23-05-2020, 02:29 PM
(This post was last modified: 23-05-2020, 02:31 PM by kumdev. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
।দুই।।
করোলার প্রবাহের মত সময় বয়ে যায়।কমল-সঞ্জীব পত্র চালাচালি শুরু হয়ে গেছে।জমে উঠেছে প্রেম।দু-বছর কেটে যায়।দুজনেই ভালভাবে পাশ করে উচ্চ-মাধ্যমিক।কমলকলি শহরের ভাল কলেজে ভর্তি হল।গুরুজি ডেকে দেবজয়ীকে বললেন,বেটি আমার যা ছিল সব তোকে দিয়েছি,আর কিছু দেওয়ার নেই।আগে বাড়তে হলে তোকে কলকাত্তা যেতে হবে। দেবজয়ী পাড়ি দেয় স্বপ্ন শহর কলকাতায়,বহুবিধ উদ্দেশ্য মনে।প্রখ্যাত নৃত্যগুরু শিবপ্রসাদের কাছে নাড়া বাঁধা।দেবজয়ীর কাছে দুর্লভ সুযোগ।তবে হিরালাল সারখেলের সুপারিশ তাকে অনেকটা সাহায্য করে গুরুজির প্রসাদ লাভে।এবার মনপ্রাণ ঢেলে অনুশীলন।নৃত্য-জগতে এমন কেউ নেই শিবপ্রসাদ পট্টবর্ধনের নাম শুনে শ্রদ্ধায় যার মাথা নত হবেনা।
কমলকলির বাবা সরকারি চাকুরে।মা-বাবা আর দুটি বোনের স্বচ্ছল পরবার।দেবজয়ীর পরিবারে সেই স্বচ্ছলতা ছিল না।বাবা-মা আর সে মিলে সংসারে তিনটি প্রাণী।চিররুগ্ন বাবার শহরে ছিল ছোট্ট একটা রেডিমেড জামা-কাপড়ের দোকান।অসুস্থতার কারণে অর্ধেকদিন থাকতো বন্ধ।বসতবাড়ি দোকান-পাট দুঃসম্পর্কিয় আত্মীয়কে বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকদিনের বাসনা পুরনের জন্য চলে গেলেন কলকাতায়।খিদিরপুরে বস্তিমত অঞ্চলে ঘরভাড়া নিয়ে শুরু হল নতুন জীবন। জলপাইগুড়ি ছাড়ার দিন দুইবন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে কাঁদল কিছুক্ষন।তারপর গলার চেন বদল করে কমলকলি বলল,এভাবে আমরা দুজনে বাঁধা থাকবো দুজনের কাছে।কমলকলির গলায় এল রুহিতন আর দেবজয়ীর গলায় হরতন।কমলকলি বলল, মনে করে চিঠি দিস।
দেবজয়ী হেসে বলে,সঞ্জীবের খবর জানাতে ভুলিস না।
কমলকলি একমুহূর্ত চুপচাপ, কথাটা জয়ীকে বলবে কিনা ভাবে।জয়ী ওর প্রাণের বন্ধু, ইতস্তত করে বলল,জানিস জয়ী সঞ্জীবের সঙ্গে এখন কেটে গেছে।
চোখ বড় করে বলে জয়ী,তুই ত বলিস নি? কি হয়েছিল কি?
–বায়না দিন দিন বাড়ছিল।আড়ালে-আবডালে চুমু খেয়েছে মাই টিপেছে আমি কিছু বলিনি।তাও তৃপ্তি হয়নি,ঐসব করতে চায়।আমি বলে দিয়েছি,বিয়ের আগে একদম না।
–মনে আছে তোকে একদিন বলেছিলাম খেলতে-খেলতে একদিন—।
–আমি অত বোকা নই।সব ছেলের নজর আমাদের ঐটার দিকে–আহা! হাতেরমোয়া!তবে মৃন্ময় ছেলেটা অন্যরকম।
–সে আবার কে?
