25-02-2019, 12:29 PM
ওদিকে বিয়ের অনুষ্টান চলছে আর এদিকে অরিত্র বর যাত্রীদের খাওয়া দাওয়া তদারকি করছিল। রুপসা দৌড়ে এসে ওকে টেনে নিয়ে গেল, খই পোড়াবার জন্য ভাইকে লাগবে। পুবালীর হাতে খই গুলো আস্তে আস্তে ঢেলে দিতে দিতে সামনের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল… একেবারে সামনের সারির চেয়ারে মৌ আর রুপসা পাশাপাশি বসে আছে… দুই অপরুপার মুখে আগুনের লাল আভার প্রতিফলন যেন ওদেরকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। রুপসা ওর অভ্যাস মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে… মেয়েটা যেন কোনো অবস্থাতেই স্থির থাকতে পারে না। ওদিকে মৌ এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেকেই চোখ ফিরিয়ে নিতে হ’ল। এখানে এত জনের সামনে ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখলে কে কি ভাববে তার ঠিক নেই। তার থেকেও বড় কথা স্টিল আর ভিডিও দুটোই এক সাথে তোলা হচ্ছে। ওদের তাকানোটা তো আর নিজেদের ভেতরে থাকবে না… কতজনে যে দেখবে তার তো ঠিক নেই। সব থেকে বেশী ভয় তো রুপসাকে নিয়ে, আর কেউ না হোক ও যে পেছনে লাগতে ছাড়বে না একেবারেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত বড় এক একটা অনুষ্ঠানে কিছু না কিছু গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটে যাওয়াতে জেঠুরা খুব খুশী। অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে বড় জেঠু এমন ভাবে তুই না থাকলে কি যে হত বলল যেন ওর জন্যই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। যদিও কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক যে ও বারে বারে সব ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে নিয়েছিল...নিজেদের ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দেখাশোনা করতে করতে মোটামুটি জানা ছিল কি করা উচিত। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লেগে যাওয়ায় ওর নিজেরও ভালো লাগছিল। জেঠিমা পাশেই ছিল, জেঠুকে ওইভাবে বলতে দেখে বলল...তোমাকে বলেছিলাম না...আমাদের দুষ্টু এই বয়সে যা দায়িত্ব নেয়...কটা ছেলে নেয় বলোতো। অরিত্র এত প্রশংসা শুনে হেসে ফেলে বলল...উঃ বাবা...তোমরা এমন করে বলছো যেন আমি একাই সব কিছু করেছি আর তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছো। আরো কিছুক্ষন জেঠু জেঠিমা ওর সাথে কথা বলে চলে যাবার পর ছোট জ়েঠিমা ওকে খুঁজে খুঁজে এসে পাকড়াও করে বলল...এই দুষ্টু...তোর সাথে কথা আছে...চল কোথাও বসি। জেঠিমা আবার কি বলবে ভাবতে ভাবতে মনে হল রুপসার বিয়ে নিয়ে কিছু হবে হয়তো। ও যা ভেবেছিল ঠিক তাই, রুপসা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না দেখে জেঠিমা ভেবেছে ওর হয়তো নিজের পছন্দের কেউ আছে। অরিত্র নিশ্চয় জানে সেটা কারন ভাই বোনের সম্পর্কটা যে একেবারে বন্ধুর মতো সেটা ভালোই জানা আছে জেঠিমার। রুপসার যে কেউ সেরকম নেই বুঝিয়ে বলার পর জেঠিমা ধরে বসল ওকে রাজী করাতেই হবে। রুপসা যদি চায় তাহলে এখন না হয় রেজিস্ট্রি করে রেখে দেওয়া যাবে। এক কথায় জেঠিমা কিছুতেই এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চাইছে না দেখে অরিত্র বলল...আচ্ছা...ঠিক আছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপসার সাথে কথা বলবো। জ়েঠিমা আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বলে উঠে গেছে। একা হয়ে যাওয়াতে মা বাবার কথা মনে পড়ে গেলে ও চুপ করে বসেছিল... কতক্ষন একা একা বসে ছিল নিজেও বুঝতে পারেনি। পুবালীর মাসতুতো ভাই বুকাই এর ডাকে প্রায় চমকে উঠল...দুজনে প্রায় একই বয়সী...আগে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও বিয়েতে এসে তুই তোকারির জায়গায় সম্পর্কটা চলে এসেছে। বুকাইকে আয় আয় বোস বলাতে ও ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে গলা নামিয়ে বলল...কিছু ব্যাবস্থা রেখেছিস নাকি রে? বুকাই কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... তোর জন্য আনিয়ে রেখেছি...দাঁড়া, নিয়ে আসছি। বুকাই খুব খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল...ওঃ গুরু...তোর তো দেখছি সব দিকেই নজর...চল... চল...গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। ছাদে গিয়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ঢেলে নিয়ে দুজনে বসে কথা বলতে বলতে খাচ্ছিল। অরিত্র ওর অভ্যাস মতো সামান্য একটু খেয়ে আর খাবে না বলাতে বুকাই চোখ গোল গোল করে বলল...সে কি আমি একা একা খাবো আর তুই বসে থাকবি? ওকে আসল কারনটা বলতে আর জোর করেনি...একা একাই খেয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষনের ভেতরেই ওর পেট থেকে দুঃখের কথা বেরোতে শুরু হয়ে গেল। ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে দু বছর আগে খুব সামান্য কারনে সেই নিয়ে কিছুক্ষন বকবক করে নিজেই... কি হবে দুঃখ পেয়ে,যে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই... বলে চুপ করে গেছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর নিজেই আবার কথা বলতে শুরু করল। সবে মাত্র অরিত্র আর মৌ এর ব্যাপারে কথা তুলেছে ঠিক সেই সময়ে রুপসা এসে হাজির। দুজনকে এক সাথে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে উঠে বলল...উঃ দাদাভাই তোরা এখানে আর আমি খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেলাম...চল চল...ছোড়দি তোদেরকে ডাকছে। ছোড়দি ডাকছে মানে বাসর ঘরে গিয়ে এক গাদা মেয়ের মুখোমুখি হতে হবে ভেবে ভেবে অরিত্র কেটে পড়ার তালে ছিল। রুপসা বুঝতে পেরে ওকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলে পেছন পেছন বুকাইও চলে এল। বাসর ঘরে যাওয়া মানেই বেশ মজা করা যাবে...আর কিছু না হোক দু চারটে মেয়ে তো থাকবেই...ভালোই কাটবে সময়। বাসর ঘর একেবারে গমগম করছে, কে যে কার পেছনে লাগছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। শুভ্রদীপের দু জন বন্ধু সানি ও রজতাভ, মামাতো বোন দিয়া ও রাকা আর সাথে ওদের একেবারে পাশের বাড়ীর একজন মেয়ে নম্রতা আর পুবালীর দিক থেকে রুপসা, মৌ, অরিত্র, বুকাই আর পুবালীর মামাতো বোন সৃজা। আরো কয়েক জন নাকি ছিল, এই কিছুক্ষন আগে ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেছে। অরিত্ররা আসতে পুবালী ওর কাছে বসতে বলাতে ও কোথায় বসবে দেখছে...পুবালীর গা ঘেঁসে মৌ বসে আছে, না সরে গেলে ও বসতে পারবে না দেখে শুভ্রদীপ মৌ কে বলল...মৌ তুমি আমার পাশে চলে এসো...এক মাত্র শালার এক মাত্র ইয়ে বলে কথা। তোমার সাথে খাতিরটা ভালোই রাখতে হবে তাই না...।
রুপসা শুভ্রদীপের পাশে বসে পড়ে বলল...না না...সুন্দরী ছোটো শালী থাকতে থাকতে শালার বৌ কি করে চান্স পাবে? ওসব চলবে না, ওর যার পাশে বসার কথা সেখানেই বসবে। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলাতে বাধ্য হয়ে মৌ এর পাশেই ওকে বসতে হল। এত রাত হয়ে গেলে কি হবে...কারুরই যেন ক্লান্তি নেই...বাসর ঘর আরো জমে উঠল। আরো ঘন্টাখানেক বাসর জাগার পর শুভ্রদীপের বন্ধুরা ফিরে যাবে বলে বলল। ওরা পাঁচ জন গাড়ী করে ফিরবে, সেই মতো প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিল। সারাদিন বিয়ের নানা রকম আচার অনুষ্ঠানের জন্য শুভ্রদীপ আর পুবালী বিশ্রাম পায়নি...ওদেরও কিছুটা বিশ্রামের দরকার। রুপসা বুকাইকে কানে কানে কিছু একটা বলতে ও একেবারে লাফিয়ে উঠে বলল...বলিস কি রে? হ্যাঁ...চল চল... কেন যাবো না। পুবালী কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে রুপসা ফাজিল মার্কা হাসি হেসে বলল...তোর এত জানার দরকার নেই এখন...এটা আমাদের আন ম্যারেডদের ব্যাপার। বৌ ভাতের দিন তো আসছি...সব জানতে পারবি...বুঝলি। শুভ্রদীপ পুবালীর কানে কানে বলল...মনে হচ্ছে নম্রতার সাথে বুকাই এর কিছু হলেও হতে পারে। পুবালী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল...তোরা কি এখন বেরুবি নাকি আবার? রুপসা চোখ ছোট ছোট করে শুভ্রদীপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল...এটা তো ভালো হোলো না শুভ্রদা।
দাদুরা বিয়ের পর দিন বিকেলে ফিরে গেছে। সবাই এক সাথে ফিরে গেলে জেঠুরা খুব একা হয়ে যাবে বলে অরিত্ররা বৌভাত সেরে আরো দু একদিন পরে ফিরবে। আজ বৌভাত, সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস ছাড়বে, বিভিন্ন জায়গা থেকে সবাইকে তুলে নিয়ে যেতে যেতে সাড়ে ন টা বাজবে। জেঠিমা তত্ব সাজানোর দিকটা দেখতে দেখতে রুপসাকে তাড়া লাগালো… ওঃ…তোর আর সাজা যেন শেষ হয় না…
- উঃ মা…তুমি না বড্ড তাড়া দাও সব কিছুতে… সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে…দিদিভাই এর বিয়েতে সাজবো না তো কি?
- আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে… আমাকেও একটু সাজিয়ে দিবি কিন্তু।
- আচ্ছা…তাই ব’লো… দাঁড়াও…এখোনো আরো একজন বাকি আছে…দেখি আবার কোথায় গেল।
সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও আট টা বেজে গেল ছাড়তে...টু বাই টু সিটের মার্সিডিজ বেঞ্জের বাস। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে জেঠু কোন দিকেই খামতি রাখতে চান নি। বুকাই আগে থেকেই বাসে উঠে পেছনের দিকের দুটো সিট আগলে রেখেছিল। একটাতে ও আর রুপসা, আর একটাতে মৌ আর অরিত্র বসবে। অরিত্র ওর সাথে বসতে চাইলে বলেছে... না গুরু...আমার সাথে রুপসার অনেক কথা আছে। তুই বাবা তোর ইয়েকে নিয়ে বোস। অরিত্র ওর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর না করেনি... রুপসা বিয়ের দিন থেকেই উঠে পড়ে লেগেছে নম্রতা আর বুকাইকে এক করতে। অবশ্য ও যে কোনো কারন ছাড়াই এগিয়েছে তা নয়... বর যাত্রীরা আসার কিছুক্ষন পর থেকেই মাঝে মাঝে দেখছিল বুকাই আর নম্রতার এক অপরকে চুরি করে করে দেখাদেখি চলছে...ব্যাপারটা কি হতে পারে আঁচ করে ও দুজনে যাতে কথা বলতে পারে তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছিল। অরিত্র মৌ এর পাশে বসলে ও আস্তে করে একটু কাছে সরে এলো। বাসের ভেতরে খুব হালকা আলো জ্বলছে আর রুপসারা ছাড়া ওদেরকে কেউ দেখতে পাবে না বুঝে ওর আর কোনো জড়তা ছিল না। এই কদিন ওকে একেবারেই কাছে না পাওয়ার জন্য আজ সুযোগ পেয়ে ওর পাশে ঘন হয়ে বসে একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। রুপসা ওদিকে বুকাই এর সাথে কথা বলছে দেখে অরিত্র ওর দিকে একটু ঝুঁকে বসলে মৌ আস্তে করে বলল...আমরা কবে ফিরবো? যতই বিয়ে বাড়ীর আনন্দ থাক ওকে কাছে না পেয়ে ওর যে ভালো লাগছে না বুঝতে পেরে বলল..আর দুটো দিন থাকি? জেঠুরা একেবারে একা হয়ে যাবে...।
মৌ ওর হাতে চাপ দিয়ে আস্তে করে বলল...আচ্ছা। অরিত্র রুপসারদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ওকে একেবারে কাছে টেনে নিয়ে গালে আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল... খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। ওকে এত কাছ আসতে দেখে মৌ ফিসফিস করে বলল...ছোড়দি দেখতে পাবে তো। অরিত্র ওর গালে নিজের মুখটা আরো চেপে ধরে বলল...দেখুক।
বৌভাতের পরের দিন, আত্মীয় স্বজনরা মোটামুটি সবাই চলে গেলে বাড়ী প্রায় ফাঁকা। কদিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি বলে আজ সবাই দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে পড়েছে। বড়দির ছেলে পাপাই খুব দুষ্টুমি করছিল দেখে অরিত্র ওকে সাথে নিয়ে শুয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙ্গলো যখন প্রায় সন্ধে হয় হয়। টানা ঘুমের পর বেশ একটা ঝিমুনির আমেজ থাকায় বেশ ভালো লাগছিল। পাপাই একেবারে ওর বুকের ভেতরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে দেখে কি করে উঠবে ভাবছে এমন সময় বড়দি এসে ডাকলো...এই ভাই চল...সবাই বসে আছে তোর জন্য। পাপাই এর হয়তো ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়ে গিয়েছিল। মায়ের গলা পেয়ে উঠে পড়লে বড়দি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল...তাড়াতাড়ি আয় ভাই...চা হয়ে গেছে। সবাই মিলে এক সাথে চা খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল.. জেঠু নাতিকে আদর করতে করতে অরিত্রকে দেখিয়ে বলল...মামাকে বলে দাও তো বাবু...এবারে কিন্তু তোমার পালা। পাপাইও দাদুর কথা শুনে আধো আধো গলায় দাদূর শেখানো কথা গুলো বলে দিলে সবাই হেসে ফেলল দেখে পাপাইও বেশ মজা পেয়ে দাদুর কোলে নাচানাচি শূরু করে দিল। মজা করার ছলে জেঠু কথাটা বললেও জেঠুরা যে এবারে এক এক করে ওর আর রুপসার ব্যাপারে ভাবছে সেটা আর বুঝতে অসুবিধা হোলো না। মৌ লজ্জা পেয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে জেঠু ওকে কাছে বসিয়ে বলল...এই মেয়ে পালাচ্ছিস কোথায়...দুষ্টুকে তো বললেও আসতে চায় না...নেহাত দিদির বিয়ে তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। আমরা কিন্তু তোর উপরেই দায়িত্ব দিচ্ছি মাঝে মাঝে ওকে ধরে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তুই বললে তো আর ও না করতে পারবে না। কি রে আসবি তো মা? ও বললে অরিত্র না করতে পারবে না এই কথাটা শূনে ভালো লাগার সাথে সাথে ভীষন লজ্জা পেয়ে ঘাড় কাত করে বোঝালো হ্যাঁ...ও নিশ্চয় আসবে। জেঠিমাও বেশ সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়ে বলল...তোরা ছাড়া আর আমাদের কে আছে বল তো...মেয়েরা তো আর ইচ্ছে হলেই আসতে পারবে না। রুপসা ফাজলামো করে বলল...জেঠিমা... যতই তোমরা শুধু দাদাভাই ছাড়া আর কে আছে বলো...আমরা কিন্তু ভাগ ছাড়বো না।
আরো এক মাস কেটে গেছে। বিশ্বাস কাকু জানালেন মিষ্টি আর বিল্টু খুব করে ধরেছে একবার দিদিকে দেখবে। ওদের একটাই যুক্তি, ওদেরকে দেখে যখন চিনতে পারেনি তাহলে তো আর ভয়ের কিছু নেই। দিদির কিছু ক্ষতি হবে না। সবার সাথে কথা বলে ওদেরকে নিজেদের বাড়ীতেই নিয়ে আসা হবে ঠিক করা হ’ল এক দিনের জন্য। মৌকে বলা হবে যে ওরা দুজনে বিশ্বাস কাকুর আত্মীয়, এখানে বেড়াতে এসেছে। ওরা ভাই বোনে মাকে জানিয়েছে ওরা এক দিনের জন্য বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবে। ওদের মায়েরও কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাবার ছিল তার আগেই… তাই আর কোনো বাধা আসেনি। সেই মতো বিশ্বাস কাকু ওদের ভাই বোনকে নিয়ে রবিবার সকালে চলে এলেন। মিষ্টিকে আপন করে নিতে মৌ এর বেশী সময় লাগেনি, মেয়েদের এই একটা বড় গুন, বন্ধু হতে গেলে সমবয়সী হতে হবে তার কোনো মানে নেই, মনের মিল থাকলেই হবে। বোনের সাথে সাথে বিল্টুও গল্প করতে করতে দিদির খুব কাছাকাছি হয়ে গেলে দুজনেই খুব খুশী। দাদুদেরকে আর বলতে হ’ল না ওদেরকে থাকতে বলার জন্য, মৌ নিজেই দিদানকে গিয়ে বলে ফেলল ওদেরকে আজ আটকে দিতে। বিকেলের দিকে অরিত্র ছাদে উঠে টবের গাছগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছিল। শুক্লাদি এই কিছুক্ষন আগে জামাকাপড় তুলে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর মিষ্টির ডাক শুনে ফিরে তাকালো।
- অরিত্রদা…একটা কথা জিজ্ঞেস করব… কিছু মনে করবেন না তো?
