হাল্কা হবে ভেবে হয়তো কোনোরকমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলল...সব কিছু জেনেও বাবার জন্য কিছু করতে পারলাম না...জানি না ঠিক করলাম কিনা...
এই মুহুর্তে ওকে কিছু না বলে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে নীরবে সান্তনা দিয়ে যেতে থাকলে আস্তে আস্তে কান্নার দমক কমে আসার পরেও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল...বললে না তো, আমি ভুল করলাম কিনা। অরিত্র ওর হাতে আলতো ভাবে একটু চাপ দিয়ে বলল... তুমি ঠিকই করেছো মৌ...একটা ক্ষতির শোধ নিতে গিয়ে আরো একটা ক্ষতি হয়তো আমাদের বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় বা করতে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ঠিক হতো না। কথাটা শুনে ও কিছু বললো না...সামান্য একটা বিরতির পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে মুখ নীচু করে বসে থেকে হয়তো ভাবছিল..আমি ঠিক যা ভেবে ডিশিশানটা নিয়েছিলাম ও তো ঠিক সেটাই বলল...জানি না ও এত ভালো কি করে বোঝে আমাকে...
আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে, প্রথম দুটো তিনটে দিন মৌ কিছুটা হলেও চুপচাপ ছিল দেখে এর ভেতরে কেউই ওই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে কথা বলে ওকে বিরক্ত করতে চায়নি। আবার একদিন রাতে সবাই শুয়ে পড়লে ও এসেছিল অরিত্রর কাছে...চেয়ারের পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মিষ্টি করে বকুনি দিল এত রাত অব্দি কাজ করার জন্য। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল...ওর এই আদর করে বকুনি দেওয়াটা আর কিছু নয়...ও যে এখন একেবারের স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বা কোনো কথা ভেবে ভীষন খুশী হয়েছে তারই প্রমান। ওকে হাসি মুখে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চুলের ভেতরে ওর চাঁপাকলির মতো আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল...এই,এত রাতে কেন এসেছি বলোতো? তারপরেই ও কি বললো না বললো তাতে আমার বয়ে গেল এরকম একটা ভাব করে খুব খুশী খুশী গলায় বলল...এই, শোনো না...আমার না ভী-ষ-ন ভালো লাগছে...কেন বলোতো? অরিত্রর ওকে সেই আগের মতো সরলতা ভরা গলায় কথা বলতে দেখে ভীষন ভালো লাগছিল তবুও মজা করে বলল...কেন আবার...আমার কাছে এসেছো...তাই...
- উমম..শুধু ওটা নয়...শোনো না...কেন ভালো লাগছে জানো তো...দেখলে না সেদিন কেমন আচ্ছা করে দিলাম...কম অত্যাচার করেছে নাকি আমার উপরে...
- হুম...বুঝলাম...
- অবশ্য পুরো ক্রেডিটটা তোমাকেই দিতে হবে আমায়...তুমি যদি আমাকে ওইভাবে না বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে কি হয়েছিল তাহলে তো আমি আর ওইভাবে বলতে পারতাম না...জানো তো মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল...
- হুম...এখন আর আগুন জ্বলছে না তো? আমার তো আবার একটু ভয় ভয় করছে...
- এই, একদম ইয়ার্কি করবে না...তোমার ভয় পাওয়ার কি আছে শুনি...
- আচ্ছা ঠিক আছে, করলাম না ইয়ার্কি কিন্তু আমার জন্যই যখন হয়েছে তাহলে আমাকে কি দেবে বলো?
- কাঁচকলা দেব তোমাকে...তুমি নিজের থেকে কেন নাও না শুনি...
- শোনো, তুমি যখন কথা বলতে পারতে না...তখন আমি যেমন তোমাকে দেখে বুঝে নিতাম তেমনি তোমাকেও এখন থেকে আমাকে দেখে বুঝে নিতে হবে আমি কি চাই...
- ইশ, এটা কি শোধবোধ হচ্ছে নাকি...উঁ...
- সে আমি জানি না...বলো আমি এখন কি চাইছি...
- উমমম...তুমি এ-খ-ন...ধ্যাত জানি না যাও...
জানি না বললেও ও বুঝেছে ওকে এখন কি করতে হবে...আরো কাছে সরে এসে দুহাতে মুখটা ধরে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো নিজের ঠোঁট দুটোকে আলতো ভাবে দাঁতে চেপে ধরে, তারপরেই ওকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি মুখে নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে আস্তে আস্তে করে, যেন বলতে চেয়েছে...উঁ হুঁ...দেবোই না এখন...তবে, তুমি যদি নিজে উঠে এসে নিতে চাও তো নিতে পারো। অরিত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে এক মনে ওকে দেখে যেতে থাকলে নিজের থেকেই আবার ফিরে এল এক পা এক পা করে। নিজের থেকেই কোলে বসে বুকের উপরে এলিয়ে পড়ে দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল...তুমি খুব খারাপ...বিচ্ছিরি...
- তাই?
- হু...তাই তো...
- কেন?
- আমি পিছিয়ে যাচ্ছি দেখে কেন উঠে এসে আমাকে আটকালে না?
- আমি তো জানতাম ..
- কি?
- তুমি ঠিক ফিরে আসবে...
- তাই?
- হু...
তারপরে যা হবার তাই হয়েছে...বিচ্ছিরি ছেলেটার আদর খেয়ে যতটা খুশী হয়ে ও এসেছিল তার থেকেও বেশি খুশী হয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, এবারে ঘুমোতে হবে...
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অরিত্রর বন্ধুবান্ধবদের বাড়ী গিয়ে নিমন্ত্রন করে আসা হয়ে গেছে একমাত্র শুভর বাড়ী ছাড়া। রবিবার সকালে ওকে বিয়ের কার্ড নিয়ে আসতে দেখে শুভ হেসে ফেলে বলল...আমি তো তোর হয়ে অনেক আগেই মা বাবাকে বলে ফেলেছি, তুই আবার কি করতে এলি। কাকীমা রান্নাঘরে ব্যাস্ত ছিল, ছেলের কথা শুনে বেরিয়ে এসে বলল... একা একা এলি কেন রে...মৌকে তো নিয়ে আসতে পারতিস, কতদিন দেখিনি মেয়েটাকে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল...আমি নিজেই আজকাল দেখতে পাইনা তাকে, সে তো শুনি এ বাড়ী ও বাড়ী তোমাদের ওই আইবুড়ো ভাত না কি যেন খেয়ে বেড়াচ্ছে, তার উপরে পার্লার, টেলারিং শপ, গয়নার দোকান, মার্কেটিং তো লেগেই আছে। ওর কথা বলার ভঙ্গীতে কাকীমা হেসে ফেলেছে শুভর সাথে সাথে। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর কাকীমা বলল...সে তো হবেই, বিয়ের আগে মেয়েদের কত কাজ থাকে...তোরা ছেলেরে ও সব বুঝবি না।
- থাক বাবা আমার আর বুঝে কাজ নেই...তুমি এখন আমাকে একটু চা খাওয়াও তো দেখি...বাজার থেকে এসে দেখি একজন বেরিয়ে গেছে দাদুর সাথে কাছে পিঠের নিমন্ত্রনে, একজন মেজদির সাথে ফোনে কিসব গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, আর একজন বাজার থেকে এত কিছু এনেছি কেন বলে এমন মাথা খারাপ করতে শুরু করলো যে চায়ের কথা বলবো কি...কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি...
