06-06-2020, 12:02 AM
কালু আমাদের বাড়িতে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে প্রায় মাস দুয়েক হলো । হ্যাঁ ওর নাম দেয়া হয়েছে কালু । নামটি দিয়েছেন আব্বা । মায়ের অবশ্য এই নাম পছন্দ হয়নি একদম । কিন্তু ওকে কালু ছাড়া অন্য নামে ডাকলে কোন সাড়া দেয়না । সুধু কালু বলে ডাকলেই দাঁত বের করে হাজির হয় । আর কি বিচ্ছিরি সেই দাঁত দেখলেই বমি পায় ।
প্রথম প্রথম আব্বা বিরক্ত হলেও এখন কালু ছাড়া ওনার সকাল শুরু হয়না । আব্বা আর আম্মা ছাড়া অন্য কোন কথা না বলতে পারা এই অসুন্দর ছেলেটি আব্বার ডান হাত হয়ে উঠেছে । আর কালু আসার পর আব্বা ও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ে হাঁটা হাটি করতে তখন আব্বার সঙ্গী কালু । বিকেলে পুকুরে মাছ ধরা দেখাশুনা করতে যায় আব্বা তখনো আব্বার সঙ্গী কালু । সন্ধ্যার পর বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আরাম করার সময় ও আব্বার সঙ্গী কালু । আব্বার পায়ের আঙুল টেনে দেয়া পায়ের তেল মালিস করাই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আনন্দের কাজ অন্তত কালু কে দেখলে তাই মনে হতো । হ্যারিকেন এর আলোয় কালুর কালো মিশমিশে শরীর দেখা যেত না সুধু দাঁত গুলি দেখা যেত তখন ।
সকাল দুপুর আর সন্ধ্যে টা আব্বার সাথে কাটালেও কালুর সারাদিন কাটতো মায়ের সাথে । মনে হচ্ছিলো রহিমার চাকরি আর মনে হয় বেসিদিন থাকবে না এই বাড়িতে । এমনিতে ও রহিমার বেশ বয়স হয়েছিলো এই বাড়িতে কাজের মানুষ হিসেবে থাকলেও বেশিরভাগ কাজ মা ই করতো । আগের দিনের গেরস্থ বাড়িতে বাড়ির বউরাই নিজেদের কাজ নিজেরা করতো সে যত বড় গেরস্থ ই হোক না কেন ।
মায়ের সব কাজ কালুই করে দিত , এই নিয়ে রহিমা প্রায় মজা করে বলতো “ আমার কপাল থেকে মনেহয় এই বাড়ির ভাত উঠে যাচ্ছে “ ।
আমি অবশ্য কালুর সাথে বেশি ঘেঁষতাম না । কেমন জানি একটা ভয় কাজ করতো আমার সাথে হিংসে । অবশ্য কালু খেতে বসলে দূর থেকে দেখতাম । কালু কখনো আমাদের সাথে খতে বসতো না । সবার খাওয়া হয়ে গেলে তারপর ওকে খেতে দেয়া হতো । মা কত বলেছে ওকে আমাদের সাথে খেতে বসতে কিন্তু কিছুতেই রাজি করান যায়নি । একাই চার পাঁচ জনের ভাত খেয়ে ফেলত কালু । সুধু ভাত হলেই হতো ওর তরকারী দরকার পড়তো না । আর সেই খাওয়া ও ছিলো দেখার মতো । বিশাল বিশাল গ্রাস তুলত মুখে । তারপর কিছুক্ষন চিবিয়ে গিলে ফেলত । কালু খাওয়ার সময় মা সবসময় ওর সামনে থাকতো পাছে রহিমা ওকে কম ভাত দেয় সেই কারনে । কালু কে এক থালা ভাত দিলে ও নিমেষে শেষ করে থালা টা মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতো “ আম্মা “ আর মা হেঁসে ওকে আরও ভাত দিত ।
“ কি করছ আয়শা ও তো আমার ধানের গোলা সবার করে ফেলবে “ আব্বার এই অভিযোগ গুলো ও ছিলো কৌতুক পূর্ণ । আমার বাবা মায়ের একটা অল্প পরিচিত অনাহুত একটি ছেলের প্রতি এমন দরদ দেখে আমি বেশ অবাক হতাম । মনে মনে ভাবতাম কালু কি এমন জাদু করেছে ওদের । নিজের ছেলের চাইতেও এই অনাহুত অসুন্দর ছেলেটির সাথে ওদের আচরন অনেক সহজ অনেক আপন ।
প্রায় মাকে দেখতাম কাজ করতে করতে কালুর সাথে হেঁসে গল্প করছে । দুটি শব্দ ছাড়া অন্য কোন কথা উচ্চারন করতে না পারা কালুর সাথে গল্প করে কি মজা সেটা আমি বুঝতাম না । না এমন ছিল না যে মা আমার সাথে সময় কাটাত না । সারাদিন কাজের ফাঁকে সময় মতোই আমার খোঁজ নিতো । প্র্যজনিয়তা পুরন করতো । কিন্তু মন খুলে গল্প করা সেটা কোনদিন হয়ে ওঠেনি । অবশ্য মায়ের সাথে যে গল্প করা যায় সেটাই কোনদিন আমার মাথেয় আসেনি । কিন্তু কালু কে দেখে এখন অবশ্য আমার সেই ইচ্ছে হয় । একদিন এর ঘটনা বলি ।