–এখন যার সঙ্গে প্রেম চলছে।হি-হি-হি! দারুন দেখতে ইংলিশ অনার্স পড়ে। জানিস তোর মত মৃণ্ময়েরও কবিতা লেখার বাতিক।কি সুন্দর লেখে,আমি অবশ্য বুঝতে পারি না।ভীষণ ভালবাসে আমাকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না–পাগল।
দেবজয়ী বলল,আসিরে গোছগাছ করতে হবে।দেবজয়ী ভাবে কে পাগল কে জানে।কমল খুব চঞ্চল প্রকৃতি।
বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে দেবজয়ী কলকাতার ট্রেনে চেপে বসে।ঠাই হল খিদিরপুরের একটা পুরানো আমলের বাড়ীতে।খিদিরপুর থেকে আলিপুর গিয়ে নিয়মিত গুরুজির তত্ত্বাবধানে নৃত্যশিক্ষার তালিম নেয়।নাচ তার ধ্যান-জ্ঞান সবটুকু নিংড়ে দিতে চায়।সেজন্য বাড়ির কাছে সাধারণ একটা কলেজে ভর্তি হয়।কমল পড়ে সাম্মানিক অর্থনীতি।কলকাতায় এসে বাবার শরীর ভেঙ্গেছে।মেয়ের সাধনার কথা ভেবে যা করেছেন সেটা এখন মনে হচ্ছে ভুল।মেয়েকে সেকথা বলেন না।জমা টাকা যা ছিল--সে আর কতো? দিন আর চলতে চায় না।মার ছিল সেলাইয়ের শখ এখন সেই সেলাই কাজে আসছে।এদিক-ওদিক সেলাই ফোড়াই করে ঘরে আসছে কিছু টাকা।গুরুজি একটা টিউশন ঠিক করে দিয়েছেন, মেয়েটিকে নাচ শিখিয়ে জয়ীও কিছু উপার্জন করে।
এতকষ্টের মধ্যেও যখন সেই দীর্ঘদেহী কাধ পর্যন্ত বাবরিচুল টানা-টানা চোখ গুরুজির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেবজয়ী শরীর মনে ফিরে পায় এক নতুন উদ্যম।তখন অভাব অনটন সামনে এসে দাঁত খিচিয়ে ভয় দেখাতে পারে না।শরীরের প্রতিটী মাশল চনমন করে ওঠে।
কমলের চিঠি আসে জমজমাট চলছে প্রেম।দুজন কোরালের ধারে গিয়ে কত স্বপ্নের গল্প করে।দেবজয়ীর কথাও ওঠে ওদের আলোচনায়।এখানে কোরাল নেই কিন্তু গঙ্গা আছে।গঙ্গার ধারে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় দেবজয়ী।
জোর কদমে চলছে নাচ পরীক্ষার পর আমেদাবাদে যেতে হবে।যাতায়াত সহ দিন সাতেকের প্রোগ্রাম সেখানে।গুরুজি বিদেশি ট্যুর কমিয়ে দিয়েছেন।বাবা মাকে প্রণাম করে আশির্বাদ নিয়ে আমেদাবাদের ট্রেনে চেপে বসল।ফিরল দিন সাতেক পর সঙ্গে নিয়ে এল প্রচুর খ্যাতি নিয়ে,বিভিন্ন সংবাদ পত্রে ভুয়সী প্রশংসা বেরোল ছবি সহ।বাড়িতে পা দিতে শুনলো,বাবা নেই,মারা গেছেন তিনদিন আগে।
সাধক-সাধিকাদের সহজে বিচলিত হলে চলে না।শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটলে জোর কদমে চলল অনুশিলন।অনেক পথ পেরোতে হবে তাকে।তুচ্ছ শোকতাপে ডুবে থাকার মত বিলাসিতা তাকে মানায় না।
