30-04-2020, 03:28 AM
একছুট্টে ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে নিয়েছি | উত্তেজনায় আমার হৃদয়ের গতি যেন শতগুন বেড়ে গিয়েছে | লুকিয়ে লুকিয়ে ভিজতে গিয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে, কিন্তু বৃষ্টির শীতল স্পর্শে মুহূর্তে সমস্ত ভয় লাজ লজ্জা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল | গেয়ে উঠেছিলাম দু কলি | কিন্তু বুঝতে পারিনি উনি যে এভাবে আমার অলক্ষ্যে আমায় লক্ষ্য করছেন | এতদিন শুধু ওনাকে মনে মনে ভালোবেসেছি, ওনাকে নিজের করে পেতে চেয়েছি | কিন্তু আজ ওনার এত কাছে দাঁড়িয়ে, ওনার ওই গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হারিয়ে যাব ভাবিনি | ওনার ওই মুগ্ধতার দৃষ্টিতে কোথা থেকে যে একরাশ লজ্জারা এসে জড়ো হয়েছিল আমার দুচোখে, বুঝতে পারিনি | লজ্জা কাটিয়ে তাকাতে পারিনি ওনার ওই অন্তরস্পর্শী দৃষ্টির সামনে | ওনার প্রতিটা নি:শ্বাসে শিহরিত হয়ে উঠছিলাম | জলের ফোঁটা গুলো সেই শিহরনকে যেন আরও উস্কে দিচ্ছিল, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সমস্ত ভাবনা গুলো | যদি উনি আমাকে এতটাই অপছন্দ করেন তাহলে আজকে ওনার উপস্থিতিতে এত ভালোলাগার ছোঁয়া কেন??!!! আজ সকল বাঁধন ভেঙে খুব ইচ্ছে করছিল ওনার বুকে মুখ লুকিয়ে বলি.........
"মেঘলা দিনের আস্কারাতে
চেয়েছি তোমার হাত ধরতে,
ঝড়ের রাতে তোমার পাশে
থাকব আমি ভালোবেসে....... |"
**************************************
আমি এটা কি করতে যাচ্ছিলাম!!! ছি:!!! আমার নিজেকে, নিজের অনুভূতি গুলোকে সংযত করা উচিত ছিল | এতটা দুর্বলতা আমার শোভা পায় না | আঁখি আমায় ওর স্যার হিসেবে শ্রদ্ধা করে হয়ত ভালোও বাসে আর আমি কিনা....... যে জন্য ওর সাথে আমি এত কড়া ব্যবহার করতাম, ওকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম, আজ সেই ভুলটাই আমি করতে চলেছিলাম | হয়ত করেই ফেলেছি | প্রথম দিন কলেজে দরজার আড়ালে দেখা ওর ওই চোখ দেখেই জীবনে প্রথমবার পড়াশোনা ছেড়ে মন ছুটে গিয়েছিল ওর দিকে | ওর ওই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হারিয়ে ছিলাম মুখের ভাষা, মনের কথা | চেয়েছিলাম ওর স্বপ্ন গুলোকে সত্যি করে তুলতে, নিজেকে উজার করে ওকে ভালোবাসতে | তবে পারিনি দুজনের মাঝের এই বয়সের ব্যবধানকে মিটিয়ে ফেলতে | তাই চক্ষুলজ্জার ভয়ে, এড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজের অনুভূতি গুলোকে | কিন্তু যেদিন থেকে ওর সাথে দেখা বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন শুনলাম কোন না কোন ছেলের সাথে ওর বিয়ের ঠিক হয়েছে, সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি | পারিনি নিজের অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রাখতে | কলেজের পর ওর আসার অপেক্ষায় নিজের অজান্তেই বার বার ঘড়ি দেখতাম | পথ চেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম | তখন এগুলোকে সামান্য কেয়ার করা বলে চালিয়ে দিলেও ওর অনুপস্থিতি আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ওগুলো কেবল শিক্ষকের ছাত্রীর প্রতি হওয়া টান ছিল না, ছিল অনেক বেশি কিছু | যখন ওর হাসির আওয়াজে ঘরের প্রতিটা কোন মুখরিত হয়ে উঠত, তখন যে অনুভূতিটা মনে অনুভূত হত, সেটা আর পাঁচজন মেয়ের জন্য অনুভূত হয় না |
