04-06-2020, 12:21 PM
-মিনু আমি চাই না। আমার নাম জড়িয়ে তুই কলেজে কাউকে কিছু বলিস। এটা ঠিক নয়, আমার সন্মন্ধে আর একজন খারাপ ভাবতে পারে।
-কে ভাববে তোকে খারাপ? দেব, আমি তোর ফ্যান। কলেজে বাকীরা যেমন তোর গান মুগ্ধের মত শোনে, আমিও তেমন শুনি। তোকে তো বলেছি, বোনটাকে তুই যদি গান শেখাতে রাজী হয়ে যাস, আমি তাহলে ধন্য হয়ে যাবো। তোর কাছে কৃতার্থ থাকবো দেব। এগুলো যারা বলেছে, তারা সব বাড়িয়ে বলেছে। সেরকম কিছু নয়।
চকিতে মিনু সেদিন মনের মধ্যে পাপটা রেখে পাল্টি খেয়ে গেলো। আমি ধরতেও পারলাম না, মিনু হল সুযোগ সন্ধানি। যেদিন সুযোগ পাবে, মোক্ষম চাল দিয়ে ও আমাকে ঘায়েল করবে।
আমি শুয়ে শুয়ে পুরোনো কথা সব চিন্তা করছি, অথচ মনে হলো, কে যেন আমার ভেতরে হাতুরী দিয়ে ঘা পিটছে। দুমদুম করে আওয়াজ করছে। আমার দু’গালে ঠাসঠাস করে দুটো চড় মেরে দিয়ে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে সে, আমার জামার বোতাম ছিড়ে রাগে দূঃখে, চেঁচিয়ে বলছে, ভালোমানুষের অভিনয়? ভালোই পারো তুমি তাই না? এসব গল্প লিখে লোককে বোকা বানাচ্ছো। নিজে ভালো সেজে কখনো মিনুকে খারাপ করছো, কখনো শুক্লাকে খারাপ করছো তুমি কি? আদর্শ প্রেমিক? একটা মেয়েকে ভালোবেসে, শুধু তার কথা ভেবেই জীবনকে অতিবাহিত করে ফেললে। এসব কি বিশ্বাস যোগ্য? আবার সেই মেয়েটাই যখন তোমার জীবনে ফিরে এলো। তার জন্য তোমার দরদ একেবারে উথলে পড়ছে। তাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না। একেবারে সাধুপুরুষ যুধিষ্ঠীর তুমি? সবাই তোমার গল্প পড়ে, তুমি যা বলো, সত্যি কথাটাই তারা ধরে নেয়। সত্যের আড়ালেও যে কিছু থাকে। তাকে গোপণ কেন করো? মিথ্যেবাদী তুমি লেখক। যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। বিদিশা এই জন্যই তোমার জীবনে কোনদিন ফিরবে না।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাবছি, যা লিখেছি, এর মধ্যে তো কোন মিথ্যে নেই। আমি তো কিছুই গোপণ করিনি। আমি তো মিনুর সাথে সেভাবে কোনদিন কিছু করিনি। শুক্লার সাথেও আমার সেভাবে ঘনিষ্ঠতা হয় নি। তাহলে কেন? এভাবে-
হঠাৎই অনুভব করলাম, মা আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে। জোরে জোরে আমার গায়ে ঠেলা মারছে। চেঁচিয়ে বলছে, একি রে দেব? সকাল হয়েছে, ঘুম থেকে ওঠ। আপন মনে কি সব বিড়বিড় করছিস?
মা’র ঠেলা খেয়ে আমি ধরমড় করে বিছানা ছেড়ে উঠেছি।
ঠিক যেভাবে খারাপ স্বপ্ন দেখলে মানুষের মনটা খারাপ হয়ে যায়, মনে হয়, এটা দেখার কি সত্যি কোনো প্রয়োজন ছিল?আমারও ঘুমটা ভাঙার পর, খুব বাজে লাগছিলো। মনে হল, বিদিশাকে নিয়ে কাল বাড়ী ফেরার পর থেকে এতো চিন্তা করেছি, তারই প্রভাব পড়েছে স্বপ্নে। মা’র সাথে কাল বাড়ী ফিরে সেভাবে কথা বলিনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে মা জিজ্ঞাসা করছে, ‘এতদিন বাদে, তুই শুভেন্দুদের বাড়ীতে গেলি, হঠাৎ ও তোকে নেমতন্ন করলো, কি কারণ সেটা তো বললি না?’
মা’র কাছে বিদিশার নামটা মুখ থেকে আবার উচ্চারণ করতে গিয়েও করতে পারলাম না। মনে হল, বিদিশা যখন কাল আবার আমাকে একটা ধাঁধায় ফেলে গেছে, তখন এই নিয়ে কথা তুলে কোনো লাভ নেই, শুধু শুধু মা’রও আবার টেনশন বাড়বে। আগে তো সমস্যার সমাধান হোক। তারপর বিদিশার কথা মা’কে খুলে বলতে অসুবিধে নেই। বিদিশাও আমার কাছ থেকে দুদিন টাইম চেয়েছে। সুতরাং এই দুদিন আমাকেও একটু ধৈর্য রাখতে হবে।
মা দেখি আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবার পর একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা’কে বললাম, ‘না মা, এমনি কোনো কারন নয়। তুমি তো জানো, শুভেন্দুটা কি রকম করে আমি গেলে। এতদিন পরে গেছি, না খাইয়ে কি আমাকে ছাড়বে? এত পীড়াপিড়ী করলো, যে আমাকেও শেষপর্যন্ত ওর কথাটা রাখতে হলো।’
মা বললো, ‘আর কি কেউ এসেছিলো?’
