25-02-2019, 12:43 PM
এরপর অরিত্র দাদু আর দুই জেঠুর সাথে ওনাদের ফোনে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই মৌ ওর হারানো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ায় সবাই খুশী ছিল তার উপরে ওনাদের সাথে আলাপ হওয়ায় সবাই আরো খুশী। মৌয়ের দাদু ও মামা দুজনেই চাইছেন বিয়েটা ওনারাই দিতে চান, অরিত্রর দাদু বা জেঠুরা ওনাদের ব্যাপারটা বুঝে আর না করেননি তখনকার মতো, ভেবে রেখেছেন ওনারা এলে সামনা সামনি কথা বলে ব্যাপারটা ঠিক করে নেবেন কারন বিয়েটা যেভাবে হবে ভাবা আছে তাতে খরচের অঙ্কটা বেশ মোটা হবে । তার আগে অবশ্য অরিত্র ওর কে কে আছে, কে কি করে…কোথায় থাকে…মোটামুটি সব বলেছে। ঠিক করা হয়েছে সামনের সপ্তাহের শেষে মামা কোলকাতা এসে অরিত্রর বাড়ী আর সাথে ভবানীপুরের বাড়ীতে যাবেন কথাবার্তা বলার জন্য।
মৌ সেই যে গেছে, লজ্জায় আর এমুখো হয়নি। মাঝে মাসী একবার অরিত্র কিছুক্ষনের জন্য উঠে গেলে ওরা ব্রাম্ভন কিনা খোঁজ নিতে বলায় দাদু বলেছেন ‘তোর বিয়েটা তো জাতপাত সব কিছু দেখে তবে দিয়েছিলাম… পারলি কি সংসার করতে’? মাসী ‘গ্রামের লোকজন কি বলবে…আত্মীয় স্বজনরাই বা কি ভাববে’ বলতে গেলে দাদু খুব রেগে গিয়ে বললেন ‘রাখ তোর আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোক… কিছু হয়ে গেলে কেউ দেখতে তো আসেই না উল্টে মজা লোটে …সব থেকে বড় কথা…মেয়েটা সুখী হবে… আর কিছু দেখার দরকার নেই আমার… তোর ভালো না লাগলে আমার কিছু করার নেই’।
এতদিন পর হঠাৎ বোন এসেছে খবর পেয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে এগারোটা নাগাদ সুমনা ওর ছেলে পাপাইকে নিয়ে আসানসোল থেকে এসেছে, ওর বর আসতে পারেনি অফিসের জরুরী কাজের জন্য। আরো একটু আগে পৌছোতে পারতো কিন্তু রাস্তায় বাসটা খারাপ হয়ে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। মামনের কাছে ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে মৌকে জড়িয়ে ধরে দুবোনের এক প্রস্থ হাসি কান্নার পর দুজনে বসে গল্প করছিল। মৌ এর যখন চার বছর বয়স…ওর মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর বাবার সাথে মামা বাড়ী এসে দু বোনের শেষ দেখা হয়েছিল। এখন কিছু কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সব দিনের কথা একে অপরকে মনে পড়িয়ে দিতে দিতে কখোনো চোখে জল… কখোনো হাসি। গল্প করতে করতে সুমনা উঠে গিয়ে আলমারী খুলে একটা পুতুল বের করে ওকে দেখিয়ে বলল ‘চিনতে পারছিস মৌ’? পুতুলটা দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল…ওর খুব প্রিয় পুতুলটা ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, বাড়ী ফিরে কত মনে পড়তো কিন্তু কোনো উপায় ছিল না ফেরত পাবার…বাবা এত ব্যাস্ত যে একটা তুচ্ছ পুতুলের জন্য আর এত দুরে আসতে পারতো না। তারপর সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গিয়েছিল। পুতুলটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘দিদি…তুই এত যত্ন করে রেখেছিস? একেবারে নতুনের মতো আছে এখোনো। সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘তোর এত সুন্দর পুতুল আছে কিন্তু আমার নেই ভেবে খুব হিংসা হোত…বুঝলি…তুই চলে যাবার আগে ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছিলাম এই ভেবে যে যদি তুই ভুলে যাস…কি খুশী হয়েছিলাম জানিস…তুই যখন চলে গেলি ওটা না নিয়ে… রোজ মাকে লুকিয়ে এক বার করে দেখতাম, তারপর একদিন মা দেখতে পেয়ে কি মার মেরেছিল… কেন আমি মনে করিয়ে দিই নি তোকে… তারপর যখন আর তুই এলি না… পুতুলটা দেখে খুব কষ্ট হোত। মৌ পুতুলটা হাতে নিয়ে এক মনে দেখতে দেখতে বলল ‘মা কিনে দিয়েছিল…খুব ভালো করেছিলি রেখে দিয়ে… একটা পুতুল হলেও কি হয়েছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে তো থেকে গেছে’।
- এই মৌ...নিয়ে যাস কিন্তু এবারে…
- না রে... থাক, তোর কাছে রেখে দে… কত যত্ন করে রেখেছিস এত বছর…
ওদের কথার মাঝে মামন পাপাইকে নিয়ে এসে বলল ‘দেখ না দিদি…কি কাঁদছে…দাদুর কাছেও থাকছে না…ক্ষিধে পেয়েছে বোধ হয়’।
- না…না…এই তো আসার সময় একটা গোটা ক্যাডবেরী খেতে খেতে এল…এখন ওনার খেলা চাই…এই সময়টা আমাদের পাশের বাড়ীর বাপ্পা কলেজ থেকে ফিরে এসে ওর সাথে হুটোপুটি করে।
মৌ পাপাইকে কোলে নিয়ে আদর করে থামাবার চেষ্টা করেও না পেরে মামনকে বলল ‘এক কাজ কর না মামন…ওর কাছে নিয়ে যা…ঠিক চুপ করিয়ে দেবে। সুমনা হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল ‘তাই নাকি…খুব বাচ্চা ভালোবাসে’?
- হবে হয়তো…বাচ্চা আর কুকুর…ওর কাছে যেন অপরিচিত নয়…একবার দেখলেই যেন বন্ধু হয়ে যায়…জানিস তো কাল এসেই লালুর সাথে জমিয়ে নিয়েছে।
মামন চলে যাবার পর সুমনা চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘এই…মৌ…এই ও-টা কে রে? কেমন যেন একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। মৌ হাসি হাসি মুখে বলল ‘কেউ একটা হবে হয়তো’।
- যাই বল…দারুন জুটিয়েছিস কিন্তু…যেমন দেখতে…তেমনি চেহারা…
- হুমম…লোভ হচ্ছে নাকি রে দিদি?
- তা…যদি তোর ভাগ দিতে অসুবিধা না থাকে…আমার নিতে কি ক্ষতি আছে… বলে হেসে ফেলল সুমনা।
- আ-চ্ছা…খুব শখ…তাই না… পুতুল নিয়েছিস… কিচ্ছু বলিনি…এটায় কিন্তু ভাগ বসাতে দিচ্ছিনা…তবে…পুরোনো হয়ে গেলে না হয়…ভেবে দেখতে পারি…
- না বাবা…থাক…তোর জিনিষ তোর কাছে…আমার যা আছে সেটাই ভালো…
- এই দিদি…তোরটা কেমন রে?
