22-05-2020, 10:09 AM
শুভেন্দু বললো, তুই ওটা দিয়ে শুরু কর। ‘এ রাতে এ মৌসম, নদীকা কিনারা এ চঞ্চল হাওয়া।’
আমি বললাম, এই গানটা কিন্তু বিদিশারও খুব পছন্দ।
সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু বললো, না, না, তাহলে বরঞ্চ তুই ওটা গা, এ মেরী জোহরা জেবীন, তুছে মালুম নেহী, তু অভীতক হ্যায় হাসীন, অউর ম্যায় জওয়ান, তুঝপে কুরবান মেরী জান মেরী জান।
মাধুরী বললো, ছোড়দা তুই না? কবেকার সেই সেকেলে মার্কা গান, ভালো ভালো কত গান আছে তা না।
রনি মাধুরীকে বললো, তুমি জানো না ডারলিং, দেবের কাছে যা স্টক আছে, গুনে গুনে শেষ করতে পারবে না। নতুন পুরোনো, ক্ল্যাসিকাল, লাভ সঙ সব ও গলায় নিয়ে বসে আছে। খালি একবার করে বিদিশার দিকে তাকাবে, আর মেহেফিল ভরিয়ে দেবে।
বিদিশা চুপ করে বসেছিলো, আমি বললাম, আমি আজ কারুর পছন্দের গান গাইবো না। যে কটা গান গাইবো, তোদের সবারই ভালো লাগবে।
শুভেন্দু বললো, সেই ভালো সেই ভালো। তুই গা।
মাধুরীকে রনি বললো, তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমিও বসো।
বিদিশা যেখানটা বসেছিল, মাধুরী ঠিক তার পাশে গিয়েই বসলো। আমি স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়ামটা হাতে নিয়ে আঙুলে সুর বেঁধে কিছুক্ষণ হূ হূ করলাম। তারপর গাইতে শুরু করলাম, কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই। নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে, নেই তারা আজ কোন খবরে। গ্র্যাণ্ডের গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা, ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে। কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে, পাগলা গারদে আছে রমা রায়, অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যানসারে। জীবন করে নি তাকে ক্ষমা হায়।……………………. কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।
গান গাইতে গাইতে আমি সবার দিকেই তাকাচ্ছিলাম একবার করে। দেখলাম ওরা সব আমার গান শুনছে, আর সেই পুরোনো স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। মনে পড়ছে কলেজ, কফিহাউস, সেই সোনালী দিনগুলো, যেগুলো কবেই আমরা সবাই হারিয়ে এসেছি।
রনি বললো, তুই তো আজ কাঁদিয়ে ছাড়বি রে।
আমি দ্বিতীয় গানটা ধরলাম, এতো রাগ নয়, এ যে অভিমান, এ শুধু তোমায় চাওয়ার, আরো বেশী কাছে পাওয়ার, ছল ভরা গান, এ যে অভিমান।
দেখলাম বিদিশার চোখটা এবার ছল ছল করছে। হঠাৎ রুমাল দিয়ে চোখটা বারে বারে মুছতে লাগলো। শুভেন্দু বললো, এই বিদিশা তুই কাঁদছিস নাকি?
আমি তৃতীয় গানটা শুরু করলাম, জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই। পাছে ভালোবেসে ফেলো তাই। দূরে দূরে রই।
বিদিশা গানটা দু লাইন গাওয়া মাত্রই উঠে ছুট্টে দূরে কয়েক হাত চলে গেল। দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি গান থামিয়ে দিয়েছি, শুভেন্দু আর রনি দুজনেই অবাক। মাধুরী কাছে গিয়ে বিদিশাকে জড়িয়ে ধরলো, কি হয়েছে বিদিশা তুমি কাঁদছো কেন?
কোনোরকমে রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে বিদিশা বললো, খুব ভুল হয়ে গেছে। দেবের মত নিষ্পাপ ভালো ছেলেকে আমি এভাবে ঠকাতে পারবো না। আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে।
আমি গান থামিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছি বিদিশার দিকে। মনে একটা প্রশ্ন। হঠাৎ বিদিশা একথা বললো কেন?