আমি বললাম, ‘রনি আর মাধুরী এসেছিলো। আর তো কেউ আসেনি।’
আমার দিকে তাকিয়ে মা এমন ভাবে হাসলো, মনে হল, মা যেন সবই জানে। আমাকে বললো, ‘সারাদিনে বিদিশার নামটা আপন মনে কতবার উচ্চারণ করিস তুই? আর আমি যখন কিছু জিজ্ঞাসা করি, তখন আমার কাছে সব চেপে যাস। কাল যে বিদিশাও ওখানে ছিলো, আমি ভালমতনই জানি তা। তুই ঘুমের ঘোরে বকবক করছিলিস, বিদিশার নামটা বারে বারে উচ্চারণ করছিলিস, আমি সব শুনে নিয়েছি।’
আমাকে যেন বিদিশা রোগে পেয়েছে। মা বললো, ‘জানি না বাপু। কি তুই চাস? তবে শুধু শুধু এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। ও যদি তোকে এতদিনেও বুঝতে না পারে, তাহলে আর কবে বুঝবে? আমি তো বলবো, আমার ছেলেকে বোঝার জন্য ওকে জন্মজন্মান্তর তপস্যা করতে হবে, তবেই ও তোকে বুঝতে পারবে। তার আগে নয়।’
আমি বললাম, ‘না মা, বিদিশার কোনো দোষ নেই। ওর হয়তো কিছু সমস্যা আছে, যেটা ও খুলে বলছে না। ইচ্ছে থাকলেও ওর বিবেক ওকে বাঁধা দিচ্ছে। আমি অনেক কষ্ট করেছি বলেই, ও নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখছে না। এমনও হতে পারে, সেই সমাধানের পথটাও খুলে গেলো, আর বিদিশাও পুরোপুরি আমার হয়ে গেলো।’
মা বললো, ‘কি সমস্যা? সেটা যতক্ষণ না ও তোকে খুলে না বলছে, তুই কি করে তার সমাধান করবি? ওর যদি সমস্যাটা গুরুতর হয়, তাহলে ওর পক্ষে বলাটা অত সহজ নয়। ও জেনেও তোকে বলবে না। আর যদি সমস্যাটা অল্পতেই সমাধান হয়ে যেতে পারে, তাহলে দেখ, আজই তোকে হয়তো বিদিশা ফোন করবে, সব খুলে বলবে।’
মায়ের কথা শুনে আমার মনে হলো, মা হয়তো ঠিকই বলছে। কারণ বিদিশা কাল ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও আমাকে ওর সমস্যাটার কথাটা সেভাবে কিছু খুলে বলেনি। আমার কাছে আরো দু তিনদিন বিদিশা টাইম চেয়েছে। এটা যদি গুরুতর কিছু সমস্যা না হত, তাহলেই হয়তো কালকেই বিদিশা সব খুলে বলতো। কি জানি ভাগ্যে আমার কি লেখা আছে।
মন খারাপ না করে এবারে আমি অফিসে বেরুবার জন্য তৈরী হতে শুরু করেদিলাম। কাল থেকে কি সুন্দর উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছিলাম। মনে হলো, কালকের এক ঝটকায় গল্পটা কেমন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আগে কি লিখবো, এখন আর বুঝতে পারছি না। যতক্ষণ বিদিশার রহস্যের উন্মোচন যতক্ষণ না হচ্ছে, আমাকে ঐ কলেজের পুরোনো স্মৃতিগুলোর কথা মনে করেই আরো কিছু পাতা ভরিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আর কিছু লেখার নেই।
সকালে যে শুভেন্দু একটা ফোন করবে, এটা জানাই ছিলো। কিন্তু আমি আরো অবাক হলাম, যখন দেখলাম, শুক্লাও আমাকে পরপর চারটে মিস কল করেছে, সে জায়গায় শুভেন্দু করেছে একটা। অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম, এতগুলো মোবাইলে মিস কল হয়েছে আমি টেরই পাইনি।
শুভেন্দু একটা মেসেজ ছেড়েছে। ‘কাল বিদিশা তোকে কিছু বলেছে? জানতে খুব ইচ্ছে করছে। ফ্রি হলে আমাকে একটা ফোন করিস। -শুভেন্দু।
অফিসের জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছি। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে শুভেন্দুকে এবারে ফোনটা করলাম। দেখলাম, ওর ফোনটা বিজি বলছে, তার মানে কোনো ক্লায়েন্টের সাথে হয়তো কথা বলছে শুভেন্দু। ঠিক তার পাঁচ মিনিট পরেই শুভেন্দু ঘুরিয়ে ফোনটা করলো আমকে।
আমাকে বললো, ‘কি ব্যাপার বলতো দেব? একটু আগে বিদিশা আমাকে ফোন করেছিলো, আমাকে বললো, সরি, ‘কাল তোদের মুডটা আমি খারাপ করেদিয়েছিলাম। আসলে ওই অবস্থায় আমার তখন কিছু করারও ছিলো না। দেবের কথা ভেবে আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হলো, দেবকে এভাবে ঠকানোটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তাই আমি মনে মনে একটা অন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মূহূর্তে দেবের বাড়ীতে আমি আর যাচ্ছি না।’
বারবার বিদিশাকে ঘিরে মনের মধ্যে সেই একই হতাশা আর বিষন্নতা। হঠাৎ বিদিশা কেন এমন আচরণ করছে? আমার জীবনটাকে নিয়ে ও কি শুধু খেলতেই চাইছে? আমাকে যদি সে নিজের মনে করে, তাহলে সত্যি কথাটা কেন খুলে বলছে না। কেন বলছে না দেব, আমি তোমার কাছেই আবার ফিরে আসতে চাই। তুমি যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে। আমার এই বিপদে তুমি আমার পাশে দাঁড়াতে। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তা না বলে-
শুভেন্দুর কথার উত্তরে আমি কি বলবো, কিছু ভেবে পেলাম না। ও শুধু বললো, ‘কাল বাড়ী ফেরার সময় বিদিশা তোকে কিছু বলেনি? ও কেন হঠাৎ ও রকম হয়ে গেলো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি বললাম, ‘সেতো আমিও বুঝতে পারছি না। আর বিদিশাও সেভাবে আমাকে কিছু বলেনি। শুধু আমার কাছে দুতিনদিন ও সময় চেয়েছে। বললো, আমাকে ও আর ঠকাতে চায় না।’
