09-05-2020, 01:23 PM
মাস শেষ হতেই রঞ্জনকে চলে যেতে হল।কিছু ফর্মালি কাজ আছে।সুছন্দা টিকটিক করে রঞ্জনের জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল।রাত্রি ন'টায় ফ্লাইট।রঞ্জন বলল---এটা জিনিস দিচ্ছ কেন? ওখানে কিনতে পাওয়া যায় না নাকি?
---বাইরে কোথায় কি ফালতু জিনিস কিনবে কেন?
বাবা চলে যেতে অর্কের মনটা খারাপ হয়ে গেল।সুছন্দা বলল---অর্ক ঘুমিয়ে পড়।কাল রবিবার আঁকার নতুন স্যারের কাছে যেতে হবে মনে আছে তো?
খুব ভোরে অর্ককে তুলে দিল সুছন্দা।অর্ক ব্রাশ করে আসতেই সুছন্দা বলল---তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নেয়ে।তোকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বাড়ী ফিরতে হবে।অনেক কাজ আছে।কাজের মেয়েটা আজ আসবে না এমনিতে।
অর্ক রেডি হয়ে দেখল মাও রেডি।সুছন্দা একটা সবুজ রঙের তাঁত শাড়ি আর ছাইরঙা ব্লাউজ পরেছে।হাতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলল---সব কিছু ঠিকঠাক নিয়েছিস?
অর্ক মাথা নাড়ল।
সুছন্দা বাড়ী থেকে বেরিয়ে একটা অটোকে দাঁড় করালো।বলল---বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেবেন।
অর্ক দেখল মাত্র পাঁচ মিনিট লাগল অটোতে।হেঁটেও আসা যায়।একটা মোরাম রাস্তা দিয়ে মাকে এগিয়ে যেতে দেখে অর্কও পিছু নিল।জায়গাটা বেশ ফাঁকা।কিছুটা যাবার পর।অর্ক দেখল একটা পিচ রাস্তায় উঠল।পিচ রাস্তাটা দেখে অর্ক চিনতে পারল এটা বস্তি যাবার রাস্তাটা শেষ হয়েছে।অর্ক একবার বাপির সঙ্গে বস্তিতে এসেছিল।তাদের বাড়ীর রঙমিস্ত্রী যে লোকটা আসতো তার বাড়ীতে।
পিচরাস্তার শেষমাথাতেই বাড়িটা।রাস্তার গায়ে ইটের দেওয়ালের বাড়ী।রাস্তা সংলগ্নই টিনের দরজা।
দরজাটা সুছন্দা খুলে বলল---ভেতরে আয়।অর্ক ভেতরে ঢুকে দেখল।সামনে একটা টিউওয়েল।তার মুখেই কাঠের দরজা।
সুছন্দা দরজাটায় শব্দ করল।প্রায় দু-তিন মিনিট পর ক্যাঁচ করে শব্দ হল দরজায়।অর্ক দেখল একটা লোক খালি গায় দাঁড়িয়ে।লোকটা বেশ লম্বা হলেও পাতলা।চুলগুলো এলোমেলো উষ্কখুস্ক।দীর্ঘদিন সাবান না পড়লে যেমন লালচে হয় তেমন।দাড়ি গোঁফ সবই খোঁচা খোঁচা।মোটা ঠোঁট দুটোর কোন ক্ষয়ে গেছে।রাগি গম্ভীর মুখ।গায়ে ভীষন ঘাম।গায়ের রঙ কালো নয়।বরং রোদে পোড়া।পরনে ময়লা লুঙ্গি।হাতে জ্বলছে একটা বিড়ি।
সুছন্দা বলল---এই যে তোমার ছাত্র কানু দা!!!!
অর্ককে প্রনাম করতে ইশারা করল সুছন্দা।অর্ক মায়ের কথা মত প্রনাম করল।কিন্তু লোকটার কোনো অভিব্যপ্তি নেই।
অর্কর কেমন অদ্ভুত লাগছিল লোকটাকে।ভেতরে ঢুকে দেখল মুখেই একটা সিঁড়ি।সিঁড়িতে কোনো প্লাস্টার নেই।আর নিচে ভাঙা চোরা যত জিনিসপত্র রাখা।একটা ভ্যাপসা গুমোট মত আবহাওয়া।
নিচেই একটা ঘরে নিয়ে গেল লোকটা।সুছন্দা অর্ককে একটা চেয়ারে বসতে বলল।অর্ক দেখল চারদিকে ল্যান্ডস্কেপ, পোট্রেট আঁকা।এই ঘরটাও যত্রতত্র জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
সুছন্দা বলল---তাহলে আসি।একা যেতে পারবি তো?
অর্ক মাথা নাড়ল মায়ের কথায় সায় দিয়ে।
মা চলে যাবার পর অর্ক তার ড্রয়িং পেপার, ব্রাশ বের করল।অর্ক দেখল স্যার একটা ব্ল্যাংক পোট্রেট আনলেন।খুব গম্ভীর গলায় বললেন---তোর নাম কি?
---অর্ক মৈত্র!
---বাপের নাম কি? কথা বলতে বলতেই লোকটা ঝটঝট করে পেনশিল স্কেচ করে যাচ্ছেন।
অর্ক লোকটার মুখে 'বাপ' কথাটা শুনে খারাপ লাগল।মুখের উপর বলল---বাপ না বাপি!
লোকটা বিচ্ছিরি ভাবে বলল---ওই ওই হল! শালা ইংরেজের বাচ্চা হয়েছ! কি নাম তোর বাপির?
অর্ক ভাবলো এ কেমন স্যার! মুখের ভাষা এত খারাপ কেন!
----রঞ্জন মৈত্র।
লোকটা এবার বলল---ঠাকুর্দার নাম কি?
অর্ক বলল---বিমল মৈত্র।
লোকটা কোনো কথা আর বলল না।এঁকে যাচ্ছে এক মনে।অর্ক দেখছি লোকটা যতই খারাপ হোক।আঁকে দারুন।কিন্তু সে এখান থেকে কিছুই শিখতে পারছে না।
সে তাই বলল---স্যার আমি তো এসব শিখিনি।
গলা খাঁকারি দিয়ে লোকটা বলল---শিখিসনি শিখে যাবি!দে পেন্সিল দে।
অর্ক পেন্সিল দিল।লোকটা একটা বাঁক নিয়ে ময়ূর এঁকে দিল।এই ময়ূর একটা আর্ট ফর্মে আঁকা।অর্কও নকল করে আঁকল।দেখল বেশ তো হল।
লোকটা এবার বলল---কিরে বড়লোকের নাতি? হল?