কাকীমা ওর অবস্থা শুনে হাসতে হাসতে বলল... বিয়ে করার কি জ্বালা বুঝতে পারছিস তাহলে বল।
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আর মাঝে মাত্র দশটা দিন বাকি আছে বিয়ের। মোটামুটি সব কিছু প্রায় করা হয়ে গেলেও আর কিছু বাকি থেকে গেল কিনা তাই নিয়ে দাদু চেক লিস্ট বানাতে বসেছে। যদিও অরিত্রকে কিছুই করতে দেওয়া হয়নি তবুও ওকে পাশে থেকে দাদুকে এটা ওটা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। সবকিছু হয়ে গেলে দাদু বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল...যাক বাবা, আর কিছু বাকি নেই দেখছি। অরিত্র দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল...নারায়নদার বাড়ীর কথা তো আমাদের কারুরই খেয়াল নেই। ওর কথা শুনে দাদু বেশ অবাক হয়ে বলল...কেন...আমি নিজে গিয়ে বলে এসেছি, বাড়ীর সবাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতেই হবে...আর নারায়ন তো প্রায় রোজই আসে...নিজের ছেলে মেয়ের বিয়েতেও হয়তো এত খাটাখাটনি করেনি, নিজের থেকেই এটা ওটা করছে...না বললেও তো শোনে না। অরিত্র একটু সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল...আমি ওসবের কথা বলছি না,আসলে ওদের জন্য কিছু একটা করা উচিত আমাদের। নারায়নদার বয়স হচ্ছে, এই বয়সেও রিক্সা টেনে যাচ্ছে,আমার ঠিক ভালো লাগে না...তাছাড়া সেদিন যদি আমাকে জোর না করতো তাহলে তো মৌকে এখানে নিয়ে আসা হয়তো হতো না আর প্রিয়ার থেকেই তো অনেকটা খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা।
ও কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে দাদু কয়েক মুহুর্ত কিছু একটা ভেবে দিদানের দিকে তাকালে দিদান অরিত্রকে বলল... ঠিকই বলেছিস,কিন্তু ওকে তো জানিস...এই বয়সেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে ছেলের কাছে হাত পাতে না যাতে বৌমা কিছু না বলতে পারে...
- আমিও যে ভাবিনি ওটা নিয়ে তা নয়...সোজাসুজি কিছু দিতে গেলে নেবে না কিন্তু ধর যদি আমরা ঘুরিয়ে কিছু করি...
- সে তো বুঝলাম কিন্তু ঘুরিয়ে কি ভাবে দেওয়া যাবে?
- স্টেশন রোডে তো আমাদের একটা জমি পড়ে আছে...ওটাতে যদি দুটো দোকান ঘর করে দেওয়া যায়...একটাতে নারায়নদার সাইকেল রিক্সার পার্টসের দোকান আর একটাতে প্রিয়ার জন্য বিউটি পার্লার করা যেতে পারে, প্রিয়া তো শুনেছিলাম বিউটিশিয়ান কোর্স করছিল...
- সেই তো সরাসরি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না কি?
- না না...তা হবে কেন...আমরা না হয় সামান্য টাকায় লিজ হিসেবে সাজানো দোকান দিয়ে দেব...বা দোকান থেকে যা লাভ হবে তার থেকে অল্প কিছু আমাদের জন্য দিতে পারে...পুরো ব্যাপারটাই যদি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটে করা যায় তাহলে তো বলতে পারবে না যে আমরা সাহায্য করছি...
নাতির কথাটা দাদু দিদান দুজনেরই পছন্দ হয়ে যেতে ওইদিন বিকেলেই দাদু নাতি দুজনে মিলে নারায়নদার বাড়ী গিয়ে বুঝিয়েছে এই বলে যে খালি জায়গা পড়ে থাকলে কোন দিন না আবার দখল হয়ে যায় আর বাইরের কাউকে দেওয়ার থেকে জানাশোনা আর বিশ্বাস করা যায় এমন কাউকে দেওয়াটা তো ভালো...সবকিছু শুনেও না না করছিল কোনো অভিজ্ঞতা নেই দোকান চালানোর কথা বলে। অরিত্র হাতে ধরে যখন বুঝিয়েছে যে সব কাজই তো মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রথম বারের জন্য করে, তাহলে এত ভয় পাওয়ার কি আছে...তারপরেই রাজী হয়েছে কিন্তু একটা শর্ত আছে...সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও এসে হিসেব দেখিয়ে যাবে যাতে করে বোঝা যায় লাভ ক্ষতি কি হচ্ছে...
আরো তিনটে দিন চলে গেছে। বাঁকুড়া থেকে মৌয়ের মামা ছেলে মেয়েকে এখানে পৌঁছে দিয়ে সেইদিন দুপুরেই ফিরে গেছেন। ওদিকেও কিছু কাজ আছে যেগুলো নিজে না থাকলে নাকি হবে না। ওরা দু ভাইবোনে দিন তিনেক এখানে থেকে দিদিকে সাথে নিয়ে ফিরবে। অবশ্য ওরা নিজেদের মতো করে যাবে না, শুভ ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে দুর্গাপুরে ওইদিন রাতে থেকে ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা নিজের চোখে দেখে আসবে। যেহেতু বিয়েটা দুর্গাপুরে হবে তাই তার আগে মামাবাড়ীতে দুদিন মতো ওকে থাকতে হবে মৌকে। মেয়ের বিয়ের আগে বাড়ির দুর্গামন্ডপে প্রনাম করে আশীর্বাদ নেবার একটা ওদের বংশানুক্রমিক নিয়ম আছে ওনাদের আর তার সাথে সাথে আছে আরো কিছু অনুষ্ঠান। রুপসা ব্যাপারটা শুনে প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল, মৌ ওখানে থেকে বিয়ের দিন সকালে দুর্গাপুর এলে ওকে সাজানোর কি হবে। ওর মতে দুপুর থেকে সন্ধে এতটা সময়ও নাকি যথেষ্ট নয়। শেষ পর্যন্ত যখন ওকে বলা হল যে তুইও ওর সাথে যা, তো শুনে বলল...তাহলে বাবা ঠিক আছে, আসলে তোমরা ঠিক বুঝবে না..আমার একটুও ইচ্ছে করছে না একা একা ছেড়ে দিতে, কোথায় কি হয়ে যাবে কে বলতে পারে। এরপরে এক ফাঁকে রুপসা অরিত্রকে একা পেয়ে পেছনে লেগে বলেছে...কি রে দাদাভাই...থাকতে পারবি তো একা একা? অরিত্র ওকে তাড়া করলে দৌড়ে পালাবার ভান করে বলেছে... তুই কি রে...তোর মন খারাপ হবে ভেবেই তো বললাম আর তুই কিনা আমাকেই তাড়া করছিস...
