25-02-2019, 12:44 PM
পরের দিন বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেছে, হোক না, ফেরার সময় তো আর রাস্তা খোঁজার ব্যাপার নেই। বেরোবার আগে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবার মন খারাপ। দিদা, মামীমা মাসী মামন দাদু কেউ না কেউ মৌকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে দেখে মামাও চোখের জল আটকাতে না পারলেও এদিকে ওদের দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে সামলেছে। দাদু অরিত্রর হাত ধরে বার বার করে আবার আসতে বলায় নিশ্চয় আসবো বলে ওনাকে শান্ত করতে হয়েছে। নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল ওই ভাবে চলে আসতে কিন্তু কিছু করার নেই। যেদিনই ওরা বেরোক না কেন একই ঘটনা ঘটবে। গাড়ীর পেছনের সিটে সুমনা আর মৌ, সামনে অর্ক পাপাইকে কোলে নিয়ে বসেছে...ও কলেজের মাঠ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তেই অবাক হতে হল...লালু গাড়ীর পেছনে পেছনে দৌড়োচ্ছে...খুব খারাপ লাগলো...ইস ওকে তো বলে আসা হয়নি, এই কটা দিন ওর কাছ ছাড়া হয়নি একবারের জন্যও, সব সময় পায়ে পায়ে ঘুরেছে। গাড়ী থামিয়ে দিয়ে নেমে এসে দাঁড়ালে লালু কাছে এসে ওর দিকে যেন করুন ভাবে তাকালো...মানুষ না হলেও ঠিক কি করে যেন বুঝে গেছে ওরা আজ চলে যাচ্ছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলে গা ঘেঁষে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইলো...তুমি চলে যাচ্ছো? অর্ক নেমে এসে ওকে ফিরে যেতে বললেও গেল না দেখে বলল...দাদা, চলো...ও এখন কিছুতেই যাবে না...কলেজের মাঠ থেকে আমার সাথে না হয় ফিরবে।
দুর্গাপুর পর্যন্ত সুমনা সাথে থাকায় কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে মৌয়ের মন খারাপটা কেটে গেছে কিছুটা...অরিত্র ওকে আসানসোলে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলাতে সুমনা কিছুতেই রাজী হল না। বিকেল হয়ে এসেছে...ওদেরও তো অনেকটা পথ যেতে হবে। দুর্গাপুরে ওকে আসানসোলের বাসে উঠিয়ে দিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় চারটে বাজলো, খুব কপাল ভালো ছিল, পাপাই ঘুমিয়ে পড়েছে, না হলে কান্নাকাটি জুড়ে দিত হয়তো...
দুর্গাপুর থেকে বেরোনোর সময়েই আকাশে অল্প অল্প মেঘ দেখা যাচ্ছিল যদিও তাতে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না...হাইওয়েতে উঠলেই তো ঘন্টা চারেকের ভেতরে কোলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে। বিধি বাম থাকলে যা হয় সেটাই ঘটলো, পানাগড়ে রাস্তা জ্যাম। জ্যাম ঠেলে এদিকে যখন পৌঁছোল তখন প্রায় সন্ধে... আকাশে সাঙ্ঘাতিক মেঘ, বৃষ্টি যে কোন সময় শুরু হতে পারে। পানাগড় পেরোনোর পর খুব বেশী হলে দশ বারো কিলোমিটার এসে আবার আটকে যেতে হ’ল। সামনে লাইন দিয়ে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য...কড় কড় আওয়াজের সাথে নিকষ কালো আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশের এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত...দুরের ট্রেন লাইনে বোধহয় একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আবছা অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে করে এগিয়ে যাচ্ছে ...ডান দিকের কিছু দেখা না গেলেও রাস্তার বাঁ দিকের আদিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ...আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে চুপচাপ দুজনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৌয়ের অস্ফুট স্বরে ‘কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না’...শুনে অরিত্র বললো...প্রকৃতির কত রুপ, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না...
ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল একটু পরেই, সাথে কানে তালা লাগানো আওয়াজের সাথে বাজ পড়ছে। রাস্তার ধার দিয়ে যে এগোনো যাবে তার উপায়ও থাকলো না আর। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর উলটো দিক থেকে একজনকে ভিজতে ভিজতে আসতে দেখা গেলে তাড়াতাড়ি জানলার কাঁচটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বেশ কিছুটা দু’রে একটা মাল বোঝাই ট্রেলার উলটে গিয়ে রাস্তা আটকে যাবার পর উল্টোদিক দিয়ে এদিকের গাড়ী যেতে গিয়ে ওদিকটাও আটকে গেছে বিচ্ছিরি ভাবে। এগিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই দেখে দুজনে কথা বলে সময় কাটানোর চেস্টা করতে করতে সাড়ে আট টা মতো বাজলো, সামনে গাড়ীর লাইনটা একটু একটু করে এগোতে শুরু করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। যাক বাবা, এক জায়গায় বসে থাকার চেয়ে যা এগোনো যায়, তাই ভালো। ঘন্টা খানেক লাগলো আরো হাফ কিলোমিটার এগোতে। এই বৃষ্টির ভেতরে উলটে যাওয়া গাড়ীটা কি করে সরাচ্ছে কে জানে ভাবতে গিয়ে মনে হল ভাগ্যিস সরাচ্ছে, না হলে তো এগোনোই যেত না। ওর ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই আবার আটকে গেল গাড়ীর লাইনটা। রাত ন-টা বাজে। এত রাতে মৌকে নিয়ে এই হাইওয়েতে থাকাটা কি ঠিক হবে? সামনে পেছনে শুধু বড় বড় লরি। বেশ কয়েক জন মিলে এসে যদি হামলা করে কিছু করার থাকবে না। মৌকেও কিছু ব’লা যাচ্ছে না। এমনিতেই ও খুব চিন্তায় পড়ে গেছে, শুনলেই কেঁদে ফেলবে হয়তো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে একটু দূরে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেয়ে ভালো করে দেখে বুঝল, একটা হোটেল। কপাল ঠুকে কোনো রকমে রাস্তার ধার দিয়ে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে গাড়ীটাকে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল খুব একটা খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না হোটেলটা। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগানের ভেতরে দোতলা বাড়ী,বাগানের ছোট ছোট গাছের ভেজা পাতায় হালকা নিলাভ আলো পড়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। গাড়ীটাকে আস্তে আস্তে গেটের কাছে নিয়ে এলে সিকিউরিটি ছাতা মাথায় দিয়ে এসে গেটটা খুলে দিল...