- তুমি যদি এখোনো আপনি করে কথা বলো… নিশ্চয় মনে করতে হবে।
- না মানে… আজকেই তো আলাপ হ’ল…
- তাতে কি হয়েছে? আমাদেরকে কি এখোনো পর পর মনে হচ্ছে নাকি।
- না না …তা নয়… আচ্ছা…ঠিক আছে তুমি করেই বলছি…কিছু মনে করবে না তো?
- এই তো, এবারে ঠিক আছে…ব’লো।
মিষ্টিকে একটু কিন্তু কিন্তু করতে দেখে অরিত্র বলল… তুমি কিন্তু এখোনো পর ভাবছো…বলোই না …কি বলবে। মিষ্টি অরিত্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল… তুমি কি দিদিকে… মানে…।
অরিত্র ও কি বলতে গিয়েও বলতে পারছে না বুঝে গেলে, হেসে ফেলে বলল… কি…আমি কি… মানে তোমার দিদিকে… কি?
- বলো না…
- হু…বুঝেছি…তোমার কি মনে হচ্ছে?
মিষ্টি একটু লাজুক হেসে বলল… কি জানি… মনে হচ্ছে… দিদি তোমাকে…
- ঠিকই ধরেছো… শুধু তোমার দিদি নয়…আমিও…
- তাই? ইস… আমার না ভীষন ভালো লাগছে।
- জানো তো মিষ্টি… একটাই চিন্তা আছে… তোমার দিদির যদি আগের সব কিছু মনে পড়ে যায় আর এখনকার কথা ভুলে যায়…
কথাটা শুনে মিষ্টি চুপ করে গেল, ও এতটা ভাবেনি হয়তো… ওর এত কিছু ভাবার বয়স বা সময় কোনোটাই এক্ষেত্রে ছিল না। ওকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে অরিত্র ওর কাছে গিয়ে বলল… এই…মিষ্টি…মন খারাপ করতে নেই…দেখা যাক না কি হয়…আমরা তো চেষ্টা করছিই, আর… তোমরাও তো আছো…তাই না…।
মিষ্টিকে কিছু বলতে না দেখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল… চোখে মুখে কান্নার আভাষ... নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আজ দিদির ভালো হবে জানার পর মনটা যেমন ভাবে খুশী হয়ে উঠেছিল তেমনি ভাবেই আবার খারাপ হয়ে গেল আবার সমস্যা হতে পারে শুনে। অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল…এই মিষ্টি…কাঁদে না।মিষ্টি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… অরিত্রদা…তুমি কোনো অবস্থাতেই দিদির কাছ থেকে সরে যাবে না বলো। অরিত্র আস্তে করে বলল… সে ভয় নেই মিষ্টি, আমি কাউকে কথা দিলে রাখি। ও, হ্যাঁ… তোমাদেরকে বলা হয়নি… সামনের মাসে তোমার দিদিকে নিয়ে চেন্নাই যাচ্ছি… দেখি যদি কিছু হয়…এখানে তো কিছু হবে ব’লে মনে হচ্ছে না। যেটুকু হয়েছে নিজের থেকেই হয়েছে।
- তুমি আর দিদি?
- দেখি, দাদুর শরীর ভালো থাকলে সবাই মিলে যাবো… না হলে… আমরা দুজনে…
মিষ্টি কিছু বলতে যাচ্ছিল, মৌ আসছে দেখে চুপ করে গেল। ও কাছে এসে মিষ্টির হাত ধরে বলল… তাই ভাবি… আমার বোনটা কোথায় গেল… নতুন দাদাভাই এর সাথে গল্প হচ্ছে…তাই না? নতুন দাদাভাই এর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে একটু আগের মন খারাপটা আর নেই, তার উপরে দিদিকে দেখে আরো খুশী হয়ে বলল…এই যে…গল্প করছি আর কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে…তাই দেখছিলাম।
- ভালো লেগেছে তোমার?
- ইস, ভালো লাগবে না কেন? আগে কখোনো দেখিনি… কত নতুন নতুন ফুল।
- হ্যাঁ… তোমার নতুন দাদাভাই আর দাদু কোথাও গেলে এইসব করে… নতুন কিছু দেখলেই খুঁজে পেতে নিয়ে আসবেই।
মিষ্টি দিদির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবছিল… ফুল ভালোবাসে…তাই তো আমার দিদিটাকে ভালোবেসে ফেলেছে আমার নতুন দাদাভাই।
জুলাই মাসে আবার অরিত্রকে বাইরে যেতে হবে, এবারে সিঙ্গাপুর, এক মাসের জন্য, তবুও ভালো, কাছাকাছি। তেমন মনে হলে চলে আসা যাবে। এবারে আর খুব একটা চিন্তা নেই ওর… মৌকে এখন অনেকটাই ভরসা করা যায়, তাছাড়া দাদুর শরীরও আগের থেকে ভালো। তবুও স্বাভাবিক ভাবেই যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত মন খারাপ একটু একটু করে বাড়ছে। যদিও মৌ বুঝতে দেয় না কাউকে তবুও অরিত্র ওকে দেখলে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে একা পেলে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বোঝায়... এবারে তো আরো কাছে যাচ্ছি… খুব মন খারাপ করলে বলবে…এক দিনের জন্য ঠিক চলে আসবো। তখনকার মতো সব বুঝলেও বলে…তুমি না থাকলে আমার ভালো লাগে না, কি করবো মন যদি খারাপ করে।
আজ নিয়ে আঠাশ দিন হয়ে গেছে অরিত্র সিঙ্গাপুরে। আর তিন দিন পরেই ফিরবে। অফিস থেকে ফিরে সবার সাথে কথা বলেছে। খেয়ে শুতে যাবে এমন সময় বাড়ীর ফোন দেখে একটু অবাক হ’ল। কিছু আবার হয়নি তো? মৌ মাঝে মাঝে রাতের দিকে আবার ফোন করে কিন্তু সে তো ওর মোবাইল থেকে। চিন্তা করতে করতে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে শুক্লাদির কান্না শুনতে পেলো। ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না…তার ভেতরেই কোনো রকমে বলল… ভাই…তোর দাদুর হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে… আর ওদিকে মৌ দাদূর ওই অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ভীষন ছটপট করছিল...এখন আর কোনো সাড়া পাচ্ছি না। অরিত্র ওই টুকু শুনে কি করবে ভেবে নিয়ে কোনো রকমে শুক্লাদিকে বলল…তুমি ফোনটা রাখো…আমি শুভকে এখুনি বলছি আসতে…
অরিত্র তাড়াতাড়ি করে শুভকে ফোন করে কি হয়েছে জানিয়ে ডাক্তার দাদুকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে আসতে বলে দিয়ে আবার বাড়ীতে ফোন করল… আরো খারাপ অবস্থা, মৌ-ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। শুক্লাদিকে দিদানকে সামলাবার কথা বলে অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছু করার নেই জেনেও অস্থির ভাবে এদিক ওদিক করতে করতে ভাবছিল কি করবে। এখুনি জেঠুদেরকে ফোন করে লাভ নেই...এত রাতে ওদেরকে আর চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কাল সকালে জানাবে কি হয়েছে। কিছুক্ষন পর শুভ জানালো… দুজনকেই নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিন্তা করিস না, আমি পরে জানাচ্ছি।
