25-02-2019, 12:40 PM
অরিত্রকে আর নিজের থেকে বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে হয়নি, যা করার দাদুরাই করেছে। পরের দিনই পুবালী মাকে নিয়ে চলে এসেছিল এবাড়ীতে, একদিন থেকে দাদুদের সাথে আলোচনা করে গেছে বিয়েটা কবে নাগাদ ঠিক করা যায়, কোথায় বিয়েটা হলে ভালো হয় ইত্যাদি। বাড়ীর একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা তার উপরে দিদিদের বিয়েতে ও অনেক করেছে তাই এবারে আর ওকে কোনো দায়িত্ব দিতে রাজী নয় কেউ। রুপসার আসার খুব ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার ছিল না, নতুন চাকরী,এক বছরও হয়নি, এখোনো প্রোবেশানে আছে…ছুটি না পেয়ে রেগে গিয়ে চাকরীটা ছেড়েই দেবে বলেছিল। অরিত্র বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করেছে। একদিন দুপুরে মৌকে সাথে নিয়ে শ্যামবাজার গিয়ে বিল্টু আর মিষ্টির সাথে দেখা করেছে। বার বার ওদের মাকে না জানিয়ে আসা খুব একটা সহজ ছিল না। ওরা দু ভাইবোন বিয়ের কথা শুনেই দিদিকে জ়ড়িয়ে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। ওদের মা দিদিকে দেখতে না পারলে কি হবে ভাই বোন দুজনেই দিদিকে যে নিজেদের থেকে বেশি ভালোবাসে। মৌ যা টাকা পয়সা আছে ওদের দুজনকে দেবে বলাতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। মৌ অনেক করে বোঝাতে গররাজী হয়েছ কিন্তু বার বার একটাই কথা বলছে দুজনে…দিদির টাকার জন্য ওদের কোনো লোভ নেই… মা যে দিদিকে কোনোদিনই নিজের করে দেখেনি বরং বলতে গেলে চরম অত্যাচার করেছে…সেটা ওদের থেকে তো ভালো আর কেউ জানে না। আজ দিদির জীবনে খুশী আসছে জেনে নিজেদের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ওদের একটাই চিন্তা মাকে না জানিয়ে দিদির বিয়েতে কি করে যাবে। মৌ কথা দিয়েছে একবার হলেও ওই বাড়ীতে যাবেই, মাকে জানিয়েই সবকিছু করবে। অরিত্র সাথে থাকবে তাই এখন তো আর ওর মাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। টাকা পয়সা ছাড়াও বাড়ির যে ভাগ আছে সেটাও ও আর নিজের নামে না রেখে মায়ের নামে করে দেবে। শুধু একটাই জিনিষ ওর দরকার, মায়ের কিছু জামা কাপড় রাখা ছিল, যদি সেগুলো পাওয়া যায়…বিশেষ করে মায়ের বিয়ের বেনারসীটা। মায়ের গয়না গুলো তো আগেই নিয়ে নিয়েছিল তাই ওগুলো নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। দিদির কথা শুনে মিষ্টি লাফ দিয়ে উঠল, টাকা পয়সা বা বাড়ীর ব্যাপার নয়…জামাকাপড় গুলো ও দেখে রাখবে কাল-ই…মা সারাদিন নাকি থাকবে না…সেই সুযোগে যা করার করে ফেলবে যাতে মা পরে না বলতে পারে যে কিছু নেই। বিল্টু বাড়ির ব্যাপারে শুনে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল…হ্যাঁ দিদি…তুমি বাড়ীটা লিখে দাও…থাকুক ওই বাড়ী নিয়ে। আমার তো থাকার ইচ্ছে নেই ওই বাড়ীতে আর মিষ্টির তো বিয়ে হয়ে গেলে চলে যাবে। মৌ হেসে ফেলে বলল…এই ভাই, মায়ের নামে ওরকম বলতে নেই রে, আমার সাথে যা হয়েছে হয়েছে…তোদের তো ভালোবাসে নাকি ভালোবাসে না? মিষ্টি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল…ছাই ভালোবাসে…টাকা ছাড়া আর কিছু যে আছে মনেই করে নাকি। দাদা ঠিকই বলেছে…সবাই চলে গেলে একা একা থাকবে ওই বাড়ী আর টাকা নিয়ে, যখন পাশে কেউ থাকবে না তখন বুঝবে কি ভুল করেছে।
দাদুর কথাই ঠিক প্রমান হয়ে গেল। বিশ্বাস কাকু তিন দিনের ভেতরে মোটামুটি বেশ কিছুটা খবর জোগাড় করতে পেরেছে, দূর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার রাস্তায় ওই নামে একটা গ্রাম আছে, বাস রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে। মৌ এর বলা নামের একজনের খবর পাওয়া গেছে, ওই গ্রামেই থাকেন,কাছাকাছি একটা হাই কলেজের হেড স্যার। একটা ফোন নাম্বারও পাওয়া গেছে কিন্তু যতবার ফোন করা হয়েছে সুইচড অফ। কোনো এক মন্ত্রীর জেলা সফর শুরু হতে যাচ্ছে বলে পুলিশ মহল খুব ব্যাস্ত থাকায় বিশ্বাস কাকু আরো কয়েকটা দিন সময় চেয়েছিলেন যাতে কাউকে পাঠিয়ে দেখে নিতে পারেন ওটাই সঠিক জায়গা কিনা কিন্তু মৌ খবরটা পাওয়ার পর এতটাই ছটপট করছে যে যা হবে হবে, একবার গিয়েই দেখা যাক না, না মিললে ফিরে আসবে ভেবে যাওয়ার ডিশিশান নেওয়া হয়ে গেছে। বিশ্বাস কাকুর দেওয়া খবর অনু্যায়ী যখন তখন নাকি বাস বন্ধ হয়ে যায় ওই রাস্তায় তাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো ভেবে কপাল ঠুকে শুক্রবার খুব ভোরে মৌকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরিত্র, বেরোবার আগে দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেছে, খুশী মনে যা, একদম চিন্তা করিস না, আমার মন বলছে নিশ্চয় তোর মামাদের সাথে দেখা হবে। ব্যারাকপুর পেরিয়ে গেলে অরিত্র ওকে পেছনের সিটে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে বললে মৌ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে ‘কেন’? ‘শুক্লাদি বলছিল তুমি নাকি রাতে ঠিক করে ঘুমোও নি’ বলাতে লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল...আসলে খুব চিন্তা হচ্ছে, এতদুর থেকে গিয়ে যদি দেখা না হয়। ‘চিন্তা কোরো না, যদি খুঁজে না পাই তাহলে দুর্গাপুর ফিরে এসে থেকে যাবো না হয় আজ, আবার কাল সকালে নতুন করে খুঁজতে যাবো’ বলাতে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল...তোমাকে আমার জন্য আর কতো ঝামেলায় পড়তে হবে কে জানে। অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতে চাপ দিয়ে হাসি মুখে বলল...কি হয়েছে তাতে, তোমার জন্য করবো না তো কার জন্য করবো বলো...