কমল বাবার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে দুঃখ করল।মৃন্ময়ের সঙ্গে বিয়ের কথা বার্তা চলছে।কুঞ্জ উকিলের বকাটে গেজেল ছেলে সুভাষও তাকে প্রেম নিবেদন করেছে।হি-হি-হি!এইসব নানাকথায় ভরা চিঠি পেল কমলের।
কুঞ্জ উকিল শহরের নামকরা উকিল একডাকে চেনে সবাই।ওনার কি রকম বোন মনোরমা বিবাহ বিচ্ছিন্না।শোনা যেত সুভাষের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।একদিন সুভাষের পিসি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল চাকদা না কোথায় খোরপোষের টাকায় ভরসা করে।
মার সেলাই-ফোড়াইয়ের টাকায় সংসার চলা দায় হয়ে উঠল।কি করবে এখন দেবজয়ী? ঘরে জমা হয়েছে দিনের পর দিন নানা ধরনের প্রাইজ তা দিয়ে সংসার চলেনা।নাচে ঢিলেমি আসে,গুরুজি তিরস্কার করেন,আবার বোঝান 'মা ঈশ্বর তোমার উপর করুণা করেছেন তাকে তুমি অবহেলা কোরনা। জীবনে বাধা বিঘ্ন আসবে তাকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যেতে হবে সাধনা।ধ্যান করো মা ধ্যান করো।'বড় বড় মানুষের উদাহরণ দিলেন তারা কিভাবে কষ্ট করে দারিদ্রকে জয় করে খ্যাতির চুড়ায় আরোহণ করেছিলেন।গুরুজির কথায় আলোর আভাস থাকলেও অন্ধকার কাটতে চায় না।তার মধ্যেও বাড়িতে চলতে থাকে অনুশিলন–তা-ধিন-ধিন-তাক..তা-ধিন-ধিন-তাক।গুরুজির সুপারিশে ডাক পেল এক জলসায়।কিছু দক্ষিণা সহ গাড়ি করে নিয়ে যাবে আবার পৌছে দিয়ে যাবে।যে ছেলেটি নিতে এল তার নাম তপন।তার নাচ দেখে মুগ্ধ,ফেরার পথে নানা কথা হল ট্যাক্সিতে।অনুষ্ঠানের কর্ম কর্তাদের একজন।জলসা মিটে গেলেও তপন যোগাযোগ রেখেছিল।ভদ্র ব্যবহার শিল্পানুরাগী,ছোক ছোক ভাব নেই,দেখতে শুনতে মন্দ না।বাড়িতে এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেত,মাকে বলতো মাসিমা।নিত্য যাতায়াত ছিল বাড়িতে।
কমলের চিঠি এল।'মৃন্ময় আগে একদিন দেখা না হলে থাকতে পারতো না।এখন এড়িয়ে চলে।চুমু খেয়ে কষ নিয়েছি কিন্তু রস নিইনি।সবার বোকাচোদার গানের এক সুর।সঞ্জীবকে মনে আছে?মিচকেটা এত হারামি আমার প্রেমপত্রের গোছা নিয়ে দেখিয়েছে মৃন্ময়ের মাকে।বলেছে একসঙ্গে নাকি শুয়েছে।ওর মা বলেছে প্রান থাকতে অমন মেয়েকে ঘরে নেবে না।আমি নাকি দুশ্চরিত্র।মেনিমুখো মৃন্ময় মায়ের অবাধ্য হতে পারবে না শালা মাতৃভক্ত হনুমান।বোকাচোদা প্রেম করার সময় মায়ের অনুমতি নিয়েছিলি?'
