25-02-2019, 12:31 PM
মনের ভেতরে আশা নিরাশার দোলা নিয়ে কত সময় ও বসে আছে নিজেই হয়তো জানে না। মৌ ওকে কি বলতে চাইছে কিছুতেই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। একবার মনে হচ্ছে ও ফিরে আসতে চাইবে তো পরক্ষনেই মনে হচ্ছে ও হয়তো এখান থেকে চলে যাবার কথা বলবে। এক একটা সেকেন্ড যেন এক একটা যুগ, কখন বিকেল হবে...কখন জানতে পারবে ও কি বলতে চায় ভেবে যখন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না, নিজের উপরেই নিজের ধিক্কার এসে গেল...কেন ওকে ফিরে যেতে দিল, ওকে তো বলা যেতো যে আমি বিকেলে থাকবো না...তুমি যা বলার এখুনি বলো। কখন যে ও বাড়ী থেকে বেরিয়ে ক্লাবে চলে এসেছে নিজেই জানে না। শুভ একা একা ক্যারাম খেলছিল, ওকে দেখে.. আয় আয়, সেই কখন থেকে একা একা বোর হচ্ছি...বলাতে খেয়াল করল ও কোথায়। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল নিজেকে সামলে নিতে। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর বৃথা চেষ্টা করে ম্লান একটা হাসিতে শুভ কে বলল...বাজার থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গেল। শুভ ভালো করেই জানতো ও কখন বাজার থেকে ফিরেছে আর ওর দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলেও নতুন করে আর ওকে ঘা দিতে চাইলো না। মুখ নিচু করে বোর্ড সাজাতে সাজাতে বলল... মা একবার তোকে ডেকেছে। ওরিত্র আচ্ছা ঠিক আছে বলে স্ট্রাইকারটা বসিয়ে খেলায় মন দেবার চেষ্টা করল।
আজ কেন কে জানে ক্লাবে আর কেউ আসেনি। সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভ বাড়ী যেতে হবে বলাতে বেরিয়ে আসতে হয়েছে ক্লাব থেকে। কি করবে এত তাড়াতাড়ি বাড়ী গিয়ে...ওখানে গেলেই তো আবার বুকের ভেতরে রক্ত ঝরতে শুরু করবে ভেবে নদীর পাড়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসে চুপ করে দূরে তাকিয়ে বসেছিল। একটু পরে ওখান থেকেও উঠে আসতে হল...একা একা থাকলেই অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠছে...বাধ্য হয়ে বাড়ী ফিরে এসে দাদুর সাথে কিছুক্ষন দাবা খেলতে গিয়ে বারে বারে হেরে যাচ্ছিল দেখে দাদু বলল... কি করবি এতো ভেবে, যা হবার তা হবেই...যা, স্নান করে খেয়ে নে।
দুপুর থেকে বিকেল যেন হতে চাইছে না কিছুতেই। শুতে ভালো লাগছে না, বসতে ভালো লাগছে না...আবার মাথার ভেতরে চিন্তা গুলো এলোমেলো ভাবে আবার ঘুরতে শুরু করেছে দেখে নিজেকে অন্যমনস্ক করার জন্য উঠে বসে বাইরের দিকে তাকালো। দক্ষিন পুর্ব কোনে নিকষ কালো মেঘের ঘনঘটা চলছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে মনে হল চারদিক আস্তে আস্তে যেন থমথমে হয়ে আসছে... কাল বৈশাখীর পুর্বাভাষ। মনটাকে ভাবনা বিহীন করে দিয়ে প্রকৃতির সাথে নিজের তুলনা করে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল ওর...কি সুন্দর মিলে গেছে আজ ওর সাথে...মনে পড়ে গেল একটা গানের দু একটা লাইন আকাশে আজ রং-এর খেলা...মনে মেঘের মেলা...হারানো সুর হারানো গান ফুরালো যে বেলা...মনে মেঘের মেলা...
কখন যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে হয়তো বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টাও করেনি... নদীর ধারের গাছ গুলো হাওয়ার ধাক্কায় যেন এখুনি ভেঙ্গে পড়বে...উল্টোপাল্টা ঝোড়ো হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে দাপাদাপি করে বেড়ালেও যেন ওর কিছু যায় আসে না আর। হাওয়ার ধাক্কায় টেবিলের উপর থেকে কি একটা যেন পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল...যা যেতে চায় যাক...কি হবে ভেবে আর যেখানে নিজের জীবনটাই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির তান্ডব দেখতে দেখতে হয়তো ভাবছিল... পারো না আমাকেও এখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে? এতো কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারো আর পারো না আমার মতো দুর্ভাগাকে মেরে ফেলতে? সম্বিত ফিরে পেলো শুক্লাদির চিৎকারে... বসে বসে দেখছিস? ঘরটার কি অবস্থা হয়েছে দেখতে পাচ্ছিস না? শুক্লাদি দৌড়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না দেখে নিজেই উঠে গেল। জানলাটা গায়ের জোরে চেপে বন্ধ করে ফিরে আসার সময় দেখলো মৌ দরজার ঠিক বাইরে, ওর দিকে তাকিয়ে আছে... শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেল আরো কোথায় কি অবস্থা হচ্ছে দেখার জন্য। শুক্লাদি বেরিয়ে গেলে মৌ ও ফিরে গেল তবে নিজের ঘরে নয়...এক তলার দিকে। এক দৃষ্টে ওর ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে কি হল নিজের বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে করছিল ওকে টেনে হিঁচড়ে এখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতে, আমি তো তোমাকে অনেক করে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম...তুমি হতে দাওনি। বারে বারে আমার কাছে ছুটে আসতে। আমি তো তোমাকে ফিরিয়ে দিইনি...সব জেনে বুঝেও তুমি যা চেয়েছিলে আমি আমার সব কিছু দিয়ে পুরন করার চেষ্টা করেছি। তাহলে আজ কেন আমাকে এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে...বলতে পারো?
ভাবলেই সব কিছু করা যায় না। চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না... তারপরেই ভীষন খারাপ লাগলো মৌকে সব কিছুর জন্য দায়ী করার কথাটা ভেবে। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেই আবার মনে মনে মৌ এর কাছে ক্ষমা চাইলো... কিছু মনে করবে না...তোমার তো কোনো দোষ নেই। আমি তো জেনেশুনেই বিষ খেয়ে আজ নিজে জ্বলে পুড়ে মরছি। যার কাছে ক্ষমা চাইলো সে জানতেও পারলো না ও কি ভেবেছে আর কি বলতে চেয়েছে...একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ে পায়ে বেরিয়ে গিয়ে ছাদের দরজাটা খুলে ওই তান্ডবের ভেতরেই যেন নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ভিজতে ভিজতে হঠাৎ করে ফেলা ভুলটাকে ধুয়ে মুছে ফেলতে চাইলো।
ঝড় বৃষ্টির পর চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে। শুক্লাদি এসে দুবার ডেকে গেছে চা খাবার জন্য। অনেক দিন হয়ে গেছে ও আর এখানে একা একা চা খায় না...নিচে গিয়েই খেয়ে আসে। উঠি উঠি করেও যেতে ইচ্ছে করছে না... যদি মৌ এসে ফিরে যায়? কি করবে ভাবতে ভাবতে ...... কখন মৌ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারেনি। ওকে দেখতে পেয়েই আবার সেই সকালের মতো অভিমান বুকে দানা বাঁধতে শুরু করলেও মনের শেষ আশাটুকুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়ে ওকে ভেতরে ডাকলো। মৌ ভেতরে এসে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...’তুমি তো মাঝে মাঝেই থাকো না…দাদুদের বয়স হচ্ছে…কিছু ভেবেছো’? অরিত্র ওর কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল... ‘কি ভাববো’? কিছুক্ষন ও চুপ করে থাকার পর বলল ‘তুমি যখন থাকো না তখন দাদুদের দেখা শোনার জন্য তো কাউকে চাই। অরিত্র ওর কথার উত্তরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আস্তে করে বলল...তুমি তো আছো। ‘আমি যে নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি’ বলতে গিয়েও বলতে পারলো না মৌ। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো ওর। অরিত্র ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ’কিছু বললে না তো’? প্রশ্নটা শুনে ও অস্ফুট স্বরে বলল ‘আমার কি আর এখানে থাকা ঠিক হবে’?