রিশেপশানে ওদেরকে বসতে বলে ম্যানেজার কাউকে ডেকে পাঠিয়েছে। রুম একটা পাওয়া যাবে কিন্তু একটু বসতে হবে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি খালি হয়েছে রুমটা, রেডি করার জন্য সময় লাগবে। ওরা বসে থাকতে থাকতে দুটো কম বয়সী মেয়ে এসে ম্যানেজারের সাথে কিসব কথা বলতে বলতে ওদের দিকে তাকাচ্ছিল, তারপরেই ওরা দুজনে দোতলার দিকে চলে গেল।
একটু পরে যে রুমটা ওদেরকে দেওয়া হল সেটা বেশ সাজানো গোছানো দেখে পছন্দ হয়ে গেছে। হয়তো নতুন হোটেল বলেই এখোনো বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আছে। রুমেই খাওয়ারের অর্ডার দিয়ে অরিত্র টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফোন করে জানিয়ে দিল কি অবস্থা। দাদু শুনেই চিন্তায় পড়ে গিয়ে বলল...বিশ্বাস কাকুকে এখুনি ফোন করছে। এমনিতেই ওনাকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে এর আগে তাই সামান্য কারনে আর ফোন করার দরকার নেই বলাতে দাদু প্রথমে কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না। দাদুর মতে অরিত্র একা থাকলে না হয় ঠিক ছিল, সাথে মৌ আছে, হাইওয়ের হোটেল, কি বিশ্বাস আছে? দিন কাল তো একেবারেই ভালো নয়। কোনোরকমে দাদুকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে জেঠিমাকে জানাতে হল যে আজ রাতে ওরা ভবানীপুরের বাড়ীতে যেতে পারছে না। সেখানেও আর এক প্রস্থ বুঝিয়ে উঠতে উঠতে মৌ জামাকাপড় পালটে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে ওর পাসে বসে বলল… এই শোনো না, ওই মেয়ে দুটো কেমন যেন, তাই না?
- হুম…হবে
- হ্যাঁ গো, দেখলে না…কেমন ভাবে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে।
- হুম…
- ধ্যাত... কি শুধু তখন থেকে হুম হুম করে যাচ্ছো…
অরিত্র হেসে ফেলে বলল…কি করবো? দেখে বুঝতে পারোনি?
- কি বুঝবো?
- ওরা এখানে কাউকে সঙ্গ দিতে এসেছে...
- ধ্যাত, কি বলছো…ওই টুকু টুকু মেয়ে…
- এটাই ওদের কাজ…
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…বিশ্বাস হচ্ছে না।
মেয়ে দুটোকে ওইভাবে তাকাতে দেখে অরিত্ররও মোটেও ভালো লাগেনি, মৌকে ওরা কি নিজেদের মতো কেউ ভেবেছে মনে করে ভীষন বিচ্ছিরি লাগলেও ওই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না, ও কি ভাবছে সেটা মৌকে বললে ওরও খারাপ লাগবে।
ডিনারের পর দিদিদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে নিয়ে মৌ ক্লান্ত লাগছে বলে শুয়ে পড়তে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘এই…শোবে না’?
- হু, তুমি শোও…আমি এই খেলাটা শেষ হলেই আসছি...
- দেরি করবে না কিন্তু, অনেক ধকল গেছে তোমার...
- আচ্ছা ঠিক আছে...তুমি শুয়ে পড়,আমি আসছি...
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি মৌ। ক্লান্ত থাকায় রাতে আর ঘুমও ভাঙ্গেনি আজ। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দেখলো পাশে তো ও নেই। এরই মধ্যে উঠে পড়ল নাকি ভেবে উঠতে গিয়ে বুঝল, ও শুতেই আসেনি, সোফাতেই কোনো রকমে পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। ইশ, আমার জন্য ওকে কত কষ্ট করতে হচ্ছে ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সাথে সাথে আরো কিছু প্রশ্নও মাথার ভেতরে এসে গেল...আমার ওই ব্যাপারটা কি ও বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে? তাই বা কি করে হয়, ও তো নিজেই এগিয়ে এসেছিল… আমি সব কিছু বলার পরও ও পিছিয়ে যায়নি। আমি তো ওকে জোর করিনি, বরং ভালো করে ভেবে ডিশিশান নিতে বলেছিলাম... তাহলে কেন ও আমার কাছে আসতে চাইছে না? বাড়ীতে না হয় কাছে আসার অসুবিধা আছে। এখানে আমার সাথে শুলে কি ক্ষতি হোতো?
কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে ও উঠে গিয়ে রুম সার্ভিসে ফোন করে চায়ের জন্য বলে দিয়ে ফ্রেস হয়ে ফিরে এলো, একটু পরেই বেলটা বেজে উঠলে বুঝলো চা এসে গেছে। সার্ভিসের ছেলেটা বেরিয়ে যাবার আগে অদ্ভুত দৃষ্টিতে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল, এ আবার কেমন ধারার লোক... বিছানা থাকতে সোফায় শুয়ে, তার উপরে সাথে একটা মেয়ে। অরিত্র ঘুম চোখে চা খেতে খেতে মৌ এর দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল ওর সারা মুখে অভিমান মাখানো। কারনটা কি না বোঝারও কিছু নেই, ও যদি নিজের থেকে জিজ্ঞেস করে ঠিক আছে, না হলে এখন ভাবতে হবে কিভাবে ওকে বুঝিয়ে বলবে। এমনিতে নরম মনের মেয়ে হলেও যে ও কিছুটা অভিমানী সেটা আর কেউ না বুঝলেও অরিত্র খুব ভালো করে জানে। অন্য কারুর থেকে হাজার অসুবিধা হলেও ও কিছু মনে করবে না বা করলেও প্রকাশ করবে না কিন্তু অরিত্রর দিক থেকে তেমন কিছু হলে ভীষন কষ্ট পায়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না কিছুতেই। কিছুটা সময় কেটে গেলেও মৌ নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, চুপচাপ ব্যাগ খুলে কিসব করতে করতে এত সময় পরে একটাই কথা জিজ্ঞেস করল তাও আবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে...কখন বেরোতে হবে? নাঃ, আর দেরী করা ঠিক হবে না ভেবে ওর পাশে গিয়ে বসলে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। সত্যিই খুব অভিমান করেছে, না হলে ও মুখ ফিরিয়ে রাখার মেয়েই নয়। কিছু না বলেও যে অনেক কিছু বলা যায় তা আজ আরো একবার প্রমান হয়ে গেল। অরিত্রকে চুপ করে ওর পাশে বসে থাকতে দেখে ও নিজেকে আর দুরে সরিয়ে রাখতে পারলো না, কাছে সরে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বলল… তুমি শুতে এলে না কেন?
- এমনি...
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…আমি তো তোমাকে ডেকেছিলাম...
- জানি…
- তাহলে?
- আসলে তোমাকে ঘুমোতে দেখে আর ডিসটার্ব করতে চাই নি...
মৌ ওর হাতের উপরে নিজের হাতটা আলতো ভাবে ছুঁইয়ে রেখে নিজের মনেই যেন বলল... তোমার কি আর আমাকে ভালো লাগছে না?