- ভালোই…তবে…তোরটার মতো এত হ্যান্ডসাম নয়…
দুবোনে গল্প করতে করতে খুব হাসছিল, মামন ফিরে এসে বলল ‘দিদি… ঠিকই বলেছিলে গো…সত্যিই চুপ করিয়ে দিয়েছে…দেখবে চলো কেমন সুন্দর খেলছে’।
দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। সবাই বলতে দাদু, মামা আর ওদের চার ভাই বোনের সাথে অরিত্র। মাসী আর মামীমা পরিবেশনে ব্যাস্ত। পাপাইকে নিয়ে গিয়ে দিদা ঘুম পাড়াচ্ছে। মামীমা আরো একটু ভাত দিতে গেলে অরিত্র প্রায় থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল ‘মামীমা…সত্যি বলছি আর পারবো না। তারপরেও মামীমা জোর করতে গেলে মামা হেসে ফেলে বারন করে বললেন ‘আরে…ছেড়ে দাও…দেখছো না কেমন থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না বলছে। মামীমা হেসে ফেলে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে… অরিত্র…কিছু মনে কোরোনা…তোমরা কি এদেশীয় নাকি ওপার বাংলার? অরিত্র একটু মজা করে বলল ‘খাঁটি নয় মামীমা…ভেজাল আছে। ওর কথা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে ফেললে বলল… ‘আমার দাদু এদেশীয়…দিদান ওপার বাংলা…তবে দিদান কোনোদিন যায়নি…এখানেই জন্ম আর বাবার আদি বাড়ী হুগলী…তো…আমি ভেজাল ছাড়া আর কি। দাদু হাসতে হাসতে বললেন ‘তাহলে ওপার বাংলার ভাগটা খুবই কম…বেশির ভাগটাই এদিকের…তাই তো’? অরিত্রও হাসতে হাসতে বলল ‘আমারও তাই মনে হয়’।
- তা তোমাদের বাড়ীতে রান্না বান্না কি ধরনের হয়…এদিকের নাকি ওদিকের?
- বোঝা খুব মুশকিল…ইলিশ আর চিংড়ি দুটোই হয়…তবে মনে হয় এদিকের ভাগটাই বেশী…দিদানের বাবার ট্রান্সফারের চাকরী ছিল… দু তিন বছর অন্তর জায়গা পালটাতে হোতো বলে দিদানের মায়ের অসুবিধার জন্য নাকি রাঁধুনি ছিল…মেদিনীপুরের লোক…
সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘মা…এখন তোমার ঘটি না বাঙ্গাল জেনে কি হবে…পছন্দ না হলে কি পালটানো যাবে নাকি… আমার বেলায় না হয় আগে থেকে ঘটি না হলে বিয়েই দেবে না জ়েদ ধরে বসেছিলে…মৌ এর বেলা তো আর তা হবে না’।
- ওমা…তাই বলে কি জানতে ইচ্ছে হবে না? অরিত্র্, তুমি কিছু মনে করনি তো?
- না না… মনে করার কি আছে…
সুমনা আসায় মামন আজ মৌ দিদির সাথে শুতে পায়নি…মুখ ভার করে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়েছে। সুমনা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল আর ওদিকে মৌ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে …আজ বোধহয় পূর্নিমা…চারদিক মিষ্টি জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ফ্যানটা এত আস্তে ঘুরছে যে হাওয়া আছে কিনা বোঝা না গেলেও জানলা দিয়ে ঝির ঝির করে দখিনা হাওয়া ঘরের ভেতরে এসে যেন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে যাচ্ছে। সুমনা পাপাইকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল ‘কি রে মৌ… এত চুপচাপ…কি ভাবছিস’?
- চাঁদের আলোয় বাইরেটা কি সু্ন্দর লাগছে …তাই না… সত্যি গ্রামে না এলে প্রকৃতিকে ঠিক মতো চেনা যায় না…
- বুঝেছি…চাঁদের আলো দেখছিস শুধু নাকি আর একজনের কথা ভাবছিস রে? কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে…তাই না রে?
- এই দিদি…তুই না খালি পেছনে লাগিস...
- আচ্ছা বাবা…আয়…শুয়ে শুয়ে গল্প করবো…
দিদির হাতটা জড়িয়ে ধরে মৌ চুপচাপ শুয়ে ছিল। সুমনা ওর খুব কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল ‘এই মৌ…কেমন পারে রে’? মৌ ওর প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ‘কি’?
- আহা…ন্যাকা…কি আবার…কেমন করতে পারে?
মৌ ভীষন লজ্জা পেয়ে গিয়ে ভাবছিল…ইস দিদিটা যে কি… কি সব জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের পর মেয়েদের বোধহয় মুখে কিছু আটকায় না। সুমনা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ‘খুব ভালো…তাই না’?
- কি করে বলবো?
- এই বল না…আমি কি ভাগ বসাবো নাকি? তোর জিনিষ বাবা তোরই থাকবে…
- জানি না রে…কিছু হলে তো বলবো কেমন…
- ধুস…কিছু নাকি হয়নি…আজকাল গ্রামেই সব কিছু হচ্ছে…আর তোরা শহরে একই বাড়ীতে থাকিস…আর কিছু করিস নি…বললেই হোলো…
- সত্যি বলছি রে দিদি…বিশ্বাস কর,কিছু হয়নি…ও ওরকম নয়…
- হুমম…করলাম…তাহলে কি শুধু চুমু খেয়েছে…আর…হাত দিয়েছে… তাই তো?
- শুধু প্রথমটা…
- এই মৌ…আমি কিন্তু আর বিশ্বাস করতে পারছি না…এই বল না…
- সত্যি বলছি…
- তোর ইচ্ছে করে না?
- কি জানি…তেমন কিছু না…
- ওকে দেখে বুঝতে পারিস না? হয়তো তুই না করে দিবি ভেবে ইচ্ছে থাকলেও এগোয় না...
- তেমন কিছু মনে হয়নি…বিশ্বাস কর…
- ঠিক আছে বাবা…করলাম…
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৌ দিদিকে ডাকলো ‘এই…দিদি’
- কি?
মৌ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সুমনা বলল ‘বল না…কি বলবি’।
- প্রথম প্রথম খুব লাগে…তাই না?
সুমনা বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘একটু তো লাগবেই…তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই’।
- তাই? ঠিক বলছিস?
- অবশ্য ছেলেদের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে…
দিদির কথা শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘এই দিদি…তোর লাগেনি’?
- উঁ…
- বল না দিদি…
- লেগেছিল…
মৌকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনা তারপরেই ফিসফিস করে বলল… খুব লেগেছিল…তবে ভালো। মৌ দিদির বুকে মুখ গুঁজ়ে চুপ করে শুয়ে কিছু একটা হয়তো ভাবছিল, সুমনা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল ‘এই…মৌ’
- উঁ…
- তোরা নাকি কাল চলে যাবি?
- হ্যাঁ…সোমবার ওর অফিস আছে।
- আর একটা দিন থাক না… কতদিন পর দেখা হল…
- আমারও তো ইচ্ছে করছে…দেখি বলে দেখবো…
- এই…শোন না…ভালো করে বলবি কিন্তু…
- আচ্ছা…
- এই মৌ...
- হু...
- তোর কথা শুনবে তো?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজের মনেই যেন বলল... জানিস তো দিদি, মা যে আমাকে দেখতে পারতো না তাতে আমার আর একটুও দুঃখ হয় না। সেদিন যদি বাড়ী থেকে না বেরিয়ে আসতাম তাহলে কি ওর সাথে কোনোদিন দেখা হত...
বোন কি বলতে চেয়েছে ওর প্রশ্নের উত্তরে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সুমনা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সত্যিই তোর কপালটা ভালো রে, সেদিন যদি ওর জায়গায় অন্য কারুর হাতে পড়তিস তাহলে কি হতে পারতো ভাবতেই ভয় লাগে। মৌ আস্তে করে বলল... ওর কাছে থাকলে আমার কেন জানি না... মনে হয় আর কোনো ভয় নেই...যাই হোক না কেন ও আমাকে ঠিক আগলে রাখবে...