কাল শুভেন্দু আমাকে শুক্লার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। রনি তো বলেই দিয়েছে, ওর ফোন এলে ফোনও ধরবি না তুই। সবাই এখন শুক্লাকে খারাপ চোখে দেখছে। ব্যাচারা শুক্লা। বিদিশার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুক্লারই বা আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখানোর কারণটা কি? বিদিশাকে ও সহ্য করতে পারছে না। বারে বারে আমাকে ও ফোন কল করছে, বাড়ীতে যাবার জন্য বলছে। কই এতদিন তো শুক্লার একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
মনে হল এই মূহূর্তে আমার মনে শক্তি জোগানোর বা মনকে শান্তনা দেবার জন্য এমন কাউকে দরকার। শুক্লা সেই ভূমিকাটা কিছুতেই পালন করতে পারবে না। বরঞ্চ ও যদি বিদিশার ব্যাপারে হতাশাজনক আমাকে কিছু বলে দেয়, তাহলে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ব।
ফোনটা ধরলাম না। সুইচটা অফ না করে সাইলেন্ট মোড করে দিলাম। একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে শুক্লা। ওর ধৈর্য দেখে, আমিও রীতিমতন অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, হয় মেয়েটা আমার ভালো চাইছে, সত্যিকারের বন্ধু হয়ে এক বন্ধুর উপকার করতে চাইছে, নয়তো সে নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখছে, আমার স্বার্থটাকে নয়।
‘প্লীজ শুক্লা লিভ মি অ্যালোন। আমাকে একটু একা থাকতে দে। কেন তুই ফোন করে আমাকে বিরক্ত করছিস?’
বাড়ী থেকে বেরুবার সময়ও দেখেছি, শুক্লা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিল। আবার এখনও করে যাচ্ছে কনটেনিউসালি। যেন আমাকে ক্ষিপ্ত না করে ও এবারে ছাড়বে না।
অনেক বিরক্ত হয়েই শেষমেষে ওর ফোনটা ধরলাম। ঠিক করে নিলাম, বিদিশার ব্যাপারে শুক্লা যদি কিছু উচ্চবাচ্য করে প্রথমেই ওকে না করে দেবো, কথাই বলব না হয়তো। ফোনের লাইনটাও কেটে দেবো। ঠিক এই মূহূর্তে আমার মনোভাবটা এমনই কঠোর হওয়া দরকার। নিজেকে দূর্বল করলে চলবে না। বিদিশার প্রতি দুদিন অন্তত আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
ফোন ধরলাম, হ্যালোও বললাম। কিন্তু ভেতর থেকে সেই উদ্দীপনাটা এল না। শুক্লা আমাকে অবাক করে প্রথমেই বলল, ‘দেব, আমি কিন্তু মিনু নই। তুই কিন্তু আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছিস। এতবার করে তোকে ফোন করছি, ফোনটা অন্তত ধরবি তো? না শুক্লা বলে, তোর কেউ কোনদিন ছিল না। কলেজে শুভেন্দু, রনি সবাই তোর বন্ধু। আমি তোর কেউ নই।’
আমি কোন কথা বলছি না। শুক্লা বলল, ‘কি হল জবাব দে। কথা বলছিস না কেন?’
মনে হল, শুক্লা বোধহয় বিদিশার ব্যাপারে এবার কিছু বলবে। হয়তো কাল শুভেন্দুর বাড়ীতে কি হল, সেটাই জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে বিদিশা ওখানে এসেছিল কিনা? আমার সাথে বিদিশার কথা হল কিনা? বিদিশার জন্য আমি যে এখনও কাতর। এই ছটফটে মনটা নিয়ে কোথায় যাই? আমার ভালবাসার গভীরতা বোঝার মত ক্ষমতা যদি শুক্লার থাকতো-
ও বলল, ‘শোন, তোকে আমি এখন কিছুই বলব না। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখবি। কাল যখন আসতে পারিস নি। আজ অবশ্যই আমার ফ্ল্যাটে আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু ভীষন দূঃখ পাবো। যতদূর জানি, দেব কাউকে না বলে না। কাউকে ফেরায় না। অন্তত আমার এই অনুরোধটা তুই ফেলিস না। দেব প্লীজ। তোর পায়ে ধরে তোকে রিকোয়েস্ট করছি।’
আমি বললাম,‘আরে না, না। তুই এতকরে আমাকে রিকোয়েস্ট করছিস কেন বলতো? আমি কি তোকে না বলেছি? কাল তো শুভেন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বলেই তোর ওখানে যেতে পারিনি। তাই বলে কি আর যাব না কোনদিন? নিশ্চই যাবো।’
শুক্লা বলল, ভাবছিস আমি তোকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলব। তাই না?
আমি বললাম, ‘না, না। তা কেন হবে? তুই তো কালকেই-
-’হ্যাঁ। যা বলেছি। ওটার আর পুনরাবৃত্তি আমি করব না। তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলে, তোর মনকে আমি বিষিয়ে দিতে চাই না। শুক্লা দেবের খুব ভাল বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। ব্যাস। আর কিছু নয়। হ্যাপি? বল এবারে আসবি তো?
আমার যেন মনে হল, শুক্লা যেন আমার মনটাকে খুব ভালো করে পড়ে নিয়েছে। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বললে, আমি যে ওর বাড়ীতে যেতে আর আগ্রহ দেখাবো না। সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। শুক্লা ভাল করেই জানে, এতদিন বাদে বিদিশার পুনরাগমন, আমার কাছে একটা অক্সিজেনের মতন। ওর এই ফিরে আসার মধ্যে যতই রহস্য থাক। যতই বিদিশা আমার কাছে একটু সময় চেয়ে নিক, যতই আমার মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে যাক, একটা আশা নিয়ে দুদিন তো আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে বিদিশাই বা কি মুখ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে? শুভেন্দুকেই বা কি বলব? রনিকেই বা কি বলব তখন? আমি নিজে থেকেই বিদিশার ফিরে আসাটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে চির দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
একবার মায়ের কথাটা সে সময় খুব মনে হল। মা আমার জন্য খুব ভাবে, কষ্ট পায়। বিদিশাকে অর্জন করে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফোটানোটা দরকার।
শুক্লাকে বললাম, ‘যাবো তোর বাড়ী। কবে যেতে হবে বল? অফিস ফেরত একদিন চলে যাব তোর ফ্ল্যাটে।’
শুক্লা বলল, ‘না তুই আজকেই আসবি। আমি আজকেই তোকে আমার এখানে দেখতে চাই।’
ওকে বললাম, ‘আজকেই যাব? তাহলে তো অফিস ফেরত তোর ওখানে যেতে হয়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। তোর বাড়ী থেকে তো আর বেশী দূরে নয়। সল্টলেকে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে। একটা ট্যাক্সি নিবি। আর ঝটপট চলে আসবি।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া দাওয়ার আবার অ্যারেঞ্জ করবি না তো? মাকে কিন্তু কিছু বলে আসিনি। কাল এমনিতেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে অনেক খেয়েছি। আজ তোর ওখানে খেলে, মা বহূত চটে যাবে।’
শুক্লা বলল, ‘দেব, তোর আপত্তি থাকলে আমি তোকে জোর করব না। কিন্তু তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি। আমাকে আবার ফোন করতে বাধ্য করিস না।’
যেন নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। কিছুতেই আমাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না। আমিও শেষ পর্ষন্ত শুক্লাকে কথা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।
অফিস থেকে বেরিয়ে শুক্লার বাড়ীর দিকে যখন আসছিলাম। ট্যাক্সিতে এফ এম এ খুব সুন্দর একটা কিশোর কুমারের গান হচ্ছিল। গানটা আমারও খুব ফেভারিট।
হে প্রিয়তমা, আমি তো তোমায়, বিদায় কখনো দেবো না।
শুনে মনে হল, সত্যি তাই। বিদিশাকে আমি নিজে থেকে কখনও বিদায় দিতে পারি না, এক সে যদি নিজে থেকে না চায়। আমার মনের মধ্যে আশাটা কিছুটা হলেও এখনো যেন বেঁচে আছে। বিদিশাকে আমি চাই। শেষ পর্যন্ত যে করেই হোক বিদিশাকে আমি ফিরে পেতে চাই।
ঠিক তার পরে পরেই কিশোর কুমারের আর একটা গান শুরু হল, গানটা হল, ‘আজ থেকে আর ভালোবাসার নাম নেবো না আমি। যারে দিয়েছিলাম, যা কিছু তা আমার চেয়েও দামী। নাম নেবো না আমি।’
এবার আমার মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘দাদা এই যে লোকটার গান শুনছেন না? ইনি তো অমর শিল্পী কিশোর কুমার। কিন্তু লোকে বলে ইনি নাকি মরে যাবার আগের দিন পর্যন্ত প্রেমিক ছিলেন। চার চারটে বিয়ে করেছেন, ভালোবাসা ওনার কাছে অফুরন্ত ছিল।
আমি বললাম, কিশোর কুমার সন্মন্ধে আমি যা জানি, তা আর কেউ জানে না। একসময় কিশোরের গান গেয়েও অনেকের প্রশংসা কুড়িযেছি। লোকটার জীবনে প্রেম অনেক ছিল তাও জানি। কিন্তু লোকটার জীবনে একটা ব্যাথাও ছিল। সেটা বাইরে থেকে ওর পাগলামী দেখে কেউ বুঝতে পারত না। কিশোর কুমার নিজেও এমন ছিলেন, কাউকে বুঝতে দিতেন না।
ঠিক সন্ধে সোয়া সাতটা নাগাদ ট্যাক্সিটা শুক্লার ফ্ল্যাটের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ীতে আসতে আসতে এরমধ্যেই শুক্লার ২বার ফোন এসে গেছে আমার মোবাইলে। আমি যে সত্যি আসছি কিনা সেটা ও ফোন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। যাচাই করে দেখে নিতে চেয়েছে আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি কিনা? আমার কাছ থেকে কনফারমেশন পেয়ে থুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে শুক্লা। অবাক লাগছে, এতটা আনন্দ পেতে আমি বিদিশাকেও কোনদিন দেখিনি।
কেমন যেন ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আকস্মিক শুক্লার আচরণে আমি স্তম্ভিত। বুঝতে পারছি শুক্লার মনে এখন শান্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মানসিক ভাবে আমিও কিছুটা বিপর্যস্ত। যাকে কোনদিন প্রেমিকা হিসেবে আমি ভাবিনি, বিদিশার জায়গায় যাকে কোনদিন চিন্তা করিনি, সে আমাকে এক গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। শুক্লাকে আমি কি বলব, নিজেই বুঝতে পারছি না।
মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছু করে বসে। পরিনতির কথা চিন্তা না করে সে তখন নিজের ইচ্ছেটাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। স্বভাবে, আচরণে তার পরিবর্তন ঘটে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে ছটফট করে ওঠে। ভেতরে ভেতরে তার অস্থিরতা ফুটে উঠে। শুক্লা মুখে আমাকে সরি বললেও, ওর ভেতরে আমাকে নিয়ে যে একটা প্রবল চিন্তা সেটা আমি ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারছি।
কিছুটা দূরে গিয়ে শুক্লা বলল, ‘দেখ, তুই আবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলি। এই আমার হয়েছে বড় জ্বালা। কখন কি যে করে বসি। তোকে সব পুরোনো কথা বলতে গিয়ে নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। এই দেব, কি ভাবছিস? তুই সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলি নাকি আমাকে নিয়ে?
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে শুক্লা বলল, ‘আজ থেকে শুক্লা খারাপ হয়ে গেল তো তোর কাছে? দেখ আমার কিন্তু বন্ধু বলে কেউ আর রইলো না। সবাই আমার থেকে দূরে সরে গেল। তুইও সরে গেলি।’
নিজের মনের মধ্যে কেমন একটা দুশ্চিন্তা তৈরী হচ্ছে শুক্লাকে নিয়ে। ওর কাছে সেভাবে কঠোর হতে পারছি না। কিন্তু নরমও হতে পারছি না। কেমন যেন ডামাডোলে আমি দুলছি।
শুক্লা বলল, ‘বল না দেব? কাল কি হল? বিদিশা এসেছিল?’
আমার ভেতরে তখনো একটা কিন্তু কিন্তু বিরাজ করছে। বিদিশাকে নিয়ে শুক্লার এখনো এত আগ্রহ? ওর মনোভাবটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে।
আমি বললাম, ‘ছাড় না ওসব প্রসঙ্গ। তুই তোর কথা বল। ভালোই তো লাগছিল শুনতে।’
শুক্লা বলল, ‘আমার কথা শুনতে বুঝি তোর ভালো লাগবে? কি একটা জীবন নিয়ে এতকাল অতিবাহিত করে দিলাম। আমার আবার জীবন কাহিনী বলে কিছু বাকী আছে নাকি?’
আমি বললাম, ‘তোর বরের কথা একটু শুনি। বেশ ভালই তো হয়েছিল বিয়েটা। হঠাৎ ভেঙে গেল কেন?’
শুক্লা বলল, ‘জোড়া লাগানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সেই সুযোগটা দেয় নি।’
কারণটা জানতে শুক্লা বলল, ‘আসলে আমার হাজব্যান্ড হল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। জামশেদপুরে ওদের আদী বাড়ী। চাকরীর দরুন, কলকাতাতেই অনেকদিন ছিল। হঠাৎই আমার শাশুড়ী এসে সব গুবলেট করে দিল।’
আমি বললাম, ‘সেটা কিরকম?’
আমি বললাম, এই গানটা কিন্তু বিদিশারও খুব পছন্দ।
সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু বললো, না, না, তাহলে বরঞ্চ তুই ওটা গা, এ মেরী জোহরা জেবীন, তুছে মালুম নেহী, তু অভীতক হ্যায় হাসীন, অউর ম্যায় জওয়ান, তুঝপে কুরবান মেরী জান মেরী জান।
মাধুরী বললো, ছোড়দা তুই না? কবেকার সেই সেকেলে মার্কা গান, ভালো ভালো কত গান আছে তা না।
রনি মাধুরীকে বললো, তুমি জানো না ডারলিং, দেবের কাছে যা স্টক আছে, গুনে গুনে শেষ করতে পারবে না। নতুন পুরোনো, ক্ল্যাসিকাল, লাভ সঙ সব ও গলায় নিয়ে বসে আছে। খালি একবার করে বিদিশার দিকে তাকাবে, আর মেহেফিল ভরিয়ে দেবে।
বিদিশা চুপ করে বসেছিলো, আমি বললাম, আমি আজ কারুর পছন্দের গান গাইবো না। যে কটা গান গাইবো, তোদের সবারই ভালো লাগবে।
শুভেন্দু বললো, সেই ভালো সেই ভালো। তুই গা।
মাধুরীকে রনি বললো, তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমিও বসো।
বিদিশা যেখানটা বসেছিল, মাধুরী ঠিক তার পাশে গিয়েই বসলো। আমি স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়ামটা হাতে নিয়ে আঙুলে সুর বেঁধে কিছুক্ষণ হূ হূ করলাম। তারপর গাইতে শুরু করলাম, কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই। নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে, নেই তারা আজ কোন খবরে। গ্র্যাণ্ডের গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা, ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে। কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে, পাগলা গারদে আছে রমা রায়, অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যানসারে। জীবন করে নি তাকে ক্ষমা হায়।……………………. কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।
গান গাইতে গাইতে আমি সবার দিকেই তাকাচ্ছিলাম একবার করে। দেখলাম ওরা সব আমার গান শুনছে, আর সেই পুরোনো স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। মনে পড়ছে কলেজ, কফিহাউস, সেই সোনালী দিনগুলো, যেগুলো কবেই আমরা সবাই হারিয়ে এসেছি।
রনি বললো, তুই তো আজ কাঁদিয়ে ছাড়বি রে।
আমি দ্বিতীয় গানটা ধরলাম, এতো রাগ নয়, এ যে অভিমান, এ শুধু তোমায় চাওয়ার, আরো বেশী কাছে পাওয়ার, ছল ভরা গান, এ যে অভিমান।
দেখলাম বিদিশার চোখটা এবার ছল ছল করছে। হঠাৎ রুমাল দিয়ে চোখটা বারে বারে মুছতে লাগলো। শুভেন্দু বললো, এই বিদিশা তুই কাঁদছিস নাকি?
আমি তৃতীয় গানটা শুরু করলাম, জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই। পাছে ভালোবেসে ফেলো তাই। দূরে দূরে রই।
বিদিশা গানটা দু লাইন গাওয়া মাত্রই উঠে ছুট্টে দূরে কয়েক হাত চলে গেল। দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি গান থামিয়ে দিয়েছি, শুভেন্দু আর রনি দুজনেই অবাক। মাধুরী কাছে গিয়ে বিদিশাকে জড়িয়ে ধরলো, কি হয়েছে বিদিশা তুমি কাঁদছো কেন?
কোনোরকমে রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে বিদিশা বললো, খুব ভুল হয়ে গেছে। দেবের মত নিষ্পাপ ভালো ছেলেকে আমি এভাবে ঠকাতে পারবো না। আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে।
আমি গান থামিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছি বিদিশার দিকে। মনে একটা প্রশ্ন। হঠাৎ বিদিশা একথা বললো কেন?
কাল শুভেন্দু আমাকে শুক্লার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। রনি তো বলেই দিয়েছে, ওর ফোন এলে ফোনও ধরবি না তুই। সবাই এখন শুক্লাকে খারাপ চোখে দেখছে। ব্যাচারা শুক্লা। বিদিশার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুক্লারই বা আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখানোর কারণটা কি? বিদিশাকে ও সহ্য করতে পারছে না। বারে বারে আমাকে ও ফোন কল করছে, বাড়ীতে যাবার জন্য বলছে। কই এতদিন তো শুক্লার একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
মনে হল এই মূহূর্তে আমার মনে শক্তি জোগানোর বা মনকে শান্তনা দেবার জন্য এমন কাউকে দরকার। শুক্লা সেই ভূমিকাটা কিছুতেই পালন করতে পারবে না। বরঞ্চ ও যদি বিদিশার ব্যাপারে হতাশাজনক আমাকে কিছু বলে দেয়, তাহলে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ব।
ফোনটা ধরলাম না। সুইচটা অফ না করে সাইলেন্ট মোড করে দিলাম। একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে শুক্লা। ওর ধৈর্য দেখে, আমিও রীতিমতন অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, হয় মেয়েটা আমার ভালো চাইছে, সত্যিকারের বন্ধু হয়ে এক বন্ধুর উপকার করতে চাইছে, নয়তো সে নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখছে, আমার স্বার্থটাকে নয়।
‘প্লীজ শুক্লা লিভ মি অ্যালোন। আমাকে একটু একা থাকতে দে। কেন তুই ফোন করে আমাকে বিরক্ত করছিস?’
বাড়ী থেকে বেরুবার সময়ও দেখেছি, শুক্লা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিল। আবার এখনও করে যাচ্ছে কনটেনিউসালি। যেন আমাকে ক্ষিপ্ত না করে ও এবারে ছাড়বে না।
অনেক বিরক্ত হয়েই শেষমেষে ওর ফোনটা ধরলাম। ঠিক করে নিলাম, বিদিশার ব্যাপারে শুক্লা যদি কিছু উচ্চবাচ্য করে প্রথমেই ওকে না করে দেবো, কথাই বলব না হয়তো। ফোনের লাইনটাও কেটে দেবো। ঠিক এই মূহূর্তে আমার মনোভাবটা এমনই কঠোর হওয়া দরকার। নিজেকে দূর্বল করলে চলবে না। বিদিশার প্রতি দুদিন অন্তত আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
ফোন ধরলাম, হ্যালোও বললাম। কিন্তু ভেতর থেকে সেই উদ্দীপনাটা এল না। শুক্লা আমাকে অবাক করে প্রথমেই বলল, ‘দেব, আমি কিন্তু মিনু নই। তুই কিন্তু আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছিস। এতবার করে তোকে ফোন করছি, ফোনটা অন্তত ধরবি তো? না শুক্লা বলে, তোর কেউ কোনদিন ছিল না। কলেজে শুভেন্দু, রনি সবাই তোর বন্ধু। আমি তোর কেউ নই।’
আমি কোন কথা বলছি না। শুক্লা বলল, ‘কি হল জবাব দে। কথা বলছিস না কেন?’
মনে হল, শুক্লা বোধহয় বিদিশার ব্যাপারে এবার কিছু বলবে। হয়তো কাল শুভেন্দুর বাড়ীতে কি হল, সেটাই জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে বিদিশা ওখানে এসেছিল কিনা? আমার সাথে বিদিশার কথা হল কিনা? বিদিশার জন্য আমি যে এখনও কাতর। এই ছটফটে মনটা নিয়ে কোথায় যাই? আমার ভালবাসার গভীরতা বোঝার মত ক্ষমতা যদি শুক্লার থাকতো-
ও বলল, ‘শোন, তোকে আমি এখন কিছুই বলব না। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখবি। কাল যখন আসতে পারিস নি। আজ অবশ্যই আমার ফ্ল্যাটে আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু ভীষন দূঃখ পাবো। যতদূর জানি, দেব কাউকে না বলে না। কাউকে ফেরায় না। অন্তত আমার এই অনুরোধটা তুই ফেলিস না। দেব প্লীজ। তোর পায়ে ধরে তোকে রিকোয়েস্ট করছি।’
আমি বললাম,‘আরে না, না। তুই এতকরে আমাকে রিকোয়েস্ট করছিস কেন বলতো? আমি কি তোকে না বলেছি? কাল তো শুভেন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বলেই তোর ওখানে যেতে পারিনি। তাই বলে কি আর যাব না কোনদিন? নিশ্চই যাবো।’
শুক্লা বলল, ভাবছিস আমি তোকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলব। তাই না?