অরিত্র ওকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল...তুমি তো জানো তুমি কতোটা জায়গা জুড়ে আছো আমার জীবনে... মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে বসেছিল, ওর কথাটা ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে গেল। কেন ওকে আবার এসব বলতে গেল, সত্যিই হয়তো কিছু ব্যাপার আছে যার জন্য ও খুব একটা কাছে আসতে চায় না। তাতে ও আর ভালোবাসে না ভেবে নেওয়াটা একেবারেই ঠিক হয়নি। নিজেকে ওর বুকে চেপে ধরে রেখে বলল...এই, কিছু মনে কোরো না…আমি বুঝতে ভুল করেছি...
- আচ্ছা…
- এই…
- বলো…
- সত্যি বলছি, ভুল বুঝেছিলাম...বিশ্বাস করো...
- হু, জানি...তোমার জায়গায় আমি থাকলেও তাই হোতো...
দুজনেই চুপচাপ এক ভাবে বসে থাকার পর আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে। অরিত্র খুব আস্তে করে বলল... চুপ করে আছো?
- তুমিও তো চুপ করে আছো...
- একটা কথা বলবো?
- বলো
- তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল...
- আমি কি তোমাকে না করতাম?
- জানি...
- তাহলে?
- সবকিছু আগে ভাগে শেষ না করে কিছু তো তুলে রাখতে হয়...তাই না...
মৌ ওর শেষ কথাটার কি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না, একটু সময় চুপ করে থাকার পর বলল... তুমি আমাকে খারাপ ভাবছো না তো?
- উঁ হুঁ...এসো...
- কি?
- খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে আদর করতে...
- এই যে বললে কিছু তুলে রাখবে…
- সে তো রাখবোই...
- তাহলে?
- জানি না…এসো…
শুধু একটু ভালোবাসা পেলেই যে খুশী হয় তার পক্ষে অভিমান করে বসে থাকা সম্ভব? তাও আবার এতো আদরের পর? মৌ বেশ কিছুক্ষন ওর মুখটা দুহাতে ধরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কি যেন খোঁজার চেস্টা করতে করতে বলল... তোমাকে আমি না ঠিক বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে। অরিত্র ওর কথাটা শুনে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল... কেন বলোতো?
- কেন আবার... কেউ তো এখানে ছিল না তবুও কাল রাতে শুতে এলে না... এখন আবার নিজের থেকেই আদর করলে.....তারপর...সেদিন স্নান করার সময় কিসব করলে...
- কি করেছি?
- ইশ, কি করেছি? আমি সব বলে দিয়েছি ছোড়দিকে...
- মানে?
মৌ ওর বুকে মুখ গুঁজে দুষ্টুমি ভরা গলায় হেসে ফেলে বলল... ছোড়দি কি বলেছে জানো?
- কি?
- ইশ, দাদাভাইটা এতো রোমান্টিক? আমি ভাবতেই পারছি না...
- তাই?
- হু...তোমাকে ফোন করবে বলেছে...
- হুম...সে তো করবেই...আমার পেছনে লাগার এতবড় সুযোগ পেয়েছে...ছাড়বে নাকি...আচ্ছা বলোতো ঠিক কি কি বলেছো ফাজিল-টাকে...
- ইশ...ফাজিল বললে কেন ছোড়দিকে?
- ফাজিলকে ফাজিল বলবো না তো আর কি বলবো শুনি...যাকগে কি কি বলেছো বলো...
- কি আবার বলবো...ওই, তুমি কিভাবে জলের ভেতরে ডুব দিয়ে চুমু খেয়েছিলে...তাই...
মৌ স্নান করে বেরিয়ে এসে ওকে তাড়া লাগালো...এই, ওঠো না...বেরোতে হবে তো নাকি। অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসিতে মুখ ভরিয়ে নিয়ে বলল...কেন তোমার আমার সাথে এখানে একা একা থাকতে ভালো লাগছে না? এই, একদম দুষ্টুমি নয়...যাও আগে...ওদিকে জেঠিমা রান্না করে নিয়ে বসে থাকবে শুনে অগত্যা উঠতে উঠতে বলতে হল... আচ্ছা বাবা যাচ্ছি, তুমি তৈরী হয়ে নাও...আমি যাবো আর আসবো...
যাবো আর আসবো বললেও বেশ কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে দেখলো তখোনো মৌয়ের হয়নি... ওর জন্য একটা জিন্স আর লাল টিসার্ট বের করে রেখেছে পরার জন্য আর নিজ়ে কি পরবে তাই নিয়ে বোধহয় ঠিক করতে পারছে না। ওকে বেরোতে দেখে মুখটা ভার করে বলল...এই তোমার যাবো আর আসবো? কখন থেকে বসে আছি। ‘কেন’ বলাতে বলল...এই, কি পরবো একটু দেখে দাও না। অরিত্র কিছু না বলে একটা শালোয়ার কামিজের সেট নিয়ে ওর হাতে দিলে গায়ের উপরে ফেলে আয়নায় নিজেকে ঘুরিরে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে খুব খুশী হয়ে বলল... ইস, কি সুন্দর... একটু আগেই ও নিজে দেখেছে সেটা ভুলেই গেছে। অরিত্র ভালো করে মাথা মুছতে মুছতে বলল... যাবো তো গাড়ীতে, কে দেখবে তোমাকে? ইস, কে দেখবে তোমাকে...আমি কি অন্য কাউকে দেখাবার জন্য সাজবো নাকি? অরিত্র অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল... তো কার জন্য সাজবে শুনি। মৌ উঠে এসে ওর হাতে টিসার্টটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... তুমি জানো না...কার জন্য? অরিত্র খুব ভালো করেই জানতো ওর উত্তরটা কি তবুও ওর মুখ থেকে শোনার জন্যই আবার জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরেই ইয়ার্কি করে বলল...এই গরমে টকটকে লাল? এটার কি মানে? মৌ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...ওটার মানে ...তোমার দিকে কেউ নজর দিতে পারবে না...বুঝেছো? অরিত্র ওর পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল...আর যদি কেউ নজর দেয়? মৌ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল... আমি তাকে মেরেই ফেলবো...একেবারে। ওর কাঁধে থুতনি রেখে আগের মতোই জড়িয়ে ধরে থেকে ‘তাই?’ বললে...মৌ দুচোখের ঝিলিক দিয়ে বোঝালো...হুঁ, তাই। ‘আর আমি যদি কারুর দিকে তাকাই তাহলে?’বলাতে ও হাসি মুখে জবাব দিল... তুমি পারবেই না আমাকে ছেড়ে আর কারুর দিকে তাকাতে। ‘এতো বিশ্বাস?’ জিজ্ঞেস করাতে ও মুখ ঘুরিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল... প্রশ্নটা আমাকে না করে নিজেকে করলেই তো পারো...পাজী কোথাকার...
- হু, বুঝলাম...চলো তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও...
- এই, একটু বাইরে যাও না...
- কেন?
- ধ্যাত, যাও না...
- হুম, লজ্জা করছে?
- এই, তুমি যাবে?
- ভেবেছিলুম একটু দেখবো...সে আর হলো না...
