25-02-2019, 12:32 PM
এগারোটা মতো বাজে, ভালোই রোদ উঠেছে...কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে মনে হয়েছে অনেকদিন ছাদের গাছ গুলোর যত্ন আত্তি কিছুই করা হয়নি। দাদু মাঝে মাঝে লোক ডেকে করায় শুনেছে কিন্তু তারা কি আর নিজের মতো করে করবে’ ভেবে ওটাই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে ওই রোদের মাঝেই মাথায় একটা টুপি পরে ছাদে চলে গেছে। বেশ কিছুক্ষন একা একা থাকায় আবার মনটা খারাপ লাগছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক গাছের গোড়া পরিস্কার, মাটি খোঁড়া ইত্যাদি করে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা হয়ে গেলেও ‘কিছুতেই নিচে যাবো না’ ভেবে এক ভাবে কাজ করে যাচ্ছিল ও। পাশের বাড়ীর জেঠিমার ডাকে মুখ তুলে তাকালো...কি রে দুষ্টু...এই রোদে কি করছিস? এত সময় পরে কথা বলার মতো কাউকে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোমর সোজা করতে করতে বলল... অনেকদিন গাছগুলোকে দেখতে পারিনি গো জেঠিমা। তাই ভাবলাম, আজ সময় আছে যখন সেরেই ফেলি। জেঠিমা ওর কথা শুনে একটু বকুনি দিয়ে বলল...কি জানি বাবা, এই আজকালকার ছেলে পুলেদের বোঝা দায়। তোর দিদান বোধ হয় জানে না তাই না রে? জেঠিমা কথাটা জিজ্ঞেস করলেও ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল... জানলে কি আর তোকে আসতে দিতো! অরিত্র জেঠীমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ইশারা করে আস্তে কথা বলতে বলল ও যাতে দিদান নীচ থেকে শুনতে না পায়। ও খুব ভালো করে জানে জেঠীমার বলা কথাটা কতটা সত্যি।
জেঠিমার সাথে কিছুক্ষন বকবক করে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে জেঠিমা চলে যাবার পর। আবার সেই জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে...না, কিছুতেই যাবো না নীচে। ও কেন আসছে না একবার? এতক্ষনে তো স্নান করে ছাদে জামাকাপড় শুকোতে দিতে আসার সময় হয়ে গেছে নাকি তাও হয়নি? এই যে আজ সকালে বললে আমাকে আর কষ্ট দেবে না? ভুলে গেলে এর ভেতরেই? তোমরা মেয়েরা সত্যিই কি নিষ্ঠুর...কেন বোঝো না আমি একবারের জন্য হলেও দেখতে চাইছি তোমাকে? আর কিছু কি চেয়েছি? নিজেই প্রশ্ন করছে কাজ করতে করতে আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছে... না না...ও তো এমন নয়...মাঝে যা হবার হয়ে গেছে...তাতে ওর তো কিছু করার ছিল না। কি মনে করে মুখ তুলে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা যেন ভরে গেল খুশিতে। হৃদপিন্ড যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যাকে একবার দেখার জন্য এত সময় মনে মনে নিজের সাথে নিজে কথা বলছিল সে এসেছে... দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মাত্র চুল ভিজিয়ে স্নান করে এলো, লাল টুকটুকে সালোয়ারের সাথে দুধ সাদা কুর্তি, ভালো করে গা না মুছে পরার জন্য এখানে ওখানে ভিজে আছে। জামাকাপড় মেলা হয়ে গেছে দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই হয়তো এসেছে। নিজেকে রোদের হাত থেকে বাঁচাতে দিদানের মেলে রাখা শাড়ীর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ও। হালকা আকাশী নীল সুতির শাড়ির নীলাভ ছায়া ওর সদ্যস্নাত শরীরে...ঠিক যেন ছায়া নয় তা বরং যেন একটা হালকা রং এর ছটা ওর উজ্জল মসৃন ত্বকে পিছলে যেতে গিয়েও যেন আটকে থাকতে চেয়ে ওকে করে তুলেছে আরো মোহময়ী, ঠিক যেন হাল্কা নীলাভ রুপসী সমুদ্রকন্যা। ওর চোখে মুখে বকুনি দেবার ইচ্ছে, ভালোবাসা মাখানো শাষনের সুরে বলল... এই রোদের ভেতরে আর তোমাকে কাজ করতে হবে না...চলো। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই তো হয়ে এসেছে...তুমি যাও, আমি আসছি। মৌ আগের মতো অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ স্বরে বলল... না, তুমি আগে চলো...না হলে আমি যাবো না। আচ্ছা, তুমি শেডের নীচে দাঁড়াও...আমি আসছি’ বলাতে ও নরম গলায় জিজ্ঞেস করল ঠিক তো? অরিত্র ঘাড় কাত করে বাধ্য ছেলের মতো হ্যাঁ বলাতে ও ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে অরিত্র এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল... ভেজা চুলে একটা তোয়ালে জড়ানো,তোয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা অবাধ্য চুলের শেষ প্রান্তে তখোনো কয়েক ফোঁটা জলের বিন্দু রোদের ভেতরে যেন হীরের টুকরোর মতো ঝলসে উঠছে...পড়ে যেতে যেতে যেন আটকে গিয়ে বলতে চাইছে...না, কিছুতেই আমরা যাবো না তোমাকে ছেড়ে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে ভুলে গিয়েছিল ওকে কথা দিয়েছে এখুনি যাচ্ছে। মৌ যেতে গিয়েও একবার ফিরে তাকালো...তখোনো ও ওঠেনি, ওর দিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র অপ্রস্তুতের হাসিতে মুখ ভরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাজের জিনিষপত্র গুলো এক এক করে তুলে নিয়ে জায়গায় রেখে দিয়ে ও ফিরে আসছিল। মৌ সিঁড়ির দরজার ঠিক পরেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর অপেক্ষায়। অরিত্র সামনে এলে নিচু গলায় ওকে দাঁড়াতে বলে কাছে এগিয়ে এসে চুলে জড়ানো তোয়ালেটা খুলে নিয়ে ওর মুখের ঘাম আস্তে আস্তে মুছে দিতে দিতে বলল...খুব অভিমান...না? অরিত্র কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের মনেই যেন বলল... কি করবো... শুক্লাদি একা একা রান্না করছে দেখে যেতে হয়েছিল। অরিত্র এবারেও কিছু না বলে চুপ করে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের কাজ করে যেতে যেতে বলল...আমি কি একা একা কথা বলে যাবো? অরিত্র অভিমানের স্বরে বলল... তাই বলে কি একবারের জন্যও আসা যেতো না? মৌ মুখ তুলে ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজ করে যেতে বলল... তাই বলে তুমি আমার উপরে অভিমান করে নিজেকে এইভাবে শাস্তি দেবে? অরিত্র কলেজের বাচ্চাদের মতো করে ‘বেশ করবো, তুমি না এলে আবার করবো’ বলাতে মৌ একবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে ওর একেবারে কাছে সরে এসে আগের মতোই নিচু স্বরে বলল... আমারও তো ইচ্ছে করছিল তোমার কাছে আসতে! হঠাৎ করে অবুঝ হয়ে যাওয়া ছেলেটা যেন এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল, ওর আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি বুঝে আস্তে করে বলল... জানি। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ওর মুখে ক্ষনে ক্ষনে রং এর পরিবর্তন দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল...এখোনো অভিমান করে আছো? অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... অভিমান করে তো থাকতে পারি না। ও যে অভিমান করে থাকতে পারবেই না সেটা জানা ছিল কিন্তু সেটা ওর নিজের মুখে বলাতে যেন আরো ভালো লাগলো শুনতে আর তাই শুনে মৌ হাসি মুখে বলল... তাহলে একটু হাসো...ইস কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে। অরিত্র ওর কথা বলার ধরনে না হেসে থাকতে না পেরে বলল...তোমার জন্যই তো...সব দোষ তোমার। মৌ আগের মতোই হাসি মুখে বলল... আচ্ছা বাবা...সব দোষ আমার...এই দেখো কান ধরলাম...এবারে ঠিক আছে? অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল... থাক... আমি কি কান ধরতে বলেছি? ওদিক থেকে মনে হল...দিদান মৌ কোথায় গেলি বলে ডাকলে মৌ ‘আ-স-ছি দি-দা-ন...বলে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল...আজ কিন্তু একসাথে খাবো...দেরী করবে না...কেমন। মান অভিমানের পালা শেষ... একজন বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় কাত করে বলেছে আচ্ছা... দেরী হয়ে গেছে ভেবে বা বিশেষ কারুর অভিমান ভাঙ্গাতে পারার খুশীতে একজন ত্রস্ত হরিনীর মতো তর তর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যাচ্ছে, আর একজন খুশী মনে ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিল ও চলে যাক, তারপর আমি যাবো... সিঁড়ির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগের মুহুর্তে এক পলকের জন্য থমকে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে একজন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে মুক্তো ঝরানো মিষ্টি হাসি... কয়েকটা মুহুর্ত থমকে গিয়ে সেই মুক্তো কূড়োতে কুড়োতে একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ পেরোতে শুরু করেছে আর একজন...