শুভেন্দু বললো, ‘তুই জোর করলি না কেন? এত কিছু করেও বিদিশার সাথে তোর মিলনটা করিয়ে দিতে পারলাম না। আমার নিজেরই তো খুব খারাপ লাগছে।’
শুভেন্দুকে বললাম, ‘মন খারাপ করিস না শুভেন্দু। হয়তো দু তিনদিন পরেই অজানা কথাগুলো সব জানা হয়ে যাবে। বিদিশার কিসে এত অসুবিধা হচ্ছে, সেটা আমি তুই দুজনেই তখন জানতে পারবো।
জানি শুভেন্দু আমার মনকেও শান্তনা দেবে। ও নিজের থেকে আমার ব্যাপারে চিন্তা করে বেশী। ফোনে বললো, ‘দেব, নিজের মনকে একটু শক্ত কর। দু তিনদিন বেশী সময় নয়। আশাকরি এ রহস্যের জট কাটবে। বিদিশা আবার তোরই হবে। তুই দেখে নিস, আমার মন তাই বলছে।’
অফিসে পৌঁছোলাম। নিজের রুমে বসে বিদিশার কথাই শুধু ভাবছি। হঠাৎ ওর পুনরাগমনে নিজের মধ্যে একটা শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সেই কলেজের দিনগুলোর মতই আবার আমার মধ্যে জীবনীশক্তির এতই প্রাচুর্য হঠাৎ যেন ভীষন লাফাতে ইচ্ছে করছে আমার। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে সবাইকে খুশীর খবরটা দিতে ইচ্ছে করছে। অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে, যেন যাকে আমি ভালোবাসতাম, সে ঠিক এতদিন বাদে আমার কাছেই ফিরে এসেছে আবার।
বিদিশার আগমন, আমাকে সেই তরুন বয়সে ফিরে দিয়েছে আবার। কলেজের দিনগুলোর মতই আবার গাইতে ইচ্ছে করছে, নাচতে ইচ্ছে করছে, আনন্দ করতে ইচ্ছ করছে।
আবার পরক্ষণে এটাও মনে হল, সেই উদ্দীপনা এসেও যেন আবার নিভে গেলো। আমি যেন পরিশ্রান্ত হয়ে নিজের সিটের ওপরে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছি। নানা রকম চিন্তা আমার মনকে ঘিরে ধরছে। নিজের জীবনটাকে মনে হচ্ছে একেবারে শূন্য। এই পৃথিবীটাকে মনে হচ্ছে একটা মরুভুমি। এই মূহূর্তে বিদিশার ছায়াটাকে আমি আমার রুমের মধ্যে দেখেছি। ছায়াটা ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে ক্রমশ আবার দূরে সরে যাচ্ছে। আমি স্থির থাকতে না পেরে, বিচলিত হয়ে রুমের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দিয়েছি,এমন একটা কঠিন পরিস্থিতি, জীবনের যখন একটা মান খুঁজে পেলাম, তখন আমি আবার একা। ভীষন ভাবে একা। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার পর ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মতো, বিহ্বল চোখে আমি যখন বাস্তব জীবনের দিকে তাকাই, আমার ঘরের শূন্য দেওয়ালগুলো ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পারি না। বা অনুভব করতে পারি না।
মনে হয় আমার জীবনকে রমনীয় করে তোলার জন্য সত্যি কোনো নারী নেই। নেই কোনো সঙ্গিনী। সবাই যেখানে প্রেম অভিসারে ব্যস্ত। আমাকে সেখানে অবসর সময় কাটানোর জন্য এমন কিছু জায়গা খুঁজতে হয়, যেখানে আশ্রয় না নিলে আমার যেন সময় কাটানোর আর জায়গা নেই। ঐ শুভেন্দুর কথাটাই তখন সত্যি হয়। বিদিশাকে ভালোবেসে জীবনটা নষ্ট করলি তুই। এখন শুধু লেখালেখি, আর গানের চর্চা নিয়েই পড়ে থাকিস তুই। এটাই কি জীবন নাকি? ধূর। এভাবে জীবন কাটানো মানে একেবারেই তা অর্থহীন।
অফিসে গিয়ে কাজকর্ম সেভাবে এখনো শুরু করতে পারিনি। চেয়ারে বসে উল্টোপাল্টা এসব ভাবছি, আর চোখটাও অল্প একটু বুজে এসেছে। ঠিক তখনই দেখলাম, মোবাইলটা আবার বাজছে। শুক্লা আবার আমাকে ফোন করেছে।
কাল শুভেন্দু আমাকে শুক্লার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। রনি তো বলেই দিয়েছে, ওর ফোন এলে ফোনও ধরবি না তুই। সবাই এখন শুক্লাকে খারাপ চোখে দেখছে। ব্যাচারা শুক্লা। বিদিশার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুক্লারই বা আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখানোর কারণটা কি? বিদিশাকে ও সহ্য করতে পারছে না। বারে বারে আমাকে ও ফোন কল করছে, বাড়ীতে যাবার জন্য বলছে। কই এতদিন তো শুক্লার একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
মনে হল এই মূহূর্তে আমার মনে শক্তি জোগানোর বা মনকে শান্তনা দেবার জন্য এমন কাউকে দরকার। শুক্লা সেই ভূমিকাটা কিছুতেই পালন করতে পারবে না। বরঞ্চ ও যদি বিদিশার ব্যাপারে হতাশাজনক আমাকে কিছু বলে দেয়, তাহলে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ব।
ফোনটা ধরলাম না। সুইচটা অফ না করে সাইলেন্ট মোড করে দিলাম। একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে শুক্লা। ওর ধৈর্য দেখে, আমিও রীতিমতন অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, হয় মেয়েটা আমার ভালো চাইছে, সত্যিকারের বন্ধু হয়ে এক বন্ধুর উপকার করতে চাইছে, নয়তো সে নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখছে, আমার স্বার্থটাকে নয়।
‘প্লীজ শুক্লা লিভ মি অ্যালোন। আমাকে একটু একা থাকতে দে। কেন তুই ফোন করে আমাকে বিরক্ত করছিস?’