একটা করে দিন কমে আসছে আর বাড়ীতে ভীড় জমতে শুরু করেছে। বাকি আত্মীয়দের প্রায় বেশীরভাগই আগেরদিন রাতের ভেতরে আসবে আবার কেউ কেউ বিয়ের দিন সকালে সোজা দুর্গাপুর আসছে যে যার সুবিধা মতো। আত্মীয়রা যেমন আসছে আসুক কিন্তু কয়েক জনের আগেই আসা চাই এটা দিদান বার বার বলে দিয়েছিল, সেই কয়েক জন হচ্ছে...রুপসা, পুবালী, বিল্টু, মিষ্টি যাদেরকে কাছে পাওয়াটা নাকি মৌয়ের খুব দরকার। এরা ছাড়াও ওদিক থেকে অর্ক আর মামন আসায় ব্যাপারটা আরো জমে উঠেছে। ছোটগুলো সবকটাতে মিলে এত হৈ হুল্লোড় করছে যে মনে হচ্ছে বিয়েটা আজ কালের ভেতরেই হচ্ছে।
একটু বেলার দিকে অর্ককে একা একা মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে অরিত্র ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল দিদিরা ওকে নাকি পাত্তা দিচ্ছে না। ওর মুখ ভার করে বলা কারনটা শুনে মনে মনে হেসে ফেলল অরিত্র। দিদিরা বলতে মামন আর মিষ্টী, ওরা ওদের কিশোরী সুলভ স্বভাবের বশে কি পরবে, কেমন ভাবে সাজবে ওই নিয়ে ব্যাস্ত। ওদের কি আর ভাই এর জন্য সময় আছে নাকি এখন। আচ্ছা আমি দেখছি বলে ওকে সাথে নিয়ে রুপসার খোঁজে এদিক ওদিক দেখে পাওয়া গেল ছাদে...ওড়নাটা কোমরে বেঁধে বিল্টুর কাছে ঘুড়ী ওড়ানো শিখছে। মেয়েটা পারেও বটে বাবা ভাবতে ভাবতে ওকে ডেকে অর্কর সমস্যাটা বলতে ঘুড়ী ওড়ানো শেখা শিকেয় তুলে ওদের দুজনকে খুঁজে পেতে একজায়গায় নিয়ে এসে বকে দিয়ে বলল... এই তোরা কেউ আমার ভাই এর সাথে কথা বলবি না। কে তোদেরকে সাজিয়ে দেয় দেখবো আমি...চল তো ভাই, আমরা বাইরে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে আসি। দিদি যে মিথ্যে মিথ্যে বকছে বুঝতে পেরে মিষ্টি মুখ টিপে হাসছিল। অর্ক ওকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... হুঁ...চলো তো দিদি...কে ওদের ফাইফরমাস খাটে দেখবো...এই ভাই চল না দোকানে যাবো বললে কে যায় দেখবো। মামনও উলটে ভাইকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... কে তোকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয় আমিও দেখবো।
রুপসা একাই ভাইকে সাথে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাবে বললেও বাকিরা কেউ বাদ গেল না। ড্রাইভার এই মুহুর্তে না থাকায় অরিত্রকেই ড্রাইভ করতে হবে। গাড়ীতে গাদাগাদি করে সবাই উঠে পড়ে এত হৈ চৈ করছে যে কান পাতা দায়। ছোটো গুলোকে আর কি বলা যাবে...দলের নেত্রী যেখানে রুপসা সেখানে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অরিত্রর আর থাকতে না পেরে...উঃ বাবা রে বাবা...তোরা একটু চুপ করবি? বললে রুপসা এক প্রস্থ হেসে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ছোটদের কান বাঁচিয়ে বলল...তুই কি রে দাদাভাই... বেরসিক ভোঁদড় একটা... দু দুটো সুন্দরী শালী পেয়ে কোথায় বর্তে যাবি তা নয় উলটে আবার চুপ করতে বলছিস...হাঁদারাম কি আর এমনি বলি। এবারেও সেই একই সমস্যা, ছোটদের সামনে তো আর বলা যায় না যে আমার সুন্দরী শ্যালিকাদের প্রতি কোনো লোভ নেই, আমি তাদের আরো মিষ্টি দিদিকে নিয়ে খুশী...তাই বলতে হল...যা পারিস কর...অন্য গাড়ীর হর্ন শুনতে না পেয়ে যদি ঠুকে দি তো দোষ দিতে পারবি না বলে রাখলাম আর পাবলিকের মারধোর শুরু হলে বাঁচাস কিন্তু...
কটা দিন বেশ বাড়িটা জমজমাট ছিল, বাড়ীটা দুটো দিনের জন্য যেন আবার একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। কারনটা আর কিছু নয়, রুপসা থাকছে না দেখে বিল্টু আর মিষ্টিও দিদির সাথে মামাবাড়ী চলে গেছে...ওরা অবশ্য নিজের থেকে না বললেও সবাই চলে গেলে ওদের মন খারাপ হবে ভেবে অরিত্রই বলেছিল যদি ওরা যেতে চায় তো যাক...
মামাবাড়ীতে এসে গতবারেরর মতো দিদির সাথে শুতে গিয়ে কি মনে করে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল মৌ। সেই রাতে মিষ্টি চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল আর আজ বাইরে ঘন অন্ধকার, ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। হাওয়ার ঝাপটার সাথে সাথে জলের ফোঁটা মাঝে মাঝে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলে সারা শরীর শিরশির করে উঠছিল। সুমনা পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলল...কি রে...কি ভাবছিস?
- উঁ...কি জানি...
- খুব করে মনে পড়ছে...তাই না?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... কি জানি কি করছে এখন একা একা...
- এই মৌ...
- উঁ
- ফোন কর না...
- অনেকবার চেস্টা করলাম...লাইন পাচ্ছি না...
- আর একবার কর না...