রাতটা যে অরিত্রর কিভাবে কাটলো ও নিজে ছাড়া কেউ হয়তো বুঝবে না। সারা রাত জেগে বসে আছে…বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া কিছু করার নেই। তবুও ভালো… রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জানা গেছে দাদুর তেমন কিছু হয়নি, গ্যাস থেকে হয়েছে কিন্তু মৌ এর জ্ঞান ফেরেনি, ওকে নিয়ে চিন্তা আছে…যদিও ডাক্তার বাবু বলেছেন এমনিতে তেমন কিছু শারিরীক সমস্যা নেই। ওটাই অরিত্র কাছে বড় ভয়ের হয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবে ভয় পাচ্ছিল এতদিন সেটা যদি হয়ে যায়? কিছু ভাবতে পারছিল না আর। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এসে ভেবেই যাচ্ছিল যদি তাই হয় তাহলে কি হবে। একদিন পরেই ওর ফেরার কথা, কি করবে… আজই ফিরে যাবে কি? হঠাৎ করে সব কিছু নতুন করে ভাবতে গিয়েও মাথার ভেতরে সব কিছু জট পাকিয়ে গিয়ে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। শুভ আটটা নাগাদ ফোন করে ওকে তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসতে বারন করল। নার্স খবর দিয়েছে এখুনি…মৌ এর জ্ঞান ফিরেছে, এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।
কোনোরকমে দিনটা কাটালো, সারাদিন বারে বারে শুভ, দিদান, ওদিকে জেঠু জেঠিমা, বোনেদের সাথে কথা বলেছে। বিকেলে শুভর ফোনে মৌ আর দাদুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ বলেছে ডাক্তারের বারন আছে। কাল দুপুরের ফ্লাইট… রাতটা কোনো রকমে কাটাতে পারলে বাঁচে, কেমন যেন অসহ্য লাগছে...এক একটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক একটা ঘন্টা। যদিও শুভ, ডাক্তার দাদু, জেঠু সবাই পাশে আছে তবুও মন যেন মানতে চাইছে না। পরের দিন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নার্সিং হোমে গিয়ে পৌঁছোতে ভিজিটিং আওয়ার্স প্রায় শেষ। শুভ বাইরেই ছিল, দিদানরা সবে বেরিয়ে এলো, দুজনেরই মুখ একেবারে থমথমে। দিদান, শুক্লাদি দুজনেই ওকে দেখে কেঁদে ফেলল দেখে বুঝতে পারছিল না, দুজনেই ভালো আছে বলেছে তো দিদানরা কাঁদছে কেন। আবার কি খারাপ কিছু হয়েছে? না, তেমন কিছু তো হওয়ার কথা নয়। কোলকাতা পৌঁছোবার পর অন্তত বার পাঁচেক শুভর সাথে কথা হয়েছে। তেমন কিছু হলে তো আগেই জানতে পারতো। শুভ ওকে পাশে ডেকে নিয়ে গেল, যা ভয় ছিল তাই শুনতে হ’ল শুভর কাছে… মৌ কাল সকালে জ্ঞান ফেরার পর থেকে কাউকে চিনতে পারছে না, বার বার জিজ্ঞেস করেছে…আমি এখানে কেন…তোমরা কে…কোনো কারনে খুব ভয় পাচ্ছে দেখে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে দেওয়ায় প্রায় সারাদিন আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। শুভ আগেই জানতো কিন্তু ইচ্ছে করেই ওকে জানায়নি বা দিদানদেরকেও আজ বিকেলের আগে ওকে কাছে গিয়ে দেখতে দেয়নি। শুভর কাছ থেকে শোনার পর নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে দিদানদেরকে চিন্তা করতে বারন করে নিজে গেল দেখতে। জানাশোনা থাকায় ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে গেলেও ঢুকতে অসুবিধা ছিল না। আগে দাদুর সাথে দেখা করে কথা বলল দু চারটে, দাদুকে এখোনো জানানো হয়নি মৌ এর ব্যাপারটা, তাই নিজেকে ভীষন ভাবে সামলাতে হচ্ছিল তা সে যতই মনের ভেতরে কষ্ট থাকুক। দাদুর কেবিন থেকে বেরিয়ে পা যেন চলছিল না… কি করে ওর মুখোমুখি হবে ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তবুও যেতে হ’ল, মৌ চুপ করে শুয়ে ছিল, ওকে দেখে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো… কিছু যেন বলছে দেখে কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি বলছে। একেবারে কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো...জিজ্ঞেস করছে আমি এখানে কেন? অরিত্র চেয়ারটা টেনে নিয়ে ওর পাশে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল… তুমি এখন অসুস্থ, আগে সুস্থ হও…তারপরে সব জানতে পারবে। কি বুঝলো কে জানে, কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করল… আপনি কে? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে, আস্তে করে বলল…এখন কথা বোলো না…তোমার কষ্ট হবে… আমি কে পরে জানলেও হবে। কথাটা শুনেও মৌ ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল… আমি অরিত্র। এর পরে মৌ চুপ করে থাকলেও ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল কোনো কারনে ভয় পাচ্ছে। কাকে ভয় পেতে পারে সেটা না বোঝার কিছু ছিল না, তাই ওকে বোঝানোর জন্য বলতে হ’ল…ভয় পেও না… তোমার মা জানে না যে তুমি এখানে আছো। কথাটা শুনে যেন একটু নিশ্চিন্ত হল। কিছুক্ষনের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়লে অরিত্র আরো কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পর উঠে এল। ওর পাশে থাকার ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার নেই… নার্স এসে দুবার তাড়া দিয়ে গেছে।
অরিত্র বাড়ী ফিরে এসে চুপ চাপ বসেছিল, কিছুই ভালো লাগছে না। দিদানদেরকে যতটা সম্ভব বুঝিয়েছে কিন্তু ওরাও যে কিছু বোঝার মতো অবস্থায় নেই সেটাও ঠিক। রুপসা আর পুবালীকে ফোনে জানালো কি হয়েছে। ওরা দু বোন খবরটা শুনে কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিল। জ়েঠূরাও জানতো না বলে ওদেরকেই সবাইকে জানিয়ে দিতে বলে ফোনটা রেখে দিল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না, আসার কথাও নয়। রুপসা আবার ফোন করেছে দেখে ধরল… রুপসা কিছু বলতে গিয়েও বলতে না পেরে কেঁদে ফেলল… নিজেকেই বোঝাতে পারছে না তো ওকে আর কি বোঝাবে। তাও ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল… কি করবি ব’ল, জানতাম, আমার কপালে এটাই ছিল। রুপসা কাঁদতে কাঁদতেই বলল...
- কি হবে দাদাভাই?
- জানি না রে... কাঁদিস না…
- পারছিনা রে দাদাভাই… আমি কত জোর করেছিলাম তোকে…না হ’লে হয়তো…
- না রে…আমিও তো চেয়েছিলাম এগোতে…
- দাদাভাই, ওর কি আগের সবকিছু মনে পড়েছে?