বাড়ী থেকে বেরুবার সময়ও দেখেছি, শুক্লা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিল। আবার এখনও করে যাচ্ছে কনটেনিউসালি। যেন আমাকে ক্ষিপ্ত না করে ও এবারে ছাড়বে না।
অনেক বিরক্ত হয়েই শেষমেষে ওর ফোনটা ধরলাম। ঠিক করে নিলাম, বিদিশার ব্যাপারে শুক্লা যদি কিছু উচ্চবাচ্য করে প্রথমেই ওকে না করে দেবো, কথাই বলব না হয়তো। ফোনের লাইনটাও কেটে দেবো। ঠিক এই মূহূর্তে আমার মনোভাবটা এমনই কঠোর হওয়া দরকার। নিজেকে দূর্বল করলে চলবে না। বিদিশার প্রতি দুদিন অন্তত আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
ফোন ধরলাম, হ্যালোও বললাম। কিন্তু ভেতর থেকে সেই উদ্দীপনাটা এল না। শুক্লা আমাকে অবাক করে প্রথমেই বলল, ‘দেব, আমি কিন্তু মিনু নই। তুই কিন্তু আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছিস। এতবার করে তোকে ফোন করছি, ফোনটা অন্তত ধরবি তো? না শুক্লা বলে, তোর কেউ কোনদিন ছিল না। কলেজে শুভেন্দু, রনি সবাই তোর বন্ধু। আমি তোর কেউ নই।’
আমি কোন কথা বলছি না। শুক্লা বলল, ‘কি হল জবাব দে। কথা বলছিস না কেন?’
মনে হল, শুক্লা বোধহয় বিদিশার ব্যাপারে এবার কিছু বলবে। হয়তো কাল শুভেন্দুর বাড়ীতে কি হল, সেটাই জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে বিদিশা ওখানে এসেছিল কিনা? আমার সাথে বিদিশার কথা হল কিনা? বিদিশার জন্য আমি যে এখনও কাতর। এই ছটফটে মনটা নিয়ে কোথায় যাই? আমার ভালবাসার গভীরতা বোঝার মত ক্ষমতা যদি শুক্লার থাকতো-
ও বলল, ‘শোন, তোকে আমি এখন কিছুই বলব না। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখবি। কাল যখন আসতে পারিস নি। আজ অবশ্যই আমার ফ্ল্যাটে আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু ভীষন দূঃখ পাবো। যতদূর জানি, দেব কাউকে না বলে না। কাউকে ফেরায় না। অন্তত আমার এই অনুরোধটা তুই ফেলিস না। দেব প্লীজ। তোর পায়ে ধরে তোকে রিকোয়েস্ট করছি।’
আমি বললাম,‘আরে না, না। তুই এতকরে আমাকে রিকোয়েস্ট করছিস কেন বলতো? আমি কি তোকে না বলেছি? কাল তো শুভেন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বলেই তোর ওখানে যেতে পারিনি। তাই বলে কি আর যাব না কোনদিন? নিশ্চই যাবো।’
শুক্লা বলল, ভাবছিস আমি তোকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলব। তাই না?
আমি বললাম, ‘না, না। তা কেন হবে? তুই তো কালকেই-
-’হ্যাঁ। যা বলেছি। ওটার আর পুনরাবৃত্তি আমি করব না। তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলে, তোর মনকে আমি বিষিয়ে দিতে চাই না। শুক্লা দেবের খুব ভাল বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। ব্যাস। আর কিছু নয়। হ্যাপি? বল এবারে আসবি তো?
আমার যেন মনে হল, শুক্লা যেন আমার মনটাকে খুব ভালো করে পড়ে নিয়েছে। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বললে, আমি যে ওর বাড়ীতে যেতে আর আগ্রহ দেখাবো না। সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। শুক্লা ভাল করেই জানে, এতদিন বাদে বিদিশার পুনরাগমন, আমার কাছে একটা অক্সিজেনের মতন। ওর এই ফিরে আসার মধ্যে যতই রহস্য থাক। যতই বিদিশা আমার কাছে একটু সময় চেয়ে নিক, যতই আমার মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে যাক, একটা আশা নিয়ে দুদিন তো আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে বিদিশাই বা কি মুখ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে? শুভেন্দুকেই বা কি বলব? রনিকেই বা কি বলব তখন? আমি নিজে থেকেই বিদিশার ফিরে আসাটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে চির দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
একবার মায়ের কথাটা সে সময় খুব মনে হল। মা আমার জন্য খুব ভাবে, কষ্ট পায়। বিদিশাকে অর্জন করে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফোটানোটা দরকার।
শুক্লাকে বললাম, ‘যাবো তোর বাড়ী। কবে যেতে হবে বল? অফিস ফেরত একদিন চলে যাব তোর ফ্ল্যাটে।’
শুক্লা বলল, ‘না তুই আজকেই আসবি। আমি আজকেই তোকে আমার এখানে দেখতে চাই।’
ওকে বললাম, ‘আজকেই যাব? তাহলে তো অফিস ফেরত তোর ওখানে যেতে হয়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। তোর বাড়ী থেকে তো আর বেশী দূরে নয়। সল্টলেকে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে। একটা ট্যাক্সি নিবি। আর ঝটপট চলে আসবি।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া দাওয়ার আবার অ্যারেঞ্জ করবি না তো? মাকে কিন্তু কিছু বলে আসিনি। কাল এমনিতেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে অনেক খেয়েছি। আজ তোর ওখানে খেলে, মা বহূত চটে যাবে।’