অর্ক মাথা নাড়ল।লোকটাকে সত্যিই তার পছন্দ হচ্ছে না।
এবার লোকটা আবার একটা টার্ন নিল।একটা হরিণ হয়ে গেল।অর্ক চেষ্টা করল।হল না।
লোকটা হলদে দাঁত বের করে খিঁচিয়ে বলল---বাঞ্চোদ! বাল ছিঁড়তে এসেছো এখানে?
অর্ক ভয় পেয়ে গেল।এমন অশ্লীল কথা তাকে কেউ বলবে সে কল্পনাও করতে পারেনি।সে মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে এমন নোংরা কথা শুনে সে যেমন ঘৃণা বোধ করছিল তেমন লোকটার মুখ ভঙ্গি দেখে ভয় পেল।
লোকটা এবার ওর হাত থেকে পেন্সিল ছাড়িয়ে আবার আঁক কষল।অর্কও এবার করল।আস্তে আস্তে হরিণটাও গড়ে উঠল।
এবার বলল---বল দেখি ময়ূর আর ময়ূরী চিনবি কি করে?
অর্ক ভয়ে ভয়ে বলল--ময়ূরের পেখম আছে! ময়ূরীর পেখম নেই!
---হুম্ম।এইবার দেখ! বলে একটা ময়ূরী আঁকল।
এবার বলল---বলতো মানুষ আর মানুষী চিনবি কি করে?
অর্ক কিছু বলতে পারল না।আসলে সে কি বলবে বুঝতে পাচ্ছিল না।
লোকটা বিচ্ছিরি করে অশালীন হাসি হাসল।---তোর বাপ আর মাকে চিনিস তো?
অর্ক চুপ করে বসে আছে।লোকটা ধমক দিয়ে বলল---কি হল বল!
অর্ক চমকে উঠল।সে ভয়ে কাঁপছে।বলল---চিনি।
---হুম।কি করে চিনলি?
অর্ক চুপ।লোকটা এসে অর্কের মাথায় টোকা মারল।বলল---পরের বার দেখে আসিস।তারপর বলিস তোর মা আর বাপের ফারাক কি কি আছে!
অর্ক বড় রাস্তায় এসে অটো ধরল।বাড়ী ফিরে দেখল মা কোমরে শাড়ি বেঁধে ঝুল ঝাড়ছে।অর্ককে দেখে বলল---কি রে ক্লাস ঠিকঠাক হল?
অর্ক মাথা নাড়ল।
*******
ছোট থেকে বাবাকে পেয়েছে অর্ক।বাবার ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় তার বেশ বিষন্ন লাগে।তার কলেজ খুলে গেছে।
সে খুব একা বোধ করছে।ঘড়ির দিকে তাকালো সে।রাত্রি সাড়ে আটটা।আজ শনিবার তবুও তার মায়ের আসতে দেরী হচ্ছে।সুছন্দার আসতে এখন প্রতিদিন আরো দেরী হয়।অর্ক বই পত্র গুছিয়ে উঠল।টিভিটা চালিয়ে সে কিছু পুরোনো ম্যাচের ক্লিপিংস দেখতে লাগল।
সাড়ে ন'টার সময় সুছন্দা ঢুকল।ঢুকেই বলল---কি রে পড়া হয়ে গেছে?
---হ্যা মা।এত দেরী হল কেন মা?
সুছন্দা শাড়ি বদল করতে করতে বলল---এখন অফিসের খুব কাজের চাপ রে!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো সুছন্দা।বলল---রাতে কি খাবি বল?
---তুমি যা চাইবে করো।
সুছন্দা রান্না ঘরে ঢুকে গেল।প্রতিদিন অর্কর যেন আরো বেশি একা মনে হচ্ছে।কলেজের বন্ধুদের সাথে তার কলেজেই দেখা হয়।টিউশন তার সপ্তাহে তিন দিন থাকে।দুদিন সকালে তার বাড়ীতে সায়েন্সের স্যার আসেন।তিনদিন বিকেলে আসেন আর্টসের স্যার।সবই বাড়ীতে, ফলে কলেজের বন্ধুদের সাথে তার আর দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।
সে কখনো ভিডিও গেমস কখনো ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বসে।মনে পড়ল কাল রবিবার, আবার সেই আঁকার স্যারের কাছে যেতে হবে।ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল।
সুছন্দা রান্না করে ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়ে ডাকল---অর্ক চলে আয়।
পরদিন সকালে সুছন্দা তুলে দিল অর্ককে---আঁকা স্যারের কাছে যেতে হবে যে?
অর্ক বলল---মা, একটু ঘুমোই না, আজ তো রবিবার।
---কত ঘুমোবি, ওঠ!
অর্ক ব্রাশ করে, জলখাবার খেয়ে রেডি হয়ে পড়ল।আঁকা স্যারের বাড়ী পৌঁছে দেখল সেই টিনের দরজাটা বন্ধ।না, কোনো তালা দেওয়া নেই।ভেতরে হাত গলিয়ে খুলে দেওয়া যায়।অর্ক দরজাটা খুলে কাঠের দরজায় নক করল।
কিছুক্ষণ পর লোকটা এসে দরজা খুলল।সেই গম্ভীর মুখ, নোংরা লম্বা পাতলা ঘর্মাক্ত চেহারা!
অর্কর দেখলেই ভয় করে।ভেতরে ঢুকে বসাবার কিছুক্ষণ পর আঁকার স্যার এলো।এসেই বলল---কি রে!বাপ আর মায়ের ফারাক দেখে এসেছিস?
অর্ক ভয়ে ভয়ে বলল--বাবা খেতে ভালো বাসে, মা বই পড়তে, বাবা ব্যাঙ্কে চাকরী করে, মা পোস্ট অফিসে।
---দূর বাঁড়া! লোকটা খেঁকিয়ে উঠল।বলল---বাবা আর মায়ের ছবি আঁকতে দিলে তুই কি করবি? একটা দুপেয়ে জন্তু ব্যাঙ্কে বসে গিলছে আর একটা দু পেয়ে জন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়ছে?