একবারের জায়গায় বেশ কয়েকবার চেস্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না দেখে ফোনটা রেখে দিয়ে আগের মতোই দিদির সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুরে ফিরে ওর কথাই চলে আসছিল... জানিস তো দিদি, মুখ ফুটে কিছুই বলবে না...আমাকেই সব বুঝে নিতে হবে ওর কি চাই। মাঝে মাঝে বড্ড ভয় করে রে...
- কি?
- আগে বলো, যা বলবো তুমি ছাড়া আর কেউ জানবে না...
কাউকে না জানানোর মতো কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে ও একটু অবাক হয়ে গিয়ে চুপ করে থাকার পর বলল...আচ্ছা...
ও আচ্ছা বললেও অরিত্র খুব ভালো করেই জানে শোনার পর ওর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে আর সেই অবস্থায় ওর পাশে থাকার কতটা দরকার আছে। ওকে নিবিড় ভাবে বুকে চেপে ধরে অনেকটা সময় নিয়ে একটু একটু করে যা জেনেছে বলা হয়ে গেছে। মৌ কথাগুলো শুনে কান্না আটকানোর চেস্টা করলেও পারলো না, গুমরে গুমরে বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। অরিত্র ওকে এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে চাইছিল না, মুখে কিছু না বলে যে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে থেকে অনেক বেশী সান্তনা দেওয়া যায় সেটা আরো একবার প্রমান হয়ে গেল আজ। এরকম একটা মর্মান্তিক খবর শোনার পরেও যে ও নিজেকে ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাতে পেরেছে সেটা আর কেউ না বুঝুক ও নিজে জানে। চুপচাপ আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, মৌ অস্ফুট গলায় বলল... আমি কিভাবে নেবো সেই ভেবে কি তুমি আগে বলোনি?
উত্তরটা হ্যাঁ শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আগের মতোই বলল... তুমি কিছু ভেবোনা আর এই নিয়ে..আমি চাইনা আমার জন্য সবার খুশী নষ্ট হোক, এমনিতেই আমাকে নিয়ে তোমার ...
ও কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে অরিত্র আস্তে করে বলল... কাজটা সোজা নয়, তবুও নিজেকে শক্ত করতে হবে মৌ...এখন তুমি আর একা নয়...
ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে ও জবাব দিয়েছে...জানি...
এরপর আর বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। চুপচাপ দুজনে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পর ও ফিরে গেছে। অরিত্র ওকে আরো কিছুটা সময় থাকতে বললে ও বলেছিল...চিন্তা করবে না,আমি ঠিক আছি। ওকে এখন একা থাকতে দেওয়াটা হয়তো ভালো হবে ভেবে আর জোর করেনি। মৌ চলে যাবার পরও অরিত্র শুতে যেতে পারেনি, চুপ করে বসে থেকে ভাবছিল ঠিক কি কি ঘটে গেছে এইটুকু সময়ে, কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেল কিনা... যেটাকে নিয়ে ওকে ভাবতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওর একটা কথা বারে বারে মনে আসছে... আমার জন্য তো রাতের অন্ধকার আছেই, ওইটুকু সময় আমি না হয় বাবার জন্য একটু কাঁদবো...
অরিত্র যতটা ভয় পেয়েছিল ঠিক তা হয়নি, ভেতরে যতই যন্ত্রনা থাকুক না কেন কাউকে সেটা একেবারেই বুঝতে দেয়নি ও। একমাত্র অরিত্রকে যেটুকু সময় একা পেতো সেই সময়টুকু ও চেস্টা করতো না স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করার। মাঝে একবার নিজের থেকেই অরিত্রকে বলেছিল...ভেবে আর কি করবো বলো...বাবা তো আর ফিরে আসবে না...
সবকিছু ঠিক করা হয়ে গেলে একদিন বিশ্বাস কাকু আর ল-ইয়ার মিঃ মুখার্জীকে সাথে নিয়ে যেতে হয়েছিল মায়ের সাথে দেখা করতে। বিল্টু আর মিষ্টি বাড়ী ছিল না, ওরা দিদি কোন সময়ে আসবে জানা থাকায় কাজ আছে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে একসাথে, তবে দুজনেই খুব চিন্তায় আছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই ভেবে। মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নিয়েছে ওরা কতদুর পৌঁছোলো। সবাই ভেবেছিল হঠাৎ মৌকে দেখে হয়তো উনি অবাক হবেন কিন্তু ওনাকে দেখে মনেই হয়নি তেমন কিছু হয়েছে...বা হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর সহজাত ক্ষমতাটা ওনার বড্ড বেশি। ওদেরকে বসার কথা বলে শুধু একটাই কথা বলেছেন...তুই যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে গেলি সেটা কি ঠিক হয়েছিল... আর ছিলিই বা কোথায় এতদিন? মৌ কথাটার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছে...তোমার সাথে কিছু দরকার আছে বলেই আমি এসেছি। মৌ দরকার আছে বলাতে কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হয়তো বোঝার চেস্টা করেছেন দরকারটা কি হতে পারে। কিছু একটা অনুমান করে ওদেরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলে মৌ এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো পুরোনো দিনের কথা ভাবছিল। তারপর কি মনে করে ভেতরে গিয়ে ওনাকে ডেকে আনলো, ও চাইছিল না হয়তো বেশী সময় দিতে, যা বলার বা করার তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। মিঃ মুখার্জী কথা শুরু করতে যেতেই উনি বললেন... আমাকে দুর্বল ভাবার কিন্তু কোনো কারন নেই... ভাববেন না আমি কিছু বুঝিনি। বেশ কিছুদিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। আমিও কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে কিডন্যাপের কেস করতে পারি। আপনাদের হয়তো জানা নেই যে আমার উপর মহলের সাথে ওঠাবসাটা কিছু কম নয়। এতটা বলে হয়তো উনি থামলেন প্রতিপক্ষের দিক থেকে কি সাড়া আসে সেটা জানার জন্য।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মৌ খুব একটা জোরে না হলেও বেশ দৃঢতার সাথে বলল...তোমার খেয়াল রাখা উচিত যে আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তুমি যা খুশি করো না কেন আমার বক্তব্যটাই কোর্ট মেনে নেবে আর তার থেকে বড় কথা বাবার ব্যাপারে তুমি যা করেছো তার কিছু হলেও প্রমান আমাদের কাছে আছে যখন আমরাও কি ছেড়ে দেবো ভেবেছো? যাকগে, ওসব কথা ছাড়ো, তোমার সাথে কোনোরকম ঝামেলা করার জন্য বা কিছু নিতে আমি আসিনি। আমি আজ এখানে এসেছি, যে কারনে তুমি আমাকে সরাতে চেয়েছিলে সেগুলো সব তোমাকে দিয়ে যেতে। আর কিছু বলবে?