- আমাদের দিক থেকে কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
- না।
- তাহলে?
- আমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিত আমার।
- কেন?
- কেউ তো আসবে… আজ না হয় কাল।
অরিত্র অবাক হয়ে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ‘তুমি কি আমার বিয়ের কথা বলছো’? মৌ এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘হ্যাঁ। অরিত্র বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো… যাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবেসে ফেলেছে তার মুখে ওকে ওন্য কাউকে বিয়ে করতে বলাটা যে কি যন্ত্রনার সেটা ওর থেকে হয়তো ভালো কেউ বুঝবে না। অরিত্র চুপ করে বসে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তোমার যদি অন্য কোনো কিছু কারন থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই’। ওর উত্তরটা শুনে মৌ যেন নিজের মনেই বলল...কিসের অধিকারে থাকবো? অরিত্র কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না…ও অধিকারের কথা কেন বললো? কি বলতে চাইছে? মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এলে, ও যা ভাবে ভাবুক…আর তো নতুন করে হারানোর কিছু নেই ভেবে কোনোরকমে বলল ‘অধিকার চাইলেই পেতে পারো কিন্তু তুমি তো চাইছো না। কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারছিল না ওর প্রতিক্রিয়াটা কি…বেশ কিছুক্ষন কেটে গেলেও কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো…মৌ নিজের কোলে মুখ গুঁজে বসে নিঃশ্বব্দে কাঁদছে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না… কোনোদিন ওকে নিজের অজান্তে হলেও কাঁদাবে ভাবেনি…আজও চায়নি… কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে উঠে গিয়ে পাশে বসে ওর পিঠে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল…’প্লিজ…আমি বুঝতে পারিনি…তোমার এতটা খারাপ লাগবে’…
নিজেকে আর বোধ হয় ও আটকে রাখতে পারলো না…ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলতে চাইলো ‘আমি নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি যা তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে। অরিত্র চুপ করে বসে থাকলো… ও এত কাঁদছে যে এই মুহূর্তে ওকে কিছু বলা আর না বলা একই ব্যাপার। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে, আস্তে আস্তে কান্না থেমে গেলেও আগের মতো মুখ গুঁজে বসে ছিল…হয়তো বুঝতে পারছিল না… মুখ তুলে কি শুনতে হবে… জীবনে কোনোদিন কিছু না পেয়ে আজ কিছু পাওয়ার সন্ধিক্ষনে এসেও বুঝতে পারছিল না কি করবে।
আরো কিছুক্ষন কেটে গেল… কিছু একটা শুনে আস্তে আস্তে মুখ তুলে এতদিন অভিমান বুকে করে নিয়ে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিজেই বুঝতে পারছিল না যা শুনেছে ঠিক কিনা… সত্যি না কি স্বপ্ন দেখছে… নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে না পেরে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল… মন চাইছে … আরো একবার নয় … বার বার ওই কথাটা শুনতে … সত্যিই যে ও বিশ্বাস করতে পারছে না … অরিত্রর মোবাইলটা বেজে বেজে থেমে গেল… প্রয়োজন মনে করল না উঠে গিয়ে ফোনটা ধরার… এই মূহুর্তে ফোন ধরার থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন ওর পাশে থাকা… না হলে যে ওকে সারা জীবন কিছু না পাওয়ার ব্যাথা বুকে করে নিয়ে বেড়াতে হতে পারে… ওর পাশে বসে থাকা একজন যে এখোনো ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি…আজ যে ওর প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে… হারিয়েও ফিরে পাবার এত কাছে এসে আবার হারানোর ব্যাথা ও পারবে না সহ্য করতে ভেবে জিজ্ঞেস করল… ‘কই ব’লো’…
কান্না ভেজা গলায় মৌ প্রশ্ন করলো ‘আমার ভুলটা কি না জেনেই এগোবে’?
- আমার আর কিছু জানার নেই মৌ…তোমাকে আমি যা জানি তাই আমার কাছে যথেষ্ট...
- তবুও, আমার অতীত…তোমার জানা উচিত...
- তোমার অতীত নিয়ে আমি জানতে চাই না…ভাবতেও চাই না ...
ওর দৃঢ স্বরে বলা কথাটা শুনে মৌ কয়েক মুহুর্ত থমকে গিয়ে আস্তে করে বলল...আমি চাই না…ভবিষ্যতে তোমার আমার কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।
- ঠিক আছে… তুমি যদি চাও… বলতে পারো।
বেশ কিছুক্ষন চুপ করে হয়তো নিজের সাথে বোঝাপড়া করল ও… আস্তে করে বলল… ‘আমি কারুর সাথে চলে যাবার জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। অরিত্র অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে, তাহলে কি ওর মায়ের কোনো ভুমিকা ছিল না? ওকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখে হয়তো মৌ বুঝতে পেরেছিল ও কি ভাবছে… আবার ও আস্তে আস্তে বলল… ‘মায়ের জন্যই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল… না হলে কি হত জানি না’।
- যার সাথে যেতে চেয়েছিলে সে আসেনি?
- না
- কেন?
- তখন বুঝতে পারিনি
- তুমি কি তাকে ভালোবাসতে?
- হয়তো।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...
অরিত্র বুঝতে পারছে না বলাতে মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... ‘বিল্টুকে একজন পড়াতে আসতো বাড়ীতে… ভাই এর পড়াশোনা নিয়েমাঝে মধ্যে কথা হোতো আমাদের। আগে কোনো ছেলের সাথে না মেশায় হয়তো কিছুটা হলেও আমার ভেতরে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। তারপর যখন বুঝতে পারলাম মায়ের দিক থেকে বিপদ আসছে, কি করবো ভেবে না পেয়ে ওকেই ভরসা করে বাড়ী ছাড়তে চেয়েছিলাম’…
অরিত্র কিছুটা সময় ওর থেকে শোনা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল...তুমি কি ওকে তোমার দুর্বলতার কথা জানিয়েছিলে?
- না
- তারপর?
- ওকে কারনটা বলিনি…শুধু বলেছিলাম আমাকে বাড়ী থেকে চলে যেতে হবে।
- কি বলেছিল? আসবে?
- হ্যাঁ
- আসেনি...তাই তো?
- হ্যাঁ
- তুমি একদিন যেন একা একা কোথাও গিয়েছিলে?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… জানতে গিয়েছিলাম কেন আসেনি …
- তোমার কি তখোনো সেই সামান্য হলেও দূর্বলতাটা ছিল?
- ঠিক তা নয়, খুব খারাপ লেগেছিল তাই মনে হয়েছিল জানা দরকার...
- দেখা হয়েছিল?
- হয়েছিল।
- আসেনি কেন?
- মা যদি ওর কিছু ক্ষতি করে ভেবে ও ভয় পেয়েছিল...এছাড়াও আগে থেকেই একজনের সাথে রিলেশান ছিল তাই আর আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি।
- তোমার দিক থেকে যখন তেমন কিছু ছিল না তো ওটা নিয়ে ভাবছো কেন?
- কিছুটা হলেও তো ছিল…তোমার সব কিছু শোনার পর মনে হয়েছিল ঠকানো ঠিক হবে না…অনেকবার ভেবেছিলাম চলে যাবো কিন্তু ভয় পেতাম যদি তুমি কিছু করে ফেলো… বলতে পারো দোটানায় পড়ে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত...
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…
- কি?
- তুমি সেদিন ফিরে এসে কেন কেঁদেছিলে…
- নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল…জানতাম তোমার কাছে ফিরতে চাইলে তুমি না করবে না কিন্তু নিজেই পারছিলাম না… আবার চলেও যেতে পারছিলাম না…
- আমি যদি বলি ওটা কোনো ব্যাপার নয়…তুমি আমার কাছে যা ছিলে তাই থাকবে…
- তবুও আমার মনে হচ্ছে…তুমি একবার ভেবে দেখো… সারাটা জীবনের ব্যাপার...