শুক্লা বলল, ‘দেব, তোর আপত্তি থাকলে আমি তোকে জোর করব না। কিন্তু তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি। আমাকে আবার ফোন করতে বাধ্য করিস না।’
যেন নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। কিছুতেই আমাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না। আমিও শেষ পর্ষন্ত শুক্লাকে কথা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।
-কে ভাববে তোকে খারাপ? দেব, আমি তোর ফ্যান। কলেজে বাকীরা যেমন তোর গান মুগ্ধের মত শোনে, আমিও তেমন শুনি। তোকে তো বলেছি, বোনটাকে তুই যদি গান শেখাতে রাজী হয়ে যাস, আমি তাহলে ধন্য হয়ে যাবো। তোর কাছে কৃতার্থ থাকবো দেব। এগুলো যারা বলেছে, তারা সব বাড়িয়ে বলেছে। সেরকম কিছু নয়।
চকিতে মিনু সেদিন মনের মধ্যে পাপটা রেখে পাল্টি খেয়ে গেলো। আমি ধরতেও পারলাম না, মিনু হল সুযোগ সন্ধানি। যেদিন সুযোগ পাবে, মোক্ষম চাল দিয়ে ও আমাকে ঘায়েল করবে।
আমি শুয়ে শুয়ে পুরোনো কথা সব চিন্তা করছি, অথচ মনে হলো, কে যেন আমার ভেতরে হাতুরী দিয়ে ঘা পিটছে। দুমদুম করে আওয়াজ করছে। আমার দু’গালে ঠাসঠাস করে দুটো চড় মেরে দিয়ে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে সে, আমার জামার বোতাম ছিড়ে রাগে দূঃখে, চেঁচিয়ে বলছে, ভালোমানুষের অভিনয়? ভালোই পারো তুমি তাই না? এসব গল্প লিখে লোককে বোকা বানাচ্ছো। নিজে ভালো সেজে কখনো মিনুকে খারাপ করছো, কখনো শুক্লাকে খারাপ করছো তুমি কি? আদর্শ প্রেমিক? একটা মেয়েকে ভালোবেসে, শুধু তার কথা ভেবেই জীবনকে অতিবাহিত করে ফেললে। এসব কি বিশ্বাস যোগ্য? আবার সেই মেয়েটাই যখন তোমার জীবনে ফিরে এলো। তার জন্য তোমার দরদ একেবারে উথলে পড়ছে। তাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না। একেবারে সাধুপুরুষ যুধিষ্ঠীর তুমি? সবাই তোমার গল্প পড়ে, তুমি যা বলো, সত্যি কথাটাই তারা ধরে নেয়। সত্যের আড়ালেও যে কিছু থাকে। তাকে গোপণ কেন করো? মিথ্যেবাদী তুমি লেখক। যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। বিদিশা এই জন্যই তোমার জীবনে কোনদিন ফিরবে না।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাবছি, যা লিখেছি, এর মধ্যে তো কোন মিথ্যে নেই। আমি তো কিছুই গোপণ করিনি। আমি তো মিনুর সাথে সেভাবে কোনদিন কিছু করিনি। শুক্লার সাথেও আমার সেভাবে ঘনিষ্ঠতা হয় নি। তাহলে কেন? এভাবে-
হঠাৎই অনুভব করলাম, মা আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে। জোরে জোরে আমার গায়ে ঠেলা মারছে। চেঁচিয়ে বলছে, একি রে দেব? সকাল হয়েছে, ঘুম থেকে ওঠ। আপন মনে কি সব বিড়বিড় করছিস?
মা’র ঠেলা খেয়ে আমি ধরমড় করে বিছানা ছেড়ে উঠেছি।
ঠিক যেভাবে খারাপ স্বপ্ন দেখলে মানুষের মনটা খারাপ হয়ে যায়, মনে হয়, এটা দেখার কি সত্যি কোনো প্রয়োজন ছিল?আমারও ঘুমটা ভাঙার পর, খুব বাজে লাগছিলো। মনে হল, বিদিশাকে নিয়ে কাল বাড়ী ফেরার পর থেকে এতো চিন্তা করেছি, তারই প্রভাব পড়েছে স্বপ্নে। মা’র সাথে কাল বাড়ী ফিরে সেভাবে কথা বলিনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে মা জিজ্ঞাসা করছে, ‘এতদিন বাদে, তুই শুভেন্দুদের বাড়ীতে গেলি, হঠাৎ ও তোকে নেমতন্ন করলো, কি কারণ সেটা তো বললি না?’
মা’র কাছে বিদিশার নামটা মুখ থেকে আবার উচ্চারণ করতে গিয়েও করতে পারলাম না। মনে হল, বিদিশা যখন কাল আবার আমাকে একটা ধাঁধায় ফেলে গেছে, তখন এই নিয়ে কথা তুলে কোনো লাভ নেই, শুধু শুধু মা’রও আবার টেনশন বাড়বে। আগে তো সমস্যার সমাধান হোক। তারপর বিদিশার কথা মা’কে খুলে বলতে অসুবিধে নেই। বিদিশাও আমার কাছ থেকে দুদিন টাইম চেয়েছে। সুতরাং এই দুদিন আমাকেও একটু ধৈর্য রাখতে হবে।
মা দেখি আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবার পর একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা’কে বললাম, ‘না মা, এমনি কোনো কারন নয়। তুমি তো জানো, শুভেন্দুটা কি রকম করে আমি গেলে। এতদিন পরে গেছি, না খাইয়ে কি আমাকে ছাড়বে? এত পীড়াপিড়ী করলো, যে আমাকেও শেষপর্যন্ত ওর কথাটা রাখতে হলো।’
মা বললো, ‘আর কি কেউ এসেছিলো?’