- ইশ, কি শখ, দেখবো...যাও ভাগো...
- মনে থাকে যেন...পরে কিন্তু দেখাতে চাইলেও দেখবো না...
- বয়ে গেছে আমার দেখাতে...
- ঠিক তো?
- এই, তুমি যাবে... না কি আমি ছোড়দিকে ফোন করবো...
‘আচ্ছা বাবা...যাচ্ছি’ বলে ওকে ছেড়ে সরে যেতেই মৌ কি মনে করে বলল...থাক, ওরকম গোমড়া মুখ করে যেতে হবে না...তুমি থাকো তবে দেখা যাবে না কিন্তু...রাজী? অরিত্র হেসে ফেলে বলল...চুরি করেও দেখতে পারবো না? ছোট্ট একটা কিল খেতে হল চুরি করে দেখার ইচ্ছের জন্য আর তার সাথে ওর মিষ্টি করে বলা উঁ হুঁ...শুনতে হল। ‘ওক্কে বাবা, আমি এই সোফাতে এদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসছি, তুমি যা খুশী কর’ বলে অরিত্র মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছিল। এসির হাল্কা আওয়াজের সাথে মাঝে মাঝে ওর হাতের চুড়ির রিন রিন আওয়াজ কানে আসছে...ওকে কথা দিতে হয়েছে তাকাবে না, তাই যতই ইচ্ছে হোক দেখা যাবে না। কি মনে করে মুখ তুলে আয়নার দিকে চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস আটকে গেল... এমন একটা জায়গায় ও পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে যে ও বুঝতেই পারবে না যে এখান থেকে ওকে আয়নার ভেতরে দেখা যাবে। অরিত্র যখন কথা দিয়েছে দেখবে না তো দেখবেই না বুঝে ও নিশ্চিন্তে চুড়িদারটা পরছে...সরু কোমর থেকে আস্তে আস্তে চওড়া হতে শুরু করেছে উপরের দিক, একেবারে নিঁখুত শরীরের গড়ন, যেখানে যেটুকু দরকার সেখানে ঠিক ততটুকুই আছে... টুকটুকে ফর্সা উজ্জ্বল মসৃন ত্বকের উপরে লাল রংয়ের অন্ত্রর্বাসের সরু ফিতে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে গেল আবরনের আড়ালে। চোখ বুজে হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া অপরুপ এক নারী শরীরের রুপে মুগ্ধ হতে হতে ও ভাবছিল...একেই কি বলে দেবভোগ্যা নারী? বুকের উপরে হাত দুটো রেখে এক অজানা অনুভুতিতে বুকের ভেতরটা ভরে তুলতে তুলতে শুনল ওর মিষ্টি গলার ডাক...এই ওঠো...চোখ মেলে তাকালে, মৌ মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর মুখের উপরে ঝুঁকে এসে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার লক্ষী সোনা আমাকে কথা দিয়েছিল...তার জন্য...
মৌ ওকে কেন চুমু দিয়েছে শোনার পর মনে হল, ও তো জানেনা যে আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে না চাইলেও চোখ চলে গিয়েছিল। ও তো আমাকে বিশ্বাস করে... তাহলে কি আমার না বলাটা ঠিক হবে? মৌ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভেবেছে ওর একটা চুমুতে মন ভরেনি,আরো চাই... তাই হাসি মুখে বলল...কি...আরো চাই? ততক্ষনে অরিত্রও ভেবে নিয়েছে কি বলবে, ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল... রাগ করবে না বলো...মৌ ওর সেই মন ভোলানো হাসি মাখা মুখে উত্তর দিল...উঁ হু...
- আমি না তোমাকে দেখে ফেলেছি...
ওকে দেখে ফেলেছে শুনে কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ লুকিয়েছে তারই বুকে যার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কি বলবে বা কি করবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না ও, তারপর ভেবেছে... আচ্ছা আমি তো পেছন ফিরে ছিলাম, তাহলে ও কি করে দেখেছে বলছে? বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে রেখেই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করেছে...সত্যিই দেখেছো?
অরিত্র ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ওরই মতো মৃদু স্বরে বলেছে...সত্যিই দেখেছি...এই তো এই টুকুনি...
ও পিঠের উপরে হাত রেখে কি দেখেছে বললো সেটা বুঝতে পেরে মৌ জিজ্ঞেস করল... আর কিছু না তো?
- উঁ হুঁ...
- তাই? কি করে?
- কি জানি, কি মনে করে আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল...
মৌ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকালো...তখোনো ওর লজ্জা পুরোপুরি না কাটলেও তাকিয়ে থেকে ওর দুচোখে কি যেন খুঁজলো...তারপর যখন বুঝলো ও সত্যিই ইচ্ছে করে কিছু করেনি, আস্তে করে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে আবার একটা চুমু দিল ঠোঁটে...আগের মতোই আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার সোনা আমাকে ঠকাতে চায়নি বলে...
সাড়ে ন-টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়েছে কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় আজ আর সেই গায়ে জ্বালা ধরানো গরম নেই দেখে গাড়ীর এসি চালানো হয়নি। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ধীরে সুস্থে এগোতে এগোতে দুজনের গল্প হচ্ছিল, গল্প বলতে মৌ-ই বেশী কথা বলছে, বেশীর ভাগটাই ওর মামাবাড়ী নিয়ে। ও যে কতোটা খুশী হয়েছে এতদিন পরে এখানে আসতে পেরে তা ওর কথাবার্তা বা শরীরের ভাষা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ওর কথা শুনতে শুনতে পুবালী ফোন করেছে দেখে অরিত্র ওকে ফোনটা দিয়েছে... দুজনে অনেকক্ষন ধরে কি সব কথা বলছে নীচু গলায়...কখোনো হাসছে, কখোনো ওর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে... দুজনের চোখাচুখি হলে হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওদিকে হুঁ হাঁ উত্তর দিচ্ছে দেখে অরিত্র ওকে বলেছে আমার দিকে তাকাতে হবে না, তুমি আগে কথা বলে নাও... মৌ ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে...ও ওদিকে ফোনে ব্যাস্ত দেখে অরিত্র অডিও সিস্টেমটা চালিয়ে দিয়ে আওয়াজ কমিয়ে রেখে দিল যাতে মৌয়ের ফোনে কথা বলতে অসুবিধা না হয়। কিছুক্ষন পর পুবালীর সাথে কথা হয়ে গেলে ফোনটা রেখে দিয়ে মৌ কান পেতে কি গান হচ্ছে শোনার চেস্টা করছে দেখে আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিতে হয়েছে...
Love me tender,
love me sweet,
never let me go.
You have made my life complete,
and I love you so.
Love me tender,
love me true,
all my dreams fulfilled.
For my darlin' I love you,
and I always will.
Love me tender,
love me long,
take me to your heart.
For it's there that I belong,
and we'll never part.
Love me tender,
love me dear,
tell me you are mine.
I'll be yours through all the years,
till the end of time.