রবিবার সবাই এক সাথে গল্প করতে করতে খাওয়ার চল ছিল কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেটা বন্ধ। মন মেজাজ ভালো না থাকলে যা হয়। মৌ না হয় নিজের থেকে বলেছিল আজ এক সাথে খাবে কিন্তু খেতে বসতে গিয়ে আজ দাদু কেন হঠাৎ মৌ কোথায় খোঁজ করল বোঝা গেল না। অরিত্র চুপচাপ চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে গিয়ে ভাবছিল তাহলে কি দাদু কিছু বুঝতে পেরেছে? মৌ আগের মতো ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে না সেটা সবাই জানে কিন্তু ওদের ভেতরে যে কিছু কথা হয়েছে সেটা তো কেউ জানে না। মৌ নিজেই দাদুদেরকে কিছু বলে দিয়েছে কি? কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াতে শুক্লাদি কি একটা বললো দাদুকে কিন্তু খেয়াল করতে পারলো না। তারপরেই মনে হল...দাদুরা নিজের থেকে বুঝলে তো ভালোই, আমাকে আর নিজের থেকে জানাবার কথা ভাবতে হবে না। ওকে অন্যমনস্ক দেখে দাদু জিজ্ঞেস করল...কি রে কি হয়েছে? অরিত্র মুখ তুলে দাদূর দিকে তাকাতে গিয়ে দিদানের সাথে মৌকে দেখে একটু থমকে গিয়ে বলল... কই কিছু না তো। তারপরেই শুক্লাদির দিকে তাকিয়ে বলল... আজ কি কি স্পেশাল রান্না করলে গো? আজ বহুদিন পর ওকে কি রান্না হয়েছে জিজ্ঞেস করতে দেখে শুক্লাদি হাসি মুখে বলল... আজ তোর দাদুর পছন্দের তেল কই আর তোর পছন্দের মাংশ। অরিত্র ‘বাঃ খুব ভালো’ বলাতে দিদান ওদিক থেকে বলল... আজ কিন্তু মৌ মাংশ রান্না করেছে। দিদানের কথা শুনে কিছু না বলে মৌ এর দিকে মুখ তুলে তাকালে ও লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল... ও দিদান তোমাকে যে বলতে বারন করেছিলাম। দাদু হেসে ফেলে বলল... আরে কি হয়েছে বললে...আয়, আজ আমরা সবাই একসাথে খাবো। কতদিন একসাথে খাই না বলতো। অরিত্র দাদুর কথা শুনে বুঝলো আর যাই হোক না কেন মৌ নিজের থেকে কিছু জানায় নি...যাকগে, ও নিজেই না হয় বলবে...আজ না হয় কাল তো বলতেই হোতো...
আজ দুপুরে খাওয়ার সময়ে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটার জন্য অরিত্র মানসিক ভাবে তৈরী ছিল না। সেই আগের মতো সবাই গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। অনেকদিন পর সবাই যেন কিছুটা হলেও মন খুলে কথা বলতে পেরে ভীষন খুশী। অরিত্র মনে মনে খুশী হলেও কম কথা বলার চেষ্টা করছিল। বেশীর ভাগ সময়ে মুখ নীচু করে খেয়ে যেতে যেতে যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল... ওর কথা বলার থেকে খাওয়াতেই বেশী মন রয়েছে কিন্তু আসল কারনটা যে অন্য জায়গায় তা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। এক পলকের জন্য মৌকে দেখে ও থমকে গিয়েছিল, এখন যেন আবার নতুন করে ওকে ভালো লেগে গেল, সামান্য একটা ছোট্ট সাদা টিপ কপালের মাঝে আর চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়া যেন ওর মুখটাকে অসামান্য করে তুলেছে। যতই ওকে ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করুক না কেন সবার সামনে তা সম্ভব নয় বুঝে মুখ নীচু করে খেতে খেতে ওর কথাই ভাবছিল। পায়ের পাতায় আলতো ভাবে নরম কিছুর ছোঁয়া পেয়ে প্রায় চমকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে ভাবছিল কি হতে পারে...মুখ তুলে মৌ এর তাকিয়ে দেখলো দিদান ওকে আরো কিছু দিতে চাইছে আর ও ‘আর না দিদান, সত্যিই পারবো না’... বলে আটকাবার চেষ্টা করছে। মৌ কি ওর পায়ের উপরে পা রেখেছিল ভেবেও মনে হল...না মনে হয়...হয়তো আমার ভুল হয়েছে...ওর কথা ভাবছি বলেই হয়তো ও আমাকে ছুঁয়েছে ভেবেছি মনে করে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে খাওয়ায় মন দিল... রান্না সত্যিই খুব ভালো হয়েছে...অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেতে খেতে ভাবছিল শুধু রান্না নয়, হতে পারে মন ভালো আছে বলে সবকিছুই ভালো লাগছে বা মৌ নিজের হাতে রান্না করেছে আর তাই এত ভালো লাগছে। আবার পায়ের উপরে সেই আলতো নরম স্পর্শ... মুখ নীচু করে থেকেই আড় চোখে মৌ এর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও দিদানের দিকে তাকিয়ে বলছে...দিদান আর একটা মাছ নাও না...খুব ভালো হয়েছে খেতে। এদিকে পায়ের উপরে স্পর্শটা আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে... না, আর কোনো সন্দেহ নেই, কি হচ্ছে সবার চোখের আড়ালে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সবার মাঝখানে বসেও ওর ছোঁয়া পেয়ে ভীষন ভালো লাগার সাথে সাথে ভয় করছিল যদি কেউ বুঝে যায়...কিন্তু কিছু করার নেই...মৌ ওর দিকে তাকাচ্ছেই না যে ওকে সবার চোখ এড়িয়ে ইশারা করে বারন করবে। ওকে বারন করার কথা ভাবলেও নিজের পা সরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না। এত ভালো লাগছিল যে খাওয়ার কথা ভুলে চুপ করে বসেছিল বুঝতেই পারেনি...দিদানের ডাকে যেন বুঝতে পারলো ওকে খাওয়া শেষ করতে হবে।
শুয়ে শুয়ে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন গভীর ঘমের ভেতরে তলিয়ে গেছে নিজেই জানে না। বেশ লম্বা ঘুমের পর কোনোরকমে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল না কটা বাজে...ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারলো না... এতো ঘুমিয়েছে যে চোখ এখোনো ঝাপসা হয়ে আছে। দক্ষিনের ঝির ঝিরে হাওয়ায় ঠান্ডার আমেজ পেয়ে বুঝলো বিকেল হয়ে গেছে। উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোল বালিশটাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছিল ...কই, মৌ তো এলো না চা নিয়ে। কি আবার হলো ভাবতে ভাবতে জানলার বাইরের দিকে তাকালো। মাধবীলতার গাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে। বুক ভরে মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে নিজের মনেই বলে ফেলল...আঃ...কি মিষ্টি। আপন মনে কথা গুলো বললেও কেউ যে এসে শুনে ফেলেছে খেয়াল করেনি। কারুর আস্তে করে মিষ্টি গলায়... কি মিষ্টি? শুনে ফিরে তাকালো... মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বিছানার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে ওকে মন ভরে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে গিয়ে ভুলেই গেছে ও কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সেই একই মেয়ে যাকে এক এক সময়ে দেখলে এক এক রকমের মনে হয়, সেই একই টিপ কপালে, শুধু কাজলের রেখা যেন সামান্য একটু ছড়িয়ে পড়েছে চোখের পাতায়, যদিও তাতে ওর সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কমেনি বরং নতুন এক মাত্রা পেয়েছে । কালো হরিন চোখ দুটোকে করে তুলেছে আরো নিস্পাপ। মৌ ওকে চোখের পলক না ফেলে দেখে যেতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, কই বললে না তো কি মিষ্টি? অরিত্র একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল ‘কে আবার...তুমি। মৌ মুখটা গোমড়া করে বলল... ইস...মিথ্যুক কোথাকার। এই না...মিথ্যে কেন হবে বলাতে মৌ হেসে ফেলে বলল...মিথ্যেই তো...তুমি তো ওদিকে তাকিয়ে ছিলে। তুমি কি জানতে নাকি আমি এসেছি? অরিত্র হেসে ফেলে বলল... বোসো...সেই কখন থেকে ভাবছি...তুমি আসছো না। মৌ ওর দিকে মুখ করে বসতে বসতে বলল...এসেছিলাম তো, তুমি ঘুমোচ্ছো দেখে আর ডাকিনি। ‘ইস, খুব মিস করেছি তাহলে বলো’ বলে ওর দিকে তাকালে মৌ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই, বলোনা...কি মিষ্টি? অরিত্র আর কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একগোছা মাধবীলতার ফুল তুলে নিয়ে এসে বলল...শুঁকে দেখ...কি মিষ্টি গন্ধ...আমার তো ভীষন ভালো লাগে... মৌ ওর হাত থেকে ফুলের গোছাটা নিয়ে চোখ বুজে বুক ভরে গন্ধ নিয়ে জিজ্ঞেস করল... এবারে বলো...কে বেশী মিষ্টি। অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল... বলবো না...সে আছে একজন। মৌ একই ভাবে ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল...তাই? ‘হু...তাই তো’ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মৌ ওর চোখের ভাষায় বুঝে গেলো কি বলতে চাইছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে দিয়েছে হাতে ধরা ফুলের গোছা...আর একজন সেই ফুলের গোছা নিয়ে হাত বাড়ালে কাছে সরে এসেছে অপরজন, মুখ নিচু করে থেকে ওকে দিয়েছে ফুলের গোছা চুলে গুঁজে দিতে। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে থেকে একজনের চোখের মুগ্ধতার ভেতর দিয়ে বুঝেছে কত সুন্দর লাগছে ওকে...