ভদ্রমহিলার আর কি কি ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে না জানা থাকলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়ানো যায় সেটা বেশ ভালোই জানেন। সামান্য কয়েক মুহুর্ত মুখ নিচু করে বসে থাকার পর নিজেকে নিমেষের ভেতরে পালটে নিয়ে চোখে জল এনে বললেন...তুই আমাকে ভুল বুঝিস না মৌ, আমি কখোনো তোর খারাপ চাইনি...বিশ্বাস কর...যা কিছু করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি...তোর বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম...
মৌ চাইছিল না আর কথা বাড়াতে বা এটাও চাইছিল না পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিক...আর কেউ ওনাকে চিনুক বা না চিনুক, ও তো ভালোভাবেই চেনে। মা-কে থামিয়ে দিয়ে বলল...আমি কোনোকিছুই আর জানতে বা শুনতে চাই না। তুমি সত্যিই যদি আমার ভালো চাইতে তাহলে আমি চলে যাবার পর আর কিছু না করো বা না করো একটা মিসিং ডাইরি অন্তত করতে... যাই হোক,তুমি যা যা করেছো বা করতে চেয়েছিলে সেগুলো আমি আর এখানে সবার সামনে ওঠাতে চাই না। আমি তো সব কিছু দিতেই এসেছি, এখন আর ওসব কথা তুলে কিছু লাভ নেই। তবে, একটা কথা বলে যাচ্ছি...তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখলেও বিল্টু আর মিষ্টির সাথে আমার যোগাযোগ থাকছেই। আমি এখানে না এলেও ওরা যখন চাইবে আমার কাছে যাবে। তোমার যদি মনে হয় আমার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া উচিৎ তাহলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারো তবে আমি যখন সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু ভুলেও চেস্টা করবে না সেটা নিয়ে কিছু করার বা ভাবার...আর একটা কথাও বলে যাচ্ছি, তুমি আমার মা হতে পারোনি তাতে আমার আর বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই কিন্তু যদি এখন থেকে নিজের ছেলেমেয়ের কথা ভেবে অন্তত ওদের মা হওয়ার চেস্টা করতে পারো তো ভালো হয়। ধরে নাও, শুধুমাত্র ওদের দুজনের কথা ভেবেই আমি সবকিছু জেনেও বাবার ব্যাপারটা নিয়ে তোমার বিরুদ্ধে আইন আদালত করতে চাইছি না...
বিল্টু আর মিষ্টির কথা শুনে ভদ্রমহিলা হয়তো বোঝার চেস্টা করছিলেন তাহলে কি নিজের ছেলে মেয়েও পর হয়ে যাবে? ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে মৌ পরিস্কার করে বলে দিয়েছে ওরা ভাইবোন দিদির সাথে যোগাযোগ রাখলে যেন ওদেরকে কিছু না বলা হয় আর ওদেরকে যদি কিছু বলা হয় তাহলে তার ফল খারাপ ছাড়া ভালো হবে না। দরকার হলে ও আজই পাড়ার সবাইকে জানিয়ে দেবে কি কি ঘটেছে এতদিন ধরে আর মা যেন মনে রাখে যে ঊনার উপর মহলে যেমন ওঠাবসা আছে তেমন আর কারুর নেই সেটা ভুলেও না ভাবতে।
যে মেয়েকে নিজের খুশী মতো এত বছর চালানো হলেও কোনোদিন মুখ ফুটে একটাও কথা বলেনি কোনোদিন, সেই মেয়ের মুখে এত বড় বড় কথা শুনেও আর সাহস হয়নি কোনো কথা বলার বা তিন তিন জন অপরিতিত মানুষের সামনে বসে ওইটুকু মেয়ের কাছে হেরে এইভাবে যাওয়াটা হয়তো সহ্য হচ্ছিল না। মুখ নীচু করে উঠে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেছেন আমি ভেতরে আছি, কি করতে হবে বল, করে দেবো।
তারপরের ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক ভাবে মিটে গেছে একটার পর একটা। অরিত্র বিল্টুকে ফোন করে বাড়ী আসতে বলে দেবার পর ওরা ফিরে এসেছে। ওরা দুজনেই একটু ভয়ে ভয়ে ফিরে আসার পর যখন দেখলো যে মায়ের সেই রুপ আর দেখা যাচ্ছে না, তখন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে মিলে সবার জন্য ওদের বুদ্ধিমতো আতিথেয়তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। এদিকে কাগজপত্রের কাজ করতে করতে মিষ্টিকে নিয়ে মৌ ভেতরে গিয়ে ওর একান্ত নিজস্ব কিছু জিনিষ বা দরকারী কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছে। সব কিছু মিটে গেলে আর এক মুহুর্তও মৌ ওখানে থাকতে চাইছিল না। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে ছটপট করছে কখন বেরিয়ে আসবে, তবে তার আগে ভাইবোনকে মায়ের সামনেই বার বার করে বলে দিয়েছে ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওরা যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর বিয়ের কয়েক দিন আগে যেমন আসার কথা বলা আছে সেইমতো চলে আসে বা তেমন যদি ওরা মনে করে তাহলে বললেই দাদা অফিস থেকে ফেরার পথে চলে আসতে পারে ওদেরকে তুলে নিতে।
ফেরার সময় মিঃ মুখার্জী আর বিশ্বাস কাকু শ্যমবাজারে নেমে গেলেন নিজেদের কিছু কাজ থাকায়। অস্বাভাবিক ভাবে আজ যেন রাস্তায় গাড়ীর ভীড় তেমন নেই। মৌ চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেও অরিত্র মৌয়ের হঠাৎ করে পালটে যাওয়াটা বা যেভাবে ও একটার পর একটা কথা বলে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবছিল। ও হঠাৎ করে যা যা করে ফেলেছে সেগুলো কোনোভাবেই ওর স্বভাবের সাথে খাপ খায়না। কোনোভাবেই মেলাতে না পেরে পরে ওর সাথে কথা বলবে ভেবে খেয়াল করল বেশ কিছুটা সময় ধরে ও কোনো কথা বলেনি...তারপরই ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছুই হয়তো দেখছে না, পাথরের মতো বসে থেকে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। ড্রাইভারকে সাবধানে গাড়ী চালাতে বলে অরিত্র ওর পাশে সরে গিয়ে হাতের উপরে হাতটা রাখলে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। এত সময় নিঃশব্দে কেঁদে গেলেও আর পারলো না নিজেকে আটকে রাখতে। ওর সবথেকে কাছের যে আছে তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারলে তো মনটা হাল্কা হবে ভেবে হয়তো কোনোরকমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলল...সব কিছু জেনেও বাবার জন্য কিছু করতে পারলাম না...জানি না ঠিক করলাম কিনা...
