25-02-2019, 12:24 PM
ও যে মৌ এর কথা বলছে বুঝতে অসুবিধা হোলো না…যা ভাবছে ভাবুক…এখন আর ওর ভুল ভাঙ্গিয়ে লাভ নেই…বড় বাবু কতটা কি ওকে বলেছে জানেনা…যদি দাদুদের সামনে আবার কিছু বলে বসে এই ভয়ে ও পবন কে বলল…আপ…মেরা ঘরবালো কো কুছ মত বাতানা…ঠিক হ্যায়?
হাঁ সাব…বড়া সাব ও ভি বাতায়া।সমঝমে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনি পেয়ারী হ্যায়…উনকি নুকসান কৌন কিঁউ করনা চাহাতা হ্যায়…
ওহি তো বাত হ্যায়…
সাব…অউর এক বাত সমঝ মে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনা খুশ রহতী হ্যায়…লেকিন কভি বাত কিঁউ নেহি করতি।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…ও বাত নেহি কর সকতী…মতলব…করতি থি…লেকিন আভি…
পবন যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…কেয়া বোল রহে হ্যায় সাব…মেরেকো বিসওয়াস নেহি হো রাহা হ্যায়… পাতা নেহি…আচ্ছা আদমীকো ভগওয়ান কিঁউ ইতনা দুখ দেতি হ্যায়…আপ এক কাম কিজিয়ে না সাব…ভাবীজী কে লিয়ে মহাকাল মন্দীরমে পুজা দিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগি…
ঠিক হ্যায়…কাল জায়েঙ্গে।
পবন খুব খুশী হয়ে বলল…হাঁ…সাব…হামভি পুজা দেঙ্গে। আপ দেখ লিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগী…ফির সে বাতে করনে লাগেগী। ভাবীজীকা আওয়াজ জরুর বহুত মিঠা হোগী।
উপরে গিয়েও পবন আরো একবার পুজো দেবার কথা তুললো দিদানের কাছে…ওকে দেখে মনে হচ্ছিল…যেন ওর নিজের কারুর জন্য কিছুকরতে চাইছে। বিকেলে দুরে কোথাও না গিয়ে সবাই মিলে মলে গিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে ফিরে আসার সময় দিদান আবার কিছু কেনাকাটা করাতে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেছে…সবাই মিলে গরম কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল… দাদুর ছোটোবেলায় ভুত দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। কম্বলের নিচে মৌ দিদানের গায়ে সেঁটে গিয়ে চুপ করে গল্প শুনছে…ওদিকে শুক্লাদিও গুটিসুটি মেরে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে দিদানের আর এক পাশে। গরমের শেষ…বর্ষা সবে আসবে আসবে করছে …ইকলেজ থেকে ফিরে রায়েদের পোড়ো বাগান বাড়ীর পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে খেলতে খেয়াল নেই কখন সন্ধে হয়ে এসেছে…ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতেই দৌড়ে গিয়ে বাগান বাড়ীর লোহার গেট টপকে সবাই মিলে ভেতরে ঢুকে পড়েছি। দিনের বেলা অনেকবার আম জাম কাঁঠাল খেতে ঢুকেছি কিন্তু সেই প্রথম সন্ধের পর ঢোকা…গাড়ী বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছি…বৃষ্টি থামলেই বেরোবো…চারদিকের বড়বড় গাছের জন্য জায়গাটা বেশ অন্ধকার মতো হয়ে আছে…আমাদের পাড়ার হাবু ছিল একটু ভিতু টাইপের…চারদিক তাকাতে তাকাতে আমার গায়ে সেঁটে গেছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম…কি হল আবার…সরে দাঁড়া না। হাবু আমার গায়ে আরো সেঁটে গিয়ে বলল…বিশু চল…পালাই…দাদুর কাছে শুনেছি এখানে নাকি ভুত আছে। ধুস…তুই একটা ভিতুর ডিম…আসুক না ভুত…এতজন আছি…কি করবে? বলা শেষ হতে না হতেই…পেছনে রায়বাড়ির বড় কাঠের দরজায় যেন কিসের একটা আওয়াজ হল…ক্যাঁচর ক্যাঁচ। সাথে সাথে গাডী বারান্দার ছাদে দুম করে কিছু একটা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ…এতক্ষন ঠিক ছিল…এমনিতেই হাবুর কথা শুনে মুখে যতই বলি না কেন একটু যে ভয় লাগছিল না তা নয়…এক সাথে দুটো অদ্ভুত আওয়াজ পেয়ে বুকের ভেতরে ভয় এসে গেল… চারদিক আলো হয়ে উঠে কড়কড় করে খুব কাছে একটা বাজ পড়ল…ওই আলোতে পেছনের দিকে তাকিয়ে হাড় হিম হয়ে গেল… কি একটা বিশাল জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে…এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থেমেছে…আর…হটাত লোডশেডিং হয়ে গেলে ঘরের পরিবেশটা যেন আরো ভুতুড়ে হয়ে গেল…কোনো আওয়াজ নেই…সবাই চুপ…একটু পরে হোটেলের জেনারেটার চালালে আলো ফিরে এল…মৌকে দেখা যাচ্ছেনা…কম্বলের নিচে ঢুকে গিয়ে দিদানকে জড়িয়ে ধরে আছে…শুক্লাদি দিদানের আর এক দিকে আরো জড়সড় হয়ে বসে…দাদু হো হো করে হেসে ফেলে বলল…শুনেই এই অবস্থা…আর আমার মতো অবস্থায় পড়লে কি হত কে জানে…দাদুর কথা শেষ হতেই…আবার আলো চলে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর ফিরে এল…আলো যাওয়া আর আসার মাঝে দরজায় টক টক করে আওয়াজ হল দুবার…দাদুর হাসি শুনে মৌ চোখের নীচ পর্যন্ত মাথাটা বের করেছিল সবে…যেই ঘর অন্ধকার হওয়ার পরেই দরজায় আওয়াজ হয়েছে সাথে সাথে আবার কম্বলের তলায় ঢুকে গেল। ওদের অবস্থা দেখে অরিত্রর হাসি পেয়ে গেল…কোনো রকমে হাসি চেপে দরজাটা খুলে দিতে…এক মুখ হাসি নিয়ে পবন ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল…সাব…কেয়া হুয়া? লাগতা হ্যায়…সব ডর গ্যয়ে হ্যায়…
দাদু মুখটা গম্ভীর করে বলল…হাঁ…ভুত আয়া থা…আভি আভি চলে গ্যায়ে।
পবন চোখ বড় বড় করে বলল…সাচমুচ ভুত আয়া থা?
অরিত্র আর থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বলল…মাথা খারাপ হ্যায় কেয়া? ভুত কাঁহাসে আয়েগা?