মা রান্না করছিলো আর সেদিন রহিমার শরীর খারাপ ছিল । তাইসব কিছু মা কে একাই করতে হচ্ছিলো । আমি সেদিন বাড়িতেই ছিলাম । গ্রামের অন্য ছেলেদের মতো ডানপিটে ছিলাম না আমি তাই বারান্দায় বসে একটি কি খেলনা নিয়ে যেন খেলছিলাম । রান্না ঘর থেকে চাপ কল বেশ দূরে হওয়ায় মা কে কিছক্ষন পর পর পানি নিয়ে আসতে হচ্ছিলো । আমি দেখছিলাম আর মনে মনে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু পানি টা যে আমিও এনে দিতে পারি সেই চিন্তাই আমার মাথায় আসেনি । অবশ্য অতো বড় কলসি আমি নিতেও পারতাম না । এমন সময় কালু চলে এলো । দেখলাম ওর হাতে দুটো ঝুনা নারকেল । এসেই হাঙ্গামা শুরু করে দিলো কালু । পুরো বাড়ি মাথায় করে নিলো একটি শব্দে “ আম্মা “ “আম্মা” । মা তখন চাপ কলে চাপ দিয়ে পানি তুলছিল । কালু এসেই মা কে সরিয়ে নিজে চেপে পানি ভরে কলসি এক হাটে উঠিয়ে রান্না ঘরে নিয়ে দিলো ।
মা সে কি খুশি । কালুর কোঁকড়ান চুল গুলি হাতে নেড়ে দিয়ে বলছিল “ তোর মা ছোট বেলা থেকেই এইসব কাজ করে অভস্থ” কিন্তু কালু মানতে নারাজ । হাত নেড়ে মা কে কোন সময় ভারি কিছু করতে নিষেধ করছে । তারপর মা যতক্ষণ রান্না করলো ততক্ষন কালু বসে রইলো মায়ের সাথে । এটা ওটা করে দিচ্ছে । এর ফাঁকে মা যেন কি সব কথা বলছে ওই বোবাটার সাথে । সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিলো , আমিও কি পারতাম না মায়ের কলসি ভরে দিতে মায়ের সাথে রান্না ঘরে বসে কথা বলতে । মা হাসিমুখে আমার চুল গুলি এলোমেলো করে দিয়ে আহ্লাদ করে বলতো “ ইস আমার ছেলে কত্ত কাজের মায়ের সব কাজ করে দেয় “ । আমি কি নিজেই মায়ের ওই ঘনিষ্ঠতা ত্যাগ করছি এমন একটা চিন্তা আমার মাথেয় এসেছিলো । জেদ চেপে গিয়েছিলো মাথায় , জেদ মনে হয় আমার নিজের উপর ই হয়েছিলো , কিন্তু ঝারতে গিয়েছিলাম মায়ের উপরে । রান্না ঘরের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাস করেছিলাম “ আর কত সময় লাগবে রান্না হতে ? আমার কি খিদে লাগে না বসে বসে হাসা হাসি করলে কি কাজ হয় ?”
আমার এই রাগের কথা গুলি শুনে মা হেঁসে বলেছিল “ ইস আমার শ্বশুর সাহেব এসেছে , মাত্র তো এগারোটা বাজে এখনি খিদে পেয়ে গেলো “ মায়ের ঘর্মাক্ত মুখের সেই মিষ্টি হাসি আমার কাছে লেগেছিল বিষের মতো । মনে মনে এমন একটা বাক্য খুজছিলাম যেটা মাকে অনেক কষ্ট দেবে । “ আমি তো তোমার ছেলে না ওই কালু বোবাই তোমার ছেলে যাও খাওয়াও তোমার বোবা কুচ্ছিত ছেলেকে “ সেই কচি বয়সে এই বাক্যটি ই খুজে পেয়েছিলাম মা এর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। মনে করেছিলাম খুব একটি মোক্ষম আঘাত করেছি । কিন্তু অচিরেই আমার করা আঘাত আমার শরীরে এসে লাগলো যখন দেখলাম । আমার বলা সেই বিষ বাক্য মা কে স্পর্শ ই করলো না উল্টো হেঁসে লুটোপুটি খেতে লাগলো । আর বলল “পাগল ছেলে বলে কি “ অন্য আরও অনেক সময় মা আমাকে পাগল বলেছে আমি কিছুই মনে করিনি কিন্তু অইদিন কালুর সামনে পাগল বলায় আমার কাছে এমন লজ্জা আর অপমান লেগেছিল যে মনে হচ্ছিলো আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে । আর কালু ও দাঁত বের করে “ আম্মা “ বলে মায়ের কথায় সায় দিয়ছিল । রাগে অপমানে আমি বলে ছিলাম “ আমি পাগল না তোর ওই কালু পাগল , থাক তুই কালু পাগলা কে নিয়ে “ দৌরে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে । পেছন থেকে মায়ের শত ডাক ও কানে তুলিনি । ইচ্ছা ছিল আর বাড়িতে ফিরবনা ।
কিন্তু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলাম আর এক বিপদে , সময় কাটছিল না কিছুতেই । এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে রোদে ক্লান্ত হয়ে শেষে আমাদের বাড়ির পেছনে একটি মজা পুকুরের ঝপের আড়ালে বসে ছিলাম । কিছুক্ষন বসে থেকেই শুরু অয়েছিল অনুতাপ , ছোট বেলার আবছা সৃতি গুলি মনে পড়ছিল খুব । যখন আমি মায়ের সাথেই থাকতাম সব সময় আমাকে নিয়ে করা মায়ের আহ্লাদ গুলি মনে পড়ছিল খুব । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই । ঘুম ভেঙ্গে ছিল ঘেমো একটা গন্ধে । সেই গন্ধ কালুর এতো সাবান পানি সব বিফলে গিয়েছে কালুর এই ঘেমো গন্ধের কাছে । কি তীব্র সেই গন্ধ আমার তো মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে । কালু আমাকে পাজকোল করে উঠিয়ে বাড়ির দিকে দৌর দিলো । আমার চেয়ে কালুর বয়স খুব বেশি হবে না বড় জ্বর ২-৩ বছরের বড় । আর লম্বায় ও বেশ খাটো কি করে যে আমার মতো একটা ছেলেকে এমন করে কোলে নিয়ে দৌরে যাচ্ছে সেটা ভেবে ও অবাক হলাম খুব । আর এই অবাক হওয়ার পড়বো শেষ হলে এলো রাগ , যার জন্য রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম সেই এখন আমাকে আমার ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে এমন অসহায় অবস্থায় কোলে ফেলে জোড় করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে । প্রচণ্ড অভিমান হলো আর সাথে রাগ , রাগে কান্না চলে এলো । আঁচরে কামড়ে দিতে লাগলাম কালু কে । কিন্তু কালুর শরীর যেন পাথর এর । আমার নখ ওর চামড়া ভেদ করতে পারছে না কিছুতেই ।
তীব্র ঘামের গন্ধ সাথে চেঁচিয়ে কান্না করা আর হাত পা ছোরা এই সব মিলে ক্লান্ত হয়ে গেলাম । কিন্তু কালু দামড়া টার কোন ক্লান্তি নেই আমাকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর আমি ওর কোলে অপমানজনক ভাবে লেং ছেড়ে পড়ে আছি । আশপাশ থেকে কয়েকটা তির্যক উক্তি ও শুনতে পেলাম । এতে আমার রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিলো ।
বাড়িতে এনেই কালু আম্মা আম্মা বলে চেচাতে লাগলো কিছুতেই আমাকে কোল থেকে নামাচ্ছে না । কালুর চেঁচামেচি শুনে মা বেড়িয়ে এলো । আমাকে দেখেই জিজ্ঞাস কলো কোথায় পেলি । কালু উত্তর দিলো আমাকে কোল থেকে ধপাস করে মায়ের পায়ের নিচে ফেলে দিয়ে সাথে ওর বোবা মুখে সেই আম্মা বোল । কি ভয়ানক উত্তর , ধপাস করে মাটিতে পড়ে ভীষণ ব্যাথা পেলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না ।
ওকে এমন করে ফেললি কেন রে বোকা ছেলে , ভাই ব্যাথা পাবে না ? এই বলে মা আমাকে টেনে তুলে দাঁর করিয়ে দিলো । তারপর আমার চিবুক ধরে একটু উচু করে হাসি মখে বলল । পাগল ছেলে আমার অমন করে কেউ বেড়িয়ে যায় কখনো আর মায়ের মনে কি দুঃখ দিতে আছে । কিন্তু মায়ের অমন মিষ্টি কথাও আমার মনে দাগ কাটল না , কালু যে এভাবে আমাকে ফেলে দিলো তার জন্য মা ওকে কিছুই বলল না এটা ভেবে আমার রাগ আরও বেড়ে গেলো । আমি এক ঝটকায় মায়ের হাত আমার চিবুক থেকে সরিয়ে এক দৌড়ে আমার দোতলার ঘরে চলে গেলাম ।
কিছুক্ষন পর মা ঢুকল আমার ঘরে । হাসিমুখ আর হাতে খাবার এর থালা । পেটে টান অনুভব করলাম খাবার এর গন্ধ নাকে যেতেই । কিন্তু মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম জানালার দিকে । খোকন সোনা চাঁদের কোণা রাগ করেনা , এই বলে আম্মু আমার মুখটা নিজের দিকে করার চেষ্টা করলো । কিন্তু ছোট বেলার প্রিয় আদুরে বোল ও আমার রাগ ভাঙ্গাতে পারলো না । বরং রাগ যেন বেড়ে গেলো । আমি কেঁদেই ফেললাম রাগের কারনে । এই দেখে আম্মু খাবার এর থালা রেখে দু হাতে আমার মুখটা দুপাশ থেকে ধরে নিজের দিকে করলো ।
ছিঃ তুই কাদছিস কেন ? তুই তো আমার ভালো ছেলে লক্ষি ছেলে
কিন্তু মায়ের মন ভুলানো কথা গুলি আমার উপর কোন প্রভাব ফেললো না উল্টো আমার কান্নার দমক বেড়ে গেলো । কান্নার তিব্রতায় আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো । হেঁচকি উঠে যাচ্ছে কান্নার কারনে । মা আমার মাথা বুকে টেনে নিলেন। অনেক্ষন মায়ের বুকে মাথা রেখে একটু শান্তি পেলাম । কান্না একটু চেপে এলো । তখন মা আমাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে বলল এই তো লক্ষি ছেলে নে এবার খেয়ে নে অনেক বেলা হলো তোর জন্য ইলিশ মাছের ডিম ভেজে রেখেছি।
আমিও খাওয়া শুরু করলাম । মা আমাকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে । অনেকদিন পর মায়ের হাতে খেলাম । একটু পর খেয়াল করলাম কালু দাড়িয়ে আছে দরজায় , হলদে দাঁত বের করে । আমি ভাত মুখে নিয়েই মা কে বললাম ওকে ওর দাঁত লুকিয়ে রাখতে আমার বমি পায় । মা হেঁসে কালু কে ডাকল , এই কালু এদিকে আয় ।