- মনে তো হয় তাই, ওর মা জানতে পারবে না বলাতে তো দেখলাম নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল, তার আগে মনে হচ্ছিল খুব টেনশানে ছিল।
রুপসার সাথে কথা বলতে বলতে এত সময় নিজেকে সামলে রাখলেও আর পারলো না...কান্নায় গলা বুজে এলে বাধ্য হয়ে ওকে বলল...এখন রেখে দে...কাল কথা বলব।
দুজনকেই একদিন আগে পরে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পর পুবালী আর জেঠুরা মাঝে একদিন এসে দেখে গেছে। পুবালী আগেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু অরিত্র তাড়াহুড়ো করতে বারন করেছিল…আগে ওরা ফিরে আসুক নার্সিং হোম থেকে, তারপর এলেই ভালো…এমনিতেই এসেই বা কি আর করবে...যা হবার তা তো হয়েই গেছে। রুপসা রোজ ফোন করে খোঁজ নেয়… মৌ কেমন আছে। আরো কয়েক দিন পর, মিষ্টি আর বিল্টুকে আনানো হয়েছে যাতে মৌ মানসিক ভাবে কিছুটা ভরসা পায়। ভাই বোনকে দেখে যেন ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না… সত্যি নাকি স্বপ্ন। তিন ভাই বোনে কান্নাকাটি করার পর বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসেছিল। ওদের সাথে মোটামুটি কথা বলে গেলেও মৌ কিছুটা হলেও আবার ভয় পেয়েছে মা যদি জানতে পারে। ওরা দু ভাইবোন ওকে বুঝিয়েছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা মাকে কিছু বলবে না। ওরাই তারপরে জানিয়েছে ও কিভাবে এখানে এসেছে আর কতদিন মতো এখানে আছে। মৌ সব শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না… প্রায় দেড় বছর ও এখানে আছে। ভাই বোনের দিকে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষন।
এত বড় এক একটা অনুষ্ঠানে কিছু না কিছু গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটে যাওয়াতে জেঠুরা খুব খুশী। অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে বড় জেঠু এমন ভাবে তুই না থাকলে কি যে হত বলল যেন ওর জন্যই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। যদিও কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক যে ও বারে বারে সব ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে নিয়েছিল...নিজেদের ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দেখাশোনা করতে করতে মোটামুটি জানা ছিল কি করা উচিত। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লেগে যাওয়ায় ওর নিজেরও ভালো লাগছিল। জেঠিমা পাশেই ছিল, জেঠুকে ওইভাবে বলতে দেখে বলল...তোমাকে বলেছিলাম না...আমাদের দুষ্টু এই বয়সে যা দায়িত্ব নেয়...কটা ছেলে নেয় বলোতো। অরিত্র এত প্রশংসা শুনে হেসে ফেলে বলল...উঃ বাবা...তোমরা এমন করে বলছো যেন আমি একাই সব কিছু করেছি আর তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছো। আরো কিছুক্ষন জেঠু জেঠিমা ওর সাথে কথা বলে চলে যাবার পর ছোট জ়েঠিমা ওকে খুঁজে খুঁজে এসে পাকড়াও করে বলল...এই দুষ্টু...তোর সাথে কথা আছে...চল কোথাও বসি। জেঠিমা আবার কি বলবে ভাবতে ভাবতে মনে হল রুপসার বিয়ে নিয়ে কিছু হবে হয়তো। ও যা ভেবেছিল ঠিক তাই, রুপসা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না দেখে জেঠিমা ভেবেছে ওর হয়তো নিজের পছন্দের কেউ আছে। অরিত্র নিশ্চয় জানে সেটা কারন ভাই বোনের সম্পর্কটা যে একেবারে বন্ধুর মতো সেটা ভালোই জানা আছে জেঠিমার। রুপসার যে কেউ সেরকম নেই বুঝিয়ে বলার পর জেঠিমা ধরে বসল ওকে রাজী করাতেই হবে। রুপসা যদি চায় তাহলে এখন না হয় রেজিস্ট্রি করে রেখে দেওয়া যাবে। এক কথায় জেঠিমা কিছুতেই এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চাইছে না দেখে অরিত্র বলল...আচ্ছা...ঠিক আছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপসার সাথে কথা বলবো। জ়েঠিমা আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বলে উঠে গেছে। একা হয়ে যাওয়াতে মা বাবার কথা মনে পড়ে গেলে ও চুপ করে বসেছিল... কতক্ষন একা একা বসে ছিল নিজেও বুঝতে পারেনি। পুবালীর মাসতুতো ভাই বুকাই এর ডাকে প্রায় চমকে উঠল...দুজনে প্রায় একই বয়সী...আগে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও বিয়েতে এসে তুই তোকারির জায়গায় সম্পর্কটা চলে এসেছে। বুকাইকে আয় আয় বোস বলাতে ও ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে গলা নামিয়ে বলল...কিছু ব্যাবস্থা রেখেছিস নাকি রে? বুকাই কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... তোর জন্য আনিয়ে রেখেছি...দাঁড়া, নিয়ে আসছি। বুকাই খুব খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল...ওঃ গুরু...তোর তো দেখছি সব দিকেই নজর...চল... চল...গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। ছাদে গিয়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ঢেলে নিয়ে দুজনে বসে কথা বলতে বলতে খাচ্ছিল। অরিত্র ওর অভ্যাস মতো সামান্য একটু খেয়ে আর খাবে না বলাতে বুকাই চোখ গোল গোল করে বলল...সে কি আমি একা একা খাবো আর তুই বসে থাকবি? ওকে আসল কারনটা বলতে আর জোর করেনি...একা একাই খেয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষনের ভেতরেই ওর পেট থেকে দুঃখের কথা বেরোতে শুরু হয়ে গেল। ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে দু বছর আগে খুব সামান্য কারনে সেই নিয়ে কিছুক্ষন বকবক করে নিজেই... কি হবে দুঃখ পেয়ে,যে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই... বলে চুপ করে গেছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর নিজেই আবার কথা বলতে শুরু করল। সবে মাত্র অরিত্র আর মৌ এর ব্যাপারে কথা তুলেছে ঠিক সেই সময়ে রুপসা এসে হাজির। দুজনকে এক সাথে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে উঠে বলল...উঃ দাদাভাই তোরা এখানে আর আমি খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেলাম...চল চল...ছোড়দি তোদেরকে ডাকছে। ছোড়দি ডাকছে মানে বাসর ঘরে গিয়ে এক গাদা মেয়ের মুখোমুখি হতে হবে ভেবে ভেবে অরিত্র কেটে পড়ার তালে ছিল। রুপসা বুঝতে পেরে ওকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলে পেছন পেছন বুকাইও চলে এল। বাসর ঘরে যাওয়া মানেই বেশ মজা করা যাবে...আর কিছু না হোক দু চারটে মেয়ে তো থাকবেই...ভালোই কাটবে সময়। বাসর ঘর একেবারে গমগম করছে, কে যে কার পেছনে লাগছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। শুভ্রদীপের দু জন বন্ধু সানি ও রজতাভ, মামাতো বোন দিয়া ও রাকা আর সাথে ওদের একেবারে পাশের বাড়ীর একজন মেয়ে নম্রতা আর পুবালীর দিক থেকে রুপসা, মৌ, অরিত্র, বুকাই আর পুবালীর মামাতো বোন সৃজা। আরো কয়েক জন নাকি ছিল, এই কিছুক্ষন আগে ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেছে। অরিত্ররা আসতে পুবালী ওর কাছে বসতে বলাতে ও কোথায় বসবে দেখছে...পুবালীর গা ঘেঁসে মৌ বসে আছে, না সরে গেলে ও বসতে পারবে না দেখে শুভ্রদীপ মৌ কে বলল...মৌ তুমি আমার পাশে চলে এসো...এক মাত্র শালার এক মাত্র ইয়ে বলে কথা। তোমার সাথে খাতিরটা ভালোই রাখতে হবে তাই না...।
রুপসা শুভ্রদীপের পাশে বসে পড়ে বলল...না না...সুন্দরী ছোটো শালী থাকতে থাকতে শালার বৌ কি করে চান্স পাবে? ওসব চলবে না, ওর যার পাশে বসার কথা সেখানেই বসবে। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলাতে বাধ্য হয়ে মৌ এর পাশেই ওকে বসতে হল। এত রাত হয়ে গেলে কি হবে...কারুরই যেন ক্লান্তি নেই...বাসর ঘর আরো জমে উঠল। আরো ঘন্টাখানেক বাসর জাগার পর শুভ্রদীপের বন্ধুরা ফিরে যাবে বলে বলল। ওরা পাঁচ জন গাড়ী করে ফিরবে, সেই মতো প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিল। সারাদিন বিয়ের নানা রকম আচার অনুষ্ঠানের জন্য শুভ্রদীপ আর পুবালী বিশ্রাম পায়নি...ওদেরও কিছুটা বিশ্রামের দরকার। রুপসা বুকাইকে কানে কানে কিছু একটা বলতে ও একেবারে লাফিয়ে উঠে বলল...বলিস কি রে? হ্যাঁ...চল চল... কেন যাবো না। পুবালী কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে রুপসা ফাজিল মার্কা হাসি হেসে বলল...তোর এত জানার দরকার নেই এখন...এটা আমাদের আন ম্যারেডদের ব্যাপার। বৌ ভাতের দিন তো আসছি...সব জানতে পারবি...বুঝলি। শুভ্রদীপ পুবালীর কানে কানে বলল...মনে হচ্ছে নম্রতার সাথে বুকাই এর কিছু হলেও হতে পারে। পুবালী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল...তোরা কি এখন বেরুবি নাকি আবার? রুপসা চোখ ছোট ছোট করে শুভ্রদীপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল...এটা তো ভালো হোলো না শুভ্রদা।
দাদুরা বিয়ের পর দিন বিকেলে ফিরে গেছে। সবাই এক সাথে ফিরে গেলে জেঠুরা খুব একা হয়ে যাবে বলে অরিত্ররা বৌভাত সেরে আরো দু একদিন পরে ফিরবে। আজ বৌভাত, সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস ছাড়বে, বিভিন্ন জায়গা থেকে সবাইকে তুলে নিয়ে যেতে যেতে সাড়ে ন টা বাজবে। জেঠিমা তত্ব সাজানোর দিকটা দেখতে দেখতে রুপসাকে তাড়া লাগালো… ওঃ…তোর আর সাজা যেন শেষ হয় না…
- উঃ মা…তুমি না বড্ড তাড়া দাও সব কিছুতে… সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে…দিদিভাই এর বিয়েতে সাজবো না তো কি?
- আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে… আমাকেও একটু সাজিয়ে দিবি কিন্তু।
- আচ্ছা…তাই ব’লো… দাঁড়াও…এখোনো আরো একজন বাকি আছে…দেখি আবার কোথায় গেল।
সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও আট টা বেজে গেল ছাড়তে...টু বাই টু সিটের মার্সিডিজ বেঞ্জের বাস। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে জেঠু কোন দিকেই খামতি রাখতে চান নি। বুকাই আগে থেকেই বাসে উঠে পেছনের দিকের দুটো সিট আগলে রেখেছিল। একটাতে ও আর রুপসা, আর একটাতে মৌ আর অরিত্র বসবে। অরিত্র ওর সাথে বসতে চাইলে বলেছে... না গুরু...আমার সাথে রুপসার অনেক কথা আছে। তুই বাবা তোর ইয়েকে নিয়ে বোস। অরিত্র ওর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর না করেনি... রুপসা বিয়ের দিন থেকেই উঠে পড়ে লেগেছে নম্রতা আর বুকাইকে এক করতে। অবশ্য ও যে কোনো কারন ছাড়াই এগিয়েছে তা নয়... বর যাত্রীরা আসার কিছুক্ষন পর থেকেই মাঝে মাঝে দেখছিল বুকাই আর নম্রতার এক অপরকে চুরি করে করে দেখাদেখি চলছে...ব্যাপারটা কি হতে পারে আঁচ করে ও দুজনে যাতে কথা বলতে পারে তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছিল। অরিত্র মৌ এর পাশে বসলে ও আস্তে করে একটু কাছে সরে এলো। বাসের ভেতরে খুব হালকা আলো জ্বলছে আর রুপসারা ছাড়া ওদেরকে কেউ দেখতে পাবে না বুঝে ওর আর কোনো জড়তা ছিল না। এই কদিন ওকে একেবারেই কাছে না পাওয়ার জন্য আজ সুযোগ পেয়ে ওর পাশে ঘন হয়ে বসে একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। রুপসা ওদিকে বুকাই এর সাথে কথা বলছে দেখে অরিত্র ওর দিকে একটু ঝুঁকে বসলে মৌ আস্তে করে বলল...আমরা কবে ফিরবো? যতই বিয়ে বাড়ীর আনন্দ থাক ওকে কাছে না পেয়ে ওর যে ভালো লাগছে না বুঝতে পেরে বলল..আর দুটো দিন থাকি? জেঠুরা একেবারে একা হয়ে যাবে...।
মৌ ওর হাতে চাপ দিয়ে আস্তে করে বলল...আচ্ছা। অরিত্র রুপসারদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ওকে একেবারে কাছে টেনে নিয়ে গালে আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল... খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। ওকে এত কাছ আসতে দেখে মৌ ফিসফিস করে বলল...ছোড়দি দেখতে পাবে তো। অরিত্র ওর গালে নিজের মুখটা আরো চেপে ধরে বলল...দেখুক।
বৌভাতের পরের দিন, আত্মীয় স্বজনরা মোটামুটি সবাই চলে গেলে বাড়ী প্রায় ফাঁকা। কদিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি বলে আজ সবাই দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে পড়েছে। বড়দির ছেলে পাপাই খুব দুষ্টুমি করছিল দেখে অরিত্র ওকে সাথে নিয়ে শুয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙ্গলো যখন প্রায় সন্ধে হয় হয়। টানা ঘুমের পর বেশ একটা ঝিমুনির আমেজ থাকায় বেশ ভালো লাগছিল। পাপাই একেবারে ওর বুকের ভেতরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে দেখে কি করে উঠবে ভাবছে এমন সময় বড়দি এসে ডাকলো...এই ভাই চল...সবাই বসে আছে তোর জন্য। পাপাই এর হয়তো ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়ে গিয়েছিল। মায়ের গলা পেয়ে উঠে পড়লে বড়দি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল...তাড়াতাড়ি আয় ভাই...চা হয়ে গেছে। সবাই মিলে এক সাথে চা খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল.. জেঠু নাতিকে আদর করতে করতে অরিত্রকে দেখিয়ে বলল...মামাকে বলে দাও তো বাবু...এবারে কিন্তু তোমার পালা। পাপাইও দাদুর কথা শুনে আধো আধো গলায় দাদূর শেখানো কথা গুলো বলে দিলে সবাই হেসে ফেলল দেখে পাপাইও বেশ মজা পেয়ে দাদুর কোলে নাচানাচি শূরু করে দিল। মজা করার ছলে জেঠু কথাটা বললেও জেঠুরা যে এবারে এক এক করে ওর আর রুপসার ব্যাপারে ভাবছে সেটা আর বুঝতে অসুবিধা হোলো না। মৌ লজ্জা পেয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে জেঠু ওকে কাছে বসিয়ে বলল...এই মেয়ে পালাচ্ছিস কোথায়...দুষ্টুকে তো বললেও আসতে চায় না...নেহাত দিদির বিয়ে তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। আমরা কিন্তু তোর উপরেই দায়িত্ব দিচ্ছি মাঝে মাঝে ওকে ধরে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তুই বললে তো আর ও না করতে পারবে না। কি রে আসবি তো মা? ও বললে অরিত্র না করতে পারবে না এই কথাটা শূনে ভালো লাগার সাথে সাথে ভীষন লজ্জা পেয়ে ঘাড় কাত করে বোঝালো হ্যাঁ...ও নিশ্চয় আসবে। জেঠিমাও বেশ সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়ে বলল...তোরা ছাড়া আর আমাদের কে আছে বল তো...মেয়েরা তো আর ইচ্ছে হলেই আসতে পারবে না। রুপসা ফাজলামো করে বলল...জেঠিমা... যতই তোমরা শুধু দাদাভাই ছাড়া আর কে আছে বলো...আমরা কিন্তু ভাগ ছাড়বো না।
আরো এক মাস কেটে গেছে। বিশ্বাস কাকু জানালেন মিষ্টি আর বিল্টু খুব করে ধরেছে একবার দিদিকে দেখবে। ওদের একটাই যুক্তি, ওদেরকে দেখে যখন চিনতে পারেনি তাহলে তো আর ভয়ের কিছু নেই। দিদির কিছু ক্ষতি হবে না। সবার সাথে কথা বলে ওদেরকে নিজেদের বাড়ীতেই নিয়ে আসা হবে ঠিক করা হ’ল এক দিনের জন্য। মৌকে বলা হবে যে ওরা দুজনে বিশ্বাস কাকুর আত্মীয়, এখানে বেড়াতে এসেছে। ওরা ভাই বোনে মাকে জানিয়েছে ওরা এক দিনের জন্য বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবে। ওদের মায়েরও কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাবার ছিল তার আগেই… তাই আর কোনো বাধা আসেনি। সেই মতো বিশ্বাস কাকু ওদের ভাই বোনকে নিয়ে রবিবার সকালে চলে এলেন। মিষ্টিকে আপন করে নিতে মৌ এর বেশী সময় লাগেনি, মেয়েদের এই একটা বড় গুন, বন্ধু হতে গেলে সমবয়সী হতে হবে তার কোনো মানে নেই, মনের মিল থাকলেই হবে। বোনের সাথে সাথে বিল্টুও গল্প করতে করতে দিদির খুব কাছাকাছি হয়ে গেলে দুজনেই খুব খুশী। দাদুদেরকে আর বলতে হ’ল না ওদেরকে থাকতে বলার জন্য, মৌ নিজেই দিদানকে গিয়ে বলে ফেলল ওদেরকে আজ আটকে দিতে। বিকেলের দিকে অরিত্র ছাদে উঠে টবের গাছগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছিল। শুক্লাদি এই কিছুক্ষন আগে জামাকাপড় তুলে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর মিষ্টির ডাক শুনে ফিরে তাকালো।
- অরিত্রদা…একটা কথা জিজ্ঞেস করব… কিছু মনে করবেন না তো?