আপ জানতে নেহি সাব…ভুত হ্যায়…হামভি দেখা।
আচ্ছা ঠিক হ্যায়…দেখা তো দেখা…আভি ব্যায়ঠো…গরম কফি অউর নমকীন হ্যায়…
সাব ভাবীজীকী হাত পে এ ধাগা বাঁধ দিজিয়ে…ম্যায় খুদ নাহাকে পুজা দিয়া...সব কুছ ঠিক হো জায়েগা…
দুপুর বেলা ঠিক ছিল…ও একাই ছিল…কিন্তু এখন সবার সামনে ভাবীজী বললে…কান লাল হয়ে উঠল…কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল…দিদান…পরিয়ে দাও না।
নেহি… নেহি…সাব…আপ খুদ…
অরিত্রর মুখের কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে দিদান বলল…পরিয়ে দে না…কি হয়েছে…
মৌ কম্বলের নিচ থেকে মুখ বের করে বোঝার চেষ্টা করছিল কি হচ্ছে…দিদান ওকে ছোট্ট একটা আদুরে ধাক্কা দিয়ে বলল…এই মেয়ে…কি তখন থেকে কাঠবেড়ালীর মতো মুখ বের করে দেখছিস…ওঠ…
অরিত্র মৌ এর হাতে ধাগা বাঁধতে বাঁধতে এক বার চোখ তুলে তাকালো…ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে…দু চোখে অদ্ভুত এক ভালো লাগার ছোঁয়া…শুধু দিদান নয়…দাদু আর শুক্লাদিও ওর অবস্থা টা বুঝে ওদের দিকে না তাকিয়ে পবনের সাথে কথা বলছে দেখে চোখ পাকিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করল…সবার সামনে ওইভাবে আমাকে না দেখলেই নয়?
সারা মুখে দুষ্টুমির হাসি ভরিয়ে দিয়ে যেন জবাব দিতে চাইলো…বেশ করেছি…আরো করবো…কেন তুমি আমাকে সব সময় দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা কর।
রাতে খেয়ে রুমে ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল, ছোড়দি ফোন করেছে দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলে…পুবালী জিজ্ঞেস করল…কি রে ভাই…রুপসার ফোন ধরছিস না কেন? তিন বার ফোন করেছে তোকে।
আমি ছিলাম না রে, খেতে গিয়েছিলাম…এখুনি করছি…এখোনো রেগে আছে নাকি রে?
না রে…ও রাগ করে থাকার মেয়ে নাকি…
ছোড়দি…তুই একটু ধর…রুপসাকে লাইনে নিচ্ছি…খুব এম্ব্যারাসাড হয়েছি আজ…বুঝলি।
কি হোলো আবার…
একটু ধর…রুপসাকে ধরি…তারপর বলছি…
দু বোনকে লাইনে নিয়ে পবনের ভাবীজী বলা আর পূজো দেবার ব্যাপারটা বলতেই রুপসা প্রায় লাফিয়ে উঠল…দেখলি তো…আমি বললেই তোর যত প্রবলেম…আর সবাই কি বলছে এখন? তোদের ওই পবন দু দিনেই বুঝে গেছে…আর তুই কিছু বুঝতে পারছিস না…বল…এবার…
হুম…বুঝলাম…তুই এবার বল…আমার উপরে আর রেগে নেই তো?
ধুস…তোর উপর রেগে থাকলে এতবার ফোন করি নাকি? একটা মাত্র দাদাভাই…রাগ করে থেকে কি করবো রে? কি রে ছোড়দি…তাই তো?
পুবালী হেসে ফেলে বলল…তাছাড়া …আবার কি…
পরের দিন মহাকাল মন্দীরে সবাই মিলে গিয়ে পূজো দেওয়ার পর আর হোটেলে না ফিরে দিনের বাকিটা এদিক ওদিক ঘুরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। আগের দিন শুক্লাদি আর মৌ ভুতের গল্প শুনে খুব ভয় পেয়েছিল বলে আজ ওরা চারজনে বসে লুডো খেলছে। অরিত্র পবন কে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে গেল কিছু ঘর সাজানোর জিনিষ কিনতে…বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ… সবাই কে কিছু না কিছু দিতে হয়। ফিরে এসে কিছুক্ষন গল্প গুজব করে খেয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সাড়ে নটা বাজলো…ঠান্ডাও মোটামুটি ভালোই পড়েছে…সারাদিন বাইরে ঘুরে সবাই একটু ক্লান্তও ছিল। পরের দিন সকালে আর বেরোনো গেল না,দিদান আর শুক্লাদি দুজনেরই গায়ে অল্প জ্বর এসেছে। বোস দাদুকে ফোন করলে… কি ওষুধ খাওয়াবে বলে দিয়ে বলল…এক কাজ কর একটু করে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দে…বিকেলের ভেতরে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।পবন দুবার উপরে এসে ডাক্তার দেখাতে হবে কিনা খোঁজ নিয়ে গেছে। দিদানরা বেরোতে পারবে না বলে দাদু বলে দিয়েছে বেরোবে না…মৌ দিদানের পাশে বসে টিভি দেখছে…কেউ বেরোচ্ছে না বলে ওরও বেরোবার কোনো ইচ্ছে ছিল না। অরিত্র কিছু কাজ না পেয়ে নিজের রুমে গিয়ে টিভিতে গান শুনছিল…চ্যনেল ভি তে। দরজাটা খোলাই ছিল…সাড়ে দশটা নাগাদ দাদু এসে বলল…চুপচাপ বসে থেকে কি করবি…মৌ কে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও গিয়ে ঘুরে আয় না…
কোথায় যাবো? দিদান দের জ্বর।
সামান্য জ্বর…ও নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই…আমি তো আছিই…তোরা ঘুরে আয়। মৌ কে বলেছি…তুই গেলে ও যেতে রাজী আছে।
পবন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আরো কয়েক জনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল, ওরা দুজনে বেরোতেই দৌড়ে এসে বলল…সাব…কাঁহা যানা হ্যায়?