আরো কিছুক্ষন দুজনে মিলে সেই আগের মতো বকবক করে গেলো...ঠিক কি নিয়ে কেউই জানে না...মৌ হঠাৎ ইস...ভুলেই গেছিলাম তোমাকে ডাকতে এসেছি...এই চলো না... বলতে অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্জেস করল... কোথায়?
- বা-রে… দাদুদেরকে জানাতে হবে না?
- এখনই?
- হুঁ…এখনই…
- পরে হলে হবে না?
- কেন…এখোনো বিশ্বাস হচ্ছে না?
- না তা নয়…
- তবে?
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল… আজই না বললে হোতো না?
- উঁ… হুঁ…কেন? লজ্জা করছে?
- নাঃ…ঠিক তা নয়… ভাবছি ঠিক কি ভাবে শুরু করবো…
- এই, আমার ঘরে চলো না…
- কেন?
- তোমার মায়ের ফটো আছে না…আগে মাকে বলো, তারপর দাদুদেরকে বলবে…কেমন…
ঠিকই বলেছে মৌ, মা ছাড়া আর কে আছে সবথেকে কাছের’ ভেবে ওর সাথে এসেছে পাশের ঘরে। মায়ের ফটোর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল…কতবার দেখেছে কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে মায়ের সুন্দর মুখটা আরো বেশী খুশীতে ভরে গেছে… মৌ একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল…ওর চোখে জল দেখে কাছে এসে হাত ধরে ফিসফিস করে বলল… কই…বলো। অরিত্র মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে মনে মনে বলল… আর্শীবাদ করো মা… ওকে যেন আমি সারা জীবন খুশী রাখতে পারি।
অরিত্র ঠিকই ভেবেছিল, কয়েকদিন ধরে মৌ-এর আচার ব্যাবহারে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা দাদুদের চোখ এড়ায়নি স্বাভাবিক ভাবেই। অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও ওর মুখেও যে সেই যন্ত্রনার ছাপ নেই সেটাও না বোঝার কথা নয়। ওদের দুজনকে একসাথে আসতে দেখে দাদু একটু গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল…কি ব্যাপার… আবার কিছু সমস্যা? অরিত্র দাদু আর দিদানের মাঝে বসে পড়ে বলল… না...না …সমস্যা আবার কি হবে…
- তাহলে?
- না … মানে…তোমাদেরকে কিছু বলার ছিল…
- বুঝেছি…
অরিত্র একবার দাদু আর একবার দিদানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল কি বুঝেছে। দিদান ওকে ওইভাবে তাকাতে দেখে কাছে টেনে নিয়ে বলল...তোকে সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আর তোকে দেখে বুঝবো না রে বোকা? অরিত্র দিদানকে জড়িয়ে ধরে থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকে ভাবছিল ‘বাঁচলাম, নিজের মুখে এসব কথা বলা যে কতটা ঝামেলার তা যেন হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি। দিদান ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দাদু কিছু বলতে চাইছে দেখে থেমে গিয়ে বলল...আচ্ছা, তুমি আগে বলে নাও। দাদু এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে দেখতে না পেয়ে বলল...আগে আমার ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে…এই মেয়ে কোথায় গেলি আবার… সামনে আয়। মৌ সোফার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুক্লাদি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে মিনমিন করে বলল…আমি আবার কি করলাম দাদু? দাদু আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল… আমি আবার কি করলাম? পরের জিনিষ না বলে নেওয়াকে কি বলে শুনি? মৌ শুক্লাদির গা ঘেঁষে বসে থেকে আস্তে করে বলল…আমি কেন চুরি করতে যাবো দাদু… আমি তো শুধু তোমাদেরকে কে দেখাশোনা করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম…
- হুম… বুঝেছি…তুই জিজ্ঞেস করলি কে আমাদেরকে দেখাশোনা করবে আর তার উত্তরে বুদ্ধুটা তোর চুলে ফুল গুঁজে দিল…বাঃ…
মৌ দাদুর কথা শুনে লজ্জায় জিব কেটে কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো...দেখলে তো কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল। একবার তো মনে করিয়ে দিতে পারতে... অরিত্রর ওর চোখে চোখ রেখে যেন বোঝাতে চাইলো...খেয়াল না থাকলে কি করবো আমি। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে দাদু হেসে ফেলে বলল...থাক আর লজ্জা পেতে হবে না, বেশ তো লাগছে দেখতে। দাদু তারপরেই দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল...কি গো বলোনা...কি মিষ্টি লাগছে না আমাদের মেয়েটাকে? ঠিক তোমাকে যেমন দেখতে লাগতো...মনে আছে? এবারে দিদানের লজ্জা পাওয়ার পালা, দাদুকে বকুনি দিয়ে বলল...বুড়ো হয়ে গেলে তবু ছেলেমানুষী গেল না। দাদু হাসতে হাসতে বলল...নাতির কাছে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তারপরেই মুখটা আগের মতো গম্ভীর করে বলল... এই শোন, তোরা দুটোতে মিলে খুব জ্বালিয়েছিস আমাদেরকে… আর যেন এদিক ওদিক না দেখি…বুঝলি? আর যদি কথা না শুনিস তো বিয়ে দিয়ে দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দেব… দেখবো কি করিস। দাদুর কথা শুনে দিদান হেসে ফেলে বলল… ঘর থেকে বের করে দিলে তো যেদিকে পারবে চলে যাবে…ওদের আর কি…যত চিন্তা তো আমাদের। ওদিকে মৌ শুক্লাদিকে জড়িয়ে ধরে লজ্জা মাখানো আদুরে গলায় বলল...ও শুক্লাদি দেখোনা...দাদু কেমন বকে দিল আর দিদানও কিসব বলছে। শুক্লাদি ওকে আদর করতে করতে বলল...বকবে না তো কি... কম চিন্তায় ফেলেছিলি নাকি?