মনটা খারাপ হয়ে গেল কি করতো মেয়েটা বিয়ের জন্য।শেষে ওর কপালে কি না এই? দেবজয়ী ভাবে কে জানে তার কপালে কি আছে?তপন একটা নাচের টিউশনি ধরিয়ে দিয়েছে ওদের পাড়ায়।গুরুজির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে ঘিরে বসে আছে,উনি কি বলছেন।
নৃত্যকলা অতি প্রাচীন বিদ্যা।রাজা-জমিদার নাচের আসর বসাতেন।পুরানেও এই বিদ্যার কথা পাবে। দেব সভায় নৃত্য প্রদর্শন করা হত।বহু মুনি-ঋষি এমন কি দেবতাদেরো ধ্যান ভেঙ্গে দিতে পারতো নৃত্য পটিয়সী অপ্সরারা।সে জন্য অভিশাপ কুড়োতে হয়েছে কম না।একবার রাজর্ষি বিশ্বামিত্র কঠোর তপস্যায় রত।অপরুপা মেনকা দেব নির্দেশে নৃত্য প্রদর্শন করলেন।নৃত্যের ছটায় ধ্যান ভেঙ্গে মিলিত হলেন ঋষিবর।পরিনামে সৃষ্টি হল শকুন্তলা…।দেবজয়ীর দিকে তাকালেন গুরুজি তারপর সবাইকে বললেন,আজ যাও।
সবাই চলে গেল।দেবজয়ী প্রণাম করল।গুরুজির গমগমে গলা শোনা গেল, বেটি তীরে এসেও তরী ভাসিয়ে রাখতে পারলি না?
–গুরুজি নাচ ছাড়া আমি বাঁচবো না।
–নটরাজের কৃপা! গুরুজি চলে গেলেন ভিতরে।একটু দাঁড়িয়ে থেকে দেবজয়ী বাসায় ফিরে এল।
মাসখানেক পর আবার কমলের চিঠি।'সুভাষকে বিয়ে করছি।অনেক করে ধরেছে।না বলতে পারলাম না।কথা দিয়েছে গাঁজা ছেড়ে দেবে।কাউকে নেমন্তন্ন করিনি কুঞ্জ উকিল খুব খুশি।সামনের সতেরো তারিখ দার্জিলিং মেলে শিয়ালদা পৌছাবো,হনিমুনে যাচ্ছি চাঁদিপুর।স্টেশনে থাকিস।
সংক্ষিপ্ত চিঠি।গেজেলটাকে বিয়ে করছে?লেখাপড়াও বেশি করেনি।চাকরি-বাকরি কি করে কিছু বলেনি।খাওয়াবে কি?করার মধ্যে একটা কাজ করত গাঁজা খাওয়া তাও নাকি ছেড়ে দেবে তাহলে সারাদিন করবেটা কি?
করোলার প্রবাহের মত সময় বয়ে যায়।কমল-সঞ্জীব পত্র চালাচালি শুরু হয়ে গেছে।জমে উঠেছে প্রেম।দু-বছর কেটে যায়।দুজনেই ভালভাবে পাশ করে উচ্চ-মাধ্যমিক।কমলকলি শহরের ভাল কলেজে ভর্তি হল।গুরুজি ডেকে দেবজয়ীকে বললেন,বেটি আমার যা ছিল সব তোকে দিয়েছি,আর কিছু দেওয়ার নেই।আগে বাড়তে হলে তোকে কলকাত্তা যেতে হবে। দেবজয়ী পাড়ি দেয় স্বপ্ন শহর কলকাতায়,বহুবিধ উদ্দেশ্য মনে।প্রখ্যাত নৃত্যগুরু শিবপ্রসাদের কাছে নাড়া বাঁধা।দেবজয়ীর কাছে দুর্লভ সুযোগ।তবে হিরালাল সারখেলের সুপারিশ তাকে অনেকটা সাহায্য করে গুরুজির প্রসাদ লাভে।এবার মনপ্রাণ ঢেলে অনুশীলন।নৃত্য-জগতে এমন কেউ নেই শিবপ্রসাদ পট্টবর্ধনের নাম শুনে শ্রদ্ধায় যার মাথা নত হবেনা।