চলো…নজদিক থোড়া ঘুমকে আতে হ্যায়।
কিছুটা যাবার পর রাস্তার একদিকে চায়ের বাগান আর একদিকে পাহাড় …এক জায়গায় রাস্তার বাঁকে একটা ছোটো ঝরনার মতো…অনেকটা উপর থেকে সরু জলের ধারা নেমে আসছে…মৌ খুব মন দিয়ে জায়গাটা দেখছে দেখে অরিত্র গাড়ী দাঁড় করালো…দুজনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল…খুব সুন্দর জায়গাটা…রাস্তার উল্টো দিকের ঢালে চায়ের ছোটো ছোটো গাছ…হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে…আর এদিকে ঝরনা। পবন গাড়ী থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এসে বলল…সাব ফোটো লিজিয়ে না…
মৌকে ঝরনার দিকে দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন পোজে কয়েকটা ফটো তোলার পর পবন নিজেই এগিয়ে এসে বলল…সাব…আপ ভাবীজী কী পাশ যাইয়ে…আপ দোনো কা সাথ সাথ মে ফোটো বহুত আচ্ছা আয়েগা…
নিকন ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা…শুধু শাটার টিপলেই হবে না…পবন তুলতে পারবে কি পারবে না ভেবে মৌকে উলটো দিকে দাঁড় করিয়ে সব কিছু সেট করে নিয়ে পবন কে দেখিয়ে দিল কি করতে হবে…পবন ক্যামেরাটা নিয়ে দাঁড়ালে অরিত্র রাস্তা পেরিয়ে মৌ এর পাশে গিয়ে ইশারা করলো শাটার টিপতে…ওর দাঁড়ানো পবনের পছন্দ হল না…হাত নাড়িয়ে ইশারা করছিল ওদের দুজনকে আরো কাছাকাছি আসতে। আরো একটু কাছাকাছি এলেও পবন ইসারা করছিল…আরো কাছাকাছি। কি বিপদে পড়া গেছে ভেবে মৌ এর দিকে তাকালো…নির্বিকার মুখে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে…ভাবখানা যেন এই…ঠিক হয়েছে…আমি এত চেয়েছি…তবু কাছে আসোনি…এখন বোঝো…কি করবে। ধ্যাত তেরি কি…জড়িয়ে ধরে দাঁড়াই…ভেবে…ওর একেবারে পাশে এসে এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালে পবন হাত তুলে ইশারা করল…এবার ঠিক আছে। পবন বোধহয় ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নিচ্ছিল শাটার টিপতে কিন্তু কিছু করার নেই…মৌ এর এত কাছে কোনোদিন আসেনি…ভীষন ভালো লাগছিল…ওকে এত কাছে পেয়ে…ওর শরীরের মেয়েলী গন্ধে মন মাতাল হয়ে যেতে চাইছিল। পবন হাত তুলে জানালো হয়ে গেছে…তার পরেই বলল…সাব অউর এক…আপলোগ ইধার আইয়ে…ম্যায় উস তরফসে খিচেঙ্গে।
মৌকে সাথে করে রাস্তা পেরিয়ে চা গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ক্যামেরাটা সেট করতে…ওদিকে গাছের ছায়া থাকায় আলো কম ছিল…এদিকে অনেকটাই ঝকঝকে আলো আছে…আগের মতো তুললে হবে না…মৌ একটা চা গাছ ছুঁয়েহাসি মুখে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে…ক্যামেরার লেন্স দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লোজ আপে নিয়ে এসে দেখছিল…কি সুন্দর সারল্য মাখানো মুখ…কোথাও কোনো মালিন্য নেই…ক্যামেরাটা সেট করে পবনের হাতে দিয়ে রাস্তা পেরোতে গেল…এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে খেয়াল করেনি যে ও একটা রাস্তা পেরোতে যাচ্ছে। হটাত একটা ভীষন কর্কশ আওয়াজ কানে এল…সাথে সাথে কেউ যেন ওকে এক ঝটকায় টেনে ধরল। কয়েক সেকেন্ড মাথাটা পুরো যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল…সম্বিত ফিরে এলে কি হতে যাচ্ছিল ভেবে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল… রাস্তার মাঝখানে একটা টাটা সুমো দাঁড়িয়ে আছে…ডাইভার গালাগালি দিতে যাচ্ছিল…পবনকে দেখে গালাগালি না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল…কোথাও লেগেছে কিনা।
কিছু হয়নি…খুব ভুল হয়ে গেছে…একেবারে খেয়াল করিনি বলার পর মনে পড়ল…ওদিকে মৌ একা দাঁড়িয়ে আছে…ভয় পেয়ে যায় নি তো? ওর আবার টেনশান হলে চলবে না…ভেবে…তাড়াতাড়ি গাড়ীটার পেছন দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেল…মৌ চা গাছটার পাশে হাঁটু মুড়ে মুখ নিচু করে বসে আছে …সারা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে…আরো কাছে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওকে ডাকতে গিয়ে ওর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে অবাক হয়ে গেল।এর আগে একবার কাঁদতে দেখেছে কিন্তু গলায় তো কোনো আওয়াজ ছিল না। আর কিছু ভাবার সময় ছিলনা…তাড়াতাড়ি ওর কাঁধে দু হাত রেখে ডাকলো…এই…মৌ…এই তো আমি…কিছু হয়নি আমার…ওঠো…
নিজের কানকেই বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিল না ও…আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে… কান্না যেন আরো বেড়ে গেল…অরিত্র দু হাতে ধরে তোলার চেষ্টা করলে নিজেই উঠে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকলো…কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে…অরিত্র আবার বলল…এই…আমি ঠিক আছি… দেখো…আমার কিছু হয়নি…
বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে কান্না ভেজা গলায় বলল…আমার চাই না ফটো…তুমি কেন ওদিকে একা গেলে?
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অরিত্র…মৌ কথা বলছে…স্বপ্ন দেখছে না তো? ওর মাথা নিজের বুকে আরো নিবীড় ভাবে চেপে ধরে মুখ নামিয়ে বলল…তোমাকে একা রেখে আমি আর কোথাও যাবো না…
আর কোথাও যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিল না…সবাই কে জানাবার জন্য মনটা ভীষন ছটপট করছিল…নিজের ফোনটা আনতে ভুলে গিয়েছিল…পবনের ফোন থেকে যে দাদুকে ফোন করবে তার উপায় নেই…দাদুর নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করা থাকে বলে মনে থাকে না …পবন সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে বকবক করে যাচ্ছে…ও যে বলেছিল পূজো দিলেই কাজ হবে। মৌ ওর পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে কোলের উপরে অরিত্রর হাতটা ধরে চুপ করে চোখ বুজে বসে আছে পরম নিশ্চিন্তে…
হোটেলের সামনে পৌঁছোতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে মৌ এর হাত ধরে প্রায় দৌড়ে দাদুর রুমে গিয়ে পৌঁছোলে সবাই ওদেরকে ওইভাবে আসতে দেখে বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে…কোনো রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে পারল…মৌ…
আর কিছু বলতে পারছে না দেখে দাদু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে…এত হাঁপাচ্ছিস কেন…
অরিত্র একটু দম নিয়ে বলতে পারল…কথা বলেছে।
কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না ওর কথা…দিদান ততক্ষনে উঠে এসেছে…মৌ দিদান কে জড়িয়ে ধরলে দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে বলল…এই মৌ…সত্যি?
মৌ অস্ফুট স্বরে বলল …দিদান…
শুক্লাদি আর দাদুও ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল…কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না…দিদান নিজের চোখের জল আটকাতে পারলো না…ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ওকে কিভাবে আদর করবে যেন বুঝতে পারছিল না। দিদানের চোখের জল আস্তে আস্তে যেন বাকিদের চোখেও জল এনে দিল…
পবন প্রায় লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালো…হাতে বেশ বড় একটা মিষ্টির প্যকেট…সবার চোখে জল দেখে ওর চোখেও জল এসে গেছে…চোখের জল নিজেই মুছে নিয়ে একটা মিষ্টি মৌ এর মুখে দিয়ে…বলল…আজ ম্যায় বহুত খুশ হঁ…মেরা বহেন ঠিক হো গ্যায়ি। দিদান ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল…যা…নিজের হাতে সবাই কে খাইয়ে দে। সবার আগে পবনকে খাইয়ে তারপর সবাই কে এক এক করে খাইয়ে অরিত্রর কাছে এলে…অরিত্র মুখটা গম্ভীর করে বলল…আমার দুটো চাই।
তখোনো মুখের কান্না কান্না ভাবটা যায়নি…তার ভেতরেই মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল…কেন?