কিন্তু আমি বুঝি নি এটাও কি করে সম্ভব কারন আমি তো অঞ্জলিকে ভালোবাসি | ও ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা | এত গুলো বছর ওকে ছাড়া কাটালেও কখনও ওর অভাব বা অন্য কারোর প্রয়োজন হয়নি | তবে আঁখিকে দেখলে, ওর কথা ভাবলে আমি এতটা দুর্বল হয়ে পড়ি কেন??!! কেন মনে হয় আমার একাকিত্ব জীবনে আঁখির উপস্থিত থাকা খুব খুব প্রয়োজন??!! কিসের জন্যে??!!! নতুন ভাবে জীবন শুরু করার জন্য আমাকে বহুবার বহুজন নানা রকম ভাবে বলেছে | কম বেশি অনেকের কাছ থেকেই প্রস্তাব পেয়েছি | তখন আমি যতটা নিরুদ্বেগ থাকতাম আঁখিকে দেখার পর ততটা নিরুদ্বেগ কেন থাকতে পারি না??!!! কেন মনে হয় আঁখি আমার অনুভূতি গুলো বুঝুক, আমার হয়েই থাকুক??!!! কিন্তু যেদিন রাস্তায় দেখলাম রাঘব আঁখির গায়ে হাত তুলছে, ওর সাথে অভদ্র ব্যবহার করছে, সেদিন আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল | আমি বুঝেছিলাম যে........
"ভালোবাসায় প্রথম ও দ্বিতীয় বলে কিছু হয় না
ভালোবাসা কখনও হারিয়েও যায় না,
সময়ের সাথে ভালোবাসা শুধু রুপ বদলায়
ভালোবাসা পূর্ন হয় কেবলই ভালোবাসায়...... |"
***********************************
তাড়াতাড়ি ভিজে জামা কাপড় পাল্টে চুলটা তোয়ালেতে জড়িয়েই বাইরে চলে এলাম | তবে স্যারের ঘরের দরজাটা বন্ধ কেন?? একবার ডাকব?? কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করে কেন...... কি বলবো?? ইসসসস, কেন যে আজ ভিজতে গেলাম | উনি হয়ত খুব রাগ করে আছেন আমার ওপর | উফফফ, এত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে জীবনেও পড়িনি | তবে এমন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকি কি ভাবে | এমনিই ওনার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস নেই, কে জানে শরীর কেমন আছে!!! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করার থেকে একবার বরং ডেকেই দেখি |
রাম নাম জপতে জপতে গিয়ে নক করলাম.......
- স্যা..... স্যার, আপনি ঠিক আছেন??!!
- কেন কি হয়েছে??
- না তখন আমার সাথে ভিজলেন তো তাই আর কি.......
- তোমার সাথে ভিজলাম মানে!!! কি বলতে চাইছ তুমি??
- না মানে আমার সাথে না, মানে ওই একলাই...... আসলে আপনার তো অভ্যেস নেই, যদি.......
- কি যদি??
- যদি..... যদি আপনি..... মানে আমি আদা দিয়ে চা করছিলাম | আপনি খাবেন কিনা তাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম |
- হুমমম, কিন্তু তার আগে বলো তুমি পড়াশোনা বইখাতা ফেলে ছাদে এই বৃষ্টিতে ছাদে কি করছিলে??
গেলাম রে!!! ঠিক যেটা ভাবছিলাম সেটাই হল | এবার কি করি?? কি বলি?? কোনো রকমে ঢোক গিলে বললাম.........
- ইয়ে...... মানে লেখাটা হয়ে গিয়েছে তাই ভাবলাম ছাদ থেকে জামা কাপড় গুলো তুলে আনি যদি বৃষ্টিতে ভিজে যায় | ব্যাস গেলাম আর বৃষ্টি এসে গেল | তাই একটু........
- ও তাই বুঝি!!!!
- হ্যাঁ সত্যি লেখা হয়ে গিয়েছে | আপনি বাইরের ঘরে আসুন, আমি ততক্ষণ চা করে আনছি | তারপর না হয়........