অর্ক চুপ করে গেল।লোকটার গা দিয়ে তীব্র ঘামের গন্ধ! অর্ক মনে মনে ভাবল স্নান করেনা নাকি!
লোকটা বলল---তোর বাপের দুধ নেই, তোর মায়ের দুধ আছে, তার মানে পুরুষ আঁকলে বুক সমান হবে আর নারী আঁকলে ভারী দুটো বুক হবে।
লোকটা এঁকে যাচ্ছে পোট্রেটে।একটা নগ্ন নারী হাঁসের মত ডানা মেলে আছে।তার কেবল ঊর্ধাঙ্গ নগ্ন, নিম্নাঙ্গ হাঁসের মত।দুটো ডানা মেলে আছে, আর একটা পুরুষ যে সেটা ধরে ফেলবার চেষ্টা করছে।
অর্ক তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে।খুব নিখুঁত আঁকা হলেও ছবিটার মাথা মুন্ডু সে বুঝে উঠতে পারল না।
লোকটা এবার ঘুরে পড়ে বলল--ফ্যালফেলিয়ে দেখছিস কি? যেন তোর মার দুধ নেই! দুধ খাসনি তুই?
অর্ক লজ্জায় ঘৃণায় লাল হয়ে উঠল।লোকটা বলল--- যেটা আঁকলাম আঁক।
অর্ক চেষ্টা করল।পারফেক্ট হল না।অর্ক জানে এবার সে গালি খাবে।লোকটা হেসে উঠল বলল---দুধ আঁকতে লজ্জা শালা! মায়ের দুধ খাসনি? না কি তোর বাপ সব খেয়ে ফেলত তোকে দিত না।
অর্ক চুপটি করে বসে থাকল।লোকটা এবার একটা শেপ দিয়ে দেখালো।অর্ক অনুকরণ করল।দেখল এবার হচ্ছে।
লোকটা হেসে উঠল।সেই অশ্লীল হাসি।একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল---তোর মা কাল বলল তুই খুব ওবিডিয়েন্ট ছেলে সত্যিই তুই খুব শান্ত।
অর্ক ভাবল কাল মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল স্যারের।কই মা বলেনিতো।লোকটা এবার একটু নরম গলায় বলল---তুই পারবি।চেষ্টা কর পারবি।তোর মা আজ এলে তোর প্রশংসা করে দেব।
অর্কের কানে লোকটার প্রশংসা ঢুকছে না।কেবল সে ভাবছে মা কোথায় আসবে? মা কি এখানে আসবে?
অর্ক আবার আঁকায় মন দিল।বলল---স্যার দেখুন হয়েছে?
লোকটা বিড়ির টুকরোটা ঐখানেই ফেলে দিয়েই বলল---হয়েছে, তবে দুধ গুলো ছোট হয়ে গেল! তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি বোধ হয়।আজ তোর মাকে জিজ্ঞেস করব তার বুকের দুধ যেত কোথায়?
অর্ক কিছু বলল না।আঁকার ক্লাস শেষ করে সে যখন বাড়ী ফিরল দেখল মা স্নানে গেছে।
অর্কের সত্যি এই স্যারকে একদম ভাল্লাগেনা।সে রবিবার আসবে ভাবলেই ভয় পায়।
মা স্নান করে বেরোতেই সে বলল---মা তুমি কাল স্যারের বাড়ী গেছিলে?
সুছন্দা ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল---কোন স্যারের বাড়ী?
---আঁকা স্যার?
---কই না তো।
অর্ক ভাবল তাহলে কি স্যার ভুল বলল।সুছন্দা বলল--কেন? কানু দা কিছু বলছিল নাকি?
---হ্যা, বললেন তুমি এসছিলে।
সুছন্দা চুল ঝাড়া থামিয়ে বলল---আর কি বলছিল?
অর্ক গালি গুলো বলতে পারল না।বলল--তুমি আমার প্রশংসা করেছ।
সুছন্দা হাসল।বলল---লোকের কাছে তোর প্রশংসা করি বলে তুই আবার মাথায় উঠে যাসনা।
অর্ক কিছু বলল না।নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
কলেজবাস থেকে নেমে নিজেই বাড়ীর চাবি খুলে ঘরে ঢোকে অর্ক।তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে।ব্যাগের একের পর এক চেইন খুলে দেখল চাবি নেই।বুঝল সে চাবি আজ বাড়ী থেকে নেয়নি।অর্ক বেরোনোর পর সুছন্দা অফিস বেরোয়।সুছন্দাই মনে করে অর্ককে চাবি দিয়ে দেয়।
অর্ক বাড়ীর গ্রীল খুলে তাদের ছোট্ট বারান্দায় বসে রইল।অর্ক জানে তার মা ফিরতে ফিরতে সেই রাত্রি ন'টা বাজবে।তারচেয়ে বরং সে তার বন্ধু শান্তনুর বাড়ী চলে যাওয়াটাই ঠিক মনে করল।
শান্তনুদের বাড়ীতে কুকুর আছে।অর্কের আবার কুকুরের ভয়।অর্ক বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।শান্তনুর মা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বললেন---ও মা! অর্ক? এই টুবাই অর্ক এসছে।
শান্তনুর ডাকনাম টুবাই।শান্তনু নেমে এলো।তার পিছু পিছু জার্মান শেফার্ডটাও নেমে এলো।শান্তনুর মা কুকুরটাকে নিয়ন্ত্রন করে নিয়ে গেলেন।অর্ক নিশ্চিন্ত হল।
শান্তনু বলল---কি রে? তুই বাড়ী যাসনি।
---না রে, আমি আজ চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গেছি।মা অফিস থেকে ফিরতে দেরী হবে।
শান্তনু বলল---ভালোই হল, আমি ভাবছিলাম আজকে গেম স্টোরে যাবো।চল দুজনে যাওয়া যাবে।
অর্ক আর শান্তনু বেরোলো।অর্ক বাপিকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই গেম স্টোরে এসছে।অর্কের মা আবার গেম টেম পছন্দ করে না।তাই সুছন্দা রঞ্জনকে বলত---এইসব কিনে দিয়ে ছেলেটার ফিউচার নষ্ট করছ।তবু রঞ্জন কিনে দিত।
গেম স্টোরে গিয়ে শান্তনু এক একটা গেমসের প্রাইস চেক করছিল।অর্ক দেখছিল তার এসব আছে।এখন পছন্দ হলেও সে কিনতে পারবে না।এখন তার কাছে পয়সা নেই।পরে মাকে নিয়ে আসবে ঠিক করল সে।
গেমস্টোর থেকে বেরিয়ে অর্ক জিজ্ঞেস করল---ক'টা বাজেরে?