বা রে…আমিই তো তোমার কথা প্রথম শুনেছি…তাই না?
উমম…এখন পাবে না…পরে।
পবন এখুনি ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেছে…কোন মন্দীরে নাকি মানত করে রেখেছিল পূজো দেবে বলে…দাদু, দিদান আর শুক্লাদি মৌকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিল না…যেন আজই ওর সাথে সব কথা বলা শেষ করতে হবে, নিজেদের যে শরীর ভালো নেই যেন ভুলেই গেছে। অরিত্র ওর রুমে গিয়ে এক এক করে সবাইকে ওর কথা বলা শুরু করার ব্যাপারটা জানাচ্ছিল। বোস দাদু শুনেই বলল…মনে হচ্ছে যা ভেবেছিলাম…তাই…বিরাট একটা শক পেয়ে যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তেমনি আবার একটা শক পেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যাক গে…আরো একটা চিন্তা থেকেই গেল…স্মৃতি ফিরবে কিনা আর যদি ফেরে কতটা বা কিভাবে ফিরবে…ভালো বা খারাপ দুটোই হতে পারে…এর মাঝে আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি কিন্তু কেউ সেভাবে আশার আলো দেখাতে পারেনি…আজকাল অনেকরকম চিকিতসা হচ্ছে কিন্তু ভালো হবেই কেউ বলতে পারছে না…ভালো করতে গিয়ে যদি আরো খারাপ হয়ে যায়…সেটাই চিন্তা। কেউ কেউ বলছে ঠিক কি কি ঘটেছিল জানতে পারলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেত।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…কি জানি কি হবে…দেখা যাক। এখন যা হয়েছে…সেটাই বা কম কি…
বিশ্বাস কাকুকে ফোনে পাওয়া গেল না…নেটওয়ার্কের বাইরে আছে…পরে আবার চেষ্টা করবে ভেবে রুপসাকে ফোন করল…একসাথে পুবালীকে পেলে ভালো হ’ত কিন্তু এখন পাওয়া যাবে না, ওর অফিসে একটা মিটিং আছে বলেছিল। রুপসা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…দাদাভাই, প্লিজ একবার আমার সাথে কথা বলিয়ে দে…উঃ…আমার ইচ্ছে করছে এখুনি চলে যাই রে…
দাঁড়া…দিদানদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছি। আর শোন…তুই কাউকে বলিস না…আমি সবাই কে নিজে জানাবো…না হলে…খারাপ দেখাবে…বুঝলি…
হ্যাঁ…বুঝলাম…তুই আগে ফোনটা দে না বাবা…
মৌকে ডেকে নিয়ে এসে ফোনটা হাতে দিলে জিজ্ঞেস করল…কে?
অরিত্র হেসে বলল…দেখো…কে আছে…
মৌ হ্যালো বলতেই…রপসা…বলল…এই…মৌ…আমি কে বলোতো?
মৌ একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল…উমম…ছোড়দি…
ইস…ছোড়দির নাম তো পুবালী।
উঁ হুঁ…পুবালী দিদি তো তোমার ছোড়দি…আর আমার মেজ দি। তুমি…আমার ছোড়দি…রুপসা দিদি।
কি করে বুঝলে?
বা রে…বলবো কেন?
জানো তো…তোমার কথা খুব মিষ্টি…একেবারে তোমার মতো।
ধ্যাত…তুমি খালি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছো। তোমার গলাও তো কত মিষ্টি।
ধুস…আমার গলা…হাঁসের মতো…সব সময় নাকি প্যাঁক প্যাঁক করে কথা বলি…
মৌ হেসে ফেলে বলল…কে বলেছে…তোমার গলা হাঁসের মতো।
কে আবার বলবে…বলার তো একজনই আছে…
কে… ব’ল না।
উমম…তোমার কাছে কেউ নেই তো?
উঁ হুঁ…এখানে খালি তোমার দাদাভাই ছাড়া আর কেউ নেই…
ওই দাদাভাই টাই তো বলে…আমার সাথে কথা বললে নাকি কান ঝালাপালা হয়ে যায়…পাগল পাগল লাগে।
অরিত্রর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিয়ে হেসে ফেলে বলল…তাই?
হ্যাঁ গো…তাই বলে…আচ্ছা…শোনো না…কি করে হোলো বলোতো…আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
কি জানি…তোমার দাদাভাই জানে হয়তো।
যাক গে…বাদ দাও…তুমি কথা বলতে পারছো…এটাই আমাদের কাছে সব থেকে বড়…পরে দাদাভাই এর থেকে জেনে নেবো।
ছোড়দি…তুমি কবে আসছো?
ইচ্ছে তো করছে…আজই চলে আসি…সামনের সোমবার আমার একটা ইন্টারভিউ আছে…হয়ে গেলেই চলে আসবো।
খুব ভালো হবে…তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।
ইস…আমার সাথে কেন গল্প করবে…আর একজন তো পাশেই আছে।
ধ্যাত…তুমি না খালি পেছনে লাগো।
ইস…আমি পেছনে লাগি? তোমার ইচ্ছে করে না নাকি? ও হ্যাঁ…ওটার কিছু হ’ল…তোমাকে যেটা বলেছিলাম…
কি গো?
ওই যে দাদাভাইকে দিয়ে ব’লাতে…
তুমি এসো না…তারপর…
দুপুরের পর থেকে আবার ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠান্ডায় কারুরই শুতে ইচ্ছে ছিল না…দাদুদের ঘরে ওরা সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর অরিত্র ওদিকে নিজের ঘরে এক এক করে সবাইকে ফোন করে জানাচ্ছে। যারা খুব কাছের তাদেরকে আবার উঠে গিয়ে মৌ এর সাথে কথা বলিয়ে দিতে হচ্ছে…এই করতে করতে বিকেল হয়ে গেল তবুও বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির জন্য বোধহয় ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে দেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে কি করা যায় ভাবছিল, শুক্লাদি এসে বললো…দাদু ডাকছে। দাদু সোফায় পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আর ওদিকে মৌ যথারীতি দিদানের সাথে কম্বলের তলায়। আগের দিনের মতো শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। শুক্লাদিও ফিরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল।
কি ব্যাপার…দাদু…আজকেও কি ভুতের গল্প হচ্ছে নাকি?
