25-02-2019, 12:20 PM
(This post was last modified: 25-02-2019, 01:03 PM by pcirma. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
মৌ কথা কও
Raunak_3
মৌ কথা কও
<<<<<< এই গল্পের সমস্ত ঘটনাবলী ও চরিত্র সম্পুর্নভাবে কাল্পনিক।জীবিত বা মৃত কোনো ব্যাক্তি অথবা কোনো ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। >>>>>>
সল্টলেকের অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের গাড়ী করে উল্টোডাঙ্গা স্টশনে পৌঁছোতে প্রায় ন টা বাজলো অরিত্রর। চারিদিকে লোকে লোকারন্য, দেড় ঘন্টা হয়ে গেছে নাকি কোনো আপ ট্রেন আসেনি। ডাউন ট্রেনের ও একই অবস্থা…এখানেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শিয়ালদা স্টেশনে কি হতে পারে আর এর পরে যে ট্রেন আসবে তাতে কোনো মতেই যে ওঠা যাবেনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে শিয়ালদা চলে যাওয়া ভালো, কয়েক টা ট্রেন ছেড়ে তার পর না হয় ওঠা যাবে ভেবে স্টেশনের বাইরে এসে বাস ধরে শিয়ালদা পৌঁছে দেখলো একই অবস্থা, স্টেশনে ঢোকার মতো অবস্থা নেই। বাড়ীতে একটা ফোন করে জানিয়ে দেওয়া ভালো মনে করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মোবাইল টা নেই…এই নিয়ে পাঁচবার হল…কখন যে তুলে নেয় বোঝাই যায় না। যাক খুব একটা দামী ছিল না, আর একটা কিনে নেওয়া যাবে ভেবে বুথে গিয়ে ফোন করল, দিদান ফোন টা রিসিভ করলে মোটামুটি বুঝিয়ে বলে দিল…ট্রেনের গন্ডগোল আছে… দেরী হবে ফিরতে…তোমরা খেয়ে শুয়ে পড়, যা অবস্থা তাতে কত রাতে পৌঁছব, বলতে পারছি না। দিদান শুনে বলল…খুব অসুবিধা দেখলে ও যেন ভবানীপুরের বাড়ী চলে যায়। অরিত্র…কোনো দরকার নেই…আমি ঠিক চলে যাবো বলাতে দিদান বলল…আমি তোর দাদু কে বলছি নারায়ন কে খবর দিয়ে রাখতে, যত রাত হোক ও তোকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসবে।
কি দরকার আবার বুড়ো মানুষটাকে বিব্রত করে, সারাদিন রিকশা টেনে একটু তো বিশ্রাম নিতে দাও, দাদু বললে তো আবারনা করতে পারবে না।
দিদান বললো…তোকে ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তুই তো জানিস নারায়ন তোকে কত ভালোবাসে।
আরো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর জানা গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই রানাঘাট লোকাল ছাড়বে, আরো দু একটা ট্রেন না ছাড়লে গিয়ে লাভ নেই দেখে চা খেয়ে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর মনে হল ভীড়টা একটু হালকা হয়ে গেছে। গোটা তিনেক ট্রেন ছাড়ার পর, এবারে স্টেশনে ঢোকা যেতে পারে দেখে স্টেশনে ঢুকে প রের ট্রেন টাতে কোনো রকমে ধাক্কাধাক্কি করে একটা কামরায় উঠতে পারলেও ভেতরে যাবার কোনো উপায় নেই, অগত্যা একটু একটু করে দরজার পাশে যতটা যাওয়া যায় চেপে গিয়ে খুব কপাল ভালো পার্টিশান টায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে পারলো। একে ওই রকম ভীড় তার উপরে আবার কামরা টার বেশ কয়েক টা আলো জ্বলছে না। যে কটা জ্বলছে তার আলো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে, বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর একটু একটু করে ট্রেন এগোতে শুরু করল, যত টা না এগোয়,তার থেকে বেশী দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দমদম পৌঁছোল রাত প্রায় বারোটা, আধো আলো, আধো অন্ধকারে ঠিক মতো বোঝা না গেলেও খেয়াল করে দেখলো ওর বুকের উপরে মাথা রেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে, কিছু করার তো নেই ভেবে ওদিকে আর মন দিলো না, ট্রেনে ভীড় থাকলে হতেই পারে।ট্রেন টা ব্যারাকপুর ছাড়লো, ভীড়টা একটুও কমেনি। ট্রেন টা যেভাবে এগোচ্ছে, দুটোর আগে মনে হয় না বাড়ী পৌছোতে পারবে ভাবতে ভাবতে মেয়েটার খেয়াল করে দেখতে গিয়ে মনে হল, ঘুমিয়ে গেছে। এ কি রে বাবা, এতো ভীড়ে ঘুমোচ্ছে কি করে? ওর স্টেশন পেরিয়ে যায়নি তো ভেবে কাঁধে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…এই যে শুনছেন…কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পাশ থেকে একজন টিপুন্নি কাটলো…কি দরকার ডাকার, ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোতে দিন না, আর আপনার তো কোনো ক্ষতি দেখছি না।লোকটার কথা শুনে গা পিত্তি জ্বলে গেলেও জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলো।পরের স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার নামতে শুরু করল ধাক্কাধাক্কি করতে করতে, মেয়েটা প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছে দেখে কোনোরকমে হাত দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে থেকে একটু একটু করে নিজের পাশে নিয়ে আসার চেষ্টা করে পার্টিশানের গায়ে নিয়ে এসে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। পাশ থেকে একজন বলল…এতো মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে না, দেখুন আবার বেঁচে আছে কিনা…আজকাল কি যে হচ্ছেবোঝা খুব মুশকিল। লোকটার কথা শুনে একটা ঠান্ডা স্রোত শির দাঁড়া দিয়ে নেমে গেল, কোনোরকমে মেয়েটার একটা হাত ধরে বুঝলো…খুব আস্তে আস্তে পালস চলছে। যাক, বেঁচে আছে কিন্তুকি করা যায় ভাবছিল। দু এক জন বলল এক কাজ করুন স্টেশনে নেমে পুলিশের কাছে জমা করে দিয়ে আপনি আপনার মতো বাড়ী চলে যান। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে, কি দরকার বেশী ঝামেলায় যাবার।
পরের স্টেশনেই ওকে নামতে হবে, এই অবস্থায় অসহায় মেয়েটাকে এত রাতে এইভাবে ফেলে যাওয়া টা কেমন যেন অমানবিক মনে হল। আগে তো নামাই তারপরে দেখা যাবে ভেবে পাশের একজনকে অনুরোধ করল যদি একটু হেল্প করে নামাতে। হুড়োহুড়ি করে সবাই নেমে যাবার পর ধরাধরি করে কোনোরকমে নামিয়ে কপাল ভালো ছিল একটা বসার জায়গা পেয়ে ওখানে বসিয়ে দিয়ে একটু দম নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, ঘাড় কাত করে বসে আছে…মানে যেভাবে বসানো হয়েছিল সেই ভাবেই আছে। এদিক ওদিক তাকালো কাউকে যদি পাওয়া যায়, সবাই যেভাবে তাড়াতাড়ি করে চলে যাচ্ছে তাতে হেল্প করার কথা শুনলে হয়তো তেড়ে আসবে ভেবে আর সাহস হোল না। এতটা রাস্তা ওই ভীড়ে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে, নিজের ই শরীরের অবস্থা খারাপ, ভীষন ক্লান্ত লাগছে…একটু বসে জিরিয়ে নি ভেবে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল একটা জলের কল আছে, উঠে গিয়ে জল খেয়ে মাথায় ঘাড়ে জল দিয়ে একটু সুস্থ বোধ হলে ফিরে এসে বসে ভাবছিল…কি করবে…মেয়েটাকে ডাক্তার দেখানো দরকার মনে হচ্ছে, পুলিশের কাছে দিলে তো ফেলে রেখে দেবে অথবা একলা মেয়ে পেয়ে হয়তো আরো কিছু করতে পারে। হসপিটালে নিয়ে গেলেই ভালো ভেবে উঠে পড়ল কিন্তু কি করে স্টেশনের বাইরে নিয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে নারায়ন দার কথা মনে পড়ল। দিদান তো বলেছিল নারায়ন দা অপেক্ষা করবে, কিন্তু নারায়ণ দা তো আর জানে না কোন ট্রেনে ফিরবে…হয়তো ওকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছে পরের কোনো ট্রেনে আসবে আর তাই ভেবে অন্য কোনো প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে। ধুস, কি যে ঝামেলায় পড়লাম ভালোমানুষী করতে গিয়ে ভেবে নিজের উপরই রাগ হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর মেয়েটার দিকে তাকালো… দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ভালো বাড়ীর মেয়ে, মুখটা বেশ মিষ্টি…চেহারাতে বেশ একটা মাধুর্য আছে…দেখে মনে হচ্ছে না কুড়ি বাইশের বেশী বয়স হবে… একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না দেখে কি করবে ভাবতে ভাবতে দেখা যাক একাই নিয়ে যাওয়া যায় কিনা... দু হাতে করে তুলে নিয়ে দেখলো … নাঃ, খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না, জোরে পা চালিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দেখলো একটাই রিকসা দাঁড়িয়ে আছে, যাক বাঁচা গেল, হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে ভেবে ওটার কাছে গিয়ে অনেক টা নিশ্চিন্ত বোধ করল… নারায়ন দার রিক্সা…বুড়ো মানুষটা পাদানিতে বসে ঢুলছে।
ও নারায়ন দা ওঠো…বলে জোরে ডাকতেই নারায়ন দা ধড়পড় করে উঠে পড়ে ওকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল…আরে, এ আবারকে তোমার সাথে?