পরের দিন সকালে অরিত্র ফিরে যাওয়ার কথা তুলতেই মামীমা এক কথায় নাকচ করে দিয়ে বলল…না…না…তা কি করে হয়। এতদিন পরে মেয়েটা এসেছে, অন্তত আর একটা দিন থাকতেই হবে। মামীমা এত আন্তরিকভাবে থাকার কথা বলল যে না বলার কোনো উপায় ছিল না, তবুও একবার শেষ চেস্টা করতে গিয়ে মৌয়ের দিকে তাকালে ও এমনভাবে ‘আমি কি জানি ...তুমি দেখো কি করবে’ বলল যে তাতে পরিস্কার হয়ে গেল ওর থাকার ইচ্ছেটাই বেশী। আর কিছু করার নেই দেখে অরিত্র থাকতে রাজী হয়ে যেতে মামীমা বলল... যাও না আজ সবাই মিলে শুশুনিয়া পাহাড় দেখে এসো। মামন পাশেই ছিল, মায়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল... হ্যাঁ মা, খুব ভালো হবে। অর্ক তো শুনেই লাফাতে শুরু করে দিল...পাহাড় দেখার থেকে ওর বেশী আনন্দ হচ্ছে গাড়ীতে করে ঘুরতে যেতে পারবে।
সাড়ে এগারোটা মতো বাজে। অরিত্রর সাথে পাপাই আর অর্ক, দূর্গামন্ডপের মেঝেতে তিন অসমবয়সীর খেলা চলছে জোর কদমে...আরো একজন অবশ্য সাথে আছে, সে হল লালু। অরিত্রর বুকের উপরে চেপে বসে পাপাই নাচন কোদন চালিয়ে যাচ্ছে সমানে, নাচন কোদনের সাথে চলছে চিল চিৎকার। মাঝে মাঝে অর্ক আর পাপাইয়ের গলার আওয়াজ এত বেড়ে যাচ্ছে যা লালুও থাকতে না পেরে ওদের সাথে গলা মেলাচ্ছে ভো-উ-উ ভো-উ-উ করে। মাঝে একবার দিদা এসে লালুকে মন্দীরের চাতালে দেখতে পেয়ে তাড়া করতে গেলে লালু দৌড়ে গিয়ে দূর্গা প্রতিমার কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে পড়লে দিদা আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুমা স্নান না করে মন্ডপে উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে অর্ক বক দেখিয়ে বলেছে
পা-র-বে না...পা-র-বে না...লালুকে তাড়াতে পারবে নাআআআআ... নাতির সাথে না পেরে ঠাকুমা নিজের মনে বকতে বকতে ফিরে গেলে পর লালু বেরিয়ে এসে লেজ নাড়াতে নাড়াতে যেন অর্ককে বলতে চেয়েছে...ভাগ্যিস ঠাকুমাকে ভাগিয়ে দিলে...না হলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিতো...
একটু পরে মামন এসে তাড়া লাগালো...অরিত্রদা...দিদি ডাকছে, এখুনি চলো। একটু পরে তিন মুর্তিমানকে ধুলো মাখা অবস্থায় দেখে ওদের তিন বোনের হাসি যেন আর থামে না। ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে পাপাইও কিছু না বুঝে ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছে দেখে অরিত্র নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে বলল... কি হয়েছে বাবা এত হাসির, একটু না হয় ধুলো লেগেছে। মৌ মুখে হাত আড়াল করে হাসি চাপতে চাপতে বলল... একটু ধুলো? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো একবার। ওদিক থেকে সুমনা থাকতে না পেরে বলল... এই, চল তো তিনটেকে পুকুরে নিয়ে যাই। সবাই মিলে পুকুরে স্নান করতে যাবে শুনে অর্ক হৈ হৈ করে উঠে লাফাতে শুরু করলে সুমনা ভাইকে আদরের বকুনি দিয়ে বলল...এই বাঁদর...আর লাফাতে হবে না...দাদাকে নিয়ে যা, আমরা আসছি...বুঝলি?
পুকুরটা বেশ বড়ই...টলটলে পরিস্কার নীল জল...ঘাটের পাশেই একটা বেশ ঝাঁকড়া আম গাছ থাকায় ছায়া হয়ে আছে জায়গাটা। শান বাধানো ঘাটে বসে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে পাপাইকে জলে দাঁড় করিয়ে ধরে রাখতে হয়েছে, যা ছটপটে ছেলে হাত ফসকে কখন জলে পড়ে যাবে তার ঠিক নেই। অর্ক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে গিয়ে পাপাইয়ের দিকে জল ছেটালে পাপাইও ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মামার দিকে জল ছেটাবার চেস্টা করে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ওদের মামা ভাগ্নের জল কেলী চলতে চলতে একটু পরেই ওরা তিন বোন চলে এলো সাজগোজ করে। টাইট চুড়িদার পরে ওড়না বুকের উপর দিয়ে নিয়ে এসে কোমরে গিঁট মেরে বেঁধে রেখেছে যাতে খুলে না যায়। ওরা এসে যেতেই অর্ক ঝাঁপ দিলো জলে... জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেই পাপাইকে আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না...ওকেও মামার মতো জলে নামতে দিতে হবে। সুমনা জলে নামতে নামতে ওকে সাঁতার জানে কিনা জিজ্ঞেস করায় অরিত্র উত্তর দিলো... জানি, তবে অনেক দিন হয়ে গেল জলে নামা হয়নি। মৌ জলে পা ডুবিয়ে জল ছেটাতে ছেটাতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...সত্যি তুমি সাঁতার জানো? অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... চলো, তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দি আজ। মৌ হাত দিয়ে একটু জল ওর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল... ধ্যাত, কেউ এসে গেলে? ওদিকে ওরা দু বোনে গলা অব্দি জলে নেমে মৌকে ডাকাডাকি করলেও কিছুতেই যাবে না দেখে অরিত্র পাপাইকে কোলে নিয়ে কিছুটা জলে নেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালে মৌ কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উঠে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোঝালো ওকে ধরতে হবে। এক একটা করে ধাপ নিচে নামতে নামতে কখন ও অরিত্রকে জড়িয়ে ধরেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মৌ ভালো করে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেও ভয় পাচ্ছে দেখে অরিত্র আস্তে করে বলল... আমি ধরে আছি তো, কিছু হবে না। মৌ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আস্তে করে বলল... কি করবো ভয় করলে...
বুক পর্যন্ত জলে নেমে ও আর কিছুতেই নামবে না দেখে অরিত্র ওখানেই দাঁড়িয়ে গেছে... একটু একটু করে ভয় কেটে গিয়ে মৌ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক...ওদের ভাইবোনের সাঁতার কাটা দেখতে দেখতে পাপাইয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল... এই যে দুষ্টু ছেলে, মামার কোলে খুব আদর খাওয়া হচ্ছে...না। পাপাই মাসির গালে ওর ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে খামচানোর চেস্টা করতে করতে উত্তরটা দিল ওর অবোধ্য ভাষায়। অরিত্র হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল...কিছু বুঝলে? মৌ পাপাইকে আরো একটা চুমু দিয়ে আস্তে করে বলল...বুঝেছি, ও বলছে...মামা তো আর একা আমাকে আদর করে না...তোমাকেও তো করে।
একটু পরেই সুমনা ফিরে এসে পাপাইকে নিয়ে গেছে স্নান করিয়ে বাড়ীতে দিয়ে আসতে না হলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে আর অরিত্ররও আর স্নান করা হবে না। মামন আর অর্ক ওদিকে কে আগে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে গিয়ে ফিরে আসতে পারবে দেখাতে গিয়ে সাঁতরাতে শুরু করেছে, এখন আর কেউ নেই ওরা কি করছে দেখার... অরিত্র ওকে আস্তে করে বলল...এই, নাকটা চেপে ধরো না এখুনি। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নাক চেপে ধরলে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভালো করে ধরে টুপ করে জলে ডুব দিয়েছে... হঠাৎ করে ওইভাবে জলে ডুব দেওয়ায় মৌ ভীষন ভয় পেয়ে গিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে...ওর আর কিছু বোঝার মতো অবস্থা ছিল না... একটু পরে যখন জলের ভেতর থেকে উঠে এলো দুজনে, ততক্ষনে মৌ বুঝেছে কি হয়েছে... ভালো করে নিশ্বাস নিতে নিতে ওর বুকে গোটা কয়েক দুমদাম করে কিল মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলেছে...পাজী কোথাকার। অরিত্র কিছু না বলে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল...তোমার ভালো লাগেনি? ততক্ষনে মৌ একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে...ভাইবোন তখোনো সাঁতার কেটে যাচ্ছে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল... আগে থেকে তো বলবে। অরিত্র এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল...তাহলে আর একবার? মৌ দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি মুখে ঘাড় কাত করে বুঝিয়েছে ওর কোনো আপত্তি নেই। আগে থেকে জানা থাকায় বুক ভরে হাওয়া নিয়ে এবারের অদৃশ্য হওয়াটা আরো বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে...ওরাই জানে ঠিক কি কি হয়েছে সবার চোখের আড়ালে...
দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। পেছনের সিটে ওরা তিন বোন, সামনে অর্কর কোলে পাপাই। দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে বিকেলে ঝড় বৃষ্টি হলেও হতে পারে। সারা রাস্তাটা লাল কৃষ্ণচুড়া ফুলের গাছে ভরা। প্রায় সব কটা গাছই ফুলে ফুলে ছয়লাপ...যেন মনে হচ্ছে আগুন লেগেছে... মৌ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে দিদিকে উদ্দেশ্য করে বলল... এই দিদি, কি সুন্দর লাগছে না... সুমনা ওর বোনের হাতে আস্তে করে চিমটি কেটে কানে কানে বলছে...ভালো তো লাগবেই...তোর মনে যে এখন বসন্ত। রাস্তার ধার দিয়ে কয়েক জনের একটা দল ঝুড়ি কোদাল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে... মেয়েদের কাপড় হাঁটুর ঠিক নীচে আর ছেলেদের কোমরে শুধুমাত্র এক চিলতে একটা গামছা... মৌ ওদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে সুমনা হেসে ফেলে বলল... বাব্বা, ওরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন রে... দেখে বুঝতে পারছিস না ওরা সাঁওতাল...কোথাও থেকে কাজ করে ফিরছে... অরিত্রর কানে ওদের কথা গেলে একটু উদাস হয়ে যেন গেয়ে উঠল... যেখানে কৃষ্ণচুড়া লালে লাল... যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল... সুমনা খুব মন দিয়ে ওর গাওয়া গানের কলিটা শুনে বলল...এই, অরিত্রদা তুমি পুরো গানটা জানো? অরিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল... সুরটা মনে আছে...কথা গুলো সবটা বোধহয় মনে করতে পারবো না। মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে যেন মনে করার চেস্টা করে গুন গুন করে গানটা গাওয়ার চেস্টা করছিল, একটু পরেই সুমনা খুব খুশী হয়ে বলল... এই মনে পড়েছে, দাঁড়াও আমি গাইছি...হাসবে না কিন্তু, আমার যা গলা...
ওরা দুবোনে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলে মামনও গলা মেলালো ওদের সাথে...
চলো রীনা, ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে মেখে মেখে
লাল কাঁকরের পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাই...
বলো যাবে কিনা
সোনা রোদ ঝিক মিক দেখো বালু চিক চিক
ছোট্ট নদী খোয়াই পার হয়ে যাই
যেখানে কৃষ্ণ চুড়া লালে লাল
যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল
আরো দূরে ঘুরে ঘুরে চলো না হেঁটে আসি
চলো না পাশাপাশি...
ওদের গাওয়া শেষ হলে মামন মৌয়ের কানে কানে কিছু বলতেই ও বোনের হাতে চিমটি কেটে আস্তে করে বলল...খুব ফাজিল হয়ে গেছিস... দাঁড়া তোর অরিত্রদাকে বলে তোর জন্য একটা বেশ ভালো দেখে ছেলে খুঁজতে হবে যাতে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে যেতে পারিস। মামন দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল...ইস...আমি কি আমার জন্য বললাম নাকি... ওদের ফিসফিসানি শুনে সুমনা ওদের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল...এই কি এত গোপন কথা হচ্ছে রে তোদের? মৌ হেসে ফেলে বলল... আমাদের ছোটদের কথায় কান দিবি না দিদি। ‘ইস, কি আমার ছোট রে, এদিকে উনি প্রেম করছেন আর নাকি ছোট’ বলতেই মৌ হেসে ফেলেছে ...সাথে সাথে ওরা দুবোনেও হাসতে শুরু করলে অরিত্র হাসির কারন বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বোকার মতো ওদের দিকে তাকালো দেখে মৌ হাসতে হাসতে বলল...এই, তুমি গাড়ী চালাও...মেয়েদের দিকে তাকাবার খুব শখ... না। নেহাত অর্ক সাথে আছে, না হলে বেশ জমিয়ে একটা উত্তর দেওয়া যেত ভাবতে ভাবতে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... হুম, আমি তো এখন তোমার ড্রাইভার...
শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে গাড়ী রেখে ওরা সবাই এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। খুব একটা উঁচু নয় পাহাড়টা, বরং সবুজে সবুজে ভরা বড় সড় টিলা বলা যেতে পারে... অর্ক দিদির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে ওকে ছোট্ট ঝরনা দেখাতে, মামনও গেছে ওদের সাথে...এদিকে পাপাই কিছুতেই মায়ের কোলে থাকবে না, ওর এখন মামার কোলে উঠা চাই। অরিত্র ওর লাফালাফি দেখে হেসে ফেলে ওকে কোলে নিয়ে সুমনার সাথে কথা বলতে বলতে ওরা তিন ভাইবোন ফিরে এলো। মৌ বাচ্চাদের মতো খুশীতে ঝলমল করতে করতে বলল...এই, চলো না...কি সুন্দর মিষ্টি জল...
অরিত্রর কোলে পাপাই, ওর আর এক হাত মৌ চেপে ধরে রেখেছে শক্ত করে, সরু পাহাড়ী পায়ে চলা সুঁড়ি পথে এক সাথে উঠতে গিয়ে ওরা একেবারে পাশাপাশি। ওদের আগে আগে সুমনারা তিন ভাই বোন... মৌ মাঝামাঝি আসার পর বসে পড়ে বলল...এই হাঁপিয়ে গেছি, একটু বসি? ওকে বসতে দেখে অরিত্রকেও ওর পাশে বসতে হল পাপাইকে কোলে নিয়ে ...পাপাই ওর কোলে মুখোমুখি বসে ওর ছোট্ট ছোট্ট নরম হাতে ওকে আদর করতে চাইছে...অরিত্র ওর নাকে আলতো ভাবে নাক লাগিয়ে আদর করে বলল...উমম...সোনা ছেলে...একটুও কাঁদে না ... মৌ অরিত্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে থেকে হাসি মুখে ওদের দুজনের খেলা দেখতে দেখতে বলল... একদম দুষ্টু ছেলে...আমার কাছে এলে ওনার যত কান্না...আমি কি কামড়ে দি? অরিত্র পাপাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সোনা, মাসীকে বলে দাও তো...তুমি কত্তো ভালোবাসো মাসীকে... তারপরে ওর কানে কানে বলেছে...তোমার কাছেও কাঁদবে না যদি তুমি আমাকে যেমন করে আদর কর, তেমনি করে... ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পিঠের উপরে দুম করে একটা কিল পড়ল আর তার সাথে মিষ্টি বাক্যবান...তুমি না খুব অসভ্য...তুমি আর ও এক? অরিত্র হাসতে হাসতে বলল... এই দেখো, আমি তো শুধু আদরটা কতটা মন দিয়ে করতে হবে তাই বলেছি। ওদেরকে বসে পড়তে দেখে সুমনা আর মামন ফিরে আসছে দেখে মৌ একটু সরে বসল...ওরা কাছে এলে মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে বলল... হাঁপিয়ে গেছি রে দিদি, একটু দম নিয়ে নি। সুমনা ওর গা ঘেঁষে বসে কানে কানে বলল... এত তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে গেলে খেলবি কি করে রাতে? মৌ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেও দিদিকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল... তোর থেকে শিখে নেব...বুঝলি। সুমনাও কম যায় না, হেসে ফেলে বোনের কানে কানে বলেছে... প্রাক্টিক্যালটা কি তোর জামাইবাবুর সাথে নাকি তোর ওর সাথে করতে হবে আমাকে?