না রে…যা সব ভীতু…ভুতের গল্প নয়…আজ তোর দিদানের ছোটোবেলার গল্প হচ্ছিল। কলেজ যেতে গিয়ে নাকি রামছাগলের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছিল…আরো কত কি…
যাই বলো দাদু…তোমাদের ছোটোবেলায় খুব মজার মজার ঘটনা আছে…
তা অবশ্য ছিল…তোরা তো অনেক কিছুই দেখিস নি…আস্তে আস্তে সব কিছু কেমন যেন পালটে যাচ্ছে।
তা তো যাবেই…তোমরা কিছু খাবে এখন? দুপুরে তো ভালো করে খাওয়াই হোলো না…পবন কেও ডাকি একবার…ও বেচারা এই ঠান্ডায় বাইরে বসে আছে।
হাঁ সাব…বড়া সাব ও ভি বাতায়া।সমঝমে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনি পেয়ারী হ্যায়…উনকি নুকসান কৌন কিঁউ করনা চাহাতা হ্যায়…
ওহি তো বাত হ্যায়…
সাব…অউর এক বাত সমঝ মে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনা খুশ রহতী হ্যায়…লেকিন কভি বাত কিঁউ নেহি করতি।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…ও বাত নেহি কর সকতী…মতলব…করতি থি…লেকিন আভি…
পবন যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…কেয়া বোল রহে হ্যায় সাব…মেরেকো বিসওয়াস নেহি হো রাহা হ্যায়… পাতা নেহি…আচ্ছা আদমীকো ভগওয়ান কিঁউ ইতনা দুখ দেতি হ্যায়…আপ এক কাম কিজিয়ে না সাব…ভাবীজী কে লিয়ে মহাকাল মন্দীরমে পুজা দিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগি…
ঠিক হ্যায়…কাল জায়েঙ্গে।
পবন খুব খুশী হয়ে বলল…হাঁ…সাব…হামভি পুজা দেঙ্গে। আপ দেখ লিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগী…ফির সে বাতে করনে লাগেগী। ভাবীজীকা আওয়াজ জরুর বহুত মিঠা হোগী।
উপরে গিয়েও পবন আরো একবার পুজো দেবার কথা তুললো দিদানের কাছে…ওকে দেখে মনে হচ্ছিল…যেন ওর নিজের কারুর জন্য কিছুকরতে চাইছে। বিকেলে দুরে কোথাও না গিয়ে সবাই মিলে মলে গিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে ফিরে আসার সময় দিদান আবার কিছু কেনাকাটা করাতে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেছে…সবাই মিলে গরম কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল… দাদুর ছোটোবেলায় ভুত দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। কম্বলের নিচে মৌ দিদানের গায়ে সেঁটে গিয়ে চুপ করে গল্প শুনছে…ওদিকে শুক্লাদিও গুটিসুটি মেরে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে দিদানের আর এক পাশে। গরমের শেষ…বর্ষা সবে আসবে আসবে করছে …ইকলেজ থেকে ফিরে রায়েদের পোড়ো বাগান বাড়ীর পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে খেলতে খেয়াল নেই কখন সন্ধে হয়ে এসেছে…ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতেই দৌড়ে গিয়ে বাগান বাড়ীর লোহার গেট টপকে সবাই মিলে ভেতরে ঢুকে পড়েছি। দিনের বেলা অনেকবার আম জাম কাঁঠাল খেতে ঢুকেছি কিন্তু সেই প্রথম সন্ধের পর ঢোকা…গাড়ী বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছি…বৃষ্টি থামলেই বেরোবো…চারদিকের বড়বড় গাছের জন্য জায়গাটা বেশ অন্ধকার মতো হয়ে আছে…আমাদের পাড়ার হাবু ছিল একটু ভিতু টাইপের…চারদিক তাকাতে তাকাতে আমার গায়ে সেঁটে গেছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম…কি হল আবার…সরে দাঁড়া না। হাবু আমার গায়ে আরো সেঁটে গিয়ে বলল…বিশু চল…পালাই…দাদুর কাছে শুনেছি এখানে নাকি ভুত আছে। ধুস…তুই একটা ভিতুর ডিম…আসুক না ভুত…এতজন আছি…কি করবে? বলা শেষ হতে না হতেই…পেছনে রায়বাড়ির বড় কাঠের দরজায় যেন কিসের একটা আওয়াজ হল…ক্যাঁচর ক্যাঁচ। সাথে সাথে গাডী বারান্দার ছাদে দুম করে কিছু একটা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ…এতক্ষন ঠিক ছিল…এমনিতেই হাবুর কথা শুনে মুখে যতই বলি না কেন একটু যে ভয় লাগছিল না তা নয়…এক সাথে দুটো অদ্ভুত আওয়াজ পেয়ে বুকের ভেতরে ভয় এসে গেল… চারদিক আলো হয়ে উঠে কড়কড় করে খুব কাছে একটা বাজ পড়ল…ওই আলোতে পেছনের দিকে তাকিয়ে হাড় হিম হয়ে গেল… কি একটা বিশাল জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে…এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থেমেছে…আর…হটাত লোডশেডিং হয়ে গেলে ঘরের পরিবেশটা যেন আরো ভুতুড়ে হয়ে গেল…কোনো আওয়াজ নেই…সবাই চুপ…একটু পরে হোটেলের জেনারেটার চালালে আলো ফিরে এল…মৌকে দেখা যাচ্ছেনা…কম্বলের নিচে ঢুকে গিয়ে দিদানকে জড়িয়ে ধরে আছে…শুক্লাদি দিদানের আর এক দিকে আরো জড়সড় হয়ে বসে…দাদু হো হো করে হেসে ফেলে বলল…শুনেই এই অবস্থা…আর আমার মতো অবস্থায় পড়লে কি হত কে জানে…দাদুর কথা শেষ হতেই…আবার আলো চলে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর ফিরে এল…আলো যাওয়া আর আসার মাঝে দরজায় টক টক করে আওয়াজ হল দুবার…দাদুর হাসি শুনে মৌ চোখের নীচ পর্যন্ত মাথাটা বের করেছিল সবে…যেই ঘর অন্ধকার হওয়ার পরেই দরজায় আওয়াজ হয়েছে সাথে সাথে আবার কম্বলের তলায় ঢুকে গেল। ওদের অবস্থা দেখে অরিত্রর হাসি পেয়ে গেল…কোনো রকমে হাসি চেপে দরজাটা খুলে দিতে…এক মুখ হাসি নিয়ে পবন ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল…সাব…কেয়া হুয়া? লাগতা হ্যায়…সব ডর গ্যয়ে হ্যায়…
দাদু মুখটা গম্ভীর করে বলল…হাঁ…ভুত আয়া থা…আভি আভি চলে গ্যায়ে।
পবন চোখ বড় বড় করে বলল…সাচমুচ ভুত আয়া থা?
অরিত্র আর থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বলল…মাথা খারাপ হ্যায় কেয়া? ভুত কাঁহাসে আয়েগা?