তুমি আগে একটু ধর, সিটে বসিয়ে দি…
দুজনে মিলে ধরাধরি করে কোনোরকমে সিটে বসিয়ে হুড টা উঠিয়ে দিয়ে ওতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে উঠে মেয়েটাকে ধরে বসে বলল…নারায়ন দা…হসপিটালের দিকে চলো।
আগে তুমি বলোতো…কি ব্যাপার,মেয়েটা কে আর তোমার সাথেই বা কেন।
নারায়ন দা কে ও কখোনোই রিক্সাওয়ালা হিসেবে দেখেনি, কিছুটা গুরুজনের চোখে দেখে বলে… কিছু মনে না করে…সংক্ষেপে সব টা বললে নারায়ন দা বললো হসপিটালে তো নিয়ে যাবে বলছো কিন্তু এখন কি আর ডাক্তার পাবে, সরকারী হাসপাতাল, ওদের আর কি কোনো দায়িত্ব আছে…সারারাত ফেলেই রেখে দেবে। কাল রাতেই তো আমাদের পাড়ার একটা বৌ কে নিয়ে গিয়েছিলাম…বরটা মদ খেয়ে এসে বেদম মার মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল দেখে নিয়ে গেলাম…ভর্তি করা তো দুরের কথা কেউ একবার দেখলো না পর্যন্ত…নাইট ডিউটির ডাক্তার নাকি এসে বেরিয়ে গেছে… জোরজার করাতে বলল…অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। তার থেকে চলো…বাড়ী নিয়ে যাই, বোস ডাক্তার তো তোমার দাদুর বন্ধু, ওনাকে ডাকলে নিশ্চয় না করবেন না। তুমি দাদাভাই একটা কাজ কর বাড়ীতে একটা ফোন করে বল ডাক্তার বাবুকে খবর দিয়ে রাখতে, আমি তোমাদের কে নামিয়ে দিয়ে ওনাকে তুলে নিয়ে আসবো।
ফোন কি আর আছে, ভীড়ের মাঝে তুলে নিয়েছে।
চলো তাহলে আগে বাড়ীর দিকে যাই তারপর দেখা যাবে… বলে নারায়ন দা রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিল। নারায়ন দা খুব সাবধানে চালালেও…মাঝে মাঝে রাস্তা খারাপ, তার উপর মেয়েটার জ্ঞান নেই…ধরে বসে থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল দেখে কোলের উপরে ওর মাথা রেখে শুইয়ে নিতে হল। দিদান এত রাতে না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝেই দেরী হয়…কিন্তু আজ যেন খুব বেশী দেরি হচ্ছে ছেলেটার…তার উপরে আবার ফোনটাও হারিয়ে বসে আছে… ওদের কে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে দুজনে মিলে ধরাধরি করে মেয়েটাকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফাতে শুইয়ে দিল, ততক্ষনে দাদু ও উঠে এসেছে…ওদের কে ঘটনা টা বলতেই দাদু তাড়াতাড়ি করে বোস ডাক্তার কে ফোন করে মোটামুটিভাবে কি হয়েছে বুঝিয়ে দিয়ে আসার জন্য বলে দিলে নারায়ন বেরিয়ে গেল নিয়ে আসার জন্য।
অরিত্র একটু জল খেয়ে নিজেই কফি বানিয়ে নিয়ে এলো, একেই রাত হয়েছে… মেয়েটার জন্য খুব টেনশান হচ্ছে…খারাপ কিছু হয়ে না যায়। ওদিকে দাদু খুব অধৈর্য হয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে দেখে আসছে ডাক্তার এলো কিনা। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে মেয়েটার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে জল খাওয়াবার চেষ্টা করছিল। ততক্ষনে ডাক্তার দাদু পৌছে গিয়েছেন… বেশ কিছুক্ষন দেখে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিলেন প্রথমেই… প্রেশক্রিপসান লিখে দিয়ে নিজেই ব্যাগ থেকে কিছু ওষুধ বের করে বললেন…এখুনি কিছু আনার দরকার নেই…এই ওষুধ গুলো কাল পর্যন্ত চলে যাবে…খুব একটা ভয়ের কিছু নেই, কয়েকদিন হয়তো খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করেনি বা টেনশান করে এই অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাবার মতো কিছু ঘটনা থাকতে পারে। এখন কিছুটা গরম দুধ খাইয়ে দাও, আমি আরো কিছুক্ষন দেখে তারপর যাবো বলাতে শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে দুধ গরম করে নিয়ে এসে চামচে করে একটু একটু করে খাওয়াবার চেষ্টা করল…খুব বেশী না হলেও কিছুটা খাওয়ানো গেল। প্রায় এক ঘন্টা পর বোস দাদু আর একবার সবকিছু দেখে বললেন নাঃ…ঠিক ই আছে, পেশেন্ট রেসপন্স করছে… ভয় পাবার কিছু নেই, আমি কাল সকালে একবার এসে দেখে যাবো। কাল সকালে বরং পুলিশে একটা খবর দেওয়া ভালো… বলা তো যায়না… কোথা থেকে কি হয়ে যায়।
অরিত্রর স্নান করে অল্পছু খেয়ে নিতে নিতে রাত প্রায় চারটে বাজলো। মেয়েটাকে গেস্ট রুমে শুইয়ে দিয়ে ওখানেই শুক্লাদি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। প্রায় সারা রাত অনেক ধকল গেছে বলে সকাল সকাল ওকে আর কেউ ডাকেনি, প্রায় ন টা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গার পর উঠে… আগে গিয়ে মেয়েটা কেমন আছে দেখতে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে আছে…মিষ্টি মুখটাতে ভীষন ক্লান্তির ছাপ…শুক্লাদি জানালো ভোরের দিকে একবার চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে হাত মুখ ধুয়ে চা এর কাপ টা নিয়ে দাদুর কাছে গিয়ে বসে বলল…কি করা যায় বলোতো? পুলিশ কেখবর দেওয়া উচিত মনে হচ্ছে?