মৌ সেই যে গেছে, লজ্জায় আর এমুখো হয়নি। মাঝে মাসী একবার অরিত্র কিছুক্ষনের জন্য উঠে গেলে ওরা ব্রাম্ভন কিনা খোঁজ নিতে বলায় দাদু বলেছেন ‘তোর বিয়েটা তো জাতপাত সব কিছু দেখে তবে দিয়েছিলাম… পারলি কি সংসার করতে’? মাসী ‘গ্রামের লোকজন কি বলবে…আত্মীয় স্বজনরাই বা কি ভাববে’ বলতে গেলে দাদু খুব রেগে গিয়ে বললেন ‘রাখ তোর আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোক… কিছু হয়ে গেলে কেউ দেখতে তো আসেই না উল্টে মজা লোটে …সব থেকে বড় কথা…মেয়েটা সুখী হবে… আর কিছু দেখার দরকার নেই আমার… তোর ভালো না লাগলে আমার কিছু করার নেই’।
এতদিন পর হঠাৎ বোন এসেছে খবর পেয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে এগারোটা নাগাদ সুমনা ওর ছেলে পাপাইকে নিয়ে আসানসোল থেকে এসেছে, ওর বর আসতে পারেনি অফিসের জরুরী কাজের জন্য। আরো একটু আগে পৌছোতে পারতো কিন্তু রাস্তায় বাসটা খারাপ হয়ে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। মামনের কাছে ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে মৌকে জড়িয়ে ধরে দুবোনের এক প্রস্থ হাসি কান্নার পর দুজনে বসে গল্প করছিল। মৌ এর যখন চার বছর বয়স…ওর মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর বাবার সাথে মামা বাড়ী এসে দু বোনের শেষ দেখা হয়েছিল। এখন কিছু কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সব দিনের কথা একে অপরকে মনে পড়িয়ে দিতে দিতে কখোনো চোখে জল… কখোনো হাসি। গল্প করতে করতে সুমনা উঠে গিয়ে আলমারী খুলে একটা পুতুল বের করে ওকে দেখিয়ে বলল ‘চিনতে পারছিস মৌ’? পুতুলটা দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল…ওর খুব প্রিয় পুতুলটা ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, বাড়ী ফিরে কত মনে পড়তো কিন্তু কোনো উপায় ছিল না ফেরত পাবার…বাবা এত ব্যাস্ত যে একটা তুচ্ছ পুতুলের জন্য আর এত দুরে আসতে পারতো না। তারপর সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গিয়েছিল। পুতুলটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘দিদি…তুই এত যত্ন করে রেখেছিস? একেবারে নতুনের মতো আছে এখোনো। সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘তোর এত সুন্দর পুতুল আছে কিন্তু আমার নেই ভেবে খুব হিংসা হোত…বুঝলি…তুই চলে যাবার আগে ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছিলাম এই ভেবে যে যদি তুই ভুলে যাস…কি খুশী হয়েছিলাম জানিস…তুই যখন চলে গেলি ওটা না নিয়ে… রোজ মাকে লুকিয়ে এক বার করে দেখতাম, তারপর একদিন মা দেখতে পেয়ে কি মার মেরেছিল… কেন আমি মনে করিয়ে দিই নি তোকে… তারপর যখন আর তুই এলি না… পুতুলটা দেখে খুব কষ্ট হোত। মৌ পুতুলটা হাতে নিয়ে এক মনে দেখতে দেখতে বলল ‘মা কিনে দিয়েছিল…খুব ভালো করেছিলি রেখে দিয়ে… একটা পুতুল হলেও কি হয়েছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে তো থেকে গেছে’।
- এই মৌ...নিয়ে যাস কিন্তু এবারে…
- না রে... থাক, তোর কাছে রেখে দে… কত যত্ন করে রেখেছিস এত বছর…
ওদের কথার মাঝে মামন পাপাইকে নিয়ে এসে বলল ‘দেখ না দিদি…কি কাঁদছে…দাদুর কাছেও থাকছে না…ক্ষিধে পেয়েছে বোধ হয়’।
- না…না…এই তো আসার সময় একটা গোটা ক্যাডবেরী খেতে খেতে এল…এখন ওনার খেলা চাই…এই সময়টা আমাদের পাশের বাড়ীর বাপ্পা কলেজ থেকে ফিরে এসে ওর সাথে হুটোপুটি করে।
মৌ পাপাইকে কোলে নিয়ে আদর করে থামাবার চেষ্টা করেও না পেরে মামনকে বলল ‘এক কাজ কর না মামন…ওর কাছে নিয়ে যা…ঠিক চুপ করিয়ে দেবে। সুমনা হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল ‘তাই নাকি…খুব বাচ্চা ভালোবাসে’?
- হবে হয়তো…বাচ্চা আর কুকুর…ওর কাছে যেন অপরিচিত নয়…একবার দেখলেই যেন বন্ধু হয়ে যায়…জানিস তো কাল এসেই লালুর সাথে জমিয়ে নিয়েছে।
মামন চলে যাবার পর সুমনা চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘এই…মৌ…এই ও-টা কে রে? কেমন যেন একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। মৌ হাসি হাসি মুখে বলল ‘কেউ একটা হবে হয়তো’।
- যাই বল…দারুন জুটিয়েছিস কিন্তু…যেমন দেখতে…তেমনি চেহারা…
- হুমম…লোভ হচ্ছে নাকি রে দিদি?
- তা…যদি তোর ভাগ দিতে অসুবিধা না থাকে…আমার নিতে কি ক্ষতি আছে… বলে হেসে ফেলল সুমনা।
- আ-চ্ছা…খুব শখ…তাই না… পুতুল নিয়েছিস… কিচ্ছু বলিনি…এটায় কিন্তু ভাগ বসাতে দিচ্ছিনা…তবে…পুরোনো হয়ে গেলে না হয়…ভেবে দেখতে পারি…
- না বাবা…থাক…তোর জিনিষ তোর কাছে…আমার যা আছে সেটাই ভালো…
- এই দিদি…তোরটা কেমন রে?
- ভালোই…তবে…তোরটার মতো এত হ্যান্ডসাম নয়…
দুবোনে গল্প করতে করতে খুব হাসছিল, মামন ফিরে এসে বলল ‘দিদি… ঠিকই বলেছিলে গো…সত্যিই চুপ করিয়ে দিয়েছে…দেখবে চলো কেমন সুন্দর খেলছে’।
দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। সবাই বলতে দাদু, মামা আর ওদের চার ভাই বোনের সাথে অরিত্র। মাসী আর মামীমা পরিবেশনে ব্যাস্ত। পাপাইকে নিয়ে গিয়ে দিদা ঘুম পাড়াচ্ছে। মামীমা আরো একটু ভাত দিতে গেলে অরিত্র প্রায় থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল ‘মামীমা…সত্যি বলছি আর পারবো না। তারপরেও মামীমা জোর করতে গেলে মামা হেসে ফেলে বারন করে বললেন ‘আরে…ছেড়ে দাও…দেখছো না কেমন থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না বলছে। মামীমা হেসে ফেলে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে… অরিত্র…কিছু মনে কোরোনা…তোমরা কি এদেশীয় নাকি ওপার বাংলার? অরিত্র একটু মজা করে বলল ‘খাঁটি নয় মামীমা…ভেজাল আছে। ওর কথা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে ফেললে বলল… ‘আমার দাদু এদেশীয়…দিদান ওপার বাংলা…তবে দিদান কোনোদিন যায়নি…এখানেই জন্ম আর বাবার আদি বাড়ী হুগলী…তো…আমি ভেজাল ছাড়া আর কি। দাদু হাসতে হাসতে বললেন ‘তাহলে ওপার বাংলার ভাগটা খুবই কম…বেশির ভাগটাই এদিকের…তাই তো’? অরিত্রও হাসতে হাসতে বলল ‘আমারও তাই মনে হয়’।
- তা তোমাদের বাড়ীতে রান্না বান্না কি ধরনের হয়…এদিকের নাকি ওদিকের?