আম্মা আম্মা করে হাজির কালু । এখনো নোংরা দাঁত গুলি বের করে রেখেছে । আমি কোনরকম মুখের ভাত গুলি গিলে ফেললাম । মা কালুর একটি হাত ধরে বলল এই কালু শোন এটা হচ্ছে তোর ছোট ভাই , একে কখনো কষ্ট দিবি না বুঝলি।কালু মাথা নেড়ে সায় দিলো সাথে নোংরা দাঁতের বিটকেলে হাসি । মা আবারো ওর হাত ঝাকি মেরে বলল বুঝেছিস তো আমার কথা । কালু এবার বলল আম্মা । এর মানে ও ঠিক মতো বুঝেছে । ইস মা ওকে সহ্য করে কি করে , আমি একটু দূরে বসা এখান থেকেই ওর ঘেমো গন্ধ পাচ্ছি ।
মা আমার মুখে আর এক বার ভাত তুলে দিয়ে বলল , বুঝলি অপু , কালু হচ্ছে তোর হাতের লাঠি , তোর কোন বিপদ আপদ এলে দেখবি কালু ই সবার প্রথম ঝাপিয়ে পড়বে । তারপর কালুর দিকে তাকিয়ে বলল কিরে কালু ভাই কে দেখবি না । কালু জবাব দিলো আম্মা । কি আম্মা আম্মা করছিস , বোল তো অপু তোর কি হয় ।
কালুর উত্তর এলো আম্মা । সাথে সাথে আম্মু হেঁসে ফেললো , প্রান খোলা হাসি । এমন হাসি আম্মু কে আগে আমি খুব কম ই হাসতে দেখেছি । আমারও হাসি পেয়ে গেলো ।
আসলে আমি এখন বুঝতে পারি মা কালুর সঙ্গে কেন এতো মিশত । আসলে মা নিঃসঙ্গ ছিলো । বাড়িতে আর কোন মেয়ে ও ছিলো যার সাথে মা সময় পাড় করবে দুটো কথা বলবে । আমি তো সারাক্ষণ পড়াশুনা বা খেলা ধুলা নিয়ে থাকতাম । যতক্ষণ সময় আমার জন্য মা কে দরকার ঠিক ততটাই সময় আমি মায়ের সাথে ব্যায় করতাম । এখন কার সময় এর স্বামী স্ত্রীর মতো আগের দিনের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোয়ালিটি টাইম বলতে কোন কথা ছিলো না । স্বামীদের সান্নিধ্য স্ত্রীরা সুধু রাতে শোয়ার সময় ই পেত । আর কালু ছিলো একজন আদর্শ স্রোতা , মা এমনসব কথাও কালুর সাথে বলতো যা ঠিক কালুর সাথে বলার কথা না ।
একদিন এর কথা বলি
মা দুপুর এর খাওয়া শেষে না ঘুমিয়ে পুকুর ঘাটে ছিপ নিয়ে বসে আছে আর কালু ও সাথে বসা । মা প্রায় ই দুপুর বেলা এমন করতো । আমার কি একটা প্রয়োজনে যেন আমি মা কে খুজছিলাম । খুজতে খুজতে পুকুর ঘাটে চলে এলাম । দেখি দুজনে খুব হাসা হাসি । তখনো কালুর প্রতি হিংসে আমার পুরো পুরি কাটেনি । কি নিয়ে এতো হাসা হাসি সেটা জানার খুব ইচ্ছে হলো আমি চুপি চুপি ওদের পেছনে ঘাপটি মেরে রইলাম ।
তোর আব্বার অনেক সখ ছিলো অনেক গুলি ছেলেপুলে হবে রে কালু , কিন্তু আমার পেটে যে কি পাথর আছে এতো চেষ্টার পর ও কিচ্ছু হচ্ছে না । এতো করে বললাম আর একটা বিয়ে করেন , কিছুতেই করলো না , আমাকে কি বলে জানিস ।
কালু বলল আম্মা
ধুর পাগল খালি আম্মা আম্মা করিস কেন , আর কিছু শিখতে পারিস না ।
এবার কালু বলল আব্বা , মা জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো , আর বলল
বুঝেছি বুঝেছি তুই খুব পারিস । শোন তোর আব্বা কি বলে তাকে আর একটা বিয়ের কথা বললে । বলে শোন আয়শা তুমি আর কোনদিন আর একটা বিয়ের কথা বলবে না , যদি বলো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো , তুমি কি মনে করো পীর সাহেব বলছে এই জন্য আমি বিয়ে করি না , এতো দিনেও আমাকে চিনলে না , কি রাগ যে করে তোর আব্বা , সেই রাগ ভাঙ্গাতে আমার রাত পাড় হয়ে যায় । আমার অবশ্য এতো ছেলে পুলে ভালো লাগে না বেশি ছেলে হলে ওই আমেনা আপার মতো মটকি হয়ে যাবো । এই বলে মায়ের আবার হাসি , এতো খোলা হাসি সুধু আমি মা কে কালুর সাথেই হাসতে দেখতাম । তবে সেই হাসি ধীরে ধীরে কেমন যেন একটা বিষাদ মাখা রূপ নিলো । তারপর একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
শোন কালু তুই আমার বড় ছেলে , তুই ই তোর আব্বার হাতের লাঠি হবি ভাই এর ছায়া হবি । বুঝলি আমার আর ছেলে পুলের দরকার নেই ।