দাদু একটু ভেবে বলল…এখন থাক,আগে সুস্থ হোক, নাম ঠিকানা নিয়ে তারপর যা করার করা যাবে। এই অবস্থায় পুলিশে টানা হেঁচড়া করবে…আমার ঠিক ভালো লাগছে না… আমি না হয় একবার তোর বিশ্বাস কাকুর সাথে কথা বলে রাখবো।
বিস্বাস কাকু আবার কে জিজ্ঞেস করাতে দাদু বলল… আরে তুই ভুলে গেলি…আমার বন্ধু সজল বিশ্বাসের ছেলে… বেঙ্গল পুলিশে কাজ করে, এখন কুচবিহারের কোথাও একটা পোস্টিং…খুব শিগরিই নাকি বিধাননগরে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসছে। তোর পাসপোর্ট করানোর সময় অনেক হেল্প করেছিল।
ও আচ্ছা…হ্যাঁ…আমি আসলে খেয়াল করিনি…
তুই আজ অফিস যাবি নাকি?
নাঃ…ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি…যাবো না…
সেই ভালো…মেয়েটার যা অবস্থা…কিছু হলে…আমরা বুড়োবুড়ি সামলাতে পারবো না…
মনে হচ্ছে…আর বাড়াবাড়ি হবেনা…আর ডাক্তার দাদু তো বললোই ভয়ের কিছু নেই।
তা অবশ্য বলেছে… এক কাজ কর দাদুভাই…কিছু খেয়ে একবার গাড়ীটা নিয়ে ডাক্তার কে নিয়ে চলে আয়।
অরিত্র খেয়ে উঠে বেরোতে যাবে এমন সময় নারায়ন দা ডাক্তার বাবুকে নিয়ে এসে হাজির। শুধু নিজে আসেনি, সাথে করে আবার কিছু টাটকা ফল ও নিয়ে এসেছে। দিদান বকাবকি করাতে বলল…আরে নিয়ে এসেছি তো কি হয়েছে, মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। আমার নাতনি টা তো প্রায় ওর ই বয়সী।
দুপুরের একটু আগে মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গল… নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই… ভীষন দূর্বল…কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আর না পেরে চোখ বুজে ফেলল। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে হালকা গরম জল দিয়ে হাতমুখ স্পঞ্জ করে দিয়ে কিছুটা গরম সুপ খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানোর পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পরেরদিন সকাল পর্যন্ত ওইভাবে মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকানো আর তারপরেই আবার ঘুমিয়ে পড়া চলল।দুপুরের পর থেকে মনে হচ্চিল যেন কিছুটা হলেও আগের থেকে ভালো… খুব সামান্য হলেও নড়াচড়া করতে পারছে… কিন্তু চোখের সেই শুন্য দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।
পরের দিন বিকেল, মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো… শরীরটা খুব ভারী লাগছে। বোঝার চেষ্টা করল… কোথায় আছে। কেমন যেন অচেনা লাগছে সবকিছু… কিছুই বুঝতে পারছে না… চিন্তা করতে গেলেই মাথার ভেতরে কেমন যেন একটা যন্ত্রনা শুরু হয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ শুয়ে থাকলে বরং কষ্ট হচ্ছে না…মনে হল কেউ এসে যেন আদর মাখানো গলায় বলছে… এই তো ঘুম ভেঙ্গেছে…কেমন আছো? এখন একটু ভালো লাগছে?
মাথাটা আস্তে আস্তে কাত করে দেখলো… অচেনা কেউ এক মহিলা… সারা মুখে স্নেহ মাখানো…ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে গেল…আমি কোথায়? ঠোঁট দুটো হয়তো একটু নড়ে উঠল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না…আবার বলার চেষ্টা করলো… একই অবস্থা। ও যে চেষ্টা করছে কিছু বলার কিন্তু পারছে না… বুঝতে পেরে ওই মহিলা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল… আচ্ছা…ঠিক আছে…থাক এখন কথা বলতে হবে না… শরীরটা এখোনো দূর্বল… আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওর দু চোখের কোন দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে জল বেরিয়ে আসতে শুরু করল… আমি কেন কথা বলতে পারছি না? আমি কোথায়? তুমি ই বা কে? আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না…চোখ দুটো ভীষন ক্লান্তিতে বুজে এলো।
তারপর দিন সাতেক কেটে গেছে। মেয়েটা অনেক টাই সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু দুর্বলতা বেশ কিছুটা কমলেও পুরোপুরি কাটেনি,শুক্লা দি ওকে নিয়েই থাকে, স্নান করানো থেকে শুরু করে খাইয়ে দেওয়া সব কিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছে। মুশকিল হয়েছে আজ পর্যন্ত একটা কথা বলেনি কিন্তু কিছু বললে বুঝতে পারে। প্রথম প্রথম নিজেকে খুব গুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক টা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, দিদান আর শুক্লাদি কে খুব পছন্দ করে, মাঝে সাঝে অল্প হাসিও দেখা যাছে মুখে কিন্তু বেশির ভাগ সময় কেমন যেন একটা বিষন্ন ভাব…কিছু জিজ্ঞেস করলে ভাবলেষহীন মুখে তাকিয়ে থাকে… ডাক্তারদাদু বলেছেন…হয়তো খুব বড় কিছু শক পেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে…আবার বোবাও হতে পারে… আরো কিছুদিন না গেলে বোঝা যাবে না। অরিত্র দুবেলাই ওকে একবার করে দেখে যাওয়া ছাড়াও সারাদিনে অন্তত এক দুবার অফিস থেকে ফোন করে খোঁজ নেয় কেমন আছে।
আরো কয়েক টা দিন কেটে গেছে, এখন আর সেই দুর্বলতা নেই, মাঝে মাঝে ঘরের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়ায়…কিছু যেন একটা বোঝার চেষ্টা করে। গেস্টরুম থেকে ওকে সরিয়ে এখন দোতলায় অরিত্রর পাশের ঘরটায় রাখা হয়েছে যতটা সম্ভব পাড়া প্রতিবেশীর চোখের আড়াল করতে, সাথে শুক্লাদিকেও ওর সাথে উপরের ঘরে থাকতে হচ্ছে । দিদান ওকে নিজের অনেক দুর সম্পর্কের নাতনী বলে পরিচয় দিয়ে পাড়া প্রতিবেশির কৌতুহল এড়িয়ে গেছে।
একটা সমস্যা তো ছিলই কথা না বলা, তার সাথে এখন যোগ হয়েছে…মাঝে মাঝে রাত্রে কিছু একটা হয়, ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাত ভয় পেয়ে ভীষন ছটপট করে। শুক্লাদি উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কষ্টে ওকে স্বাভাবিক করার পর শুক্লাদি কে জড়ীয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, এক সপ্তাহের ভেতরে দিন তিনেক এরকম হওয়ার পর থেকে এখন শুক্লাদি ওর সাথেই শোয়। ডাক্তার দাদু এখন অনেক টাই নিশ্চিত যে মেয়েটার জীবনে কোনো একটা খারাপ কিছু ঘটেছিল বা ঘটতে যাচ্ছিল যার জেরে মানসিক ধাক্কায় এই অবস্থা।মাঝে একদিন একজন ডাক্তার দাদুর চেনা শোনা একজন কে নিয়ে আসা হয়েছিল যিনি ডিফ এন্ড ডাম্ব কলেজের শিক্ষক। ইশারায় ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ হয়নি, মাথা নেড়ে বুঝিয়েছিল ও কিছুই বুঝতে পারছে না, তার মানে ও বোবা নয়, আগে নিশ্চয় কথা বলতে পারতো, যদি তাই হোতো তাহলে ইশারায় কথা বলার ব্যাপার টা জানা থাকতো। মোটামুটি আরো কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে কলকাতার নাম করা একজন নিউরো আর সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছে। নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করার পর ওনারা বলেছেন… দেখা যাক…এই ওষুধ গুলো খাওয়ান। কি হবে… না হবে… বলা মুশকিল। তবে দেখবেন কোনো রকম মানসিক চাপ যেন না পড়ে।
এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বাস কাকুর সাহায্য নিয়ে লালবাজার আর ভবানী ভবনের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কোলকাতা বা কোলকাতার বাইরে কোনো থানায় হারিয়ে যাবার ডায়েরী করা হয়েছে কিনা কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে খবরের কাগজে বা টিভি তে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওর পরিচিত জনের খোঁজ করার চিন্তাও বাতিল করতে হয়েছে কারন যদি এটা হয় যে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল আর তার জন্য ই ও কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে…যারা ওর খোঁজ পেলে আবার ক্ষতি করতে পারে। এখন ওর থেকে কিছু জানার আগে আর কিছু করা উচিত হবে না ঠিক করে এটাও চেষ্টা করা হয়েছিল ওকে দিয়ে যদি লিখিয়ে জানা যায় ও কে। সে চেষ্টা ও বিফলে গেছে, কিছুই মনে করতে পারে নি…উলটে মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। ডাক্তার বাবুরা কোনো রকম মানসিক চাপ দিতে বারন করেছিলেন বলে খুব বেশী চেষ্টা ও করা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস কাকুর ভরসায় পুলিশে খবর দেবার ব্যাপার টা নিয়ে এই মূর্হুতে তাই আর ভাবা হচ্ছিল না। তেমন কিছু যদি প্রয়োজন হয় তাহলে বলা যাবে যা কিছু করা হয়েছে তা নিতান্তই মানবিকতার কারনে…এর মধ্যে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
এক সাথেথাকতে থাকতে কবে যে মেয়েটা ওদের বাড়ীরই একজন হয়ে গেছে বোঝা যায়নি। কোন নাম নেই তাইদিদান ওর নাম রাখতে চেয়েছিল অনামিকা, যদি কোনোদিন ওর নিজের নাম জানা যায় সেদিন না হয়ওই নামে ডাকা যাবে কিন্তু এখন তো কিছু একটা বলে ডাকতে হবে। দাদু রাজী হয়নি, এত মিষ্টিমেয়ের নাম মধুমিতা ছাড়া আর কিছু নাকি হওয়া উচিত নয়…দুজনের কেউ কারুর কথা শুনতে রাজীনয়…শেষে অরিত্র র কথায় মৌ নাম রাখতে দুজনেই রাজী হয়েছে…কেউ ই নাতির কথা ফেলতে পারেনি।এখন মৌ বলে ডাকলে ও সাড়া দেয়, হয়তো বুঝেছে ওটাই ওর নাম।
কোনো এক রবিবার দুপুরে খাওয়ার পর অরিত্র ওর ঘরে প্রিয় কতগুলো রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। কি মনে করে দরজার দিকে তাকিয়ে মনে হল পর্দার ওদিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কে হতে পারে? দিদান বা শুক্লাদি হলে তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না আর ওদের তো এখন বিশ্রাম করার সময় ভেবে উঠে এসে দেখে মৌ চুপ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে, মনে হয় গানের কলি গুলো নিজেই গাওয়ার চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে ওর এক মনে গান শোনা দেখে ভীষন ভালো লাগছিল ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে। গান টা শেষ হলে মৌ তাকিয়ে সামনে অরিত্র কে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিলে অরিত্র ওকে ঘরের ভেতরে আসতে বলে পর্দা টা সরিয়ে দিল।ভেতরে আসতে চাইছিল না দেখে অরিত্র ওর হাত ধরে ভেতরে গিয়ে সোফাতে বসতে বলে একটু দুরে নিজেও বসে জিজ্ঞেস করল… তোমার গান শুনতে ভালো লাগছে?…তাই না? প্রথম প্রথম আপনি দিয়ে কথা বলতো …কিন্তু ওর যেন পছন্দ হয়নি…মাথা নেড়ে আপত্তি জানানোয় তুমি করে বলতে খুব খুশি হয়েছিল দেখে তারপর থেকে তুমি টাই চলছিল।
মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…
ঠিক আছে…তুমি এখানে বসে শোনো…আমি ছাদে যাচ্ছি… বেশ কয়েকদিন গাছ গুলো কেমন আছে দেখা হয়নি…
মাথা নেড়ে জানালো…না…
কেন? এখন ইচ্ছে করছে না শুনতে?
হ্যাঁ…
তাহলে?
মৌ উঠে গিয়ে বিছানা থেকে বই টা হাতে নিয়ে দেখালো…অরিত্রর বই পড়া ছেড়ে ছাদে যেতে হবে না।
ও আচ্ছা…আমি ছাদে যাবো না…তাইতো?
একটা মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…তাই…
ঠিক আছে আমি যাবো না…তুমি এখানে বোসো…আমিও বসছি…আমার পরে পড়লেও হবে।
মৌ প্রায় দিন দুপুরে অরিত্রর ঘরে বসে নিচু আওয়াজে গান শোনে…অবশ্য রবিবার টা বাদ দিয়ে কারন ওই দিন অরিত্র বাড়ীতে থাকে। ও আসার পর থেকে বাড়ীর সবার ছকে বাঁধা জীবন টা যেন এক ধাক্কায় একেবারে পালটে গেছে। শুধু শুক্লাদি নয়, দিদান আর দাদু দুজনেরই অনেক টা সময় ওর সাথে কাটে…অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক তৈরী হয়ে উঠেছে। কথা না বলতে পারা বা বয়সের একটা বিশাল ফারাক কোনো বাধা হতে পারেনি সেই সম্পর্কে। সবারই যেন কেমন মায়া পড়ে গেছে ওর উপরে। অরিত্রর অফিস বেরোবার সময়ে ও দিদানের সাথে থাকে,দিদান যখন রোজকার মতো সাবধানে যাবি, দেরী হলে জানিয়ে দিবি বলে, পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে মৌ ওকে বিদায় জানায়। আজকাল অফিস বেরোবার সময়ে ওর ওই মিষ্টি হাসি টা দেখতে পাবে ভেবেই যেন অফিস বেরোতে ইচ্চে করে…অফিস থেকে ফিরতে কোনোদিন দেরী হলে খুব অস্থির হয়ে পড়ে, বারবার দিদানের কাছে গিয়ে জানার চেষ্টা করে কখন ফিরবে। বেশ কয়েকদিন দেরি করে ফেরার সময় রিকশা থেকে নেমে দেখেছে ওর ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, ওকে দেখতে পেলেই তাড়াতাড়ি নেমে আসে নিচে, সারা মুখে একটু যেন বকুনি দেবার ইচ্ছে…কেন তুমি দেরী করলে? এর মাঝে আবার একদিন ট্রেনের গন্ডগোলে অনেক রাত হয়েছিল ফিরতে, বাড়ীতে ফোন করে জানাতে জানাতে অনেক টা দেরী হয়ে গিয়েছিল। দিদানের কাছে শুনলো…ও নাকি অরিত্রর ফোন আসার আগে দিদান কে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে…গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোলেও চোখের জল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কতটা কষ্ট পেয়েছে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি দিদান ওকে জোর করে শুতে পাঠিয়েছে না হলে সারাক্ষন নিচেই বসে ছিল। অরিত্র খেয়ে উপরে ওঠার সময় দেখলো মৌ ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে,সামনে গিয়ে দেরী হয়ে গেল বলাতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো…ওর যে ভীষন অভিমান হয়েছে বোঝাবার আর তো কোনো উপায় ছিল না। অরিত্র ওর হাত ধরে ঘরের ভেতরে গিয়ে বলল…সত্যি ভুল হয়ে গেছে…আর হবে না…এবার থেকে দেরী হলে আগেই জানিয়ে দেবো…কিছুতেই ওর দিকে তাকাচ্ছেনা দেখে অরিত্র ওর কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলল…এই…তাকাও আমার দিকে…। তাতেও তাকালো না দেখে ওর মুখ টা তুলে ধরে দেখলো…দু চোখে কান্নার আভাস। নিজের হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল…এই…তাকাবে না আমার দিকে? আস্তে আস্তে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো…খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল…এই তো আমি এসে গেছি…এখোনো…অভিমান করে থাকবে? ছোট্ট একটা নিস্বাস ফেলে কান্না ভরা চোখে নরম একটা হাসি মুখে নিয়ে বোঝালো…নাঃ…আমি আর অভিমান করে নেই…কিন্তু তুমি আর কখোনো আমাকে কষ্ট দেবে না। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু না বলে…চোখের ভাষাতে হয়তো দুজনেই বুঝে নেবার চেষ্টা করছিল অন্যের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অজানা কথা গুলো।
Raunak_3
মৌ কথা কও
<<<<<< এই গল্পের সমস্ত ঘটনাবলী ও চরিত্র সম্পুর্নভাবে কাল্পনিক।জীবিত বা মৃত কোনো ব্যাক্তি অথবা কোনো ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। >>>>>>