কমলকলির বাবা সরকারি চাকুরে।মা-বাবা আর দুটি বোনের স্বচ্ছল পরবার।দেবজয়ীর পরিবারে সেই স্বচ্ছলতা ছিল না।বাবা-মা আর সে মিলে সংসারে তিনটি প্রাণী।চিররুগ্ন বাবার শহরে ছিল ছোট্ট একটা রেডিমেড জামা-কাপড়ের দোকান।অসুস্থতার কারণে অর্ধেকদিন থাকতো বন্ধ।বসতবাড়ি দোকান-পাট দুঃসম্পর্কিয় আত্মীয়কে বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকদিনের বাসনা পুরনের জন্য চলে গেলেন কলকাতায়।খিদিরপুরে বস্তিমত অঞ্চলে ঘরভাড়া নিয়ে শুরু হল নতুন জীবন। জলপাইগুড়ি ছাড়ার দিন দুইবন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে কাঁদল কিছুক্ষন।তারপর গলার চেন বদল করে কমলকলি বলল,এভাবে আমরা দুজনে বাঁধা থাকবো দুজনের কাছে।কমলকলির গলায় এল রুহিতন আর দেবজয়ীর গলায় হরতন।কমলকলি বলল, মনে করে চিঠি দিস।
দেবজয়ী হেসে বলে,সঞ্জীবের খবর জানাতে ভুলিস না।
কমলকলি একমুহূর্ত চুপচাপ, কথাটা জয়ীকে বলবে কিনা ভাবে।জয়ী ওর প্রাণের বন্ধু, ইতস্তত করে বলল,জানিস জয়ী সঞ্জীবের সঙ্গে এখন কেটে গেছে।
চোখ বড় করে বলে জয়ী,তুই ত বলিস নি? কি হয়েছিল কি?
–বায়না দিন দিন বাড়ছিল।আড়ালে-আবডালে চুমু খেয়েছে মাই টিপেছে আমি কিছু বলিনি।তাও তৃপ্তি হয়নি,ঐসব করতে চায়।আমি বলে দিয়েছি,বিয়ের আগে একদম না।
–মনে আছে তোকে একদিন বলেছিলাম খেলতে-খেলতে একদিন—।
–আমি অত বোকা নই।সব ছেলের নজর আমাদের ঐটার দিকে–আহা! হাতেরমোয়া!তবে মৃন্ময় ছেলেটা অন্যরকম।
–সে আবার কে?
–এখন যার সঙ্গে প্রেম চলছে।হি-হি-হি! দারুন দেখতে ইংলিশ অনার্স পড়ে। জানিস তোর মত মৃণ্ময়েরও কবিতা লেখার বাতিক।কি সুন্দর লেখে,আমি অবশ্য বুঝতে পারি না।ভীষণ ভালবাসে আমাকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না–পাগল।
দেবজয়ী বলল,আসিরে গোছগাছ করতে হবে।দেবজয়ী ভাবে কে পাগল কে জানে।কমল খুব চঞ্চল প্রকৃতি।
বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে দেবজয়ী কলকাতার ট্রেনে চেপে বসে।ঠাই হল খিদিরপুরের একটা পুরানো আমলের বাড়ীতে।খিদিরপুর থেকে আলিপুর গিয়ে নিয়মিত গুরুজির তত্ত্বাবধানে নৃত্যশিক্ষার তালিম নেয়।নাচ তার ধ্যান-জ্ঞান সবটুকু নিংড়ে দিতে চায়।সেজন্য বাড়ির কাছে সাধারণ একটা কলেজে ভর্তি হয়।কমল পড়ে সাম্মানিক অর্থনীতি।কলকাতায় এসে বাবার শরীর ভেঙ্গেছে।মেয়ের সাধনার কথা ভেবে যা করেছেন সেটা এখন মনে হচ্ছে ভুল।মেয়েকে সেকথা বলেন না।জমা টাকা যা ছিল--সে আর কতো? দিন আর চলতে চায় না।মার ছিল সেলাইয়ের শখ এখন সেই সেলাই কাজে আসছে।এদিক-ওদিক সেলাই ফোড়াই করে ঘরে আসছে কিছু টাকা।গুরুজি একটা টিউশন ঠিক করে দিয়েছেন, মেয়েটিকে নাচ শিখিয়ে জয়ীও কিছু উপার্জন করে।