আমি সেদিন আমার দরকার এর কথা না বলেই চলে এসেছিলাম । একটু অভিমান হয়েছিলো মায়ের উপর আমাকে কালুর চেয়ে দুর্বল ভাবার কারনে । তবে এখন বুঝতে পারি মা আমার কথা ভেবেই অমনটা বলেছিলো । আসলেই আমি দুর্বল প্রকিতির লোক । আর কালুকে আমার ও খুব প্রয়োজন এটা বুঝতে বেসিদিন সময় লাগেনি আমারও ।
প্রথম প্রথম আব্বা বিরক্ত হলেও এখন কালু ছাড়া ওনার সকাল শুরু হয়না । আব্বা আর আম্মা ছাড়া অন্য কোন কথা না বলতে পারা এই অসুন্দর ছেলেটি আব্বার ডান হাত হয়ে উঠেছে । আর কালু আসার পর আব্বা ও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ে হাঁটা হাটি করতে তখন আব্বার সঙ্গী কালু । বিকেলে পুকুরে মাছ ধরা দেখাশুনা করতে যায় আব্বা তখনো আব্বার সঙ্গী কালু । সন্ধ্যার পর বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আরাম করার সময় ও আব্বার সঙ্গী কালু । আব্বার পায়ের আঙুল টেনে দেয়া পায়ের তেল মালিস করাই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আনন্দের কাজ অন্তত কালু কে দেখলে তাই মনে হতো । হ্যারিকেন এর আলোয় কালুর কালো মিশমিশে শরীর দেখা যেত না সুধু দাঁত গুলি দেখা যেত তখন ।
সকাল দুপুর আর সন্ধ্যে টা আব্বার সাথে কাটালেও কালুর সারাদিন কাটতো মায়ের সাথে । মনে হচ্ছিলো রহিমার চাকরি আর মনে হয় বেসিদিন থাকবে না এই বাড়িতে । এমনিতে ও রহিমার বেশ বয়স হয়েছিলো এই বাড়িতে কাজের মানুষ হিসেবে থাকলেও বেশিরভাগ কাজ মা ই করতো । আগের দিনের গেরস্থ বাড়িতে বাড়ির বউরাই নিজেদের কাজ নিজেরা করতো সে যত বড় গেরস্থ ই হোক না কেন ।
মায়ের সব কাজ কালুই করে দিত , এই নিয়ে রহিমা প্রায় মজা করে বলতো “ আমার কপাল থেকে মনেহয় এই বাড়ির ভাত উঠে যাচ্ছে “ ।
আমি অবশ্য কালুর সাথে বেশি ঘেঁষতাম না । কেমন জানি একটা ভয় কাজ করতো আমার সাথে হিংসে । অবশ্য কালু খেতে বসলে দূর থেকে দেখতাম । কালু কখনো আমাদের সাথে খতে বসতো না । সবার খাওয়া হয়ে গেলে তারপর ওকে খেতে দেয়া হতো । মা কত বলেছে ওকে আমাদের সাথে খেতে বসতে কিন্তু কিছুতেই রাজি করান যায়নি । একাই চার পাঁচ জনের ভাত খেয়ে ফেলত কালু । সুধু ভাত হলেই হতো ওর তরকারী দরকার পড়তো না । আর সেই খাওয়া ও ছিলো দেখার মতো । বিশাল বিশাল গ্রাস তুলত মুখে । তারপর কিছুক্ষন চিবিয়ে গিলে ফেলত । কালু খাওয়ার সময় মা সবসময় ওর সামনে থাকতো পাছে রহিমা ওকে কম ভাত দেয় সেই কারনে । কালু কে এক থালা ভাত দিলে ও নিমেষে শেষ করে থালা টা মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতো “ আম্মা “ আর মা হেঁসে ওকে আরও ভাত দিত ।
“ কি করছ আয়শা ও তো আমার ধানের গোলা সবার করে ফেলবে “ আব্বার এই অভিযোগ গুলো ও ছিলো কৌতুক পূর্ণ । আমার বাবা মায়ের একটা অল্প পরিচিত অনাহুত একটি ছেলের প্রতি এমন দরদ দেখে আমি বেশ অবাক হতাম । মনে মনে ভাবতাম কালু কি এমন জাদু করেছে ওদের । নিজের ছেলের চাইতেও এই অনাহুত অসুন্দর ছেলেটির সাথে ওদের আচরন অনেক সহজ অনেক আপন ।
প্রায় মাকে দেখতাম কাজ করতে করতে কালুর সাথে হেঁসে গল্প করছে । দুটি শব্দ ছাড়া অন্য কোন কথা উচ্চারন করতে না পারা কালুর সাথে গল্প করে কি মজা সেটা আমি বুঝতাম না । না এমন ছিল না যে মা আমার সাথে সময় কাটাত না । সারাদিন কাজের ফাঁকে সময় মতোই আমার খোঁজ নিতো । প্র্যজনিয়তা পুরন করতো । কিন্তু মন খুলে গল্প করা সেটা কোনদিন হয়ে ওঠেনি । অবশ্য মায়ের সাথে যে গল্প করা যায় সেটাই কোনদিন আমার মাথেয় আসেনি । কিন্তু কালু কে দেখে এখন অবশ্য আমার সেই ইচ্ছে হয় । একদিন এর ঘটনা বলি ।