সল্টলেকের অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের গাড়ী করে উল্টোডাঙ্গা স্টশনে পৌঁছোতে প্রায় ন টা বাজলো অরিত্রর। চারিদিকে লোকে লোকারন্য, দেড় ঘন্টা হয়ে গেছে নাকি কোনো আপ ট্রেন আসেনি। ডাউন ট্রেনের ও একই অবস্থা…এখানেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শিয়ালদা স্টেশনে কি হতে পারে আর এর পরে যে ট্রেন আসবে তাতে কোনো মতেই যে ওঠা যাবেনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে শিয়ালদা চলে যাওয়া ভালো, কয়েক টা ট্রেন ছেড়ে তার পর না হয় ওঠা যাবে ভেবে স্টেশনের বাইরে এসে বাস ধরে শিয়ালদা পৌঁছে দেখলো একই অবস্থা, স্টেশনে ঢোকার মতো অবস্থা নেই। বাড়ীতে একটা ফোন করে জানিয়ে দেওয়া ভালো মনে করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মোবাইল টা নেই…এই নিয়ে পাঁচবার হল…কখন যে তুলে নেয় বোঝাই যায় না। যাক খুব একটা দামী ছিল না, আর একটা কিনে নেওয়া যাবে ভেবে বুথে গিয়ে ফোন করল, দিদান ফোন টা রিসিভ করলে মোটামুটি বুঝিয়ে বলে দিল…ট্রেনের গন্ডগোল আছে… দেরী হবে ফিরতে…তোমরা খেয়ে শুয়ে পড়, যা অবস্থা তাতে কত রাতে পৌঁছব, বলতে পারছি না। দিদান শুনে বলল…খুব অসুবিধা দেখলে ও যেন ভবানীপুরের বাড়ী চলে যায়। অরিত্র…কোনো দরকার নেই…আমি ঠিক চলে যাবো বলাতে দিদান বলল…আমি তোর দাদু কে বলছি নারায়ন কে খবর দিয়ে রাখতে, যত রাত হোক ও তোকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসবে।
কি দরকার আবার বুড়ো মানুষটাকে বিব্রত করে, সারাদিন রিকশা টেনে একটু তো বিশ্রাম নিতে দাও, দাদু বললে তো আবারনা করতে পারবে না।
দিদান বললো…তোকে ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তুই তো জানিস নারায়ন তোকে কত ভালোবাসে।
আরো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর জানা গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই রানাঘাট লোকাল ছাড়বে, আরো দু একটা ট্রেন না ছাড়লে গিয়ে লাভ নেই দেখে চা খেয়ে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর মনে হল ভীড়টা একটু হালকা হয়ে গেছে। গোটা তিনেক ট্রেন ছাড়ার পর, এবারে স্টেশনে ঢোকা যেতে পারে দেখে স্টেশনে ঢুকে প রের ট্রেন টাতে কোনো রকমে ধাক্কাধাক্কি করে একটা কামরায় উঠতে পারলেও ভেতরে যাবার কোনো উপায় নেই, অগত্যা একটু একটু করে দরজার পাশে যতটা যাওয়া যায় চেপে গিয়ে খুব কপাল ভালো পার্টিশান টায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে পারলো। একে ওই রকম ভীড় তার উপরে আবার কামরা টার বেশ কয়েক টা আলো জ্বলছে না। যে কটা জ্বলছে তার আলো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে, বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর একটু একটু করে ট্রেন এগোতে শুরু করল, যত টা না এগোয়,তার থেকে বেশী দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দমদম পৌঁছোল রাত প্রায় বারোটা, আধো আলো, আধো অন্ধকারে ঠিক মতো বোঝা না গেলেও খেয়াল করে দেখলো ওর বুকের উপরে মাথা রেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে, কিছু করার তো নেই ভেবে ওদিকে আর মন দিলো না, ট্রেনে ভীড় থাকলে হতেই পারে।ট্রেন টা ব্যারাকপুর ছাড়লো, ভীড়টা একটুও কমেনি। ট্রেন টা যেভাবে এগোচ্ছে, দুটোর আগে মনে হয় না বাড়ী পৌছোতে পারবে ভাবতে ভাবতে মেয়েটার খেয়াল করে দেখতে গিয়ে মনে হল, ঘুমিয়ে গেছে। এ কি রে বাবা, এতো ভীড়ে ঘুমোচ্ছে কি করে? ওর স্টেশন পেরিয়ে যায়নি তো ভেবে কাঁধে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…এই যে শুনছেন…কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পাশ থেকে একজন টিপুন্নি কাটলো…কি দরকার ডাকার, ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোতে দিন না, আর আপনার তো কোনো ক্ষতি দেখছি না।লোকটার কথা শুনে গা পিত্তি জ্বলে গেলেও জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলো।পরের স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার নামতে শুরু করল ধাক্কাধাক্কি করতে করতে, মেয়েটা প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছে দেখে কোনোরকমে হাত দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে থেকে একটু একটু করে নিজের পাশে নিয়ে আসার চেষ্টা করে পার্টিশানের গায়ে নিয়ে এসে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। পাশ থেকে একজন বলল…এতো মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে না, দেখুন আবার বেঁচে আছে কিনা…আজকাল কি যে হচ্ছেবোঝা খুব মুশকিল। লোকটার কথা শুনে একটা ঠান্ডা স্রোত শির দাঁড়া দিয়ে নেমে গেল, কোনোরকমে মেয়েটার একটা হাত ধরে বুঝলো…খুব আস্তে আস্তে পালস চলছে। যাক, বেঁচে আছে কিন্তুকি করা যায় ভাবছিল। দু এক জন বলল এক কাজ করুন স্টেশনে নেমে পুলিশের কাছে জমা করে দিয়ে আপনি আপনার মতো বাড়ী চলে যান। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে, কি দরকার বেশী ঝামেলায় যাবার।
পরের স্টেশনেই ওকে নামতে হবে, এই অবস্থায় অসহায় মেয়েটাকে এত রাতে এইভাবে ফেলে যাওয়া টা কেমন যেন অমানবিক মনে হল। আগে তো নামাই তারপরে দেখা যাবে ভেবে পাশের একজনকে অনুরোধ করল যদি একটু হেল্প করে নামাতে। হুড়োহুড়ি করে সবাই নেমে যাবার পর ধরাধরি করে কোনোরকমে নামিয়ে কপাল ভালো ছিল একটা বসার জায়গা পেয়ে ওখানে বসিয়ে দিয়ে একটু দম নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, ঘাড় কাত করে বসে আছে…মানে যেভাবে বসানো হয়েছিল সেই ভাবেই আছে। এদিক ওদিক তাকালো কাউকে যদি পাওয়া যায়, সবাই যেভাবে তাড়াতাড়ি করে চলে যাচ্ছে তাতে হেল্প করার কথা শুনলে হয়তো তেড়ে আসবে ভেবে আর সাহস হোল না। এতটা রাস্তা ওই ভীড়ে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে, নিজের ই শরীরের অবস্থা খারাপ, ভীষন ক্লান্ত লাগছে…একটু বসে জিরিয়ে নি ভেবে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল একটা জলের কল আছে, উঠে গিয়ে জল খেয়ে মাথায় ঘাড়ে জল দিয়ে একটু সুস্থ বোধ হলে ফিরে এসে বসে ভাবছিল…কি করবে…মেয়েটাকে ডাক্তার দেখানো দরকার মনে হচ্ছে, পুলিশের কাছে দিলে তো ফেলে রেখে দেবে অথবা একলা মেয়ে পেয়ে হয়তো আরো কিছু করতে পারে। হসপিটালে নিয়ে গেলেই ভালো ভেবে উঠে পড়ল কিন্তু কি করে স্টেশনের বাইরে নিয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে নারায়ন দার কথা মনে পড়ল। দিদান তো বলেছিল নারায়ন দা অপেক্ষা করবে, কিন্তু নারায়ণ দা তো আর জানে না কোন ট্রেনে ফিরবে…হয়তো ওকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছে পরের কোনো ট্রেনে আসবে আর তাই ভেবে অন্য কোনো প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে। ধুস, কি যে ঝামেলায় পড়লাম ভালোমানুষী করতে গিয়ে ভেবে নিজের উপরই রাগ হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর মেয়েটার দিকে তাকালো… দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ভালো বাড়ীর মেয়ে, মুখটা বেশ মিষ্টি…চেহারাতে বেশ একটা মাধুর্য আছে…দেখে মনে হচ্ছে না কুড়ি বাইশের বেশী বয়স হবে… একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না দেখে কি করবে ভাবতে ভাবতে দেখা যাক একাই নিয়ে যাওয়া যায় কিনা... দু হাতে করে তুলে নিয়ে দেখলো … নাঃ, খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না, জোরে পা চালিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দেখলো একটাই রিকসা দাঁড়িয়ে আছে, যাক বাঁচা গেল, হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে ভেবে ওটার কাছে গিয়ে অনেক টা নিশ্চিন্ত বোধ করল… নারায়ন দার রিক্সা…বুড়ো মানুষটা পাদানিতে বসে ঢুলছে।
ও নারায়ন দা ওঠো…বলে জোরে ডাকতেই নারায়ন দা ধড়পড় করে উঠে পড়ে ওকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল…আরে, এ আবারকে তোমার সাথে?