- হুমমমম |
উফফফ এখনকার মতো তো চায়ের বাহানায় বাঁচলাম কিন্তু একটু পর যখন লেখাটা দেখতে চাইবে কি দেখাবো?? কিছুই তো লিখি নি | আর যেটা করছিলাম সেটা যদি দেখতে পায় তাহলে তো আর রক্ষে থাকবে না |
- আঁখি, কি ভাবছো এমন আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে??!!! আর একটু হলেই তো গরম চা পড়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি বাঁধত | তুমি কি আমায় একটু শান্তি দেবে না?? আমি না এলে এখনই যদি তোমার কিছু হয়ে যেত...... আমি কি করতাম, হ্যাঁ??!!! সামান্য চা করতে এসেই এই অবস্থা, এরপর নাকি তুমি আমার জন্য রান্না করতে | তাই আবার রান্নার লোক রাখতেও না বলছিলে | এমনিই বাড়ি থাকি না, তুমি যে কি করতে তখন, ভাবলেও আমার বুক কেঁপে উঠছে!!!
- না মানে দেখছিলামই তো..... এত ভয় পাচ্ছেন কেন??!! কিছু হত না, আমি সব সামলে নিতাম | আপনি যান আমি আসছি |
- হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি কেমন সামলাতে | তার চেয়ে বরং তুমি গিয়ে বই খাতা নিয়ে বসো, আমিই চা ছেঁকে নিয়ে আসছি |
আমার কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আবার শুরু করলেন.........
- উহ: হু, কোনো কথা বলবে না, আমি তোমাকে আর একটু খানির জন্যও রান্না ঘরে দেখতে চাই না | যাও বলছি |
ওরে বাবা, ওনাকে কি করে বলি কি ভাবছি!!! এবার তো বসেই বলবে লেখাটা দেখি, কি দেখাব আমি?? উফফফ, এদিকে খাতাটাও তো খুঁজে পাচ্ছি না | গেল কোথায়??!! এখানেই তো টেবিলের ওপর রেখে গিয়েছিলাম | হাওয়ায় পড়ে যায়নি তো??!! একবার বরং টেবিলের নিচ টাও দেখে নি যদি.......
- কিছু খুঁজছ??
- হ্যাঁ, আরে খাতা টা যে কোথায় গেল বুঝতে.......
কথাটা বলেই মনে হল আরে স্যার কি এখানেই ভেবে মাথাটা তুলতে গিয়ে গেল চুলের তোয়ালেটা খুলে | একে তো খুঁজে পাচ্ছি না, তার মধ্যে ভিজে চুলটা খুলে যাওয়ার আর সময় পেল না |
- তুমি কি এই খাতা টা খুঁজছ??
স্যারের হাতে আমার খাতা টা দেখে আমার তো ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা | আর রক্ষে নেই | কোনো মতে ঢোক গিলে বললাম........
- ইয়ে মানে..... হ্যাঁ.... আসলে এটা..... মানে ওই খাতা টা.......
একি, উনি আমার দিকে এগোচ্ছেন কেন??!! এবার মারবেন নাকি??!! এদিকে পিছতে পিছতে যে দেওয়ালে এসে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, পাস কাটিয়ে যে পালাবো তারও উপায় নেই | কি করি ভাবতে ভাবতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম | তখন স্যার একদম সামনা সামনি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন........
- এটা খুঁজছিলে??
- হ্যাঁ মানে.......
- লেখা হয়ে গিয়েছে তাহলে??
- ইয়ে, মানে একবার দেখতে হবে সব ঠিক আছে কিনা |
- ও তাই বুঝি!!! তাহলে আমিই দেখি, যদি কিছু ভুল হয় আমিই ঠিক করে দেব | কি বলো??
- না...... না!!! মানে একবার আমাকে দিন, আমি পরিষ্কার করে লিখে দিচ্ছি | ওটাতে হাতের লেখা খুব খারাপ হয়েছে | দিন না প্লিজ!!!
আমার আরও কাছে সরে এসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন.........
- আমায় তুমি খুব ভয় পাও তাই না আঁখি??
ওনার এত কাছে, যেখানে ওনার প্রতিটা নি:শ্বাস আমি নিজের নি:শ্বাসে অনুভব করতে পারছি, যেখানে আমার হৃদয়ের গতিবেগ স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম, সেই পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি এতই সহজ!!! আমি নিষ্পলক ওনার দিকে চেয়ে রইলাম |
***************************************
আমি এসেছিলাম আঁখিকে শাসন করতে, কিন্তু আবার ওর কাছে হেরে গেলাম | একটা সামান্য খাতা না খুঁজে পাওয়ায় যে কেউ এতটা ব্যাকুল হতে পারে, সেটা ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না | ওর ওই ভিজে চুল গুলো যখন মুখের ওপর এসে পড়ে, ওকে ব্যাস্ত করে তোলে | মনে হয় ওর ওই ব্যাস্ততাকে নিজের বুকে আগলে রেখে দিই | যখন হাওয়ায় ভেসে আসা ওর ওই ভিজে চুলের মিষ্টি সুবাস আমায় আবিষ্ট করে রাখে, যখন ব্যাস্ততার মুহূর্তে ওর ভিজে চুলের থেকে ছিটকে আসা জলের ফোঁটা গুলো আমায় মাতাল করে তোলে, যখন আমার কাছে এসে ওর নি:শ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে, তখন আমি অনুভব করি নিজের অস্তিত্ব | খুঁজে পাই বেঁচে থাকার কারন | তখন মনে হয় সময়টা যেন এখানেই থমকে থাকে, আমাদের মাঝে, আমাদের জন্য |
"মেঘলা দিনের আস্কারাতে
চেয়েছি তোমার হাত ধরতে,
ঝড়ের রাতে তোমার পাশে
থাকব আমি ভালোবেসে....... |"
**************************************
আমি এটা কি করতে যাচ্ছিলাম!!! ছি:!!! আমার নিজেকে, নিজের অনুভূতি গুলোকে সংযত করা উচিত ছিল | এতটা দুর্বলতা আমার শোভা পায় না | আঁখি আমায় ওর স্যার হিসেবে শ্রদ্ধা করে হয়ত ভালোও বাসে আর আমি কিনা....... যে জন্য ওর সাথে আমি এত কড়া ব্যবহার করতাম, ওকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম, আজ সেই ভুলটাই আমি করতে চলেছিলাম | হয়ত করেই ফেলেছি | প্রথম দিন কলেজে দরজার আড়ালে দেখা ওর ওই চোখ দেখেই জীবনে প্রথমবার পড়াশোনা ছেড়ে মন ছুটে গিয়েছিল ওর দিকে | ওর ওই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হারিয়ে ছিলাম মুখের ভাষা, মনের কথা | চেয়েছিলাম ওর স্বপ্ন গুলোকে সত্যি করে তুলতে, নিজেকে উজার করে ওকে ভালোবাসতে | তবে পারিনি দুজনের মাঝের এই বয়সের ব্যবধানকে মিটিয়ে ফেলতে | তাই চক্ষুলজ্জার ভয়ে, এড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজের অনুভূতি গুলোকে | কিন্তু যেদিন থেকে ওর সাথে দেখা বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন শুনলাম কোন না কোন ছেলের সাথে ওর বিয়ের ঠিক হয়েছে, সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি | পারিনি নিজের অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রাখতে | কলেজের পর ওর আসার অপেক্ষায় নিজের অজান্তেই বার বার ঘড়ি দেখতাম | পথ চেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম | তখন এগুলোকে সামান্য কেয়ার করা বলে চালিয়ে দিলেও ওর অনুপস্থিতি আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ওগুলো কেবল শিক্ষকের ছাত্রীর প্রতি হওয়া টান ছিল না, ছিল অনেক বেশি কিছু | যখন ওর হাসির আওয়াজে ঘরের প্রতিটা কোন মুখরিত হয়ে উঠত, তখন যে অনুভূতিটা মনে অনুভূত হত, সেটা আর পাঁচজন মেয়ের জন্য অনুভূত হয় না |
কিন্তু আমি বুঝি নি এটাও কি করে সম্ভব কারন আমি তো অঞ্জলিকে ভালোবাসি | ও ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা | এত গুলো বছর ওকে ছাড়া কাটালেও কখনও ওর অভাব বা অন্য কারোর প্রয়োজন হয়নি | তবে আঁখিকে দেখলে, ওর কথা ভাবলে আমি এতটা দুর্বল হয়ে পড়ি কেন??!! কেন মনে হয় আমার একাকিত্ব জীবনে আঁখির উপস্থিত থাকা খুব খুব প্রয়োজন??!! কিসের জন্যে??!!! নতুন ভাবে জীবন শুরু করার জন্য আমাকে বহুবার বহুজন নানা রকম ভাবে বলেছে | কম বেশি অনেকের কাছ থেকেই প্রস্তাব পেয়েছি | তখন আমি যতটা নিরুদ্বেগ থাকতাম আঁখিকে দেখার পর ততটা নিরুদ্বেগ কেন থাকতে পারি না??!!! কেন মনে হয় আঁখি আমার অনুভূতি গুলো বুঝুক, আমার হয়েই থাকুক??!!! কিন্তু যেদিন রাস্তায় দেখলাম রাঘব আঁখির গায়ে হাত তুলছে, ওর সাথে অভদ্র ব্যবহার করছে, সেদিন আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল | আমি বুঝেছিলাম যে........