- বোঝা খুব মুশকিল…ইলিশ আর চিংড়ি দুটোই হয়…তবে মনে হয় এদিকের ভাগটাই বেশী…দিদানের বাবার ট্রান্সফারের চাকরী ছিল… দু তিন বছর অন্তর জায়গা পালটাতে হোতো বলে দিদানের মায়ের অসুবিধার জন্য নাকি রাঁধুনি ছিল…মেদিনীপুরের লোক…
সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘মা…এখন তোমার ঘটি না বাঙ্গাল জেনে কি হবে…পছন্দ না হলে কি পালটানো যাবে নাকি… আমার বেলায় না হয় আগে থেকে ঘটি না হলে বিয়েই দেবে না জ়েদ ধরে বসেছিলে…মৌ এর বেলা তো আর তা হবে না’।
- ওমা…তাই বলে কি জানতে ইচ্ছে হবে না? অরিত্র্, তুমি কিছু মনে করনি তো?
- না না… মনে করার কি আছে…
সুমনা আসায় মামন আজ মৌ দিদির সাথে শুতে পায়নি…মুখ ভার করে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়েছে। সুমনা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল আর ওদিকে মৌ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে …আজ বোধহয় পূর্নিমা…চারদিক মিষ্টি জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ফ্যানটা এত আস্তে ঘুরছে যে হাওয়া আছে কিনা বোঝা না গেলেও জানলা দিয়ে ঝির ঝির করে দখিনা হাওয়া ঘরের ভেতরে এসে যেন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে যাচ্ছে। সুমনা পাপাইকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল ‘কি রে মৌ… এত চুপচাপ…কি ভাবছিস’?
- চাঁদের আলোয় বাইরেটা কি সু্ন্দর লাগছে …তাই না… সত্যি গ্রামে না এলে প্রকৃতিকে ঠিক মতো চেনা যায় না…
- বুঝেছি…চাঁদের আলো দেখছিস শুধু নাকি আর একজনের কথা ভাবছিস রে? কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে…তাই না রে?
- এই দিদি…তুই না খালি পেছনে লাগিস...
- আচ্ছা বাবা…আয়…শুয়ে শুয়ে গল্প করবো…
দিদির হাতটা জড়িয়ে ধরে মৌ চুপচাপ শুয়ে ছিল। সুমনা ওর খুব কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল ‘এই মৌ…কেমন পারে রে’? মৌ ওর প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ‘কি’?
- আহা…ন্যাকা…কি আবার…কেমন করতে পারে?
মৌ ভীষন লজ্জা পেয়ে গিয়ে ভাবছিল…ইস দিদিটা যে কি… কি সব জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের পর মেয়েদের বোধহয় মুখে কিছু আটকায় না। সুমনা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ‘খুব ভালো…তাই না’?
- কি করে বলবো?
- এই বল না…আমি কি ভাগ বসাবো নাকি? তোর জিনিষ বাবা তোরই থাকবে…
- জানি না রে…কিছু হলে তো বলবো কেমন…
- ধুস…কিছু নাকি হয়নি…আজকাল গ্রামেই সব কিছু হচ্ছে…আর তোরা শহরে একই বাড়ীতে থাকিস…আর কিছু করিস নি…বললেই হোলো…
- সত্যি বলছি রে দিদি…বিশ্বাস কর,কিছু হয়নি…ও ওরকম নয়…
- হুমম…করলাম…তাহলে কি শুধু চুমু খেয়েছে…আর…হাত দিয়েছে… তাই তো?
- শুধু প্রথমটা…
- এই মৌ…আমি কিন্তু আর বিশ্বাস করতে পারছি না…এই বল না…
- সত্যি বলছি…
- তোর ইচ্ছে করে না?
- কি জানি…তেমন কিছু না…
- ওকে দেখে বুঝতে পারিস না? হয়তো তুই না করে দিবি ভেবে ইচ্ছে থাকলেও এগোয় না...
- তেমন কিছু মনে হয়নি…বিশ্বাস কর…
- ঠিক আছে বাবা…করলাম…
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৌ দিদিকে ডাকলো ‘এই…দিদি’
- কি?
মৌ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সুমনা বলল ‘বল না…কি বলবি’।
- প্রথম প্রথম খুব লাগে…তাই না?
সুমনা বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘একটু তো লাগবেই…তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই’।
- তাই? ঠিক বলছিস?
- অবশ্য ছেলেদের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে…
দিদির কথা শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘এই দিদি…তোর লাগেনি’?
- উঁ…
- বল না দিদি…
- লেগেছিল…
মৌকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনা তারপরেই ফিসফিস করে বলল… খুব লেগেছিল…তবে ভালো। মৌ দিদির বুকে মুখ গুঁজ়ে চুপ করে শুয়ে কিছু একটা হয়তো ভাবছিল, সুমনা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল ‘এই…মৌ’
- উঁ…
- তোরা নাকি কাল চলে যাবি?
- হ্যাঁ…সোমবার ওর অফিস আছে।
- আর একটা দিন থাক না… কতদিন পর দেখা হল…
- আমারও তো ইচ্ছে করছে…দেখি বলে দেখবো…
- এই…শোন না…ভালো করে বলবি কিন্তু…
- আচ্ছা…
- এই মৌ...
- হু...
- তোর কথা শুনবে তো?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজের মনেই যেন বলল... জানিস তো দিদি, মা যে আমাকে দেখতে পারতো না তাতে আমার আর একটুও দুঃখ হয় না। সেদিন যদি বাড়ী থেকে না বেরিয়ে আসতাম তাহলে কি ওর সাথে কোনোদিন দেখা হত...
বোন কি বলতে চেয়েছে ওর প্রশ্নের উত্তরে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সুমনা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সত্যিই তোর কপালটা ভালো রে, সেদিন যদি ওর জায়গায় অন্য কারুর হাতে পড়তিস তাহলে কি হতে পারতো ভাবতেই ভয় লাগে। মৌ আস্তে করে বলল... ওর কাছে থাকলে আমার কেন জানি না... মনে হয় আর কোনো ভয় নেই...যাই হোক না কেন ও আমাকে ঠিক আগলে রাখবে...