আমি বললাম, ‘রনি আর মাধুরী এসেছিলো। আর তো কেউ আসেনি।’
আমার দিকে তাকিয়ে মা এমন ভাবে হাসলো, মনে হল, মা যেন সবই জানে। আমাকে বললো, ‘সারাদিনে বিদিশার নামটা আপন মনে কতবার উচ্চারণ করিস তুই? আর আমি যখন কিছু জিজ্ঞাসা করি, তখন আমার কাছে সব চেপে যাস। কাল যে বিদিশাও ওখানে ছিলো, আমি ভালমতনই জানি তা। তুই ঘুমের ঘোরে বকবক করছিলিস, বিদিশার নামটা বারে বারে উচ্চারণ করছিলিস, আমি সব শুনে নিয়েছি।’
আমাকে যেন বিদিশা রোগে পেয়েছে। মা বললো, ‘জানি না বাপু। কি তুই চাস? তবে শুধু শুধু এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। ও যদি তোকে এতদিনেও বুঝতে না পারে, তাহলে আর কবে বুঝবে? আমি তো বলবো, আমার ছেলেকে বোঝার জন্য ওকে জন্মজন্মান্তর তপস্যা করতে হবে, তবেই ও তোকে বুঝতে পারবে। তার আগে নয়।’
আমি বললাম, ‘না মা, বিদিশার কোনো দোষ নেই। ওর হয়তো কিছু সমস্যা আছে, যেটা ও খুলে বলছে না। ইচ্ছে থাকলেও ওর বিবেক ওকে বাঁধা দিচ্ছে। আমি অনেক কষ্ট করেছি বলেই, ও নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখছে না। এমনও হতে পারে, সেই সমাধানের পথটাও খুলে গেলো, আর বিদিশাও পুরোপুরি আমার হয়ে গেলো।’
মা বললো, ‘কি সমস্যা? সেটা যতক্ষণ না ও তোকে খুলে না বলছে, তুই কি করে তার সমাধান করবি? ওর যদি সমস্যাটা গুরুতর হয়, তাহলে ওর পক্ষে বলাটা অত সহজ নয়। ও জেনেও তোকে বলবে না। আর যদি সমস্যাটা অল্পতেই সমাধান হয়ে যেতে পারে, তাহলে দেখ, আজই তোকে হয়তো বিদিশা ফোন করবে, সব খুলে বলবে।’
মায়ের কথা শুনে আমার মনে হলো, মা হয়তো ঠিকই বলছে। কারণ বিদিশা কাল ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও আমাকে ওর সমস্যাটার কথাটা সেভাবে কিছু খুলে বলেনি। আমার কাছে আরো দু তিনদিন বিদিশা টাইম চেয়েছে। এটা যদি গুরুতর কিছু সমস্যা না হত, তাহলেই হয়তো কালকেই বিদিশা সব খুলে বলতো। কি জানি ভাগ্যে আমার কি লেখা আছে।
মন খারাপ না করে এবারে আমি অফিসে বেরুবার জন্য তৈরী হতে শুরু করেদিলাম। কাল থেকে কি সুন্দর উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছিলাম। মনে হলো, কালকের এক ঝটকায় গল্পটা কেমন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আগে কি লিখবো, এখন আর বুঝতে পারছি না। যতক্ষণ বিদিশার রহস্যের উন্মোচন যতক্ষণ না হচ্ছে, আমাকে ঐ কলেজের পুরোনো স্মৃতিগুলোর কথা মনে করেই আরো কিছু পাতা ভরিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আর কিছু লেখার নেই।
সকালে যে শুভেন্দু একটা ফোন করবে, এটা জানাই ছিলো। কিন্তু আমি আরো অবাক হলাম, যখন দেখলাম, শুক্লাও আমাকে পরপর চারটে মিস কল করেছে, সে জায়গায় শুভেন্দু করেছে একটা। অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম, এতগুলো মোবাইলে মিস কল হয়েছে আমি টেরই পাইনি।
শুভেন্দু একটা মেসেজ ছেড়েছে। ‘কাল বিদিশা তোকে কিছু বলেছে? জানতে খুব ইচ্ছে করছে। ফ্রি হলে আমাকে একটা ফোন করিস। -শুভেন্দু।
অফিসের জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছি। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে শুভেন্দুকে এবারে ফোনটা করলাম। দেখলাম, ওর ফোনটা বিজি বলছে, তার মানে কোনো ক্লায়েন্টের সাথে হয়তো কথা বলছে শুভেন্দু। ঠিক তার পাঁচ মিনিট পরেই শুভেন্দু ঘুরিয়ে ফোনটা করলো আমকে।
আমাকে বললো, ‘কি ব্যাপার বলতো দেব? একটু আগে বিদিশা আমাকে ফোন করেছিলো, আমাকে বললো, সরি, ‘কাল তোদের মুডটা আমি খারাপ করেদিয়েছিলাম। আসলে ওই অবস্থায় আমার তখন কিছু করারও ছিলো না। দেবের কথা ভেবে আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হলো, দেবকে এভাবে ঠকানোটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তাই আমি মনে মনে একটা অন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মূহূর্তে দেবের বাড়ীতে আমি আর যাচ্ছি না।’
বারবার বিদিশাকে ঘিরে মনের মধ্যে সেই একই হতাশা আর বিষন্নতা। হঠাৎ বিদিশা কেন এমন আচরণ করছে? আমার জীবনটাকে নিয়ে ও কি শুধু খেলতেই চাইছে? আমাকে যদি সে নিজের মনে করে, তাহলে সত্যি কথাটা কেন খুলে বলছে না। কেন বলছে না দেব, আমি তোমার কাছেই আবার ফিরে আসতে চাই। তুমি যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে। আমার এই বিপদে তুমি আমার পাশে দাঁড়াতে। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তা না বলে-
শুভেন্দুর কথার উত্তরে আমি কি বলবো, কিছু ভেবে পেলাম না। ও শুধু বললো, ‘কাল বাড়ী ফেরার সময় বিদিশা তোকে কিছু বলেনি? ও কেন হঠাৎ ও রকম হয়ে গেলো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি বললাম, ‘সেতো আমিও বুঝতে পারছি না। আর বিদিশাও সেভাবে আমাকে কিছু বলেনি। শুধু আমার কাছে দুতিনদিন ও সময় চেয়েছে। বললো, আমাকে ও আর ঠকাতে চায় না।’