দূর্গাপুর পৌছতে সাড়ে এগারোটা মতো বাজলো। আরো কিছুটা আগে পৌঁছোনো যেত কিন্তু হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ী দেখে মৌ এমন ভাবে ওর হাত চেপে ধরে ভয়ের চোখে তাকাচ্ছিল যে বাধ্য হয়ে স্পীড কমাতে হয়েছিল। এর পরে রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখে গাড়ী থামিয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ওকে বোঝাতে গিয়েছিল ভয়ের কিছু নেই কিন্তু মৌ কোনো কথা শুনতে রাজী নয়। ওর হাত চেপে ধরে বলেছে...না, তুমি জোরে চালাবে না, কিছু হয়ে গেলে? কিছুতেই ওকে বোঝানো গেল না দেখে ‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আস্তে চালাবো’ বলাতে তবেই গাড়ীতে উঠেছে। দুর্গাপুরে একটা মোটামুটি ভালো হোটেল দেখে খেয়ে নিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিভাবে যেতে হবে। রাস্তা ভুল না করলে আর ঘন্টা দেড় দুই মতো লাগবে জেনে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়তে হল…যদি ভুল জায়গায় পৌঁছে যায় তাহলে ফিরে আসার মতো অবস্থায় থাকতে হবে। অবশ্য বিশ্বাস কাকু তো আছেই, খুব দরকার হলে লোকাল থানার সাহায্য পেতে অসুবিধা হবে না।
দূর্গাপুর পর্যন্ত রাস্তা ঠিক ছিল, হাইওয়েতে গাড়ী চালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি কিন্তু বাঁকুড়ার রাস্তায় পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেতে হচ্ছিল খারাপ রাস্তা কাকে বলে…একে সরু রাস্তা, উলটো দিক থেকে গাড়ী এলে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে সাইড দিতে হচ্ছে…তার উপর মাঝে মাঝে পিচ বলে কিছু নেই। দু ধারে শুধু খটখটে শুকনো ফাঁকা মাঠ। ওই দুপুর বেলা মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে দু একটা ঝুপড়ি ধরনের দোকান দেখা গেলেও লোকজনের নাম গন্ধ নেই। অরিত্র সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে মৌয়ের দিকে তাকালে দেখতে পেল ও খুব একটা স্বস্তিতে নেই…সারা মুখে একটা চিন্তার ছাপ…সাথে যেন একটু অপরাধবোধও কাজ করছে এই ভেবে যে ওর জন্য এত কষ্ট করে অরিত্রকে আসতে হয়েছে। একটা গাছের ছায়ায় গাড়ীটা দাঁড় করিয়ে দিলে মৌ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকালে অরিত্র বলল…বুঝতে পারছি না ঠিক যাচ্ছি কিনা…
- কি করবে?
- দেখি…কোনো গাড়ী এলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি…
মৌ মুখটা নিচু করে নিয়ে বলল…আমার জন্য তোমাকে কত ঝামেলায় পড়তে হল বলোতো…
- হুমম…পড়েছি তো কি হয়েছে…মুখ গোমড়া করে না থেকে একটু হাসবে কি?
- কি করে হাসবো…না এলেই ভালো ছিল…
- ইস…না এলেই ভালো ছিল…মামাকে না পেলে বিয়েটা কি করে হবে শুনি…
- যাদের মামা নেই তাদের কি বিয়ে হয়না?
- আমার এত কিছু জানার দরকার নেই, তোমার বিয়ে মামা ছাড়া হবে না…বুঝেছো? আর… তোমার বিয়ে না হলে আমারও যে বিয়ে হবে না…আমার বাবা চিরকুমার থাকার আর কোনো ইচ্ছে নেই…
মৌ ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে না হেসে থাকতে না পেরে বলল…আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তোমার যত খুশী মামা খোঁজো…আমার কি। গ্রীষ্মের শুনশান দুপুর, কথা বলতে বলতে ওর মুখে আর চিন্তার ছাপ দেখতে না পেয়ে অরিত্র চুপ করে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হল কিছু বলতে চাইছে আর বুঝে গেলে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেছে ‘উঁ হুঁ, এখানে এই ফাঁকা রাস্তায় ওসব চলবে না। না বললে কে শুনছে? তুমি আমার কাছে না এলে কি হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসতে পারি ভেবে একজন নিজের জায়গাতে বসেই এদিকে ঝুঁকে এসেছে। এই... না...কেউ এসে গেলে? বলতে গিয়েও অন্যজন বুঝিয়েছে তারও খুব একটা যে অনিচ্ছা আছে তা নয়...আর একজন তো কথা শোনার জায়গাতেই নেই। কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ‘উমম...না...কথা শোনো’...বলেও কাজ না হলে বাধ্য হয়ে বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুট স্বরে বলেছে তুমি খুব দুষ্টূ...কথা শোনো না। মিষ্টী মেয়ের মুখে আদর করে দুষ্টু বলা যে কতটা মিষ্টি হতে পারে তা যে শোনে সেই শুধু বোঝে। না না করে গেলেও এত কাছে পেলে কি আর আদর না করে থাকা যায় নাকি ভেবে সবকিছু ভুলে গিয়ে আদর করে আর করতে দিয়ে প্রায় সারাদিনের জার্নির ধকল আর দুশ্চিন্তার রেশ যেন কেটে গেল নিমেষে। কিছুক্ষন কেটে গেছে, তারপরে...এই, এবারে ছাড়ো...বললে একজন আস্তে করে বলেছে ‘ইচ্ছে করছে না তো...
বেশ কিছুটা দূরে উল্টোদিক থেকে একটা বাস আসছে দেখে অরিত্র তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে এল। এসির ভেতর থেকে বাইরে এসে যেন চোখ মুখ ঝলসে গেল…দুপুরের হাওয়া তো নয় যেন লু বইছে। ওকে হাত তুলে ইশারা করতে দেখে বাসটা ধুলোর ঝড় তুলে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র ওদের গন্তব্য বাস স্টপের নাম বলে ঠিক যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বাস ড্রাইভারের কাছ থেকে জানা গেল ঠিকই যাচ্ছে…আরো ঘন্টা খানেক লাগবে পৌঁছোতে। ড্রাইভার বাস ছাড়ার আগে জানিয়ে গেল দূর্গাপুরের দিক থেকে পরের বাসটা আর মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে এসে যেতে পারে…চাইলে ওটার পেছন পেছন যেতে পারে ওরা। গাড়ীতে বসে লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনের দিকে দেখতে দেখতে সত্যিই দেখা গেল একটা বাস আসছে। আগের বারের মতোই গাড়ীটাকে থামিয়ে বাস কন্ডাকটারের সাথে কথা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত মনে বাসটার পেছন পেছন যেতে যেতে দুজনের হেসে গড়াগড়ি যাবার মতো অবস্থা। সামনের স্টপে বাসটা দাঁড়ালে একজন মাঝ বয়সী লোক একটা মোরগ হাতে করে বাসে উঠতে গিয়ে হাত ফসকে মোরগটা ঝটপট করে উড়ে এসে গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়লে জনা তিনেক লোক কোত্থেকে হৈ হৈ করে দৌড়ে এসে মোরগটাকে ধরার চেষ্টা করলো…একজন রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রায় গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়ে মোরগটাকে ধরে বের করে নিয়ে এসে মালিকের হাতে ধরিয়ে দিল। ওদিকে বাস দাঁড়িয়ে আছে, মোরগের মালিক উঠলে তবে বাস ছাড়লো। পরের দুটো স্টপে আর কিছু হয়নি, তারপরের স্টপে আবার এক মজার ঘটনা। বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে প্রায় দশ বারো জনের একটা দল নেমে কিচির মিচির করতে করতে সামনের মোরাম রাস্তার দিকে হাঁটা দিয়েছে…বাসটা সবে ছেড়েছে এমন সময় ওদের একজন পেছন ফিরে হাত তুলে দৌড়ে এসে বাসটাকে থামালো…চিৎকার চেঁচামেচি শুনে যা বোঝা গেল তা হল ওদের আরো একটা বাচ্চা বাসে থেকে গেছে। কন্ডাক্টার বোধহয় খুঁজে পেতে একটা বছর দুই আড়াই এর বাচ্চার হাত ধরে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ওটাই কিনা। ততক্ষনে বাচ্চার মা ও ফিরে এসেছে…বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ফেলে কন্ডাক্টারকে গালাগালি করতে শুরু করে দিল, যেন ওর দোষেই বাচ্চাটা বাসে থেকে গিয়েছে। কন্ডাক্টারও ছাড়বে কেন…নিজের কটা বাচ্চা তারই হিসেব নেই বলে উলটে দু চার কথা শুনিয়ে তবে বাস ছাড়ার ঘন্টি বাজালো। মৌ-কে নিজের মনে হাসতে দেখে অরিত্র ওর দিকে তাকালে ও জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা, ওই সবকটা বাচ্চা কি একজনের হতে পারে? হু…কেন হতে পারে না বললে মৌ হেসে ফেলে বলল…বাব্বা, পারেও বটে। অরিত্র হাসতে হাসতে বলল…ওদের মা বাবা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে তো…তাই। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ধ্যাত, তুমিও না খুব অসভ্য বলাতে অরিত্র রাস্তার দিকটা দেখে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল… আচ্ছা ধরো আমাদেরও যদি অনেকগুলো হয়…আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো। এবারে আর মৌ থাকতে না পেরে চোখ পাকিয়ে ওর হাতে চিমটি কেটে বলল…এই, তুমি থামবে…ছিঃ… ছিঃ। নিজেদের ভেতরে হাসি ঠাট্টা করতে করতে কখন এক ঘন্টার জায়গায় ঘন্টা দেড়েক কেটে গেছে বুঝতে পারেনি। একটা জায়গায় বাস দাঁড়ালে পেছনের দরজার কন্ডাক্টার নেমে এসে জানালো ওদের একটু আগে বাঁ দিকের মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে।
বাসটা চলে গেলে সামান্য একটু এগোনোর পর একটা মোরাম রাস্তা পাওয়া গেল, নামেই রাস্তা…খানা খন্দে ভরা…সামনে একটা ভ্যান রিকশা দুজন সওয়ারী নিয়ে যাচ্ছে, পেরিয়ে যাবার উপায় নেই দেখে ওটার পেছন পেছন আস্তে আস্তে করে যেতে হচ্ছিল। বেশ কিছুটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে যাবার পর এক জায়গায় একটা খেলার মাঠ আর কলেজ দেখা গেল, খুব একটা পুরোনো কলেজ বলে মনে হল না। সামনেই কিছুটা চওড়া জায়গা আছে দেখে অরিত্র ভাবছিল ভ্যান রিক্সাটাকে পেরিয়ে গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করে নেবে কিন্তু তা আর হল না। ভ্যান রিক্সাটা কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল দেখে সামান্য একটু এগিয়ে গেলে দুজন কলেজের ছেলেকে পাওয়া গেল। ওদেরকে গ্রামের নাম করে জিজ্ঞেস করতে সামনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল আরো কিছুটা যেতে হবে। ততক্ষনে ভ্যান রিক্সাটাও চলে এসেছে দেখে ওদেরই একজন বলল ওই ভ্যানটা নাকি ওই গ্রামের দিকেই যাচ্ছে, তারপর নিজেই এগিয়ে এসে ভ্যানওয়ালাকে বলল…ও মাধব কাকা, তোমাদের গ্রামে যাবে গো…রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাও। ভ্যানওয়ালা নেমে এসে জিজ্ঞেস করল কার বাড়ী যাবে ওরা। দেবাশীষ মুখার্জি বলাতে কলেজের ছেলেটা খুব যেন খুব আপন এমন ভাব করে বলল ‘ও আপনারা স্যারের বাড়ী যাবেন? হ্যাঁ বলাতে ছেলেটি জানালো স্যার কলেজে নেই, কলেজের কাজে বাঁকুড়া গেছেন।
আবার সেই আগের মতো ভ্যানের পেছন পেছন যেতে যেতে একটা পুরোনো মন্দীর আর সামনের দীঘি দেখে মৌ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল…খুব চেনা চেনা লাগছে…ঠিক জায়গাতেই এসেছি মনে হচ্ছে। ওর চোখে মুখে যেন খুশী ঝরে পড়ছিল, ভালো করে দেখে বলল…হ্যাঁ…এটাই…আর একটু এগোলেই মামার বাড়ী…খুব ছোটো বেলায় দেখা কিন্তু এখোনো মনে আছে। ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছে বুঝতে পেরে মৌ বাইরের দিকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল আরো কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা যেটা ও ওর ছোটোবেলায় দেখেছিল।
আরো কিছুটা যাবার পর ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বলল এসে গেছি, তারপরেই নিজে নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে বাড়ীর লোকজনকেও বের করে নিয়ে এলো। ততক্ষনে সামনের রাস্তার ধার ঘেঁসে গাড়ীটা রেখে ওরা দুজনে নেমে এসেছে। মৌ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর সেই ছোটোবেলার স্মৃতি থেকে আরো কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা, বাড়ীটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অরিত্রর হাত চেপে ধরলে ওর দিকে তাকিয়ে অরিত্র বুঝতে অসুবিধা হল না যে আর কোনো ভুল নেই, ওরা ঠিক জায়গাতেই এসেছে। একজন মাঝ বয়সী মহিলা ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলে ভ্যানওয়ালা বলল…আরে বৌদি…কুটুম এসে দাঁড়িয়ে আছে…আর তোমরা সব ঘুমোচ্ছো। মৌকে দেখে চিনতে পারার কথা নয়…সেই কোন ছোটো বেলায় এসেছিল ও। মহিলা কি করবে বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলে মৌ এগিয়ে গিয়ে বলল… আমি মৌ…কোলকাতা থেকে আসছি। ওর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…মৌ? মানে বর্নার মেয়ে…মৌ? হ্যাঁ বলাতে জড়িয়ে ওকে ধরে কি করবে যেন বুঝতে পারছিল না…ওকে আদর করতে করতে বলল…চিনতে পারছিস আমাকে? আমি তোর মামীমা…এক এক করে বাড়ীর ভেতর থেকে বোধ হয় ওর দাদু আর দিদা বেরিয়ে এসে কে এসেছে জানতে পেরে ওকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অরিত্র চুপচাপ একটা খাটিয়ার উপরে বসে ছিল, সবাই মৌকে নিয়ে ব্যাস্ত…ওর দিকে কে তাকাবে এখন। খারাপ লাগার কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক…মেয়েটা কত বছর পর এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। ওকে নিয়েই তো সবাই থাকবে এখন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে ওদের কান্নাকাটি দেখে ভৌ ভৌ করে ডাক দিয়ে অরিত্রর দিকে এগিয়ে এসে জুল জুল করে দেখতে শুরু করল…নাক উঁচু করে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করল নতুন মানুষটা ভালো না খারাপ। অরিত্র চুক চুক করে আওয়াজ করে ডাকলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে লেজ নাড়াতে শুরু করল… অরিত্র ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলে কত দিনের চেনা এমন একটা ভাব করে পায়ের কাছে বসে পড়ল। অরিত্রর মনে মনে হাসি পেয়ে গেল…যাক…কেউ একজন তো ওর কাছে এসেছে ভেবে… একটু পরে গোটা দুয়েক মুরগী কোঁক কোঁক করে ডাকতে ডাকতে এসে খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ল দেখে কুকুরটা ঘ্যাঁক করে ডেকে উঠল…ভাবখানা যেন এমন…এই…তোরা এখান থেকে ভাগ। আমাদের বাড়ি কেন এসেছিস…ঠাকুমা দেখতে পেলে কিন্তু তাড়া করবে… ওর ডাক শুনে মুরগী দুটো ত্রাহি মধুসুদন ভাব করে দৌড় লাগালো…কুকুরটা একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে বোঝালো…দেখলে তো…কেমন ভাগিয়ে দিলাম। হাসি মুখে