শান্তনুর হাতে রিস্টওয়াচ আছে।সে দেখে বলল---ছ'দশ।
অর্ক মনে মনে ভাবল তার মা'র ফিরতে এখনো অনেক দেরী।
শান্তনু বলল---ফুচকা খাবি?
ফুচকা দোকানটা রাস্তার ওপারে।পারাপার হবে অর্ক ঠিক সেই সময় দেখল অনাদি জেঠুকে।অনাদি রঞ্জন দাস সুছন্দার কলিগ।অর্ক বলল---আরে অনাদি জেঠু ভালো আছেন?
---আরে তুমি সুছন্দার ছেলে না?কলেজ ড্রেসে?
---আমি বাড়ীর চাবি নিতে ভুলে গেছি।মা অফিস থেকে না ফিরলে...তাই বন্ধুর সঙ্গে এসছি।
অনাদিরঞ্জন বললেন---তবে জলদি যাও।তোমার মা এতক্ষনে বাড়ী পৌঁছে গেছেন।টেনশন করছেন হয়ত।
শান্তনু বলল---এই রে কাকিমা এসে গেছে তো।আর ফুচকা খাওয়া হবে না।
অর্ক বলল---অন্য একদিন হবে।
অর্ক বাড়ী ফিরে দেখল না মা ফেরেনি।লোহার গেট খুলে প্রায় দশ মিনিট বসে রইল সে বাড়ীর বাগানে।তারপর তার মনে পড়ল--আরে! স্যার বলেছিলেন মা ওখানে যাবে।
অর্ক ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো।একটা অটোকে দাঁড় করিয়ে বলল---বড় রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দেবেন।
বড় রাস্তায় নেমে সে মোরাম রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল।পিচ রাস্তায় উঠেই স্যারের দোতলা ইটের ভাঙাচোরা বাড়ীর টিনের দরজায় কড়া নাড়ল।
কোনো সাড়াশব্দ নেই!
আবার নাড়ল।কিছুক্ষণ পর ভেতরে কাঠের দরজা খোলার শব্দ পেল অর্ক।তারপর টিনের দরজা খুলে আঁকার স্যার বললেন---কি রে তুই!
অর্ক কেমন এই লোকটাকে দেখলেই ভয়ে গুটিয়ে যায়।লোকটার সারা গা ঘামে চপচপ করছে।যেন কোনো ভারী কাজ করছিল।
অর্ক বলল---স্যার! মা আছে?
---আছে।কি দরকার?
অর্ক এমন জবাবে অবাক হল।তার মায়ের সাথে তার কি দরকার সেটা তাকে বলতে হবে।
লোকটার গলাটাই বেশ রূঢ়।অর্ক বলল---মাকে ডেকে দিন।
লোকটা কি একটা ভাবল।বলল---দাঁড়া ডেকে দিচ্ছি।বলেই টিনের দরজাটা অর্কের মুখের সামনে এঁটে দিল।অর্ক শব্দ পেল কাঠের দরজাটাও লেগে যাবার।
অর্ক চেয়েছিল ভেতরে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে।কিন্তু লোকটা এভাবে দরজা বন্ধ করে চলে যাবে ভাবতে পারেনি।
অর্ক রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।কি অদ্ভুত মা এতো দেরী করছে কেন?
অর্ক দাঁড়িয়ে রইল।মায়ের কি কিছু জরুরী কাজ আছে, তাই দেরী হচ্ছে? অর্ক নানাবিধ ভাবল।
অবশেষে সে ভেতরে হাত গলিয়ে টিনের দরজাটা খুলে ফেলল।ভেতরে ঢুকে দেখল কাঠের দরজাটা বন্ধ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল সে।বাইরে বেরিয়ে এলো।রাস্তা দিয়ে একটা সাতাশ আঠাশ বছরের যুবক যাচ্ছে।বস্তির ছেলে বোধ হয়।লুঙ্গি পরা, হাতে মোবাইলে ভোজপুরি গান শুনতে শুনতে চলেছে।
অর্ক বলল---দাদা ক'টা বাজে?
ছেলেটা মোবাইলের টাইম দেখে বলল---সাতটা কুড়ি।
অর্ক বুঝল পাক্কা এক ঘন্টা সে দাঁড়িয়ে আছে।আর অপেক্ষা না করে সে বাড়ীর পথে রওনা দিল।
তেষ্টা পাচ্ছে তার।বাড়ীর বাগানের কাছে বসে সে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করল।ঢকঢক করে জল খেয়ে ব্যাগে বোতলটা রাখতে গিয়ে দেখল ওই তো চাবি!
নিজেকে দূষতে থাকল সে।এমনিই তার ধকল গেল।দরজা খুলে সোজা ড্রয়িং রুমের সোফায় আছড়ে পড়ল সে।
প্রতিদিনের মত ন'টার পর হাজির হল সুছন্দা।অর্কর ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকাডাকিতে।---ওঠ বাবা, খাবি ওঠ!
অর্ক বুঝল সে এতক্ষণ ঘুমিয়ে গেছিল।তার মা এসে আর ডাকেনি।খেতে বসে অর্ক ভাবল মাকে বলবে স্যারের বাড়ীতে গেলাম, তুমি এত দেরী করলে চলে এলাম।তারপরে তার মনে হল, তাহলে তার মা'ই বলত চলে গেলি কেন? তবে কি স্যার মাকে জানায়নি? অর্কের এমনিতেই লোকটাকে পছন্দ নয়, তাই সে একদম নিশ্চিত হল লোকটা মাকে জানায়নি।তা নাহলে মা নিশ্চিত এত দেরী করত না।আর কাজ থাকলে বেরিয়ে বলত দেরী হবে বলে।কিন্তু স্যারের বাড়ীতে মা'র কি কাজ থাকে।একবার জিজ্ঞেস করবে?