"ভালোবাসায় প্রথম ও দ্বিতীয় বলে কিছু হয় না
ভালোবাসা কখনও হারিয়েও যায় না,
সময়ের সাথে ভালোবাসা শুধু রুপ বদলায়
ভালোবাসা পূর্ন হয় কেবলই ভালোবাসায়...... |"
***********************************
তাড়াতাড়ি ভিজে জামা কাপড় পাল্টে চুলটা তোয়ালেতে জড়িয়েই বাইরে চলে এলাম | তবে স্যারের ঘরের দরজাটা বন্ধ কেন?? একবার ডাকব?? কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করে কেন...... কি বলবো?? ইসসসস, কেন যে আজ ভিজতে গেলাম | উনি হয়ত খুব রাগ করে আছেন আমার ওপর | উফফফ, এত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে জীবনেও পড়িনি | তবে এমন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকি কি ভাবে | এমনিই ওনার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস নেই, কে জানে শরীর কেমন আছে!!! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করার থেকে একবার বরং ডেকেই দেখি |
রাম নাম জপতে জপতে গিয়ে নক করলাম.......
- স্যা..... স্যার, আপনি ঠিক আছেন??!!
- কেন কি হয়েছে??
- না তখন আমার সাথে ভিজলেন তো তাই আর কি.......
- তোমার সাথে ভিজলাম মানে!!! কি বলতে চাইছ তুমি??
- না মানে আমার সাথে না, মানে ওই একলাই...... আসলে আপনার তো অভ্যেস নেই, যদি.......
- কি যদি??
- যদি..... যদি আপনি..... মানে আমি আদা দিয়ে চা করছিলাম | আপনি খাবেন কিনা তাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম |
- হুমমম, কিন্তু তার আগে বলো তুমি পড়াশোনা বইখাতা ফেলে ছাদে এই বৃষ্টিতে ছাদে কি করছিলে??
গেলাম রে!!! ঠিক যেটা ভাবছিলাম সেটাই হল | এবার কি করি?? কি বলি?? কোনো রকমে ঢোক গিলে বললাম.........
- ইয়ে...... মানে লেখাটা হয়ে গিয়েছে তাই ভাবলাম ছাদ থেকে জামা কাপড় গুলো তুলে আনি যদি বৃষ্টিতে ভিজে যায় | ব্যাস গেলাম আর বৃষ্টি এসে গেল | তাই একটু........
- ও তাই বুঝি!!!!
- হ্যাঁ সত্যি লেখা হয়ে গিয়েছে | আপনি বাইরের ঘরে আসুন, আমি ততক্ষণ চা করে আনছি | তারপর না হয়........
- হুমমমম |
উফফফ এখনকার মতো তো চায়ের বাহানায় বাঁচলাম কিন্তু একটু পর যখন লেখাটা দেখতে চাইবে কি দেখাবো?? কিছুই তো লিখি নি | আর যেটা করছিলাম সেটা যদি দেখতে পায় তাহলে তো আর রক্ষে থাকবে না |
- আঁখি, কি ভাবছো এমন আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে??!!! আর একটু হলেই তো গরম চা পড়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি বাঁধত | তুমি কি আমায় একটু শান্তি দেবে না?? আমি না এলে এখনই যদি তোমার কিছু হয়ে যেত...... আমি কি করতাম, হ্যাঁ??!!! সামান্য চা করতে এসেই এই অবস্থা, এরপর নাকি তুমি আমার জন্য রান্না করতে | তাই আবার রান্নার লোক রাখতেও না বলছিলে | এমনিই বাড়ি থাকি না, তুমি যে কি করতে তখন, ভাবলেও আমার বুক কেঁপে উঠছে!!!
- না মানে দেখছিলামই তো..... এত ভয় পাচ্ছেন কেন??!! কিছু হত না, আমি সব সামলে নিতাম | আপনি যান আমি আসছি |
- হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি কেমন সামলাতে | তার চেয়ে বরং তুমি গিয়ে বই খাতা নিয়ে বসো, আমিই চা ছেঁকে নিয়ে আসছি |
আমার কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আবার শুরু করলেন.........