ওর মাথায় আদর করে একটা চাপড় দিতে আবার পায়ের কাছে বসে পড়ল কুকুরটা। মৌকে নিয়ে সবাই বাড়ীর ভেতরে গেছে দেখে ও উঠে চারদিকটা দেখছিল…উঠোনের একদিকে এক চালা একটা ঠাকুর দালান… ভেতরে সপরিবারে মা দূর্গা…খড়ের কাঠামো…এখোনো মাটির প্রলেপ পড়েনি…তার মানে বাড়ীতে দুর্গা পূজো হয়…বনেদী বাড়ী হবে…বাড়ীটা বেশ পুরোনো হলেও তো তাই মনে হচ্ছে। পেছনে কারুর পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে বছর পনেরো ষোলর একটা মেয়ে…কলেজ থেকে ফিরছে…অচেনা মানুষ দেখে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হলে বোধ হয় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। পেছন পেছন আরো একজন কলেজ থেকে ফিরলো…মেয়ে নয়…ছেলে… বয়স আর একটু কম…বড়জোর বছর বারো হতে পারে…আগের জনের মতো ওকে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল। কুকুরটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল, ছেলেটাকে দেখে লেজ নেড়ে হয়তো বলতে চাইলো আজ আর খেলতে যেতে হবে না, দেখো গিয়ে কে এসেছে। ছেলেটা ভেতরে চলে যাবার পর অরিত্র রাস্তার দিকে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে কুকুরটাকে কয়েকটা বিস্কুট দিলে খুব খুশি হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে খেয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে বলতে চাইলো আরো চাই। অরিত্র হাসি মুখে বাকি বিস্কুট গুলো একটা একটা করে খাওয়াতে খাওয়াতে দাদুকে ফোনে জানিয়ে দিল ওরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছতে পেরেছে। দাদু খুব খুশী হয়ে বলল...যাক বাবা, ভালোই হয়েছে...আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। আরো কিছুক্ষন বাড়ীতে কথা বলার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে আসতে দেখা গেল…সাথে ওই ছেলেটা। ও কাছে এসে সারা মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব নিয়ে বলল…এই…কিছু মনে কোরো না…সবাই আমাকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে তোমার কথা ভুলেই গেছে। অরিত্র হাসি মুখে বলল…মনে করার কিছু নেই, এত বছর পরে তোমাকে পেয়েছে…এটাই স্বাভাবিক...
- সত্যিই কিছু মনে করনি তো?
- না রে বাবা…দেখোনা…এর মধ্যে কেমন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছি।
মৌ অবাক হয়ে আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল…কাকে আবার জোটালে? অরিত্র কুকুরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালে মৌ হেসে ফেলে বলল…তুমি ও না পারো বাবা…শোনো না…এ আমার মামাতো ভাই…অর্ক…ওর সাথে আর একটু থাকো…কেমন...
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আমার জন্য এত ভাবতে হবে না…তুমি যাও…
মৌ যাবার আগে শুভকে বলল…এই অর্ক…কোথাও চলে যাবি না কিন্তু, দাদার সাথে থাকবি। যাকে বলা হল সে খুব মন দিয়ে গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ঘাড় নেড়ে জানালো বুঝেছে।
মৌ চলে যাবার পর অরিত্র ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল…তুমি কোন ক্লাসে পড়?
- সেভেনে…
- কলেজ কোথায়?
- ওই তো…আসার সময় যেখানটা তোমরা দাঁড়িয়েছিলে…বড় একটা খেলার মাঠ আছে…
- এই দেখো…আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম…তুমি জানলে কি করে?
- বা রে…ক্লাসের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় তো। আমাদের এখানে তো এত সুন্দর গাড়ী আসে না…তাই সবাই মিলে দেখছিলাম…
- তাই…তোমার গাড়ী ভালো লাগে?
- খুউব…আচ্ছা…অনেক দাম…তাই না?
- না না…খুব বেশি না…
অর্ক খুব অবাক গিয়ে বলল…বেশী না? এত সুন্দর দেখতে…
- বড় হও…তখন না হয় দাম নিয়ে ভাববে…
- আচ্ছা…দিদি তো বললো না তোমাকে কি বলে ডাকবো…
- হুমম…দুষ্টু দাদা বলে ডাকতে পারো…
অর্ক কেমন যেন অবাক হয়ে বলল…ধ্যাত…দুষ্টু আবার কারুর নাম হয় নাকি?
- হয়…সত্যিই আমার নাম দুষ্টু…
- তোমাকে কিন্তু একটুও দুষ্টু বলে মনে হচ্ছে না…
ওর কথা শুনে অরিত্র হাসি মুখে বলল…তাই? কি মনে হচ্ছে?
- বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন সুন্দর গল্প করছো আমার সাথে…রাজুদা তো পাত্তাই দেয় না…
- তাই? রাজুদা কে?
- বড়দির বর…বাইকে হাত দিলেই কেমন যেন করে…আমি যেন ভেঙ্গে ফেলবো…
- হুমম…বাইকটাকে খুব ভালোবাসে তো…তাই…
- তুমি গাড়ীটাকে ভালোবাসো না?
- খুব…
- আমাকে এক বার গাড়ী চড়াবে?
- কেন চড়াবো না? চলো…তোমার কলেজের সামনে থেকে ঘুরে আসি…
- না না…এখন না, দাদু বকবে…তোমাকে নিয়ে বাড়ীতে যেতে বলেছে একটু পরে, বেড়াতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। কাল সকালে যাবো…থাকবে তো?
- হুম…থাকবো…
অর্ক আনন্দে প্রায় নেচে উঠে বলল…খুব মজা হবে। ওদের কথার মাঝখানে কুকুরটা একবার ডেকে উঠলে অরিত্র জিজ্ঞেস করল… ওর কোনো নাম আছে? অর্ক খুব গর্বের সাথে বলল…হ্যাঁ…লালু…জানো তো…ও একদিন কলেজের সামনে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল…খুব ছোটো…কলেজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছিলাম। মা তো কিছুতেই রাখতে দেবে না…এত ছোটো…ওর মা নাকি কাঁদবে…কান্নাকাটি করে দাদুকে দিয়ে বলাতে তবে রাজী হয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষন অর্কর সাথে গল্প করার পর বাড়ীর সামনে থেকে কেউ জোরে...এই অর্ক…দাদাকে নিয়ে আয় বলাতে ও বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলল…আসছি দাদু… তারপর অরিত্রর হাত ধরে বলল…চলো…দাদু ডাকছে। অর্কর সাথে ভেতরে যেতে গিয়ে দাদুর সাথে দেখা হয়ে গেল, উনি অরিত্রর হাত ধরে বললেন…কিছু মনে করো না বাবা…মৌকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো আশা ছিল না…মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। অরিত্র দাদুকে প্রনাম করে বলল…না না…আমি কিছু মনে করিনি…এই তো এতক্ষন আপনার নাতির সাথে গল্প করলাম।
- যাও…বাবা…ভেতরে যাও…আমি এখুনি আসছি…ছেলেটাও বাড়ী নেই…কখন ফিরবে কে জানে…
দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা ভ্যান রিকশা এসে বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো…ওদিকে তাকিয়ে দাদু বললেন…যাক…বাবা…ছেলেটা এসে গেছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন…আরে শোন মৌ এসেছে…আমি মাছের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখি।
- বাস থেকে নেমে মাধবের কাছে শুনেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম কাজ ফেলে…মাছের ব্যাবস্থা করে এসেছি…একটু পরে মাধবের ছেলে এসে জাল ফেলবে…
- যাক বাবা…ভালো করেছিস। নিশ্চিন্ত হলাম…ছেলে মেয়ে দুটোকে ভালো করে খাওয়াতে পারবো কিনা চিন্তা হচ্ছিল…আর শোন…এ হল অরিত্র…আমাদের মৌ কে সাথে করে নিয়ে এসেছে...
