25-02-2019, 12:46 PM
ওরা আজ আসবে বলে জেঠু অফিস যায়নি। পুবালীও ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছে। দুপুরে খেতে বসে জেঠিমার সাথে কথা হয়ে গিয়েছিল কাল সকালে অরিত্র অফিস চলে যাবে এখান থেকে, বিকেলে তাড়াতাড়ি ফিরে মৌকে নিয়ে বাড়ী ফিরবে। বিকেলের দিকে ওকে একা পেয়ে মৌ মুখ ভার করে বলল... কেন, কাল অফিস না গেলেই নয়? তোমার তো অনেক ছুটি জমে আছে। তুমি কি করে জানলে আমার ছুটি জমে আছে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল... না জানার কি আছে...তুমি কি একদিনও কামাই করেছো নাকি...এই তো সবে চার দিনের ছুটি নিলে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল...তার মানে তুমি সব খবর রাখতে, আমি কি করি কোথায় যাই...
- হু, কি হয়েছে তাতে?
তাহলে তুমি আগে কেন আসোনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করাতে ও দুহাতে ওর মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে তো বলেছি, কেন আসতে পারতাম না। অরিত্র ওর চোখে কষ্ট পাওয়ার আভাস দেখে ওকে বুকে চেপে ধরে নিয়ে বলল... আমরা দুজনেই অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি...তাই না...আমিও তো তোমাকে কিছু বলতে পারিনি...
ওরা ফিরে আসার পর আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে। ওদিক থেকে মৌয়ের দাদু আর মামা এলে তারপর সবাই মিলে বসে সব কিছু ঠিক করার কথা, তাই যেগুলো নিজেরা শুরু করতে পারবে সেগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করা হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য গয়না বানানোর একটা বড় কাজ তো আছেই দেখে এর ভেতরে একদিন দিদান ব্যাঙ্কের লকারে যত গয়না ছিল সব নিয়ে এসেছে। নিজের তো ছিলই তার উপরে মেয়ের সমস্ত গয়না অরিত্রর ছোটো জেঠিমা কয়েক বছর আগে নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছিল। দিদান মৌকে ডেকে সব এক এক করে দেখাতে দেখাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ও একটা একটা করে দেখেছে আর বলেছে ‘এটা বড্ড পুরোনো পুরোনো’ বা ‘আরে এই হারটা কি সুন্দর। কোনটা কোনটা দিদানরা কোন দিন পরবে তাই বলে গেছে এক এক করে। দিদান তখন কিছু বলেনি ওকে কিন্তু সব দেখা হয়ে গেলে যেই বলেছে...এই মেয়ে শোন, এখন থেকে এগুলো সব তোর ওমনি মৌ চোখ বড় বড় করে দিদানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছে না না, আমাকে কেন সব দেবে?
- তোকে দেবোনা তো কাকে দেবো শুনি?
- সে আমি কি জানি...
- ও মা...মেয়ের কথা শোনো...সে আমি কি জানি বললে হবে? তোকেই সব নিতে হবে...বুঝলি?
- ও দিদান কি শুরু করেছো বলোতো? আমাকে কি গয়না দিয়ে মুড়ে রাখবে নাকি?
- হ্যাঁ তাই রাখবো...শোন, পরশু আমরা বৌবাজার যাচ্ছি, মাপ দিতে হবে, ডিজাইন পছন্দ করতে হবে...অনেক কাজ আছে...তুই এক কাজ কর না মা...তোর জেঠিমা আর দিদিকে ফোন করে বল আসতে...ওরা না এলে তো হবে না...আমি কি আর এখন কি চলছে বুঝবো?
তখনকার মতো দিদানকে বোঝাতে না পেরে চুপ করে গেলেও রাতে অরিত্র ফিরে আসার পর ও গেছে অরিত্রর কাছে। অরিত্র সব শুনেও কিছু না বলে মুখ টিপে হাসছে দেখে ও হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল...এই চলো না, দিদানকে বোঝাবে। কেন তোমার গয়না ভালো লাগে না নাকি জিজ্ঞেস করাতে বলল... ভালো লাগবে না কেন...তাই বলে এতো? আমি কি পুতুল নাকি যে তোমরা সাজিয়ে রাখবে আমাকে।
অরিত্র হেসে ফেলে বলল...তুমি দিদানদের কতোটা আদরের জানোই তো...
- সে তো জানি...তাই বলে সব কেন দেবে?
- আচ্ছা দিতে চাইছে দিক না...জানোই তো মা বাবা নেই বলে কিভাবে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে আমাকে। মা বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি কখোনো...তাছাড়া, কাল রাতে দেখলাম, মায়ের ফটোটা বুকে চেপে নিয়ে কাঁদছে...সত্যিই তো আজ মা থাকলে কি খুশী হোতো... সেটাই হয়তো মেটাবার চেস্টা করছে...
ওকে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যেতে দেখে মৌ আর কিছু বলতে পারলো না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...আচ্ছা...
কথাবার্তা বলার জন্য মৌয়ের মামারা যেমন চলে এসেছে, তেমনি ওদিক থেকে বড় জ়েঠুও কোলকাতা চলে এসেছে। একেবারে সব কিছু ঠিক করে তারপরে ফিরবে। বিয়ের কোনো ব্যাপারেই অরিত্রকে কোনো কিছু করতে হচ্ছে না মানে দাদু বা জেঠুরা করতে দিচ্ছে না। কয়েকবার ও বলতে গিয়েছিল, তোমরা কেন সব ঝামেলা নিতে চাইছো? আমি তো আছি। দাদুদের আদরের বকুনি শুনে ওকে থেমে যেতে হয়েছে। দাদু পরিস্কার বলে দিয়েছে... তুই শুধু তোর অফিস কলিগ আর বন্ধুবান্ধবদের নেমত্তন্ন করবি আর বিয়ের দিন যা যা করার তাই করলেই আমি খুশী...বাকি আমরা বুঝে নেবো। খরচের ব্যাপারেও ওর কোনো কথা শুধু দাদু কেন, জেঠুরাও শুনতে রাজী নয়। আচ্ছা, আমাকে কিছু তো দিতে দাও বলে জেঠুর বকুনি শুনেছে...উঃ, দুষ্টু তুই চুপ করবি। এদিকে দাদু আর জেঠুরা আর ওদিকে মৌয়ের দাদু আর মামা, কে কোন খরচটা দেবেন নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন, ওর দাদু বিয়ের সমস্ত খরচ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু এদিকের দাদু বলেছেন যে না, ওটা চলবে না...মৌ আমাদের বাড়ীর বৌ হতে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার আগে ও আমাদেরও মেয়ে। তো মেয়ের বিয়ের খরচ আমরাও দেবো...দুই দাদুর সম্পর্কটা এখন এতটাই গভীর যে হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়ে ব্যাপারটা মিটে গেছে। কারুর কথায় কেউ নিজেকে ছোট করা হচ্ছে মনে করেন নি। মৌয়ের মামাবাড়ীর কথা ভেবে বিয়েটা হবে দূর্গাপুরে কারন ওনারা এই বিয়েটাকে মেয়ের ঘরের নাতনীর বিয়ে হিসেবে দেখছেন না, বাড়ীর মেয়ের বিয়েতে যেমন ভাবে আশেপাশের সবাইকে বলার তাই করতে চাইছেন। তারপরে ভাবার ছিল জেঠুদের কথা, ভবানীপুরের বাড়ীটা যেহেতু অরিত্রর নিজেরও তাই বিয়ের পরের দিন প্রথমে ওরা আসবে ওখানে। জ়েঠিমারা বৌ বরন করার পর কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে তারপর ওরা আসবে এই বাড়ীতে। এখানেও আবার এক প্রস্থ অনুষ্ঠান থাকছে যথারীতি। পরের দিনের বৌভাত হবে এখানেই আর তারপর একটা দিন বাদ দিয়ে কোলকাতার কোনো হোটেলে রাখা হবে রিশেপশান যাতে করে ওর অফিস কলিগ বা আরো যারা কোলকাতা থেকে কিছুটা দুরে বলে এখানে আসতে পারবে না তাদের সুবিধা হয়। এই পর্যন্ত বলে দিয়ে বড় জেঠু হাসতে হাসতে বলেছে...তারপর তোরা দুজনে হানিমুনে কোথায় আর কবে যাবি সেটা তোরা ঠিক করবি। রুপসা পাশেই ছিল...বাবার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল...না না...দাদাভাই কেন ঠিক করতে যাবে...তোমরাই তো বলেছিলে দাদাভাই শুধু বিয়েটা করবে আর বাকি সব ঠিক করে দেওয়া হবে...ইশ, আমি সেই কবে থেকে ভেবে রেখেছি দাদাভাইরা গোয়ায় হানিমুন সেরে ফেরার সময় আমাদের ওখানে সাতদিন থেকে তারপর ফিরবে...
অরিত্র এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল আর ভেতরে ভেতরে হাসি পেলেও হাসি চেপে রেখেছিল যাতে কেউ না খারাপ ভাবে। এতদিন যেখানেই কিছু দরকার হয়েছে ওকেই করতে হয়েছে দায়িত্ব নিয়ে আর নিজের বিয়েতে একেবারে প্রায় ঝাড়া হাত পা হয়ে যাওয়াটা বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও বেশ মজার লাগছিল। রুপসা হানিমুনের জায়গাটাও ঠিক করে ফেলেছে শুনে আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। ওকে হাসতে দেখে রুপসা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে একেবারে আস্তে করে বলল...এই দাদাভাই, আরো আছে...এখানে বলা যাবে না... বুঝলি? ও পরে বলবে বললেও কেউ যাতে না শুনতে পায় এমন ভাবে অরিত্র জিজ্ঞেস করেছে...কি ব্যাপারে? রুপসা এবারে আরো আস্তে করে বলেছে...হানিমুনে গিয়ে কি কি করবি ওটাও ভেবে রেখেছি...বুঝলি...
ওদের ভাইবোনকে গুজ গুজ করতে দেখে জেঠু বলেছে...এই তোরা পরে তোদের গোপন আলোচনা করলেও হবে ...শোন এদিকের আরো কিছু বলতে বাকি আছে। রুপসা বাবার দিকে তাকিয়ে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল...বাপি, তুমি না বড্ড বেরসিক, সব জায়গাতেই তোমার কর্পোরেট কালচার ইম্পলিমেন্ট করতে চাও। বড় জেঠু মেয়ের ভ্যঙ্গানোতে হেসে ফেলে বলল...ফাজিল মেয়ে কোথাকার...তুই কি কোনোদিন ও একটু সিরিয়াস হতে পারবি না...
- আচ্ছা বাবা...এই হলাম সিরিয়াস...বলো কি বলবে...এই দাদাভাই, মন দিয়ে শুনবি কিন্তু...বিয়েটা তোর...আমার নয়...বুঝলি?
রুপসার কথাবার্তা শুনে আবার এক প্রস্থ হাসাহাসির পর জেঠু বলল...শোন, এখানে বৌভাতের সব দায়িত্ব শুভর। রিশেপশানের দায়িত্ব শুভ্রর আর বিয়েটা আমরা দিয়ে দেবো একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের হাতে...ওরা খুব ভালো কাজ করে শুনেছি। ওখানে শুভ আর শুভ্র দুজনে ওভার অল দেখাশোনা করবে আর তোদের মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার দেখবে রুপসা একাই...
রুপসা শুনেই এক প্রস্থ হৈচৈ করে বলল...ইশ, আমি একা কেন...বড়দি ছোড়দি ওরা সব সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে নাকি? পুবালী এতক্ষন চুপ করে শুনছিল...বোনকে চেঁচামেচি করতে দেখে বলল...আরে শোন, আমরা দুজনে তোকে হেল্প করবো...চিন্তা করিস না...
সবকিছু ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে গেলে পর মামারা ফিরে গেলেও দাদু ফিরতে পারেনি। মৌ বায়না করে বলেছে দাদু...ও দাদু, আর কটা দিন থেকে যাও না। কি করবে ওখানে গিয়ে। আরে তোর বিয়ের জোগাড় যন্ত্র করতে হবে যে বলাতে মৌ দাদুর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছে...ও ঠিক হয়ে যাবে, মামা আছে তো...তুমি থাকো এখানে। আর কিছু করার ছিল না দাদুর, নাতনির বায়না রাখতেই হয়েছে। সময় কাটাবার কোনো অসুবিধাই নেই এই বাড়ীতে। দুই দাদুর সারাদিন কেটে যায় দাবার বোর্ডে চাল দিতে দিতে গল্প গুজবে। মোক্ষম একটা চাল চেলে এদিকের দাদু বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার নাতনীর খুব দেমাক হয়েছে। ওদিকের দাদু নাতনীর দেমাক হয়েছে শুনে দাবার চাল দিতে ভুলে গিয়ে একটু ভয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে? মেয়ের তরফের দাদু, একটু ভয় তো হবেই। এদিকের দাদু একটু গম্ভীর হয়ে বলল...আরে মশাই...ওই টুকু পুঁচকে মেয়ে...সাত চড়ে রা বেরোয় না আর বলে কিনা তোমার নাতি তো আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে... আমি বেঁচে থাকতে কিনা আমার নাতবৌ ডাল ভাত খেয়ে থাকবে... বুঝলেন কিছু?
মুখুজ্জে মশাইয়ের এতক্ষনে ধড়ে প্রান ফিরে এসেছে, হেসে ফেলে বললেন... তা কি নিয়ে মেয়ের এত দেমাক দেখাতে হল?
- আর বলবেন না, আমি শুধু বলেছিলাম...তোর দিদান গয়নাগুলো দিতে চাইছে তো নিবি না কেন... সোনা দানা তো মানুষ ভবিষ্যতের জন্য ভেবেও রাখে নাকি? তার উত্তরে বলে কিনা, কি হবে আমার এত গয়না...তোমার নাতি আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে...উঃ, কি দেমাক...আরে বাবা, পেলি কোথায় আমার নাতিটাকে... কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলাম বলেই না...
মুখুজ্জে মশাই আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বললেন...ঠিক বলেছেন মশাই, এত দেমাক ভালো নয়। আসলে আজকালকার ছেলে মেয়ে তো...বুঝতেই পারছেন...
মৌ দাদুদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছিল, ট্রে টা টেবিলের এক পাশে রেখে টিপট থেকে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল... কি হয়েছে দাদু?
ও মুখ নীচু করে থাকায় দেখতে পেলো না যে দুই দাদুর ইশারায় কিছু কথা হয়ে গেছে, তারপরেই দাদু বললেন...আমি তোর দাদুকে তোর ওই ডাল ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা বলছিলাম আর কি...আমাদের অনেক পয়সা বেঁচে যাবে তো...
মৌ চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল... বুঝেছি, তুমি নালিশ করছিলে...
দাদু ওকে মুখ ভার করে কথাটা বলতে দেখে ওর হাত ধরে কাছে বসিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার এই নাতনিটি একটু অভিমানী। আসলে কি জানেন...আমরা একটু বেশী ভালোবাসি তো... তাই মেয়ের আমার এত অভিমান...
দাদু মজা করছে বুঝতে পেরে মৌ আদুরে গলায় বলেছে...ইস, আমি অভিমানী? যাও তোমার সাথে আমি কথা বলবো না...
দাদুও সাথে সাথে বলেছে...ইশ, কথা বলবো না বললে আমি শুনছি না..সেদিন যে বললাম আমি তোর বুড়ো বর...গা হাত পা টিপে দিবি...আমার বুড়ি তো আর পারে না আজকাল...
মৌ আর থাকতে না পেরে উঠে যেতে যেতে বলল...ধ্যাত, তোমাকে আমার বিয়ে করতে বয়েই গেছে...দিদানকে গিয়ে বলছি দাঁড়াও...তোমাকে আচ্ছা করে দেবে...
ওদের দাদু নাতনির খুনসুটি দেখতে দেখতে ওদিকের দাদুর চোখে জল এসে গেছে...মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে এত গুলো বছর কিন্তু এখানে যে ও সুখে থাকবে সেটা বারে বারে বুঝতে পেরে দাদু ধুতির কোন দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলেও মৌ বা এদিকের দাদু কিন্তু একেবারেই খেয়াল করতে পারেনি মানুষটা আনন্দে চোখের জল ফেলছে...
এদিকে বিয়ের নানান কাজের সাথে সাথে আরো একটা গুরুত্বপুর্ন কাজ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপার রয়েছে। মৌয়ের ইচ্ছে বিয়ের আগেই ও বাড়ীর ভাগ, টাকাপয়সার ব্যাপারে যা যা করার করে ফেলবে কিন্তু তার জন্য একবার হলেও ওকে বাড়ী যেতে হবে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। না গেলেও চলতো কিন্তু কাজটা করতে গেলে বাবার ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর ওর ব্যাঙ্কের কাগজপত্র যা আছে সেগুলো লাগবে। কাজটা ভাবতে যত সোজ়া, কাজে মোটেও ততটা সোজ়া নয়। এখন ও আর সেই বাধ্য হয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করার জায়গায় নেই, এদিকের সবাই ছাড়াও নিজের ভাই বোন ওর পাশে আছে, তবুও কিছুটা হলেও চিন্তা আছে ঠিক কি দাঁড়াবে ব্যাপারটা, মাকে কি আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে যে ও যাচ্ছে নাকি বিল্টুদের কাছ থেকে মা কবে থাকবে জেনে নিয়ে কিছু না বলেই চলে যাবে সেটা ঠিক করা যাচ্ছিল না। সে যাই হোক একটা ভেবে ঠিক করা যাবে, এখন যেটা করার দরকার সেটাই করা হোক ভেবে একজন ভালো লইয়ার ঠিক করা হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় জানা গেল উনি এক সময়ে দাদুর ছাত্র ছিলেন। পরিচয় পাওয়ার পর উনি খুব মন দিয়ে সমস্ত ঘটনা আর কি করতে চাওয়া হচ্ছে শুনে বললেন চিন্তা করার কারন নেই, উনি যতটা সহজে কাজটা করা যায় করে দেবেন, তেমন হলে মৌকে যেতেও হবে না...রেজিস্টারকে বাড়ীতে এনেও কাজটা করা সম্ভব।
সবার সাথে আলোচনা করে মৌয়ের মতামত নিয়ে ঠিক করা হয়েছে আগে থেকে খবর না দিয়েই যাওয়াই ভালো। সেই মতো বিল্টুর কাছ থেকে খবর নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে যাওয়া হবে ঠিক করা আছে। যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে যাবার পর থেকেই মৌকে মাঝে মাঝে কিছুটা অন্যমনস্ক হতে দেখা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে...’কই কিছু না তো’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেস্টা করেছে। হয়তো ও এখোনো কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে ভেবে ওকে বোঝানো হয়েছে যাতে ওখানে গিয়ে আবার ভেঙ্গে না পড়ে কারন ওর উপরেই অনেকটা নির্ভর করছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সবার সামনে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বললেও পরে অরিত্রকে একা পেয়ে চুপি চুপি বলেছে... মায়ের সাথে যদি ঝগড়া করার দরকার হয় তাই রিহার্সাল দিচ্ছিলাম...বুঝেছো। অরিত্র ওর ঝগড়া করার কথা শুনে কিছুক্ষন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে হাসি মুখে বলেছে... বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? অরিত্র আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল...তুমি করবে ঝগড়া আর আমাকে তাই বিশ্বাস করতে হবে? এ তো সেই সোনার পাথর বাটির মতো কিছু একটা হবে। মৌ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করতে হবে না... আমি না হয় ওখানে গিয়ে কিছু করলাম না কিন্তু তোমার সাথে তো ভবিষ্যতে একটু আধটু করতে হবে আর তার জন্যও তো এখন থেকে শিখতে হবে...নাকি। অরিত্র এবারে আর না হেসে পারলো না ওর কথা বলার ভঙ্গীতে...কোনো রকমে হাসি চাপতে চাপতে বলল...বুঝলাম, কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করতে এলে কি হবে জানা আছে তো? অরিত্র ওকে কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে মৌ কাছে এসে আস্তে করে বলল...বয়ে গেছে আমার... পাজি কোথাকার...
সব কিছুই প্ল্যান মতো এগোচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে পাওয়া একটা খবর পুরো ব্যাপারটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বিশ্বাস কাকু অনেক দিন ধরেই চেস্টা করছিলেন ভেতরের কিছু খবর জোগাড় করার জন্য কিন্তু হঠাৎ করে যে এরকম একটা খবর পাওয়া যাবে নিজেই হয়তো জানতেন না। মৌয়ের বাবার মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়নি, ওটা করানো হয়েছিল এবং সেটাও আবার বাইরের কারুর করানো নয়। এতবড় একটা মর্মান্তিক খবর কিভাবে মৌকে জানানো হবে বা আদৌ এখন জানানো হবে কিনা সেই নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনার পর ঠিক করা হয়েছে না জানানোই ভালো এই মুহুর্তে, আবার একটা শক পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আর কিছু করার থাকবে না হয়তো। এত সমস্যার পর সবকিছু একটু একটু করে পরিনতির দিকে এগোচ্ছে, কেউই চাইছিল না নতুন করে আবার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে। ওকে এই মুহুর্তে জানানো হবে না ঠিক করলেও অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল এই ভেবে যে পরে যদি ও জানতে পারে যে সব কিছু জেনেও ওকে জানানো হয়নি তাহলে খারাপ ভাবে নিতে পারে, যতই হোক ও বাবাকে এখোনো ভীষন ভাবে মিস করে। এই মুহুর্তে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে তাই আর ওটা নিয়ে নিজের মনে যাই থাকুক না কেন সেটাকে চেপে রাখতে হয়েছে যাতে মৌ ওকে দেখে কিছু বুঝতে না পারে কারন ও যদি নিজের থেকে এসে জিজ্ঞেস করে তাহলে ওকে ভুল বোঝানো যাবে না, তাতে সারা জীবনের মতো একটা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়ে যেতে পারে।
একই বাড়ীতে ওরা থাকলেও বিয়ের যা কিছু নিয়ম আছে সব একেবারে ঠিকঠাক ভাবে করতে হবেই এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সামনের বৃহস্পতিবার ভালো দিন আছে, একই দিনে ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই আশীর্বাদ করা হবে ভবানীপুরের বাড়ীতে। অরিত্রর জন্য আসছেন মৌয়ের মামা আর মেয়েকে আশীর্বাদ করার জন্য তো লোকের অভাব নেই। তার আগে মৌকে সাথে নিয়ে গিয়ে তানিস্কের শোরুম থেকে একটা হীরের আংটি পছন্দ করে এসেছে অরিত্র। যথারীতি মৌ এত দামের আংটি নিতে রাজী হচ্ছিল না প্রথমে। পুবালী হেসে ফেলে বলেছে, তুই কি বোকা রে মৌ? আমি হলে তো বলতাম...আরো বেশী দামের কিছু থাকলে দেখাতে। মৌ দিদির কানে কানে বলেছে, কি হবে আমার এত দামের আংটি। পুবালী প্রথমে বুঝতে পারেনি ও কি বলতে চেয়েছে, তারপরেই বুঝতে পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছে... সে তো জানি, তোর সব থেকে দামী জিনিষটা কি। অরিত্র ওদিকে কাউন্টারে পেমেন্টের জন্য গেছে, মৌ পুবালীর কাছে সরে গিয়ে আস্তে করে বলল...মেজদি, আমাকেও তো তোমার ভাইকে কিছু দিতে হবে...কি দিই বলো না। তারপর দুজনে মিলে রুপসাকে ফোন করে ঠিক করেছে কি করবে কিন্তু সেটা কিছুতেই অরিত্র যেন না জানতে পারে এমন ভাবে করেছে ওরা। ফেরার সময়ে ওদের দুজনকে চুপি চুপি কথা বলতে দেখে অরিত্র একবার জিজ্ঞেস করেছে... কি ব্যাপার রে দিদিভাই...কি এত তোদের গোপন আলোচনা চলছে? পুবালী খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করে ভাইকে বলেছে...মেয়েদের কত কথা থাকে...ও তুই বুঝবি না...
আশীর্বাদের দিন ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে একসাথে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। এক এক করে বড়দের সবাইয়ের আশীর্বাদ করা হয়ে গেলে অরিত্র মৌয়ের আঙ্গুলে হীরের আংটিটা পরিয়ে দিলে জেঠিমা মজা করে জেঠুকে বলল...দেখেছো, আমাদের দুষ্টু কত সুন্দর একটা আংটি দিয়েছে...তুমি তো আমাকে কি একটা দিয়েছিলে কে জানে। জেঠু হেসে ফেলে বলল...আমি তো আর ওর মতো এত মাইনে পেতাম না তখন যে তোমাকে হীরের আংটি দেবো। দাদু হেসে ফেলে বলল...শুধু হীরের আংটি দিলেই হবে না বাবা, আমি লিস্ট বানিয়ে রেখেছি আরো কি কি করতে হবে।
সব কিছু মিটে গেলে দাদু মৌকে পাশে বসিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল...নে পড়ে শোনা তো দেখি বুদ্ধুটাকে কি কি করতে হবে বিয়ে করতে গেলে। মৌ কাগজটা দেখেই মুখ কাঁচুমাচু করে বলল...আমি কেন দাদু...
- আরে আমি কেন মানে? তুই এখন আমার নাতনী...আর ও ব্যাটা এখন এই বাড়ীর ছেলে, আমার কেউ নয় কিছুক্ষনের জন্য। সব কটা নিয়ম মেনে যদি চলবে কথা দেয় তবেই বিয়ে হবে আর যদি বলে মানবো না তো আমি তোর অন্য জায়গায় বিয়ে দেব...তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমার হাতে অনেক ভালো ভালো ছেলে আছে...বুঝলি...
দাদুর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা। মোটামুটি সবাই দাদুকে একটু গম্ভীর দেখেছে এতদিন কিন্তু সেই মানুষটা যে এত মজা করতে পারে কারুরই প্রায় জানা ছিল না। জেঠু হাসতে হাসতে বলল...এই দুষ্টু, ভয় করিস না, আমি তোর পাশে আছি। বুক চাপড়ে বলে দে...হ্যাঁ বলো কি কি নিয়ম আছে...
মৌ কিছুতেই পড়বে না কি লেখা আছে, শেষে দাদু নিজেই পড়তে শুরু করল...
১) এখন থেকে গাড়ী নিয়ে অফিস যাওয়া আসা করতে হবে। নিজে ড্রাইভ করাতে আপত্তি থাকলে ড্রাইভার রাখতে হবে।
২) দেরী করে অফিস থেকে ফেরা যাবে না। দরকার হলে বাড়ীতে বসে কাজ করতে হবে। অনেক অফিসেই এখন এই নিয়ম চালু হয়ে গেছে, এতএব এই ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা হবে না।
৩) শনিবার কোনো অবস্থাতেই অফিস আছে বলা যাবে না। এক্ষেত্রেও পয়েন্ট নাম্বার ২ প্রযোজ্য হতে পারে যদি মৌ অনুমতি দেয়।
৪) মাসে অন্তত একবার সস্ত্রীক ভবানীপুরের বাড়ীতে এসে দুদিন থাকতেই হবে। জেঠুরা চাইলে দিনের সংখা বাড়তে পারে। শুধু ভবানীপুর এলেই হবে না, ওদিকে বড় জেঠুদের কথাও খেয়াল রেখে বছরে অন্তত একবার যেতে হবে। এছাড়াও বাকি আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে সময় সুযোগ করে যাওয়া আসার ব্যাপারটা থাছে।
৫) বছরে দুটো বড় বা একটা বড় ও একটা ছোট বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম রাখতেই হবে এবং সেটা আমাদের সাথে অবশ্যই নয়। আমাদের সাথে যেতে চাইলে এর বাইরে যাওয়া যেতে পারে।
৬) আগামী অন্তত চার বছর একেবারে ঝাড়া হাত পা থাকতেই হবে। মৌ সংসার করার সব কিছু শিখে গেলে তবেই বাচ্চাকাচ্চা নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে।
৭) এখন থেকে দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে থাকতে গেলে একা একা যাওয়া চলবে না।
সব কটা নিয়ম পড়া হয়ে গেলে দাদু মুখ তুলে সবার মুখে হাসি দেখে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল...বল, কি করবি...
অরিত্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে হাসি মুখে বলল...ধরো আমি এখন হ্যাঁ বলে দিলাম আর পরে মানলাম না...তাহলে কি হবে...
দাদু এবারে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি রে...কি হবে? মৌ মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল...আমি কি জানি...তোমার নাতি, তুমি বুঝবে...
দাদু হাসতে হাসতে বলল...সে কি রে...আমি তো তোর জন্যই এত কিছু ভাবছি আর তুই আমার কোর্টেই বল ফেলে দিলি...যাকগে, শোন...এগুলো আমি মোটেও মজা করার জন্য ভাবিনি...চাইলে সবকটা নিয়মই মেনে চলা যায় বুঝলি...
দিদান এতক্ষন কিছু বলেনি, চুপচাপ বসে দাদুর কথা শুনছিল। দাদুর কথা শেষ হতেই বলল...এ তো দেখছি এক তরফা হয়ে গেল। আমারও কিছু বক্তব্য আছে...এক এক করে বলছি, শোনো...
১) সারাদিন যখন তখন তুমি মৌ কোথায় গেল বলে হাঁক ডাক করতে পারবে না।
২) আমাদের লুকিয়ে মৌকে চুপিচুপি বলা যাবে না চা খাওয়াতে।
৩) আমরা ওষুধ দিলেও খেয়ে নিতে হবে চুপচাপ।
দিদানের কথা শেষ হলে দাদু বেশ গম্ভীরভাবে... ‘হুম, বুঝেছি... তুমি আজকাল খুব হিংসে করছো আমাকে’...বললে, সবাইয়ের হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর ঠিক হয়েছে দু পক্ষই সব কিছু মেনে নিচ্ছে।
মৌয়ের বাবার ব্যাপারে ওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলেও অরিত্র মনের ভেতরের খচখচানিটা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে ও একা একাই ঠিক করে ফেলেছে সবকিছু জানিয়ে দেবে ওকে, যদিও ঠিক কি ভাবে বললে ঠিক হবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। কয়েকদিন ধরে ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখে দিদান দু একবার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও অফিসের কিছু কাজের কথা ভাবছে বলে ও এড়িয়ে গেছে। দিদান এমনিতেই খুব ব্যাস্ত থাকায় আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে পারেনি বা পরে একা ওর সাথে কথা বলবে ভেবেও ভুলে গেছে।
আজকাল অরিত্রকে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে আসতে হচ্ছে তার উপরে মাঝে মাঝে ছুটি নিতে হচ্ছে বলে রাতের দিকে বাড়ীতে বসে অফিসের কিছুটা কাজকর্ম করতে হচ্ছিল। সেদিন ও রাতে একা একা কাজ করছে, রাত প্রায় সাড়ে বারোটা পৌনে একটা মতো বাজে। একটানা কাজ করতে করতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ও চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। অবশ্য শুধু হয়তো বিশ্রাম নেওয়া নয়, সাথে সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছিল। কি করবো ভাবতে ভাবতে তো একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে... আর দেরী করা যাবেই না, যেভাবেই হোক ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবার আগেই জানানোটা দরকার...কিন্তু কি ভাবে?
চোখ বুজে থেকে ভাবতে ভাবতে খুব পরিচিত হালকা কিন্তু মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলে চোখ না খুলেই বুঝে গেল কে এসেছে। যাই থাকুক না কেন মনের ভেতরে, ও এসেছে বুঝতে পেরে ভালো লাগার অনুভুতিতে মনটা ভরে উঠলো। শুধু ভালো লাগা নয়, সাথে সাথে ওকে বলতে পারার সুযোগটা অযাচিত ভাবে এসে যাওয়ায় সাথে সাথেই মনস্থির করে নিল কি করবে। ও যে বুঝতে পেরেছে মৌ এসেছে সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে আরো কিছুক্ষন চোখ বুজে চুপ করে বসে থেকে হয়তো দেখতে চাইছিল ও কি করে। ভালো করেই জানে ও এসেছে যখন কথা না বলে ফিরে যাবেই না। অরিত্র ওকে আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না ভেবে চোখ না খুলেই বলল...ঘুমোওনি? ও কিভাবে বুঝলো যে আমি এসেছি ভাবতে ভাবতে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মৌ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও যে নিঃশব্দে আরো কাছে সরে এসেছে বুঝে গিয়ে অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলে ও আস্তে করে বলল...কি করে বুঝলে আমি এসেছি? প্রশ্নটা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলে মৌ ওর কপালে হাত রেখে আস্তে করে বলল...একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তারপরেই ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল...তোমার কি হয়েছে আমাকেও বলতে পারবে না?
- হু, কি হয়েছে তাতে?
তাহলে তুমি আগে কেন আসোনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করাতে ও দুহাতে ওর মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে তো বলেছি, কেন আসতে পারতাম না। অরিত্র ওর চোখে কষ্ট পাওয়ার আভাস দেখে ওকে বুকে চেপে ধরে নিয়ে বলল... আমরা দুজনেই অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি...তাই না...আমিও তো তোমাকে কিছু বলতে পারিনি...
ওরা ফিরে আসার পর আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে। ওদিক থেকে মৌয়ের দাদু আর মামা এলে তারপর সবাই মিলে বসে সব কিছু ঠিক করার কথা, তাই যেগুলো নিজেরা শুরু করতে পারবে সেগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করা হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য গয়না বানানোর একটা বড় কাজ তো আছেই দেখে এর ভেতরে একদিন দিদান ব্যাঙ্কের লকারে যত গয়না ছিল সব নিয়ে এসেছে। নিজের তো ছিলই তার উপরে মেয়ের সমস্ত গয়না অরিত্রর ছোটো জেঠিমা কয়েক বছর আগে নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছিল। দিদান মৌকে ডেকে সব এক এক করে দেখাতে দেখাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ও একটা একটা করে দেখেছে আর বলেছে ‘এটা বড্ড পুরোনো পুরোনো’ বা ‘আরে এই হারটা কি সুন্দর। কোনটা কোনটা দিদানরা কোন দিন পরবে তাই বলে গেছে এক এক করে। দিদান তখন কিছু বলেনি ওকে কিন্তু সব দেখা হয়ে গেলে যেই বলেছে...এই মেয়ে শোন, এখন থেকে এগুলো সব তোর ওমনি মৌ চোখ বড় বড় করে দিদানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছে না না, আমাকে কেন সব দেবে?
- তোকে দেবোনা তো কাকে দেবো শুনি?
- সে আমি কি জানি...
- ও মা...মেয়ের কথা শোনো...সে আমি কি জানি বললে হবে? তোকেই সব নিতে হবে...বুঝলি?
- ও দিদান কি শুরু করেছো বলোতো? আমাকে কি গয়না দিয়ে মুড়ে রাখবে নাকি?
- হ্যাঁ তাই রাখবো...শোন, পরশু আমরা বৌবাজার যাচ্ছি, মাপ দিতে হবে, ডিজাইন পছন্দ করতে হবে...অনেক কাজ আছে...তুই এক কাজ কর না মা...তোর জেঠিমা আর দিদিকে ফোন করে বল আসতে...ওরা না এলে তো হবে না...আমি কি আর এখন কি চলছে বুঝবো?
তখনকার মতো দিদানকে বোঝাতে না পেরে চুপ করে গেলেও রাতে অরিত্র ফিরে আসার পর ও গেছে অরিত্রর কাছে। অরিত্র সব শুনেও কিছু না বলে মুখ টিপে হাসছে দেখে ও হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল...এই চলো না, দিদানকে বোঝাবে। কেন তোমার গয়না ভালো লাগে না নাকি জিজ্ঞেস করাতে বলল... ভালো লাগবে না কেন...তাই বলে এতো? আমি কি পুতুল নাকি যে তোমরা সাজিয়ে রাখবে আমাকে।
অরিত্র হেসে ফেলে বলল...তুমি দিদানদের কতোটা আদরের জানোই তো...
- সে তো জানি...তাই বলে সব কেন দেবে?
- আচ্ছা দিতে চাইছে দিক না...জানোই তো মা বাবা নেই বলে কিভাবে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে আমাকে। মা বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি কখোনো...তাছাড়া, কাল রাতে দেখলাম, মায়ের ফটোটা বুকে চেপে নিয়ে কাঁদছে...সত্যিই তো আজ মা থাকলে কি খুশী হোতো... সেটাই হয়তো মেটাবার চেস্টা করছে...
ওকে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যেতে দেখে মৌ আর কিছু বলতে পারলো না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...আচ্ছা...
কথাবার্তা বলার জন্য মৌয়ের মামারা যেমন চলে এসেছে, তেমনি ওদিক থেকে বড় জ়েঠুও কোলকাতা চলে এসেছে। একেবারে সব কিছু ঠিক করে তারপরে ফিরবে। বিয়ের কোনো ব্যাপারেই অরিত্রকে কোনো কিছু করতে হচ্ছে না মানে দাদু বা জেঠুরা করতে দিচ্ছে না। কয়েকবার ও বলতে গিয়েছিল, তোমরা কেন সব ঝামেলা নিতে চাইছো? আমি তো আছি। দাদুদের আদরের বকুনি শুনে ওকে থেমে যেতে হয়েছে। দাদু পরিস্কার বলে দিয়েছে... তুই শুধু তোর অফিস কলিগ আর বন্ধুবান্ধবদের নেমত্তন্ন করবি আর বিয়ের দিন যা যা করার তাই করলেই আমি খুশী...বাকি আমরা বুঝে নেবো। খরচের ব্যাপারেও ওর কোনো কথা শুধু দাদু কেন, জেঠুরাও শুনতে রাজী নয়। আচ্ছা, আমাকে কিছু তো দিতে দাও বলে জেঠুর বকুনি শুনেছে...উঃ, দুষ্টু তুই চুপ করবি। এদিকে দাদু আর জেঠুরা আর ওদিকে মৌয়ের দাদু আর মামা, কে কোন খরচটা দেবেন নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন, ওর দাদু বিয়ের সমস্ত খরচ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু এদিকের দাদু বলেছেন যে না, ওটা চলবে না...মৌ আমাদের বাড়ীর বৌ হতে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার আগে ও আমাদেরও মেয়ে। তো মেয়ের বিয়ের খরচ আমরাও দেবো...দুই দাদুর সম্পর্কটা এখন এতটাই গভীর যে হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়ে ব্যাপারটা মিটে গেছে। কারুর কথায় কেউ নিজেকে ছোট করা হচ্ছে মনে করেন নি। মৌয়ের মামাবাড়ীর কথা ভেবে বিয়েটা হবে দূর্গাপুরে কারন ওনারা এই বিয়েটাকে মেয়ের ঘরের নাতনীর বিয়ে হিসেবে দেখছেন না, বাড়ীর মেয়ের বিয়েতে যেমন ভাবে আশেপাশের সবাইকে বলার তাই করতে চাইছেন। তারপরে ভাবার ছিল জেঠুদের কথা, ভবানীপুরের বাড়ীটা যেহেতু অরিত্রর নিজেরও তাই বিয়ের পরের দিন প্রথমে ওরা আসবে ওখানে। জ়েঠিমারা বৌ বরন করার পর কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে তারপর ওরা আসবে এই বাড়ীতে। এখানেও আবার এক প্রস্থ অনুষ্ঠান থাকছে যথারীতি। পরের দিনের বৌভাত হবে এখানেই আর তারপর একটা দিন বাদ দিয়ে কোলকাতার কোনো হোটেলে রাখা হবে রিশেপশান যাতে করে ওর অফিস কলিগ বা আরো যারা কোলকাতা থেকে কিছুটা দুরে বলে এখানে আসতে পারবে না তাদের সুবিধা হয়। এই পর্যন্ত বলে দিয়ে বড় জেঠু হাসতে হাসতে বলেছে...তারপর তোরা দুজনে হানিমুনে কোথায় আর কবে যাবি সেটা তোরা ঠিক করবি। রুপসা পাশেই ছিল...বাবার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল...না না...দাদাভাই কেন ঠিক করতে যাবে...তোমরাই তো বলেছিলে দাদাভাই শুধু বিয়েটা করবে আর বাকি সব ঠিক করে দেওয়া হবে...ইশ, আমি সেই কবে থেকে ভেবে রেখেছি দাদাভাইরা গোয়ায় হানিমুন সেরে ফেরার সময় আমাদের ওখানে সাতদিন থেকে তারপর ফিরবে...
অরিত্র এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল আর ভেতরে ভেতরে হাসি পেলেও হাসি চেপে রেখেছিল যাতে কেউ না খারাপ ভাবে। এতদিন যেখানেই কিছু দরকার হয়েছে ওকেই করতে হয়েছে দায়িত্ব নিয়ে আর নিজের বিয়েতে একেবারে প্রায় ঝাড়া হাত পা হয়ে যাওয়াটা বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও বেশ মজার লাগছিল। রুপসা হানিমুনের জায়গাটাও ঠিক করে ফেলেছে শুনে আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। ওকে হাসতে দেখে রুপসা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে একেবারে আস্তে করে বলল...এই দাদাভাই, আরো আছে...এখানে বলা যাবে না... বুঝলি? ও পরে বলবে বললেও কেউ যাতে না শুনতে পায় এমন ভাবে অরিত্র জিজ্ঞেস করেছে...কি ব্যাপারে? রুপসা এবারে আরো আস্তে করে বলেছে...হানিমুনে গিয়ে কি কি করবি ওটাও ভেবে রেখেছি...বুঝলি...
ওদের ভাইবোনকে গুজ গুজ করতে দেখে জেঠু বলেছে...এই তোরা পরে তোদের গোপন আলোচনা করলেও হবে ...শোন এদিকের আরো কিছু বলতে বাকি আছে। রুপসা বাবার দিকে তাকিয়ে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল...বাপি, তুমি না বড্ড বেরসিক, সব জায়গাতেই তোমার কর্পোরেট কালচার ইম্পলিমেন্ট করতে চাও। বড় জেঠু মেয়ের ভ্যঙ্গানোতে হেসে ফেলে বলল...ফাজিল মেয়ে কোথাকার...তুই কি কোনোদিন ও একটু সিরিয়াস হতে পারবি না...
- আচ্ছা বাবা...এই হলাম সিরিয়াস...বলো কি বলবে...এই দাদাভাই, মন দিয়ে শুনবি কিন্তু...বিয়েটা তোর...আমার নয়...বুঝলি?
রুপসার কথাবার্তা শুনে আবার এক প্রস্থ হাসাহাসির পর জেঠু বলল...শোন, এখানে বৌভাতের সব দায়িত্ব শুভর। রিশেপশানের দায়িত্ব শুভ্রর আর বিয়েটা আমরা দিয়ে দেবো একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের হাতে...ওরা খুব ভালো কাজ করে শুনেছি। ওখানে শুভ আর শুভ্র দুজনে ওভার অল দেখাশোনা করবে আর তোদের মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার দেখবে রুপসা একাই...
রুপসা শুনেই এক প্রস্থ হৈচৈ করে বলল...ইশ, আমি একা কেন...বড়দি ছোড়দি ওরা সব সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে নাকি? পুবালী এতক্ষন চুপ করে শুনছিল...বোনকে চেঁচামেচি করতে দেখে বলল...আরে শোন, আমরা দুজনে তোকে হেল্প করবো...চিন্তা করিস না...
সবকিছু ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে গেলে পর মামারা ফিরে গেলেও দাদু ফিরতে পারেনি। মৌ বায়না করে বলেছে দাদু...ও দাদু, আর কটা দিন থেকে যাও না। কি করবে ওখানে গিয়ে। আরে তোর বিয়ের জোগাড় যন্ত্র করতে হবে যে বলাতে মৌ দাদুর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছে...ও ঠিক হয়ে যাবে, মামা আছে তো...তুমি থাকো এখানে। আর কিছু করার ছিল না দাদুর, নাতনির বায়না রাখতেই হয়েছে। সময় কাটাবার কোনো অসুবিধাই নেই এই বাড়ীতে। দুই দাদুর সারাদিন কেটে যায় দাবার বোর্ডে চাল দিতে দিতে গল্প গুজবে। মোক্ষম একটা চাল চেলে এদিকের দাদু বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার নাতনীর খুব দেমাক হয়েছে। ওদিকের দাদু নাতনীর দেমাক হয়েছে শুনে দাবার চাল দিতে ভুলে গিয়ে একটু ভয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে? মেয়ের তরফের দাদু, একটু ভয় তো হবেই। এদিকের দাদু একটু গম্ভীর হয়ে বলল...আরে মশাই...ওই টুকু পুঁচকে মেয়ে...সাত চড়ে রা বেরোয় না আর বলে কিনা তোমার নাতি তো আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে... আমি বেঁচে থাকতে কিনা আমার নাতবৌ ডাল ভাত খেয়ে থাকবে... বুঝলেন কিছু?
মুখুজ্জে মশাইয়ের এতক্ষনে ধড়ে প্রান ফিরে এসেছে, হেসে ফেলে বললেন... তা কি নিয়ে মেয়ের এত দেমাক দেখাতে হল?
- আর বলবেন না, আমি শুধু বলেছিলাম...তোর দিদান গয়নাগুলো দিতে চাইছে তো নিবি না কেন... সোনা দানা তো মানুষ ভবিষ্যতের জন্য ভেবেও রাখে নাকি? তার উত্তরে বলে কিনা, কি হবে আমার এত গয়না...তোমার নাতি আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে...উঃ, কি দেমাক...আরে বাবা, পেলি কোথায় আমার নাতিটাকে... কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলাম বলেই না...
মুখুজ্জে মশাই আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বললেন...ঠিক বলেছেন মশাই, এত দেমাক ভালো নয়। আসলে আজকালকার ছেলে মেয়ে তো...বুঝতেই পারছেন...
মৌ দাদুদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছিল, ট্রে টা টেবিলের এক পাশে রেখে টিপট থেকে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল... কি হয়েছে দাদু?
ও মুখ নীচু করে থাকায় দেখতে পেলো না যে দুই দাদুর ইশারায় কিছু কথা হয়ে গেছে, তারপরেই দাদু বললেন...আমি তোর দাদুকে তোর ওই ডাল ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা বলছিলাম আর কি...আমাদের অনেক পয়সা বেঁচে যাবে তো...
মৌ চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল... বুঝেছি, তুমি নালিশ করছিলে...
দাদু ওকে মুখ ভার করে কথাটা বলতে দেখে ওর হাত ধরে কাছে বসিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার এই নাতনিটি একটু অভিমানী। আসলে কি জানেন...আমরা একটু বেশী ভালোবাসি তো... তাই মেয়ের আমার এত অভিমান...
দাদু মজা করছে বুঝতে পেরে মৌ আদুরে গলায় বলেছে...ইস, আমি অভিমানী? যাও তোমার সাথে আমি কথা বলবো না...
দাদুও সাথে সাথে বলেছে...ইশ, কথা বলবো না বললে আমি শুনছি না..সেদিন যে বললাম আমি তোর বুড়ো বর...গা হাত পা টিপে দিবি...আমার বুড়ি তো আর পারে না আজকাল...
মৌ আর থাকতে না পেরে উঠে যেতে যেতে বলল...ধ্যাত, তোমাকে আমার বিয়ে করতে বয়েই গেছে...দিদানকে গিয়ে বলছি দাঁড়াও...তোমাকে আচ্ছা করে দেবে...
ওদের দাদু নাতনির খুনসুটি দেখতে দেখতে ওদিকের দাদুর চোখে জল এসে গেছে...মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে এত গুলো বছর কিন্তু এখানে যে ও সুখে থাকবে সেটা বারে বারে বুঝতে পেরে দাদু ধুতির কোন দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলেও মৌ বা এদিকের দাদু কিন্তু একেবারেই খেয়াল করতে পারেনি মানুষটা আনন্দে চোখের জল ফেলছে...
এদিকে বিয়ের নানান কাজের সাথে সাথে আরো একটা গুরুত্বপুর্ন কাজ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপার রয়েছে। মৌয়ের ইচ্ছে বিয়ের আগেই ও বাড়ীর ভাগ, টাকাপয়সার ব্যাপারে যা যা করার করে ফেলবে কিন্তু তার জন্য একবার হলেও ওকে বাড়ী যেতে হবে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। না গেলেও চলতো কিন্তু কাজটা করতে গেলে বাবার ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর ওর ব্যাঙ্কের কাগজপত্র যা আছে সেগুলো লাগবে। কাজটা ভাবতে যত সোজ়া, কাজে মোটেও ততটা সোজ়া নয়। এখন ও আর সেই বাধ্য হয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করার জায়গায় নেই, এদিকের সবাই ছাড়াও নিজের ভাই বোন ওর পাশে আছে, তবুও কিছুটা হলেও চিন্তা আছে ঠিক কি দাঁড়াবে ব্যাপারটা, মাকে কি আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে যে ও যাচ্ছে নাকি বিল্টুদের কাছ থেকে মা কবে থাকবে জেনে নিয়ে কিছু না বলেই চলে যাবে সেটা ঠিক করা যাচ্ছিল না। সে যাই হোক একটা ভেবে ঠিক করা যাবে, এখন যেটা করার দরকার সেটাই করা হোক ভেবে একজন ভালো লইয়ার ঠিক করা হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় জানা গেল উনি এক সময়ে দাদুর ছাত্র ছিলেন। পরিচয় পাওয়ার পর উনি খুব মন দিয়ে সমস্ত ঘটনা আর কি করতে চাওয়া হচ্ছে শুনে বললেন চিন্তা করার কারন নেই, উনি যতটা সহজে কাজটা করা যায় করে দেবেন, তেমন হলে মৌকে যেতেও হবে না...রেজিস্টারকে বাড়ীতে এনেও কাজটা করা সম্ভব।
সবার সাথে আলোচনা করে মৌয়ের মতামত নিয়ে ঠিক করা হয়েছে আগে থেকে খবর না দিয়েই যাওয়াই ভালো। সেই মতো বিল্টুর কাছ থেকে খবর নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে যাওয়া হবে ঠিক করা আছে। যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে যাবার পর থেকেই মৌকে মাঝে মাঝে কিছুটা অন্যমনস্ক হতে দেখা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে...’কই কিছু না তো’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেস্টা করেছে। হয়তো ও এখোনো কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে ভেবে ওকে বোঝানো হয়েছে যাতে ওখানে গিয়ে আবার ভেঙ্গে না পড়ে কারন ওর উপরেই অনেকটা নির্ভর করছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সবার সামনে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বললেও পরে অরিত্রকে একা পেয়ে চুপি চুপি বলেছে... মায়ের সাথে যদি ঝগড়া করার দরকার হয় তাই রিহার্সাল দিচ্ছিলাম...বুঝেছো। অরিত্র ওর ঝগড়া করার কথা শুনে কিছুক্ষন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে হাসি মুখে বলেছে... বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? অরিত্র আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল...তুমি করবে ঝগড়া আর আমাকে তাই বিশ্বাস করতে হবে? এ তো সেই সোনার পাথর বাটির মতো কিছু একটা হবে। মৌ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করতে হবে না... আমি না হয় ওখানে গিয়ে কিছু করলাম না কিন্তু তোমার সাথে তো ভবিষ্যতে একটু আধটু করতে হবে আর তার জন্যও তো এখন থেকে শিখতে হবে...নাকি। অরিত্র এবারে আর না হেসে পারলো না ওর কথা বলার ভঙ্গীতে...কোনো রকমে হাসি চাপতে চাপতে বলল...বুঝলাম, কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করতে এলে কি হবে জানা আছে তো? অরিত্র ওকে কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে মৌ কাছে এসে আস্তে করে বলল...বয়ে গেছে আমার... পাজি কোথাকার...
সব কিছুই প্ল্যান মতো এগোচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে পাওয়া একটা খবর পুরো ব্যাপারটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বিশ্বাস কাকু অনেক দিন ধরেই চেস্টা করছিলেন ভেতরের কিছু খবর জোগাড় করার জন্য কিন্তু হঠাৎ করে যে এরকম একটা খবর পাওয়া যাবে নিজেই হয়তো জানতেন না। মৌয়ের বাবার মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়নি, ওটা করানো হয়েছিল এবং সেটাও আবার বাইরের কারুর করানো নয়। এতবড় একটা মর্মান্তিক খবর কিভাবে মৌকে জানানো হবে বা আদৌ এখন জানানো হবে কিনা সেই নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনার পর ঠিক করা হয়েছে না জানানোই ভালো এই মুহুর্তে, আবার একটা শক পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আর কিছু করার থাকবে না হয়তো। এত সমস্যার পর সবকিছু একটু একটু করে পরিনতির দিকে এগোচ্ছে, কেউই চাইছিল না নতুন করে আবার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে। ওকে এই মুহুর্তে জানানো হবে না ঠিক করলেও অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল এই ভেবে যে পরে যদি ও জানতে পারে যে সব কিছু জেনেও ওকে জানানো হয়নি তাহলে খারাপ ভাবে নিতে পারে, যতই হোক ও বাবাকে এখোনো ভীষন ভাবে মিস করে। এই মুহুর্তে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে তাই আর ওটা নিয়ে নিজের মনে যাই থাকুক না কেন সেটাকে চেপে রাখতে হয়েছে যাতে মৌ ওকে দেখে কিছু বুঝতে না পারে কারন ও যদি নিজের থেকে এসে জিজ্ঞেস করে তাহলে ওকে ভুল বোঝানো যাবে না, তাতে সারা জীবনের মতো একটা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়ে যেতে পারে।
একই বাড়ীতে ওরা থাকলেও বিয়ের যা কিছু নিয়ম আছে সব একেবারে ঠিকঠাক ভাবে করতে হবেই এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সামনের বৃহস্পতিবার ভালো দিন আছে, একই দিনে ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই আশীর্বাদ করা হবে ভবানীপুরের বাড়ীতে। অরিত্রর জন্য আসছেন মৌয়ের মামা আর মেয়েকে আশীর্বাদ করার জন্য তো লোকের অভাব নেই। তার আগে মৌকে সাথে নিয়ে গিয়ে তানিস্কের শোরুম থেকে একটা হীরের আংটি পছন্দ করে এসেছে অরিত্র। যথারীতি মৌ এত দামের আংটি নিতে রাজী হচ্ছিল না প্রথমে। পুবালী হেসে ফেলে বলেছে, তুই কি বোকা রে মৌ? আমি হলে তো বলতাম...আরো বেশী দামের কিছু থাকলে দেখাতে। মৌ দিদির কানে কানে বলেছে, কি হবে আমার এত দামের আংটি। পুবালী প্রথমে বুঝতে পারেনি ও কি বলতে চেয়েছে, তারপরেই বুঝতে পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছে... সে তো জানি, তোর সব থেকে দামী জিনিষটা কি। অরিত্র ওদিকে কাউন্টারে পেমেন্টের জন্য গেছে, মৌ পুবালীর কাছে সরে গিয়ে আস্তে করে বলল...মেজদি, আমাকেও তো তোমার ভাইকে কিছু দিতে হবে...কি দিই বলো না। তারপর দুজনে মিলে রুপসাকে ফোন করে ঠিক করেছে কি করবে কিন্তু সেটা কিছুতেই অরিত্র যেন না জানতে পারে এমন ভাবে করেছে ওরা। ফেরার সময়ে ওদের দুজনকে চুপি চুপি কথা বলতে দেখে অরিত্র একবার জিজ্ঞেস করেছে... কি ব্যাপার রে দিদিভাই...কি এত তোদের গোপন আলোচনা চলছে? পুবালী খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করে ভাইকে বলেছে...মেয়েদের কত কথা থাকে...ও তুই বুঝবি না...
আশীর্বাদের দিন ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে একসাথে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। এক এক করে বড়দের সবাইয়ের আশীর্বাদ করা হয়ে গেলে অরিত্র মৌয়ের আঙ্গুলে হীরের আংটিটা পরিয়ে দিলে জেঠিমা মজা করে জেঠুকে বলল...দেখেছো, আমাদের দুষ্টু কত সুন্দর একটা আংটি দিয়েছে...তুমি তো আমাকে কি একটা দিয়েছিলে কে জানে। জেঠু হেসে ফেলে বলল...আমি তো আর ওর মতো এত মাইনে পেতাম না তখন যে তোমাকে হীরের আংটি দেবো। দাদু হেসে ফেলে বলল...শুধু হীরের আংটি দিলেই হবে না বাবা, আমি লিস্ট বানিয়ে রেখেছি আরো কি কি করতে হবে।
সব কিছু মিটে গেলে দাদু মৌকে পাশে বসিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল...নে পড়ে শোনা তো দেখি বুদ্ধুটাকে কি কি করতে হবে বিয়ে করতে গেলে। মৌ কাগজটা দেখেই মুখ কাঁচুমাচু করে বলল...আমি কেন দাদু...