এতকষ্টের মধ্যেও যখন সেই দীর্ঘদেহী কাধ পর্যন্ত বাবরিচুল টানা-টানা চোখ গুরুজির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেবজয়ী শরীর মনে ফিরে পায় এক নতুন উদ্যম।তখন অভাব অনটন সামনে এসে দাঁত খিচিয়ে ভয় দেখাতে পারে না।শরীরের প্রতিটী মাশল চনমন করে ওঠে।
কমলের চিঠি আসে জমজমাট চলছে প্রেম।দুজন কোরালের ধারে গিয়ে কত স্বপ্নের গল্প করে।দেবজয়ীর কথাও ওঠে ওদের আলোচনায়।এখানে কোরাল নেই কিন্তু গঙ্গা আছে।গঙ্গার ধারে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় দেবজয়ী।
জোর কদমে চলছে নাচ পরীক্ষার পর আমেদাবাদে যেতে হবে।যাতায়াত সহ দিন সাতেকের প্রোগ্রাম সেখানে।গুরুজি বিদেশি ট্যুর কমিয়ে দিয়েছেন।বাবা মাকে প্রণাম করে আশির্বাদ নিয়ে আমেদাবাদের ট্রেনে চেপে বসল।ফিরল দিন সাতেক পর সঙ্গে নিয়ে এল প্রচুর খ্যাতি নিয়ে,বিভিন্ন সংবাদ পত্রে ভুয়সী প্রশংসা বেরোল ছবি সহ।বাড়িতে পা দিতে শুনলো,বাবা নেই,মারা গেছেন তিনদিন আগে।
সাধক-সাধিকাদের সহজে বিচলিত হলে চলে না।শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটলে জোর কদমে চলল অনুশিলন।অনেক পথ পেরোতে হবে তাকে।তুচ্ছ শোকতাপে ডুবে থাকার মত বিলাসিতা তাকে মানায় না।
কমল বাবার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে দুঃখ করল।মৃন্ময়ের সঙ্গে বিয়ের কথা বার্তা চলছে।কুঞ্জ উকিলের বকাটে গেজেল ছেলে সুভাষও তাকে প্রেম নিবেদন করেছে।হি-হি-হি!এইসব নানাকথায় ভরা চিঠি পেল কমলের।
কুঞ্জ উকিল শহরের নামকরা উকিল একডাকে চেনে সবাই।ওনার কি রকম বোন মনোরমা বিবাহ বিচ্ছিন্না।শোনা যেত সুভাষের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।একদিন সুভাষের পিসি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল চাকদা না কোথায় খোরপোষের টাকায় ভরসা করে।
মার সেলাই-ফোড়াইয়ের টাকায় সংসার চলা দায় হয়ে উঠল।কি করবে এখন দেবজয়ী? ঘরে জমা হয়েছে দিনের পর দিন নানা ধরনের প্রাইজ তা দিয়ে সংসার চলেনা।নাচে ঢিলেমি আসে,গুরুজি তিরস্কার করেন,আবার বোঝান 'মা ঈশ্বর তোমার উপর করুণা করেছেন তাকে তুমি অবহেলা কোরনা। জীবনে বাধা বিঘ্ন আসবে তাকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যেতে হবে সাধনা।ধ্যান করো মা ধ্যান করো।'বড় বড় মানুষের উদাহরণ দিলেন তারা কিভাবে কষ্ট করে দারিদ্রকে জয় করে খ্যাতির চুড়ায় আরোহণ করেছিলেন।গুরুজির কথায় আলোর আভাস থাকলেও অন্ধকার কাটতে চায় না।তার মধ্যেও বাড়িতে চলতে থাকে অনুশিলন–তা-ধিন-ধিন-তাক..তা-ধিন-ধিন-তাক।গুরুজির সুপারিশে ডাক পেল এক জলসায়।কিছু দক্ষিণা সহ গাড়ি করে নিয়ে যাবে আবার পৌছে দিয়ে যাবে।