আমি বললাম, ‘না, না। তা কেন হবে? তুই তো কালকেই-
-’হ্যাঁ। যা বলেছি। ওটার আর পুনরাবৃত্তি আমি করব না। তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলে, তোর মনকে আমি বিষিয়ে দিতে চাই না। শুক্লা দেবের খুব ভাল বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। ব্যাস। আর কিছু নয়। হ্যাপি? বল এবারে আসবি তো?
আমার যেন মনে হল, শুক্লা যেন আমার মনটাকে খুব ভালো করে পড়ে নিয়েছে। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বললে, আমি যে ওর বাড়ীতে যেতে আর আগ্রহ দেখাবো না। সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। শুক্লা ভাল করেই জানে, এতদিন বাদে বিদিশার পুনরাগমন, আমার কাছে একটা অক্সিজেনের মতন। ওর এই ফিরে আসার মধ্যে যতই রহস্য থাক। যতই বিদিশা আমার কাছে একটু সময় চেয়ে নিক, যতই আমার মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে যাক, একটা আশা নিয়ে দুদিন তো আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে বিদিশাই বা কি মুখ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে? শুভেন্দুকেই বা কি বলব? রনিকেই বা কি বলব তখন? আমি নিজে থেকেই বিদিশার ফিরে আসাটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে চির দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
একবার মায়ের কথাটা সে সময় খুব মনে হল। মা আমার জন্য খুব ভাবে, কষ্ট পায়। বিদিশাকে অর্জন করে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফোটানোটা দরকার।
শুক্লাকে বললাম, ‘যাবো তোর বাড়ী। কবে যেতে হবে বল? অফিস ফেরত একদিন চলে যাব তোর ফ্ল্যাটে।’
শুক্লা বলল, ‘না তুই আজকেই আসবি। আমি আজকেই তোকে আমার এখানে দেখতে চাই।’
ওকে বললাম, ‘আজকেই যাব? তাহলে তো অফিস ফেরত তোর ওখানে যেতে হয়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। তোর বাড়ী থেকে তো আর বেশী দূরে নয়। সল্টলেকে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে। একটা ট্যাক্সি নিবি। আর ঝটপট চলে আসবি।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া দাওয়ার আবার অ্যারেঞ্জ করবি না তো? মাকে কিন্তু কিছু বলে আসিনি। কাল এমনিতেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে অনেক খেয়েছি। আজ তোর ওখানে খেলে, মা বহূত চটে যাবে।’
শুক্লা বলল, ‘দেব, তোর আপত্তি থাকলে আমি তোকে জোর করব না। কিন্তু তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি। আমাকে আবার ফোন করতে বাধ্য করিস না।’
যেন নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। কিছুতেই আমাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না। আমিও শেষ পর্ষন্ত শুক্লাকে কথা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।
অফিস থেকে বেরিয়ে শুক্লার বাড়ীর দিকে যখন আসছিলাম। ট্যাক্সিতে এফ এম এ খুব সুন্দর একটা কিশোর কুমারের গান হচ্ছিল। গানটা আমারও খুব ফেভারিট।
হে প্রিয়তমা, আমি তো তোমায়, বিদায় কখনো দেবো না।
শুনে মনে হল, সত্যি তাই। বিদিশাকে আমি নিজে থেকে কখনও বিদায় দিতে পারি না, এক সে যদি নিজে থেকে না চায়। আমার মনের মধ্যে আশাটা কিছুটা হলেও এখনো যেন বেঁচে আছে। বিদিশাকে আমি চাই। শেষ পর্যন্ত যে করেই হোক বিদিশাকে আমি ফিরে পেতে চাই।
ঠিক তার পরে পরেই কিশোর কুমারের আর একটা গান শুরু হল, গানটা হল, ‘আজ থেকে আর ভালোবাসার নাম নেবো না আমি। যারে দিয়েছিলাম, যা কিছু তা আমার চেয়েও দামী। নাম নেবো না আমি।’
এবার আমার মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘দাদা এই যে লোকটার গান শুনছেন না? ইনি তো অমর শিল্পী কিশোর কুমার। কিন্তু লোকে বলে ইনি নাকি মরে যাবার আগের দিন পর্যন্ত প্রেমিক ছিলেন। চার চারটে বিয়ে করেছেন, ভালোবাসা ওনার কাছে অফুরন্ত ছিল।