তুমি আগে একটু ধর, সিটে বসিয়ে দি…
দুজনে মিলে ধরাধরি করে কোনোরকমে সিটে বসিয়ে হুড টা উঠিয়ে দিয়ে ওতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে উঠে মেয়েটাকে ধরে বসে বলল…নারায়ন দা…হসপিটালের দিকে চলো।
আগে তুমি বলোতো…কি ব্যাপার,মেয়েটা কে আর তোমার সাথেই বা কেন।
নারায়ন দা কে ও কখোনোই রিক্সাওয়ালা হিসেবে দেখেনি, কিছুটা গুরুজনের চোখে দেখে বলে… কিছু মনে না করে…সংক্ষেপে সব টা বললে নারায়ন দা বললো হসপিটালে তো নিয়ে যাবে বলছো কিন্তু এখন কি আর ডাক্তার পাবে, সরকারী হাসপাতাল, ওদের আর কি কোনো দায়িত্ব আছে…সারারাত ফেলেই রেখে দেবে। কাল রাতেই তো আমাদের পাড়ার একটা বৌ কে নিয়ে গিয়েছিলাম…বরটা মদ খেয়ে এসে বেদম মার মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল দেখে নিয়ে গেলাম…ভর্তি করা তো দুরের কথা কেউ একবার দেখলো না পর্যন্ত…নাইট ডিউটির ডাক্তার নাকি এসে বেরিয়ে গেছে… জোরজার করাতে বলল…অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। তার থেকে চলো…বাড়ী নিয়ে যাই, বোস ডাক্তার তো তোমার দাদুর বন্ধু, ওনাকে ডাকলে নিশ্চয় না করবেন না। তুমি দাদাভাই একটা কাজ কর বাড়ীতে একটা ফোন করে বল ডাক্তার বাবুকে খবর দিয়ে রাখতে, আমি তোমাদের কে নামিয়ে দিয়ে ওনাকে তুলে নিয়ে আসবো।
ফোন কি আর আছে, ভীড়ের মাঝে তুলে নিয়েছে।
চলো তাহলে আগে বাড়ীর দিকে যাই তারপর দেখা যাবে… বলে নারায়ন দা রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিল। নারায়ন দা খুব সাবধানে চালালেও…মাঝে মাঝে রাস্তা খারাপ, তার উপর মেয়েটার জ্ঞান নেই…ধরে বসে থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল দেখে কোলের উপরে ওর মাথা রেখে শুইয়ে নিতে হল। দিদান এত রাতে না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝেই দেরী হয়…কিন্তু আজ যেন খুব বেশী দেরি হচ্ছে ছেলেটার…তার উপরে আবার ফোনটাও হারিয়ে বসে আছে… ওদের কে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে দুজনে মিলে ধরাধরি করে মেয়েটাকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফাতে শুইয়ে দিল, ততক্ষনে দাদু ও উঠে এসেছে…ওদের কে ঘটনা টা বলতেই দাদু তাড়াতাড়ি করে বোস ডাক্তার কে ফোন করে মোটামুটিভাবে কি হয়েছে বুঝিয়ে দিয়ে আসার জন্য বলে দিলে নারায়ন বেরিয়ে গেল নিয়ে আসার জন্য।
অরিত্র একটু জল খেয়ে নিজেই কফি বানিয়ে নিয়ে এলো, একেই রাত হয়েছে… মেয়েটার জন্য খুব টেনশান হচ্ছে…খারাপ কিছু হয়ে না যায়। ওদিকে দাদু খুব অধৈর্য হয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে দেখে আসছে ডাক্তার এলো কিনা। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে মেয়েটার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে জল খাওয়াবার চেষ্টা করছিল। ততক্ষনে ডাক্তার দাদু পৌছে গিয়েছেন… বেশ কিছুক্ষন দেখে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিলেন প্রথমেই… প্রেশক্রিপসান লিখে দিয়ে নিজেই ব্যাগ থেকে কিছু ওষুধ বের করে বললেন…এখুনি কিছু আনার দরকার নেই…এই ওষুধ গুলো কাল পর্যন্ত চলে যাবে…খুব একটা ভয়ের কিছু নেই, কয়েকদিন হয়তো খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করেনি বা টেনশান করে এই অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাবার মতো কিছু ঘটনা থাকতে পারে। এখন কিছুটা গরম দুধ খাইয়ে দাও, আমি আরো কিছুক্ষন দেখে তারপর যাবো বলাতে শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে দুধ গরম করে নিয়ে এসে চামচে করে একটু একটু করে খাওয়াবার চেষ্টা করল…খুব বেশী না হলেও কিছুটা খাওয়ানো গেল। প্রায় এক ঘন্টা পর বোস দাদু আর একবার সবকিছু দেখে বললেন নাঃ…ঠিক ই আছে, পেশেন্ট রেসপন্স করছে… ভয় পাবার কিছু নেই, আমি কাল সকালে একবার এসে দেখে যাবো। কাল সকালে বরং পুলিশে একটা খবর দেওয়া ভালো… বলা তো যায়না… কোথা থেকে কি হয়ে যায়।
অরিত্রর স্নান করে অল্পছু খেয়ে নিতে নিতে রাত প্রায় চারটে বাজলো। মেয়েটাকে গেস্ট রুমে শুইয়ে দিয়ে ওখানেই শুক্লাদি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। প্রায় সারা রাত অনেক ধকল গেছে বলে সকাল সকাল ওকে আর কেউ ডাকেনি, প্রায় ন টা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গার পর উঠে… আগে গিয়ে মেয়েটা কেমন আছে দেখতে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে আছে…মিষ্টি মুখটাতে ভীষন ক্লান্তির ছাপ…শুক্লাদি জানালো ভোরের দিকে একবার চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে হাত মুখ ধুয়ে চা এর কাপ টা নিয়ে দাদুর কাছে গিয়ে বসে বলল…কি করা যায় বলোতো? পুলিশ কেখবর দেওয়া উচিত মনে হচ্ছে?