- ঠিক আছে…তুমি যখন চাইছো…তাই…আরো ভালো করে ভেবে দেখবো…
এরপরে হয়তো আর কারুর কিছু বলার ছিল না এই মুহুর্তে। মৌ আরো কিছুক্ষন বসে থাকার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে আমি আসি? অরিত্র হয়তো কিছু ভাবছিল, ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে থেকে তখুনি বলতে ইচ্ছে করছিল...আমার আর নতুন করে ভাবার কি আছে... তারপরেই মনে হল ...না থাক, আমি তো কথা দিলাম ভেবে দেখবো বলে। কথা যখন দিয়েছি আর ও যখন আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে তাহলে আর তো কোনো ভয় নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল...এখুনি চলে যাবে? আর একটু বোসো না...
‘আর একটু বোসো না’ কথাটার ভেতরে ঠিক কি ছিল তা একমাত্র যাকে বলা হয়েছে সেই বুঝল, না...আর কোনো কথা হয়নি ওদের, কেউ কারুর দিকে তাকায়নি, কেউ কাউকে ছোঁয়নি...তবুও যেন অনেক কিছু বলা...অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেল। নীরবে বসে থাকার ভেতরেও যে কত কথা বলা যায় তা ওরাই বোঝে। আরো কিছুক্ষন থাকার পর মৌ ফিরে গেছে… ঠিক তার আগের মুহুর্তে চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল, কে আগে তাকিয়েছে জানা না থাকলেও দুজনেই যে কিছু বলতে চেয়েছে বা জানতে চেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না...
কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল অরিত্র...কিছুই ভাবছে না তবুও যেন অনেক কিছু ভাবছে। একটা ছোট্ট কথাও যে এভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তা নিজের জীবনে না ঘটলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতো না। মনের বোঝা হালকা হয়ে গেলে হয়তো এমনটাই হয়, শরীর নামে যে কিছু একটা আছে অনুভব করতে পারছে না, নিজেকে মনে হচ্ছে আকাশে ভেসে যাওয়া ভারবিহীন এক টুকরো মেঘের মতো... এই মুহুর্তে নিঃসঙ্গ কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা যন্ত্রনাদায়ক নয় মোটেও…
একা থাকাও যে কতোটা সুখের হতে পারে তা নিজেকে দিয়ে অনুভব করতে করতে মনে হল ফোনটা মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। এই মুহুর্তে ফোন ধরার ইচ্ছে না থাকলেও ছোড়দি ফোন করেছে দেখে ধরতে হল। পুবালীর উদ্বিগ্ন গলায় ‘ভাই কি হয়েছে… ফোন ধরছিস না কেন’ শুনে আস্তে করে বলল…না রে, কিছু না, রুপসাকে একবার লাইনে নিবি দিদিভাই? ওকে দেখতে না পেলেও ভাই এর গলায় এমন কিছু ছিল যাতে পুবালীর বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না যে কিছু একটা ভালো খবর থাকলেও থাকতে পারে। ওদিকে পুবালী ওকে হোল্ড করে রুপসাকে ফোনে ধরার চেস্টা করতে করতে নিজেকে কথা বলার মতো অবস্থায় নিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল ও। বোনেদেরকে একটু একটু করে সব কিছু জানিয়ে ওরা কি ভাবছে জানতে চেয়েছে। পুবালী কি বলবে বুঝতে পারছিল না, ফোনটা কানে চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেস্টা করছে ওদিকে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই রুপসা একটুও সময় নেয় নি, ও খুশীতে ফেটে পড়ে বলেছে…দাদাভাই, আমি ভাবতেই পারছি না রে। তুই কি রে…কেন বলে দিলি না যে তোর আর কিছু ভাবার নেই? ওর যদি আবার অন্য কিছু মনে হয় তখন কি করবি? অরিত্র ওকে আস্তে করে বলেছে, না রে, আর কোনো ভয় নেই। দুবোনেই চেয়েছিল সেই রাতেই ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু অরিত্র ওদেরকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেছে এই বলে যে মৌ যদি ভাবে ওকে চাপ দেওয়া হচ্ছে…ওর কথা শোনা হচ্ছে না…ওর কথার ভেতরে যুক্তি থাকায় বোনেরা তখনকার মতো মেনে নিলেও বার বার করে ওকে বলেছে…ও যেন আর দেরী না করে আর কাল সকালেই ওরা মৌ এর সাথে কথা বলবেই…
অনেকদিন পর আজ ভালো ঘুম হয়েছে, ভোর রাতে কি একটা সুখের স্বপ্নও দেখেছে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে কিছু মনে করতে পারছে না। ঘুম চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে মনে হল দুটো বুলবুলি পাখি মাঝে মাঝে জানলায় এসে বসছে, দু একবার করুন ভাবে ডেকে আবার ফিরে যাচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য। কি মনে করে একবার দেখি তো ভেবে উঠে গিয়ে একটু আড়াল থেকে দেখল কাল ঝড়ে ওদের বাসাটা ভেঙ্গে পড়ে গেছে। দুজনে মিলে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাখি দুটো অচেনা নয়, বাগানের বকুল গাছটায় কিছুদিন ধরে দেখছিল দুজনে মিলে বাসা বানাচ্ছে...মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারুর ভাঙ্গে আর কারুর গড়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল বাসাটা যদি ও তুলে দেয় তাহলে কি ওরা সেটাতে থাকতে চাইবে? মানুষের ছোঁয়া নাকি অনেক প্রানী পছন্দ করে না। ঠিক আছে, তুলে তো দি... দেখি না ওরা কি করে ভেবে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করেছে দেখার জন্য ওরা কি করে এর পর। একটু পরেই দুটোতে কোথায় যেন চলে গেল দেখে নিচে গিয়ে পাঁচিলে উঠে বাসাটা গাছে তুলে দিয়ে ফিরে আসছিল। কি মনে করে উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ আটকে গেল। সেই মিষ্টি মুখটা এক পলকের জন্য দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে। মৌ যে ওকে দেখছিল বুঝতে পেরে বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা আলোড়নের সাথে সাথে ভালো লাগায় বুক ভরে উঠলে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল...
তারপর আরো একটা সপ্তাহ চলে গেছে…যেহেতু ও কথা দিয়েছিল তাই অনেক ভেবে দেখেছে কিন্তু কোনোভাবেই ওকে ছাড়া নিজেকে কিছুতেই ভাবতে পারছে না। সেদিনের পর থেকে মৌ আর ওর কাছাকাছি আসেনি…কিন্তু দুর থেকে ওর মিষ্টি মুখে এক চিলতে হাসি…কখোনো আড় চোখে ভ্রু তুলে তাকানো হয়তো বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে যে ওর কোনো ভয় নেই…ও বুঝে গেছে অরিত্রর মনের কথা…একটু একটু করে সেই আগের মতো ওর ভেতরে খুশী খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে… যেটা কিনা ওর স্মৃতি ফিরে আসার পর থেকে ছিল না। আজ রবিবার…মৌ সেই আগের মতো ওর জন্য চা করে নিয়ে এসে ঘুম ভাঙ্গালো… চোখে মুখে খুব প্রিয়জনকে একান্তে পাওয়ার ছাপ… অরিত্র একটু দুরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমার কিছু জানার ছিল আমার থেকে। মৌ সারা মুখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলল… আমার মনে হয় জানি।
- কি জানো?
- আমি তো জানি… তুমি ব’লো।
এত সকালে দিদানরা উপরে আসে না … অরিত্র বিছানা থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে’? মৌ চায়ের কাপটা পাশের ট্রেতে রেখে বলল ‘কিসের জন্য’?
- তোমার জন্য…
- আমি তো তোমার কাছেই আছি…
- এইভাবে নয়…একেবারে নিজের করে…
- আমি কি জানি?
- কে জানবে?
- বারে…তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে…যা কিছু করার তো তোমাদেরকেই করতে হবে…তাই না…
আর কিছু বলার ছিল না…মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললো…মৌ…একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- বলো…
- নাঃ…থাক…পরে কোনোদিন বলবো…
- বলো না…আমি কিছু মনে করবো না…
অরিত্র কিন্তু কিন্তু করেও বলে ফেলল… কেউ কি তোমাকে রাজী করিয়েছে…মৌ ওর প্রশ্নটা শুনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল… কে আবার… তুমি। অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল… আমি তো এমন কিছু করিনি যাতে তোমাকে বোঝানো যায়…
- উমম… বিশ্বাস করতে পারছো না… তাই তো?
অরিত্র ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে আগের মতো হাসি মুখে বলল…থাক না…কিছু কথা না বলা…কিছু কথা না জানা…
- পরে বলবে?