শুভেন্দু বললো, ‘তুই জোর করলি না কেন? এত কিছু করেও বিদিশার সাথে তোর মিলনটা করিয়ে দিতে পারলাম না। আমার নিজেরই তো খুব খারাপ লাগছে।’
শুভেন্দুকে বললাম, ‘মন খারাপ করিস না শুভেন্দু। হয়তো দু তিনদিন পরেই অজানা কথাগুলো সব জানা হয়ে যাবে। বিদিশার কিসে এত অসুবিধা হচ্ছে, সেটা আমি তুই দুজনেই তখন জানতে পারবো।
জানি শুভেন্দু আমার মনকেও শান্তনা দেবে। ও নিজের থেকে আমার ব্যাপারে চিন্তা করে বেশী। ফোনে বললো, ‘দেব, নিজের মনকে একটু শক্ত কর। দু তিনদিন বেশী সময় নয়। আশাকরি এ রহস্যের জট কাটবে। বিদিশা আবার তোরই হবে। তুই দেখে নিস, আমার মন তাই বলছে।’
অফিসে পৌঁছোলাম। নিজের রুমে বসে বিদিশার কথাই শুধু ভাবছি। হঠাৎ ওর পুনরাগমনে নিজের মধ্যে একটা শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সেই কলেজের দিনগুলোর মতই আবার আমার মধ্যে জীবনীশক্তির এতই প্রাচুর্য হঠাৎ যেন ভীষন লাফাতে ইচ্ছে করছে আমার। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে সবাইকে খুশীর খবরটা দিতে ইচ্ছে করছে। অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে, যেন যাকে আমি ভালোবাসতাম, সে ঠিক এতদিন বাদে আমার কাছেই ফিরে এসেছে আবার।
বিদিশার আগমন, আমাকে সেই তরুন বয়সে ফিরে দিয়েছে আবার। কলেজের দিনগুলোর মতই আবার গাইতে ইচ্ছে করছে, নাচতে ইচ্ছে করছে, আনন্দ করতে ইচ্ছ করছে।
আবার পরক্ষণে এটাও মনে হল, সেই উদ্দীপনা এসেও যেন আবার নিভে গেলো। আমি যেন পরিশ্রান্ত হয়ে নিজের সিটের ওপরে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছি। নানা রকম চিন্তা আমার মনকে ঘিরে ধরছে। নিজের জীবনটাকে মনে হচ্ছে একেবারে শূন্য। এই পৃথিবীটাকে মনে হচ্ছে একটা মরুভুমি। এই মূহূর্তে বিদিশার ছায়াটাকে আমি আমার রুমের মধ্যে দেখেছি। ছায়াটা ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে ক্রমশ আবার দূরে সরে যাচ্ছে। আমি স্থির থাকতে না পেরে, বিচলিত হয়ে রুমের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দিয়েছি,এমন একটা কঠিন পরিস্থিতি, জীবনের যখন একটা মান খুঁজে পেলাম, তখন আমি আবার একা। ভীষন ভাবে একা। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার পর ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মতো, বিহ্বল চোখে আমি যখন বাস্তব জীবনের দিকে তাকাই, আমার ঘরের শূন্য দেওয়ালগুলো ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পারি না। বা অনুভব করতে পারি না।
মনে হয় আমার জীবনকে রমনীয় করে তোলার জন্য সত্যি কোনো নারী নেই। নেই কোনো সঙ্গিনী। সবাই যেখানে প্রেম অভিসারে ব্যস্ত। আমাকে সেখানে অবসর সময় কাটানোর জন্য এমন কিছু জায়গা খুঁজতে হয়, যেখানে আশ্রয় না নিলে আমার যেন সময় কাটানোর আর জায়গা নেই। ঐ শুভেন্দুর কথাটাই তখন সত্যি হয়। বিদিশাকে ভালোবেসে জীবনটা নষ্ট করলি তুই। এখন শুধু লেখালেখি, আর গানের চর্চা নিয়েই পড়ে থাকিস তুই। এটাই কি জীবন নাকি? ধূর। এভাবে জীবন কাটানো মানে একেবারেই তা অর্থহীন।
অফিসে গিয়ে কাজকর্ম সেভাবে এখনো শুরু করতে পারিনি। চেয়ারে বসে উল্টোপাল্টা এসব ভাবছি, আর চোখটাও অল্প একটু বুজে এসেছে। ঠিক তখনই দেখলাম, মোবাইলটা আবার বাজছে। শুক্লা আবার আমাকে ফোন করেছে।
কাল শুভেন্দু আমাকে শুক্লার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। রনি তো বলেই দিয়েছে, ওর ফোন এলে ফোনও ধরবি না তুই। সবাই এখন শুক্লাকে খারাপ চোখে দেখছে। ব্যাচারা শুক্লা। বিদিশার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুক্লারই বা আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখানোর কারণটা কি? বিদিশাকে ও সহ্য করতে পারছে না। বারে বারে আমাকে ও ফোন কল করছে, বাড়ীতে যাবার জন্য বলছে। কই এতদিন তো শুক্লার একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
মনে হল এই মূহূর্তে আমার মনে শক্তি জোগানোর বা মনকে শান্তনা দেবার জন্য এমন কাউকে দরকার। শুক্লা সেই ভূমিকাটা কিছুতেই পালন করতে পারবে না। বরঞ্চ ও যদি বিদিশার ব্যাপারে হতাশাজনক আমাকে কিছু বলে দেয়, তাহলে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ব।
ফোনটা ধরলাম না। সুইচটা অফ না করে সাইলেন্ট মোড করে দিলাম। একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে শুক্লা। ওর ধৈর্য দেখে, আমিও রীতিমতন অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, হয় মেয়েটা আমার ভালো চাইছে, সত্যিকারের বন্ধু হয়ে এক বন্ধুর উপকার করতে চাইছে, নয়তো সে নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখছে, আমার স্বার্থটাকে নয়।
‘প্লীজ শুক্লা লিভ মি অ্যালোন। আমাকে একটু একা থাকতে দে। কেন তুই ফোন করে আমাকে বিরক্ত করছিস?’