অরিত্র মামাকে প্রনাম করতে যেতে না না করে উঠে বললেন…থাক…থাক…প্রনাম করতে হবে না…সারা দুনিয়ার ধুলো পায়ে…কেমন জায়গায় থাকি দেখছো তো…
মানুষ কতটা আন্তরিক হতে পারে এখানে না এলে বোঝা যেত না ভাবতে ভাবতে অর্কর সাথে ভেতরে যাওয়ার পর মৌ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আমার তো মনে হয়…তুমি নিজেই এখোনো ঠিক করে জানো না কে কোন জন…
- ইস…আমি চিনি না নাকি…শুধু মামন আর অর্ক ছাড়া আর সবাইকে দেখেছি…দাদু, দিদা, মাসী, মামা, মামীমা, সুমনাদি…
- না না…আরো এক জন আছে যাকে তুমি দেখোনি আগে…
ওর কথা শুনে মৌ বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…কে?
অরিত্র একটু গম্ভীর হয়ে ‘লালু’ বলতেই সবাই হেসে ফেলল। মৌ বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে দেখে অর্ক দিদির কাছে গিয়ে বলল…দিদি…লালু মানে আমাদের কুকুরটা…
সবার সাথে আলাপ হওয়ার পর প্রথমে চা আর তার কিছুক্ষন পরে মামীমা জোর করে লুচি, আলুভাজা, পায়েস, মিষ্টি খাইয়ে তবে রেহাই দিয়েছে, ‘না না সত্যিই আর খেতে পারবো না’ বললেও শোনেনি। মামীমাকে বোঝাতে না পেরে অসহায় চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে ও হেসে ফেলে বলেছে আমি বাবা কিছু বলতে পারবো না।
দাদুর কথাই ঠিক প্রমান হয়ে গেল। বিশ্বাস কাকু তিন দিনের ভেতরে মোটামুটি বেশ কিছুটা খবর জোগাড় করতে পেরেছে, দূর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার রাস্তায় ওই নামে একটা গ্রাম আছে, বাস রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে। মৌ এর বলা নামের একজনের খবর পাওয়া গেছে, ওই গ্রামেই থাকেন,কাছাকাছি একটা হাই কলেজের হেড স্যার। একটা ফোন নাম্বারও পাওয়া গেছে কিন্তু যতবার ফোন করা হয়েছে সুইচড অফ। কোনো এক মন্ত্রীর জেলা সফর শুরু হতে যাচ্ছে বলে পুলিশ মহল খুব ব্যাস্ত থাকায় বিশ্বাস কাকু আরো কয়েকটা দিন সময় চেয়েছিলেন যাতে কাউকে পাঠিয়ে দেখে নিতে পারেন ওটাই সঠিক জায়গা কিনা কিন্তু মৌ খবরটা পাওয়ার পর এতটাই ছটপট করছে যে যা হবে হবে, একবার গিয়েই দেখা যাক না, না মিললে ফিরে আসবে ভেবে যাওয়ার ডিশিশান নেওয়া হয়ে গেছে। বিশ্বাস কাকুর দেওয়া খবর অনু্যায়ী যখন তখন নাকি বাস বন্ধ হয়ে যায় ওই রাস্তায় তাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো ভেবে কপাল ঠুকে শুক্রবার খুব ভোরে মৌকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরিত্র, বেরোবার আগে দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেছে, খুশী মনে যা, একদম চিন্তা করিস না, আমার মন বলছে নিশ্চয় তোর মামাদের সাথে দেখা হবে। ব্যারাকপুর পেরিয়ে গেলে অরিত্র ওকে পেছনের সিটে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে বললে মৌ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে ‘কেন’? ‘শুক্লাদি বলছিল তুমি নাকি রাতে ঠিক করে ঘুমোও নি’ বলাতে লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল...আসলে খুব চিন্তা হচ্ছে, এতদুর থেকে গিয়ে যদি দেখা না হয়। ‘চিন্তা কোরো না, যদি খুঁজে না পাই তাহলে দুর্গাপুর ফিরে এসে থেকে যাবো না হয় আজ, আবার কাল সকালে নতুন করে খুঁজতে যাবো’ বলাতে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল...তোমাকে আমার জন্য আর কতো ঝামেলায় পড়তে হবে কে জানে। অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতে চাপ দিয়ে হাসি মুখে বলল...কি হয়েছে তাতে, তোমার জন্য করবো না তো কার জন্য করবো বলো...
দূর্গাপুর পৌছতে সাড়ে এগারোটা মতো বাজলো। আরো কিছুটা আগে পৌঁছোনো যেত কিন্তু হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ী দেখে মৌ এমন ভাবে ওর হাত চেপে ধরে ভয়ের চোখে তাকাচ্ছিল যে বাধ্য হয়ে স্পীড কমাতে হয়েছিল। এর পরে রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখে গাড়ী থামিয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ওকে বোঝাতে গিয়েছিল ভয়ের কিছু নেই কিন্তু মৌ কোনো কথা শুনতে রাজী নয়। ওর হাত চেপে ধরে বলেছে...না, তুমি জোরে চালাবে না, কিছু হয়ে গেলে? কিছুতেই ওকে বোঝানো গেল না দেখে ‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আস্তে চালাবো’ বলাতে তবেই গাড়ীতে উঠেছে। দুর্গাপুরে একটা মোটামুটি ভালো হোটেল দেখে খেয়ে নিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিভাবে যেতে হবে। রাস্তা ভুল না করলে আর ঘন্টা দেড় দুই মতো লাগবে জেনে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়তে হল…যদি ভুল জায়গায় পৌঁছে যায় তাহলে ফিরে আসার মতো অবস্থায় থাকতে হবে। অবশ্য বিশ্বাস কাকু তো আছেই, খুব দরকার হলে লোকাল থানার সাহায্য পেতে অসুবিধা হবে না।
দূর্গাপুর পর্যন্ত রাস্তা ঠিক ছিল, হাইওয়েতে গাড়ী চালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি কিন্তু বাঁকুড়ার রাস্তায় পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেতে হচ্ছিল খারাপ রাস্তা কাকে বলে…একে সরু রাস্তা, উলটো দিক থেকে গাড়ী এলে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে সাইড দিতে হচ্ছে…তার উপর মাঝে মাঝে পিচ বলে কিছু নেই। দু ধারে শুধু খটখটে শুকনো ফাঁকা মাঠ। ওই দুপুর বেলা মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে দু একটা ঝুপড়ি ধরনের দোকান দেখা গেলেও লোকজনের নাম গন্ধ নেই। অরিত্র সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে মৌয়ের দিকে তাকালে দেখতে পেল ও খুব একটা স্বস্তিতে নেই…সারা মুখে একটা চিন্তার ছাপ…সাথে যেন একটু অপরাধবোধও কাজ করছে এই ভেবে যে ওর জন্য এত কষ্ট করে অরিত্রকে আসতে হয়েছে। একটা গাছের ছায়ায় গাড়ীটা দাঁড় করিয়ে দিলে মৌ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকালে অরিত্র বলল…বুঝতে পারছি না ঠিক যাচ্ছি কিনা…
- কি করবে?
- দেখি…কোনো গাড়ী এলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি…
মৌ মুখটা নিচু করে নিয়ে বলল…আমার জন্য তোমাকে কত ঝামেলায় পড়তে হল বলোতো…
- হুমম…পড়েছি তো কি হয়েছে…মুখ গোমড়া করে না থেকে একটু হাসবে কি?
- কি করে হাসবো…না এলেই ভালো ছিল…
- ইস…না এলেই ভালো ছিল…মামাকে না পেলে বিয়েটা কি করে হবে শুনি…
- যাদের মামা নেই তাদের কি বিয়ে হয়না?
- আমার এত কিছু জানার দরকার নেই, তোমার বিয়ে মামা ছাড়া হবে না…বুঝেছো? আর… তোমার বিয়ে না হলে আমারও যে বিয়ে হবে না…আমার বাবা চিরকুমার থাকার আর কোনো ইচ্ছে নেই…
মৌ ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে না হেসে থাকতে না পেরে বলল…আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তোমার যত খুশী মামা খোঁজো…আমার কি। গ্রীষ্মের শুনশান দুপুর, কথা বলতে বলতে ওর মুখে আর চিন্তার ছাপ দেখতে না পেয়ে অরিত্র চুপ করে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হল কিছু বলতে চাইছে আর বুঝে গেলে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেছে ‘উঁ হুঁ, এখানে এই ফাঁকা রাস্তায় ওসব চলবে না। না বললে কে শুনছে? তুমি আমার কাছে না এলে কি হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসতে পারি ভেবে একজন নিজের জায়গাতে বসেই এদিকে ঝুঁকে এসেছে। এই... না...কেউ এসে গেলে? বলতে গিয়েও অন্যজন বুঝিয়েছে তারও খুব একটা যে অনিচ্ছা আছে তা নয়...আর একজন তো কথা শোনার জায়গাতেই নেই। কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ‘উমম...না...কথা শোনো’...বলেও কাজ না হলে বাধ্য হয়ে বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুট স্বরে বলেছে তুমি খুব দুষ্টূ...কথা শোনো না। মিষ্টী মেয়ের মুখে আদর করে দুষ্টু বলা যে কতটা মিষ্টি হতে পারে তা যে শোনে সেই শুধু বোঝে। না না করে গেলেও এত কাছে পেলে কি আর আদর না করে থাকা যায় নাকি ভেবে সবকিছু ভুলে গিয়ে আদর করে আর করতে দিয়ে প্রায় সারাদিনের জার্নির ধকল আর দুশ্চিন্তার রেশ যেন কেটে গেল নিমেষে। কিছুক্ষন কেটে গেছে, তারপরে...এই, এবারে ছাড়ো...বললে একজন আস্তে করে বলেছে ‘ইচ্ছে করছে না তো...
বেশ কিছুটা দূরে উল্টোদিক থেকে একটা বাস আসছে দেখে অরিত্র তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে এল। এসির ভেতর থেকে বাইরে এসে যেন চোখ মুখ ঝলসে গেল…দুপুরের হাওয়া তো নয় যেন লু বইছে। ওকে হাত তুলে ইশারা করতে দেখে বাসটা ধুলোর ঝড় তুলে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র ওদের গন্তব্য বাস স্টপের নাম বলে ঠিক যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বাস ড্রাইভারের কাছ থেকে জানা গেল ঠিকই যাচ্ছে…আরো ঘন্টা খানেক লাগবে পৌঁছোতে। ড্রাইভার বাস ছাড়ার আগে জানিয়ে গেল দূর্গাপুরের দিক থেকে পরের বাসটা আর মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে এসে যেতে পারে…চাইলে ওটার পেছন পেছন যেতে পারে ওরা। গাড়ীতে বসে লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনের দিকে দেখতে দেখতে সত্যিই দেখা গেল একটা বাস আসছে। আগের বারের মতোই গাড়ীটাকে থামিয়ে বাস কন্ডাকটারের সাথে কথা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত মনে বাসটার পেছন পেছন যেতে যেতে দুজনের হেসে গড়াগড়ি যাবার মতো অবস্থা। সামনের স্টপে বাসটা দাঁড়ালে একজন মাঝ বয়সী লোক একটা মোরগ হাতে করে বাসে উঠতে গিয়ে হাত ফসকে মোরগটা ঝটপট করে উড়ে এসে গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়লে জনা তিনেক লোক কোত্থেকে হৈ হৈ করে দৌড়ে এসে মোরগটাকে ধরার চেষ্টা করলো…একজন রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রায় গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়ে মোরগটাকে ধরে বের করে নিয়ে এসে মালিকের হাতে ধরিয়ে দিল। ওদিকে বাস দাঁড়িয়ে আছে, মোরগের মালিক উঠলে তবে বাস ছাড়লো। পরের দুটো স্টপে আর কিছু হয়নি, তারপরের স্টপে আবার এক মজার ঘটনা। বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে প্রায় দশ বারো জনের একটা দল নেমে কিচির মিচির করতে করতে সামনের মোরাম রাস্তার দিকে হাঁটা দিয়েছে…বাসটা সবে ছেড়েছে এমন সময় ওদের একজন পেছন ফিরে হাত তুলে দৌড়ে এসে বাসটাকে থামালো…চিৎকার চেঁচামেচি শুনে যা বোঝা গেল তা হল ওদের আরো একটা বাচ্চা বাসে থেকে গেছে। কন্ডাক্টার বোধহয় খুঁজে পেতে একটা বছর দুই আড়াই এর বাচ্চার হাত ধরে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ওটাই কিনা। ততক্ষনে বাচ্চার মা ও ফিরে এসেছে…বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ফেলে কন্ডাক্টারকে গালাগালি করতে শুরু করে দিল, যেন ওর দোষেই বাচ্চাটা বাসে থেকে গিয়েছে। কন্ডাক্টারও ছাড়বে কেন…নিজের কটা বাচ্চা তারই হিসেব নেই বলে উলটে দু চার কথা শুনিয়ে তবে বাস ছাড়ার ঘন্টি বাজালো। মৌ-কে নিজের মনে হাসতে দেখে অরিত্র ওর দিকে তাকালে ও জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা, ওই সবকটা বাচ্চা কি একজনের হতে পারে? হু…কেন হতে পারে না বললে মৌ হেসে ফেলে বলল…বাব্বা, পারেও বটে। অরিত্র হাসতে হাসতে বলল…ওদের মা বাবা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে তো…তাই। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ধ্যাত, তুমিও না খুব অসভ্য বলাতে অরিত্র রাস্তার দিকটা দেখে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল… আচ্ছা ধরো আমাদেরও যদি অনেকগুলো হয়…আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো। এবারে আর মৌ থাকতে না পেরে চোখ পাকিয়ে ওর হাতে চিমটি কেটে বলল…এই, তুমি থামবে…ছিঃ… ছিঃ। নিজেদের ভেতরে হাসি ঠাট্টা করতে করতে কখন এক ঘন্টার জায়গায় ঘন্টা দেড়েক কেটে গেছে বুঝতে পারেনি। একটা জায়গায় বাস দাঁড়ালে পেছনের দরজার কন্ডাক্টার নেমে এসে জানালো ওদের একটু আগে বাঁ দিকের মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে।
