03-05-2020, 04:21 AM
- দেখুন অনেকক্ষণ থেকে ভালো ভাবে জিজ্ঞাসা করছি আঁখির ব্যাপারে যা জানেন বলে দিন, না হলে এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব |
- আমরা সত্যি বলছি সেদিনের পর থেকে আমাদের আঁখির সাথে একবারের জন্যও দেখা হয় নি, আমরা কিছু জানি না | এমনিতেই আমরা মা বাপ মরা মেয়েটার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছি, তাই তুমি ওকে নিয়ে যাওয়ার পর লজ্জায় ওর সাথে আমরা কোনো রকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করিনি | যদি তোমরা আমাদের ভুল বুঝতে........
- তাহলে আঁখি গেল কোথায়?? এ বাড়ি ছাড়া আর কোথায় কার কাছে ও যেতে পারে কিছু জানেন??!!!
- তা তো জানি না বাবা, তবে তিন চার দিন আগে রাঘব ওর খোঁজ করতে রাতের বেলা এ বাড়িতে এসেছিল | কিন্তু ওকে এখানে না পেয়ে আমাদের মারধর করে তোমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে চলে যায় |
- কি:!!!! আর এই ব্যাপারটা আপনারা আমাকে এতক্ষণেও বলেন নি??!!!
- না মানে, আসলে.........
আমি ঝট করে ফোনটা বের করে বড়বাবু কে বিস্তারিত সব বললাম | উনি শুনে বললেন ওদের সব কটা ডেরায় একসাথে তল্লাশি চালানোর ব্যাবস্থা করতে হবে যাতে পালাতে না পারে, কিন্তু একটু সময় লাগবে এত বড় অপারেশন টার জন্য |
কিন্তু ততক্ষণ তো আমি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না | অয়নকে ফোন করতে বলল সব বন্ধুদের ও জিজ্ঞেস করেছে, কেউ কিছু বলতে পারে নি | আমার মুখে বাকি ঘটনাটা শোনায় ও তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে এল, কিন্তু দুজনে তো ঠিকই করতে পারছি না কোথা থেকে অনুসন্ধান শুরু করব |
- আচ্ছা স্যার আঁখি কলেজ থেকে বেরিয়ে নিশ্চয়ই বাড়ির দিকেই আসছিল, তাহলে আমরা একবার ওই পথেই যদি খুঁজি........
- কিন্তু অয়ন, তখন দুপুরের সময়, এমনিই রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকে | আমরা ওকে কোথায় খুঁজব?? কাকে জিজ্ঞাসা করব??? তবে একটা হতে পারে, যদি আমরা সিগন্যালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ গুলোর মাধ্যমে খুঁজি | কিন্তু তার জন্য তো অনেক পারমিশান লাগবে, তারপর পুলিশ কাজ শুরু করবে | ওহ ভগবান আমি কি যে করি, কেন যে আজ ওকে এভাবে বললাম!!! না হলে তো.........
- স্যার আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না | মিতার দাদা পুলিশের উঁচু পদের অফিসার, ওনার পক্ষে এটা করা কোনো ব্যাপারই না | আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই সব ব্যাবস্থা করছি |
এরপরে অয়ন আর মিতার দাদার সহযোগিতায় সিসিটিভি ফুটেজ থেকে যে গাড়ি করে রাঘব রা আঁখিকে নিয়ে যায় তার নম্বর প্লেট দেখে সেই গাড়ি আর ওদের ডেরার খোঁজ মেলে | সময়মত পুলিশি তৎপরতায় ও সহযোগিতায় রাঘব সহ একটি বিশাল মেয়ে পাচারকারী দলের একটি বড় অংশ ধরা পরে | আর বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়ত আমি চিরকালের জন্য আঁখিকে হারিয়ে ফেলতাম | এ ব্যাপারে আমি অয়ন আর মিতার দাদার কাছে চিরঋণী থাকব |
আঁখির মাথায় চোট ও নেশার ইনজেকশনের জন্য ওর শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে ওকে তখনই হস্পিটালাইজড করতে হয় | যে মেয়ে সামান্য একটা ইনজেকশন নিতে কেঁদে ভাসায় তাকে এই অবস্থায় হসপিটালে শুয়ে থাকতে দেখে আমার বুকটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে | কেন????? কেন সেদিন একবার ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম না!!! কেন একবার ওকে বিশ্বাস করে আর একটু ধৈর্য্য ধরে ওর বলার অপেক্ষা করলাম না!!! তাহলে তো আজ ওকে এই অবস্থায় দেখতে হত না!!!! সেই কথা বলা চঞ্চল আঁখি আজ একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে | শারীরিক ভাবে বিপদমুক্ত হলেও ওর এই চুপ করে থাকাটা আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না | একবার অন্তত রাগ করুক, অভিমান করুক, ঝগড়া করুক, অন্তত কিছু কথা তো বলুক!!! ওকে ছাড়া প্রতিটা মুহূর্ত আমার এক একটা যুগের সমান মনে হচ্ছে যে |
