Thread Rating:
  • 26 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance রূপাই নদীর রূপকথা/কামদেব
#50
 ।।১৭।।


                 গলির মুখে এসে দময়ন্তী 'বাই' বলে চলে গেল।আমি তাকিয়ে থাকি,কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে আমাকে দেখে হেসে হাত নাড়ল।আজকের দিনটা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।দিয়া যদি অনুদির মত করেও তবু আমি ভুলবো না। একজন কাউকে আজকের কথা বলতে পারলে স্বস্তি পেতাম কিন্তু কাকে বলবো?অনুদিকে আর বলা যায় না। কি যে হচ্ছে মনের মধ্যে বুঝিয়ে বলতে পারব না অনুভুত হয় মর্মে মর্মে।আকাশ আজ নতুন সাজে সেজেছে। মাকে বললে ভয় পেয়ে যাবে কেননা অস্বাভাবিক সম্পর্কে জড়িয়ে তার ছেলেটা না কষ্ট পায়। মলিনাবৌদির জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। তাহলে কি পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে? আমি দ্রুত পা চালাই বাড়ির দিকে।সুন্দর মনটাকে মলিনাবৌদির স্পর্শ হতে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।দময়ন্তি একান্ত আমার  ভেবে মনটা যেমন ফুর ফুর তেমনি একটা আশঙ্কা ডা.সেন কিছুতেই এসম্পর্ক মেনে নেবেন না।আজ সারাদিন যাযা ঘটেছে সব কি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিনা।এখনো জিভে দিয়ার আস্বাদ টের পাই।আমাকে নিয়ে দিয়া নতুন কোনো খেলায় মাতেনি তো?
ড.দিবানাথ সেনের চেম্বারে রোগীর ভীড় কিছুটা পাতলা।আগে নাম না লেখালে উনি দেখেন না।আসলে এত ভীড় হয় দেখা সম্ভব নয়।দময়ন্তী দরজার কড়া নাড়তে মিসেস সেন দরজা খুলে অবাক হয়ে বলেন, কিরে তুই হঠাৎ?
আহা! কিছু জানোনা যেন,তুমি দূত পাঠাও নি?
মিসেস সেন মুচকি হেসে বলেন, কেমন আছিস?
দময়ন্তী মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা, মোন বিসিএস-এ Rank করেছে --খুব ভালো ছেলে।
মনোরমা শিউরে ওঠেন। কত ডাক্তার পাত্র অপেক্ষা করছে।ওর বন্ধুর ছেলে ডাক্তার মাঝে মাঝেই ফোন করে। মেয়ে সুখী হোক সব মা-ই কামনা করে।তিনি মানলেও ওর বাবা কি মেনে নেবে? দিয়ার মধ্যে পরিবর্তন দেখে ভাল লাগে। জিজ্ঞেস করেন, হিজলতলিতে কখন এসেছিস?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে দময়ন্তী বলে, মা আমাকে একটু চা দেবে?
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সেন প্রবেশ করেন। অবাক হয়ে দেখেন হৃদ্য পরিবেশে মা-মেয়ে খোশ গল্পে মশগুল। এমন বিরল দৃশ্য দেখে ডাক্তার সেন ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করেন, এখন তুমি কোন হাসপাতালে আছো?
--বাঙ্গুর হাসপাতাল। আচ্ছা বাবা--।
চমকে ওঠেন ডাক্তার সেন,বহুদিন পর মেয়ের মুখে 'বাবা' ডাক শুনলেন। মুখ তুলে তাকালেন।
--তুমি কেমন জামাই পছন্দ করো?
--বেকার রাজনীতি করে বাবা চাষবাস করে লোকের বাড়ি কাজ করে মা--ঠগ, প্রতারক-- ।চোয়াল চেপে বললেন ড সেন।
দময়ন্তী রাগ করেনা হেসে বলে,বিসিএস অফিসর হলে কেমন হয়?