অর্ক কোনোদিন বাপি-মায়ের অফিস সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো প্ৰশ্ন করেনি।এটা তার অভ্যাসের বাইরে।তাই সে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করল না।কিন্তু প্ৰশ্নটা তার মনের মধ্যে থেকে গেল।
(চলবে)
---বাইরে কোথায় কি ফালতু জিনিস কিনবে কেন?
বাবা চলে যেতে অর্কের মনটা খারাপ হয়ে গেল।সুছন্দা বলল---অর্ক ঘুমিয়ে পড়।কাল রবিবার আঁকার নতুন স্যারের কাছে যেতে হবে মনে আছে তো?
খুব ভোরে অর্ককে তুলে দিল সুছন্দা।অর্ক ব্রাশ করে আসতেই সুছন্দা বলল---তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নেয়ে।তোকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বাড়ী ফিরতে হবে।অনেক কাজ আছে।কাজের মেয়েটা আজ আসবে না এমনিতে।
অর্ক রেডি হয়ে দেখল মাও রেডি।সুছন্দা একটা সবুজ রঙের তাঁত শাড়ি আর ছাইরঙা ব্লাউজ পরেছে।হাতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলল---সব কিছু ঠিকঠাক নিয়েছিস?
অর্ক মাথা নাড়ল।
সুছন্দা বাড়ী থেকে বেরিয়ে একটা অটোকে দাঁড় করালো।বলল---বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেবেন।
অর্ক দেখল মাত্র পাঁচ মিনিট লাগল অটোতে।হেঁটেও আসা যায়।একটা মোরাম রাস্তা দিয়ে মাকে এগিয়ে যেতে দেখে অর্কও পিছু নিল।জায়গাটা বেশ ফাঁকা।কিছুটা যাবার পর।অর্ক দেখল একটা পিচ রাস্তায় উঠল।পিচ রাস্তাটা দেখে অর্ক চিনতে পারল এটা বস্তি যাবার রাস্তাটা শেষ হয়েছে।অর্ক একবার বাপির সঙ্গে বস্তিতে এসেছিল।তাদের বাড়ীর রঙমিস্ত্রী যে লোকটা আসতো তার বাড়ীতে।
পিচরাস্তার শেষমাথাতেই বাড়িটা।রাস্তার গায়ে ইটের দেওয়ালের বাড়ী।রাস্তা সংলগ্নই টিনের দরজা।
দরজাটা সুছন্দা খুলে বলল---ভেতরে আয়।অর্ক ভেতরে ঢুকে দেখল।সামনে একটা টিউওয়েল।তার মুখেই কাঠের দরজা।
সুছন্দা দরজাটায় শব্দ করল।প্রায় দু-তিন মিনিট পর ক্যাঁচ করে শব্দ হল দরজায়।অর্ক দেখল একটা লোক খালি গায় দাঁড়িয়ে।লোকটা বেশ লম্বা হলেও পাতলা।চুলগুলো এলোমেলো উষ্কখুস্ক।দীর্ঘদিন সাবান না পড়লে যেমন লালচে হয় তেমন।দাড়ি গোঁফ সবই খোঁচা খোঁচা।মোটা ঠোঁট দুটোর কোন ক্ষয়ে গেছে।রাগি গম্ভীর মুখ।গায়ে ভীষন ঘাম।গায়ের রঙ কালো নয়।বরং রোদে পোড়া।পরনে ময়লা লুঙ্গি।হাতে জ্বলছে একটা বিড়ি।
সুছন্দা বলল---এই যে তোমার ছাত্র কানু দা!!!!
অর্ককে প্রনাম করতে ইশারা করল সুছন্দা।অর্ক মায়ের কথা মত প্রনাম করল।কিন্তু লোকটার কোনো অভিব্যপ্তি নেই।
অর্কর কেমন অদ্ভুত লাগছিল লোকটাকে।ভেতরে ঢুকে দেখল মুখেই একটা সিঁড়ি।সিঁড়িতে কোনো প্লাস্টার নেই।আর নিচে ভাঙা চোরা যত জিনিসপত্র রাখা।একটা ভ্যাপসা গুমোট মত আবহাওয়া।
নিচেই একটা ঘরে নিয়ে গেল লোকটা।সুছন্দা অর্ককে একটা চেয়ারে বসতে বলল।অর্ক দেখল চারদিকে ল্যান্ডস্কেপ, পোট্রেট আঁকা।এই ঘরটাও যত্রতত্র জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
সুছন্দা বলল---তাহলে আসি।একা যেতে পারবি তো?
অর্ক মাথা নাড়ল মায়ের কথায় সায় দিয়ে।
মা চলে যাবার পর অর্ক তার ড্রয়িং পেপার, ব্রাশ বের করল।অর্ক দেখল স্যার একটা ব্ল্যাংক পোট্রেট আনলেন।খুব গম্ভীর গলায় বললেন---তোর নাম কি?
---অর্ক মৈত্র!
---বাপের নাম কি? কথা বলতে বলতেই লোকটা ঝটঝট করে পেনশিল স্কেচ করে যাচ্ছেন।
অর্ক লোকটার মুখে 'বাপ' কথাটা শুনে খারাপ লাগল।মুখের উপর বলল---বাপ না বাপি!
লোকটা বিচ্ছিরি ভাবে বলল---ওই ওই হল! শালা ইংরেজের বাচ্চা হয়েছ! কি নাম তোর বাপির?
অর্ক ভাবলো এ কেমন স্যার! মুখের ভাষা এত খারাপ কেন!
----রঞ্জন মৈত্র।
লোকটা এবার বলল---ঠাকুর্দার নাম কি?
অর্ক বলল---বিমল মৈত্র।
লোকটা কোনো কথা আর বলল না।এঁকে যাচ্ছে এক মনে।অর্ক দেখছি লোকটা যতই খারাপ হোক।আঁকে দারুন।কিন্তু সে এখান থেকে কিছুই শিখতে পারছে না।
সে তাই বলল---স্যার আমি তো এসব শিখিনি।
গলা খাঁকারি দিয়ে লোকটা বলল---শিখিসনি শিখে যাবি!দে পেন্সিল দে।
অর্ক পেন্সিল দিল।লোকটা একটা বাঁক নিয়ে ময়ূর এঁকে দিল।এই ময়ূর একটা আর্ট ফর্মে আঁকা।অর্কও নকল করে আঁকল।দেখল বেশ তো হল।
লোকটা এবার বলল---কিরে বড়লোকের নাতি? হল?