- তুমি যদি এখোনো আপনি করে কথা বলো… নিশ্চয় মনে করতে হবে।
- না মানে… আজকেই তো আলাপ হ’ল…
- তাতে কি হয়েছে? আমাদেরকে কি এখোনো পর পর মনে হচ্ছে নাকি।
- না না …তা নয়… আচ্ছা…ঠিক আছে তুমি করেই বলছি…কিছু মনে করবে না তো?
- এই তো, এবারে ঠিক আছে…ব’লো।
মিষ্টিকে একটু কিন্তু কিন্তু করতে দেখে অরিত্র বলল… তুমি কিন্তু এখোনো পর ভাবছো…বলোই না …কি বলবে। মিষ্টি অরিত্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল… তুমি কি দিদিকে… মানে…।
অরিত্র ও কি বলতে গিয়েও বলতে পারছে না বুঝে গেলে, হেসে ফেলে বলল… কি…আমি কি… মানে তোমার দিদিকে… কি?
- বলো না…
- হু…বুঝেছি…তোমার কি মনে হচ্ছে?
মিষ্টি একটু লাজুক হেসে বলল… কি জানি… মনে হচ্ছে… দিদি তোমাকে…
- ঠিকই ধরেছো… শুধু তোমার দিদি নয়…আমিও…
- তাই? ইস… আমার না ভীষন ভালো লাগছে।
- জানো তো মিষ্টি… একটাই চিন্তা আছে… তোমার দিদির যদি আগের সব কিছু মনে পড়ে যায় আর এখনকার কথা ভুলে যায়…
কথাটা শুনে মিষ্টি চুপ করে গেল, ও এতটা ভাবেনি হয়তো… ওর এত কিছু ভাবার বয়স বা সময় কোনোটাই এক্ষেত্রে ছিল না। ওকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে অরিত্র ওর কাছে গিয়ে বলল… এই…মিষ্টি…মন খারাপ করতে নেই…দেখা যাক না কি হয়…আমরা তো চেষ্টা করছিই, আর… তোমরাও তো আছো…তাই না…।
মিষ্টিকে কিছু বলতে না দেখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল… চোখে মুখে কান্নার আভাষ... নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আজ দিদির ভালো হবে জানার পর মনটা যেমন ভাবে খুশী হয়ে উঠেছিল তেমনি ভাবেই আবার খারাপ হয়ে গেল আবার সমস্যা হতে পারে শুনে। অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল…এই মিষ্টি…কাঁদে না।মিষ্টি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… অরিত্রদা…তুমি কোনো অবস্থাতেই দিদির কাছ থেকে সরে যাবে না বলো। অরিত্র আস্তে করে বলল… সে ভয় নেই মিষ্টি, আমি কাউকে কথা দিলে রাখি। ও, হ্যাঁ… তোমাদেরকে বলা হয়নি… সামনের মাসে তোমার দিদিকে নিয়ে চেন্নাই যাচ্ছি… দেখি যদি কিছু হয়…এখানে তো কিছু হবে ব’লে মনে হচ্ছে না। যেটুকু হয়েছে নিজের থেকেই হয়েছে।
- তুমি আর দিদি?
- দেখি, দাদুর শরীর ভালো থাকলে সবাই মিলে যাবো… না হলে… আমরা দুজনে…
মিষ্টি কিছু বলতে যাচ্ছিল, মৌ আসছে দেখে চুপ করে গেল। ও কাছে এসে মিষ্টির হাত ধরে বলল… তাই ভাবি… আমার বোনটা কোথায় গেল… নতুন দাদাভাই এর সাথে গল্প হচ্ছে…তাই না? নতুন দাদাভাই এর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে একটু আগের মন খারাপটা আর নেই, তার উপরে দিদিকে দেখে আরো খুশী হয়ে বলল…এই যে…গল্প করছি আর কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে…তাই দেখছিলাম।
- ভালো লেগেছে তোমার?
- ইস, ভালো লাগবে না কেন? আগে কখোনো দেখিনি… কত নতুন নতুন ফুল।
- হ্যাঁ… তোমার নতুন দাদাভাই আর দাদু কোথাও গেলে এইসব করে… নতুন কিছু দেখলেই খুঁজে পেতে নিয়ে আসবেই।
মিষ্টি দিদির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবছিল… ফুল ভালোবাসে…তাই তো আমার দিদিটাকে ভালোবেসে ফেলেছে আমার নতুন দাদাভাই।
জুলাই মাসে আবার অরিত্রকে বাইরে যেতে হবে, এবারে সিঙ্গাপুর, এক মাসের জন্য, তবুও ভালো, কাছাকাছি। তেমন মনে হলে চলে আসা যাবে। এবারে আর খুব একটা চিন্তা নেই ওর… মৌকে এখন অনেকটাই ভরসা করা যায়, তাছাড়া দাদুর শরীরও আগের থেকে ভালো। তবুও স্বাভাবিক ভাবেই যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত মন খারাপ একটু একটু করে বাড়ছে। যদিও মৌ বুঝতে দেয় না কাউকে তবুও অরিত্র ওকে দেখলে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে একা পেলে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বোঝায়... এবারে তো আরো কাছে যাচ্ছি… খুব মন খারাপ করলে বলবে…এক দিনের জন্য ঠিক চলে আসবো। তখনকার মতো সব বুঝলেও বলে…তুমি না থাকলে আমার ভালো লাগে না, কি করবো মন যদি খারাপ করে।
আজ নিয়ে আঠাশ দিন হয়ে গেছে অরিত্র সিঙ্গাপুরে। আর তিন দিন পরেই ফিরবে। অফিস থেকে ফিরে সবার সাথে কথা বলেছে। খেয়ে শুতে যাবে এমন সময় বাড়ীর ফোন দেখে একটু অবাক হ’ল। কিছু আবার হয়নি তো? মৌ মাঝে মাঝে রাতের দিকে আবার ফোন করে কিন্তু সে তো ওর মোবাইল থেকে। চিন্তা করতে করতে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে শুক্লাদির কান্না শুনতে পেলো। ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না…তার ভেতরেই কোনো রকমে বলল… ভাই…তোর দাদুর হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে… আর ওদিকে মৌ দাদূর ওই অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ভীষন ছটপট করছিল...এখন আর কোনো সাড়া পাচ্ছি না। অরিত্র ওই টুকু শুনে কি করবে ভেবে নিয়ে কোনো রকমে শুক্লাদিকে বলল…তুমি ফোনটা রাখো…আমি শুভকে এখুনি বলছি আসতে…
অরিত্র তাড়াতাড়ি করে শুভকে ফোন করে কি হয়েছে জানিয়ে ডাক্তার দাদুকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে আসতে বলে দিয়ে আবার বাড়ীতে ফোন করল… আরো খারাপ অবস্থা, মৌ-ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। শুক্লাদিকে দিদানকে সামলাবার কথা বলে অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছু করার নেই জেনেও অস্থির ভাবে এদিক ওদিক করতে করতে ভাবছিল কি করবে। এখুনি জেঠুদেরকে ফোন করে লাভ নেই...এত রাতে ওদেরকে আর চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কাল সকালে জানাবে কি হয়েছে। কিছুক্ষন পর শুভ জানালো… দুজনকেই নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিন্তা করিস না, আমি পরে জানাচ্ছি।
রাতটা যে অরিত্রর কিভাবে কাটলো ও নিজে ছাড়া কেউ হয়তো বুঝবে না। সারা রাত জেগে বসে আছে…বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া কিছু করার নেই। তবুও ভালো… রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জানা গেছে দাদুর তেমন কিছু হয়নি, গ্যাস থেকে হয়েছে কিন্তু মৌ এর জ্ঞান ফেরেনি, ওকে নিয়ে চিন্তা আছে…যদিও ডাক্তার বাবু বলেছেন এমনিতে তেমন কিছু শারিরীক সমস্যা নেই। ওটাই অরিত্র কাছে বড় ভয়ের হয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবে ভয় পাচ্ছিল এতদিন সেটা যদি হয়ে যায়? কিছু ভাবতে পারছিল না আর। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এসে ভেবেই যাচ্ছিল যদি তাই হয় তাহলে কি হবে। একদিন পরেই ওর ফেরার কথা, কি করবে… আজই ফিরে যাবে কি? হঠাৎ করে সব কিছু নতুন করে ভাবতে গিয়েও মাথার ভেতরে সব কিছু জট পাকিয়ে গিয়ে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। শুভ আটটা নাগাদ ফোন করে ওকে তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসতে বারন করল। নার্স খবর দিয়েছে এখুনি…মৌ এর জ্ঞান ফিরেছে, এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।