শুধু বাড়ীর মানুষ গুলোই যেন নয়, সাথে সাথে সারা বাড়ীটাও যেন খুশী ধরে রাখতে পারছে না। বাগানের ভুঁইচাপা ফুল গুলো যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল যার হাত ধরে এই বাড়ীতে এসেছিল তার জীবনে বসন্ত ফিরে আসার জন্য, তার জীবনে ভালোবাসা ফিরে এসেছে আর তাই তাদের ফুটতে সময় লাগেনি একটুও...সবুজ ঘাসের কার্পেটের মাঝে মাটি ছুঁয়ে থাকা বেগুনী ফুল গুলো যেন এক একটা একটা ছবি। শুধু কি ভুঁইচাপা... সাথে সাথে লাল টুকটুকে গ্লোব-ও তাদের সৌন্দর্য যেন কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে ন... একে অপরকে ছুঁয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইছে কতো ভালোবাসি তোমায়। একটা করে দিন আসছে আর কিভাবে চলে যাচ্ছে যেন বোঝাই যাচ্ছে না। সকালে অফিস বেরোবার সময় খুব তাড়াহুড়ো থাকে বলে অরিত্রর হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা অনেক দিনের। আগে যেটা হোতো ও বেরোবার জন্য তৈরী হতে শুরু করলে প্রায় দিনই দিদান বা শুক্লাদি কেউ না কেউ ওকে খাইয়ে দিতো, না হলে হয়তো প্রায় কিছু মুখে না দিয়েই চলে যাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে। মৌ আসার পরেও একই ভাবে চলে আসছিল ব্যাপারটা, দিদান বা শুক্লাদির ওকে আদর করে খাইয়ে দেওয়াটা ও খুব ইচ্ছে করলেও কোনোদিনই চায়নি নিজের হাতে নিতে, হয়তো দিদা নাতির সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে বুঝেছিল ওর ওই অধিকারটা ছিনিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। এসবই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছিল প্রায়, বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অরিত্রর সাথে সাথে নিজেদেরও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় দিদানরাও খুব একটা জোর করতো পারতো না। এই মুহুর্তে সব কিছু আগের মতো বা তার থেকেও বেশী কিছু হয়ে যাওয়ায় অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও দিদান নিজের থেকেই ওকে না খেয়ে বেরোতে দিতে চাইছিল না। প্রথম দিন নিজের হাতে খাইয়ে দিতে গেলে অরিত্র সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়ে দিদানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে... উমম দিদান...দাও...কতোদিন তোমার হাতে খাইনি বলোতো। দিদান ওকে খাইয়ে দিয়ে ... তুইও তো খেতে চাইতিস না বললে ও দিদানকে জড়িয়ে ধরে বলল...তুমিও তো আগের মতো জোর করতে না...তাই না। দিদান হেসে ফেলে বলল...আমাকে আর জোর করতে হবে না...জোর করার জন্য আর একজন তো আছে। অরিত্র খেতে খেতে বলল... ‘উমম না দিদান...তোমার হাতে খাওয়া কি আর... ওর কথা শেষ হবার আগেই মৌ ঘরে ঢুকে ওকে দিদানের হাতে ওকে সেই আগের মতো খেতে দেখে থেমে গেলে দিদান ওকে ডেকে বলল...এই নে মৌ...খাইয়ে দে তো। মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলে দিদান ওর হাতে খাওয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... এতদিন আমরা সামলেছি, এবারে বাবা তোর জিনিষ তুই বুঝে নে। অরিত্র দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে বলল...দিদান, আমি কি জড় পদার্থ নাকি? দিদানও হাসি মুখে বলল... তা কিছুটা বই কি। মৌ দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার নাতি তো তোমার হাতে খেতে বেশী ভালো লাগে বলছিল মনে হয়। দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল...ওর কথা ছাড়তো, পেটে ক্ষিধে আর মুখ ফুটে না বলা ওর চিরকালের অভ্যাস। দিদান তারপরেই ওর কানে কানে বলল... ছেলেদের সব কথা শুনতে নেই...বুঝলি? মৌ হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে।
দিদান চলে যাবার পর মৌ ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল, কিছুটা খাওয়ার পর... এই, না ...আর খেতে পারবো না বলাতে মৌ মুখটা ভার করে বলল... তাহলে আমিও আজ সারাদিন কিছু খাবো না। আরে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আট-টা পঞ্চাশের গ্যালপিং লোকালটা ধরতে পারবো না বললেও মৌ শুনতে চাইলো না... গলা নীচু করে বলল ওই সব খাওয়ার সময় হয় আর আর একটু খেতে গেলে দেরী হয়ে যায়...তাই না? অরিত্র দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে বলল... ওইগুলো তো অনেক মিষ্টি খেতে...তাই না...
- পেট ভরবে ওতে?
- পেট না ভরুক, মন তো ভরবে...
মৌ কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে বলল...এই...
- উমম...না...আগে বলো খাবে...
- আচ্ছা বাবা খাবো...আগে দাও...
- উঁ হুঁ...আগে খাও, তারপরে দেবো...
মিষ্টি মেয়ের আরো মিষ্টি গলায় বলা কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না, তার উপরে আবার দিদান বলে গেছে ও নাকি ওর জিনিষ...তাই মেনে নিতে হয়েছে ও যা বলেছে। খাওয়া হয়ে গেলে অরিত্রকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌ চোখ পাকিয়ে বলল...উঁ হুঁ...আগে মুখ ধুয়ে এসো আর তাই শুনে আর একজন মাথা নেড়ে বোঝালো না আগে চাই। কি আর করা যাবে কথা যখন দিয়েছি, তাই হোক ভেবে আর একজন হাসি মুখে চোখ বুজে থেকে বোঝালো... তোমার যা চাই নাও...
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ চলে গেছে কিভাবে যেন বোঝাই যায়নি। দাদু আর দেরী করতে চাইছিল না একেবারেই। ছুটির দিন বিকেলে আর হাঁটতে না বেরিয়ে সবাইকে নিয়ে বসে বিয়ের কথা তুলতেই মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে দিদানের পেছনে লুকোবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে মুখ নীচু করে বসে ছিল। অরিত্র একটা ফোন এসে যাওয়াতে যেন পালিয়ে বেঁচেছে। তার আগে অবশ্য বলে গেছে...তোমরা যা ভালো বোঝার করো। ওর কথা শুনে দাদু পেছন থেকে বলেছে...তা তো বলবিই ...সব দায়িত্ব যেন আমাদের আর উনি শুধু বিয়ে করবেন। ও হ্যাঁ, শুনে যা, তুই যদি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াস তাহলে কিন্তু বৌ হাতছাড়া হয়ে যাবে...তোর দিদান তো বুড়ী হয়ে গেছে...বুঝেছিস। দাদুর কথা বলার ধরন দেখে দিদানের সাথে শুক্লাদিও হেসে ফেলেছে। মৌ-ও থাকতে না পেরে মুখ টিপে হেসে ফেলায়, দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল... আচ্ছা শোন…তোর বাড়ীতে জানাতে হবে তো নাকি? মৌ একটু চুপ করে থেকে বললো… কিছু দরকার নেই… বিল্টু আর মিষ্টি এলেই হবে।
- না রে… যা হবার তো হয়েই গেছে…আমাদের দিক থেকে তো একটা দায়িত্ব আছে জানাবার…পরে আবার কথা না ওঠে যে আমরা তোর টাকার লোভে এইসব করেছি।
মৌ একটু অভিমানের সাথে বলল…আমার টাকার দরকার নেই,সব কিছু ওদেরকে দিয়ে দেবো। তোমাদের কাছে থাকতে পারবো…এর থেকে বেশি আমার আর কি চাই। দাদু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে বলল...আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম রে। তুই যখন সব কিছু দিয়ে দিবি বলছিস তো তাই কর, ওটাই সব দিক থেকে ভালো হবে। টুকটাক আরো কিছু কথার পর দিদান জিজ্ঞেস করল…তোর এক মামা আছে শুনেছিলাম। মামার কথা শুনে ও চুপ করে থাকলেও একটু একটু করে ওর দু চোখ জলে ভরে উঠছিল…একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলল বড় হবার পর থেকে কোনোদিনই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবা অনেকবারই আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু কেন জানি না হয়ে ওঠেনি…তারপর তো বাবাও চলে গেল। ওর কথা শুনে কিছুক্ষন সবাই চুপ করে ছিল, কি বলবে যেন বুঝতে পারছিল না। একটু পরে দিদান জিজ্ঞেস করল…মামারা কোথায় থাকেন মনে আছে? মৌ একটু সময় চুপ করে থেকে আস্তে করে যেন নিজের মনেই বলল…অনেকদিন আগের কথা ,সব কিছু তো মনে নেই তবে বাবার কাছে শোনা কিছু কথা মনে আছে। ওর মনের ভেতরে যে মামা বাড়ীর ব্যাপারে ভালোই দূর্বলতা আছে বুঝে দাদু বলল…আমার তো মনে হয় তোর যাওয়া উচিত...
- যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু কে নিয়ে যাবে দাদু…
- কে আবার নিয়ে যাবে, দুষ্টু নিয়ে যাবে…দরকার হলে দু তিন দিনের ছুটি নিক…
- যেতে গেলে তো ঠিকানা লাগবে...
- ও নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না...জানিসই তো আমাদের বিশ্বাস সাহেব আছেনই... একবার শুধু বললেই হয়, তোর যেটুকু মনে আছে বললেই খুঁজে পেতে সব খবর বের করে ফেলবে।
জেঠিমার সাথে কিছুক্ষন বকবক করে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে জেঠিমা চলে যাবার পর। আবার সেই জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে...না, কিছুতেই যাবো না নীচে। ও কেন আসছে না একবার? এতক্ষনে তো স্নান করে ছাদে জামাকাপড় শুকোতে দিতে আসার সময় হয়ে গেছে নাকি তাও হয়নি? এই যে আজ সকালে বললে আমাকে আর কষ্ট দেবে না? ভুলে গেলে এর ভেতরেই? তোমরা মেয়েরা সত্যিই কি নিষ্ঠুর...কেন বোঝো না আমি একবারের জন্য হলেও দেখতে চাইছি তোমাকে? আর কিছু কি চেয়েছি? নিজেই প্রশ্ন করছে কাজ করতে করতে আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছে... না না...ও তো এমন নয়...মাঝে যা হবার হয়ে গেছে...তাতে ওর তো কিছু করার ছিল না। কি মনে করে মুখ তুলে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা যেন ভরে গেল খুশিতে। হৃদপিন্ড যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যাকে একবার দেখার জন্য এত সময় মনে মনে নিজের সাথে নিজে কথা বলছিল সে এসেছে... দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মাত্র চুল ভিজিয়ে স্নান করে এলো, লাল টুকটুকে সালোয়ারের সাথে দুধ সাদা কুর্তি, ভালো করে গা না মুছে পরার জন্য এখানে ওখানে ভিজে আছে। জামাকাপড় মেলা হয়ে গেছে দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই হয়তো এসেছে। নিজেকে রোদের হাত থেকে বাঁচাতে দিদানের মেলে রাখা শাড়ীর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ও। হালকা আকাশী নীল সুতির শাড়ির নীলাভ ছায়া ওর সদ্যস্নাত শরীরে...ঠিক যেন ছায়া নয় তা বরং যেন একটা হালকা রং এর ছটা ওর উজ্জল মসৃন ত্বকে পিছলে যেতে গিয়েও যেন আটকে থাকতে চেয়ে ওকে করে তুলেছে আরো মোহময়ী, ঠিক যেন হাল্কা নীলাভ রুপসী সমুদ্রকন্যা। ওর চোখে মুখে বকুনি দেবার ইচ্ছে, ভালোবাসা মাখানো শাষনের সুরে বলল... এই রোদের ভেতরে আর তোমাকে কাজ করতে হবে না...চলো। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই তো হয়ে এসেছে...তুমি যাও, আমি আসছি। মৌ আগের মতো অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ স্বরে বলল... না, তুমি আগে চলো...না হলে আমি যাবো না। আচ্ছা, তুমি শেডের নীচে দাঁড়াও...আমি আসছি’ বলাতে ও নরম গলায় জিজ্ঞেস করল ঠিক তো? অরিত্র ঘাড় কাত করে বাধ্য ছেলের মতো হ্যাঁ বলাতে ও ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে অরিত্র এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল... ভেজা চুলে একটা তোয়ালে জড়ানো,তোয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা অবাধ্য চুলের শেষ প্রান্তে তখোনো কয়েক ফোঁটা জলের বিন্দু রোদের ভেতরে যেন হীরের টুকরোর মতো ঝলসে উঠছে...পড়ে যেতে যেতে যেন আটকে গিয়ে বলতে চাইছে...না, কিছুতেই আমরা যাবো না তোমাকে ছেড়ে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে ভুলে গিয়েছিল ওকে কথা দিয়েছে এখুনি যাচ্ছে। মৌ যেতে গিয়েও একবার ফিরে তাকালো...তখোনো ও ওঠেনি, ওর দিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র অপ্রস্তুতের হাসিতে মুখ ভরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাজের জিনিষপত্র গুলো এক এক করে তুলে নিয়ে জায়গায় রেখে দিয়ে ও ফিরে আসছিল। মৌ সিঁড়ির দরজার ঠিক পরেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর অপেক্ষায়। অরিত্র সামনে এলে নিচু গলায় ওকে দাঁড়াতে বলে কাছে এগিয়ে এসে চুলে জড়ানো তোয়ালেটা খুলে নিয়ে ওর মুখের ঘাম আস্তে আস্তে মুছে দিতে দিতে বলল...খুব অভিমান...না? অরিত্র কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের মনেই যেন বলল... কি করবো... শুক্লাদি একা একা রান্না করছে দেখে যেতে হয়েছিল। অরিত্র এবারেও কিছু না বলে চুপ করে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের কাজ করে যেতে যেতে বলল...আমি কি একা একা কথা বলে যাবো? অরিত্র অভিমানের স্বরে বলল... তাই বলে কি একবারের জন্যও আসা যেতো না? মৌ মুখ তুলে ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজ করে যেতে বলল... তাই বলে তুমি আমার উপরে অভিমান করে নিজেকে এইভাবে শাস্তি দেবে? অরিত্র কলেজের বাচ্চাদের মতো করে ‘বেশ করবো, তুমি না এলে আবার করবো’ বলাতে মৌ একবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে ওর একেবারে কাছে সরে এসে আগের মতোই নিচু স্বরে বলল... আমারও তো ইচ্ছে করছিল তোমার কাছে আসতে! হঠাৎ করে অবুঝ হয়ে যাওয়া ছেলেটা যেন এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল, ওর আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি বুঝে আস্তে করে বলল... জানি। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ওর মুখে ক্ষনে ক্ষনে রং এর পরিবর্তন দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল...এখোনো অভিমান করে আছো? অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... অভিমান করে তো থাকতে পারি না। ও যে অভিমান করে থাকতে পারবেই না সেটা জানা ছিল কিন্তু সেটা ওর নিজের মুখে বলাতে যেন আরো ভালো লাগলো শুনতে আর তাই শুনে মৌ হাসি মুখে বলল... তাহলে একটু হাসো...ইস কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে। অরিত্র ওর কথা বলার ধরনে না হেসে থাকতে না পেরে বলল...তোমার জন্যই তো...সব দোষ তোমার। মৌ আগের মতোই হাসি মুখে বলল... আচ্ছা বাবা...সব দোষ আমার...এই দেখো কান ধরলাম...এবারে ঠিক আছে? অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল... থাক... আমি কি কান ধরতে বলেছি? ওদিক থেকে মনে হল...দিদান মৌ কোথায় গেলি বলে ডাকলে মৌ ‘আ-স-ছি দি-দা-ন...বলে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল...আজ কিন্তু একসাথে খাবো...দেরী করবে না...কেমন। মান অভিমানের পালা শেষ... একজন বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় কাত করে বলেছে আচ্ছা... দেরী হয়ে গেছে ভেবে বা বিশেষ কারুর অভিমান ভাঙ্গাতে পারার খুশীতে একজন ত্রস্ত হরিনীর মতো তর তর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যাচ্ছে, আর একজন খুশী মনে ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিল ও চলে যাক, তারপর আমি যাবো... সিঁড়ির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগের মুহুর্তে এক পলকের জন্য থমকে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে একজন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে মুক্তো ঝরানো মিষ্টি হাসি... কয়েকটা মুহুর্ত থমকে গিয়ে সেই মুক্তো কূড়োতে কুড়োতে একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ পেরোতে শুরু করেছে আর একজন...
রবিবার সবাই এক সাথে গল্প করতে করতে খাওয়ার চল ছিল কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেটা বন্ধ। মন মেজাজ ভালো না থাকলে যা হয়। মৌ না হয় নিজের থেকে বলেছিল আজ এক সাথে খাবে কিন্তু খেতে বসতে গিয়ে আজ দাদু কেন হঠাৎ মৌ কোথায় খোঁজ করল বোঝা গেল না। অরিত্র চুপচাপ চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে গিয়ে ভাবছিল তাহলে কি দাদু কিছু বুঝতে পেরেছে? মৌ আগের মতো ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে না সেটা সবাই জানে কিন্তু ওদের ভেতরে যে কিছু কথা হয়েছে সেটা তো কেউ জানে না। মৌ নিজেই দাদুদেরকে কিছু বলে দিয়েছে কি? কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াতে শুক্লাদি কি একটা বললো দাদুকে কিন্তু খেয়াল করতে পারলো না। তারপরেই মনে হল...দাদুরা নিজের থেকে বুঝলে তো ভালোই, আমাকে আর নিজের থেকে জানাবার কথা ভাবতে হবে না। ওকে অন্যমনস্ক দেখে দাদু জিজ্ঞেস করল...কি রে কি হয়েছে? অরিত্র মুখ তুলে দাদূর দিকে তাকাতে গিয়ে দিদানের সাথে মৌকে দেখে একটু থমকে গিয়ে বলল... কই কিছু না তো। তারপরেই শুক্লাদির দিকে তাকিয়ে বলল... আজ কি কি স্পেশাল রান্না করলে গো? আজ বহুদিন পর ওকে কি রান্না হয়েছে জিজ্ঞেস করতে দেখে শুক্লাদি হাসি মুখে বলল... আজ তোর দাদুর পছন্দের তেল কই আর তোর পছন্দের মাংশ। অরিত্র ‘বাঃ খুব ভালো’ বলাতে দিদান ওদিক থেকে বলল... আজ কিন্তু মৌ মাংশ রান্না করেছে। দিদানের কথা শুনে কিছু না বলে মৌ এর দিকে মুখ তুলে তাকালে ও লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল... ও দিদান তোমাকে যে বলতে বারন করেছিলাম। দাদু হেসে ফেলে বলল... আরে কি হয়েছে বললে...আয়, আজ আমরা সবাই একসাথে খাবো। কতদিন একসাথে খাই না বলতো। অরিত্র দাদুর কথা শুনে বুঝলো আর যাই হোক না কেন মৌ নিজের থেকে কিছু জানায় নি...যাকগে, ও নিজেই না হয় বলবে...আজ না হয় কাল তো বলতেই হোতো...
আজ দুপুরে খাওয়ার সময়ে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটার জন্য অরিত্র মানসিক ভাবে তৈরী ছিল না। সেই আগের মতো সবাই গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। অনেকদিন পর সবাই যেন কিছুটা হলেও মন খুলে কথা বলতে পেরে ভীষন খুশী। অরিত্র মনে মনে খুশী হলেও কম কথা বলার চেষ্টা করছিল। বেশীর ভাগ সময়ে মুখ নীচু করে খেয়ে যেতে যেতে যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল... ওর কথা বলার থেকে খাওয়াতেই বেশী মন রয়েছে কিন্তু আসল কারনটা যে অন্য জায়গায় তা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। এক পলকের জন্য মৌকে দেখে ও থমকে গিয়েছিল, এখন যেন আবার নতুন করে ওকে ভালো লেগে গেল, সামান্য একটা ছোট্ট সাদা টিপ কপালের মাঝে আর চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়া যেন ওর মুখটাকে অসামান্য করে তুলেছে। যতই ওকে ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করুক না কেন সবার সামনে তা সম্ভব নয় বুঝে মুখ নীচু করে খেতে খেতে ওর কথাই ভাবছিল। পায়ের পাতায় আলতো ভাবে নরম কিছুর ছোঁয়া পেয়ে প্রায় চমকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে ভাবছিল কি হতে পারে...মুখ তুলে মৌ এর তাকিয়ে দেখলো দিদান ওকে আরো কিছু দিতে চাইছে আর ও ‘আর না দিদান, সত্যিই পারবো না’... বলে আটকাবার চেষ্টা করছে। মৌ কি ওর পায়ের উপরে পা রেখেছিল ভেবেও মনে হল...না মনে হয়...হয়তো আমার ভুল হয়েছে...ওর কথা ভাবছি বলেই হয়তো ও আমাকে ছুঁয়েছে ভেবেছি মনে করে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে খাওয়ায় মন দিল... রান্না সত্যিই খুব ভালো হয়েছে...অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেতে খেতে ভাবছিল শুধু রান্না নয়, হতে পারে মন ভালো আছে বলে সবকিছুই ভালো লাগছে বা মৌ নিজের হাতে রান্না করেছে আর তাই এত ভালো লাগছে। আবার পায়ের উপরে সেই আলতো নরম স্পর্শ... মুখ নীচু করে থেকেই আড় চোখে মৌ এর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও দিদানের দিকে তাকিয়ে বলছে...দিদান আর একটা মাছ নাও না...খুব ভালো হয়েছে খেতে। এদিকে পায়ের উপরে স্পর্শটা আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে... না, আর কোনো সন্দেহ নেই, কি হচ্ছে সবার চোখের আড়ালে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সবার মাঝখানে বসেও ওর ছোঁয়া পেয়ে ভীষন ভালো লাগার সাথে সাথে ভয় করছিল যদি কেউ বুঝে যায়...কিন্তু কিছু করার নেই...মৌ ওর দিকে তাকাচ্ছেই না যে ওকে সবার চোখ এড়িয়ে ইশারা করে বারন করবে। ওকে বারন করার কথা ভাবলেও নিজের পা সরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না। এত ভালো লাগছিল যে খাওয়ার কথা ভুলে চুপ করে বসেছিল বুঝতেই পারেনি...দিদানের ডাকে যেন বুঝতে পারলো ওকে খাওয়া শেষ করতে হবে।
শুয়ে শুয়ে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন গভীর ঘমের ভেতরে তলিয়ে গেছে নিজেই জানে না। বেশ লম্বা ঘুমের পর কোনোরকমে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল না কটা বাজে...ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারলো না... এতো ঘুমিয়েছে যে চোখ এখোনো ঝাপসা হয়ে আছে। দক্ষিনের ঝির ঝিরে হাওয়ায় ঠান্ডার আমেজ পেয়ে বুঝলো বিকেল হয়ে গেছে। উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোল বালিশটাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছিল ...কই, মৌ তো এলো না চা নিয়ে। কি আবার হলো ভাবতে ভাবতে জানলার বাইরের দিকে তাকালো। মাধবীলতার গাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে। বুক ভরে মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে নিজের মনেই বলে ফেলল...আঃ...কি মিষ্টি। আপন মনে কথা গুলো বললেও কেউ যে এসে শুনে ফেলেছে খেয়াল করেনি। কারুর আস্তে করে মিষ্টি গলায়... কি মিষ্টি? শুনে ফিরে তাকালো... মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বিছানার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে ওকে মন ভরে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে গিয়ে ভুলেই গেছে ও কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সেই একই মেয়ে যাকে এক এক সময়ে দেখলে এক এক রকমের মনে হয়, সেই একই টিপ কপালে, শুধু কাজলের রেখা যেন সামান্য একটু ছড়িয়ে পড়েছে চোখের পাতায়, যদিও তাতে ওর সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কমেনি বরং নতুন এক মাত্রা পেয়েছে । কালো হরিন চোখ দুটোকে করে তুলেছে আরো নিস্পাপ। মৌ ওকে চোখের পলক না ফেলে দেখে যেতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, কই বললে না তো কি মিষ্টি? অরিত্র একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল ‘কে আবার...তুমি। মৌ মুখটা গোমড়া করে বলল... ইস...মিথ্যুক কোথাকার। এই না...মিথ্যে কেন হবে বলাতে মৌ হেসে ফেলে বলল...মিথ্যেই তো...তুমি তো ওদিকে তাকিয়ে ছিলে। তুমি কি জানতে নাকি আমি এসেছি? অরিত্র হেসে ফেলে বলল... বোসো...সেই কখন থেকে ভাবছি...তুমি আসছো না। মৌ ওর দিকে মুখ করে বসতে বসতে বলল...এসেছিলাম তো, তুমি ঘুমোচ্ছো দেখে আর ডাকিনি। ‘ইস, খুব মিস করেছি তাহলে বলো’ বলে ওর দিকে তাকালে মৌ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই, বলোনা...কি মিষ্টি? অরিত্র আর কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একগোছা মাধবীলতার ফুল তুলে নিয়ে এসে বলল...শুঁকে দেখ...কি মিষ্টি গন্ধ...আমার তো ভীষন ভালো লাগে... মৌ ওর হাত থেকে ফুলের গোছাটা নিয়ে চোখ বুজে বুক ভরে গন্ধ নিয়ে জিজ্ঞেস করল... এবারে বলো...কে বেশী মিষ্টি। অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল... বলবো না...সে আছে একজন। মৌ একই ভাবে ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল...তাই? ‘হু...তাই তো’ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মৌ ওর চোখের ভাষায় বুঝে গেলো কি বলতে চাইছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে দিয়েছে হাতে ধরা ফুলের গোছা...আর একজন সেই ফুলের গোছা নিয়ে হাত বাড়ালে কাছে সরে এসেছে অপরজন, মুখ নিচু করে থেকে ওকে দিয়েছে ফুলের গোছা চুলে গুঁজে দিতে। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে থেকে একজনের চোখের মুগ্ধতার ভেতর দিয়ে বুঝেছে কত সুন্দর লাগছে ওকে...
আরো কিছুক্ষন দুজনে মিলে সেই আগের মতো বকবক করে গেলো...ঠিক কি নিয়ে কেউই জানে না...মৌ হঠাৎ ইস...ভুলেই গেছিলাম তোমাকে ডাকতে এসেছি...এই চলো না... বলতে অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্জেস করল... কোথায়?
- বা-রে… দাদুদেরকে জানাতে হবে না?
- এখনই?
- হুঁ…এখনই…
- পরে হলে হবে না?
- কেন…এখোনো বিশ্বাস হচ্ছে না?
- না তা নয়…
- তবে?
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল… আজই না বললে হোতো না?
- উঁ… হুঁ…কেন? লজ্জা করছে?
- নাঃ…ঠিক তা নয়… ভাবছি ঠিক কি ভাবে শুরু করবো…
- এই, আমার ঘরে চলো না…
- কেন?
- তোমার মায়ের ফটো আছে না…আগে মাকে বলো, তারপর দাদুদেরকে বলবে…কেমন…
ঠিকই বলেছে মৌ, মা ছাড়া আর কে আছে সবথেকে কাছের’ ভেবে ওর সাথে এসেছে পাশের ঘরে। মায়ের ফটোর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল…কতবার দেখেছে কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে মায়ের সুন্দর মুখটা আরো বেশী খুশীতে ভরে গেছে… মৌ একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল…ওর চোখে জল দেখে কাছে এসে হাত ধরে ফিসফিস করে বলল… কই…বলো। অরিত্র মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে মনে মনে বলল… আর্শীবাদ করো মা… ওকে যেন আমি সারা জীবন খুশী রাখতে পারি।
অরিত্র ঠিকই ভেবেছিল, কয়েকদিন ধরে মৌ-এর আচার ব্যাবহারে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা দাদুদের চোখ এড়ায়নি স্বাভাবিক ভাবেই। অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও ওর মুখেও যে সেই যন্ত্রনার ছাপ নেই সেটাও না বোঝার কথা নয়। ওদের দুজনকে একসাথে আসতে দেখে দাদু একটু গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল…কি ব্যাপার… আবার কিছু সমস্যা? অরিত্র দাদু আর দিদানের মাঝে বসে পড়ে বলল… না...না …সমস্যা আবার কি হবে…
- তাহলে?
- না … মানে…তোমাদেরকে কিছু বলার ছিল…
- বুঝেছি…
অরিত্র একবার দাদু আর একবার দিদানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল কি বুঝেছে। দিদান ওকে ওইভাবে তাকাতে দেখে কাছে টেনে নিয়ে বলল...তোকে সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আর তোকে দেখে বুঝবো না রে বোকা? অরিত্র দিদানকে জড়িয়ে ধরে থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকে ভাবছিল ‘বাঁচলাম, নিজের মুখে এসব কথা বলা যে কতটা ঝামেলার তা যেন হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি। দিদান ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দাদু কিছু বলতে চাইছে দেখে থেমে গিয়ে বলল...আচ্ছা, তুমি আগে বলে নাও। দাদু এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে দেখতে না পেয়ে বলল...আগে আমার ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে…এই মেয়ে কোথায় গেলি আবার… সামনে আয়। মৌ সোফার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুক্লাদি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে মিনমিন করে বলল…আমি আবার কি করলাম দাদু? দাদু আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল… আমি আবার কি করলাম? পরের জিনিষ না বলে নেওয়াকে কি বলে শুনি? মৌ শুক্লাদির গা ঘেঁষে বসে থেকে আস্তে করে বলল…আমি কেন চুরি করতে যাবো দাদু… আমি তো শুধু তোমাদেরকে কে দেখাশোনা করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম…
- হুম… বুঝেছি…তুই জিজ্ঞেস করলি কে আমাদেরকে দেখাশোনা করবে আর তার উত্তরে বুদ্ধুটা তোর চুলে ফুল গুঁজে দিল…বাঃ…
মৌ দাদুর কথা শুনে লজ্জায় জিব কেটে কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো...দেখলে তো কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল। একবার তো মনে করিয়ে দিতে পারতে... অরিত্রর ওর চোখে চোখ রেখে যেন বোঝাতে চাইলো...খেয়াল না থাকলে কি করবো আমি। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে দাদু হেসে ফেলে বলল...থাক আর লজ্জা পেতে হবে না, বেশ তো লাগছে দেখতে। দাদু তারপরেই দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল...কি গো বলোনা...কি মিষ্টি লাগছে না আমাদের মেয়েটাকে? ঠিক তোমাকে যেমন দেখতে লাগতো...মনে আছে? এবারে দিদানের লজ্জা পাওয়ার পালা, দাদুকে বকুনি দিয়ে বলল...বুড়ো হয়ে গেলে তবু ছেলেমানুষী গেল না। দাদু হাসতে হাসতে বলল...নাতির কাছে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তারপরেই মুখটা আগের মতো গম্ভীর করে বলল... এই শোন, তোরা দুটোতে মিলে খুব জ্বালিয়েছিস আমাদেরকে… আর যেন এদিক ওদিক না দেখি…বুঝলি? আর যদি কথা না শুনিস তো বিয়ে দিয়ে দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দেব… দেখবো কি করিস। দাদুর কথা শুনে দিদান হেসে ফেলে বলল… ঘর থেকে বের করে দিলে তো যেদিকে পারবে চলে যাবে…ওদের আর কি…যত চিন্তা তো আমাদের। ওদিকে মৌ শুক্লাদিকে জড়িয়ে ধরে লজ্জা মাখানো আদুরে গলায় বলল...ও শুক্লাদি দেখোনা...দাদু কেমন বকে দিল আর দিদানও কিসব বলছে। শুক্লাদি ওকে আদর করতে করতে বলল...বকবে না তো কি... কম চিন্তায় ফেলেছিলি নাকি?