- উমম…বলবো…
দুজনে মিলে কথা বলতে অরিত্রর হটাৎ মনে পড়ে গেল পাখি দুটোর কথা। ইস, একেবারে ভুলে গেছি ভেবে বলল... এই যাঃ। মৌ একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে?
- সেদিন দেখলে না...পাখীর বাসাটা তুলে দিয়ে এলাম...
- হুঁ দেখেছি...
- ওরা ফিরেছে কিনা আর দেখা হয়নি...
- ফিরেছে...আমি রোজ দেখি...
অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে একটু যেন অবাক হয়ে বলল... রোজ দেখো?
- হু...রোজ দেখি তো...তুমি ওদের কথা ভেবে বাসাটা তুলে দিয়ে এলে আর আমি দেখবো না?
অরিত্র ওর চোখে যেন কিছু খোঁজার চেস্টা করে বলল... চলো না, একবার দেখি। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পাখী দুটোকে দেখা যাচ্ছিল না, খাওয়ারের খোঁজে বেরিয়েছে হয়তো। অরিত্র গাছটার দিকে তাকিয়ে যেন নিজের মনেই বলল... প্রচুর ফুল হয় গাছটাতে... কি সুন্দর গন্ধে ভরে যায় চারদিক...জানো তো... মৌ আস্তে করে বলল... জানি... তুমি ছোটবেলায় দিদানের বাপের বাড়ী থেকে বায়না করে নিয়ে এসে লাগিয়েছিলে। কিছুটা বিরতি, কেউ কোনো কথা বলছে না, একজন হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছে, আর একজন নিজের কল্পনায় গল্পের ভেতরে শোনা কথা গুলোকে সাজানোর চেস্টা করছে। একটু পরেই মেয়ে পাখিটা কোত্থেকে উড়ে এসে জানলায় বসতে গিয়ে ওদেরকে দেখে ফিরে গিয়ে গাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে এদিক ওদিক দেখছে...একটু পরেই ওর সঙ্গী ফিরে এসে পাশে বসলে মেয়েটি ঘাড় কাত করে তাকালো। দুজন দুজনের গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছে। দুজনে এক দৃষ্টে পাখী দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওদের মনের ভেতরেও হয়তো ইচ্ছে করছিল আরো কাছাকাছি আসতে কিন্তু এতদিনের ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা এই সবে জুড়তে শুরু করেছে, কেউই পারলো না নিজের থেকে এগোতে। মৌ আস্তে করে বলল... জানো তো...ওরা মনে হয় জানে তুমি ওদের বাসাটা তুলে দিয়েছিলে। অরিত্র ওর মতোই মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল... কি করে বুঝলে? রোজ এই জানলায় এসে বসে থাকে...বোধ হয় তোমাকে খোঁজে, কিছু বলতে চায়। মৌ এর কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালো, কিছু যেন ও বলতে চাইছে ভেবে জিজ্ঞেস করল...কিছু বলবে? মুখটা নিচু করে ও আস্তে করে বলল... আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি... তাই না? প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ বা না কোনোটাই দেওয়া যায় না, অরিত্র একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...থাক না... পুরোনো কথা। মৌ অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে আর কখোনো কষ্ট দেবো না...বিশ্বাস কর। এতক্ষনের জড়তা যেন এই একটা কথাতে কেটে গেল... অরিত্র আর কিছু না ভেবে ওকে কাছে টেনে নিলে মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল... অরিত্র মুখে কিছু না বললেও ও ভালো করেই জানে উত্তরটা কি। মৌ নিজেকে ওর বুকে নিশ্চিন্তে মিশিয়ে দিতে দিতে ভাবছিল... ওই পাখী দুটোর মতোই আমিও তোমার কাছে ফিরে পেয়েছি আমার আশ্রয়...আমার যে আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে...
বহুদিন পর, আজ বাড়ীতে থাকতে ইচ্ছে করলেও সকালে মৌ ওর কাছে আসার পর থেকে কিছুতেই যেন দাদুদের সামনে যেতে পারছে না অরিত্র। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে না। ভয় হচ্ছে এই বুঝি ওর দিকে তাকালেই মনের কথা গুলো সবাই জেনে যাবে। গত রবিবার থেকেই ও জানতো কি হবে কিন্তু অফিস যাওয়ার অছিলায় নিজেকে আড়াল করে রাখতে অসুবিধা হয়নি। ইচ্ছে করেই দেরী করে ফিরতো রাতে যাতে দাদুদের মুখোমুখি কম হতে হয়। ক্লাবেও যায়নি দেখে শুভ একবার ফোন করেছিল, ওকে ‘কাজ আছে রে, সন্ধের দিকে যাবো’ বলেছে। এদিকে বাড়ী থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছে না আবার নীচেও যেতে পারছে না, ওখানে মৌ একা নেই। একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগছে না... মাঝে একবার শুক্লাদি এসে চা না কফি কি একটা দিয়ে গিয়েছিল...শুক্লাদির হাত থেকে কাপটা নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল মৌ তো নিয়ে আসতে পারতো আর তাই ভেবে এত অভিমান হয়েছে যে ইচ্ছে করছিল ওটা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। শুক্লাদি ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি, চুপচাপ ফিরে গেছে। অরিত্র ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে করতে নিজেকে বোঝাবার চেস্টা করেছে...এতদিন মৌ দূরে ছিল... কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছি কিন্তু আজ কেন এত অভিমান হচ্ছে! নিজের উপরেই নিজের রাগ হয়েছে...আমি তো এমন ছিলাম না...সব কিছু বুঝে চলার চেস্টা করি...তাহলে আজ কেন বুঝতে চাইছি না যে ওর আমার কাছে ঘন ঘন আসার অসুবিধা আছে? ওর-ও তো আমার মতোই অবস্থা হবার কথা..দাদুদেরকে না জানানো পর্যন্ত আমরা দুজনেই তো আগের মতো মিশতে পারবো না...তাই না? নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও অভিমান ভুলে গিয়ে আবার একবার মনে মনে মৌকে বলল...কিছু মনে কোরো না প্লিজ। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, নিজের মনেই ওর সাথে কথা বলে যেতে যেতে মনে হল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। ধুস থাক দেখবো না ভেবেও কি মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বোন মেসেজ পাঠিয়েছে। কি লিখেছে দেখি ভেবে খুলে দেখে হাসি পেয়ে গেল...রুপসা লিখেছে...দাদাভাই প্লিজ একবার আমাকে একবার ফোন করবি? তোকে ফোন করতে পারছি না রে। কেন বলতো? জানিস তো আজ সকালে তুই ফোন করছিস না দেখে রাগ করে মায়ের সামনে বলে দিয়েছি তুই ফোন না করলে আমিও নিজের থেকে ফোন করবো না। মা শুনে আমাকে কি বলেছে জানিস? আমি নাকি পাগল আর যাই বলি না কেন নিজেই আবার তোকে ফোন করবো। আচ্ছা দাদাভাই তুই বল... তোকে না হয় একটু বেশীই ভালোবাসি, তাই বলে কি আমি পাগল? খুব ইচ্ছে করছে কি হল জানতে কিন্তু কি করে নিজের থেকে ফোন করি? মা বুঝতে পারলে এবারে হয়তো ছাগল বানিয়ে দেবে আমাকে। প্লিজ দাদাভাই...এখুনি একবার ফোন কর না... মেসেজটা পড়ে নিজের মনেই হাসতে হাসতে রুপসাকে ডায়াল করতেই ও সাথে সাথে রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল...এই, দাদাভাই...হ্যাঁ বলেছিস তো? সেই কোন সকাল থেকে বসে আছি কি হল জানার জন্য। তুই কি রে? এই দাদাভাই, চুপ করে আছিস কেন? ব-ল-না...প্লি-জ। আচ্ছা, তুই কি আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছিস? নিজেই তো বকে যাচ্ছিস বলাতে রুপসা নীচু গলায় বলল...হু...বল। অরিত্র ছোট করে ওকে কি কথা হয়েছে বলতেই মনে হল একপাক নেচে নিল খুশীতে। এই দাদাভাই একটু ধর, মাকে বলি...শোন না দিদিভাইকে তো বলিসনি মনে হচ্ছে...দাঁড়া আমি ওকে লাইনে নিচ্ছি এখুনি। কিছুক্ষন চুপচাপ, রুপসা ওদিকে দিদিকে ডায়াল করছে। অরিত্র চুপ করে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল...সত্যিই পাগল মেয়েটা। মাকে জানাবে আবার সাথে সাথে দিদিভাইকেও বলবে...কোনটা যে আগে করবে কে জানে। প্রায় মিনিট কুড়ি ওদের সাথে কথা বলতে হয়েছে, দুবোনেই মৌকে চেয়েছিল কথা বলার জন্য কিন্তু দাদুদেরকে জানানো হয়নি, তাই এখন মৌকে ওদের সাথে কথা বলার জন্য ডাকতে গেলে দাদুরা অন্যকিছু না ভেবে বসে বলাতে ওরা বলেছে আচ্ছা ঠিক আছে, এতদিন অপেক্ষা করেছি, আর না হয় একটা দুটো দিন অপেক্ষা করবো।