কোনোরকমে দিনটা কাটালো, সারাদিন বারে বারে শুভ, দিদান, ওদিকে জেঠু জেঠিমা, বোনেদের সাথে কথা বলেছে। বিকেলে শুভর ফোনে মৌ আর দাদুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ বলেছে ডাক্তারের বারন আছে। কাল দুপুরের ফ্লাইট… রাতটা কোনো রকমে কাটাতে পারলে বাঁচে, কেমন যেন অসহ্য লাগছে...এক একটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক একটা ঘন্টা। যদিও শুভ, ডাক্তার দাদু, জেঠু সবাই পাশে আছে তবুও মন যেন মানতে চাইছে না। পরের দিন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নার্সিং হোমে গিয়ে পৌঁছোতে ভিজিটিং আওয়ার্স প্রায় শেষ। শুভ বাইরেই ছিল, দিদানরা সবে বেরিয়ে এলো, দুজনেরই মুখ একেবারে থমথমে। দিদান, শুক্লাদি দুজনেই ওকে দেখে কেঁদে ফেলল দেখে বুঝতে পারছিল না, দুজনেই ভালো আছে বলেছে তো দিদানরা কাঁদছে কেন। আবার কি খারাপ কিছু হয়েছে? না, তেমন কিছু তো হওয়ার কথা নয়। কোলকাতা পৌঁছোবার পর অন্তত বার পাঁচেক শুভর সাথে কথা হয়েছে। তেমন কিছু হলে তো আগেই জানতে পারতো। শুভ ওকে পাশে ডেকে নিয়ে গেল, যা ভয় ছিল তাই শুনতে হ’ল শুভর কাছে… মৌ কাল সকালে জ্ঞান ফেরার পর থেকে কাউকে চিনতে পারছে না, বার বার জিজ্ঞেস করেছে…আমি এখানে কেন…তোমরা কে…কোনো কারনে খুব ভয় পাচ্ছে দেখে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে দেওয়ায় প্রায় সারাদিন আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। শুভ আগেই জানতো কিন্তু ইচ্ছে করেই ওকে জানায়নি বা দিদানদেরকেও আজ বিকেলের আগে ওকে কাছে গিয়ে দেখতে দেয়নি। শুভর কাছ থেকে শোনার পর নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে দিদানদেরকে চিন্তা করতে বারন করে নিজে গেল দেখতে। জানাশোনা থাকায় ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে গেলেও ঢুকতে অসুবিধা ছিল না। আগে দাদুর সাথে দেখা করে কথা বলল দু চারটে, দাদুকে এখোনো জানানো হয়নি মৌ এর ব্যাপারটা, তাই নিজেকে ভীষন ভাবে সামলাতে হচ্ছিল তা সে যতই মনের ভেতরে কষ্ট থাকুক। দাদুর কেবিন থেকে বেরিয়ে পা যেন চলছিল না… কি করে ওর মুখোমুখি হবে ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তবুও যেতে হ’ল, মৌ চুপ করে শুয়ে ছিল, ওকে দেখে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো… কিছু যেন বলছে দেখে কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি বলছে। একেবারে কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো...জিজ্ঞেস করছে আমি এখানে কেন? অরিত্র চেয়ারটা টেনে নিয়ে ওর পাশে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল… তুমি এখন অসুস্থ, আগে সুস্থ হও…তারপরে সব জানতে পারবে। কি বুঝলো কে জানে, কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করল… আপনি কে? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে, আস্তে করে বলল…এখন কথা বোলো না…তোমার কষ্ট হবে… আমি কে পরে জানলেও হবে। কথাটা শুনেও মৌ ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল… আমি অরিত্র। এর পরে মৌ চুপ করে থাকলেও ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল কোনো কারনে ভয় পাচ্ছে। কাকে ভয় পেতে পারে সেটা না বোঝার কিছু ছিল না, তাই ওকে বোঝানোর জন্য বলতে হ’ল…ভয় পেও না… তোমার মা জানে না যে তুমি এখানে আছো। কথাটা শুনে যেন একটু নিশ্চিন্ত হল। কিছুক্ষনের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়লে অরিত্র আরো কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পর উঠে এল। ওর পাশে থাকার ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার নেই… নার্স এসে দুবার তাড়া দিয়ে গেছে।
অরিত্র বাড়ী ফিরে এসে চুপ চাপ বসেছিল, কিছুই ভালো লাগছে না। দিদানদেরকে যতটা সম্ভব বুঝিয়েছে কিন্তু ওরাও যে কিছু বোঝার মতো অবস্থায় নেই সেটাও ঠিক। রুপসা আর পুবালীকে ফোনে জানালো কি হয়েছে। ওরা দু বোন খবরটা শুনে কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিল। জ়েঠূরাও জানতো না বলে ওদেরকেই সবাইকে জানিয়ে দিতে বলে ফোনটা রেখে দিল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না, আসার কথাও নয়। রুপসা আবার ফোন করেছে দেখে ধরল… রুপসা কিছু বলতে গিয়েও বলতে না পেরে কেঁদে ফেলল… নিজেকেই বোঝাতে পারছে না তো ওকে আর কি বোঝাবে। তাও ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল… কি করবি ব’ল, জানতাম, আমার কপালে এটাই ছিল। রুপসা কাঁদতে কাঁদতেই বলল...
- কি হবে দাদাভাই?
- জানি না রে... কাঁদিস না…
- পারছিনা রে দাদাভাই… আমি কত জোর করেছিলাম তোকে…না হ’লে হয়তো…
- না রে…আমিও তো চেয়েছিলাম এগোতে…
- দাদাভাই, ওর কি আগের সবকিছু মনে পড়েছে?
- মনে তো হয় তাই, ওর মা জানতে পারবে না বলাতে তো দেখলাম নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল, তার আগে মনে হচ্ছিল খুব টেনশানে ছিল।
রুপসার সাথে কথা বলতে বলতে এত সময় নিজেকে সামলে রাখলেও আর পারলো না...কান্নায় গলা বুজে এলে বাধ্য হয়ে ওকে বলল...এখন রেখে দে...কাল কথা বলব।
দুজনকেই একদিন আগে পরে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পর পুবালী আর জেঠুরা মাঝে একদিন এসে দেখে গেছে। পুবালী আগেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু অরিত্র তাড়াহুড়ো করতে বারন করেছিল…আগে ওরা ফিরে আসুক নার্সিং হোম থেকে, তারপর এলেই ভালো…এমনিতেই এসেই বা কি আর করবে...যা হবার তা তো হয়েই গেছে। রুপসা রোজ ফোন করে খোঁজ নেয়… মৌ কেমন আছে। আরো কয়েক দিন পর, মিষ্টি আর বিল্টুকে আনানো হয়েছে যাতে মৌ মানসিক ভাবে কিছুটা ভরসা পায়। ভাই বোনকে দেখে যেন ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না… সত্যি নাকি স্বপ্ন। তিন ভাই বোনে কান্নাকাটি করার পর বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসেছিল। ওদের সাথে মোটামুটি কথা বলে গেলেও মৌ কিছুটা হলেও আবার ভয় পেয়েছে মা যদি জানতে পারে। ওরা দু ভাইবোন ওকে বুঝিয়েছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা মাকে কিছু বলবে না। ওরাই তারপরে জানিয়েছে ও কিভাবে এখানে এসেছে আর কতদিন মতো এখানে আছে। মৌ সব শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না… প্রায় দেড় বছর ও এখানে আছে। ভাই বোনের দিকে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষন।