Thread Rating:
  • 4 Vote(s) - 3 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
জীবন যে রকম by লেখক (collected and incomplete)
#15
শুক্লা বলল, ‘আমি তখন অলরেডী ফ্ল্যাটের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন স্যানকসন্ পেয়ে গেছি। ও আর আমি বিয়ের পর ভাড়াবাড়ীতে থাকতাম। শ্বাশুড়ি মায়ের আপত্তি হল, জামশেদপুরে যখন নিজেদের বাড়ী রয়েছে, তখন লোন টোন নিয়ে আবার এসব ফ্ল্যাট কেনা কেন? তাহলে তো ওই বাড়ীটাও শেষমেষ দেখার কেউ থাকবে না। আমার শশুড় শাশুড়ীর যখন জামশেদপুরে বাড়ী রয়েছে, তখন এসব ফ্ল্যাট ট্যাট কেনার কোন দরকার নেই। আমার বর প্রথমে মায়ের কথাটার কোনো গুরুত্ব দেয় নি। পরে দেখি ও মায়ের কথায় তাল দিচ্ছে। ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, আপনারা নিজেদের কথা চিন্তা করেন। আমার বাবা মায়ের জন্যও তো আমাকে কিছু ভাবতে হবে। মা বাবা এতকাল ধরে ভাড়া বাড়ীতে রয়েছেন, তাদেরকে যদি আমি নিজের ফ্ল্যাটে এনে তুলি। অসুবিধেটা কি?’
শাশুড়ী বলল, তার মানে তুমি ফ্ল্যাট নিতে চাইছ নিজের বাবা মায়ের জন্য? নিজেদের কথা ভেবে নয়?
ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, বাবা মা কি চিরকাল থাকবেন? তারপর তো ওই ফ্ল্যাট আমাদেরই হবে। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে চাইছেন না?
আমার শাশুড়ী তারপরেও বিশ্রী ভাবে বেঁকে বসলো।
আমি শুক্লাকে বললাম, ‘এটাই কি তোদের বিচ্ছেদের কারণ?’
শুক্লা বলল, না, এরপরেও জল অনেকদূর গড়ালো। ও হঠাৎই জামশেদপুরে চলে গেল কয়েকদিনের জন্য। অফিস থেকে ছুটী নিল। বলল, বাবা মা দুজনেরই খুব শরীর খারাপ। আমাকে ওনাদের পাশে থাকতে হবে। আমি বললাম, আমি কি যাব তোমার সাথে? ও বলল, না তুমি থাকো। তাহলে তোমাকেও তো আবার ছুটী নিতে হবে।
আমি শুক্লাকে বললাম, তারপর?
শুক্লা বলল, সেই যে গেল, তারপরে দেখি আর আসার নামই করে না। আমি এদিকে রোজ ফোন করছি, ওর কাছে খবরাখবর নিচ্ছি। সেই একই কথা। না আমার এখন কলকাতায় ফেরার কোন ইচ্ছা নেই।
আমি বললাম, সেকী? তোর প্রতি ওর টানটা তাহলে চলে গেল? বিয়ে কেন করেছিল?
শুক্লা বলল, সেটাই তো কথা। বাবু চাকরি ছেড়ে একেবারে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছেন। ওসব শরীর টরীর খারাপ মিথ্যে কথা। মোদ্দা কথা হল, উনি চাকরী আর করবেন না। জামশেদপুরে দোকান খুলে ব্যাবসা করবেন।
আমি বললাম, তারপর?
শুক্লা বলল, তারপর আর কি? আমার এদিকে চিন্তা বাড়ছে। বাবা মাও চিন্তা করছে আমাকে নিয়ে। ফ্ল্যাটে আমি একা। রোজ শুধু অফিস করছি, কিন্তু মন আমার একেবারেই ভাল নেই। ঠিক করলাম ভাড়া বাড়ীটা আমি ছেড়ে দেবো। বাবা মায়ের কাছেই আবার ফিরে যাব। ততদিনে সল্টলেকের আমার এই নতুন ফ্ল্যাটটাও তখন তৈরী হতে শুরু করেছে। আমি বায়নাও অলরেডী করে দিয়েছি। ঠিক করলাম, ফ্ল্যাট কমপ্লিট হয়ে গেলে বাবা মাকে নিয়ে আমি এখানে চলে আসব।
আমি বললাম আর তোর বর?
শুক্লা বলল, ‘শেষ চেষ্টা একটা করলাম। ওকে ফোন করে আমি ট্রেন ধরে একাই চলে গেলাম জামশেদপুর। ভেতরে ভেতরে রাগটাকেও আমি প্রশমিত করে ফেলেছি। একবার ওকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করব,এই আশা নিয়ে আমি জামশেদপুর রওনা দিলাম। সারাটা রাত্রি আমার ট্রেনে ঘুম এল না। কি হয় কি হয় একটা দুশ্চিন্তা মনে কাজ করছে। আমার সব আশায় জল ঢেলে দিল, আমার শশুড় শাশুড়ী। আমার বরও তখন তার বাবা মায়ের কবলে। কিছুতেই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে রাজী হল না। উল্টে আমাকে বলে বসল, তুমি চলে এসো জামশেদপুরে। দরকার হলে ট্র্যানস্ফার নিয়ে নাও। চাকরী ছেড়ে দাও। কলকাতার প্রতি তোমার অত মায়া কেন?’
আমি চেয়ে আছি শুক্লার মুখের দিকে।
শুক্লা বলল, ‘তুই বল দেব? বাবা মাকে একা ফেলে, ওনাদেরকে ছেড়ে এভাবে কি চলে যাওয়া যায়? বিয়ের আগে আমি শর্তই করে নিয়েছিলাম। বাবা মাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও কিন্তু যেতে পারব না। সেটা সম্ভব নয়। সব শর্তে রাজী হল। অথচ বিয়ের পর, তিনি একেবারে পাল্টে গেলেন।’
শু্ক্লাকে বললাম, কতবছর ঘর করেছিলিস তোরা?
শুক্লা বলল, মাত্র একবছর।
আমি বললাম, মাত্র একবছরেই সব শেষ হয়ে গেল?
শুক্লা বলল, আমি শেষ করে দিতে চাইনি দেব। ওই আমাকে বাধ্য করল। কোর্ট থেকে আমাদের ছমাস সময় দিল। এই ছমাসেও তিনি মনোভাব চেঞ্জ করলেন না। বাধ্য হয়েই মিউচাল ডিভোর্সটা আমাদের করে নিতে হল।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুক্লা বলল, দেখ, এতকিছু করলাম। সেই বাবা মায়ের জন্যই আমি এত লড়াই করলাম। অথচ বাবা আর মা, দুজনকেই আমি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলাম না। আমার জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল।বাবা মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।
আমি শুক্লার চোখে আবার জল দেখলাম, যেন ভাঙাচোরা একটা জীবনের মতন জীবনটাকে জোড়া লাগানোর সব প্রচেষ্টাই শুক্লার ব্যর্থ হয়ে গেছে। নতুন ভাবে বাঁচার উৎস খুঁজছে। কিন্তু অসুখী নারীমন তাকে যেন চরম বিশাদে ভরিয়ে তুলেছে।
আমার দিকে চেয়ে অনেক কষ্টে মুখে আবার হাসিটা ফেরত আনার চেষ্টা করল শুক্লা। আমাকে বলল, ‘আমি কিন্তু তোর বিয়েতে খুব আনন্দ করব দেব। বিদিশার সঙ্গে যদি তোর বিয়েটা হয়, তাহলে খুব মজা করব, গাইবো নাচবো। তোকে আর বিদিশাকে নিয়ে খুনসুটী করব। সারারাত হৈ হুল্লোর হবে। বাসরে মজা হবে। এই শু্ক্লাকে দেখে তুই তখন চিন্তেই পারবি না। কি আমি ঠিক বলছি তো দেব?’
আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি শুক্লার দিকে। ভাবছি, জীবনের নানা রং দেখতে যারা অভ্যস্ত। তারা কি এই রংয়ের সাথে কোন রংকে মেলাতে পারবে? এ আমি কি দেখছি? ভালোবাসার রং কি এরকমও হয়? না, আমার মাথা আর কোনো কাজ করছে না। এবারে মনে হচ্ছে, শুক্লাকেই আমাকে পরিষ্কার করে আসল কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই হবে। শুক্লা তাহলে কি তুই?-
মনে হল, শুক্লা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ওর প্রতি আমার যে ধারনাটা তৈরী হয়েছে সেটাকে নির্মূল করার। যেন অভিনয় নয়, ভেতর থেকে খুশি আর আনন্দ ফেটে পড়ছে। আমার মনের মধ্যে যাতে কোন আশংকা বাসা না বেঁধে থাকে, তার জন্য নিজেই এবার প্রাণখুলে হাসতে লাগল শুক্লা। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, আর বলতে লাগল, ‘আমি কিন্তু তোর রকমটা খালি দেখছিলাম। যেই তোকে ভালবাসার কথা বলেছি, অমনি তোর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আরে বাবা। আমি কি অতই বোকা? যে বিদিশার জায়গাটা শুধু শুধু নিতে যাব? তুই বুঝি বিদিশাকে ছেড়ে আমাকে ভালবাসতে শুরু করে দিবি? আর আমার কথাটাও সত্যি মেনে নিবি। ওতো আমি এমনি বলছিলাম। তোকে একটু পরখ করে দেখছিলাম, আর কি? তোর সাথে একটু মজা করব না তো কি করব বল? কলেজের দিনগুলোর কথা কি তুই ভুলে গেলি?’
মনে মনে বললাম, সব কিছু যে মজা করে হয় না শুক্লা। তোর মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে এখন। তুই যেটা বলতে চেয়েছিলিস, সেটা বলেও তুই কথাটা ঘুরিয়ে নিয়েছিস। তোর মনের ইচ্ছাটা আমি তখুনি বুঝে নিয়েছি।
শুক্লা আবার আমার কাছে এল। আমাকে বলল, ‘বিদিশার কথা কিছু একটু বলবি তো? কাল শুভেন্দুদের বাড়ীতে বিদিশা এসেছিল কিনা তাও বললি না। শুধু এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে? কেন আমাকে বলতে কি তোর কোন অসুবিধে আছে?’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপরে বললাম, ‘শুক্লা, আমাকে বড় বিপদে ফেলে দিলি তুই। এ তুই কি করলি বলতো? আমাকে বাড়ীতে ডেকে এনে মনের কথাটা বলে ফেললি। কোনদিন ভেবে দেখেছিস? আমি তোকে সেভাবে, কখনো-
শুক্লা আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আমি জানি দেব। জোর করে কিছু হয় না। ভালবাসা প্রেম এগুলো তো ছেলেখেলা নয়। এই করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। আবার করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। ওই ভুল আমি জীবনে একবারই করেছি। কিন্তু তুই কেন করতে যাবি দেব? আমার জন্য তুই বিদিশার ভালবাসাটাকে ভুলে যাবি? এতদিন বাদে যে বিদিশা ফিরে এল, তার কি কোন দাম থাকবে না তোর কাছে? ও আমি ভুল করে ফেলেছি, দেব। একেবারে নির্বোধের মতন কাজ করে ফেলেছি। তুই প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি সরি ভীষন সরি। প্লীজ দেব।’
আমি আবার চেয়ে রইলাম শুক্লার মুখের দিকে। শুক্লা বলল, ‘কাল কি জানি কি মনে হল, বোকার মতন শুভেন্দুকেও কিছু খারাপ কথা বলে দিলাম, বিদিশার সন্মন্ধে। পরে নিজেরই আমার অনুশোচনা হল। ভাবলাম, এ আমি কি করলাম? শুভেন্দু নিশ্চই খারাপ ভাবলো আমাকে।’
আমি বললাম, কি বলেছিস তুই শুভেন্দুকে? বিদিশা সন্মন্ধে কিছু বলেছিস?
শুক্লা আবার এড়িয়ে যেতে লাগল, আমার কাছে। আমাকে বলল, ‘না আমি বলব না। কিছুই বলব না। তুই খালি আমাকে খোঁচাচ্ছিস। জানিস তোর মনের কি অবস্থা হবে এটা শুনলে। আমি তোর চোখে আরো খারাপ হবো। এটাই কি তুই চাস?’
এমন একটা শর্তে ফেলে দিল শুক্লা। আমার শোনার আগ্রহটা পুরোপুরি চলে গেল। মনে হল, যে ঝড়টা আমার মনের ভেতর দিয়ে এখন বইছে, আমি সত্যি বিদিশার সন্মন্ধে কোন খারাপ কথা শুনতে পারব না। যেটা সত্যি সেটাও মানতে পারব না। হয়তো মুখ ভার করে এক্ষুনি আমাকে চলে যেতে হবে শুক্লার এখান থেকে। আর কোনদিন শুক্লার মুখদর্শনও আমি করব না।
ও বলল, ‘জেনে রাখ দেব, বিদিশা যতই ভুল করুক। বা যতই তোর ভালবাসাকে ঠুকরে সে চলে যাক। এতদিন বাদে সে যখন ফিরে এসেছে। তাকে তাকে ক্ষমা করে দিতেই হবে। আমি যদি বিদিশার জায়গায় থাকতাম, তুই করতিস না?’
মনে মনে বললাম, কিন্তু তুই তো আমার বাড়ীতে কাল অন্যকথাই-
শুক্লা বলল, ‘বিদিশা ভীষন ভালো মেয়ে। হয়তো পরিস্থিতির চাপেই ওকে বিয়েটা তখন মেনে নিতে হয়েছিল। আমাকে ও সবই বলেছে। তোর ভালবাসার দামও সেভাবে ও দিতে পারেনি। কিন্তু সবাই তো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। এতদিন বাদে যখন তোর কাছেই আবার ফিরে এসেছে। সেই সুযোগ কি তুই ওকে দিবি না, বল?’
মনে মনে বললাম, সুযোগ তো আমি দিতে চাই। কিন্তু বিদিশা নিজেই তো-
কালকের বিদিশার শেষ কথাটা শুক্লাকে বলতে গিয়েও আমি বলতে পারলাম না। শুক্লা বলল, ‘আমি জানি দেব, তোর মনের ভেতরে এখন যে ঝড়টা বইছে। বিদিশার সাথে যতক্ষণ না তোর দেখা হবে এই ঝড় থামবে না। তুই বিদিশাকে একটা ফোন কর। ওকে তোর বাড়ীতে ডেকে নে। নয় তুই ওর কাছে চলে যা।’
মুখটা নিচু করে ঘাড় নেড়ে আমাকে আস্বস্ত করল শুক্লা। বলল, আমি বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিদিশা তোর কাছেই আবার ফিরে আসবে। আমার মন তাই বলছে।’
মনে মনে বললাম, তাই যেন সত্যি হয়। শুক্লার কথাটাই মিলে যাক। ভগবান যেন পুরোপুরি বিদিশাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন।
আরও আধঘন্টা শুক্লার সাথে নানা গল্প করে যখন ওর বাড়ী থেকে বেরুলাম, মনে হল, এতদিন ধরে যাকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখেছি, সেই শুক্লা আমার কাছে নিজের স্বার্থ ভুলে গিয়ে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই নিজেকে আবার প্রমান করল। ঠিক এই মূহূর্তে যে নিজের ভালটা না ভেবে আমার ভাল ছাড়া জীবনে আর কিছু চায় না।
বাড়ীতে ফিরছি, ট্যাক্সি চড়ে। আবার সেই চিন্তাটা আমার মনকে ভীষন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এবার মনে হল, না, শুক্লা যতই বন্ধুত্বের কথা বলুক। ও যেন ইচ্ছে করেই আমার প্রতি ওর দূর্বলতা আর ভালবাসাটাকে আত্মগোপণ করে নিল। প্রেমের উদ্ভব ঘটাতে গিয়েও ঘটাতে পারল না। এর জন্য দায়ী শুধু আমিই। কারণ আমার মন তো সবসময়ই আচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই একই বিদিশার চিন্তায়। জানি না বিদিশার জন্য আমাকে আরো কতদিন প্রতীক্ষা করতে হবে। আমি বোধহয় সেই পুরুষ, যাকে কোন নারী ইচ্ছে করলেও ভালবাসতে পারবে না। যেখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর এক নারী। সে শুধু বিদিশাই আর বিদিশাই। সে আর কেউ নয়।
ঠিক তখন বাজে রাত্রি দশটা। ভাবছি, শুভেন্দুকে একটা ফোন করি। কি হালচাল একটু জিজ্ঞাসা করি। আজকে যে শুক্লার বাড়ীতে গিয়েছিলাম, সেটাও ওকে বলি। শুক্লা আমাকে কি বলেছে, কি কথা হয়েছে, সেটাও ওকে খোলসা করি। তারপরেই ভাবলাম, শুক্লাকে ছোট করে আর কি লাভ? ব্যাচারা যদি কোনদিন জানতে পারে কষ্ট পাবে। শুভেন্দুর মুখ পাতলা। শুক্লাকে বলেও দিতে পারে কথাটা। বিদিশার জন্য যদি স্যাকরিফাইশ করেও থাকে শুক্লা। সেটার আর কোন দাম থাকবে না কারুর কাছে।
তবুও শুভেন্দুকে ফোনটা করলাম। ইচ্ছে হল বিদিশার কথা তুলেই শুভেন্দুর সাথে একটু গল্প করি। কাল মাধুরী আর রনি এসেছিল। ওরা এখনো আছে না চলে গেছে, সেটাও শুভেন্দুর কাছ থেকে খবর নিই। ফোন করলেই শুভেন্দু প্রথমেই আমাকে বিদিশার কথা জিজ্ঞাসা করবে, আজ সারাদিনে বিদিশার কোন খবর এসেছে কিনা সেটাও আমার কাছ থেকে জানতে চাইবে। বিদিশার জন্য আমি যাতে বেশী চিন্তিত হয়ে না পড়ি, সেটাও আমাকে বোঝাতে চাইবে। আমার মনকে শক্ত করতে বলবে শুভেন্দু। হাল যাতে না ছাড়ি, সে আশ্বাসও দেবে হয়তো আমাকে।
ওর মোবাইলের নম্বরটা এনগেজ হচ্ছিল। আমি জানি শুভেন্দুর কাছে দুটো মোবাইল। একটা নম্বরে না পেয়ে যথারীতি আর একটা নম্বরে ওকে ঠিক পেয়ে গেলাম। অন্য নম্বরটায় ঠিক দুটো রিং হবার পরই ফোনটা ধরল শুভেন্দু। আমাকে বলল, দেব, ‘তোকে আমি কল ব্যাক করছি। যাস্ট পাঁচ মিনিট।’
মনে হল, ও বোধহয় কারুর সাথে ফোনেই কথা বলছে এতক্ষণ ধরে। অন্য ফোনটা এনগেজ পাচ্ছিলাম, এই কারনেই। ফোনটা কেটে দিতে গিয়েও আমি কাটতে পারলাম না। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, শুভেন্দু কাকে যেন বলছে, তুই কি সত্যি কথাটা বলতে ভয় পাস? এরকম কেন করছিস তুই? দেব কি তোর অসুবিধার কথাটা বুঝবে না? ওকে সব খুলে বল। ওই তো সিদ্ধান্ত নেবে এখানে। দেবের উপরেই সব কিছু নির্ভর করছে।’
আমি দেখলাম শুভেন্দুও ভুলে লাইনটা কাটেনি। আর আমার ব্যাপারেই কারুর সাথে কথা বলছে। যা বলছে আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।
শুভেন্দু বলল, ‘কি হল, চুপ করে গেলি কেন তুই? কিছু তো বল?নাকি আমি তোর হয়ে বলব দেবের কাছে। তোর বলতে কেন অসুবিধা হচ্ছে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কার সাথে কথা বলছে শুভেন্দু? কি বলবে? কার হয়ে বলবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কান পেতে শুনতে লাগলাম, অন্য ফোনে শুভেন্দুর কথা। কিন্তু যার সাথে কথা বলছে, তার কথা আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। শুধু শুভেন্দুর কথাটা ভেসে আসছে কানে আর ও যেন ভীষন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কাউকে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুভেন্দু বলল, ‘দেখ দেবকে আমি সত্যি কথাটা বলতে পারতাম। কিন্তু বলিনি, তার কারণ আমি জানি, এই সমস্যাটা হয়তো কিছু দিনের, কিছু মাসের জন্য। চিরকালের জন্য তো তুই এই সমস্যা বয়ে বেড়াবি না? তাহলে অযথা কেন ভয় পাচ্ছিস? ডিভোর্স যখন হয় নি। তখন একদিন না একদিন ঠিক হয়ে যাবে। দেবও আশাকরি বুঝতে পারবে।’
আমি যেন চমকে উঠলাম। কার ডিভোর্সের কথা বলছে শুভেন্দু? কার সাথে কথা বলছে ও? তাহলে কি বিদিশা?
ঠিক সেই মূহূর্তে শুভেন্দু অন্য ফোনে বলে উঠল। এক বছরটা কোনো সময়ই নয় বিদিশা। যে ছেলেটা তোর জন্য এতবছর অপেক্ষা করল, মাত্র একবছর সে ওয়েট করতে পারবে না? তুই কি ভাবিস? দেবের মনটা অত পাথর নয়। তুই কিচ্ছু তাকে ঠকাচ্ছিস না। তোর অসুবিধার কথাটাই তাকে বলছিস।’
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বুকের কাছে ধরে একটা চাপা অস্বস্তি হতে লাগল আমার। ভাবলাম, হায় ভগবান, এ আবার কি পরীক্ষায় ফেললে আমাকে? তবে কি বিদিশার এখনো ডিভোর্সটা হয় নি? কাল তাহলে শুভেন্দু ইয়ার্কী নয়, সত্যি কথাটাই বলতে চেয়েছিল আমাকে। শেষেমেষে ওর ইয়ার্কীটাই এবার সত্যি হয়ে গেল আমার কাছে। ও সব জানতো। তাও গোপন করেছে আমাকে। কিছুই বুঝতে দেয়নি শুভেন্দু। কার কথা ভেবে শুভেন্দু সত্যিটা গোপন করল? বিদিশার কথা ভেবে? না কি এই দেবের কথা ভেবে। ঠিক বুঝতে পারছি না।
ফোনটা তখনও আমি ছাড়িনি। শুভেন্দু বিদিশাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে বিদিশাও যেন খুব অসহায়। শুভেন্দু মাঝে মাঝে ওকে বলছে, ‘চিন্তা করিস না বিদিশা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এক মূহূর্ত স্তব্ধের মতন হয়ে ফোনটা এবারে আমি ছেড়ে দিলাম। বিদিশার জন্য কষ্টও হল। মনে হল, আমার কাছে ফিরে আসার জন্য ও এতটাই ব্যাকুল। অথচ শেকলটা পায়ে এখনও বাঁধা রয়েছে। কিছুতেই ওটা ছিঁড়ে ও বেরিয়ে আসতে পারছে না। বিদিশা কাঁদছে, চোখের জল ফেলছে। হয়তো আফশোসও করছে। প্রেমের সাথে জড়িয়ে থাকা, স্বপ্ন, আশা আর আকাঙ্খাগুলো এবার ধূলিসাত হতে চলেছে।
শুভেন্দু এবার আমাকে ঘুরিয়ে ফোন করল। ওকে বললাম, ‘কার সাথে তুই কথা বলছিলিস?’
শুভেন্দু বলল, ‘এই আমার এক ক্লায়েন্টের সাথে। ব্যাটা রাত দুপুরে আমাকে ফোন করেছে। বোঝাতে বোঝাতে আমার অবস্থা খারাপ। তাই তোকে বললাম, আমি পরে ফোন করছি।’
ওকে বললাম, ‘শুভেন্দু, বিদিশার জন্য আমার ভীষন চিন্তা হচ্ছে।’
শুভেন্দু বলল, ‘কিসের চিন্তা?’
-এই আমার কাছে কি যেন একটা লুকোলো বিদিশা। হয়তো কোন সমস্যায় আছে। কিন্তু আমার কাছে সত্যিটা বলতেও ওর কি অসুবিধা আছে? বিদিশাতো আমার কাছে বলতেই পারে। অসুবিধাটা। আমি তো-
শুভেন্দু বলল, ‘কিসের জোরে সে তোকে বলবে? তোর জন্য সে কি করেছে?’
আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, ‘তুই একথা বলছিস? তুই না কালকে আমাকে-
শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ বলেছিলাম। তোকে আমি সত্যি কথাটাই বলেছিলাম। কিন্তু কালকের সান্ধ্যআসরটা তাহলে মাটী হয়ে যেত। বিদিশার ফিরে আসার আনন্দটা তোর কাছে ম্লান হয়ে যেত। সত্যিটা মেনে নিয়েও, তুই নিজের মনকে অনেক প্রশ্ন করতিস। এই সমস্যা থেকে বিদিশা আদৌ বেরুবে কিনা, তোর মনে অনেক প্রশ্ন থেকে যেতো। আমি তোর মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম দেব। তোকে এত চিন্তায় ফেলতে আমিও চাইনি।’
আমি অবাক হলাম, বললাম, ‘তুই বিদিশার এই সমস্যাটার কথাটা জানতিস। জেনেও আমাকে কিছু বলিসনি?’
শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ জানতাম। বিদিশাই আমাকে সব বলেছে। আমিই ওকে মানা করেছিলাম। বলেছিলাম, দেবকে এখনই কিছু জানাবার দরকার নেই। তাহলে ওর মনটা ভেঙে যেতে পারে। বিদিশা আমাকে কথা দিয়েছিল, তাও সব শেষে নিজের মনকে ও ঠিক রাখতে পারল না। তোর কাছে ও ভেঙে পড়ল।’
আমি বললাম, ‘আর কি কেউ জানে এই ব্যাপারটা?’