আমি বললাম, কিশোর কুমার সন্মন্ধে আমি যা জানি, তা আর কেউ জানে না। একসময় কিশোরের গান গেয়েও অনেকের প্রশংসা কুড়িযেছি। লোকটার জীবনে প্রেম অনেক ছিল তাও জানি। কিন্তু লোকটার জীবনে একটা ব্যাথাও ছিল। সেটা বাইরে থেকে ওর পাগলামী দেখে কেউ বুঝতে পারত না। কিশোর কুমার নিজেও এমন ছিলেন, কাউকে বুঝতে দিতেন না।
ঠিক সন্ধে সোয়া সাতটা নাগাদ ট্যাক্সিটা শুক্লার ফ্ল্যাটের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ীতে আসতে আসতে এরমধ্যেই শুক্লার ২বার ফোন এসে গেছে আমার মোবাইলে। আমি যে সত্যি আসছি কিনা সেটা ও ফোন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। যাচাই করে দেখে নিতে চেয়েছে আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি কিনা? আমার কাছ থেকে কনফারমেশন পেয়ে থুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে শুক্লা। অবাক লাগছে, এতটা আনন্দ পেতে আমি বিদিশাকেও কোনদিন দেখিনি।
কেমন যেন ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আকস্মিক শুক্লার আচরণে আমি স্তম্ভিত। বুঝতে পারছি শুক্লার মনে এখন শান্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মানসিক ভাবে আমিও কিছুটা বিপর্যস্ত। যাকে কোনদিন প্রেমিকা হিসেবে আমি ভাবিনি, বিদিশার জায়গায় যাকে কোনদিন চিন্তা করিনি, সে আমাকে এক গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। শুক্লাকে আমি কি বলব, নিজেই বুঝতে পারছি না।
মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছু করে বসে। পরিনতির কথা চিন্তা না করে সে তখন নিজের ইচ্ছেটাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। স্বভাবে, আচরণে তার পরিবর্তন ঘটে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে ছটফট করে ওঠে। ভেতরে ভেতরে তার অস্থিরতা ফুটে উঠে। শুক্লা মুখে আমাকে সরি বললেও, ওর ভেতরে আমাকে নিয়ে যে একটা প্রবল চিন্তা সেটা আমি ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারছি।
কিছুটা দূরে গিয়ে শুক্লা বলল, ‘দেখ, তুই আবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলি। এই আমার হয়েছে বড় জ্বালা। কখন কি যে করে বসি। তোকে সব পুরোনো কথা বলতে গিয়ে নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। এই দেব, কি ভাবছিস? তুই সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলি নাকি আমাকে নিয়ে?
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে শুক্লা বলল, ‘আজ থেকে শুক্লা খারাপ হয়ে গেল তো তোর কাছে? দেখ আমার কিন্তু বন্ধু বলে কেউ আর রইলো না। সবাই আমার থেকে দূরে সরে গেল। তুইও সরে গেলি।’
নিজের মনের মধ্যে কেমন একটা দুশ্চিন্তা তৈরী হচ্ছে শুক্লাকে নিয়ে। ওর কাছে সেভাবে কঠোর হতে পারছি না। কিন্তু নরমও হতে পারছি না। কেমন যেন ডামাডোলে আমি দুলছি।
শুক্লা বলল, ‘বল না দেব? কাল কি হল? বিদিশা এসেছিল?’
আমার ভেতরে তখনো একটা কিন্তু কিন্তু বিরাজ করছে। বিদিশাকে নিয়ে শুক্লার এখনো এত আগ্রহ? ওর মনোভাবটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে।
আমি বললাম, ‘ছাড় না ওসব প্রসঙ্গ। তুই তোর কথা বল। ভালোই তো লাগছিল শুনতে।’
শুক্লা বলল, ‘আমার কথা শুনতে বুঝি তোর ভালো লাগবে? কি একটা জীবন নিয়ে এতকাল অতিবাহিত করে দিলাম। আমার আবার জীবন কাহিনী বলে কিছু বাকী আছে নাকি?’
আমি বললাম, ‘তোর বরের কথা একটু শুনি। বেশ ভালই তো হয়েছিল বিয়েটা। হঠাৎ ভেঙে গেল কেন?’
শুক্লা বলল, ‘জোড়া লাগানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সেই সুযোগটা দেয় নি।’
কারণটা জানতে শুক্লা বলল, ‘আসলে আমার হাজব্যান্ড হল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। জামশেদপুরে ওদের আদী বাড়ী। চাকরীর দরুন, কলকাতাতেই অনেকদিন ছিল। হঠাৎই আমার শাশুড়ী এসে সব গুবলেট করে দিল।’
আমি বললাম, ‘সেটা কিরকম?’