এই মুহুর্তে ওকে কিছু না বলে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে নীরবে সান্তনা দিয়ে যেতে থাকলে আস্তে আস্তে কান্নার দমক কমে আসার পরেও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল...বললে না তো, আমি ভুল করলাম কিনা। অরিত্র ওর হাতে আলতো ভাবে একটু চাপ দিয়ে বলল... তুমি ঠিকই করেছো মৌ...একটা ক্ষতির শোধ নিতে গিয়ে আরো একটা ক্ষতি হয়তো আমাদের বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় বা করতে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ঠিক হতো না। কথাটা শুনে ও কিছু বললো না...সামান্য একটা বিরতির পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে মুখ নীচু করে বসে থেকে হয়তো ভাবছিল..আমি ঠিক যা ভেবে ডিশিশানটা নিয়েছিলাম ও তো ঠিক সেটাই বলল...জানি না ও এত ভালো কি করে বোঝে আমাকে...
আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে, প্রথম দুটো তিনটে দিন মৌ কিছুটা হলেও চুপচাপ ছিল দেখে এর ভেতরে কেউই ওই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে কথা বলে ওকে বিরক্ত করতে চায়নি। আবার একদিন রাতে সবাই শুয়ে পড়লে ও এসেছিল অরিত্রর কাছে...চেয়ারের পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মিষ্টি করে বকুনি দিল এত রাত অব্দি কাজ করার জন্য। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল...ওর এই আদর করে বকুনি দেওয়াটা আর কিছু নয়...ও যে এখন একেবারের স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বা কোনো কথা ভেবে ভীষন খুশী হয়েছে তারই প্রমান। ওকে হাসি মুখে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চুলের ভেতরে ওর চাঁপাকলির মতো আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল...এই,এত রাতে কেন এসেছি বলোতো? তারপরেই ও কি বললো না বললো তাতে আমার বয়ে গেল এরকম একটা ভাব করে খুব খুশী খুশী গলায় বলল...এই, শোনো না...আমার না ভী-ষ-ন ভালো লাগছে...কেন বলোতো? অরিত্রর ওকে সেই আগের মতো সরলতা ভরা গলায় কথা বলতে দেখে ভীষন ভালো লাগছিল তবুও মজা করে বলল...কেন আবার...আমার কাছে এসেছো...তাই...
- উমম..শুধু ওটা নয়...শোনো না...কেন ভালো লাগছে জানো তো...দেখলে না সেদিন কেমন আচ্ছা করে দিলাম...কম অত্যাচার করেছে নাকি আমার উপরে...
- হুম...বুঝলাম...
- অবশ্য পুরো ক্রেডিটটা তোমাকেই দিতে হবে আমায়...তুমি যদি আমাকে ওইভাবে না বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে কি হয়েছিল তাহলে তো আমি আর ওইভাবে বলতে পারতাম না...জানো তো মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল...
- হুম...এখন আর আগুন জ্বলছে না তো? আমার তো আবার একটু ভয় ভয় করছে...
- এই, একদম ইয়ার্কি করবে না...তোমার ভয় পাওয়ার কি আছে শুনি...
- আচ্ছা ঠিক আছে, করলাম না ইয়ার্কি কিন্তু আমার জন্যই যখন হয়েছে তাহলে আমাকে কি দেবে বলো?
- কাঁচকলা দেব তোমাকে...তুমি নিজের থেকে কেন নাও না শুনি...
- শোনো, তুমি যখন কথা বলতে পারতে না...তখন আমি যেমন তোমাকে দেখে বুঝে নিতাম তেমনি তোমাকেও এখন থেকে আমাকে দেখে বুঝে নিতে হবে আমি কি চাই...
- ইশ, এটা কি শোধবোধ হচ্ছে নাকি...উঁ...
- সে আমি জানি না...বলো আমি এখন কি চাইছি...
- উমমম...তুমি এ-খ-ন...ধ্যাত জানি না যাও...
জানি না বললেও ও বুঝেছে ওকে এখন কি করতে হবে...আরো কাছে সরে এসে দুহাতে মুখটা ধরে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো নিজের ঠোঁট দুটোকে আলতো ভাবে দাঁতে চেপে ধরে, তারপরেই ওকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি মুখে নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে আস্তে আস্তে করে, যেন বলতে চেয়েছে...উঁ হুঁ...দেবোই না এখন...তবে, তুমি যদি নিজে উঠে এসে নিতে চাও তো নিতে পারো। অরিত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে এক মনে ওকে দেখে যেতে থাকলে নিজের থেকেই আবার ফিরে এল এক পা এক পা করে। নিজের থেকেই কোলে বসে বুকের উপরে এলিয়ে পড়ে দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল...তুমি খুব খারাপ...বিচ্ছিরি...
- তাই?
- হু...তাই তো...
- কেন?
- আমি পিছিয়ে যাচ্ছি দেখে কেন উঠে এসে আমাকে আটকালে না?
- আমি তো জানতাম ..
- কি?
- তুমি ঠিক ফিরে আসবে...
- তাই?
- হু...
তারপরে যা হবার তাই হয়েছে...বিচ্ছিরি ছেলেটার আদর খেয়ে যতটা খুশী হয়ে ও এসেছিল তার থেকেও বেশি খুশী হয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, এবারে ঘুমোতে হবে...
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অরিত্রর বন্ধুবান্ধবদের বাড়ী গিয়ে নিমন্ত্রন করে আসা হয়ে গেছে একমাত্র শুভর বাড়ী ছাড়া। রবিবার সকালে ওকে বিয়ের কার্ড নিয়ে আসতে দেখে শুভ হেসে ফেলে বলল...আমি তো তোর হয়ে অনেক আগেই মা বাবাকে বলে ফেলেছি, তুই আবার কি করতে এলি। কাকীমা রান্নাঘরে ব্যাস্ত ছিল, ছেলের কথা শুনে বেরিয়ে এসে বলল... একা একা এলি কেন রে...মৌকে তো নিয়ে আসতে পারতিস, কতদিন দেখিনি মেয়েটাকে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল...আমি নিজেই আজকাল দেখতে পাইনা তাকে, সে তো শুনি এ বাড়ী ও বাড়ী তোমাদের ওই আইবুড়ো ভাত না কি যেন খেয়ে বেড়াচ্ছে, তার উপরে পার্লার, টেলারিং শপ, গয়নার দোকান, মার্কেটিং তো লেগেই আছে। ওর কথা বলার ভঙ্গীতে কাকীমা হেসে ফেলেছে শুভর সাথে সাথে। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর কাকীমা বলল...সে তো হবেই, বিয়ের আগে মেয়েদের কত কাজ থাকে...তোরা ছেলেরে ও সব বুঝবি না।
- থাক বাবা আমার আর বুঝে কাজ নেই...তুমি এখন আমাকে একটু চা খাওয়াও তো দেখি...বাজার থেকে এসে দেখি একজন বেরিয়ে গেছে দাদুর সাথে কাছে পিঠের নিমন্ত্রনে, একজন মেজদির সাথে ফোনে কিসব গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, আর একজন বাজার থেকে এত কিছু এনেছি কেন বলে এমন মাথা খারাপ করতে শুরু করলো যে চায়ের কথা বলবো কি...কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি...