অর্ক মাথা নাড়ল।লোকটাকে সত্যিই তার পছন্দ হচ্ছে না।
এবার লোকটা আবার একটা টার্ন নিল।একটা হরিণ হয়ে গেল।অর্ক চেষ্টা করল।হল না।
লোকটা হলদে দাঁত বের করে খিঁচিয়ে বলল---বাঞ্চোদ! বাল ছিঁড়তে এসেছো এখানে?
অর্ক ভয় পেয়ে গেল।এমন অশ্লীল কথা তাকে কেউ বলবে সে কল্পনাও করতে পারেনি।সে মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে এমন নোংরা কথা শুনে সে যেমন ঘৃণা বোধ করছিল তেমন লোকটার মুখ ভঙ্গি দেখে ভয় পেল।
লোকটা এবার ওর হাত থেকে পেন্সিল ছাড়িয়ে আবার আঁক কষল।অর্কও এবার করল।আস্তে আস্তে হরিণটাও গড়ে উঠল।
এবার বলল---বল দেখি ময়ূর আর ময়ূরী চিনবি কি করে?
অর্ক ভয়ে ভয়ে বলল--ময়ূরের পেখম আছে! ময়ূরীর পেখম নেই!
---হুম্ম।এইবার দেখ! বলে একটা ময়ূরী আঁকল।
এবার বলল---বলতো মানুষ আর মানুষী চিনবি কি করে?
অর্ক কিছু বলতে পারল না।আসলে সে কি বলবে বুঝতে পাচ্ছিল না।
লোকটা বিচ্ছিরি করে অশালীন হাসি হাসল।---তোর বাপ আর মাকে চিনিস তো?
অর্ক চুপ করে বসে আছে।লোকটা ধমক দিয়ে বলল---কি হল বল!
অর্ক চমকে উঠল।সে ভয়ে কাঁপছে।বলল---চিনি।
---হুম।কি করে চিনলি?
অর্ক চুপ।লোকটা এসে অর্কের মাথায় টোকা মারল।বলল---পরের বার দেখে আসিস।তারপর বলিস তোর মা আর বাপের ফারাক কি কি আছে!
অর্ক বড় রাস্তায় এসে অটো ধরল।বাড়ী ফিরে দেখল মা কোমরে শাড়ি বেঁধে ঝুল ঝাড়ছে।অর্ককে দেখে বলল---কি রে ক্লাস ঠিকঠাক হল?
অর্ক মাথা নাড়ল।
*******
ছোট থেকে বাবাকে পেয়েছে অর্ক।বাবার ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় তার বেশ বিষন্ন লাগে।তার কলেজ খুলে গেছে।
সে খুব একা বোধ করছে।ঘড়ির দিকে তাকালো সে।রাত্রি সাড়ে আটটা।আজ শনিবার তবুও তার মায়ের আসতে দেরী হচ্ছে।সুছন্দার আসতে এখন প্রতিদিন আরো দেরী হয়।অর্ক বই পত্র গুছিয়ে উঠল।টিভিটা চালিয়ে সে কিছু পুরোনো ম্যাচের ক্লিপিংস দেখতে লাগল।
সাড়ে ন'টার সময় সুছন্দা ঢুকল।ঢুকেই বলল---কি রে পড়া হয়ে গেছে?
---হ্যা মা।এত দেরী হল কেন মা?
সুছন্দা শাড়ি বদল করতে করতে বলল---এখন অফিসের খুব কাজের চাপ রে!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো সুছন্দা।বলল---রাতে কি খাবি বল?
---তুমি যা চাইবে করো।
সুছন্দা রান্না ঘরে ঢুকে গেল।প্রতিদিন অর্কর যেন আরো বেশি একা মনে হচ্ছে।কলেজের বন্ধুদের সাথে তার কলেজেই দেখা হয়।টিউশন তার সপ্তাহে তিন দিন থাকে।দুদিন সকালে তার বাড়ীতে সায়েন্সের স্যার আসেন।তিনদিন বিকেলে আসেন আর্টসের স্যার।সবই বাড়ীতে, ফলে কলেজের বন্ধুদের সাথে তার আর দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।
সে কখনো ভিডিও গেমস কখনো ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বসে।মনে পড়ল কাল রবিবার, আবার সেই আঁকার স্যারের কাছে যেতে হবে।ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল।
সুছন্দা রান্না করে ডাইনিং টেবিলে খাবার বেড়ে ডাকল---অর্ক চলে আয়।
পরদিন সকালে সুছন্দা তুলে দিল অর্ককে---আঁকা স্যারের কাছে যেতে হবে যে?
অর্ক বলল---মা, একটু ঘুমোই না, আজ তো রবিবার।
---কত ঘুমোবি, ওঠ!
অর্ক ব্রাশ করে, জলখাবার খেয়ে রেডি হয়ে পড়ল।আঁকা স্যারের বাড়ী পৌঁছে দেখল সেই টিনের দরজাটা বন্ধ।না, কোনো তালা দেওয়া নেই।ভেতরে হাত গলিয়ে খুলে দেওয়া যায়।অর্ক দরজাটা খুলে কাঠের দরজায় নক করল।
কিছুক্ষণ পর লোকটা এসে দরজা খুলল।সেই গম্ভীর মুখ, নোংরা লম্বা পাতলা ঘর্মাক্ত চেহারা!
অর্কর দেখলেই ভয় করে।ভেতরে ঢুকে বসাবার কিছুক্ষণ পর আঁকার স্যার এলো।এসেই বলল---কি রে!বাপ আর মায়ের ফারাক দেখে এসেছিস?
অর্ক ভয়ে ভয়ে বলল--বাবা খেতে ভালো বাসে, মা বই পড়তে, বাবা ব্যাঙ্কে চাকরী করে, মা পোস্ট অফিসে।
---দূর বাঁড়া! লোকটা খেঁকিয়ে উঠল।বলল---বাবা আর মায়ের ছবি আঁকতে দিলে তুই কি করবি? একটা দুপেয়ে জন্তু ব্যাঙ্কে বসে গিলছে আর একটা দু পেয়ে জন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়ছে?
অর্ক চুপ করে গেল।লোকটার গা দিয়ে তীব্র ঘামের গন্ধ! অর্ক মনে মনে ভাবল স্নান করেনা নাকি!