আপ জানতে নেহি সাব…ভুত হ্যায়…হামভি দেখা।
আচ্ছা ঠিক হ্যায়…দেখা তো দেখা…আভি ব্যায়ঠো…গরম কফি অউর নমকীন হ্যায়…
সাব ভাবীজীকী হাত পে এ ধাগা বাঁধ দিজিয়ে…ম্যায় খুদ নাহাকে পুজা দিয়া...সব কুছ ঠিক হো জায়েগা…
দুপুর বেলা ঠিক ছিল…ও একাই ছিল…কিন্তু এখন সবার সামনে ভাবীজী বললে…কান লাল হয়ে উঠল…কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল…দিদান…পরিয়ে দাও না।
নেহি… নেহি…সাব…আপ খুদ…
অরিত্রর মুখের কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে দিদান বলল…পরিয়ে দে না…কি হয়েছে…
মৌ কম্বলের নিচ থেকে মুখ বের করে বোঝার চেষ্টা করছিল কি হচ্ছে…দিদান ওকে ছোট্ট একটা আদুরে ধাক্কা দিয়ে বলল…এই মেয়ে…কি তখন থেকে কাঠবেড়ালীর মতো মুখ বের করে দেখছিস…ওঠ…
অরিত্র মৌ এর হাতে ধাগা বাঁধতে বাঁধতে এক বার চোখ তুলে তাকালো…ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে…দু চোখে অদ্ভুত এক ভালো লাগার ছোঁয়া…শুধু দিদান নয়…দাদু আর শুক্লাদিও ওর অবস্থা টা বুঝে ওদের দিকে না তাকিয়ে পবনের সাথে কথা বলছে দেখে চোখ পাকিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করল…সবার সামনে ওইভাবে আমাকে না দেখলেই নয়?
সারা মুখে দুষ্টুমির হাসি ভরিয়ে দিয়ে যেন জবাব দিতে চাইলো…বেশ করেছি…আরো করবো…কেন তুমি আমাকে সব সময় দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা কর।
রাতে খেয়ে রুমে ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল, ছোড়দি ফোন করেছে দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলে…পুবালী জিজ্ঞেস করল…কি রে ভাই…রুপসার ফোন ধরছিস না কেন? তিন বার ফোন করেছে তোকে।
আমি ছিলাম না রে, খেতে গিয়েছিলাম…এখুনি করছি…এখোনো রেগে আছে নাকি রে?
না রে…ও রাগ করে থাকার মেয়ে নাকি…
ছোড়দি…তুই একটু ধর…রুপসাকে লাইনে নিচ্ছি…খুব এম্ব্যারাসাড হয়েছি আজ…বুঝলি।
কি হোলো আবার…
একটু ধর…রুপসাকে ধরি…তারপর বলছি…
দু বোনকে লাইনে নিয়ে পবনের ভাবীজী বলা আর পূজো দেবার ব্যাপারটা বলতেই রুপসা প্রায় লাফিয়ে উঠল…দেখলি তো…আমি বললেই তোর যত প্রবলেম…আর সবাই কি বলছে এখন? তোদের ওই পবন দু দিনেই বুঝে গেছে…আর তুই কিছু বুঝতে পারছিস না…বল…এবার…
হুম…বুঝলাম…তুই এবার বল…আমার উপরে আর রেগে নেই তো?
ধুস…তোর উপর রেগে থাকলে এতবার ফোন করি নাকি? একটা মাত্র দাদাভাই…রাগ করে থেকে কি করবো রে? কি রে ছোড়দি…তাই তো?
পুবালী হেসে ফেলে বলল…তাছাড়া …আবার কি…
পরের দিন মহাকাল মন্দীরে সবাই মিলে গিয়ে পূজো দেওয়ার পর আর হোটেলে না ফিরে দিনের বাকিটা এদিক ওদিক ঘুরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। আগের দিন শুক্লাদি আর মৌ ভুতের গল্প শুনে খুব ভয় পেয়েছিল বলে আজ ওরা চারজনে বসে লুডো খেলছে। অরিত্র পবন কে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে গেল কিছু ঘর সাজানোর জিনিষ কিনতে…বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ… সবাই কে কিছু না কিছু দিতে হয়। ফিরে এসে কিছুক্ষন গল্প গুজব করে খেয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সাড়ে নটা বাজলো…ঠান্ডাও মোটামুটি ভালোই পড়েছে…সারাদিন বাইরে ঘুরে সবাই একটু ক্লান্তও ছিল। পরের দিন সকালে আর বেরোনো গেল না,দিদান আর শুক্লাদি দুজনেরই গায়ে অল্প জ্বর এসেছে। বোস দাদুকে ফোন করলে… কি ওষুধ খাওয়াবে বলে দিয়ে বলল…এক কাজ কর একটু করে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দে…বিকেলের ভেতরে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।পবন দুবার উপরে এসে ডাক্তার দেখাতে হবে কিনা খোঁজ নিয়ে গেছে। দিদানরা বেরোতে পারবে না বলে দাদু বলে দিয়েছে বেরোবে না…মৌ দিদানের পাশে বসে টিভি দেখছে…কেউ বেরোচ্ছে না বলে ওরও বেরোবার কোনো ইচ্ছে ছিল না। অরিত্র কিছু কাজ না পেয়ে নিজের রুমে গিয়ে টিভিতে গান শুনছিল…চ্যনেল ভি তে। দরজাটা খোলাই ছিল…সাড়ে দশটা নাগাদ দাদু এসে বলল…চুপচাপ বসে থেকে কি করবি…মৌ কে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও গিয়ে ঘুরে আয় না…
কোথায় যাবো? দিদান দের জ্বর।
সামান্য জ্বর…ও নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই…আমি তো আছিই…তোরা ঘুরে আয়। মৌ কে বলেছি…তুই গেলে ও যেতে রাজী আছে।
পবন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আরো কয়েক জনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল, ওরা দুজনে বেরোতেই দৌড়ে এসে বলল…সাব…কাঁহা যানা হ্যায়?