আজ কেন কে জানে ক্লাবে আর কেউ আসেনি। সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভ বাড়ী যেতে হবে বলাতে বেরিয়ে আসতে হয়েছে ক্লাব থেকে। কি করবে এত তাড়াতাড়ি বাড়ী গিয়ে...ওখানে গেলেই তো আবার বুকের ভেতরে রক্ত ঝরতে শুরু করবে ভেবে নদীর পাড়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসে চুপ করে দূরে তাকিয়ে বসেছিল। একটু পরে ওখান থেকেও উঠে আসতে হল...একা একা থাকলেই অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠছে...বাধ্য হয়ে বাড়ী ফিরে এসে দাদুর সাথে কিছুক্ষন দাবা খেলতে গিয়ে বারে বারে হেরে যাচ্ছিল দেখে দাদু বলল... কি করবি এতো ভেবে, যা হবার তা হবেই...যা, স্নান করে খেয়ে নে।
দুপুর থেকে বিকেল যেন হতে চাইছে না কিছুতেই। শুতে ভালো লাগছে না, বসতে ভালো লাগছে না...আবার মাথার ভেতরে চিন্তা গুলো এলোমেলো ভাবে আবার ঘুরতে শুরু করেছে দেখে নিজেকে অন্যমনস্ক করার জন্য উঠে বসে বাইরের দিকে তাকালো। দক্ষিন পুর্ব কোনে নিকষ কালো মেঘের ঘনঘটা চলছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে মনে হল চারদিক আস্তে আস্তে যেন থমথমে হয়ে আসছে... কাল বৈশাখীর পুর্বাভাষ। মনটাকে ভাবনা বিহীন করে দিয়ে প্রকৃতির সাথে নিজের তুলনা করে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল ওর...কি সুন্দর মিলে গেছে আজ ওর সাথে...মনে পড়ে গেল একটা গানের দু একটা লাইন আকাশে আজ রং-এর খেলা...মনে মেঘের মেলা...হারানো সুর হারানো গান ফুরালো যে বেলা...মনে মেঘের মেলা...
কখন যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে হয়তো বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টাও করেনি... নদীর ধারের গাছ গুলো হাওয়ার ধাক্কায় যেন এখুনি ভেঙ্গে পড়বে...উল্টোপাল্টা ঝোড়ো হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে দাপাদাপি করে বেড়ালেও যেন ওর কিছু যায় আসে না আর। হাওয়ার ধাক্কায় টেবিলের উপর থেকে কি একটা যেন পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল...যা যেতে চায় যাক...কি হবে ভেবে আর যেখানে নিজের জীবনটাই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির তান্ডব দেখতে দেখতে হয়তো ভাবছিল... পারো না আমাকেও এখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে? এতো কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারো আর পারো না আমার মতো দুর্ভাগাকে মেরে ফেলতে? সম্বিত ফিরে পেলো শুক্লাদির চিৎকারে... বসে বসে দেখছিস? ঘরটার কি অবস্থা হয়েছে দেখতে পাচ্ছিস না? শুক্লাদি দৌড়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না দেখে নিজেই উঠে গেল। জানলাটা গায়ের জোরে চেপে বন্ধ করে ফিরে আসার সময় দেখলো মৌ দরজার ঠিক বাইরে, ওর দিকে তাকিয়ে আছে... শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেল আরো কোথায় কি অবস্থা হচ্ছে দেখার জন্য। শুক্লাদি বেরিয়ে গেলে মৌ ও ফিরে গেল তবে নিজের ঘরে নয়...এক তলার দিকে। এক দৃষ্টে ওর ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে কি হল নিজের বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে করছিল ওকে টেনে হিঁচড়ে এখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতে, আমি তো তোমাকে অনেক করে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম...তুমি হতে দাওনি। বারে বারে আমার কাছে ছুটে আসতে। আমি তো তোমাকে ফিরিয়ে দিইনি...সব জেনে বুঝেও তুমি যা চেয়েছিলে আমি আমার সব কিছু দিয়ে পুরন করার চেষ্টা করেছি। তাহলে আজ কেন আমাকে এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে...বলতে পারো?
ভাবলেই সব কিছু করা যায় না। চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না... তারপরেই ভীষন খারাপ লাগলো মৌকে সব কিছুর জন্য দায়ী করার কথাটা ভেবে। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেই আবার মনে মনে মৌ এর কাছে ক্ষমা চাইলো... কিছু মনে করবে না...তোমার তো কোনো দোষ নেই। আমি তো জেনেশুনেই বিষ খেয়ে আজ নিজে জ্বলে পুড়ে মরছি। যার কাছে ক্ষমা চাইলো সে জানতেও পারলো না ও কি ভেবেছে আর কি বলতে চেয়েছে...একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ে পায়ে বেরিয়ে গিয়ে ছাদের দরজাটা খুলে ওই তান্ডবের ভেতরেই যেন নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ভিজতে ভিজতে হঠাৎ করে ফেলা ভুলটাকে ধুয়ে মুছে ফেলতে চাইলো।
ঝড় বৃষ্টির পর চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে। শুক্লাদি এসে দুবার ডেকে গেছে চা খাবার জন্য। অনেক দিন হয়ে গেছে ও আর এখানে একা একা চা খায় না...নিচে গিয়েই খেয়ে আসে। উঠি উঠি করেও যেতে ইচ্ছে করছে না... যদি মৌ এসে ফিরে যায়? কি করবে ভাবতে ভাবতে ...... কখন মৌ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারেনি। ওকে দেখতে পেয়েই আবার সেই সকালের মতো অভিমান বুকে দানা বাঁধতে শুরু করলেও মনের শেষ আশাটুকুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়ে ওকে ভেতরে ডাকলো। মৌ ভেতরে এসে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...’তুমি তো মাঝে মাঝেই থাকো না…দাদুদের বয়স হচ্ছে…কিছু ভেবেছো’? অরিত্র ওর কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল... ‘কি ভাববো’? কিছুক্ষন ও চুপ করে থাকার পর বলল ‘তুমি যখন থাকো না তখন দাদুদের দেখা শোনার জন্য তো কাউকে চাই। অরিত্র ওর কথার উত্তরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আস্তে করে বলল...তুমি তো আছো। ‘আমি যে নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি’ বলতে গিয়েও বলতে পারলো না মৌ। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো ওর। অরিত্র ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ’কিছু বললে না তো’? প্রশ্নটা শুনে ও অস্ফুট স্বরে বলল ‘আমার কি আর এখানে থাকা ঠিক হবে’?
- আমাদের দিক থেকে কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
- না।
- তাহলে?
- আমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিত আমার।
- কেন?