মনোরমার গলার কাছে দম আটকে আছে,সেণ্টার টেবিলের কাচটা মুছতে থাকেন। একবার স্ত্রী একবার মেয়েকে দেখে বলেন, কি ব্যাপার কলকাতায় তুমি এইসব করছ নাকি? এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা তোমাকে। ডাক্তারিটা মন দিয়ে শেষ করো। আমি তোমার বাবা,শত্রু নই।ডাক্তার দিবানাথ সেন দ্রুত অন্য ঘরে চলে গেলেন, চোখের পাতা ভিজে গেছিল পাছে ধরা পড়ে যান।কতকাল পর মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনলেন।
দময়ন্তী কথা বাড়ায় না।হয়তো মোন ঠিকই বলেছে, বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাই সামান্য অংশ। মিসেস সেন স্বস্তি বোধ করেন। দময়ন্তীর ইচ্ছে হয় একবার মোনের সঙ্গে কথা বলতে।মিসেস সেন মেয়ের জন্য চা করতে গেলেন।
কখন বাড়ির সামনে এসে পড়েছি খেয়ালই নেই। দরজার কাছে এসে শুনতে পেলাম কার সঙ্গে কথা বলছে মা। এত রাতে আবার কে এল? এক ভদ্রলোক গ্রাম্য চেহারা পৌঢ় বলা যায়। আমি ঢুকতে আমার দিকে তাকালেন। মা বলল,আমার ছেলে মনোজমোহন।
--একেবারে ছোট কর্তার চেহারা।ভদ্রলোক বললেন।
--মা কেমন আছেন? মা জিজ্ঞেস করে।
--গিন্নিমা ভালই আছেন। কানাইয়ের উপদ্রব দিন দিন বাড়ছে। ছোট কর্তা যতদিন আছেন সাহস করবেনা কিন্তু--।
কানাই নামটা শোনা-শোনা,ডায়েরি খুলে দেখতে হবে। মায়ের কাছে শুনলাম, ঠাকুর্দা মৃত্যুশয্যায়,একবার বউমাকে দেখতে চান। বহুঘুরে গ্রামের একটি ছেলের কাছে থেকে আমাদের হদিশ বের করেন জীবন সরকার। কাল সকালেই আমাদের যেতে হবে আড়াইডাঙ্গা গ্রামে। মনটা বিমর্ষ হল।চিরকাল বেহিসেবি জীবন যাপন করে মরণকালে সুবুদ্ধির উদয়। মোবাইল বাজতে পাশের ঘরে গিয়ে ধরলাম।
--এতরাতে কি ব্যাপার?
--তোমায় কি সময় মেপে ফোন করতে হবে?
--দিয়া আমার ঠাকুর্দা মরণাপন্ন,কাল সকালে আমরা যাচ্ছি।
--আমি আসবো?
--ঠিক আছে মোন। পড়াশুনায় যেন গাফিলতি নাহয় আমি বলে দিলাম।
ফোন সুইচ অফ মুখে হাসি ফুটলো।  এইতো দিয়া আবার ফোন করল,তাহলে কি সত্যি দিয়া আমার,একান্তভাবে আমার?
শোবার আগে ডায়েরি খুলে দেখলাম, "...গিরিবালা মিথ্যা বলিয়াছে, ও আগেই গর্ভবতী হইয়াছিল.....মিথ্যা বলিয়া কামারের সন্তানের দায় আমার উপর চাপাইতে চায়...... .কামারের বাচ্চা হইবে সোম বংশের সন্তান?....কিছুতেই তা হইতে দেবোনা....।ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।

সকালে বেলা মাকে নিয়ে আমি জীবনবাবু স্টেশনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।এত ভোরে লোকজন খুবই কম।আড়াইডাঙ্গা নাম শুনেছি কোনোদিন যাওয়া হয়নি। দময়ন্তী হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির।পরনে সালোয়ার কামিজ।মাকে প্রণাম করল,মা চিবুক ছুঁয়ে আশির্বাদ করল।দময়ন্তী আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,আচ্ছা আমাকে একবার বলবে না?তোমার বাড়ী গিয়ে দেখলাম তালা বন্ধ।
--অন্যায় হয়ে গেছে।
-- মোন কোন অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করবে।আর যেন ভুল না হয়।
ট্রেন আসতে আমরা উঠে পড়লাম।দময়ন্তী শেষ পর্যন্ত ছিল।ট্রেন যখন প্লাটফরম ছেড়ে চলে যাচ্ছে দময়ন্তী উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে।মনটা কেমন হূহূ করে ওঠে।এই অনুভুতিটা নতুন আগে কখনো এমন বোধ হয়নি।
বোলপুর স্টেশন থেকে বেরোতে বাসের কনডাক্টর হাঁকছে, আড়াইডাঙ্গা --আড়াইডাঙ্গা।
বাস থেকে যখন নামলাম সুর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। কয়েকটা রিক্সাওলা এগিয়ে এসে সেলাম করল। জীবনবাবু সামনে একটা রিক্সায় পিছনে আর একটায় আমি আর মা। পাকা রাস্তা ছেড়ে রিক্সা কাচা রাস্তায় নামলো।রিক্সাওলার মুখটা কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।অতি সাধারণ মুখ একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল থাকতেই পারে। মাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,মা চিনতে পারছো?
--সেই কবে এসেছি তা কি মনে আছে?
রিক্সাওলাকে জিজ্ঞেস করি,ভাই তুমি কি বরাবর এখানে রিক্সা চালাও?