মা রান্না করছিলো আর সেদিন রহিমার শরীর খারাপ ছিল । তাইসব কিছু মা কে একাই করতে হচ্ছিলো । আমি সেদিন বাড়িতেই ছিলাম । গ্রামের অন্য ছেলেদের মতো ডানপিটে ছিলাম না আমি তাই বারান্দায় বসে একটি কি খেলনা নিয়ে যেন খেলছিলাম । রান্না ঘর থেকে চাপ কল বেশ দূরে হওয়ায় মা কে কিছক্ষন পর পর পানি নিয়ে আসতে হচ্ছিলো । আমি দেখছিলাম আর মনে মনে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু পানি টা যে আমিও এনে দিতে পারি সেই চিন্তাই আমার মাথায় আসেনি । অবশ্য অতো বড় কলসি আমি নিতেও পারতাম না । এমন সময় কালু চলে এলো । দেখলাম ওর হাতে দুটো ঝুনা নারকেল । এসেই হাঙ্গামা শুরু করে দিলো কালু । পুরো বাড়ি মাথায় করে নিলো একটি শব্দে “ আম্মা “ “আম্মা” । মা তখন চাপ কলে চাপ দিয়ে পানি তুলছিল । কালু এসেই মা কে সরিয়ে নিজে চেপে পানি ভরে কলসি এক হাটে উঠিয়ে রান্না ঘরে নিয়ে দিলো ।
মা সে কি খুশি । কালুর কোঁকড়ান চুল গুলি হাতে নেড়ে দিয়ে বলছিল “ তোর মা ছোট বেলা থেকেই এইসব কাজ করে অভস্থ” কিন্তু কালু মানতে নারাজ । হাত নেড়ে মা কে কোন সময় ভারি কিছু করতে নিষেধ করছে । তারপর মা যতক্ষণ রান্না করলো ততক্ষন কালু বসে রইলো মায়ের সাথে । এটা ওটা করে দিচ্ছে । এর ফাঁকে মা যেন কি সব কথা বলছে ওই বোবাটার সাথে । সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিলো , আমিও কি পারতাম না মায়ের কলসি ভরে দিতে মায়ের সাথে রান্না ঘরে বসে কথা বলতে । মা হাসিমুখে আমার চুল গুলি এলোমেলো করে দিয়ে আহ্লাদ করে বলতো “ ইস আমার ছেলে কত্ত কাজের মায়ের সব কাজ করে দেয় “ । আমি কি নিজেই মায়ের ওই ঘনিষ্ঠতা ত্যাগ করছি এমন একটা চিন্তা আমার মাথেয় এসেছিলো । জেদ চেপে গিয়েছিলো মাথায় , জেদ মনে হয় আমার নিজের উপর ই হয়েছিলো , কিন্তু ঝারতে গিয়েছিলাম মায়ের উপরে । রান্না ঘরের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাস করেছিলাম “ আর কত সময় লাগবে রান্না হতে ? আমার কি খিদে লাগে না বসে বসে হাসা হাসি করলে কি কাজ হয় ?”
আমার এই রাগের কথা গুলি শুনে মা হেঁসে বলেছিল “ ইস আমার শ্বশুর সাহেব এসেছে , মাত্র তো এগারোটা বাজে এখনি খিদে পেয়ে গেলো “ মায়ের ঘর্মাক্ত মুখের সেই মিষ্টি হাসি আমার কাছে লেগেছিল বিষের মতো । মনে মনে এমন একটা বাক্য খুজছিলাম যেটা মাকে অনেক কষ্ট দেবে । “ আমি তো তোমার ছেলে না ওই কালু বোবাই তোমার ছেলে যাও খাওয়াও তোমার বোবা কুচ্ছিত ছেলেকে “ সেই কচি বয়সে এই বাক্যটি ই খুজে পেয়েছিলাম মা এর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। মনে করেছিলাম খুব একটি মোক্ষম আঘাত করেছি । কিন্তু অচিরেই আমার করা আঘাত আমার শরীরে এসে লাগলো যখন দেখলাম । আমার বলা সেই বিষ বাক্য মা কে স্পর্শ ই করলো না উল্টো হেঁসে লুটোপুটি খেতে লাগলো । আর বলল “পাগল ছেলে বলে কি “ অন্য আরও অনেক সময় মা আমাকে পাগল বলেছে আমি কিছুই মনে করিনি কিন্তু অইদিন কালুর সামনে পাগল বলায় আমার কাছে এমন লজ্জা আর অপমান লেগেছিল যে মনে হচ্ছিলো আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে । আর কালু ও দাঁত বের করে “ আম্মা “ বলে মায়ের কথায় সায় দিয়ছিল । রাগে অপমানে আমি বলে ছিলাম “ আমি পাগল না তোর ওই কালু পাগল , থাক তুই কালু পাগলা কে নিয়ে “ দৌরে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে । পেছন থেকে মায়ের শত ডাক ও কানে তুলিনি । ইচ্ছা ছিল আর বাড়িতে ফিরবনা ।
কিন্তু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলাম আর এক বিপদে , সময় কাটছিল না কিছুতেই । এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে রোদে ক্লান্ত হয়ে শেষে আমাদের বাড়ির পেছনে একটি মজা পুকুরের ঝপের আড়ালে বসে ছিলাম । কিছুক্ষন বসে থেকেই শুরু অয়েছিল অনুতাপ , ছোট বেলার আবছা সৃতি গুলি মনে পড়ছিল খুব । যখন আমি মায়ের সাথেই থাকতাম সব সময় আমাকে নিয়ে করা মায়ের আহ্লাদ গুলি মনে পড়ছিল খুব । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই । ঘুম ভেঙ্গে ছিল ঘেমো একটা গন্ধে । সেই গন্ধ কালুর এতো সাবান পানি সব বিফলে গিয়েছে কালুর এই ঘেমো গন্ধের কাছে । কি তীব্র সেই গন্ধ আমার তো মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে । কালু আমাকে পাজকোল করে উঠিয়ে বাড়ির দিকে দৌর দিলো । আমার চেয়ে কালুর বয়স খুব বেশি হবে না বড় জ্বর ২-৩ বছরের বড় । আর লম্বায় ও বেশ খাটো কি করে যে আমার মতো একটা ছেলেকে এমন করে কোলে নিয়ে দৌরে যাচ্ছে সেটা ভেবে ও অবাক হলাম খুব । আর এই অবাক হওয়ার পড়বো শেষ হলে এলো রাগ , যার জন্য রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম সেই এখন আমাকে আমার ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে এমন অসহায় অবস্থায় কোলে ফেলে জোড় করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে । প্রচণ্ড অভিমান হলো আর সাথে রাগ , রাগে কান্না চলে এলো । আঁচরে কামড়ে দিতে লাগলাম কালু কে । কিন্তু কালুর শরীর যেন পাথর এর । আমার নখ ওর চামড়া ভেদ করতে পারছে না কিছুতেই ।
তীব্র ঘামের গন্ধ সাথে চেঁচিয়ে কান্না করা আর হাত পা ছোরা এই সব মিলে ক্লান্ত হয়ে গেলাম । কিন্তু কালু দামড়া টার কোন ক্লান্তি নেই আমাকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর আমি ওর কোলে অপমানজনক ভাবে লেং ছেড়ে পড়ে আছি । আশপাশ থেকে কয়েকটা তির্যক উক্তি ও শুনতে পেলাম । এতে আমার রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিলো ।
বাড়িতে এনেই কালু আম্মা আম্মা বলে চেচাতে লাগলো কিছুতেই আমাকে কোল থেকে নামাচ্ছে না । কালুর চেঁচামেচি শুনে মা বেড়িয়ে এলো । আমাকে দেখেই জিজ্ঞাস কলো কোথায় পেলি । কালু উত্তর দিলো আমাকে কোল থেকে ধপাস করে মায়ের পায়ের নিচে ফেলে দিয়ে সাথে ওর বোবা মুখে সেই আম্মা বোল । কি ভয়ানক উত্তর , ধপাস করে মাটিতে পড়ে ভীষণ ব্যাথা পেলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না ।
ওকে এমন করে ফেললি কেন রে বোকা ছেলে , ভাই ব্যাথা পাবে না ? এই বলে মা আমাকে টেনে তুলে দাঁর করিয়ে দিলো । তারপর আমার চিবুক ধরে একটু উচু করে হাসি মখে বলল । পাগল ছেলে আমার অমন করে কেউ বেড়িয়ে যায় কখনো আর মায়ের মনে কি দুঃখ দিতে আছে । কিন্তু মায়ের অমন মিষ্টি কথাও আমার মনে দাগ কাটল না , কালু যে এভাবে আমাকে ফেলে দিলো তার জন্য মা ওকে কিছুই বলল না এটা ভেবে আমার রাগ আরও বেড়ে গেলো । আমি এক ঝটকায় মায়ের হাত আমার চিবুক থেকে সরিয়ে এক দৌড়ে আমার দোতলার ঘরে চলে গেলাম ।
কিছুক্ষন পর মা ঢুকল আমার ঘরে । হাসিমুখ আর হাতে খাবার এর থালা । পেটে টান অনুভব করলাম খাবার এর গন্ধ নাকে যেতেই । কিন্তু মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম জানালার দিকে । খোকন সোনা চাঁদের কোণা রাগ করেনা , এই বলে আম্মু আমার মুখটা নিজের দিকে করার চেষ্টা করলো । কিন্তু ছোট বেলার প্রিয় আদুরে বোল ও আমার রাগ ভাঙ্গাতে পারলো না । বরং রাগ যেন বেড়ে গেলো । আমি কেঁদেই ফেললাম রাগের কারনে । এই দেখে আম্মু খাবার এর থালা রেখে দু হাতে আমার মুখটা দুপাশ থেকে ধরে নিজের দিকে করলো ।
ছিঃ তুই কাদছিস কেন ? তুই তো আমার ভালো ছেলে লক্ষি ছেলে
কিন্তু মায়ের মন ভুলানো কথা গুলি আমার উপর কোন প্রভাব ফেললো না উল্টো আমার কান্নার দমক বেড়ে গেলো । কান্নার তিব্রতায় আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো । হেঁচকি উঠে যাচ্ছে কান্নার কারনে । মা আমার মাথা বুকে টেনে নিলেন। অনেক্ষন মায়ের বুকে মাথা রেখে একটু শান্তি পেলাম । কান্না একটু চেপে এলো । তখন মা আমাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে বলল এই তো লক্ষি ছেলে নে এবার খেয়ে নে অনেক বেলা হলো তোর জন্য ইলিশ মাছের ডিম ভেজে রেখেছি।
আমিও খাওয়া শুরু করলাম । মা আমাকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে । অনেকদিন পর মায়ের হাতে খেলাম । একটু পর খেয়াল করলাম কালু দাড়িয়ে আছে দরজায় , হলদে দাঁত বের করে । আমি ভাত মুখে নিয়েই মা কে বললাম ওকে ওর দাঁত লুকিয়ে রাখতে আমার বমি পায় । মা হেঁসে কালু কে ডাকল , এই কালু এদিকে আয় ।