কাকীমা ওর অবস্থা শুনে হাসতে হাসতে বলল... বিয়ে করার কি জ্বালা বুঝতে পারছিস তাহলে বল।
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আর মাঝে মাত্র দশটা দিন বাকি আছে বিয়ের। মোটামুটি সব কিছু প্রায় করা হয়ে গেলেও আর কিছু বাকি থেকে গেল কিনা তাই নিয়ে দাদু চেক লিস্ট বানাতে বসেছে। যদিও অরিত্রকে কিছুই করতে দেওয়া হয়নি তবুও ওকে পাশে থেকে দাদুকে এটা ওটা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। সবকিছু হয়ে গেলে দাদু বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল...যাক বাবা, আর কিছু বাকি নেই দেখছি। অরিত্র দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল...নারায়নদার বাড়ীর কথা তো আমাদের কারুরই খেয়াল নেই। ওর কথা শুনে দাদু বেশ অবাক হয়ে বলল...কেন...আমি নিজে গিয়ে বলে এসেছি, বাড়ীর সবাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতেই হবে...আর নারায়ন তো প্রায় রোজই আসে...নিজের ছেলে মেয়ের বিয়েতেও হয়তো এত খাটাখাটনি করেনি, নিজের থেকেই এটা ওটা করছে...না বললেও তো শোনে না। অরিত্র একটু সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল...আমি ওসবের কথা বলছি না,আসলে ওদের জন্য কিছু একটা করা উচিত আমাদের। নারায়নদার বয়স হচ্ছে, এই বয়সেও রিক্সা টেনে যাচ্ছে,আমার ঠিক ভালো লাগে না...তাছাড়া সেদিন যদি আমাকে জোর না করতো তাহলে তো মৌকে এখানে নিয়ে আসা হয়তো হতো না আর প্রিয়ার থেকেই তো অনেকটা খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা।
ও কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে দাদু কয়েক মুহুর্ত কিছু একটা ভেবে দিদানের দিকে তাকালে দিদান অরিত্রকে বলল... ঠিকই বলেছিস,কিন্তু ওকে তো জানিস...এই বয়সেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে ছেলের কাছে হাত পাতে না যাতে বৌমা কিছু না বলতে পারে...
- আমিও যে ভাবিনি ওটা নিয়ে তা নয়...সোজাসুজি কিছু দিতে গেলে নেবে না কিন্তু ধর যদি আমরা ঘুরিয়ে কিছু করি...
- সে তো বুঝলাম কিন্তু ঘুরিয়ে কি ভাবে দেওয়া যাবে?
- স্টেশন রোডে তো আমাদের একটা জমি পড়ে আছে...ওটাতে যদি দুটো দোকান ঘর করে দেওয়া যায়...একটাতে নারায়নদার সাইকেল রিক্সার পার্টসের দোকান আর একটাতে প্রিয়ার জন্য বিউটি পার্লার করা যেতে পারে, প্রিয়া তো শুনেছিলাম বিউটিশিয়ান কোর্স করছিল...
- সেই তো সরাসরি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না কি?
- না না...তা হবে কেন...আমরা না হয় সামান্য টাকায় লিজ হিসেবে সাজানো দোকান দিয়ে দেব...বা দোকান থেকে যা লাভ হবে তার থেকে অল্প কিছু আমাদের জন্য দিতে পারে...পুরো ব্যাপারটাই যদি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটে করা যায় তাহলে তো বলতে পারবে না যে আমরা সাহায্য করছি...
নাতির কথাটা দাদু দিদান দুজনেরই পছন্দ হয়ে যেতে ওইদিন বিকেলেই দাদু নাতি দুজনে মিলে নারায়নদার বাড়ী গিয়ে বুঝিয়েছে এই বলে যে খালি জায়গা পড়ে থাকলে কোন দিন না আবার দখল হয়ে যায় আর বাইরের কাউকে দেওয়ার থেকে জানাশোনা আর বিশ্বাস করা যায় এমন কাউকে দেওয়াটা তো ভালো...সবকিছু শুনেও না না করছিল কোনো অভিজ্ঞতা নেই দোকান চালানোর কথা বলে। অরিত্র হাতে ধরে যখন বুঝিয়েছে যে সব কাজই তো মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রথম বারের জন্য করে, তাহলে এত ভয় পাওয়ার কি আছে...তারপরেই রাজী হয়েছে কিন্তু একটা শর্ত আছে...সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও এসে হিসেব দেখিয়ে যাবে যাতে করে বোঝা যায় লাভ ক্ষতি কি হচ্ছে...
আরো তিনটে দিন চলে গেছে। বাঁকুড়া থেকে মৌয়ের মামা ছেলে মেয়েকে এখানে পৌঁছে দিয়ে সেইদিন দুপুরেই ফিরে গেছেন। ওদিকেও কিছু কাজ আছে যেগুলো নিজে না থাকলে নাকি হবে না। ওরা দু ভাইবোনে দিন তিনেক এখানে থেকে দিদিকে সাথে নিয়ে ফিরবে। অবশ্য ওরা নিজেদের মতো করে যাবে না, শুভ ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে দুর্গাপুরে ওইদিন রাতে থেকে ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা নিজের চোখে দেখে আসবে। যেহেতু বিয়েটা দুর্গাপুরে হবে তাই তার আগে মামাবাড়ীতে দুদিন মতো ওকে থাকতে হবে মৌকে। মেয়ের বিয়ের আগে বাড়ির দুর্গামন্ডপে প্রনাম করে আশীর্বাদ নেবার একটা ওদের বংশানুক্রমিক নিয়ম আছে ওনাদের আর তার সাথে সাথে আছে আরো কিছু অনুষ্ঠান। রুপসা ব্যাপারটা শুনে প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল, মৌ ওখানে থেকে বিয়ের দিন সকালে দুর্গাপুর এলে ওকে সাজানোর কি হবে। ওর মতে দুপুর থেকে সন্ধে এতটা সময়ও নাকি যথেষ্ট নয়। শেষ পর্যন্ত যখন ওকে বলা হল যে তুইও ওর সাথে যা, তো শুনে বলল...তাহলে বাবা ঠিক আছে, আসলে তোমরা ঠিক বুঝবে না..আমার একটুও ইচ্ছে করছে না একা একা ছেড়ে দিতে, কোথায় কি হয়ে যাবে কে বলতে পারে। এরপরে এক ফাঁকে রুপসা অরিত্রকে একা পেয়ে পেছনে লেগে বলেছে...কি রে দাদাভাই...থাকতে পারবি তো একা একা? অরিত্র ওকে তাড়া করলে দৌড়ে পালাবার ভান করে বলেছে... তুই কি রে...তোর মন খারাপ হবে ভেবেই তো বললাম আর তুই কিনা আমাকেই তাড়া করছিস...