পরের দিন সকালে অরিত্র ফিরে যাওয়ার কথা তুলতেই মামীমা এক কথায় নাকচ করে দিয়ে বলল…না…না…তা কি করে হয়। এতদিন পরে মেয়েটা এসেছে, অন্তত আর একটা দিন থাকতেই হবে। মামীমা এত আন্তরিকভাবে থাকার কথা বলল যে না বলার কোনো উপায় ছিল না, তবুও একবার শেষ চেস্টা করতে গিয়ে মৌয়ের দিকে তাকালে ও এমনভাবে ‘আমি কি জানি ...তুমি দেখো কি করবে’ বলল যে তাতে পরিস্কার হয়ে গেল ওর থাকার ইচ্ছেটাই বেশী। আর কিছু করার নেই দেখে অরিত্র থাকতে রাজী হয়ে যেতে মামীমা বলল... যাও না আজ সবাই মিলে শুশুনিয়া পাহাড় দেখে এসো। মামন পাশেই ছিল, মায়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল... হ্যাঁ মা, খুব ভালো হবে। অর্ক তো শুনেই লাফাতে শুরু করে দিল...পাহাড় দেখার থেকে ওর বেশী আনন্দ হচ্ছে গাড়ীতে করে ঘুরতে যেতে পারবে।
সাড়ে এগারোটা মতো বাজে। অরিত্রর সাথে পাপাই আর অর্ক, দূর্গামন্ডপের মেঝেতে তিন অসমবয়সীর খেলা চলছে জোর কদমে...আরো একজন অবশ্য সাথে আছে, সে হল লালু। অরিত্রর বুকের উপরে চেপে বসে পাপাই নাচন কোদন চালিয়ে যাচ্ছে সমানে, নাচন কোদনের সাথে চলছে চিল চিৎকার। মাঝে মাঝে অর্ক আর পাপাইয়ের গলার আওয়াজ এত বেড়ে যাচ্ছে যা লালুও থাকতে না পেরে ওদের সাথে গলা মেলাচ্ছে ভো-উ-উ ভো-উ-উ করে। মাঝে একবার দিদা এসে লালুকে মন্দীরের চাতালে দেখতে পেয়ে তাড়া করতে গেলে লালু দৌড়ে গিয়ে দূর্গা প্রতিমার কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে পড়লে দিদা আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুমা স্নান না করে মন্ডপে উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে অর্ক বক দেখিয়ে বলেছে
পা-র-বে না...পা-র-বে না...লালুকে তাড়াতে পারবে নাআআআআ... নাতির সাথে না পেরে ঠাকুমা নিজের মনে বকতে বকতে ফিরে গেলে পর লালু বেরিয়ে এসে লেজ নাড়াতে নাড়াতে যেন অর্ককে বলতে চেয়েছে...ভাগ্যিস ঠাকুমাকে ভাগিয়ে দিলে...না হলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিতো...
একটু পরে মামন এসে তাড়া লাগালো...অরিত্রদা...দিদি ডাকছে, এখুনি চলো। একটু পরে তিন মুর্তিমানকে ধুলো মাখা অবস্থায় দেখে ওদের তিন বোনের হাসি যেন আর থামে না। ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে পাপাইও কিছু না বুঝে ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছে দেখে অরিত্র নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে বলল... কি হয়েছে বাবা এত হাসির, একটু না হয় ধুলো লেগেছে। মৌ মুখে হাত আড়াল করে হাসি চাপতে চাপতে বলল... একটু ধুলো? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো একবার। ওদিক থেকে সুমনা থাকতে না পেরে বলল... এই, চল তো তিনটেকে পুকুরে নিয়ে যাই। সবাই মিলে পুকুরে স্নান করতে যাবে শুনে অর্ক হৈ হৈ করে উঠে লাফাতে শুরু করলে সুমনা ভাইকে আদরের বকুনি দিয়ে বলল...এই বাঁদর...আর লাফাতে হবে না...দাদাকে নিয়ে যা, আমরা আসছি...বুঝলি?
পুকুরটা বেশ বড়ই...টলটলে পরিস্কার নীল জল...ঘাটের পাশেই একটা বেশ ঝাঁকড়া আম গাছ থাকায় ছায়া হয়ে আছে জায়গাটা। শান বাধানো ঘাটে বসে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে পাপাইকে জলে দাঁড় করিয়ে ধরে রাখতে হয়েছে, যা ছটপটে ছেলে হাত ফসকে কখন জলে পড়ে যাবে তার ঠিক নেই। অর্ক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে গিয়ে পাপাইয়ের দিকে জল ছেটালে পাপাইও ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মামার দিকে জল ছেটাবার চেস্টা করে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ওদের মামা ভাগ্নের জল কেলী চলতে চলতে একটু পরেই ওরা তিন বোন চলে এলো সাজগোজ করে। টাইট চুড়িদার পরে ওড়না বুকের উপর দিয়ে নিয়ে এসে কোমরে গিঁট মেরে বেঁধে রেখেছে যাতে খুলে না যায়। ওরা এসে যেতেই অর্ক ঝাঁপ দিলো জলে... জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেই পাপাইকে আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না...ওকেও মামার মতো জলে নামতে দিতে হবে। সুমনা জলে নামতে নামতে ওকে সাঁতার জানে কিনা জিজ্ঞেস করায় অরিত্র উত্তর দিলো... জানি, তবে অনেক দিন হয়ে গেল জলে নামা হয়নি। মৌ জলে পা ডুবিয়ে জল ছেটাতে ছেটাতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...সত্যি তুমি সাঁতার জানো? অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... চলো, তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দি আজ। মৌ হাত দিয়ে একটু জল ওর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল... ধ্যাত, কেউ এসে গেলে? ওদিকে ওরা দু বোনে গলা অব্দি জলে নেমে মৌকে ডাকাডাকি করলেও কিছুতেই যাবে না দেখে অরিত্র পাপাইকে কোলে নিয়ে কিছুটা জলে নেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালে মৌ কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উঠে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোঝালো ওকে ধরতে হবে। এক একটা করে ধাপ নিচে নামতে নামতে কখন ও অরিত্রকে জড়িয়ে ধরেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মৌ ভালো করে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেও ভয় পাচ্ছে দেখে অরিত্র আস্তে করে বলল... আমি ধরে আছি তো, কিছু হবে না। মৌ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আস্তে করে বলল... কি করবো ভয় করলে...
বুক পর্যন্ত জলে নেমে ও আর কিছুতেই নামবে না দেখে অরিত্র ওখানেই দাঁড়িয়ে গেছে... একটু একটু করে ভয় কেটে গিয়ে মৌ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক...ওদের ভাইবোনের সাঁতার কাটা দেখতে দেখতে পাপাইয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল... এই যে দুষ্টু ছেলে, মামার কোলে খুব আদর খাওয়া হচ্ছে...না। পাপাই মাসির গালে ওর ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে খামচানোর চেস্টা করতে করতে উত্তরটা দিল ওর অবোধ্য ভাষায়। অরিত্র হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল...কিছু বুঝলে? মৌ পাপাইকে আরো একটা চুমু দিয়ে আস্তে করে বলল...বুঝেছি, ও বলছে...মামা তো আর একা আমাকে আদর করে না...তোমাকেও তো করে।
একটু পরেই সুমনা ফিরে এসে পাপাইকে নিয়ে গেছে স্নান করিয়ে বাড়ীতে দিয়ে আসতে না হলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে আর অরিত্ররও আর স্নান করা হবে না। মামন আর অর্ক ওদিকে কে আগে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে গিয়ে ফিরে আসতে পারবে দেখাতে গিয়ে সাঁতরাতে শুরু করেছে, এখন আর কেউ নেই ওরা কি করছে দেখার... অরিত্র ওকে আস্তে করে বলল...এই, নাকটা চেপে ধরো না এখুনি। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নাক চেপে ধরলে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভালো করে ধরে টুপ করে জলে ডুব দিয়েছে... হঠাৎ করে ওইভাবে জলে ডুব দেওয়ায় মৌ ভীষন ভয় পেয়ে গিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে...ওর আর কিছু বোঝার মতো অবস্থা ছিল না... একটু পরে যখন জলের ভেতর থেকে উঠে এলো দুজনে, ততক্ষনে মৌ বুঝেছে কি হয়েছে... ভালো করে নিশ্বাস নিতে নিতে ওর বুকে গোটা কয়েক দুমদাম করে কিল মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলেছে...পাজী কোথাকার। অরিত্র কিছু না বলে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল...তোমার ভালো লাগেনি? ততক্ষনে মৌ একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে...ভাইবোন তখোনো সাঁতার কেটে যাচ্ছে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল... আগে থেকে তো বলবে। অরিত্র এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল...তাহলে আর একবার? মৌ দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি মুখে ঘাড় কাত করে বুঝিয়েছে ওর কোনো আপত্তি নেই। আগে থেকে জানা থাকায় বুক ভরে হাওয়া নিয়ে এবারের অদৃশ্য হওয়াটা আরো বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে...ওরাই জানে ঠিক কি কি হয়েছে সবার চোখের আড়ালে...
দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। পেছনের সিটে ওরা তিন বোন, সামনে অর্কর কোলে পাপাই। দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে বিকেলে ঝড় বৃষ্টি হলেও হতে পারে। সারা রাস্তাটা লাল কৃষ্ণচুড়া ফুলের গাছে ভরা। প্রায় সব কটা গাছই ফুলে ফুলে ছয়লাপ...যেন মনে হচ্ছে আগুন লেগেছে... মৌ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে দিদিকে উদ্দেশ্য করে বলল... এই দিদি, কি সুন্দর লাগছে না... সুমনা ওর বোনের হাতে আস্তে করে চিমটি কেটে কানে কানে বলছে...ভালো তো লাগবেই...তোর মনে যে এখন বসন্ত। রাস্তার ধার দিয়ে কয়েক জনের একটা দল ঝুড়ি কোদাল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে... মেয়েদের কাপড় হাঁটুর ঠিক নীচে আর ছেলেদের কোমরে শুধুমাত্র এক চিলতে একটা গামছা... মৌ ওদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে সুমনা হেসে ফেলে বলল... বাব্বা, ওরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন রে... দেখে বুঝতে পারছিস না ওরা সাঁওতাল...কোথাও থেকে কাজ করে ফিরছে... অরিত্রর কানে ওদের কথা গেলে একটু উদাস হয়ে যেন গেয়ে উঠল... যেখানে কৃষ্ণচুড়া লালে লাল... যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল... সুমনা খুব মন দিয়ে ওর গাওয়া গানের কলিটা শুনে বলল...এই, অরিত্রদা তুমি পুরো গানটা জানো? অরিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল... সুরটা মনে আছে...কথা গুলো সবটা বোধহয় মনে করতে পারবো না। মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে যেন মনে করার চেস্টা করে গুন গুন করে গানটা গাওয়ার চেস্টা করছিল, একটু পরেই সুমনা খুব খুশী হয়ে বলল... এই মনে পড়েছে, দাঁড়াও আমি গাইছি...হাসবে না কিন্তু, আমার যা গলা...
ওরা দুবোনে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলে মামনও গলা মেলালো ওদের সাথে...
চলো রীনা, ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে মেখে মেখে
লাল কাঁকরের পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাই...
বলো যাবে কিনা
সোনা রোদ ঝিক মিক দেখো বালু চিক চিক
ছোট্ট নদী খোয়াই পার হয়ে যাই
যেখানে কৃষ্ণ চুড়া লালে লাল
যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল
আরো দূরে ঘুরে ঘুরে চলো না হেঁটে আসি
চলো না পাশাপাশি...
ওদের গাওয়া শেষ হলে মামন মৌয়ের কানে কানে কিছু বলতেই ও বোনের হাতে চিমটি কেটে আস্তে করে বলল...খুব ফাজিল হয়ে গেছিস... দাঁড়া তোর অরিত্রদাকে বলে তোর জন্য একটা বেশ ভালো দেখে ছেলে খুঁজতে হবে যাতে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে যেতে পারিস। মামন দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল...ইস...আমি কি আমার জন্য বললাম নাকি... ওদের ফিসফিসানি শুনে সুমনা ওদের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল...এই কি এত গোপন কথা হচ্ছে রে তোদের? মৌ হেসে ফেলে বলল... আমাদের ছোটদের কথায় কান দিবি না দিদি। ‘ইস, কি আমার ছোট রে, এদিকে উনি প্রেম করছেন আর নাকি ছোট’ বলতেই মৌ হেসে ফেলেছে ...সাথে সাথে ওরা দুবোনেও হাসতে শুরু করলে অরিত্র হাসির কারন বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বোকার মতো ওদের দিকে তাকালো দেখে মৌ হাসতে হাসতে বলল...এই, তুমি গাড়ী চালাও...মেয়েদের দিকে তাকাবার খুব শখ... না। নেহাত অর্ক সাথে আছে, না হলে বেশ জমিয়ে একটা উত্তর দেওয়া যেত ভাবতে ভাবতে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... হুম, আমি তো এখন তোমার ড্রাইভার...
শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে গাড়ী রেখে ওরা সবাই এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। খুব একটা উঁচু নয় পাহাড়টা, বরং সবুজে সবুজে ভরা বড় সড় টিলা বলা যেতে পারে... অর্ক দিদির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে ওকে ছোট্ট ঝরনা দেখাতে, মামনও গেছে ওদের সাথে...এদিকে পাপাই কিছুতেই মায়ের কোলে থাকবে না, ওর এখন মামার কোলে উঠা চাই। অরিত্র ওর লাফালাফি দেখে হেসে ফেলে ওকে কোলে নিয়ে সুমনার সাথে কথা বলতে বলতে ওরা তিন ভাইবোন ফিরে এলো। মৌ বাচ্চাদের মতো খুশীতে ঝলমল করতে করতে বলল...এই, চলো না...কি সুন্দর মিষ্টি জল...
অরিত্রর কোলে পাপাই, ওর আর এক হাত মৌ চেপে ধরে রেখেছে শক্ত করে, সরু পাহাড়ী পায়ে চলা সুঁড়ি পথে এক সাথে উঠতে গিয়ে ওরা একেবারে পাশাপাশি। ওদের আগে আগে সুমনারা তিন ভাই বোন... মৌ মাঝামাঝি আসার পর বসে পড়ে বলল...এই হাঁপিয়ে গেছি, একটু বসি? ওকে বসতে দেখে অরিত্রকেও ওর পাশে বসতে হল পাপাইকে কোলে নিয়ে ...পাপাই ওর কোলে মুখোমুখি বসে ওর ছোট্ট ছোট্ট নরম হাতে ওকে আদর করতে চাইছে...অরিত্র ওর নাকে আলতো ভাবে নাক লাগিয়ে আদর করে বলল...উমম...সোনা ছেলে...একটুও কাঁদে না ... মৌ অরিত্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে থেকে হাসি মুখে ওদের দুজনের খেলা দেখতে দেখতে বলল... একদম দুষ্টু ছেলে...আমার কাছে এলে ওনার যত কান্না...আমি কি কামড়ে দি? অরিত্র পাপাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সোনা, মাসীকে বলে দাও তো...তুমি কত্তো ভালোবাসো মাসীকে... তারপরে ওর কানে কানে বলেছে...তোমার কাছেও কাঁদবে না যদি তুমি আমাকে যেমন করে আদর কর, তেমনি করে... ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পিঠের উপরে দুম করে একটা কিল পড়ল আর তার সাথে মিষ্টি বাক্যবান...তুমি না খুব অসভ্য...তুমি আর ও এক? অরিত্র হাসতে হাসতে বলল... এই দেখো, আমি তো শুধু আদরটা কতটা মন দিয়ে করতে হবে তাই বলেছি। ওদেরকে বসে পড়তে দেখে সুমনা আর মামন ফিরে আসছে দেখে মৌ একটু সরে বসল...ওরা কাছে এলে মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে বলল... হাঁপিয়ে গেছি রে দিদি, একটু দম নিয়ে নি। সুমনা ওর গা ঘেঁষে বসে কানে কানে বলল... এত তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে গেলে খেলবি কি করে রাতে? মৌ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেও দিদিকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল... তোর থেকে শিখে নেব...বুঝলি। সুমনাও কম যায় না, হেসে ফেলে বোনের কানে কানে বলেছে... প্রাক্টিক্যালটা কি তোর জামাইবাবুর সাথে নাকি তোর ওর সাথে করতে হবে আমাকে?