বাড়ী থেকে বেরুবার সময়ও দেখেছি, শুক্লা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিল। আবার এখনও করে যাচ্ছে কনটেনিউসালি। যেন আমাকে ক্ষিপ্ত না করে ও এবারে ছাড়বে না।
অনেক বিরক্ত হয়েই শেষমেষে ওর ফোনটা ধরলাম। ঠিক করে নিলাম, বিদিশার ব্যাপারে শুক্লা যদি কিছু উচ্চবাচ্য করে প্রথমেই ওকে না করে দেবো, কথাই বলব না হয়তো। ফোনের লাইনটাও কেটে দেবো। ঠিক এই মূহূর্তে আমার মনোভাবটা এমনই কঠোর হওয়া দরকার। নিজেকে দূর্বল করলে চলবে না। বিদিশার প্রতি দুদিন অন্তত আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
ফোন ধরলাম, হ্যালোও বললাম। কিন্তু ভেতর থেকে সেই উদ্দীপনাটা এল না। শুক্লা আমাকে অবাক করে প্রথমেই বলল, ‘দেব, আমি কিন্তু মিনু নই। তুই কিন্তু আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছিস। এতবার করে তোকে ফোন করছি, ফোনটা অন্তত ধরবি তো? না শুক্লা বলে, তোর কেউ কোনদিন ছিল না। কলেজে শুভেন্দু, রনি সবাই তোর বন্ধু। আমি তোর কেউ নই।’
আমি কোন কথা বলছি না। শুক্লা বলল, ‘কি হল জবাব দে। কথা বলছিস না কেন?’
মনে হল, শুক্লা বোধহয় বিদিশার ব্যাপারে এবার কিছু বলবে। হয়তো কাল শুভেন্দুর বাড়ীতে কি হল, সেটাই জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে বিদিশা ওখানে এসেছিল কিনা? আমার সাথে বিদিশার কথা হল কিনা? বিদিশার জন্য আমি যে এখনও কাতর। এই ছটফটে মনটা নিয়ে কোথায় যাই? আমার ভালবাসার গভীরতা বোঝার মত ক্ষমতা যদি শুক্লার থাকতো-
ও বলল, ‘শোন, তোকে আমি এখন কিছুই বলব না। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখবি। কাল যখন আসতে পারিস নি। আজ অবশ্যই আমার ফ্ল্যাটে আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু ভীষন দূঃখ পাবো। যতদূর জানি, দেব কাউকে না বলে না। কাউকে ফেরায় না। অন্তত আমার এই অনুরোধটা তুই ফেলিস না। দেব প্লীজ। তোর পায়ে ধরে তোকে রিকোয়েস্ট করছি।’
আমি বললাম,‘আরে না, না। তুই এতকরে আমাকে রিকোয়েস্ট করছিস কেন বলতো? আমি কি তোকে না বলেছি? কাল তো শুভেন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বলেই তোর ওখানে যেতে পারিনি। তাই বলে কি আর যাব না কোনদিন? নিশ্চই যাবো।’
শুক্লা বলল, ভাবছিস আমি তোকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলব। তাই না?
আমি বললাম, ‘না, না। তা কেন হবে? তুই তো কালকেই-
-’হ্যাঁ। যা বলেছি। ওটার আর পুনরাবৃত্তি আমি করব না। তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলে, তোর মনকে আমি বিষিয়ে দিতে চাই না। শুক্লা দেবের খুব ভাল বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। ব্যাস। আর কিছু নয়। হ্যাপি? বল এবারে আসবি তো?
আমার যেন মনে হল, শুক্লা যেন আমার মনটাকে খুব ভালো করে পড়ে নিয়েছে। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বললে, আমি যে ওর বাড়ীতে যেতে আর আগ্রহ দেখাবো না। সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। শুক্লা ভাল করেই জানে, এতদিন বাদে বিদিশার পুনরাগমন, আমার কাছে একটা অক্সিজেনের মতন। ওর এই ফিরে আসার মধ্যে যতই রহস্য থাক। যতই বিদিশা আমার কাছে একটু সময় চেয়ে নিক, যতই আমার মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে যাক, একটা আশা নিয়ে দুদিন তো আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে বিদিশাই বা কি মুখ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে? শুভেন্দুকেই বা কি বলব? রনিকেই বা কি বলব তখন? আমি নিজে থেকেই বিদিশার ফিরে আসাটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে চির দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
একবার মায়ের কথাটা সে সময় খুব মনে হল। মা আমার জন্য খুব ভাবে, কষ্ট পায়। বিদিশাকে অর্জন করে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফোটানোটা দরকার।
শুক্লাকে বললাম, ‘যাবো তোর বাড়ী। কবে যেতে হবে বল? অফিস ফেরত একদিন চলে যাব তোর ফ্ল্যাটে।’
শুক্লা বলল, ‘না তুই আজকেই আসবি। আমি আজকেই তোকে আমার এখানে দেখতে চাই।’
ওকে বললাম, ‘আজকেই যাব? তাহলে তো অফিস ফেরত তোর ওখানে যেতে হয়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। তোর বাড়ী থেকে তো আর বেশী দূরে নয়। সল্টলেকে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে। একটা ট্যাক্সি নিবি। আর ঝটপট চলে আসবি।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া দাওয়ার আবার অ্যারেঞ্জ করবি না তো? মাকে কিন্তু কিছু বলে আসিনি। কাল এমনিতেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে অনেক খেয়েছি। আজ তোর ওখানে খেলে, মা বহূত চটে যাবে।’
শুক্লা বলল, ‘দেব, তোর আপত্তি থাকলে আমি তোকে জোর করব না। কিন্তু তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি। আমাকে আবার ফোন করতে বাধ্য করিস না।’
যেন নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। কিছুতেই আমাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না। আমিও শেষ পর্ষন্ত শুক্লাকে কথা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।