আম্মা আম্মা করে হাজির কালু । এখনো নোংরা দাঁত গুলি বের করে রেখেছে । আমি কোনরকম মুখের ভাত গুলি গিলে ফেললাম । মা কালুর একটি হাত ধরে বলল এই কালু শোন এটা হচ্ছে তোর ছোট ভাই , একে কখনো কষ্ট দিবি না বুঝলি।কালু মাথা নেড়ে সায় দিলো সাথে নোংরা দাঁতের বিটকেলে হাসি । মা আবারো ওর হাত ঝাকি মেরে বলল বুঝেছিস তো আমার কথা । কালু এবার বলল আম্মা । এর মানে ও ঠিক মতো বুঝেছে । ইস মা ওকে সহ্য করে কি করে , আমি একটু দূরে বসা এখান থেকেই ওর ঘেমো গন্ধ পাচ্ছি ।
মা আমার মুখে আর এক বার ভাত তুলে দিয়ে বলল , বুঝলি অপু , কালু হচ্ছে তোর হাতের লাঠি , তোর কোন বিপদ আপদ এলে দেখবি কালু ই সবার প্রথম ঝাপিয়ে পড়বে । তারপর কালুর দিকে তাকিয়ে বলল কিরে কালু ভাই কে দেখবি না । কালু জবাব দিলো আম্মা । কি আম্মা আম্মা করছিস , বোল তো অপু তোর কি হয় ।
কালুর উত্তর এলো আম্মা । সাথে সাথে আম্মু হেঁসে ফেললো , প্রান খোলা হাসি । এমন হাসি আম্মু কে আগে আমি খুব কম ই হাসতে দেখেছি । আমারও হাসি পেয়ে গেলো ।
আসলে আমি এখন বুঝতে পারি মা কালুর সঙ্গে কেন এতো মিশত । আসলে মা নিঃসঙ্গ ছিলো । বাড়িতে আর কোন মেয়ে ও ছিলো যার সাথে মা সময় পাড় করবে দুটো কথা বলবে । আমি তো সারাক্ষণ পড়াশুনা বা খেলা ধুলা নিয়ে থাকতাম । যতক্ষণ সময় আমার জন্য মা কে দরকার ঠিক ততটাই সময় আমি মায়ের সাথে ব্যায় করতাম । এখন কার সময় এর স্বামী স্ত্রীর মতো আগের দিনের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোয়ালিটি টাইম বলতে কোন কথা ছিলো না । স্বামীদের সান্নিধ্য স্ত্রীরা সুধু রাতে শোয়ার সময় ই পেত । আর কালু ছিলো একজন আদর্শ স্রোতা , মা এমনসব কথাও কালুর সাথে বলতো যা ঠিক কালুর সাথে বলার কথা না ।
একদিন এর কথা বলি
মা দুপুর এর খাওয়া শেষে না ঘুমিয়ে পুকুর ঘাটে ছিপ নিয়ে বসে আছে আর কালু ও সাথে বসা । মা প্রায় ই দুপুর বেলা এমন করতো । আমার কি একটা প্রয়োজনে যেন আমি মা কে খুজছিলাম । খুজতে খুজতে পুকুর ঘাটে চলে এলাম । দেখি দুজনে খুব হাসা হাসি । তখনো কালুর প্রতি হিংসে আমার পুরো পুরি কাটেনি । কি নিয়ে এতো হাসা হাসি সেটা জানার খুব ইচ্ছে হলো আমি চুপি চুপি ওদের পেছনে ঘাপটি মেরে রইলাম ।
তোর আব্বার অনেক সখ ছিলো অনেক গুলি ছেলেপুলে হবে রে কালু , কিন্তু আমার পেটে যে কি পাথর আছে এতো চেষ্টার পর ও কিচ্ছু হচ্ছে না । এতো করে বললাম আর একটা বিয়ে করেন , কিছুতেই করলো না , আমাকে কি বলে জানিস ।
কালু বলল আম্মা
ধুর পাগল খালি আম্মা আম্মা করিস কেন , আর কিছু শিখতে পারিস না ।
এবার কালু বলল আব্বা , মা জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো , আর বলল
বুঝেছি বুঝেছি তুই খুব পারিস । শোন তোর আব্বা কি বলে তাকে আর একটা বিয়ের কথা বললে । বলে শোন আয়শা তুমি আর কোনদিন আর একটা বিয়ের কথা বলবে না , যদি বলো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো , তুমি কি মনে করো পীর সাহেব বলছে এই জন্য আমি বিয়ে করি না , এতো দিনেও আমাকে চিনলে না , কি রাগ যে করে তোর আব্বা , সেই রাগ ভাঙ্গাতে আমার রাত পাড় হয়ে যায় । আমার অবশ্য এতো ছেলে পুলে ভালো লাগে না বেশি ছেলে হলে ওই আমেনা আপার মতো মটকি হয়ে যাবো । এই বলে মায়ের আবার হাসি , এতো খোলা হাসি সুধু আমি মা কে কালুর সাথেই হাসতে দেখতাম । তবে সেই হাসি ধীরে ধীরে কেমন যেন একটা বিষাদ মাখা রূপ নিলো । তারপর একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
শোন কালু তুই আমার বড় ছেলে , তুই ই তোর আব্বার হাতের লাঠি হবি ভাই এর ছায়া হবি । বুঝলি আমার আর ছেলে পুলের দরকার নেই ।
আমি সেদিন আমার দরকার এর কথা না বলেই চলে এসেছিলাম । একটু অভিমান হয়েছিলো মায়ের উপর আমাকে কালুর চেয়ে দুর্বল ভাবার কারনে । তবে এখন বুঝতে পারি মা আমার কথা ভেবেই অমনটা বলেছিলো । আসলেই আমি দুর্বল প্রকিতির লোক । আর কালুকে আমার ও খুব প্রয়োজন এটা বুঝতে বেসিদিন সময় লাগেনি আমারও ।