বাসটা চলে গেলে সামান্য একটু এগোনোর পর একটা মোরাম রাস্তা পাওয়া গেল, নামেই রাস্তা…খানা খন্দে ভরা…সামনে একটা ভ্যান রিকশা দুজন সওয়ারী নিয়ে যাচ্ছে, পেরিয়ে যাবার উপায় নেই দেখে ওটার পেছন পেছন আস্তে আস্তে করে যেতে হচ্ছিল। বেশ কিছুটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে যাবার পর এক জায়গায় একটা খেলার মাঠ আর কলেজ দেখা গেল, খুব একটা পুরোনো কলেজ বলে মনে হল না। সামনেই কিছুটা চওড়া জায়গা আছে দেখে অরিত্র ভাবছিল ভ্যান রিক্সাটাকে পেরিয়ে গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করে নেবে কিন্তু তা আর হল না। ভ্যান রিক্সাটা কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল দেখে সামান্য একটু এগিয়ে গেলে দুজন কলেজের ছেলেকে পাওয়া গেল। ওদেরকে গ্রামের নাম করে জিজ্ঞেস করতে সামনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল আরো কিছুটা যেতে হবে। ততক্ষনে ভ্যান রিক্সাটাও চলে এসেছে দেখে ওদেরই একজন বলল ওই ভ্যানটা নাকি ওই গ্রামের দিকেই যাচ্ছে, তারপর নিজেই এগিয়ে এসে ভ্যানওয়ালাকে বলল…ও মাধব কাকা, তোমাদের গ্রামে যাবে গো…রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাও। ভ্যানওয়ালা নেমে এসে জিজ্ঞেস করল কার বাড়ী যাবে ওরা। দেবাশীষ মুখার্জি বলাতে কলেজের ছেলেটা খুব যেন খুব আপন এমন ভাব করে বলল ‘ও আপনারা স্যারের বাড়ী যাবেন? হ্যাঁ বলাতে ছেলেটি জানালো স্যার কলেজে নেই, কলেজের কাজে বাঁকুড়া গেছেন।
আবার সেই আগের মতো ভ্যানের পেছন পেছন যেতে যেতে একটা পুরোনো মন্দীর আর সামনের দীঘি দেখে মৌ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল…খুব চেনা চেনা লাগছে…ঠিক জায়গাতেই এসেছি মনে হচ্ছে। ওর চোখে মুখে যেন খুশী ঝরে পড়ছিল, ভালো করে দেখে বলল…হ্যাঁ…এটাই…আর একটু এগোলেই মামার বাড়ী…খুব ছোটো বেলায় দেখা কিন্তু এখোনো মনে আছে। ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছে বুঝতে পেরে মৌ বাইরের দিকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল আরো কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা যেটা ও ওর ছোটোবেলায় দেখেছিল।
আরো কিছুটা যাবার পর ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বলল এসে গেছি, তারপরেই নিজে নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে বাড়ীর লোকজনকেও বের করে নিয়ে এলো। ততক্ষনে সামনের রাস্তার ধার ঘেঁসে গাড়ীটা রেখে ওরা দুজনে নেমে এসেছে। মৌ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর সেই ছোটোবেলার স্মৃতি থেকে আরো কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা, বাড়ীটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অরিত্রর হাত চেপে ধরলে ওর দিকে তাকিয়ে অরিত্র বুঝতে অসুবিধা হল না যে আর কোনো ভুল নেই, ওরা ঠিক জায়গাতেই এসেছে। একজন মাঝ বয়সী মহিলা ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলে ভ্যানওয়ালা বলল…আরে বৌদি…কুটুম এসে দাঁড়িয়ে আছে…আর তোমরা সব ঘুমোচ্ছো। মৌকে দেখে চিনতে পারার কথা নয়…সেই কোন ছোটো বেলায় এসেছিল ও। মহিলা কি করবে বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলে মৌ এগিয়ে গিয়ে বলল… আমি মৌ…কোলকাতা থেকে আসছি। ওর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…মৌ? মানে বর্নার মেয়ে…মৌ? হ্যাঁ বলাতে জড়িয়ে ওকে ধরে কি করবে যেন বুঝতে পারছিল না…ওকে আদর করতে করতে বলল…চিনতে পারছিস আমাকে? আমি তোর মামীমা…এক এক করে বাড়ীর ভেতর থেকে বোধ হয় ওর দাদু আর দিদা বেরিয়ে এসে কে এসেছে জানতে পেরে ওকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অরিত্র চুপচাপ একটা খাটিয়ার উপরে বসে ছিল, সবাই মৌকে নিয়ে ব্যাস্ত…ওর দিকে কে তাকাবে এখন। খারাপ লাগার কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক…মেয়েটা কত বছর পর এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। ওকে নিয়েই তো সবাই থাকবে এখন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে ওদের কান্নাকাটি দেখে ভৌ ভৌ করে ডাক দিয়ে অরিত্রর দিকে এগিয়ে এসে জুল জুল করে দেখতে শুরু করল…নাক উঁচু করে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করল নতুন মানুষটা ভালো না খারাপ। অরিত্র চুক চুক করে আওয়াজ করে ডাকলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে লেজ নাড়াতে শুরু করল… অরিত্র ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলে কত দিনের চেনা এমন একটা ভাব করে পায়ের কাছে বসে পড়ল। অরিত্রর মনে মনে হাসি পেয়ে গেল…যাক…কেউ একজন তো ওর কাছে এসেছে ভেবে… একটু পরে গোটা দুয়েক মুরগী কোঁক কোঁক করে ডাকতে ডাকতে এসে খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ল দেখে কুকুরটা ঘ্যাঁক করে ডেকে উঠল…ভাবখানা যেন এমন…এই…তোরা এখান থেকে ভাগ। আমাদের বাড়ি কেন এসেছিস…ঠাকুমা দেখতে পেলে কিন্তু তাড়া করবে… ওর ডাক শুনে মুরগী দুটো ত্রাহি মধুসুদন ভাব করে দৌড় লাগালো…কুকুরটা একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে বোঝালো…দেখলে তো…কেমন ভাগিয়ে দিলাম। হাসি মুখে ওর মাথায় আদর করে একটা চাপড় দিতে আবার পায়ের কাছে বসে পড়ল কুকুরটা। মৌকে নিয়ে সবাই বাড়ীর ভেতরে গেছে দেখে ও উঠে চারদিকটা দেখছিল…উঠোনের একদিকে এক চালা একটা ঠাকুর দালান… ভেতরে সপরিবারে মা দূর্গা…খড়ের কাঠামো…এখোনো মাটির প্রলেপ পড়েনি…তার মানে বাড়ীতে দুর্গা পূজো হয়…বনেদী বাড়ী হবে…বাড়ীটা বেশ পুরোনো হলেও তো তাই মনে হচ্ছে। পেছনে কারুর পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে বছর পনেরো ষোলর একটা মেয়ে…কলেজ থেকে ফিরছে…অচেনা মানুষ দেখে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হলে বোধ হয় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। পেছন পেছন আরো একজন কলেজ থেকে ফিরলো…মেয়ে নয়…ছেলে… বয়স আর একটু কম…বড়জোর বছর বারো হতে পারে…আগের জনের মতো ওকে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল। কুকুরটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল, ছেলেটাকে দেখে লেজ নেড়ে হয়তো বলতে চাইলো আজ আর খেলতে যেতে হবে না, দেখো গিয়ে কে এসেছে। ছেলেটা ভেতরে চলে যাবার পর অরিত্র রাস্তার দিকে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে কুকুরটাকে কয়েকটা বিস্কুট দিলে খুব খুশি হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে খেয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে বলতে চাইলো আরো চাই। অরিত্র হাসি মুখে বাকি বিস্কুট গুলো একটা একটা করে খাওয়াতে খাওয়াতে দাদুকে ফোনে জানিয়ে দিল ওরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছতে পেরেছে। দাদু খুব খুশী হয়ে বলল...যাক বাবা, ভালোই হয়েছে...আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। আরো কিছুক্ষন বাড়ীতে কথা বলার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে আসতে দেখা গেল…সাথে ওই ছেলেটা। ও কাছে এসে সারা মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব নিয়ে বলল…এই…কিছু মনে কোরো না…সবাই আমাকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে তোমার কথা ভুলেই গেছে। অরিত্র হাসি মুখে বলল…মনে করার কিছু নেই, এত বছর পরে তোমাকে পেয়েছে…এটাই স্বাভাবিক...