- কেউ তো আসবে… আজ না হয় কাল।
অরিত্র অবাক হয়ে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ‘তুমি কি আমার বিয়ের কথা বলছো’? মৌ এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘হ্যাঁ। অরিত্র বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো… যাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবেসে ফেলেছে তার মুখে ওকে ওন্য কাউকে বিয়ে করতে বলাটা যে কি যন্ত্রনার সেটা ওর থেকে হয়তো ভালো কেউ বুঝবে না। অরিত্র চুপ করে বসে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তোমার যদি অন্য কোনো কিছু কারন থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই’। ওর উত্তরটা শুনে মৌ যেন নিজের মনেই বলল...কিসের অধিকারে থাকবো? অরিত্র কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না…ও অধিকারের কথা কেন বললো? কি বলতে চাইছে? মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এলে, ও যা ভাবে ভাবুক…আর তো নতুন করে হারানোর কিছু নেই ভেবে কোনোরকমে বলল ‘অধিকার চাইলেই পেতে পারো কিন্তু তুমি তো চাইছো না। কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারছিল না ওর প্রতিক্রিয়াটা কি…বেশ কিছুক্ষন কেটে গেলেও কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো…মৌ নিজের কোলে মুখ গুঁজে বসে নিঃশ্বব্দে কাঁদছে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না… কোনোদিন ওকে নিজের অজান্তে হলেও কাঁদাবে ভাবেনি…আজও চায়নি… কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে উঠে গিয়ে পাশে বসে ওর পিঠে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল…’প্লিজ…আমি বুঝতে পারিনি…তোমার এতটা খারাপ লাগবে’…
নিজেকে আর বোধ হয় ও আটকে রাখতে পারলো না…ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলতে চাইলো ‘আমি নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি যা তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে। অরিত্র চুপ করে বসে থাকলো… ও এত কাঁদছে যে এই মুহূর্তে ওকে কিছু বলা আর না বলা একই ব্যাপার। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে, আস্তে আস্তে কান্না থেমে গেলেও আগের মতো মুখ গুঁজে বসে ছিল…হয়তো বুঝতে পারছিল না… মুখ তুলে কি শুনতে হবে… জীবনে কোনোদিন কিছু না পেয়ে আজ কিছু পাওয়ার সন্ধিক্ষনে এসেও বুঝতে পারছিল না কি করবে।
আরো কিছুক্ষন কেটে গেল… কিছু একটা শুনে আস্তে আস্তে মুখ তুলে এতদিন অভিমান বুকে করে নিয়ে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিজেই বুঝতে পারছিল না যা শুনেছে ঠিক কিনা… সত্যি না কি স্বপ্ন দেখছে… নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে না পেরে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল… মন চাইছে … আরো একবার নয় … বার বার ওই কথাটা শুনতে … সত্যিই যে ও বিশ্বাস করতে পারছে না … অরিত্রর মোবাইলটা বেজে বেজে থেমে গেল… প্রয়োজন মনে করল না উঠে গিয়ে ফোনটা ধরার… এই মূহুর্তে ফোন ধরার থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন ওর পাশে থাকা… না হলে যে ওকে সারা জীবন কিছু না পাওয়ার ব্যাথা বুকে করে নিয়ে বেড়াতে হতে পারে… ওর পাশে বসে থাকা একজন যে এখোনো ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি…আজ যে ওর প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে… হারিয়েও ফিরে পাবার এত কাছে এসে আবার হারানোর ব্যাথা ও পারবে না সহ্য করতে ভেবে জিজ্ঞেস করল… ‘কই ব’লো’…
কান্না ভেজা গলায় মৌ প্রশ্ন করলো ‘আমার ভুলটা কি না জেনেই এগোবে’?
- আমার আর কিছু জানার নেই মৌ…তোমাকে আমি যা জানি তাই আমার কাছে যথেষ্ট...
- তবুও, আমার অতীত…তোমার জানা উচিত...
- তোমার অতীত নিয়ে আমি জানতে চাই না…ভাবতেও চাই না ...
ওর দৃঢ স্বরে বলা কথাটা শুনে মৌ কয়েক মুহুর্ত থমকে গিয়ে আস্তে করে বলল...আমি চাই না…ভবিষ্যতে তোমার আমার কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।
- ঠিক আছে… তুমি যদি চাও… বলতে পারো।
বেশ কিছুক্ষন চুপ করে হয়তো নিজের সাথে বোঝাপড়া করল ও… আস্তে করে বলল… ‘আমি কারুর সাথে চলে যাবার জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। অরিত্র অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে, তাহলে কি ওর মায়ের কোনো ভুমিকা ছিল না? ওকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখে হয়তো মৌ বুঝতে পেরেছিল ও কি ভাবছে… আবার ও আস্তে আস্তে বলল… ‘মায়ের জন্যই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল… না হলে কি হত জানি না’।
- যার সাথে যেতে চেয়েছিলে সে আসেনি?
- না
- কেন?
- তখন বুঝতে পারিনি
- তুমি কি তাকে ভালোবাসতে?
- হয়তো।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...
অরিত্র বুঝতে পারছে না বলাতে মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... ‘বিল্টুকে একজন পড়াতে আসতো বাড়ীতে… ভাই এর পড়াশোনা নিয়েমাঝে মধ্যে কথা হোতো আমাদের। আগে কোনো ছেলের সাথে না মেশায় হয়তো কিছুটা হলেও আমার ভেতরে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। তারপর যখন বুঝতে পারলাম মায়ের দিক থেকে বিপদ আসছে, কি করবো ভেবে না পেয়ে ওকেই ভরসা করে বাড়ী ছাড়তে চেয়েছিলাম’…
অরিত্র কিছুটা সময় ওর থেকে শোনা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল...তুমি কি ওকে তোমার দুর্বলতার কথা জানিয়েছিলে?
- না
- তারপর?
- ওকে কারনটা বলিনি…শুধু বলেছিলাম আমাকে বাড়ী থেকে চলে যেতে হবে।
- কি বলেছিল? আসবে?
- হ্যাঁ
- আসেনি...তাই তো?
- হ্যাঁ
- তুমি একদিন যেন একা একা কোথাও গিয়েছিলে?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… জানতে গিয়েছিলাম কেন আসেনি …
- তোমার কি তখোনো সেই সামান্য হলেও দূর্বলতাটা ছিল?
- ঠিক তা নয়, খুব খারাপ লেগেছিল তাই মনে হয়েছিল জানা দরকার...
- দেখা হয়েছিল?
- হয়েছিল।
- আসেনি কেন?
- মা যদি ওর কিছু ক্ষতি করে ভেবে ও ভয় পেয়েছিল...এছাড়াও আগে থেকেই একজনের সাথে রিলেশান ছিল তাই আর আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি।
- তোমার দিক থেকে যখন তেমন কিছু ছিল না তো ওটা নিয়ে ভাবছো কেন?
- কিছুটা হলেও তো ছিল…তোমার সব কিছু শোনার পর মনে হয়েছিল ঠকানো ঠিক হবে না…অনেকবার ভেবেছিলাম চলে যাবো কিন্তু ভয় পেতাম যদি তুমি কিছু করে ফেলো… বলতে পারো দোটানায় পড়ে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত...
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…
- কি?
- তুমি সেদিন ফিরে এসে কেন কেঁদেছিলে…
- নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল…জানতাম তোমার কাছে ফিরতে চাইলে তুমি না করবে না কিন্তু নিজেই পারছিলাম না… আবার চলেও যেতে পারছিলাম না…
- আমি যদি বলি ওটা কোনো ব্যাপার নয়…তুমি আমার কাছে যা ছিলে তাই থাকবে…
- তবুও আমার মনে হচ্ছে…তুমি একবার ভেবে দেখো… সারাটা জীবনের ব্যাপার...
- ঠিক আছে…তুমি যখন চাইছো…তাই…আরো ভালো করে ভেবে দেখবো…
এরপরে হয়তো আর কারুর কিছু বলার ছিল না এই মুহুর্তে। মৌ আরো কিছুক্ষন বসে থাকার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে আমি আসি? অরিত্র হয়তো কিছু ভাবছিল, ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে থেকে তখুনি বলতে ইচ্ছে করছিল...আমার আর নতুন করে ভাবার কি আছে... তারপরেই মনে হল ...না থাক, আমি তো কথা দিলাম ভেবে দেখবো বলে। কথা যখন দিয়েছি আর ও যখন আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে তাহলে আর তো কোনো ভয় নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল...এখুনি চলে যাবে? আর একটু বোসো না...
‘আর একটু বোসো না’ কথাটার ভেতরে ঠিক কি ছিল তা একমাত্র যাকে বলা হয়েছে সেই বুঝল, না...আর কোনো কথা হয়নি ওদের, কেউ কারুর দিকে তাকায়নি, কেউ কাউকে ছোঁয়নি...তবুও যেন অনেক কিছু বলা...অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেল। নীরবে বসে থাকার ভেতরেও যে কত কথা বলা যায় তা ওরাই বোঝে। আরো কিছুক্ষন থাকার পর মৌ ফিরে গেছে… ঠিক তার আগের মুহুর্তে চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল, কে আগে তাকিয়েছে জানা না থাকলেও দুজনেই যে কিছু বলতে চেয়েছে বা জানতে চেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না...
কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল অরিত্র...কিছুই ভাবছে না তবুও যেন অনেক কিছু ভাবছে। একটা ছোট্ট কথাও যে এভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তা নিজের জীবনে না ঘটলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতো না। মনের বোঝা হালকা হয়ে গেলে হয়তো এমনটাই হয়, শরীর নামে যে কিছু একটা আছে অনুভব করতে পারছে না, নিজেকে মনে হচ্ছে আকাশে ভেসে যাওয়া ভারবিহীন এক টুকরো মেঘের মতো... এই মুহুর্তে নিঃসঙ্গ কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা যন্ত্রনাদায়ক নয় মোটেও…
একা থাকাও যে কতোটা সুখের হতে পারে তা নিজেকে দিয়ে অনুভব করতে করতে মনে হল ফোনটা মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। এই মুহুর্তে ফোন ধরার ইচ্ছে না থাকলেও ছোড়দি ফোন করেছে দেখে ধরতে হল। পুবালীর উদ্বিগ্ন গলায় ‘ভাই কি হয়েছে… ফোন ধরছিস না কেন’ শুনে আস্তে করে বলল…না রে, কিছু না, রুপসাকে একবার লাইনে নিবি দিদিভাই? ওকে দেখতে না পেলেও ভাই এর গলায় এমন কিছু ছিল যাতে পুবালীর বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না যে কিছু একটা ভালো খবর থাকলেও থাকতে পারে। ওদিকে পুবালী ওকে হোল্ড করে রুপসাকে ফোনে ধরার চেস্টা করতে করতে নিজেকে কথা বলার মতো অবস্থায় নিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল ও। বোনেদেরকে একটু একটু করে সব কিছু জানিয়ে ওরা কি ভাবছে জানতে চেয়েছে। পুবালী কি বলবে বুঝতে পারছিল না, ফোনটা কানে চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেস্টা করছে ওদিকে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই রুপসা একটুও সময় নেয় নি, ও খুশীতে ফেটে পড়ে বলেছে…দাদাভাই, আমি ভাবতেই পারছি না রে। তুই কি রে…কেন বলে দিলি না যে তোর আর কিছু ভাবার নেই? ওর যদি আবার অন্য কিছু মনে হয় তখন কি করবি? অরিত্র ওকে আস্তে করে বলেছে, না রে, আর কোনো ভয় নেই। দুবোনেই চেয়েছিল সেই রাতেই ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু অরিত্র ওদেরকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেছে এই বলে যে মৌ যদি ভাবে ওকে চাপ দেওয়া হচ্ছে…ওর কথা শোনা হচ্ছে না…ওর কথার ভেতরে যুক্তি থাকায় বোনেরা তখনকার মতো মেনে নিলেও বার বার করে ওকে বলেছে…ও যেন আর দেরী না করে আর কাল সকালেই ওরা মৌ এর সাথে কথা বলবেই…
অনেকদিন পর আজ ভালো ঘুম হয়েছে, ভোর রাতে কি একটা সুখের স্বপ্নও দেখেছে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে কিছু মনে করতে পারছে না। ঘুম চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে মনে হল দুটো বুলবুলি পাখি মাঝে মাঝে জানলায় এসে বসছে, দু একবার করুন ভাবে ডেকে আবার ফিরে যাচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য। কি মনে করে একবার দেখি তো ভেবে উঠে গিয়ে একটু আড়াল থেকে দেখল কাল ঝড়ে ওদের বাসাটা ভেঙ্গে পড়ে গেছে। দুজনে মিলে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাখি দুটো অচেনা নয়, বাগানের বকুল গাছটায় কিছুদিন ধরে দেখছিল দুজনে মিলে বাসা বানাচ্ছে...মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারুর ভাঙ্গে আর কারুর গড়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল বাসাটা যদি ও তুলে দেয় তাহলে কি ওরা সেটাতে থাকতে চাইবে? মানুষের ছোঁয়া নাকি অনেক প্রানী পছন্দ করে না। ঠিক আছে, তুলে তো দি... দেখি না ওরা কি করে ভেবে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করেছে দেখার জন্য ওরা কি করে এর পর। একটু পরেই দুটোতে কোথায় যেন চলে গেল দেখে নিচে গিয়ে পাঁচিলে উঠে বাসাটা গাছে তুলে দিয়ে ফিরে আসছিল। কি মনে করে উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ আটকে গেল। সেই মিষ্টি মুখটা এক পলকের জন্য দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে। মৌ যে ওকে দেখছিল বুঝতে পেরে বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা আলোড়নের সাথে সাথে ভালো লাগায় বুক ভরে উঠলে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল...
তারপর আরো একটা সপ্তাহ চলে গেছে…যেহেতু ও কথা দিয়েছিল তাই অনেক ভেবে দেখেছে কিন্তু কোনোভাবেই ওকে ছাড়া নিজেকে কিছুতেই ভাবতে পারছে না। সেদিনের পর থেকে মৌ আর ওর কাছাকাছি আসেনি…কিন্তু দুর থেকে ওর মিষ্টি মুখে এক চিলতে হাসি…কখোনো আড় চোখে ভ্রু তুলে তাকানো হয়তো বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে যে ওর কোনো ভয় নেই…ও বুঝে গেছে অরিত্রর মনের কথা…একটু একটু করে সেই আগের মতো ওর ভেতরে খুশী খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে… যেটা কিনা ওর স্মৃতি ফিরে আসার পর থেকে ছিল না। আজ রবিবার…মৌ সেই আগের মতো ওর জন্য চা করে নিয়ে এসে ঘুম ভাঙ্গালো… চোখে মুখে খুব প্রিয়জনকে একান্তে পাওয়ার ছাপ… অরিত্র একটু দুরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমার কিছু জানার ছিল আমার থেকে। মৌ সারা মুখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলল… আমার মনে হয় জানি।
- কি জানো?
- আমি তো জানি… তুমি ব’লো।
এত সকালে দিদানরা উপরে আসে না … অরিত্র বিছানা থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে’? মৌ চায়ের কাপটা পাশের ট্রেতে রেখে বলল ‘কিসের জন্য’?
- তোমার জন্য…
- আমি তো তোমার কাছেই আছি…
- এইভাবে নয়…একেবারে নিজের করে…
- আমি কি জানি?
- কে জানবে?
- বারে…তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে…যা কিছু করার তো তোমাদেরকেই করতে হবে…তাই না…
আর কিছু বলার ছিল না…মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললো…মৌ…একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- বলো…
- নাঃ…থাক…পরে কোনোদিন বলবো…
- বলো না…আমি কিছু মনে করবো না…
অরিত্র কিন্তু কিন্তু করেও বলে ফেলল… কেউ কি তোমাকে রাজী করিয়েছে…মৌ ওর প্রশ্নটা শুনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল… কে আবার… তুমি। অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল… আমি তো এমন কিছু করিনি যাতে তোমাকে বোঝানো যায়…
- উমম… বিশ্বাস করতে পারছো না… তাই তো?
অরিত্র ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে আগের মতো হাসি মুখে বলল…থাক না…কিছু কথা না বলা…কিছু কথা না জানা…
- পরে বলবে?
- উমম…বলবো…
দুজনে মিলে কথা বলতে অরিত্রর হটাৎ মনে পড়ে গেল পাখি দুটোর কথা। ইস, একেবারে ভুলে গেছি ভেবে বলল... এই যাঃ। মৌ একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে?
- সেদিন দেখলে না...পাখীর বাসাটা তুলে দিয়ে এলাম...
- হুঁ দেখেছি...
- ওরা ফিরেছে কিনা আর দেখা হয়নি...
- ফিরেছে...আমি রোজ দেখি...
অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে একটু যেন অবাক হয়ে বলল... রোজ দেখো?
- হু...রোজ দেখি তো...তুমি ওদের কথা ভেবে বাসাটা তুলে দিয়ে এলে আর আমি দেখবো না?