চলো…নজদিক থোড়া ঘুমকে আতে হ্যায়।
কিছুটা যাবার পর রাস্তার একদিকে চায়ের বাগান আর একদিকে পাহাড় …এক জায়গায় রাস্তার বাঁকে একটা ছোটো ঝরনার মতো…অনেকটা উপর থেকে সরু জলের ধারা নেমে আসছে…মৌ খুব মন দিয়ে জায়গাটা দেখছে দেখে অরিত্র গাড়ী দাঁড় করালো…দুজনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল…খুব সুন্দর জায়গাটা…রাস্তার উল্টো দিকের ঢালে চায়ের ছোটো ছোটো গাছ…হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে…আর এদিকে ঝরনা। পবন গাড়ী থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এসে বলল…সাব ফোটো লিজিয়ে না…
মৌকে ঝরনার দিকে দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন পোজে কয়েকটা ফটো তোলার পর পবন নিজেই এগিয়ে এসে বলল…সাব…আপ ভাবীজী কী পাশ যাইয়ে…আপ দোনো কা সাথ সাথ মে ফোটো বহুত আচ্ছা আয়েগা…
নিকন ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা…শুধু শাটার টিপলেই হবে না…পবন তুলতে পারবে কি পারবে না ভেবে মৌকে উলটো দিকে দাঁড় করিয়ে সব কিছু সেট করে নিয়ে পবন কে দেখিয়ে দিল কি করতে হবে…পবন ক্যামেরাটা নিয়ে দাঁড়ালে অরিত্র রাস্তা পেরিয়ে মৌ এর পাশে গিয়ে ইশারা করলো শাটার টিপতে…ওর দাঁড়ানো পবনের পছন্দ হল না…হাত নাড়িয়ে ইশারা করছিল ওদের দুজনকে আরো কাছাকাছি আসতে। আরো একটু কাছাকাছি এলেও পবন ইসারা করছিল…আরো কাছাকাছি। কি বিপদে পড়া গেছে ভেবে মৌ এর দিকে তাকালো…নির্বিকার মুখে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে…ভাবখানা যেন এই…ঠিক হয়েছে…আমি এত চেয়েছি…তবু কাছে আসোনি…এখন বোঝো…কি করবে। ধ্যাত তেরি কি…জড়িয়ে ধরে দাঁড়াই…ভেবে…ওর একেবারে পাশে এসে এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালে পবন হাত তুলে ইশারা করল…এবার ঠিক আছে। পবন বোধহয় ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নিচ্ছিল শাটার টিপতে কিন্তু কিছু করার নেই…মৌ এর এত কাছে কোনোদিন আসেনি…ভীষন ভালো লাগছিল…ওকে এত কাছে পেয়ে…ওর শরীরের মেয়েলী গন্ধে মন মাতাল হয়ে যেতে চাইছিল। পবন হাত তুলে জানালো হয়ে গেছে…তার পরেই বলল…সাব অউর এক…আপলোগ ইধার আইয়ে…ম্যায় উস তরফসে খিচেঙ্গে।
মৌকে সাথে করে রাস্তা পেরিয়ে চা গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ক্যামেরাটা সেট করতে…ওদিকে গাছের ছায়া থাকায় আলো কম ছিল…এদিকে অনেকটাই ঝকঝকে আলো আছে…আগের মতো তুললে হবে না…মৌ একটা চা গাছ ছুঁয়েহাসি মুখে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে…ক্যামেরার লেন্স দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লোজ আপে নিয়ে এসে দেখছিল…কি সুন্দর সারল্য মাখানো মুখ…কোথাও কোনো মালিন্য নেই…ক্যামেরাটা সেট করে পবনের হাতে দিয়ে রাস্তা পেরোতে গেল…এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে খেয়াল করেনি যে ও একটা রাস্তা পেরোতে যাচ্ছে। হটাত একটা ভীষন কর্কশ আওয়াজ কানে এল…সাথে সাথে কেউ যেন ওকে এক ঝটকায় টেনে ধরল। কয়েক সেকেন্ড মাথাটা পুরো যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল…সম্বিত ফিরে এলে কি হতে যাচ্ছিল ভেবে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল… রাস্তার মাঝখানে একটা টাটা সুমো দাঁড়িয়ে আছে…ডাইভার গালাগালি দিতে যাচ্ছিল…পবনকে দেখে গালাগালি না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল…কোথাও লেগেছে কিনা।
কিছু হয়নি…খুব ভুল হয়ে গেছে…একেবারে খেয়াল করিনি বলার পর মনে পড়ল…ওদিকে মৌ একা দাঁড়িয়ে আছে…ভয় পেয়ে যায় নি তো? ওর আবার টেনশান হলে চলবে না…ভেবে…তাড়াতাড়ি গাড়ীটার পেছন দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেল…মৌ চা গাছটার পাশে হাঁটু মুড়ে মুখ নিচু করে বসে আছে …সারা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে…আরো কাছে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওকে ডাকতে গিয়ে ওর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে অবাক হয়ে গেল।এর আগে একবার কাঁদতে দেখেছে কিন্তু গলায় তো কোনো আওয়াজ ছিল না। আর কিছু ভাবার সময় ছিলনা…তাড়াতাড়ি ওর কাঁধে দু হাত রেখে ডাকলো…এই…মৌ…এই তো আমি…কিছু হয়নি আমার…ওঠো…
নিজের কানকেই বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিল না ও…আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে… কান্না যেন আরো বেড়ে গেল…অরিত্র দু হাতে ধরে তোলার চেষ্টা করলে নিজেই উঠে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকলো…কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে…অরিত্র আবার বলল…এই…আমি ঠিক আছি… দেখো…আমার কিছু হয়নি…
বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে কান্না ভেজা গলায় বলল…আমার চাই না ফটো…তুমি কেন ওদিকে একা গেলে?
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অরিত্র…মৌ কথা বলছে…স্বপ্ন দেখছে না তো? ওর মাথা নিজের বুকে আরো নিবীড় ভাবে চেপে ধরে মুখ নামিয়ে বলল…তোমাকে একা রেখে আমি আর কোথাও যাবো না…
আর কোথাও যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিল না…সবাই কে জানাবার জন্য মনটা ভীষন ছটপট করছিল…নিজের ফোনটা আনতে ভুলে গিয়েছিল…পবনের ফোন থেকে যে দাদুকে ফোন করবে তার উপায় নেই…দাদুর নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করা থাকে বলে মনে থাকে না …পবন সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে বকবক করে যাচ্ছে…ও যে বলেছিল পূজো দিলেই কাজ হবে। মৌ ওর পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে কোলের উপরে অরিত্রর হাতটা ধরে চুপ করে চোখ বুজে বসে আছে পরম নিশ্চিন্তে…
হোটেলের সামনে পৌঁছোতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে মৌ এর হাত ধরে প্রায় দৌড়ে দাদুর রুমে গিয়ে পৌঁছোলে সবাই ওদেরকে ওইভাবে আসতে দেখে বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে…কোনো রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে পারল…মৌ…
আর কিছু বলতে পারছে না দেখে দাদু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে…এত হাঁপাচ্ছিস কেন…
অরিত্র একটু দম নিয়ে বলতে পারল…কথা বলেছে।
কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না ওর কথা…দিদান ততক্ষনে উঠে এসেছে…মৌ দিদান কে জড়িয়ে ধরলে দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে বলল…এই মৌ…সত্যি?
মৌ অস্ফুট স্বরে বলল …দিদান…
শুক্লাদি আর দাদুও ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল…কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না…দিদান নিজের চোখের জল আটকাতে পারলো না…ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ওকে কিভাবে আদর করবে যেন বুঝতে পারছিল না। দিদানের চোখের জল আস্তে আস্তে যেন বাকিদের চোখেও জল এনে দিল…
পবন প্রায় লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালো…হাতে বেশ বড় একটা মিষ্টির প্যকেট…সবার চোখে জল দেখে ওর চোখেও জল এসে গেছে…চোখের জল নিজেই মুছে নিয়ে একটা মিষ্টি মৌ এর মুখে দিয়ে…বলল…আজ ম্যায় বহুত খুশ হঁ…মেরা বহেন ঠিক হো গ্যায়ি। দিদান ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল…যা…নিজের হাতে সবাই কে খাইয়ে দে। সবার আগে পবনকে খাইয়ে তারপর সবাই কে এক এক করে খাইয়ে অরিত্রর কাছে এলে…অরিত্র মুখটা গম্ভীর করে বলল…আমার দুটো চাই।
তখোনো মুখের কান্না কান্না ভাবটা যায়নি…তার ভেতরেই মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল…কেন?