When at last my dreams come true
Darling this I know
Happiness will follow you
Everywhere you go.
পুরো গানটা খুব মন দিয়ে শোনার পর মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বলল...এই গানটা কখন শুনতে আরো ভালো লাগবে বলো তো?
- নিস্তব্ধ গভীর রাত...চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে...শুধু আমরা দুজনে ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও... আমার বুকে তুমি মাথা রেখে শুয়ে আছো...আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি। খুব আস্তে আস্তে গানটা বাজছে...তুমি আর আমি শুনছি...
অরিত্র গাড়ী চালাতে চালাতে কথা গুলো বলে একটু পরে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল কেমন যেন আনমনে চুপ করে বসে আছে কোলের উপরে হাতদুটো রেখে...আরো কিছু মুহুর্ত কেটে গেল ওইভাবে...অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ছুঁলে যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে ফিরে এসে লাজুক হেসে নরম গলায় বলল...ভাবছিলাম...
দুর্গাপুর পর্যন্ত সুমনা সাথে থাকায় কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে মৌয়ের মন খারাপটা কেটে গেছে কিছুটা...অরিত্র ওকে আসানসোলে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলাতে সুমনা কিছুতেই রাজী হল না। বিকেল হয়ে এসেছে...ওদেরও তো অনেকটা পথ যেতে হবে। দুর্গাপুরে ওকে আসানসোলের বাসে উঠিয়ে দিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় চারটে বাজলো, খুব কপাল ভালো ছিল, পাপাই ঘুমিয়ে পড়েছে, না হলে কান্নাকাটি জুড়ে দিত হয়তো...
দুর্গাপুর থেকে বেরোনোর সময়েই আকাশে অল্প অল্প মেঘ দেখা যাচ্ছিল যদিও তাতে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না...হাইওয়েতে উঠলেই তো ঘন্টা চারেকের ভেতরে কোলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে। বিধি বাম থাকলে যা হয় সেটাই ঘটলো, পানাগড়ে রাস্তা জ্যাম। জ্যাম ঠেলে এদিকে যখন পৌঁছোল তখন প্রায় সন্ধে... আকাশে সাঙ্ঘাতিক মেঘ, বৃষ্টি যে কোন সময় শুরু হতে পারে। পানাগড় পেরোনোর পর খুব বেশী হলে দশ বারো কিলোমিটার এসে আবার আটকে যেতে হ’ল। সামনে লাইন দিয়ে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য...কড় কড় আওয়াজের সাথে নিকষ কালো আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশের এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত...দুরের ট্রেন লাইনে বোধহয় একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আবছা অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে করে এগিয়ে যাচ্ছে ...ডান দিকের কিছু দেখা না গেলেও রাস্তার বাঁ দিকের আদিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ...আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে চুপচাপ দুজনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৌয়ের অস্ফুট স্বরে ‘কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না’...শুনে অরিত্র বললো...প্রকৃতির কত রুপ, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না...
ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল একটু পরেই, সাথে কানে তালা লাগানো আওয়াজের সাথে বাজ পড়ছে। রাস্তার ধার দিয়ে যে এগোনো যাবে তার উপায়ও থাকলো না আর। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর উলটো দিক থেকে একজনকে ভিজতে ভিজতে আসতে দেখা গেলে তাড়াতাড়ি জানলার কাঁচটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বেশ কিছুটা দু’রে একটা মাল বোঝাই ট্রেলার উলটে গিয়ে রাস্তা আটকে যাবার পর উল্টোদিক দিয়ে এদিকের গাড়ী যেতে গিয়ে ওদিকটাও আটকে গেছে বিচ্ছিরি ভাবে। এগিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই দেখে দুজনে কথা বলে সময় কাটানোর চেস্টা করতে করতে সাড়ে আট টা মতো বাজলো, সামনে গাড়ীর লাইনটা একটু একটু করে এগোতে শুরু করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। যাক বাবা, এক জায়গায় বসে থাকার চেয়ে যা এগোনো যায়, তাই ভালো। ঘন্টা খানেক লাগলো আরো হাফ কিলোমিটার এগোতে। এই বৃষ্টির ভেতরে উলটে যাওয়া গাড়ীটা কি করে সরাচ্ছে কে জানে ভাবতে গিয়ে মনে হল ভাগ্যিস সরাচ্ছে, না হলে তো এগোনোই যেত না। ওর ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই আবার আটকে গেল গাড়ীর লাইনটা। রাত ন-টা বাজে। এত রাতে মৌকে নিয়ে এই হাইওয়েতে থাকাটা কি ঠিক হবে? সামনে পেছনে শুধু বড় বড় লরি। বেশ কয়েক জন মিলে এসে যদি হামলা করে কিছু করার থাকবে না। মৌকেও কিছু ব’লা যাচ্ছে না। এমনিতেই ও খুব চিন্তায় পড়ে গেছে, শুনলেই কেঁদে ফেলবে হয়তো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে একটু দূরে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেয়ে ভালো করে দেখে বুঝল, একটা হোটেল। কপাল ঠুকে কোনো রকমে রাস্তার ধার দিয়ে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে গাড়ীটাকে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল খুব একটা খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না হোটেলটা। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগানের ভেতরে দোতলা বাড়ী,বাগানের ছোট ছোট গাছের ভেজা পাতায় হালকা নিলাভ আলো পড়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। গাড়ীটাকে আস্তে আস্তে গেটের কাছে নিয়ে এলে সিকিউরিটি ছাতা মাথায় দিয়ে এসে গেটটা খুলে দিল...
রিশেপশানে ওদেরকে বসতে বলে ম্যানেজার কাউকে ডেকে পাঠিয়েছে। রুম একটা পাওয়া যাবে কিন্তু একটু বসতে হবে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি খালি হয়েছে রুমটা, রেডি করার জন্য সময় লাগবে। ওরা বসে থাকতে থাকতে দুটো কম বয়সী মেয়ে এসে ম্যানেজারের সাথে কিসব কথা বলতে বলতে ওদের দিকে তাকাচ্ছিল, তারপরেই ওরা দুজনে দোতলার দিকে চলে গেল।
একটু পরে যে রুমটা ওদেরকে দেওয়া হল সেটা বেশ সাজানো গোছানো দেখে পছন্দ হয়ে গেছে। হয়তো নতুন হোটেল বলেই এখোনো বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আছে। রুমেই খাওয়ারের অর্ডার দিয়ে অরিত্র টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফোন করে জানিয়ে দিল কি অবস্থা। দাদু শুনেই চিন্তায় পড়ে গিয়ে বলল...বিশ্বাস কাকুকে এখুনি ফোন করছে। এমনিতেই ওনাকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে এর আগে তাই সামান্য কারনে আর ফোন করার দরকার নেই বলাতে দাদু প্রথমে কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না। দাদুর মতে অরিত্র একা থাকলে না হয় ঠিক ছিল, সাথে মৌ আছে, হাইওয়ের হোটেল, কি বিশ্বাস আছে? দিন কাল তো একেবারেই ভালো নয়। কোনোরকমে দাদুকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে জেঠিমাকে জানাতে হল যে আজ রাতে ওরা ভবানীপুরের বাড়ীতে যেতে পারছে না। সেখানেও আর এক প্রস্থ বুঝিয়ে উঠতে উঠতে মৌ জামাকাপড় পালটে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে ওর পাসে বসে বলল… এই শোনো না, ওই মেয়ে দুটো কেমন যেন, তাই না?