যে ছেলেটি নিতে এল তার নাম তপন।তার নাচ দেখে মুগ্ধ,ফেরার পথে নানা কথা হল ট্যাক্সিতে।অনুষ্ঠানের কর্ম কর্তাদের একজন।জলসা মিটে গেলেও তপন যোগাযোগ রেখেছিল।ভদ্র ব্যবহার শিল্পানুরাগী,ছোক ছোক ভাব নেই,দেখতে শুনতে মন্দ না।বাড়িতে এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেত,মাকে বলতো মাসিমা।নিত্য যাতায়াত ছিল বাড়িতে।
কমলের চিঠি এল।'মৃন্ময় আগে একদিন দেখা না হলে থাকতে পারতো না।এখন এড়িয়ে চলে।চুমু খেয়ে কষ নিয়েছি কিন্তু রস নিইনি।সবার বোকাচোদার গানের এক সুর।সঞ্জীবকে মনে আছে?মিচকেটা এত হারামি আমার প্রেমপত্রের গোছা নিয়ে দেখিয়েছে মৃন্ময়ের মাকে।বলেছে একসঙ্গে নাকি শুয়েছে।ওর মা বলেছে প্রান থাকতে অমন মেয়েকে ঘরে নেবে না।আমি নাকি দুশ্চরিত্র।মেনিমুখো মৃন্ময় মায়ের অবাধ্য হতে পারবে না শালা মাতৃভক্ত হনুমান।বোকাচোদা প্রেম করার সময় মায়ের অনুমতি নিয়েছিলি?'
মনটা খারাপ হয়ে গেল কি করতো মেয়েটা বিয়ের জন্য।শেষে ওর কপালে কি না এই? দেবজয়ী ভাবে কে জানে তার কপালে কি আছে?তপন একটা নাচের টিউশনি ধরিয়ে দিয়েছে ওদের পাড়ায়।গুরুজির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে ঘিরে বসে আছে,উনি কি বলছেন।
নৃত্যকলা অতি প্রাচীন বিদ্যা।রাজা-জমিদার নাচের আসর বসাতেন।পুরানেও এই বিদ্যার কথা পাবে। দেব সভায় নৃত্য প্রদর্শন করা হত।বহু মুনি-ঋষি এমন কি দেবতাদেরো ধ্যান ভেঙ্গে দিতে পারতো নৃত্য পটিয়সী অপ্সরারা।সে জন্য অভিশাপ কুড়োতে হয়েছে কম না।একবার রাজর্ষি বিশ্বামিত্র কঠোর তপস্যায় রত।অপরুপা মেনকা দেব নির্দেশে নৃত্য প্রদর্শন করলেন।নৃত্যের ছটায় ধ্যান ভেঙ্গে মিলিত হলেন ঋষিবর।পরিনামে সৃষ্টি হল শকুন্তলা…।দেবজয়ীর দিকে তাকালেন গুরুজি তারপর সবাইকে বললেন,আজ যাও।
সবাই চলে গেল।দেবজয়ী প্রণাম করল।গুরুজির গমগমে গলা শোনা গেল, বেটি তীরে এসেও তরী ভাসিয়ে রাখতে পারলি না?
–গুরুজি নাচ ছাড়া আমি বাঁচবো না।
–নটরাজের কৃপা! গুরুজি চলে গেলেন ভিতরে।একটু দাঁড়িয়ে থেকে দেবজয়ী বাসায় ফিরে এল।
মাসখানেক পর আবার কমলের চিঠি।'সুভাষকে বিয়ে করছি।অনেক করে ধরেছে।না বলতে পারলাম না।কথা দিয়েছে গাঁজা ছেড়ে দেবে।কাউকে নেমন্তন্ন করিনি কুঞ্জ উকিল খুব খুশি।সামনের সতেরো তারিখ দার্জিলিং মেলে শিয়ালদা পৌছাবো,হনিমুনে যাচ্ছি চাঁদিপুর।স্টেশনে থাকিস।
সংক্ষিপ্ত চিঠি।গেজেলটাকে বিয়ে করছে?লেখাপড়াও বেশি করেনি।চাকরি-বাকরি কি করে কিছু বলেনি।খাওয়াবে কি?করার মধ্যে একটা কাজ করত গাঁজা খাওয়া তাও নাকি ছেড়ে দেবে তাহলে সারাদিন করবেটা কি?