বা রে…আমিই তো তোমার কথা প্রথম শুনেছি…তাই না?
উমম…এখন পাবে না…পরে।
পবন এখুনি ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেছে…কোন মন্দীরে নাকি মানত করে রেখেছিল পূজো দেবে বলে…দাদু, দিদান আর শুক্লাদি মৌকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিল না…যেন আজই ওর সাথে সব কথা বলা শেষ করতে হবে, নিজেদের যে শরীর ভালো নেই যেন ভুলেই গেছে। অরিত্র ওর রুমে গিয়ে এক এক করে সবাইকে ওর কথা বলা শুরু করার ব্যাপারটা জানাচ্ছিল। বোস দাদু শুনেই বলল…মনে হচ্ছে যা ভেবেছিলাম…তাই…বিরাট একটা শক পেয়ে যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তেমনি আবার একটা শক পেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যাক গে…আরো একটা চিন্তা থেকেই গেল…স্মৃতি ফিরবে কিনা আর যদি ফেরে কতটা বা কিভাবে ফিরবে…ভালো বা খারাপ দুটোই হতে পারে…এর মাঝে আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি কিন্তু কেউ সেভাবে আশার আলো দেখাতে পারেনি…আজকাল অনেকরকম চিকিতসা হচ্ছে কিন্তু ভালো হবেই কেউ বলতে পারছে না…ভালো করতে গিয়ে যদি আরো খারাপ হয়ে যায়…সেটাই চিন্তা। কেউ কেউ বলছে ঠিক কি কি ঘটেছিল জানতে পারলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেত।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…কি জানি কি হবে…দেখা যাক। এখন যা হয়েছে…সেটাই বা কম কি…
বিশ্বাস কাকুকে ফোনে পাওয়া গেল না…নেটওয়ার্কের বাইরে আছে…পরে আবার চেষ্টা করবে ভেবে রুপসাকে ফোন করল…একসাথে পুবালীকে পেলে ভালো হ’ত কিন্তু এখন পাওয়া যাবে না, ওর অফিসে একটা মিটিং আছে বলেছিল। রুপসা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…দাদাভাই, প্লিজ একবার আমার সাথে কথা বলিয়ে দে…উঃ…আমার ইচ্ছে করছে এখুনি চলে যাই রে…
দাঁড়া…দিদানদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছি। আর শোন…তুই কাউকে বলিস না…আমি সবাই কে নিজে জানাবো…না হলে…খারাপ দেখাবে…বুঝলি…
হ্যাঁ…বুঝলাম…তুই আগে ফোনটা দে না বাবা…
মৌকে ডেকে নিয়ে এসে ফোনটা হাতে দিলে জিজ্ঞেস করল…কে?
অরিত্র হেসে বলল…দেখো…কে আছে…
মৌ হ্যালো বলতেই…রপসা…বলল…এই…মৌ…আমি কে বলোতো?
মৌ একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল…উমম…ছোড়দি…
ইস…ছোড়দির নাম তো পুবালী।
উঁ হুঁ…পুবালী দিদি তো তোমার ছোড়দি…আর আমার মেজ দি। তুমি…আমার ছোড়দি…রুপসা দিদি।
কি করে বুঝলে?
বা রে…বলবো কেন?
জানো তো…তোমার কথা খুব মিষ্টি…একেবারে তোমার মতো।
ধ্যাত…তুমি খালি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছো। তোমার গলাও তো কত মিষ্টি।
ধুস…আমার গলা…হাঁসের মতো…সব সময় নাকি প্যাঁক প্যাঁক করে কথা বলি…
মৌ হেসে ফেলে বলল…কে বলেছে…তোমার গলা হাঁসের মতো।
কে আবার বলবে…বলার তো একজনই আছে…
কে… ব’ল না।
উমম…তোমার কাছে কেউ নেই তো?
উঁ হুঁ…এখানে খালি তোমার দাদাভাই ছাড়া আর কেউ নেই…
ওই দাদাভাই টাই তো বলে…আমার সাথে কথা বললে নাকি কান ঝালাপালা হয়ে যায়…পাগল পাগল লাগে।
অরিত্রর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিয়ে হেসে ফেলে বলল…তাই?
হ্যাঁ গো…তাই বলে…আচ্ছা…শোনো না…কি করে হোলো বলোতো…আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
কি জানি…তোমার দাদাভাই জানে হয়তো।
যাক গে…বাদ দাও…তুমি কথা বলতে পারছো…এটাই আমাদের কাছে সব থেকে বড়…পরে দাদাভাই এর থেকে জেনে নেবো।
ছোড়দি…তুমি কবে আসছো?
ইচ্ছে তো করছে…আজই চলে আসি…সামনের সোমবার আমার একটা ইন্টারভিউ আছে…হয়ে গেলেই চলে আসবো।
খুব ভালো হবে…তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।
ইস…আমার সাথে কেন গল্প করবে…আর একজন তো পাশেই আছে।
ধ্যাত…তুমি না খালি পেছনে লাগো।
ইস…আমি পেছনে লাগি? তোমার ইচ্ছে করে না নাকি? ও হ্যাঁ…ওটার কিছু হ’ল…তোমাকে যেটা বলেছিলাম…
কি গো?
ওই যে দাদাভাইকে দিয়ে ব’লাতে…
তুমি এসো না…তারপর…
দুপুরের পর থেকে আবার ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠান্ডায় কারুরই শুতে ইচ্ছে ছিল না…দাদুদের ঘরে ওরা সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর অরিত্র ওদিকে নিজের ঘরে এক এক করে সবাইকে ফোন করে জানাচ্ছে। যারা খুব কাছের তাদেরকে আবার উঠে গিয়ে মৌ এর সাথে কথা বলিয়ে দিতে হচ্ছে…এই করতে করতে বিকেল হয়ে গেল তবুও বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির জন্য বোধহয় ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে দেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে কি করা যায় ভাবছিল, শুক্লাদি এসে বললো…দাদু ডাকছে। দাদু সোফায় পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আর ওদিকে মৌ যথারীতি দিদানের সাথে কম্বলের তলায়। আগের দিনের মতো শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। শুক্লাদিও ফিরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল।
কি ব্যাপার…দাদু…আজকেও কি ভুতের গল্প হচ্ছে নাকি?
না রে…যা সব ভীতু…ভুতের গল্প নয়…আজ তোর দিদানের ছোটোবেলার গল্প হচ্ছিল। কলেজ যেতে গিয়ে নাকি রামছাগলের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছিল…আরো কত কি…
যাই বলো দাদু…তোমাদের ছোটোবেলায় খুব মজার মজার ঘটনা আছে…
তা অবশ্য ছিল…তোরা তো অনেক কিছুই দেখিস নি…আস্তে আস্তে সব কিছু কেমন যেন পালটে যাচ্ছে।
তা তো যাবেই…তোমরা কিছু খাবে এখন? দুপুরে তো ভালো করে খাওয়াই হোলো না…পবন কেও ডাকি একবার…ও বেচারা এই ঠান্ডায় বাইরে বসে আছে।