- হুম…হবে
- হ্যাঁ গো, দেখলে না…কেমন ভাবে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে।
- হুম…
- ধ্যাত... কি শুধু তখন থেকে হুম হুম করে যাচ্ছো…
অরিত্র হেসে ফেলে বলল…কি করবো? দেখে বুঝতে পারোনি?
- কি বুঝবো?
- ওরা এখানে কাউকে সঙ্গ দিতে এসেছে...
- ধ্যাত, কি বলছো…ওই টুকু টুকু মেয়ে…
- এটাই ওদের কাজ…
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…বিশ্বাস হচ্ছে না।
মেয়ে দুটোকে ওইভাবে তাকাতে দেখে অরিত্ররও মোটেও ভালো লাগেনি, মৌকে ওরা কি নিজেদের মতো কেউ ভেবেছে মনে করে ভীষন বিচ্ছিরি লাগলেও ওই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না, ও কি ভাবছে সেটা মৌকে বললে ওরও খারাপ লাগবে।
ডিনারের পর দিদিদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে নিয়ে মৌ ক্লান্ত লাগছে বলে শুয়ে পড়তে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘এই…শোবে না’?
- হু, তুমি শোও…আমি এই খেলাটা শেষ হলেই আসছি...
- দেরি করবে না কিন্তু, অনেক ধকল গেছে তোমার...
- আচ্ছা ঠিক আছে...তুমি শুয়ে পড়,আমি আসছি...
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি মৌ। ক্লান্ত থাকায় রাতে আর ঘুমও ভাঙ্গেনি আজ। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দেখলো পাশে তো ও নেই। এরই মধ্যে উঠে পড়ল নাকি ভেবে উঠতে গিয়ে বুঝল, ও শুতেই আসেনি, সোফাতেই কোনো রকমে পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। ইশ, আমার জন্য ওকে কত কষ্ট করতে হচ্ছে ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সাথে সাথে আরো কিছু প্রশ্নও মাথার ভেতরে এসে গেল...আমার ওই ব্যাপারটা কি ও বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে? তাই বা কি করে হয়, ও তো নিজেই এগিয়ে এসেছিল… আমি সব কিছু বলার পরও ও পিছিয়ে যায়নি। আমি তো ওকে জোর করিনি, বরং ভালো করে ভেবে ডিশিশান নিতে বলেছিলাম... তাহলে কেন ও আমার কাছে আসতে চাইছে না? বাড়ীতে না হয় কাছে আসার অসুবিধা আছে। এখানে আমার সাথে শুলে কি ক্ষতি হোতো?
কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে ও উঠে গিয়ে রুম সার্ভিসে ফোন করে চায়ের জন্য বলে দিয়ে ফ্রেস হয়ে ফিরে এলো, একটু পরেই বেলটা বেজে উঠলে বুঝলো চা এসে গেছে। সার্ভিসের ছেলেটা বেরিয়ে যাবার আগে অদ্ভুত দৃষ্টিতে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল, এ আবার কেমন ধারার লোক... বিছানা থাকতে সোফায় শুয়ে, তার উপরে সাথে একটা মেয়ে। অরিত্র ঘুম চোখে চা খেতে খেতে মৌ এর দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল ওর সারা মুখে অভিমান মাখানো। কারনটা কি না বোঝারও কিছু নেই, ও যদি নিজের থেকে জিজ্ঞেস করে ঠিক আছে, না হলে এখন ভাবতে হবে কিভাবে ওকে বুঝিয়ে বলবে। এমনিতে নরম মনের মেয়ে হলেও যে ও কিছুটা অভিমানী সেটা আর কেউ না বুঝলেও অরিত্র খুব ভালো করে জানে। অন্য কারুর থেকে হাজার অসুবিধা হলেও ও কিছু মনে করবে না বা করলেও প্রকাশ করবে না কিন্তু অরিত্রর দিক থেকে তেমন কিছু হলে ভীষন কষ্ট পায়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না কিছুতেই। কিছুটা সময় কেটে গেলেও মৌ নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, চুপচাপ ব্যাগ খুলে কিসব করতে করতে এত সময় পরে একটাই কথা জিজ্ঞেস করল তাও আবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে...কখন বেরোতে হবে? নাঃ, আর দেরী করা ঠিক হবে না ভেবে ওর পাশে গিয়ে বসলে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। সত্যিই খুব অভিমান করেছে, না হলে ও মুখ ফিরিয়ে রাখার মেয়েই নয়। কিছু না বলেও যে অনেক কিছু বলা যায় তা আজ আরো একবার প্রমান হয়ে গেল। অরিত্রকে চুপ করে ওর পাশে বসে থাকতে দেখে ও নিজেকে আর দুরে সরিয়ে রাখতে পারলো না, কাছে সরে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বলল… তুমি শুতে এলে না কেন?
- এমনি...
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…আমি তো তোমাকে ডেকেছিলাম...
- জানি…
- তাহলে?
- আসলে তোমাকে ঘুমোতে দেখে আর ডিসটার্ব করতে চাই নি...
মৌ ওর হাতের উপরে নিজের হাতটা আলতো ভাবে ছুঁইয়ে রেখে নিজের মনেই যেন বলল... তোমার কি আর আমাকে ভালো লাগছে না?
অরিত্র ওকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল...তুমি তো জানো তুমি কতোটা জায়গা জুড়ে আছো আমার জীবনে... মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে বসেছিল, ওর কথাটা ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে গেল। কেন ওকে আবার এসব বলতে গেল, সত্যিই হয়তো কিছু ব্যাপার আছে যার জন্য ও খুব একটা কাছে আসতে চায় না। তাতে ও আর ভালোবাসে না ভেবে নেওয়াটা একেবারেই ঠিক হয়নি। নিজেকে ওর বুকে চেপে ধরে রেখে বলল...এই, কিছু মনে কোরো না…আমি বুঝতে ভুল করেছি...
- আচ্ছা…
- এই…
- বলো…
- সত্যি বলছি, ভুল বুঝেছিলাম...বিশ্বাস করো...
- হু, জানি...তোমার জায়গায় আমি থাকলেও তাই হোতো...
দুজনেই চুপচাপ এক ভাবে বসে থাকার পর আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে। অরিত্র খুব আস্তে করে বলল... চুপ করে আছো?
- তুমিও তো চুপ করে আছো...
- একটা কথা বলবো?
- বলো
- তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল...