লোকটা বলল---তোর বাপের দুধ নেই, তোর মায়ের দুধ আছে, তার মানে পুরুষ আঁকলে বুক সমান হবে আর নারী আঁকলে ভারী দুটো বুক হবে।
লোকটা এঁকে যাচ্ছে পোট্রেটে।একটা নগ্ন নারী হাঁসের মত ডানা মেলে আছে।তার কেবল ঊর্ধাঙ্গ নগ্ন, নিম্নাঙ্গ হাঁসের মত।দুটো ডানা মেলে আছে, আর একটা পুরুষ যে সেটা ধরে ফেলবার চেষ্টা করছে।
অর্ক তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে।খুব নিখুঁত আঁকা হলেও ছবিটার মাথা মুন্ডু সে বুঝে উঠতে পারল না।
লোকটা এবার ঘুরে পড়ে বলল--ফ্যালফেলিয়ে দেখছিস কি? যেন তোর মার দুধ নেই! দুধ খাসনি তুই?
অর্ক লজ্জায় ঘৃণায় লাল হয়ে উঠল।লোকটা বলল--- যেটা আঁকলাম আঁক।
অর্ক চেষ্টা করল।পারফেক্ট হল না।অর্ক জানে এবার সে গালি খাবে।লোকটা হেসে উঠল বলল---দুধ আঁকতে লজ্জা শালা! মায়ের দুধ খাসনি? না কি তোর বাপ সব খেয়ে ফেলত তোকে দিত না।
অর্ক চুপটি করে বসে থাকল।লোকটা এবার একটা শেপ দিয়ে দেখালো।অর্ক অনুকরণ করল।দেখল এবার হচ্ছে।
লোকটা হেসে উঠল।সেই অশ্লীল হাসি।একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল---তোর মা কাল বলল তুই খুব ওবিডিয়েন্ট ছেলে সত্যিই তুই খুব শান্ত।
অর্ক ভাবল কাল মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল স্যারের।কই মা বলেনিতো।লোকটা এবার একটু নরম গলায় বলল---তুই পারবি।চেষ্টা কর পারবি।তোর মা আজ এলে তোর প্রশংসা করে দেব।
অর্কের কানে লোকটার প্রশংসা ঢুকছে না।কেবল সে ভাবছে মা কোথায় আসবে? মা কি এখানে আসবে?
অর্ক আবার আঁকায় মন দিল।বলল---স্যার দেখুন হয়েছে?
লোকটা বিড়ির টুকরোটা ঐখানেই ফেলে দিয়েই বলল---হয়েছে, তবে দুধ গুলো ছোট হয়ে গেল! তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি বোধ হয়।আজ তোর মাকে জিজ্ঞেস করব তার বুকের দুধ যেত কোথায়?
অর্ক কিছু বলল না।আঁকার ক্লাস শেষ করে সে যখন বাড়ী ফিরল দেখল মা স্নানে গেছে।
অর্কের সত্যি এই স্যারকে একদম ভাল্লাগেনা।সে রবিবার আসবে ভাবলেই ভয় পায়।
মা স্নান করে বেরোতেই সে বলল---মা তুমি কাল স্যারের বাড়ী গেছিলে?
সুছন্দা ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল---কোন স্যারের বাড়ী?
---আঁকা স্যার?
---কই না তো।
অর্ক ভাবল তাহলে কি স্যার ভুল বলল।সুছন্দা বলল--কেন? কানু দা কিছু বলছিল নাকি?
---হ্যা, বললেন তুমি এসছিলে।
সুছন্দা চুল ঝাড়া থামিয়ে বলল---আর কি বলছিল?
অর্ক গালি গুলো বলতে পারল না।বলল--তুমি আমার প্রশংসা করেছ।
সুছন্দা হাসল।বলল---লোকের কাছে তোর প্রশংসা করি বলে তুই আবার মাথায় উঠে যাসনা।
অর্ক কিছু বলল না।নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
কলেজবাস থেকে নেমে নিজেই বাড়ীর চাবি খুলে ঘরে ঢোকে অর্ক।তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে।ব্যাগের একের পর এক চেইন খুলে দেখল চাবি নেই।বুঝল সে চাবি আজ বাড়ী থেকে নেয়নি।অর্ক বেরোনোর পর সুছন্দা অফিস বেরোয়।সুছন্দাই মনে করে অর্ককে চাবি দিয়ে দেয়।
অর্ক বাড়ীর গ্রীল খুলে তাদের ছোট্ট বারান্দায় বসে রইল।অর্ক জানে তার মা ফিরতে ফিরতে সেই রাত্রি ন'টা বাজবে।তারচেয়ে বরং সে তার বন্ধু শান্তনুর বাড়ী চলে যাওয়াটাই ঠিক মনে করল।
শান্তনুদের বাড়ীতে কুকুর আছে।অর্কের আবার কুকুরের ভয়।অর্ক বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।শান্তনুর মা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বললেন---ও মা! অর্ক? এই টুবাই অর্ক এসছে।
শান্তনুর ডাকনাম টুবাই।শান্তনু নেমে এলো।তার পিছু পিছু জার্মান শেফার্ডটাও নেমে এলো।শান্তনুর মা কুকুরটাকে নিয়ন্ত্রন করে নিয়ে গেলেন।অর্ক নিশ্চিন্ত হল।
শান্তনু বলল---কি রে? তুই বাড়ী যাসনি।
---না রে, আমি আজ চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গেছি।মা অফিস থেকে ফিরতে দেরী হবে।
শান্তনু বলল---ভালোই হল, আমি ভাবছিলাম আজকে গেম স্টোরে যাবো।চল দুজনে যাওয়া যাবে।
অর্ক আর শান্তনু বেরোলো।অর্ক বাপিকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই গেম স্টোরে এসছে।অর্কের মা আবার গেম টেম পছন্দ করে না।তাই সুছন্দা রঞ্জনকে বলত---এইসব কিনে দিয়ে ছেলেটার ফিউচার নষ্ট করছ।তবু রঞ্জন কিনে দিত।
গেম স্টোরে গিয়ে শান্তনু এক একটা গেমসের প্রাইস চেক করছিল।অর্ক দেখছিল তার এসব আছে।এখন পছন্দ হলেও সে কিনতে পারবে না।এখন তার কাছে পয়সা নেই।পরে মাকে নিয়ে আসবে ঠিক করল সে।
গেমস্টোর থেকে বেরিয়ে অর্ক জিজ্ঞেস করল---ক'টা বাজেরে?