- উহ: হু, কোনো কথা বলবে না, আমি তোমাকে আর একটু খানির জন্যও রান্না ঘরে দেখতে চাই না | যাও বলছি |
ওরে বাবা, ওনাকে কি করে বলি কি ভাবছি!!! এবার তো বসেই বলবে লেখাটা দেখি, কি দেখাব আমি?? উফফফ, এদিকে খাতাটাও তো খুঁজে পাচ্ছি না | গেল কোথায়??!! এখানেই তো টেবিলের ওপর রেখে গিয়েছিলাম | হাওয়ায় পড়ে যায়নি তো??!! একবার বরং টেবিলের নিচ টাও দেখে নি যদি.......
- কিছু খুঁজছ??
- হ্যাঁ, আরে খাতা টা যে কোথায় গেল বুঝতে.......
কথাটা বলেই মনে হল আরে স্যার কি এখানেই ভেবে মাথাটা তুলতে গিয়ে গেল চুলের তোয়ালেটা খুলে | একে তো খুঁজে পাচ্ছি না, তার মধ্যে ভিজে চুলটা খুলে যাওয়ার আর সময় পেল না |
- তুমি কি এই খাতা টা খুঁজছ??
স্যারের হাতে আমার খাতা টা দেখে আমার তো ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা | আর রক্ষে নেই | কোনো মতে ঢোক গিলে বললাম........
- ইয়ে মানে..... হ্যাঁ.... আসলে এটা..... মানে ওই খাতা টা.......
একি, উনি আমার দিকে এগোচ্ছেন কেন??!! এবার মারবেন নাকি??!! এদিকে পিছতে পিছতে যে দেওয়ালে এসে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, পাস কাটিয়ে যে পালাবো তারও উপায় নেই | কি করি ভাবতে ভাবতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম | তখন স্যার একদম সামনা সামনি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন........
- এটা খুঁজছিলে??
- হ্যাঁ মানে.......
- লেখা হয়ে গিয়েছে তাহলে??
- ইয়ে, মানে একবার দেখতে হবে সব ঠিক আছে কিনা |
- ও তাই বুঝি!!! তাহলে আমিই দেখি, যদি কিছু ভুল হয় আমিই ঠিক করে দেব | কি বলো??
- না...... না!!! মানে একবার আমাকে দিন, আমি পরিষ্কার করে লিখে দিচ্ছি | ওটাতে হাতের লেখা খুব খারাপ হয়েছে | দিন না প্লিজ!!!
আমার আরও কাছে সরে এসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন.........
- আমায় তুমি খুব ভয় পাও তাই না আঁখি??
ওনার এত কাছে, যেখানে ওনার প্রতিটা নি:শ্বাস আমি নিজের নি:শ্বাসে অনুভব করতে পারছি, যেখানে আমার হৃদয়ের গতিবেগ স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম, সেই পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি এতই সহজ!!! আমি নিষ্পলক ওনার দিকে চেয়ে রইলাম |
***************************************
আমি এসেছিলাম আঁখিকে শাসন করতে, কিন্তু আবার ওর কাছে হেরে গেলাম | একটা সামান্য খাতা না খুঁজে পাওয়ায় যে কেউ এতটা ব্যাকুল হতে পারে, সেটা ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না | ওর ওই ভিজে চুল গুলো যখন মুখের ওপর এসে পড়ে, ওকে ব্যাস্ত করে তোলে | মনে হয় ওর ওই ব্যাস্ততাকে নিজের বুকে আগলে রেখে দিই | যখন হাওয়ায় ভেসে আসা ওর ওই ভিজে চুলের মিষ্টি সুবাস আমায় আবিষ্ট করে রাখে, যখন ব্যাস্ততার মুহূর্তে ওর ভিজে চুলের থেকে ছিটকে আসা জলের ফোঁটা গুলো আমায় মাতাল করে তোলে, যখন আমার কাছে এসে ওর নি:শ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে, তখন আমি অনুভব করি নিজের অস্তিত্ব | খুঁজে পাই বেঁচে থাকার কারন | তখন মনে হয় সময়টা যেন এখানেই থমকে থাকে, আমাদের মাঝে, আমাদের জন্য |