***********************************
আজ সাত দিন পর আঁখি বাড়ি ফিরেছে দু দিন হল | ডাক্তারেরা বলেছেন এখন বিপদমুক্ত হলেও বাড়িতে বিশেষ খেয়াল রাখতে | এই দু দিনে ওর সব চেনা পরিচিত মানুষজন, বন্ধুরা এসে হোক, ফোনে হোক খোঁজ নিয়ে গিয়েছে | বিশেষ করে মিতা আর অয়ন অনেকবার এসেছে তাদের প্রিয় বন্ধুটির কাছে | আঁখি সকলের সাথেই কম বেশি হেসে কথা গল্প করলেও আমার দিকে একটি বারের জন্যও চোখ তুলে তাকায় নি | এমনকি যখন ওর কাকু কাকীমা এসেছিলেন খোঁজ নিতে, তাদের সাথেও ও ভালো করে কথা বলল | শুধু আমায় ছাড়া | ওনারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন | তাই ক্ষমাও চেয়ে গেলেন আর আমরা যাতে ভালো থাকি, একসাথে থাকি, সেই আশীর্বাদ ও করে গেলেন | কিন্তু মহারানীর দেখো কোনো হেলদোল নেই | একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না | এই কয়েকদিন এত ভিড়ের মাঝে ওর সাথে তেমন ঠিক করে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি |
আসলে হয়ে ওঠেনি বলা ভুল, ওর সামনে দাঁড়াব কি করে, ওর প্রশ্নের সম্মুখীন হব কি করে, বুঝে উঠতে পারি নি | কিন্তু আর যে আমি ওর সাথে কথা না বলে, ওর হাসি মুখটা না দেখে থাকতে পারছি না | হ্যাঁ, ও সবার সামনে হাসছে ঠিকই, কিন্তু তাতে যে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই | ও কথা বলছে, গল্প করছে ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ দুটো যে বড্ড চুপ করে গিয়েছে | আগে যখন কথা বলত, ওর মুখের ভাষা গুলোর সাথে ওর চোখ গুলোও যেন কথা বলে উঠত, হেসে উঠত ওর হাসির সাথে | কিন্তু আজ সব চুপ | এই নিস্তব্ধতা আমি আর সইতে পারছি না যে, আমাকে আজ ওর সাথে কথা বলতেই হবে | ও এভাবে আমাকে এড়িয়ে যেতে পারে না | ওর যা ইচ্ছা বলুক, তবু আমি ওকে এত সহজে দূরে চলে যেতে দিতে পারি না |
অনেক কিন্তু কিন্তু করে শেষমেষ ওর ঘরে নক করেই ফেললাম | বিশেষ রাত তো হয় নি, এখনও নিশ্চয়ই.......
- আঁখি জেগে আছো?? একটু কথা ছিল তোমার সাথে........
- হ্যাঁ...... বলুন কি হয়েছে?
ঘরে ঢুকে আঁখিকে দেখে আমার মুখে যে আর কথা সরছিল না | ঘরের এই হালকা সোনালী আলোয় একটা হলুদ শিফনের শারি পরে থাকায় ওকে যে আরও আরও মোহময়ী লাগছিল | হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল গুলো সামলাতে ওর ব্যাস্ততা আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে তুলছিল | কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে বললাম........
- ঘুমিয়ে পড়েছিলে??
বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল.......
- ঘুমিয়ে পড়লে আপনার সাথে কথা বলছি কি করে......
বলতে বলতে চুলটা হাত খোঁপা করে গুটিয়ে জানলার ধারে গিয়ে বসলো |
খুব ইচ্ছে করছিল ওর খোঁপা টা খুলে দিয়ে বলি, খোলা চুলেই তোমায় বেশি ভালো মানায়!! কিন্তু তার আগে বোকার মত প্রশ্নটা করায় বেশ অপ্রস্তুতে পরে গিয়েছিলাম | এমনিতে ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে, এমনকি আগে আঁখির সাথেও কথা বলতে কোনোদিন এত নার্ভাস লাগে নি, কিন্তু আজ কেন যে বার বার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না | অনেক কষ্টে ওর সামনে গিয়ে বললাম........
- তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ আঁখি??
- রাগ..... আমি!!! সে অধিকার কি আমার আছে স্যার!!! আমি সামান্য একজন আশ্রিতা, আশ্রয়দাতার ওপর রাগ করব কোন সাহসে!!! তার ওপর আপনি আমার স্যার, গুরুজন | এমনিতেই ওনেক সাহায্য করেছেন | আপনার কথার ওপর রাগ করা কি আমার মত মেয়ের সাজে???
- তুমি এমনভাবে বলছ কেন আঁখি, আমি........
- আমি এখন বলছি, কিন্তু কথা গুলো তো আপনারই | আপনি আগেও বহুবার বলেছেন কিন্তু আমি বোকা, তাই তো বুঝতে পারি নি | তবে সেদিন যখন আপনি ক্যান্টিনে বুঝিয়ে বললেন, তখন কিন্তু আমার আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি | কি বলুন তো, পড়াশোনা টা চট করে বুঝে ফেললেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা তো কম, তাই এত দেরি হল | তবে এরপর থেকে আর ভুল হবে না দেখবেন |
কথা গুলো বলেই ও চলে যেতে উদ্দত হতেই আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম.........
- এ কি স্যার, আপনি আমার সামনে এমন নীচে বসেছেন কেন!!!! উঠুন, উঠুন বলছি!!! আপনি কেন মাথা নিচু করে আছেন, ভুল তো আমার হয়েছে |
এ কি!!!আপনার চোখে জল??!!! এমন করবেন না দয়া করে!!! আমার জন্য আপনার চোখে জল এলে আমার যে পাপ লাগবে |
- না আঁখি আজ আমায় কাঁদতে দাও, অঞ্জলি চলে যাওয়ার পর একমাত্র তুমিই তো আছো যার সামনে আমি কাঁদতে পারি | একটু কাঁদতে দাও আজ আমায়, এ অসহ্য যন্ত্রণা আমি যে আর সইতে পারছি না |
- যন্ত্রণা!!!!...... কোথায় হচ্ছে??!!! কেন আপনার কি লেগে গিয়েছে??!!! উফফফ, এতক্ষণ আমাকে বলেন নি কেন!!!! দেখি দেখি উপরে উঠে বসুন তো...... খুব কষ্ট হচ্ছে??!!!
- হ্যাঁ অসহ্য!!! এ যন্ত্রণা যে নিজেই নিজেকে দিয়েছি তোমায় ভুল বুঝে, তোমায় অবিশ্বাস করে | সেদিন তোমাকে ওই কথা গুলো বলার পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত আমি নরক যন্ত্রণা অনুভব করেছি নিজের হৃদয়ে | ভেবেছিলাম নিজের অনুভূতি গুলো তোমার কাছে লুকিয়ে রাখব | বলব না, বলা উচিত হবে না তোমাকে | তোমাকে আমি জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছি, সেখানে এই সব দুর্বলতার কোনো স্থান হয় না | তাই তুমি নিজের অনুভূতি গুলোর কথা বলতে চাইলেও দিনের পর দিন তোমাকে তাচ্ছিল্যের স্বরে দূরে সরিয়ে রেখেছি |
মুখে তোমাকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, পুরোনো কে ভুলে নতুন করে শুরু করার কথা বললেও........ সেদিন যখন তোমাকে অয়নের সাথে বাইকে দেখি, তখন প্রথম আমার বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে | তুমি তো আমার কাছে থাকো, তাহলে অয়ন কেন তোমার কাছাকাছি আসবে?? কেন তুমি ওর সাথে হেসে কথা বলবে?? এই সব প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হয়ত একটু দেরি করে ফেলেছি | তবে এটা বুঝেছি যে আমি তোমাকে নয়, তুমি আমাকে সাহায্য করো বেঁচে থাকতে | তোমার থেকে আমি জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছি |
- এই সব আপনি কি বলছেন??!! আজ আপনার কি হয়েছে??!! আপনি ঠিক আছেন তো স্যার??!!!
- আজ আমায় বলতে দাও আঁখি, বলতে দাও | এতদিন ধরে বুকে জমে থাকা কথা গুলো বলে একটু হালকা হতে দাও | তুমি বার বার আমার কাছে আসতে চাইলেও সামাজিকতার অজুহাতে, বয়সের তফাতের অজুহাতে, লোকে কি ভাববে তার অজুহাতে তোমায় দূরে সরিয়ে রেখে তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি আর তার থেকে বেশি, অনেক বেশি কষ্ট নিজে পেয়েছি | আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, "ভালোবাসায় উঁচু নীচ, ছোটো বড়, কম বেশি কিছু হয় না | ভালোবাসায় শুধু ভালোবাসা থাকে আর তাকে ভালোবেসেই কাছে টেনে নিতে হয় |"
তবে তুমি তো আমায় খুব ভালো করে চেনো, জানো, বোঝো | তাহলে কেন সামনে দাঁড়িয়ে বললে না ভালোবাসো?? কেন একবার অয়নের কথাটা আমাকে বললে না?? কেন সব বুঝেও ভুল ধারনাটাকে এতটা প্রশ্রয় দিলে?? বলো???
- না মানে, কোন মুখে বলতাম আপনাকে ভালোবাসি!!! আমার কি সেই যোগ্যতা আছে!!!
- আবার সেই যোগ্যতার কথা..... অর্থ, শিক্ষাদীক্ষাই বুঝি ভালোবাসার মাপ কাঠি??? তাই যদি হয় তাহলে ঠিক আছে, তোমার সমস্ত স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আজ থেকে আমার | যোগ্যতার মাপ কাঠিতে তোমায় আমি আমার ওপরে দেখতে চাই | কি, করবে না আমার স্বপ্ন পূরণ??
***********************************
এমন একটা মানুষকে নিজের ভাবতেই শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় আমার মাথা নুইয়ে আসে | কেমন যেন একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে, মুখে যেন কথাই সরছে না | যেন আমার এত দিনের পূজো সার্থক হল ওনাকে পেয়ে | উত্তরে তাই শুধু বললাম হুমমম |
- তুমি তখন থেকে খালি যোগ্যতার কথা বলছ, আচ্ছা আমার মনটা, সেটা কিছু নয় বুঝি তোমার কাছে??!!!
- না মানে আমি ওভাবে বলতে চাই নি, তবে অয়নের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এতটা রেগে যাবেন সেটা বুঝতে পারি নি |
ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে আমার আরও কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বললেন.........
- তোমাকে অয়নের সাথে দেখে আমি যে কতটা কষ্ট পেয়েছি সেটা যদি তুমি একবার বুঝতে, না পেরেছি তোমায় কিছু বলতে, না পেরেছি চুপ করে থাকতে |
ওনার কথার সাথে সাথে প্রতিটা নি:শ্বাসে আমি শিহরিত হয়ে উঠছি | ওনার হৃদয়ের প্রতিটা ওঠা নামা আমি আমার হৃদয়ে অনুভব করতে পারছি | আমি ছুটে পালানোর ক্ষমতাও কেমন যেন হারিয়ে ফেলেছি | লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিতে উনি বলতে লাগলেন........
- যদি রাঘবের লোকজন তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেলতো, যদি তোমাকে আমি চিরদিনের মত...... উফফফফফ!!! ভাবতে পারছি না সেদিন অয়ন যদি আমার এই ভুলের আয়না টা আমার সামনে তুলে না ধরত, তাহলে হয়ত কোনো দিনই তোমায় বলা হত না যে..........
মুখটা অল্প তুলে বললাম.......
- যে...???
- যে...... প্রথম বার কলেজে দরজার আড়ালে লুকোনো ওই চোখ দুটো দেখেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম |
মুখটা নামিয়ে নিতেই কপালে একটা ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে বললেন........
- বুঝতে একটু দেরি হলেও, আমি আজ স্বীকার করছি, তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি | নিজের থেকেও বেশি, অনেক অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি |
- এটা হয় না স্যার..... লোকে কি ভাববে??!!!
- তুমি এখনও আমার কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবছো??!!!
বলেই আমার কোমড়টা জড়িয়ে ধরলেন |
- কি করছেন টা কি!!! পড়ে যাব তো, ছাড়ুন!!!
- ছাড়বো বলে তো ধরি নি | বুঝতে পারছ না বুঝি কি করছি??!! আর আমি তো চাই তুমি পরে যাও, তবে আমার ভালোবাসায় |
- উফফফফ, ছাড়ুন না!!!
- উঁহু, আগে তুমি আমার চোখে চোখ রেখেই বলো যে তুমিও আমায় ভালোবাসো | অবশ্য সেটা আমি জানি, কিন্তু তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে |
- পারছি না, আমায় কষ্ট দেওয়ার আগে মনে ছিল না বুঝি!!!
- হুমমম, অনেক কষ্ট দিয়েছি না?? আচ্ছা এবার আদর করে সব পুষিয়ে দিচ্ছি |
- কি হচ্ছে টা কি স্যার!!!!
- উঁহু, একে তো যেটা জানতে চাইছি সেটা কিছুতেই বলছো না, তার ওপর খালি স্যার স্যার করে যাচ্ছ | আর একবার স্যার বললে না........
- কি করবেন, মারবেন......
কথাটা শেষ করার আগেই গভীর আবেগে আমায় জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটো দখল করে নিলেন |
একটু পর ছেড়ে দিতে হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম.........
- এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি স্যার??!!
- এখনও স্যার বলা যায় নি | হুমমম বুঝলাম, তবে বাড়াবাড়ির আর কি দেখলে !!! এখনও তো কিছুই করি নি | তখন থেকে পালাই পালাই করছো, অথচ একবার বললে না ভালোবাসো কি না!!!
- জানি না!!!
- জানো না??!!! তাহলে তো আবার জানাতেই হচ্ছে |
- এই না, আর না!!! এবার সত্যিই আপনি বকা খাবেন কিন্তু!!!!
- এত দিন আমি তোমায় শাসন করেছি, এবার থেকে না হয় তুমিই আমায় শাসন করলে !!! আর এমন একটা মিষ্টি জিনিসের জন্য হাজার বার বকুনি খেতেও আমি রাজি আছি |
বলেই আমায় আর শাসন করার সুযোগ ও দিলেন না |
সময়ের সাথে সাথে প্রতিটা ছোঁয়া গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো | আজ বহুদিনের পর দুটি অতৃপ্ত হৃদয় একে অপরের সংস্পর্শে এসে পরিপূর্ণ, তৃপ্ত |
- আমরা সত্যি বলছি সেদিনের পর থেকে আমাদের আঁখির সাথে একবারের জন্যও দেখা হয় নি, আমরা কিছু জানি না | এমনিতেই আমরা মা বাপ মরা মেয়েটার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছি, তাই তুমি ওকে নিয়ে যাওয়ার পর লজ্জায় ওর সাথে আমরা কোনো রকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করিনি | যদি তোমরা আমাদের ভুল বুঝতে........
- তাহলে আঁখি গেল কোথায়?? এ বাড়ি ছাড়া আর কোথায় কার কাছে ও যেতে পারে কিছু জানেন??!!!
- তা তো জানি না বাবা, তবে তিন চার দিন আগে রাঘব ওর খোঁজ করতে রাতের বেলা এ বাড়িতে এসেছিল | কিন্তু ওকে এখানে না পেয়ে আমাদের মারধর করে তোমার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে চলে যায় |
- কি:!!!! আর এই ব্যাপারটা আপনারা আমাকে এতক্ষণেও বলেন নি??!!!
- না মানে, আসলে.........
আমি ঝট করে ফোনটা বের করে বড়বাবু কে বিস্তারিত সব বললাম | উনি শুনে বললেন ওদের সব কটা ডেরায় একসাথে তল্লাশি চালানোর ব্যাবস্থা করতে হবে যাতে পালাতে না পারে, কিন্তু একটু সময় লাগবে এত বড় অপারেশন টার জন্য |
কিন্তু ততক্ষণ তো আমি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না | অয়নকে ফোন করতে বলল সব বন্ধুদের ও জিজ্ঞেস করেছে, কেউ কিছু বলতে পারে নি | আমার মুখে বাকি ঘটনাটা শোনায় ও তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে এল, কিন্তু দুজনে তো ঠিকই করতে পারছি না কোথা থেকে অনুসন্ধান শুরু করব |
- আচ্ছা স্যার আঁখি কলেজ থেকে বেরিয়ে নিশ্চয়ই বাড়ির দিকেই আসছিল, তাহলে আমরা একবার ওই পথেই যদি খুঁজি........
- কিন্তু অয়ন, তখন দুপুরের সময়, এমনিই রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকে | আমরা ওকে কোথায় খুঁজব?? কাকে জিজ্ঞাসা করব??? তবে একটা হতে পারে, যদি আমরা সিগন্যালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ গুলোর মাধ্যমে খুঁজি | কিন্তু তার জন্য তো অনেক পারমিশান লাগবে, তারপর পুলিশ কাজ শুরু করবে | ওহ ভগবান আমি কি যে করি, কেন যে আজ ওকে এভাবে বললাম!!! না হলে তো.........
- স্যার আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না | মিতার দাদা পুলিশের উঁচু পদের অফিসার, ওনার পক্ষে এটা করা কোনো ব্যাপারই না | আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই সব ব্যাবস্থা করছি |
এরপরে অয়ন আর মিতার দাদার সহযোগিতায় সিসিটিভি ফুটেজ থেকে যে গাড়ি করে রাঘব রা আঁখিকে নিয়ে যায় তার নম্বর প্লেট দেখে সেই গাড়ি আর ওদের ডেরার খোঁজ মেলে | সময়মত পুলিশি তৎপরতায় ও সহযোগিতায় রাঘব সহ একটি বিশাল মেয়ে পাচারকারী দলের একটি বড় অংশ ধরা পরে | আর বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়ত আমি চিরকালের জন্য আঁখিকে হারিয়ে ফেলতাম | এ ব্যাপারে আমি অয়ন আর মিতার দাদার কাছে চিরঋণী থাকব |
আঁখির মাথায় চোট ও নেশার ইনজেকশনের জন্য ওর শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে ওকে তখনই হস্পিটালাইজড করতে হয় | যে মেয়ে সামান্য একটা ইনজেকশন নিতে কেঁদে ভাসায় তাকে এই অবস্থায় হসপিটালে শুয়ে থাকতে দেখে আমার বুকটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে | কেন????? কেন সেদিন একবার ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম না!!! কেন একবার ওকে বিশ্বাস করে আর একটু ধৈর্য্য ধরে ওর বলার অপেক্ষা করলাম না!!! তাহলে তো আজ ওকে এই অবস্থায় দেখতে হত না!!!! সেই কথা বলা চঞ্চল আঁখি আজ একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে | শারীরিক ভাবে বিপদমুক্ত হলেও ওর এই চুপ করে থাকাটা আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না | একবার অন্তত রাগ করুক, অভিমান করুক, ঝগড়া করুক, অন্তত কিছু কথা তো বলুক!!! ওকে ছাড়া প্রতিটা মুহূর্ত আমার এক একটা যুগের সমান মনে হচ্ছে যে |
***********************************
আজ সাত দিন পর আঁখি বাড়ি ফিরেছে দু দিন হল | ডাক্তারেরা বলেছেন এখন বিপদমুক্ত হলেও বাড়িতে বিশেষ খেয়াল রাখতে | এই দু দিনে ওর সব চেনা পরিচিত মানুষজন, বন্ধুরা এসে হোক, ফোনে হোক খোঁজ নিয়ে গিয়েছে | বিশেষ করে মিতা আর অয়ন অনেকবার এসেছে তাদের প্রিয় বন্ধুটির কাছে | আঁখি সকলের সাথেই কম বেশি হেসে কথা গল্প করলেও আমার দিকে একটি বারের জন্যও চোখ তুলে তাকায় নি | এমনকি যখন ওর কাকু কাকীমা এসেছিলেন খোঁজ নিতে, তাদের সাথেও ও ভালো করে কথা বলল | শুধু আমায় ছাড়া | ওনারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন | তাই ক্ষমাও চেয়ে গেলেন আর আমরা যাতে ভালো থাকি, একসাথে থাকি, সেই আশীর্বাদ ও করে গেলেন | কিন্তু মহারানীর দেখো কোনো হেলদোল নেই | একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না | এই কয়েকদিন এত ভিড়ের মাঝে ওর সাথে তেমন ঠিক করে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি |
আসলে হয়ে ওঠেনি বলা ভুল, ওর সামনে দাঁড়াব কি করে, ওর প্রশ্নের সম্মুখীন হব কি করে, বুঝে উঠতে পারি নি | কিন্তু আর যে আমি ওর সাথে কথা না বলে, ওর হাসি মুখটা না দেখে থাকতে পারছি না | হ্যাঁ, ও সবার সামনে হাসছে ঠিকই, কিন্তু তাতে যে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই | ও কথা বলছে, গল্প করছে ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ দুটো যে বড্ড চুপ করে গিয়েছে | আগে যখন কথা বলত, ওর মুখের ভাষা গুলোর সাথে ওর চোখ গুলোও যেন কথা বলে উঠত, হেসে উঠত ওর হাসির সাথে | কিন্তু আজ সব চুপ | এই নিস্তব্ধতা আমি আর সইতে পারছি না যে, আমাকে আজ ওর সাথে কথা বলতেই হবে | ও এভাবে আমাকে এড়িয়ে যেতে পারে না | ওর যা ইচ্ছা বলুক, তবু আমি ওকে এত সহজে দূরে চলে যেতে দিতে পারি না |
অনেক কিন্তু কিন্তু করে শেষমেষ ওর ঘরে নক করেই ফেললাম | বিশেষ রাত তো হয় নি, এখনও নিশ্চয়ই.......
- আঁখি জেগে আছো?? একটু কথা ছিল তোমার সাথে........
- হ্যাঁ...... বলুন কি হয়েছে?
ঘরে ঢুকে আঁখিকে দেখে আমার মুখে যে আর কথা সরছিল না | ঘরের এই হালকা সোনালী আলোয় একটা হলুদ শিফনের শারি পরে থাকায় ওকে যে আরও আরও মোহময়ী লাগছিল | হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল গুলো সামলাতে ওর ব্যাস্ততা আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে তুলছিল | কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে বললাম........
- ঘুমিয়ে পড়েছিলে??
বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল.......
- ঘুমিয়ে পড়লে আপনার সাথে কথা বলছি কি করে......
বলতে বলতে চুলটা হাত খোঁপা করে গুটিয়ে জানলার ধারে গিয়ে বসলো |
খুব ইচ্ছে করছিল ওর খোঁপা টা খুলে দিয়ে বলি, খোলা চুলেই তোমায় বেশি ভালো মানায়!! কিন্তু তার আগে বোকার মত প্রশ্নটা করায় বেশ অপ্রস্তুতে পরে গিয়েছিলাম | এমনিতে ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে, এমনকি আগে আঁখির সাথেও কথা বলতে কোনোদিন এত নার্ভাস লাগে নি, কিন্তু আজ কেন যে বার বার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না | অনেক কষ্টে ওর সামনে গিয়ে বললাম........
- তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ আঁখি??
- রাগ..... আমি!!! সে অধিকার কি আমার আছে স্যার!!! আমি সামান্য একজন আশ্রিতা, আশ্রয়দাতার ওপর রাগ করব কোন সাহসে!!! তার ওপর আপনি আমার স্যার, গুরুজন | এমনিতেই ওনেক সাহায্য করেছেন | আপনার কথার ওপর রাগ করা কি আমার মত মেয়ের সাজে???
- তুমি এমনভাবে বলছ কেন আঁখি, আমি........
- আমি এখন বলছি, কিন্তু কথা গুলো তো আপনারই | আপনি আগেও বহুবার বলেছেন কিন্তু আমি বোকা, তাই তো বুঝতে পারি নি | তবে সেদিন যখন আপনি ক্যান্টিনে বুঝিয়ে বললেন, তখন কিন্তু আমার আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি | কি বলুন তো, পড়াশোনা টা চট করে বুঝে ফেললেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা তো কম, তাই এত দেরি হল | তবে এরপর থেকে আর ভুল হবে না দেখবেন |
কথা গুলো বলেই ও চলে যেতে উদ্দত হতেই আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম.........
- এ কি স্যার, আপনি আমার সামনে এমন নীচে বসেছেন কেন!!!! উঠুন, উঠুন বলছি!!! আপনি কেন মাথা নিচু করে আছেন, ভুল তো আমার হয়েছে |
এ কি!!!আপনার চোখে জল??!!! এমন করবেন না দয়া করে!!! আমার জন্য আপনার চোখে জল এলে আমার যে পাপ লাগবে |
- না আঁখি আজ আমায় কাঁদতে দাও, অঞ্জলি চলে যাওয়ার পর একমাত্র তুমিই তো আছো যার সামনে আমি কাঁদতে পারি | একটু কাঁদতে দাও আজ আমায়, এ অসহ্য যন্ত্রণা আমি যে আর সইতে পারছি না |
- যন্ত্রণা!!!!...... কোথায় হচ্ছে??!!! কেন আপনার কি লেগে গিয়েছে??!!! উফফফ, এতক্ষণ আমাকে বলেন নি কেন!!!! দেখি দেখি উপরে উঠে বসুন তো...... খুব কষ্ট হচ্ছে??!!!
- হ্যাঁ অসহ্য!!! এ যন্ত্রণা যে নিজেই নিজেকে দিয়েছি তোমায় ভুল বুঝে, তোমায় অবিশ্বাস করে | সেদিন তোমাকে ওই কথা গুলো বলার পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত আমি নরক যন্ত্রণা অনুভব করেছি নিজের হৃদয়ে | ভেবেছিলাম নিজের অনুভূতি গুলো তোমার কাছে লুকিয়ে রাখব | বলব না, বলা উচিত হবে না তোমাকে | তোমাকে আমি জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছি, সেখানে এই সব দুর্বলতার কোনো স্থান হয় না | তাই তুমি নিজের অনুভূতি গুলোর কথা বলতে চাইলেও দিনের পর দিন তোমাকে তাচ্ছিল্যের স্বরে দূরে সরিয়ে রেখেছি |
মুখে তোমাকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, পুরোনো কে ভুলে নতুন করে শুরু করার কথা বললেও........ সেদিন যখন তোমাকে অয়নের সাথে বাইকে দেখি, তখন প্রথম আমার বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে ওঠে | তুমি তো আমার কাছে থাকো, তাহলে অয়ন কেন তোমার কাছাকাছি আসবে?? কেন তুমি ওর সাথে হেসে কথা বলবে?? এই সব প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হয়ত একটু দেরি করে ফেলেছি | তবে এটা বুঝেছি যে আমি তোমাকে নয়, তুমি আমাকে সাহায্য করো বেঁচে থাকতে | তোমার থেকে আমি জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছি |
- এই সব আপনি কি বলছেন??!! আজ আপনার কি হয়েছে??!! আপনি ঠিক আছেন তো স্যার??!!!
- আজ আমায় বলতে দাও আঁখি, বলতে দাও | এতদিন ধরে বুকে জমে থাকা কথা গুলো বলে একটু হালকা হতে দাও | তুমি বার বার আমার কাছে আসতে চাইলেও সামাজিকতার অজুহাতে, বয়সের তফাতের অজুহাতে, লোকে কি ভাববে তার অজুহাতে তোমায় দূরে সরিয়ে রেখে তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি আর তার থেকে বেশি, অনেক বেশি কষ্ট নিজে পেয়েছি | আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, "ভালোবাসায় উঁচু নীচ, ছোটো বড়, কম বেশি কিছু হয় না | ভালোবাসায় শুধু ভালোবাসা থাকে আর তাকে ভালোবেসেই কাছে টেনে নিতে হয় |"
তবে তুমি তো আমায় খুব ভালো করে চেনো, জানো, বোঝো | তাহলে কেন সামনে দাঁড়িয়ে বললে না ভালোবাসো?? কেন একবার অয়নের কথাটা আমাকে বললে না?? কেন সব বুঝেও ভুল ধারনাটাকে এতটা প্রশ্রয় দিলে?? বলো???
- না মানে, কোন মুখে বলতাম আপনাকে ভালোবাসি!!! আমার কি সেই যোগ্যতা আছে!!!
- আবার সেই যোগ্যতার কথা..... অর্থ, শিক্ষাদীক্ষাই বুঝি ভালোবাসার মাপ কাঠি??? তাই যদি হয় তাহলে ঠিক আছে, তোমার সমস্ত স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আজ থেকে আমার | যোগ্যতার মাপ কাঠিতে তোমায় আমি আমার ওপরে দেখতে চাই | কি, করবে না আমার স্বপ্ন পূরণ??
***********************************
এমন একটা মানুষকে নিজের ভাবতেই শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় আমার মাথা নুইয়ে আসে | কেমন যেন একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে, মুখে যেন কথাই সরছে না | যেন আমার এত দিনের পূজো সার্থক হল ওনাকে পেয়ে | উত্তরে তাই শুধু বললাম হুমমম |
- তুমি তখন থেকে খালি যোগ্যতার কথা বলছ, আচ্ছা আমার মনটা, সেটা কিছু নয় বুঝি তোমার কাছে??!!!
- না মানে আমি ওভাবে বলতে চাই নি, তবে অয়নের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এতটা রেগে যাবেন সেটা বুঝতে পারি নি |
ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে আমার আরও কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বললেন.........
- তোমাকে অয়নের সাথে দেখে আমি যে কতটা কষ্ট পেয়েছি সেটা যদি তুমি একবার বুঝতে, না পেরেছি তোমায় কিছু বলতে, না পেরেছি চুপ করে থাকতে |
ওনার কথার সাথে সাথে প্রতিটা নি:শ্বাসে আমি শিহরিত হয়ে উঠছি | ওনার হৃদয়ের প্রতিটা ওঠা নামা আমি আমার হৃদয়ে অনুভব করতে পারছি | আমি ছুটে পালানোর ক্ষমতাও কেমন যেন হারিয়ে ফেলেছি | লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিতে উনি বলতে লাগলেন........
- যদি রাঘবের লোকজন তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেলতো, যদি তোমাকে আমি চিরদিনের মত...... উফফফফফ!!! ভাবতে পারছি না সেদিন অয়ন যদি আমার এই ভুলের আয়না টা আমার সামনে তুলে না ধরত, তাহলে হয়ত কোনো দিনই তোমায় বলা হত না যে..........
মুখটা অল্প তুলে বললাম.......
- যে...???
- যে...... প্রথম বার কলেজে দরজার আড়ালে লুকোনো ওই চোখ দুটো দেখেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম |
মুখটা নামিয়ে নিতেই কপালে একটা ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে বললেন........
- বুঝতে একটু দেরি হলেও, আমি আজ স্বীকার করছি, তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি | নিজের থেকেও বেশি, অনেক অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি |
- এটা হয় না স্যার..... লোকে কি ভাববে??!!!
- তুমি এখনও আমার কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবছো??!!!
বলেই আমার কোমড়টা জড়িয়ে ধরলেন |
- কি করছেন টা কি!!! পড়ে যাব তো, ছাড়ুন!!!
- ছাড়বো বলে তো ধরি নি | বুঝতে পারছ না বুঝি কি করছি??!! আর আমি তো চাই তুমি পরে যাও, তবে আমার ভালোবাসায় |
- উফফফফ, ছাড়ুন না!!!
- উঁহু, আগে তুমি আমার চোখে চোখ রেখেই বলো যে তুমিও আমায় ভালোবাসো | অবশ্য সেটা আমি জানি, কিন্তু তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে |
- পারছি না, আমায় কষ্ট দেওয়ার আগে মনে ছিল না বুঝি!!!
- হুমমম, অনেক কষ্ট দিয়েছি না?? আচ্ছা এবার আদর করে সব পুষিয়ে দিচ্ছি |
- কি হচ্ছে টা কি স্যার!!!!
- উঁহু, একে তো যেটা জানতে চাইছি সেটা কিছুতেই বলছো না, তার ওপর খালি স্যার স্যার করে যাচ্ছ | আর একবার স্যার বললে না........
- কি করবেন, মারবেন......
কথাটা শেষ করার আগেই গভীর আবেগে আমায় জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটো দখল করে নিলেন |
একটু পর ছেড়ে দিতে হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম.........
- এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি স্যার??!!
- এখনও স্যার বলা যায় নি | হুমমম বুঝলাম, তবে বাড়াবাড়ির আর কি দেখলে !!! এখনও তো কিছুই করি নি | তখন থেকে পালাই পালাই করছো, অথচ একবার বললে না ভালোবাসো কি না!!!
- জানি না!!!
- জানো না??!!! তাহলে তো আবার জানাতেই হচ্ছে |
- এই না, আর না!!! এবার সত্যিই আপনি বকা খাবেন কিন্তু!!!!
- এত দিন আমি তোমায় শাসন করেছি, এবার থেকে না হয় তুমিই আমায় শাসন করলে !!! আর এমন একটা মিষ্টি জিনিসের জন্য হাজার বার বকুনি খেতেও আমি রাজি আছি |
বলেই আমায় আর শাসন করার সুযোগ ও দিলেন না |
সময়ের সাথে সাথে প্রতিটা ছোঁয়া গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো | আজ বহুদিনের পর দুটি অতৃপ্ত হৃদয় একে অপরের সংস্পর্শে এসে পরিপূর্ণ, তৃপ্ত |