অরিত্র ওর চোখে যেন কিছু খোঁজার চেস্টা করে বলল... চলো না, একবার দেখি। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পাখী দুটোকে দেখা যাচ্ছিল না, খাওয়ারের খোঁজে বেরিয়েছে হয়তো। অরিত্র গাছটার দিকে তাকিয়ে যেন নিজের মনেই বলল... প্রচুর ফুল হয় গাছটাতে... কি সুন্দর গন্ধে ভরে যায় চারদিক...জানো তো... মৌ আস্তে করে বলল... জানি... তুমি ছোটবেলায় দিদানের বাপের বাড়ী থেকে বায়না করে নিয়ে এসে লাগিয়েছিলে। কিছুটা বিরতি, কেউ কোনো কথা বলছে না, একজন হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছে, আর একজন নিজের কল্পনায় গল্পের ভেতরে শোনা কথা গুলোকে সাজানোর চেস্টা করছে। একটু পরেই মেয়ে পাখিটা কোত্থেকে উড়ে এসে জানলায় বসতে গিয়ে ওদেরকে দেখে ফিরে গিয়ে গাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে এদিক ওদিক দেখছে...একটু পরেই ওর সঙ্গী ফিরে এসে পাশে বসলে মেয়েটি ঘাড় কাত করে তাকালো। দুজন দুজনের গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছে। দুজনে এক দৃষ্টে পাখী দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওদের মনের ভেতরেও হয়তো ইচ্ছে করছিল আরো কাছাকাছি আসতে কিন্তু এতদিনের ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা এই সবে জুড়তে শুরু করেছে, কেউই পারলো না নিজের থেকে এগোতে। মৌ আস্তে করে বলল... জানো তো...ওরা মনে হয় জানে তুমি ওদের বাসাটা তুলে দিয়েছিলে। অরিত্র ওর মতোই মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল... কি করে বুঝলে? রোজ এই জানলায় এসে বসে থাকে...বোধ হয় তোমাকে খোঁজে, কিছু বলতে চায়। মৌ এর কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালো, কিছু যেন ও বলতে চাইছে ভেবে জিজ্ঞেস করল...কিছু বলবে? মুখটা নিচু করে ও আস্তে করে বলল... আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি... তাই না? প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ বা না কোনোটাই দেওয়া যায় না, অরিত্র একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...থাক না... পুরোনো কথা। মৌ অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে আর কখোনো কষ্ট দেবো না...বিশ্বাস কর। এতক্ষনের জড়তা যেন এই একটা কথাতে কেটে গেল... অরিত্র আর কিছু না ভেবে ওকে কাছে টেনে নিলে মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল... অরিত্র মুখে কিছু না বললেও ও ভালো করেই জানে উত্তরটা কি। মৌ নিজেকে ওর বুকে নিশ্চিন্তে মিশিয়ে দিতে দিতে ভাবছিল... ওই পাখী দুটোর মতোই আমিও তোমার কাছে ফিরে পেয়েছি আমার আশ্রয়...আমার যে আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে...
বহুদিন পর, আজ বাড়ীতে থাকতে ইচ্ছে করলেও সকালে মৌ ওর কাছে আসার পর থেকে কিছুতেই যেন দাদুদের সামনে যেতে পারছে না অরিত্র। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে না। ভয় হচ্ছে এই বুঝি ওর দিকে তাকালেই মনের কথা গুলো সবাই জেনে যাবে। গত রবিবার থেকেই ও জানতো কি হবে কিন্তু অফিস যাওয়ার অছিলায় নিজেকে আড়াল করে রাখতে অসুবিধা হয়নি। ইচ্ছে করেই দেরী করে ফিরতো রাতে যাতে দাদুদের মুখোমুখি কম হতে হয়। ক্লাবেও যায়নি দেখে শুভ একবার ফোন করেছিল, ওকে ‘কাজ আছে রে, সন্ধের দিকে যাবো’ বলেছে। এদিকে বাড়ী থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছে না আবার নীচেও যেতে পারছে না, ওখানে মৌ একা নেই। একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগছে না... মাঝে একবার শুক্লাদি এসে চা না কফি কি একটা দিয়ে গিয়েছিল...শুক্লাদির হাত থেকে কাপটা নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল মৌ তো নিয়ে আসতে পারতো আর তাই ভেবে এত অভিমান হয়েছে যে ইচ্ছে করছিল ওটা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। শুক্লাদি ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি, চুপচাপ ফিরে গেছে। অরিত্র ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে করতে নিজেকে বোঝাবার চেস্টা করেছে...এতদিন মৌ দূরে ছিল... কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছি কিন্তু আজ কেন এত অভিমান হচ্ছে! নিজের উপরেই নিজের রাগ হয়েছে...আমি তো এমন ছিলাম না...সব কিছু বুঝে চলার চেস্টা করি...তাহলে আজ কেন বুঝতে চাইছি না যে ওর আমার কাছে ঘন ঘন আসার অসুবিধা আছে? ওর-ও তো আমার মতোই অবস্থা হবার কথা..দাদুদেরকে না জানানো পর্যন্ত আমরা দুজনেই তো আগের মতো মিশতে পারবো না...তাই না? নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও অভিমান ভুলে গিয়ে আবার একবার মনে মনে মৌকে বলল...কিছু মনে কোরো না প্লিজ। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, নিজের মনেই ওর সাথে কথা বলে যেতে যেতে মনে হল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। ধুস থাক দেখবো না ভেবেও কি মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বোন মেসেজ পাঠিয়েছে। কি লিখেছে দেখি ভেবে খুলে দেখে হাসি পেয়ে গেল...রুপসা লিখেছে...দাদাভাই প্লিজ একবার আমাকে একবার ফোন করবি? তোকে ফোন করতে পারছি না রে। কেন বলতো? জানিস তো আজ সকালে তুই ফোন করছিস না দেখে রাগ করে মায়ের সামনে বলে দিয়েছি তুই ফোন না করলে আমিও নিজের থেকে ফোন করবো না। মা শুনে আমাকে কি বলেছে জানিস? আমি নাকি পাগল আর যাই বলি না কেন নিজেই আবার তোকে ফোন করবো। আচ্ছা দাদাভাই তুই বল... তোকে না হয় একটু বেশীই ভালোবাসি, তাই বলে কি আমি পাগল? খুব ইচ্ছে করছে কি হল জানতে কিন্তু কি করে নিজের থেকে ফোন করি? মা বুঝতে পারলে এবারে হয়তো ছাগল বানিয়ে দেবে আমাকে। প্লিজ দাদাভাই...এখুনি একবার ফোন কর না... মেসেজটা পড়ে নিজের মনেই হাসতে হাসতে রুপসাকে ডায়াল করতেই ও সাথে সাথে রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল...এই, দাদাভাই...হ্যাঁ বলেছিস তো? সেই কোন সকাল থেকে বসে আছি কি হল জানার জন্য। তুই কি রে? এই দাদাভাই, চুপ করে আছিস কেন? ব-ল-না...প্লি-জ। আচ্ছা, তুই কি আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছিস? নিজেই তো বকে যাচ্ছিস বলাতে রুপসা নীচু গলায় বলল...হু...বল। অরিত্র ছোট করে ওকে কি কথা হয়েছে বলতেই মনে হল একপাক নেচে নিল খুশীতে। এই দাদাভাই একটু ধর, মাকে বলি...শোন না দিদিভাইকে তো বলিসনি মনে হচ্ছে...দাঁড়া আমি ওকে লাইনে নিচ্ছি এখুনি। কিছুক্ষন চুপচাপ, রুপসা ওদিকে দিদিকে ডায়াল করছে। অরিত্র চুপ করে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল...সত্যিই পাগল মেয়েটা। মাকে জানাবে আবার সাথে সাথে দিদিভাইকেও বলবে...কোনটা যে আগে করবে কে জানে। প্রায় মিনিট কুড়ি ওদের সাথে কথা বলতে হয়েছে, দুবোনেই মৌকে চেয়েছিল কথা বলার জন্য কিন্তু দাদুদেরকে জানানো হয়নি, তাই এখন মৌকে ওদের সাথে কথা বলার জন্য ডাকতে গেলে দাদুরা অন্যকিছু না ভেবে বসে বলাতে ওরা বলেছে আচ্ছা ঠিক আছে, এতদিন অপেক্ষা করেছি, আর না হয় একটা দুটো দিন অপেক্ষা করবো।