- সত্যিই কিছু মনে করনি তো?
- না রে বাবা…দেখোনা…এর মধ্যে কেমন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছি।
মৌ অবাক হয়ে আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল…কাকে আবার জোটালে? অরিত্র কুকুরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালে মৌ হেসে ফেলে বলল…তুমি ও না পারো বাবা…শোনো না…এ আমার মামাতো ভাই…অর্ক…ওর সাথে আর একটু থাকো…কেমন...
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আমার জন্য এত ভাবতে হবে না…তুমি যাও…
মৌ যাবার আগে শুভকে বলল…এই অর্ক…কোথাও চলে যাবি না কিন্তু, দাদার সাথে থাকবি। যাকে বলা হল সে খুব মন দিয়ে গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ঘাড় নেড়ে জানালো বুঝেছে।
মৌ চলে যাবার পর অরিত্র ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল…তুমি কোন ক্লাসে পড়?
- সেভেনে…
- কলেজ কোথায়?
- ওই তো…আসার সময় যেখানটা তোমরা দাঁড়িয়েছিলে…বড় একটা খেলার মাঠ আছে…
- এই দেখো…আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম…তুমি জানলে কি করে?
- বা রে…ক্লাসের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় তো। আমাদের এখানে তো এত সুন্দর গাড়ী আসে না…তাই সবাই মিলে দেখছিলাম…
- তাই…তোমার গাড়ী ভালো লাগে?
- খুউব…আচ্ছা…অনেক দাম…তাই না?
- না না…খুব বেশি না…
অর্ক খুব অবাক গিয়ে বলল…বেশী না? এত সুন্দর দেখতে…
- বড় হও…তখন না হয় দাম নিয়ে ভাববে…
- আচ্ছা…দিদি তো বললো না তোমাকে কি বলে ডাকবো…
- হুমম…দুষ্টু দাদা বলে ডাকতে পারো…
অর্ক কেমন যেন অবাক হয়ে বলল…ধ্যাত…দুষ্টু আবার কারুর নাম হয় নাকি?
- হয়…সত্যিই আমার নাম দুষ্টু…
- তোমাকে কিন্তু একটুও দুষ্টু বলে মনে হচ্ছে না…
ওর কথা শুনে অরিত্র হাসি মুখে বলল…তাই? কি মনে হচ্ছে?
- বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন সুন্দর গল্প করছো আমার সাথে…রাজুদা তো পাত্তাই দেয় না…
- তাই? রাজুদা কে?
- বড়দির বর…বাইকে হাত দিলেই কেমন যেন করে…আমি যেন ভেঙ্গে ফেলবো…
- হুমম…বাইকটাকে খুব ভালোবাসে তো…তাই…
- তুমি গাড়ীটাকে ভালোবাসো না?
- খুব…
- আমাকে এক বার গাড়ী চড়াবে?
- কেন চড়াবো না? চলো…তোমার কলেজের সামনে থেকে ঘুরে আসি…
- না না…এখন না, দাদু বকবে…তোমাকে নিয়ে বাড়ীতে যেতে বলেছে একটু পরে, বেড়াতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। কাল সকালে যাবো…থাকবে তো?
- হুম…থাকবো…
অর্ক আনন্দে প্রায় নেচে উঠে বলল…খুব মজা হবে। ওদের কথার মাঝখানে কুকুরটা একবার ডেকে উঠলে অরিত্র জিজ্ঞেস করল… ওর কোনো নাম আছে? অর্ক খুব গর্বের সাথে বলল…হ্যাঁ…লালু…জানো তো…ও একদিন কলেজের সামনে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল…খুব ছোটো…কলেজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছিলাম। মা তো কিছুতেই রাখতে দেবে না…এত ছোটো…ওর মা নাকি কাঁদবে…কান্নাকাটি করে দাদুকে দিয়ে বলাতে তবে রাজী হয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষন অর্কর সাথে গল্প করার পর বাড়ীর সামনে থেকে কেউ জোরে...এই অর্ক…দাদাকে নিয়ে আয় বলাতে ও বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলল…আসছি দাদু… তারপর অরিত্রর হাত ধরে বলল…চলো…দাদু ডাকছে। অর্কর সাথে ভেতরে যেতে গিয়ে দাদুর সাথে দেখা হয়ে গেল, উনি অরিত্রর হাত ধরে বললেন…কিছু মনে করো না বাবা…মৌকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো আশা ছিল না…মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। অরিত্র দাদুকে প্রনাম করে বলল…না না…আমি কিছু মনে করিনি…এই তো এতক্ষন আপনার নাতির সাথে গল্প করলাম।
- যাও…বাবা…ভেতরে যাও…আমি এখুনি আসছি…ছেলেটাও বাড়ী নেই…কখন ফিরবে কে জানে…
দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা ভ্যান রিকশা এসে বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো…ওদিকে তাকিয়ে দাদু বললেন…যাক…বাবা…ছেলেটা এসে গেছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন…আরে শোন মৌ এসেছে…আমি মাছের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখি।
- বাস থেকে নেমে মাধবের কাছে শুনেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম কাজ ফেলে…মাছের ব্যাবস্থা করে এসেছি…একটু পরে মাধবের ছেলে এসে জাল ফেলবে…
- যাক বাবা…ভালো করেছিস। নিশ্চিন্ত হলাম…ছেলে মেয়ে দুটোকে ভালো করে খাওয়াতে পারবো কিনা চিন্তা হচ্ছিল…আর শোন…এ হল অরিত্র…আমাদের মৌ কে সাথে করে নিয়ে এসেছে...
অরিত্র মামাকে প্রনাম করতে যেতে না না করে উঠে বললেন…থাক…থাক…প্রনাম করতে হবে না…সারা দুনিয়ার ধুলো পায়ে…কেমন জায়গায় থাকি দেখছো তো…
মানুষ কতটা আন্তরিক হতে পারে এখানে না এলে বোঝা যেত না ভাবতে ভাবতে অর্কর সাথে ভেতরে যাওয়ার পর মৌ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আমার তো মনে হয়…তুমি নিজেই এখোনো ঠিক করে জানো না কে কোন জন…
- ইস…আমি চিনি না নাকি…শুধু মামন আর অর্ক ছাড়া আর সবাইকে দেখেছি…দাদু, দিদা, মাসী, মামা, মামীমা, সুমনাদি…
- না না…আরো এক জন আছে যাকে তুমি দেখোনি আগে…
ওর কথা শুনে মৌ বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…কে?
অরিত্র একটু গম্ভীর হয়ে ‘লালু’ বলতেই সবাই হেসে ফেলল। মৌ বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে দেখে অর্ক দিদির কাছে গিয়ে বলল…দিদি…লালু মানে আমাদের কুকুরটা…
সবার সাথে আলাপ হওয়ার পর প্রথমে চা আর তার কিছুক্ষন পরে মামীমা জোর করে লুচি, আলুভাজা, পায়েস, মিষ্টি খাইয়ে তবে রেহাই দিয়েছে, ‘না না সত্যিই আর খেতে পারবো না’ বললেও শোনেনি। মামীমাকে বোঝাতে না পেরে অসহায় চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে ও হেসে ফেলে বলেছে আমি বাবা কিছু বলতে পারবো না।