দাদু একটু ভেবে বলল…এখন থাক,আগে সুস্থ হোক, নাম ঠিকানা নিয়ে তারপর যা করার করা যাবে। এই অবস্থায় পুলিশে টানা হেঁচড়া করবে…আমার ঠিক ভালো লাগছে না… আমি না হয় একবার তোর বিশ্বাস কাকুর সাথে কথা বলে রাখবো।
বিস্বাস কাকু আবার কে জিজ্ঞেস করাতে দাদু বলল… আরে তুই ভুলে গেলি…আমার বন্ধু সজল বিশ্বাসের ছেলে… বেঙ্গল পুলিশে কাজ করে, এখন কুচবিহারের কোথাও একটা পোস্টিং…খুব শিগরিই নাকি বিধাননগরে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসছে। তোর পাসপোর্ট করানোর সময় অনেক হেল্প করেছিল।
ও আচ্ছা…হ্যাঁ…আমি আসলে খেয়াল করিনি…
তুই আজ অফিস যাবি নাকি?
নাঃ…ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি…যাবো না…
সেই ভালো…মেয়েটার যা অবস্থা…কিছু হলে…আমরা বুড়োবুড়ি সামলাতে পারবো না…
মনে হচ্ছে…আর বাড়াবাড়ি হবেনা…আর ডাক্তার দাদু তো বললোই ভয়ের কিছু নেই।
তা অবশ্য বলেছে… এক কাজ কর দাদুভাই…কিছু খেয়ে একবার গাড়ীটা নিয়ে ডাক্তার কে নিয়ে চলে আয়।
অরিত্র খেয়ে উঠে বেরোতে যাবে এমন সময় নারায়ন দা ডাক্তার বাবুকে নিয়ে এসে হাজির। শুধু নিজে আসেনি, সাথে করে আবার কিছু টাটকা ফল ও নিয়ে এসেছে। দিদান বকাবকি করাতে বলল…আরে নিয়ে এসেছি তো কি হয়েছে, মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। আমার নাতনি টা তো প্রায় ওর ই বয়সী।
দুপুরের একটু আগে মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গল… নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই… ভীষন দূর্বল…কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আর না পেরে চোখ বুজে ফেলল। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে হালকা গরম জল দিয়ে হাতমুখ স্পঞ্জ করে দিয়ে কিছুটা গরম সুপ খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানোর পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পরেরদিন সকাল পর্যন্ত ওইভাবে মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকানো আর তারপরেই আবার ঘুমিয়ে পড়া চলল।দুপুরের পর থেকে মনে হচ্চিল যেন কিছুটা হলেও আগের থেকে ভালো… খুব সামান্য হলেও নড়াচড়া করতে পারছে… কিন্তু চোখের সেই শুন্য দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।
পরের দিন বিকেল, মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো… শরীরটা খুব ভারী লাগছে। বোঝার চেষ্টা করল… কোথায় আছে। কেমন যেন অচেনা লাগছে সবকিছু… কিছুই বুঝতে পারছে না… চিন্তা করতে গেলেই মাথার ভেতরে কেমন যেন একটা যন্ত্রনা শুরু হয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ শুয়ে থাকলে বরং কষ্ট হচ্ছে না…মনে হল কেউ এসে যেন আদর মাখানো গলায় বলছে… এই তো ঘুম ভেঙ্গেছে…কেমন আছো? এখন একটু ভালো লাগছে?
মাথাটা আস্তে আস্তে কাত করে দেখলো… অচেনা কেউ এক মহিলা… সারা মুখে স্নেহ মাখানো…ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে গেল…আমি কোথায়? ঠোঁট দুটো হয়তো একটু নড়ে উঠল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না…আবার বলার চেষ্টা করলো… একই অবস্থা। ও যে চেষ্টা করছে কিছু বলার কিন্তু পারছে না… বুঝতে পেরে ওই মহিলা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল… আচ্ছা…ঠিক আছে…থাক এখন কথা বলতে হবে না… শরীরটা এখোনো দূর্বল… আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওর দু চোখের কোন দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে জল বেরিয়ে আসতে শুরু করল… আমি কেন কথা বলতে পারছি না? আমি কোথায়? তুমি ই বা কে? আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না…চোখ দুটো ভীষন ক্লান্তিতে বুজে এলো।
তারপর দিন সাতেক কেটে গেছে। মেয়েটা অনেক টাই সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু দুর্বলতা বেশ কিছুটা কমলেও পুরোপুরি কাটেনি,শুক্লা দি ওকে নিয়েই থাকে, স্নান করানো থেকে শুরু করে খাইয়ে দেওয়া সব কিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছে। মুশকিল হয়েছে আজ পর্যন্ত একটা কথা বলেনি কিন্তু কিছু বললে বুঝতে পারে। প্রথম প্রথম নিজেকে খুব গুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক টা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, দিদান আর শুক্লাদি কে খুব পছন্দ করে, মাঝে সাঝে অল্প হাসিও দেখা যাছে মুখে কিন্তু বেশির ভাগ সময় কেমন যেন একটা বিষন্ন ভাব…কিছু জিজ্ঞেস করলে ভাবলেষহীন মুখে তাকিয়ে থাকে… ডাক্তারদাদু বলেছেন…হয়তো খুব বড় কিছু শক পেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে…আবার বোবাও হতে পারে… আরো কিছুদিন না গেলে বোঝা যাবে না। অরিত্র দুবেলাই ওকে একবার করে দেখে যাওয়া ছাড়াও সারাদিনে অন্তত এক দুবার অফিস থেকে ফোন করে খোঁজ নেয় কেমন আছে।
আরো কয়েক টা দিন কেটে গেছে, এখন আর সেই দুর্বলতা নেই, মাঝে মাঝে ঘরের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়ায়…কিছু যেন একটা বোঝার চেষ্টা করে। গেস্টরুম থেকে ওকে সরিয়ে এখন দোতলায় অরিত্রর পাশের ঘরটায় রাখা হয়েছে যতটা সম্ভব পাড়া প্রতিবেশীর চোখের আড়াল করতে, সাথে শুক্লাদিকেও ওর সাথে উপরের ঘরে থাকতে হচ্ছে । দিদান ওকে নিজের অনেক দুর সম্পর্কের নাতনী বলে পরিচয় দিয়ে পাড়া প্রতিবেশির কৌতুহল এড়িয়ে গেছে।
একটা সমস্যা তো ছিলই কথা না বলা, তার সাথে এখন যোগ হয়েছে…মাঝে মাঝে রাত্রে কিছু একটা হয়, ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাত ভয় পেয়ে ভীষন ছটপট করে। শুক্লাদি উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কষ্টে ওকে স্বাভাবিক করার পর শুক্লাদি কে জড়ীয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, এক সপ্তাহের ভেতরে দিন তিনেক এরকম হওয়ার পর থেকে এখন শুক্লাদি ওর সাথেই শোয়। ডাক্তার দাদু এখন অনেক টাই নিশ্চিত যে মেয়েটার জীবনে কোনো একটা খারাপ কিছু ঘটেছিল বা ঘটতে যাচ্ছিল যার জেরে মানসিক ধাক্কায় এই অবস্থা।মাঝে একদিন একজন ডাক্তার দাদুর চেনা শোনা একজন কে নিয়ে আসা হয়েছিল যিনি ডিফ এন্ড ডাম্ব কলেজের শিক্ষক। ইশারায় ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ হয়নি, মাথা নেড়ে বুঝিয়েছিল ও কিছুই বুঝতে পারছে না, তার মানে ও বোবা নয়, আগে নিশ্চয় কথা বলতে পারতো, যদি তাই হোতো তাহলে ইশারায় কথা বলার ব্যাপার টা জানা থাকতো। মোটামুটি আরো কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে কলকাতার নাম করা একজন নিউরো আর সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছে। নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করার পর ওনারা বলেছেন… দেখা যাক…এই ওষুধ গুলো খাওয়ান। কি হবে… না হবে… বলা মুশকিল। তবে দেখবেন কোনো রকম মানসিক চাপ যেন না পড়ে।
এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বাস কাকুর সাহায্য নিয়ে লালবাজার আর ভবানী ভবনের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কোলকাতা বা কোলকাতার বাইরে কোনো থানায় হারিয়ে যাবার ডায়েরী করা হয়েছে কিনা কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে খবরের কাগজে বা টিভি তে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওর পরিচিত জনের খোঁজ করার চিন্তাও বাতিল করতে হয়েছে কারন যদি এটা হয় যে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল আর তার জন্য ই ও কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে…যারা ওর খোঁজ পেলে আবার ক্ষতি করতে পারে। এখন ওর থেকে কিছু জানার আগে আর কিছু করা উচিত হবে না ঠিক করে এটাও চেষ্টা করা হয়েছিল ওকে দিয়ে যদি লিখিয়ে জানা যায় ও কে। সে চেষ্টা ও বিফলে গেছে, কিছুই মনে করতে পারে নি…উলটে মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। ডাক্তার বাবুরা কোনো রকম মানসিক চাপ দিতে বারন করেছিলেন বলে খুব বেশী চেষ্টা ও করা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস কাকুর ভরসায় পুলিশে খবর দেবার ব্যাপার টা নিয়ে এই মূর্হুতে তাই আর ভাবা হচ্ছিল না। তেমন কিছু যদি প্রয়োজন হয় তাহলে বলা যাবে যা কিছু করা হয়েছে তা নিতান্তই মানবিকতার কারনে…এর মধ্যে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
এক সাথেথাকতে থাকতে কবে যে মেয়েটা ওদের বাড়ীরই একজন হয়ে গেছে বোঝা যায়নি। কোন নাম নেই তাইদিদান ওর নাম রাখতে চেয়েছিল অনামিকা, যদি কোনোদিন ওর নিজের নাম জানা যায় সেদিন না হয়ওই নামে ডাকা যাবে কিন্তু এখন তো কিছু একটা বলে ডাকতে হবে। দাদু রাজী হয়নি, এত মিষ্টিমেয়ের নাম মধুমিতা ছাড়া আর কিছু নাকি হওয়া উচিত নয়…দুজনের কেউ কারুর কথা শুনতে রাজীনয়…শেষে অরিত্র র কথায় মৌ নাম রাখতে দুজনেই রাজী হয়েছে…কেউ ই নাতির কথা ফেলতে পারেনি।এখন মৌ বলে ডাকলে ও সাড়া দেয়, হয়তো বুঝেছে ওটাই ওর নাম।
কোনো এক রবিবার দুপুরে খাওয়ার পর অরিত্র ওর ঘরে প্রিয় কতগুলো রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। কি মনে করে দরজার দিকে তাকিয়ে মনে হল পর্দার ওদিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কে হতে পারে? দিদান বা শুক্লাদি হলে তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না আর ওদের তো এখন বিশ্রাম করার সময় ভেবে উঠে এসে দেখে মৌ চুপ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে, মনে হয় গানের কলি গুলো নিজেই গাওয়ার চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে ওর এক মনে গান শোনা দেখে ভীষন ভালো লাগছিল ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে। গান টা শেষ হলে মৌ তাকিয়ে সামনে অরিত্র কে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিলে অরিত্র ওকে ঘরের ভেতরে আসতে বলে পর্দা টা সরিয়ে দিল।ভেতরে আসতে চাইছিল না দেখে অরিত্র ওর হাত ধরে ভেতরে গিয়ে সোফাতে বসতে বলে একটু দুরে নিজেও বসে জিজ্ঞেস করল… তোমার গান শুনতে ভালো লাগছে?…তাই না? প্রথম প্রথম আপনি দিয়ে কথা বলতো …কিন্তু ওর যেন পছন্দ হয়নি…মাথা নেড়ে আপত্তি জানানোয় তুমি করে বলতে খুব খুশি হয়েছিল দেখে তারপর থেকে তুমি টাই চলছিল।
মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…
ঠিক আছে…তুমি এখানে বসে শোনো…আমি ছাদে যাচ্ছি… বেশ কয়েকদিন গাছ গুলো কেমন আছে দেখা হয়নি…
মাথা নেড়ে জানালো…না…
কেন? এখন ইচ্ছে করছে না শুনতে?
হ্যাঁ…
তাহলে?
মৌ উঠে গিয়ে বিছানা থেকে বই টা হাতে নিয়ে দেখালো…অরিত্রর বই পড়া ছেড়ে ছাদে যেতে হবে না।
ও আচ্ছা…আমি ছাদে যাবো না…তাইতো?
একটা মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…তাই…
ঠিক আছে আমি যাবো না…তুমি এখানে বোসো…আমিও বসছি…আমার পরে পড়লেও হবে।
মৌ প্রায় দিন দুপুরে অরিত্রর ঘরে বসে নিচু আওয়াজে গান শোনে…অবশ্য রবিবার টা বাদ দিয়ে কারন ওই দিন অরিত্র বাড়ীতে থাকে। ও আসার পর থেকে বাড়ীর সবার ছকে বাঁধা জীবন টা যেন এক ধাক্কায় একেবারে পালটে গেছে। শুধু শুক্লাদি নয়, দিদান আর দাদু দুজনেরই অনেক টা সময় ওর সাথে কাটে…অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক তৈরী হয়ে উঠেছে। কথা না বলতে পারা বা বয়সের একটা বিশাল ফারাক কোনো বাধা হতে পারেনি সেই সম্পর্কে। সবারই যেন কেমন মায়া পড়ে গেছে ওর উপরে। অরিত্রর অফিস বেরোবার সময়ে ও দিদানের সাথে থাকে,দিদান যখন রোজকার মতো সাবধানে যাবি, দেরী হলে জানিয়ে দিবি বলে, পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে মৌ ওকে বিদায় জানায়। আজকাল অফিস বেরোবার সময়ে ওর ওই মিষ্টি হাসি টা দেখতে পাবে ভেবেই যেন অফিস বেরোতে ইচ্চে করে…অফিস থেকে ফিরতে কোনোদিন দেরী হলে খুব অস্থির হয়ে পড়ে, বারবার দিদানের কাছে গিয়ে জানার চেষ্টা করে কখন ফিরবে। বেশ কয়েকদিন দেরি করে ফেরার সময় রিকশা থেকে নেমে দেখেছে ওর ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, ওকে দেখতে পেলেই তাড়াতাড়ি নেমে আসে নিচে, সারা মুখে একটু যেন বকুনি দেবার ইচ্ছে…কেন তুমি দেরী করলে? এর মাঝে আবার একদিন ট্রেনের গন্ডগোলে অনেক রাত হয়েছিল ফিরতে, বাড়ীতে ফোন করে জানাতে জানাতে অনেক টা দেরী হয়ে গিয়েছিল। দিদানের কাছে শুনলো…ও নাকি অরিত্রর ফোন আসার আগে দিদান কে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে…গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোলেও চোখের জল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কতটা কষ্ট পেয়েছে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি দিদান ওকে জোর করে শুতে পাঠিয়েছে না হলে সারাক্ষন নিচেই বসে ছিল। অরিত্র খেয়ে উপরে ওঠার সময় দেখলো মৌ ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে,সামনে গিয়ে দেরী হয়ে গেল বলাতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো…ওর যে ভীষন অভিমান হয়েছে বোঝাবার আর তো কোনো উপায় ছিল না। অরিত্র ওর হাত ধরে ঘরের ভেতরে গিয়ে বলল…সত্যি ভুল হয়ে গেছে…আর হবে না…এবার থেকে দেরী হলে আগেই জানিয়ে দেবো…কিছুতেই ওর দিকে তাকাচ্ছেনা দেখে অরিত্র ওর কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলল…এই…তাকাও আমার দিকে…। তাতেও তাকালো না দেখে ওর মুখ টা তুলে ধরে দেখলো…দু চোখে কান্নার আভাস। নিজের হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল…এই…তাকাবে না আমার দিকে? আস্তে আস্তে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো…খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল…এই তো আমি এসে গেছি…এখোনো…অভিমান করে থাকবে? ছোট্ট একটা নিস্বাস ফেলে কান্না ভরা চোখে নরম একটা হাসি মুখে নিয়ে বোঝালো…নাঃ…আমি আর অভিমান করে নেই…কিন্তু তুমি আর কখোনো আমাকে কষ্ট দেবে না। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু না বলে…চোখের ভাষাতে হয়তো দুজনেই বুঝে নেবার চেষ্টা করছিল অন্যের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অজানা কথা গুলো।