শুভেন্দু বলল, ‘শুক্লা জানে কিনা জানি না। তবে রনি, মাধুরী এই ব্যাপারটা জানে না। আমি ওদেরকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলিনি।’
শুভেন্দুকে বললাম, ‘বিদিশা তার মানে এক প্রকার ওর স্বামীকে ছেড়েই এখানে চলে এসেছে। ডিভোর্সটা এখনও হয় নি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুভেন্দু বলল, ‘তুই ফোনে সব শুনেছিস না দেব? আমি বিদিশার সাথে কথা বলছিলাম।
ওকে বললাম, ‘বিদিশা তো আমার কাছে আসল সত্যিটা কালকেই বলতে পারত। আমি ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল, দুদিন আমাকে অন্তত সময় দাও। আমি তোমাকে ভেবে বলব।’
শুভেন্দু বলল, ‘বিদিশা তোর কাছে এখন অপরাধী। ও নিজে তাই মনে করে। আর কারুর কথা বলতে পারছি না। কিন্তু বিদিশা বলেই নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখতে পারছে না। তাছাড়া এ সমস্যা থেকে বেরুবার জন্য তোর তো কিছু করার নেই। ডিভোর্স যতদিন না হচ্ছে, তুই ওকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবি না। ইন্ডিয়ান ম্যারেজ অ্যাক্টতো তাই বলে। অপরের বিবাহিত স্ত্রীকে কাছে রাখাটাও অবৈধ পর্যায়ে পড়ে। তুই ওর সাথে লিভ টুগেদার হয়তো করতে পারবি। কিন্তু সেটা কি তোর মা মেনে নেবে? বিদিশার মনের মধ্যে এখন সেই চিন্তাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। ও শুধু মনে জোর পাচ্ছে না তা নয়। এক প্রকার ভেঙেই পড়েছে বলা যায়। কাল থেকে ওর অবস্থা আরো খারাপ। কাল যদিও সব ভুলে টুলে তোর মুখটা দেখার জন্য ও এখানে এসেছিল। কিন্তু আজ ওর সাথে কথা বলে মনে হল, এই কষ্টভোগের পালা শুরু যখন হয়, তখন সেটাকে সহ্য করা খুব কষ্টকর। একেবারে বিধ্বস্তের মতন হতাশা গ্রস্থ হয়ে আমাকে কথাগুলো বলছিল। বলল, আমার আপেক্ষের আর শেষ নেই শুভেন্দু। তখন যে কেন দেবের কাছে আমি ফিরে গেলাম না। জীবনে এই পরিনামটাই বোধহয় আমার কপালে লেখা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, সবকিছু এখন শেষ হয়ে গেছে। সামান্যটুকু সম্ভাবনাটাও এখন আমি দেখছি না। কেননা আমার স্বামী আমাকে বলেছে-
আমি কৌতূহল হয়ে শুভেন্দুকে বললাম, কি বলেছে বিদিশার স্বামী?
শুভেন্দু বলল, ‘বিদিশার স্বামী বলেছে, কিছুতেই ডিভোর্সটা নাকি বিদিশাকে সে আর দেবে না। সারাজীবন এভাবেই স্বামী ছাড়া শুধু কাটাতে হবে বিদিশাকে। কোর্ট কাছারীতে আমরক্ত বেরিয়ে যাবে বিদিশার। উকিলের পেছনে টাকা খরচাটাই শুধু সার। এ জীবনে বিদিশারর দ্বিতীয় বিবাহ আর কোনদিন হবে না।’
ফোনটা ছাড়ার আগে শুভেন্দুকে বললাম, ‘আমি বিদিশার সাথে একবার কথা বলতে চাই। ওর সাথে দেখা করতে চাই।’
শুভেন্দু বলল, আমি তো বিদিশাকে বলেছি। দেখ ও হয়তো ফোন করবে। কিংবা দেখাও হয়তো করবে।’
শেষকালে ফোনটা রাখার আগে শুভেন্দু শুধু বলল, ‘আমারও আফশোসের আর শেষ নেই রে দেব। মাঝে মধ্যে আমিও ভাবছি, তোর আর বিদিশার জীবনটা কি এভাবেই শুধু কেটে যাবে? জীবনে তোরা আর বিয়ে থা কোনদিন করতে পারবি না? এ কী জীবনের মানে? অদ্ভূত এই জীবন। আমি তো কোন তালগোল খুঁজেই কিছু পাচ্ছি না।’
শেষে ও নিজেই বলল, ‘তোকে অবশ্য হাল ছেড়ে দিতে আমি বলছি না। দেখ নিশ্চই কিছু তো রাস্তা বেরোবেই। ভগবান মুখ তুলে চাইবেন। এতটা নিষ্ঠুর কখনো হবেন না।’
Like Reply


Messages In This Thread
RE: জীবন যে রকম by an unknown writer (collected and incomplete) - by Buro_Modon - 22-05-2020, 10:10 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)