শুধু বাড়ীর মানুষ গুলোই যেন নয়, সাথে সাথে সারা বাড়ীটাও যেন খুশী ধরে রাখতে পারছে না। বাগানের ভুঁইচাপা ফুল গুলো যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল যার হাত ধরে এই বাড়ীতে এসেছিল তার জীবনে বসন্ত ফিরে আসার জন্য, তার জীবনে ভালোবাসা ফিরে এসেছে আর তাই তাদের ফুটতে সময় লাগেনি একটুও...সবুজ ঘাসের কার্পেটের মাঝে মাটি ছুঁয়ে থাকা বেগুনী ফুল গুলো যেন এক একটা একটা ছবি। শুধু কি ভুঁইচাপা... সাথে সাথে লাল টুকটুকে গ্লোব-ও তাদের সৌন্দর্য যেন কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে ন... একে অপরকে ছুঁয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইছে কতো ভালোবাসি তোমায়। একটা করে দিন আসছে আর কিভাবে চলে যাচ্ছে যেন বোঝাই যাচ্ছে না। সকালে অফিস বেরোবার সময় খুব তাড়াহুড়ো থাকে বলে অরিত্রর হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা অনেক দিনের। আগে যেটা হোতো ও বেরোবার জন্য তৈরী হতে শুরু করলে প্রায় দিনই দিদান বা শুক্লাদি কেউ না কেউ ওকে খাইয়ে দিতো, না হলে হয়তো প্রায় কিছু মুখে না দিয়েই চলে যাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে। মৌ আসার পরেও একই ভাবে চলে আসছিল ব্যাপারটা, দিদান বা শুক্লাদির ওকে আদর করে খাইয়ে দেওয়াটা ও খুব ইচ্ছে করলেও কোনোদিনই চায়নি নিজের হাতে নিতে, হয়তো দিদা নাতির সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে বুঝেছিল ওর ওই অধিকারটা ছিনিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। এসবই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছিল প্রায়, বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অরিত্রর সাথে সাথে নিজেদেরও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় দিদানরাও খুব একটা জোর করতো পারতো না। এই মুহুর্তে সব কিছু আগের মতো বা তার থেকেও বেশী কিছু হয়ে যাওয়ায় অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও দিদান নিজের থেকেই ওকে না খেয়ে বেরোতে দিতে চাইছিল না। প্রথম দিন নিজের হাতে খাইয়ে দিতে গেলে অরিত্র সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়ে দিদানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে... উমম দিদান...দাও...কতোদিন তোমার হাতে খাইনি বলোতো। দিদান ওকে খাইয়ে দিয়ে ... তুইও তো খেতে চাইতিস না বললে ও দিদানকে জড়িয়ে ধরে বলল...তুমিও তো আগের মতো জোর করতে না...তাই না। দিদান হেসে ফেলে বলল...আমাকে আর জোর করতে হবে না...জোর করার জন্য আর একজন তো আছে। অরিত্র খেতে খেতে বলল... ‘উমম না দিদান...তোমার হাতে খাওয়া কি আর... ওর কথা শেষ হবার আগেই মৌ ঘরে ঢুকে ওকে দিদানের হাতে ওকে সেই আগের মতো খেতে দেখে থেমে গেলে দিদান ওকে ডেকে বলল...এই নে মৌ...খাইয়ে দে তো। মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলে দিদান ওর হাতে খাওয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... এতদিন আমরা সামলেছি, এবারে বাবা তোর জিনিষ তুই বুঝে নে। অরিত্র দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে বলল...দিদান, আমি কি জড় পদার্থ নাকি? দিদানও হাসি মুখে বলল... তা কিছুটা বই কি। মৌ দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার নাতি তো তোমার হাতে খেতে বেশী ভালো লাগে বলছিল মনে হয়। দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল...ওর কথা ছাড়তো, পেটে ক্ষিধে আর মুখ ফুটে না বলা ওর চিরকালের অভ্যাস। দিদান তারপরেই ওর কানে কানে বলল... ছেলেদের সব কথা শুনতে নেই...বুঝলি? মৌ হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে।
দিদান চলে যাবার পর মৌ ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল, কিছুটা খাওয়ার পর... এই, না ...আর খেতে পারবো না বলাতে মৌ মুখটা ভার করে বলল... তাহলে আমিও আজ সারাদিন কিছু খাবো না। আরে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আট-টা পঞ্চাশের গ্যালপিং লোকালটা ধরতে পারবো না বললেও মৌ শুনতে চাইলো না... গলা নীচু করে বলল ওই সব খাওয়ার সময় হয় আর আর একটু খেতে গেলে দেরী হয়ে যায়...তাই না? অরিত্র দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে বলল... ওইগুলো তো অনেক মিষ্টি খেতে...তাই না...
- পেট ভরবে ওতে?
- পেট না ভরুক, মন তো ভরবে...
মৌ কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে বলল...এই...
- উমম...না...আগে বলো খাবে...
- আচ্ছা বাবা খাবো...আগে দাও...
- উঁ হুঁ...আগে খাও, তারপরে দেবো...
মিষ্টি মেয়ের আরো মিষ্টি গলায় বলা কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না, তার উপরে আবার দিদান বলে গেছে ও নাকি ওর জিনিষ...তাই মেনে নিতে হয়েছে ও যা বলেছে। খাওয়া হয়ে গেলে অরিত্রকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌ চোখ পাকিয়ে বলল...উঁ হুঁ...আগে মুখ ধুয়ে এসো আর তাই শুনে আর একজন মাথা নেড়ে বোঝালো না আগে চাই। কি আর করা যাবে কথা যখন দিয়েছি, তাই হোক ভেবে আর একজন হাসি মুখে চোখ বুজে থেকে বোঝালো... তোমার যা চাই নাও...
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ চলে গেছে কিভাবে যেন বোঝাই যায়নি। দাদু আর দেরী করতে চাইছিল না একেবারেই। ছুটির দিন বিকেলে আর হাঁটতে না বেরিয়ে সবাইকে নিয়ে বসে বিয়ের কথা তুলতেই মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে দিদানের পেছনে লুকোবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে মুখ নীচু করে বসে ছিল। অরিত্র একটা ফোন এসে যাওয়াতে যেন পালিয়ে বেঁচেছে। তার আগে অবশ্য বলে গেছে...তোমরা যা ভালো বোঝার করো। ওর কথা শুনে দাদু পেছন থেকে বলেছে...তা তো বলবিই ...সব দায়িত্ব যেন আমাদের আর উনি শুধু বিয়ে করবেন। ও হ্যাঁ, শুনে যা, তুই যদি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াস তাহলে কিন্তু বৌ হাতছাড়া হয়ে যাবে...তোর দিদান তো বুড়ী হয়ে গেছে...বুঝেছিস। দাদুর কথা বলার ধরন দেখে দিদানের সাথে শুক্লাদিও হেসে ফেলেছে। মৌ-ও থাকতে না পেরে মুখ টিপে হেসে ফেলায়, দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল... আচ্ছা শোন…তোর বাড়ীতে জানাতে হবে তো নাকি? মৌ একটু চুপ করে থেকে বললো… কিছু দরকার নেই… বিল্টু আর মিষ্টি এলেই হবে।
- না রে… যা হবার তো হয়েই গেছে…আমাদের দিক থেকে তো একটা দায়িত্ব আছে জানাবার…পরে আবার কথা না ওঠে যে আমরা তোর টাকার লোভে এইসব করেছি।
মৌ একটু অভিমানের সাথে বলল…আমার টাকার দরকার নেই,সব কিছু ওদেরকে দিয়ে দেবো। তোমাদের কাছে থাকতে পারবো…এর থেকে বেশি আমার আর কি চাই। দাদু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে বলল...আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম রে। তুই যখন সব কিছু দিয়ে দিবি বলছিস তো তাই কর, ওটাই সব দিক থেকে ভালো হবে। টুকটাক আরো কিছু কথার পর দিদান জিজ্ঞেস করল…তোর এক মামা আছে শুনেছিলাম। মামার কথা শুনে ও চুপ করে থাকলেও একটু একটু করে ওর দু চোখ জলে ভরে উঠছিল…একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলল বড় হবার পর থেকে কোনোদিনই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবা অনেকবারই আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু কেন জানি না হয়ে ওঠেনি…তারপর তো বাবাও চলে গেল। ওর কথা শুনে কিছুক্ষন সবাই চুপ করে ছিল, কি বলবে যেন বুঝতে পারছিল না। একটু পরে দিদান জিজ্ঞেস করল…মামারা কোথায় থাকেন মনে আছে? মৌ একটু সময় চুপ করে থেকে আস্তে করে যেন নিজের মনেই বলল…অনেকদিন আগের কথা ,সব কিছু তো মনে নেই তবে বাবার কাছে শোনা কিছু কথা মনে আছে। ওর মনের ভেতরে যে মামা বাড়ীর ব্যাপারে ভালোই দূর্বলতা আছে বুঝে দাদু বলল…আমার তো মনে হয় তোর যাওয়া উচিত...
- যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু কে নিয়ে যাবে দাদু…
- কে আবার নিয়ে যাবে, দুষ্টু নিয়ে যাবে…দরকার হলে দু তিন দিনের ছুটি নিক…
- যেতে গেলে তো ঠিকানা লাগবে...
- ও নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না...জানিসই তো আমাদের বিশ্বাস সাহেব আছেনই... একবার শুধু বললেই হয়, তোর যেটুকু মনে আছে বললেই খুঁজে পেতে সব খবর বের করে ফেলবে।