- আরে আমি কেন মানে? তুই এখন আমার নাতনী...আর ও ব্যাটা এখন এই বাড়ীর ছেলে, আমার কেউ নয় কিছুক্ষনের জন্য। সব কটা নিয়ম মেনে যদি চলবে কথা দেয় তবেই বিয়ে হবে আর যদি বলে মানবো না তো আমি তোর অন্য জায়গায় বিয়ে দেব...তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমার হাতে অনেক ভালো ভালো ছেলে আছে...বুঝলি...
দাদুর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা। মোটামুটি সবাই দাদুকে একটু গম্ভীর দেখেছে এতদিন কিন্তু সেই মানুষটা যে এত মজা করতে পারে কারুরই প্রায় জানা ছিল না। জেঠু হাসতে হাসতে বলল...এই দুষ্টু, ভয় করিস না, আমি তোর পাশে আছি। বুক চাপড়ে বলে দে...হ্যাঁ বলো কি কি নিয়ম আছে...
মৌ কিছুতেই পড়বে না কি লেখা আছে, শেষে দাদু নিজেই পড়তে শুরু করল...
১) এখন থেকে গাড়ী নিয়ে অফিস যাওয়া আসা করতে হবে। নিজে ড্রাইভ করাতে আপত্তি থাকলে ড্রাইভার রাখতে হবে।
২) দেরী করে অফিস থেকে ফেরা যাবে না। দরকার হলে বাড়ীতে বসে কাজ করতে হবে। অনেক অফিসেই এখন এই নিয়ম চালু হয়ে গেছে, এতএব এই ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা হবে না।
৩) শনিবার কোনো অবস্থাতেই অফিস আছে বলা যাবে না। এক্ষেত্রেও পয়েন্ট নাম্বার ২ প্রযোজ্য হতে পারে যদি মৌ অনুমতি দেয়।
৪) মাসে অন্তত একবার সস্ত্রীক ভবানীপুরের বাড়ীতে এসে দুদিন থাকতেই হবে। জেঠুরা চাইলে দিনের সংখা বাড়তে পারে। শুধু ভবানীপুর এলেই হবে না, ওদিকে বড় জেঠুদের কথাও খেয়াল রেখে বছরে অন্তত একবার যেতে হবে। এছাড়াও বাকি আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে সময় সুযোগ করে যাওয়া আসার ব্যাপারটা থাছে।
৫) বছরে দুটো বড় বা একটা বড় ও একটা ছোট বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম রাখতেই হবে এবং সেটা আমাদের সাথে অবশ্যই নয়। আমাদের সাথে যেতে চাইলে এর বাইরে যাওয়া যেতে পারে।
৬) আগামী অন্তত চার বছর একেবারে ঝাড়া হাত পা থাকতেই হবে। মৌ সংসার করার সব কিছু শিখে গেলে তবেই বাচ্চাকাচ্চা নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে।
৭) এখন থেকে দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে থাকতে গেলে একা একা যাওয়া চলবে না।
সব কটা নিয়ম পড়া হয়ে গেলে দাদু মুখ তুলে সবার মুখে হাসি দেখে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল...বল, কি করবি...
অরিত্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে হাসি মুখে বলল...ধরো আমি এখন হ্যাঁ বলে দিলাম আর পরে মানলাম না...তাহলে কি হবে...
দাদু এবারে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি রে...কি হবে? মৌ মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল...আমি কি জানি...তোমার নাতি, তুমি বুঝবে...
দাদু হাসতে হাসতে বলল...সে কি রে...আমি তো তোর জন্যই এত কিছু ভাবছি আর তুই আমার কোর্টেই বল ফেলে দিলি...যাকগে, শোন...এগুলো আমি মোটেও মজা করার জন্য ভাবিনি...চাইলে সবকটা নিয়মই মেনে চলা যায় বুঝলি...
দিদান এতক্ষন কিছু বলেনি, চুপচাপ বসে দাদুর কথা শুনছিল। দাদুর কথা শেষ হতেই বলল...এ তো দেখছি এক তরফা হয়ে গেল। আমারও কিছু বক্তব্য আছে...এক এক করে বলছি, শোনো...
১) সারাদিন যখন তখন তুমি মৌ কোথায় গেল বলে হাঁক ডাক করতে পারবে না।
২) আমাদের লুকিয়ে মৌকে চুপিচুপি বলা যাবে না চা খাওয়াতে।
৩) আমরা ওষুধ দিলেও খেয়ে নিতে হবে চুপচাপ।
দিদানের কথা শেষ হলে দাদু বেশ গম্ভীরভাবে... ‘হুম, বুঝেছি... তুমি আজকাল খুব হিংসে করছো আমাকে’...বললে, সবাইয়ের হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর ঠিক হয়েছে দু পক্ষই সব কিছু মেনে নিচ্ছে।
মৌয়ের বাবার ব্যাপারে ওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলেও অরিত্র মনের ভেতরের খচখচানিটা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে ও একা একাই ঠিক করে ফেলেছে সবকিছু জানিয়ে দেবে ওকে, যদিও ঠিক কি ভাবে বললে ঠিক হবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। কয়েকদিন ধরে ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখে দিদান দু একবার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও অফিসের কিছু কাজের কথা ভাবছে বলে ও এড়িয়ে গেছে। দিদান এমনিতেই খুব ব্যাস্ত থাকায় আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে পারেনি বা পরে একা ওর সাথে কথা বলবে ভেবেও ভুলে গেছে।
আজকাল অরিত্রকে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে আসতে হচ্ছে তার উপরে মাঝে মাঝে ছুটি নিতে হচ্ছে বলে রাতের দিকে বাড়ীতে বসে অফিসের কিছুটা কাজকর্ম করতে হচ্ছিল। সেদিন ও রাতে একা একা কাজ করছে, রাত প্রায় সাড়ে বারোটা পৌনে একটা মতো বাজে। একটানা কাজ করতে করতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ও চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। অবশ্য শুধু হয়তো বিশ্রাম নেওয়া নয়, সাথে সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছিল। কি করবো ভাবতে ভাবতে তো একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে... আর দেরী করা যাবেই না, যেভাবেই হোক ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবার আগেই জানানোটা দরকার...কিন্তু কি ভাবে?
চোখ বুজে থেকে ভাবতে ভাবতে খুব পরিচিত হালকা কিন্তু মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলে চোখ না খুলেই বুঝে গেল কে এসেছে। যাই থাকুক না কেন মনের ভেতরে, ও এসেছে বুঝতে পেরে ভালো লাগার অনুভুতিতে মনটা ভরে উঠলো। শুধু ভালো লাগা নয়, সাথে সাথে ওকে বলতে পারার সুযোগটা অযাচিত ভাবে এসে যাওয়ায় সাথে সাথেই মনস্থির করে নিল কি করবে। ও যে বুঝতে পেরেছে মৌ এসেছে সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে আরো কিছুক্ষন চোখ বুজে চুপ করে বসে থেকে হয়তো দেখতে চাইছিল ও কি করে। ভালো করেই জানে ও এসেছে যখন কথা না বলে ফিরে যাবেই না। অরিত্র ওকে আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না ভেবে চোখ না খুলেই বলল...ঘুমোওনি? ও কিভাবে বুঝলো যে আমি এসেছি ভাবতে ভাবতে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মৌ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও যে নিঃশব্দে আরো কাছে সরে এসেছে বুঝে গিয়ে অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলে ও আস্তে করে বলল...কি করে বুঝলে আমি এসেছি? প্রশ্নটা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলে মৌ ওর কপালে হাত রেখে আস্তে করে বলল...একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তারপরেই ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল...তোমার কি হয়েছে আমাকেও বলতে পারবে না?