- আমি কি তোমাকে না করতাম?
- জানি...
- তাহলে?
- সবকিছু আগে ভাগে শেষ না করে কিছু তো তুলে রাখতে হয়...তাই না...
মৌ ওর শেষ কথাটার কি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না, একটু সময় চুপ করে থাকার পর বলল... তুমি আমাকে খারাপ ভাবছো না তো?
- উঁ হুঁ...এসো...
- কি?
- খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে আদর করতে...
- এই যে বললে কিছু তুলে রাখবে…
- সে তো রাখবোই...
- তাহলে?
- জানি না…এসো…
শুধু একটু ভালোবাসা পেলেই যে খুশী হয় তার পক্ষে অভিমান করে বসে থাকা সম্ভব? তাও আবার এতো আদরের পর? মৌ বেশ কিছুক্ষন ওর মুখটা দুহাতে ধরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কি যেন খোঁজার চেস্টা করতে করতে বলল... তোমাকে আমি না ঠিক বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে। অরিত্র ওর কথাটা শুনে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল... কেন বলোতো?
- কেন আবার... কেউ তো এখানে ছিল না তবুও কাল রাতে শুতে এলে না... এখন আবার নিজের থেকেই আদর করলে.....তারপর...সেদিন স্নান করার সময় কিসব করলে...
- কি করেছি?
- ইশ, কি করেছি? আমি সব বলে দিয়েছি ছোড়দিকে...
- মানে?
মৌ ওর বুকে মুখ গুঁজে দুষ্টুমি ভরা গলায় হেসে ফেলে বলল... ছোড়দি কি বলেছে জানো?
- কি?
- ইশ, দাদাভাইটা এতো রোমান্টিক? আমি ভাবতেই পারছি না...
- তাই?
- হু...তোমাকে ফোন করবে বলেছে...
- হুম...সে তো করবেই...আমার পেছনে লাগার এতবড় সুযোগ পেয়েছে...ছাড়বে নাকি...আচ্ছা বলোতো ঠিক কি কি বলেছো ফাজিল-টাকে...
- ইশ...ফাজিল বললে কেন ছোড়দিকে?
- ফাজিলকে ফাজিল বলবো না তো আর কি বলবো শুনি...যাকগে কি কি বলেছো বলো...
- কি আবার বলবো...ওই, তুমি কিভাবে জলের ভেতরে ডুব দিয়ে চুমু খেয়েছিলে...তাই...
মৌ স্নান করে বেরিয়ে এসে ওকে তাড়া লাগালো...এই, ওঠো না...বেরোতে হবে তো নাকি। অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসিতে মুখ ভরিয়ে নিয়ে বলল...কেন তোমার আমার সাথে এখানে একা একা থাকতে ভালো লাগছে না? এই, একদম দুষ্টুমি নয়...যাও আগে...ওদিকে জেঠিমা রান্না করে নিয়ে বসে থাকবে শুনে অগত্যা উঠতে উঠতে বলতে হল... আচ্ছা বাবা যাচ্ছি, তুমি তৈরী হয়ে নাও...আমি যাবো আর আসবো...
যাবো আর আসবো বললেও বেশ কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে দেখলো তখোনো মৌয়ের হয়নি... ওর জন্য একটা জিন্স আর লাল টিসার্ট বের করে রেখেছে পরার জন্য আর নিজ়ে কি পরবে তাই নিয়ে বোধহয় ঠিক করতে পারছে না। ওকে বেরোতে দেখে মুখটা ভার করে বলল...এই তোমার যাবো আর আসবো? কখন থেকে বসে আছি। ‘কেন’ বলাতে বলল...এই, কি পরবো একটু দেখে দাও না। অরিত্র কিছু না বলে একটা শালোয়ার কামিজের সেট নিয়ে ওর হাতে দিলে গায়ের উপরে ফেলে আয়নায় নিজেকে ঘুরিরে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে খুব খুশী হয়ে বলল... ইস, কি সুন্দর... একটু আগেই ও নিজে দেখেছে সেটা ভুলেই গেছে। অরিত্র ভালো করে মাথা মুছতে মুছতে বলল... যাবো তো গাড়ীতে, কে দেখবে তোমাকে? ইস, কে দেখবে তোমাকে...আমি কি অন্য কাউকে দেখাবার জন্য সাজবো নাকি? অরিত্র অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল... তো কার জন্য সাজবে শুনি। মৌ উঠে এসে ওর হাতে টিসার্টটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... তুমি জানো না...কার জন্য? অরিত্র খুব ভালো করেই জানতো ওর উত্তরটা কি তবুও ওর মুখ থেকে শোনার জন্যই আবার জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরেই ইয়ার্কি করে বলল...এই গরমে টকটকে লাল? এটার কি মানে? মৌ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...ওটার মানে ...তোমার দিকে কেউ নজর দিতে পারবে না...বুঝেছো? অরিত্র ওর পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল...আর যদি কেউ নজর দেয়? মৌ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল... আমি তাকে মেরেই ফেলবো...একেবারে। ওর কাঁধে থুতনি রেখে আগের মতোই জড়িয়ে ধরে থেকে ‘তাই?’ বললে...মৌ দুচোখের ঝিলিক দিয়ে বোঝালো...হুঁ, তাই। ‘আর আমি যদি কারুর দিকে তাকাই তাহলে?’বলাতে ও হাসি মুখে জবাব দিল... তুমি পারবেই না আমাকে ছেড়ে আর কারুর দিকে তাকাতে। ‘এতো বিশ্বাস?’ জিজ্ঞেস করাতে ও মুখ ঘুরিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল... প্রশ্নটা আমাকে না করে নিজেকে করলেই তো পারো...পাজী কোথাকার...
- হু, বুঝলাম...চলো তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও...
- এই, একটু বাইরে যাও না...
- কেন?
- ধ্যাত, যাও না...
- হুম, লজ্জা করছে?
- এই, তুমি যাবে?
- ভেবেছিলুম একটু দেখবো...সে আর হলো না...
- ইশ, কি শখ, দেখবো...যাও ভাগো...
- মনে থাকে যেন...পরে কিন্তু দেখাতে চাইলেও দেখবো না...
- বয়ে গেছে আমার দেখাতে...
- ঠিক তো?
- এই, তুমি যাবে... না কি আমি ছোড়দিকে ফোন করবো...
‘আচ্ছা বাবা...যাচ্ছি’ বলে ওকে ছেড়ে সরে যেতেই মৌ কি মনে করে বলল...থাক, ওরকম গোমড়া মুখ করে যেতে হবে না...তুমি থাকো তবে দেখা যাবে না কিন্তু...রাজী? অরিত্র হেসে ফেলে বলল...চুরি করেও দেখতে পারবো না? ছোট্ট একটা কিল খেতে হল চুরি করে দেখার ইচ্ছের জন্য আর তার সাথে ওর মিষ্টি করে বলা উঁ হুঁ...শুনতে হল। ‘ওক্কে বাবা, আমি এই সোফাতে এদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসছি, তুমি যা খুশী কর’ বলে অরিত্র মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছিল। এসির হাল্কা আওয়াজের সাথে মাঝে মাঝে ওর হাতের চুড়ির রিন রিন আওয়াজ কানে আসছে...ওকে কথা দিতে হয়েছে তাকাবে না, তাই যতই ইচ্ছে হোক দেখা যাবে না। কি মনে করে মুখ তুলে আয়নার দিকে চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস আটকে গেল... এমন একটা জায়গায় ও পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে যে ও বুঝতেই পারবে না যে এখান থেকে ওকে আয়নার ভেতরে দেখা যাবে। অরিত্র যখন কথা দিয়েছে দেখবে না তো দেখবেই না বুঝে ও নিশ্চিন্তে চুড়িদারটা পরছে...সরু কোমর থেকে আস্তে আস্তে চওড়া হতে শুরু করেছে উপরের দিক, একেবারে নিঁখুত শরীরের গড়ন, যেখানে যেটুকু দরকার সেখানে ঠিক ততটুকুই আছে... টুকটুকে ফর্সা উজ্জ্বল মসৃন ত্বকের উপরে লাল রংয়ের অন্ত্রর্বাসের সরু ফিতে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে গেল আবরনের আড়ালে। চোখ বুজে হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া অপরুপ এক নারী শরীরের রুপে মুগ্ধ হতে হতে ও ভাবছিল...একেই কি বলে দেবভোগ্যা নারী? বুকের উপরে হাত দুটো রেখে এক অজানা অনুভুতিতে বুকের ভেতরটা ভরে তুলতে তুলতে শুনল ওর মিষ্টি গলার ডাক...এই ওঠো...চোখ মেলে তাকালে, মৌ মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর মুখের উপরে ঝুঁকে এসে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার লক্ষী সোনা আমাকে কথা দিয়েছিল...তার জন্য...
মৌ ওকে কেন চুমু দিয়েছে শোনার পর মনে হল, ও তো জানেনা যে আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে না চাইলেও চোখ চলে গিয়েছিল। ও তো আমাকে বিশ্বাস করে... তাহলে কি আমার না বলাটা ঠিক হবে? মৌ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভেবেছে ওর একটা চুমুতে মন ভরেনি,আরো চাই... তাই হাসি মুখে বলল...কি...আরো চাই? ততক্ষনে অরিত্রও ভেবে নিয়েছে কি বলবে, ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল... রাগ করবে না বলো...মৌ ওর সেই মন ভোলানো হাসি মাখা মুখে উত্তর দিল...উঁ হু...
- আমি না তোমাকে দেখে ফেলেছি...
ওকে দেখে ফেলেছে শুনে কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ লুকিয়েছে তারই বুকে যার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কি বলবে বা কি করবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না ও, তারপর ভেবেছে... আচ্ছা আমি তো পেছন ফিরে ছিলাম, তাহলে ও কি করে দেখেছে বলছে? বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে রেখেই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করেছে...সত্যিই দেখেছো?
অরিত্র ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ওরই মতো মৃদু স্বরে বলেছে...সত্যিই দেখেছি...এই তো এই টুকুনি...
ও পিঠের উপরে হাত রেখে কি দেখেছে বললো সেটা বুঝতে পেরে মৌ জিজ্ঞেস করল... আর কিছু না তো?
- উঁ হুঁ...
- তাই? কি করে?
- কি জানি, কি মনে করে আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল...
মৌ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকালো...তখোনো ওর লজ্জা পুরোপুরি না কাটলেও তাকিয়ে থেকে ওর দুচোখে কি যেন খুঁজলো...তারপর যখন বুঝলো ও সত্যিই ইচ্ছে করে কিছু করেনি, আস্তে করে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে আবার একটা চুমু দিল ঠোঁটে...আগের মতোই আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার সোনা আমাকে ঠকাতে চায়নি বলে...
সাড়ে ন-টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়েছে কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় আজ আর সেই গায়ে জ্বালা ধরানো গরম নেই দেখে গাড়ীর এসি চালানো হয়নি। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ধীরে সুস্থে এগোতে এগোতে দুজনের গল্প হচ্ছিল, গল্প বলতে মৌ-ই বেশী কথা বলছে, বেশীর ভাগটাই ওর মামাবাড়ী নিয়ে। ও যে কতোটা খুশী হয়েছে এতদিন পরে এখানে আসতে পেরে তা ওর কথাবার্তা বা শরীরের ভাষা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ওর কথা শুনতে শুনতে পুবালী ফোন করেছে দেখে অরিত্র ওকে ফোনটা দিয়েছে... দুজনে অনেকক্ষন ধরে কি সব কথা বলছে নীচু গলায়...কখোনো হাসছে, কখোনো ওর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে... দুজনের চোখাচুখি হলে হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওদিকে হুঁ হাঁ উত্তর দিচ্ছে দেখে অরিত্র ওকে বলেছে আমার দিকে তাকাতে হবে না, তুমি আগে কথা বলে নাও... মৌ ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে...ও ওদিকে ফোনে ব্যাস্ত দেখে অরিত্র অডিও সিস্টেমটা চালিয়ে দিয়ে আওয়াজ কমিয়ে রেখে দিল যাতে মৌয়ের ফোনে কথা বলতে অসুবিধা না হয়। কিছুক্ষন পর পুবালীর সাথে কথা হয়ে গেলে ফোনটা রেখে দিয়ে মৌ কান পেতে কি গান হচ্ছে শোনার চেস্টা করছে দেখে আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিতে হয়েছে...
Love me tender,
love me sweet,
never let me go.
You have made my life complete,
and I love you so.
Love me tender,
love me true,
all my dreams fulfilled.
For my darlin' I love you,
and I always will.
Love me tender,
love me long,
take me to your heart.
For it's there that I belong,
and we'll never part.
Love me tender,
love me dear,
tell me you are mine.
I'll be yours through all the years,
till the end of time.
When at last my dreams come true
Darling this I know
Happiness will follow you
Everywhere you go.
পুরো গানটা খুব মন দিয়ে শোনার পর মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বলল...এই গানটা কখন শুনতে আরো ভালো লাগবে বলো তো?
- নিস্তব্ধ গভীর রাত...চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে...শুধু আমরা দুজনে ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও... আমার বুকে তুমি মাথা রেখে শুয়ে আছো...আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি। খুব আস্তে আস্তে গানটা বাজছে...তুমি আর আমি শুনছি...
অরিত্র গাড়ী চালাতে চালাতে কথা গুলো বলে একটু পরে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল কেমন যেন আনমনে চুপ করে বসে আছে কোলের উপরে হাতদুটো রেখে...আরো কিছু মুহুর্ত কেটে গেল ওইভাবে...অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ছুঁলে যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে ফিরে এসে লাজুক হেসে নরম গলায় বলল...ভাবছিলাম...