একটা করে দিন কমে আসছে আর বাড়ীতে ভীড় জমতে শুরু করেছে। বাকি আত্মীয়দের প্রায় বেশীরভাগই আগেরদিন রাতের ভেতরে আসবে আবার কেউ কেউ বিয়ের দিন সকালে সোজা দুর্গাপুর আসছে যে যার সুবিধা মতো। আত্মীয়রা যেমন আসছে আসুক কিন্তু কয়েক জনের আগেই আসা চাই এটা দিদান বার বার বলে দিয়েছিল, সেই কয়েক জন হচ্ছে...রুপসা, পুবালী, বিল্টু, মিষ্টি যাদেরকে কাছে পাওয়াটা নাকি মৌয়ের খুব দরকার। এরা ছাড়াও ওদিক থেকে অর্ক আর মামন আসায় ব্যাপারটা আরো জমে উঠেছে। ছোটগুলো সবকটাতে মিলে এত হৈ হুল্লোড় করছে যে মনে হচ্ছে বিয়েটা আজ কালের ভেতরেই হচ্ছে।
একটু বেলার দিকে অর্ককে একা একা মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে অরিত্র ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল দিদিরা ওকে নাকি পাত্তা দিচ্ছে না। ওর মুখ ভার করে বলা কারনটা শুনে মনে মনে হেসে ফেলল অরিত্র। দিদিরা বলতে মামন আর মিষ্টী, ওরা ওদের কিশোরী সুলভ স্বভাবের বশে কি পরবে, কেমন ভাবে সাজবে ওই নিয়ে ব্যাস্ত। ওদের কি আর ভাই এর জন্য সময় আছে নাকি এখন। আচ্ছা আমি দেখছি বলে ওকে সাথে নিয়ে রুপসার খোঁজে এদিক ওদিক দেখে পাওয়া গেল ছাদে...ওড়নাটা কোমরে বেঁধে বিল্টুর কাছে ঘুড়ী ওড়ানো শিখছে। মেয়েটা পারেও বটে বাবা ভাবতে ভাবতে ওকে ডেকে অর্কর সমস্যাটা বলতে ঘুড়ী ওড়ানো শেখা শিকেয় তুলে ওদের দুজনকে খুঁজে পেতে একজায়গায় নিয়ে এসে বকে দিয়ে বলল... এই তোরা কেউ আমার ভাই এর সাথে কথা বলবি না। কে তোদেরকে সাজিয়ে দেয় দেখবো আমি...চল তো ভাই, আমরা বাইরে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে আসি। দিদি যে মিথ্যে মিথ্যে বকছে বুঝতে পেরে মিষ্টি মুখ টিপে হাসছিল। অর্ক ওকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... হুঁ...চলো তো দিদি...কে ওদের ফাইফরমাস খাটে দেখবো...এই ভাই চল না দোকানে যাবো বললে কে যায় দেখবো। মামনও উলটে ভাইকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... কে তোকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয় আমিও দেখবো।
রুপসা একাই ভাইকে সাথে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাবে বললেও বাকিরা কেউ বাদ গেল না। ড্রাইভার এই মুহুর্তে না থাকায় অরিত্রকেই ড্রাইভ করতে হবে। গাড়ীতে গাদাগাদি করে সবাই উঠে পড়ে এত হৈ চৈ করছে যে কান পাতা দায়। ছোটো গুলোকে আর কি বলা যাবে...দলের নেত্রী যেখানে রুপসা সেখানে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অরিত্রর আর থাকতে না পেরে...উঃ বাবা রে বাবা...তোরা একটু চুপ করবি? বললে রুপসা এক প্রস্থ হেসে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ছোটদের কান বাঁচিয়ে বলল...তুই কি রে দাদাভাই... বেরসিক ভোঁদড় একটা... দু দুটো সুন্দরী শালী পেয়ে কোথায় বর্তে যাবি তা নয় উলটে আবার চুপ করতে বলছিস...হাঁদারাম কি আর এমনি বলি। এবারেও সেই একই সমস্যা, ছোটদের সামনে তো আর বলা যায় না যে আমার সুন্দরী শ্যালিকাদের প্রতি কোনো লোভ নেই, আমি তাদের আরো মিষ্টি দিদিকে নিয়ে খুশী...তাই বলতে হল...যা পারিস কর...অন্য গাড়ীর হর্ন শুনতে না পেয়ে যদি ঠুকে দি তো দোষ দিতে পারবি না বলে রাখলাম আর পাবলিকের মারধোর শুরু হলে বাঁচাস কিন্তু...
কটা দিন বেশ বাড়িটা জমজমাট ছিল, বাড়ীটা দুটো দিনের জন্য যেন আবার একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। কারনটা আর কিছু নয়, রুপসা থাকছে না দেখে বিল্টু আর মিষ্টিও দিদির সাথে মামাবাড়ী চলে গেছে...ওরা অবশ্য নিজের থেকে না বললেও সবাই চলে গেলে ওদের মন খারাপ হবে ভেবে অরিত্রই বলেছিল যদি ওরা যেতে চায় তো যাক...
মামাবাড়ীতে এসে গতবারেরর মতো দিদির সাথে শুতে গিয়ে কি মনে করে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল মৌ। সেই রাতে মিষ্টি চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল আর আজ বাইরে ঘন অন্ধকার, ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। হাওয়ার ঝাপটার সাথে সাথে জলের ফোঁটা মাঝে মাঝে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলে সারা শরীর শিরশির করে উঠছিল। সুমনা পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলল...কি রে...কি ভাবছিস?
- উঁ...কি জানি...
- খুব করে মনে পড়ছে...তাই না?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... কি জানি কি করছে এখন একা একা...
- এই মৌ...
- উঁ
- ফোন কর না...
- অনেকবার চেস্টা করলাম...লাইন পাচ্ছি না...
- আর একবার কর না...
একবারের জায়গায় বেশ কয়েকবার চেস্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না দেখে ফোনটা রেখে দিয়ে আগের মতোই দিদির সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুরে ফিরে ওর কথাই চলে আসছিল... জানিস তো দিদি, মুখ ফুটে কিছুই বলবে না...আমাকেই সব বুঝে নিতে হবে ওর কি চাই। মাঝে মাঝে বড্ড ভয় করে রে...