শান্তনুর হাতে রিস্টওয়াচ আছে।সে দেখে বলল---ছ'দশ।
অর্ক মনে মনে ভাবল তার মা'র ফিরতে এখনো অনেক দেরী।
শান্তনু বলল---ফুচকা খাবি?
ফুচকা দোকানটা রাস্তার ওপারে।পারাপার হবে অর্ক ঠিক সেই সময় দেখল অনাদি জেঠুকে।অনাদি রঞ্জন দাস সুছন্দার কলিগ।অর্ক বলল---আরে অনাদি জেঠু ভালো আছেন?
---আরে তুমি সুছন্দার ছেলে না?কলেজ ড্রেসে?
---আমি বাড়ীর চাবি নিতে ভুলে গেছি।মা অফিস থেকে না ফিরলে...তাই বন্ধুর সঙ্গে এসছি।
অনাদিরঞ্জন বললেন---তবে জলদি যাও।তোমার মা এতক্ষনে বাড়ী পৌঁছে গেছেন।টেনশন করছেন হয়ত।
শান্তনু বলল---এই রে কাকিমা এসে গেছে তো।আর ফুচকা খাওয়া হবে না।
অর্ক বলল---অন্য একদিন হবে।
অর্ক বাড়ী ফিরে দেখল না মা ফেরেনি।লোহার গেট খুলে প্রায় দশ মিনিট বসে রইল সে বাড়ীর বাগানে।তারপর তার মনে পড়ল--আরে! স্যার বলেছিলেন মা ওখানে যাবে।
অর্ক ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো।একটা অটোকে দাঁড় করিয়ে বলল---বড় রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দেবেন।
বড় রাস্তায় নেমে সে মোরাম রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল।পিচ রাস্তায় উঠেই স্যারের দোতলা ইটের ভাঙাচোরা বাড়ীর টিনের দরজায় কড়া নাড়ল।
কোনো সাড়াশব্দ নেই!
আবার নাড়ল।কিছুক্ষণ পর ভেতরে কাঠের দরজা খোলার শব্দ পেল অর্ক।তারপর টিনের দরজা খুলে আঁকার স্যার বললেন---কি রে তুই!
অর্ক কেমন এই লোকটাকে দেখলেই ভয়ে গুটিয়ে যায়।লোকটার সারা গা ঘামে চপচপ করছে।যেন কোনো ভারী কাজ করছিল।
অর্ক বলল---স্যার! মা আছে?
---আছে।কি দরকার?
অর্ক এমন জবাবে অবাক হল।তার মায়ের সাথে তার কি দরকার সেটা তাকে বলতে হবে।
লোকটার গলাটাই বেশ রূঢ়।অর্ক বলল---মাকে ডেকে দিন।
লোকটা কি একটা ভাবল।বলল---দাঁড়া ডেকে দিচ্ছি।বলেই টিনের দরজাটা অর্কের মুখের সামনে এঁটে দিল।অর্ক শব্দ পেল কাঠের দরজাটাও লেগে যাবার।
অর্ক চেয়েছিল ভেতরে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে।কিন্তু লোকটা এভাবে দরজা বন্ধ করে চলে যাবে ভাবতে পারেনি।
অর্ক রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।কি অদ্ভুত মা এতো দেরী করছে কেন?
অর্ক দাঁড়িয়ে রইল।মায়ের কি কিছু জরুরী কাজ আছে, তাই দেরী হচ্ছে? অর্ক নানাবিধ ভাবল।
অবশেষে সে ভেতরে হাত গলিয়ে টিনের দরজাটা খুলে ফেলল।ভেতরে ঢুকে দেখল কাঠের দরজাটা বন্ধ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল সে।বাইরে বেরিয়ে এলো।রাস্তা দিয়ে একটা সাতাশ আঠাশ বছরের যুবক যাচ্ছে।বস্তির ছেলে বোধ হয়।লুঙ্গি পরা, হাতে মোবাইলে ভোজপুরি গান শুনতে শুনতে চলেছে।
অর্ক বলল---দাদা ক'টা বাজে?
ছেলেটা মোবাইলের টাইম দেখে বলল---সাতটা কুড়ি।
অর্ক বুঝল পাক্কা এক ঘন্টা সে দাঁড়িয়ে আছে।আর অপেক্ষা না করে সে বাড়ীর পথে রওনা দিল।
তেষ্টা পাচ্ছে তার।বাড়ীর বাগানের কাছে বসে সে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করল।ঢকঢক করে জল খেয়ে ব্যাগে বোতলটা রাখতে গিয়ে দেখল ওই তো চাবি!
নিজেকে দূষতে থাকল সে।এমনিই তার ধকল গেল।দরজা খুলে সোজা ড্রয়িং রুমের সোফায় আছড়ে পড়ল সে।
প্রতিদিনের মত ন'টার পর হাজির হল সুছন্দা।অর্কর ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকাডাকিতে।---ওঠ বাবা, খাবি ওঠ!
অর্ক বুঝল সে এতক্ষণ ঘুমিয়ে গেছিল।তার মা এসে আর ডাকেনি।খেতে বসে অর্ক ভাবল মাকে বলবে স্যারের বাড়ীতে গেলাম, তুমি এত দেরী করলে চলে এলাম।তারপরে তার মনে হল, তাহলে তার মা'ই বলত চলে গেলি কেন? তবে কি স্যার মাকে জানায়নি? অর্কের এমনিতেই লোকটাকে পছন্দ নয়, তাই সে একদম নিশ্চিত হল লোকটা মাকে জানায়নি।তা নাহলে মা নিশ্চিত এত দেরী করত না।আর কাজ থাকলে বেরিয়ে বলত দেরী হবে বলে।কিন্তু স্যারের বাড়ীতে মা'র কি কাজ থাকে।একবার জিজ্ঞেস করবে?
অর্ক কোনোদিন বাপি-মায়ের অফিস সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো প্ৰশ্ন করেনি।এটা তার অভ্যাসের বাইরে।তাই সে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করল না।কিন্তু প্ৰশ্নটা তার মনের মধ্যে থেকে গেল।
(চলবে)