--জ্বি না।আগে পলাশ ডাঙ্গায় চালাতাম।
পলাশ ডাঙ্গায় বিজয়া মাসীর বাড়ি হয়তো পথে ঘাটে দেখে থাকতে পারি। একসময় মাঠের রিক্ততা ছেড়ে গ্রাম সীমায় পৌছালাম।দু-একজন লোক নজরে পড়ছে রাস্তায়।যেতে যেতে ঘাড় নিচু করে সেলাম করছে।পথের দু-ধারে বিশাল-বিশাল গাছ,তার ছায়ায় পথ চলে গেছে গ্রামান্তরে।ভাঙ্গাচোরা জরাজির্ন ইটের দালান কোঠা মাঝে মাঝে কাচা মাটির উপর খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়িঘর।একটা পানায় ভরা দিঘীর পাড়ে রিক্সা থামে। আচমকা ধূমকেতুর মত একটা লোক এসে রিক্সার গতিরোধ করে বলল, এ্যাই জীবনা এরা কারা?
জীবনবাবু ভয় পেলেন না বিরক্ত হয়ে বললেন,তোর যম।
--যতবড় মুখ না তত বড় কথা। বলেই কলার ধরে জীবনবাবুকে রিক্সা থেকে নামায়।
--এ্যাই কানাই ভাল হবে না বলছি ছোট কর্তা শুনলে--।
--তোর ছোট কত্তা খাটিয়া ছেড়ে আর উঠবে ভেবেছিস?
আমার ঘিলু নড়ে উঠল।লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে অসভ্য লোকটার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিতে লোকটা ছিটকে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় লোকটা হতচকিত।ইতিমধ্যে দশাসই দুই পালোয়ান লাঠি হাতে এসে হাজির।তাদের দেখে কানাই দ্রুত উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেল।
--আসুন মা,এটুকু হেটে যেতে হবে।জাফর তোরা মালপত্র গুলো নিয়ে আয়।
দিঘীর পাড় দিয়ে রাস্তা ধরে এগোতে নজরে পড়ে বিশাল অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ।সামনে মোরাম বিছানো পথ। অট্টালিকাকে কেন্দ্র করে দুপাশে ছোট ছোট একতলা পাকা বাড়ী।সম্ভবত কাজের লোকেরা থাকে।আমাদের দেখে এক চল্লিশোর্ধ মহিলা ঘোমটা টেনে দ্রুত অন্দরে প্রবেশ করে। বোধহয় খবর দিতে গেল মালকিনকে।আমাদের পাশ দিয়ে জাফর-কালু মাল-পত্তর নিয়ে উপরে উঠে গেল।দোতলায় উঠে দীর্ঘ বারান্দার শেষ প্রান্তে একটি ঘরের সামনে পৌঁছে জীবনবাবু বললেন,আসুন মা।
বিশাল ঘর আসবাবে সাজানো পিছনে দেওয়াল ঘেঁষে পুরানো আমলের পালঙ্ক। পালঙ্কের উপর শীর্ণ দেহ কাচা হলুদের মত রং মাথায় একরাশ রুপালি চুল চওড়া পাড় হলুদ জমিনের শাড়ি পরনে এক মহিলা বসে আছেন।
মার বৈধব্য বেশ দেখে মহিলা স্তম্ভিত,দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। মা গিয়ে প্রণাম করল।সেই সঙ্গে আমিও।
মহিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন,একবার খবর দিতে পারলে না?
--কি করবো মা আপনি তো আপনার ছেলেকে জানেন।
--মণির আর কি দোষ? তুমি ওর কাছে এই পোষাকে যেওনা।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে বললেন,বিন্দু তুই এখন যা।
--চা দেবো? বিন্দু জিজ্ঞেস করে।
--হ্যাঁ চা দিয়ে যা জিজ্ঞেস করার কি আছে। আমার দিকে ফিরে বললেন,এসো মনা আমার পাশে বস।আচ্ছা বউ মা, তোমার দুই ছেলে না?
--হ্যাঁ মা  সরোজ বড়।শুনেছি বিদেশ না কলকাতায় থাকে।তারপর এক মেয়ে সব ছোটো মনোজ।মনোজের জন্মের আগেই মেয়েটা চলে গেছে।
বৃদ্ধা দামিনী আমাকে পাশে বসিয়ে সারা শরীরে শীর্ন হাত বোলাতে থাকেন।
--সরকার মশায়।
জীবনবাবু বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন,ডাক পেয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন।
--বিন্দুকে দিয়ে পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রাখুন।জাফর-কালুকে বলবেন,আমার নাতির উপর নজর রাখতে,যেন কোন ক্ষতি না হয়।
--জি।আমি আসি?
--একটু বিশ্রাম করে নিন।
একটা রুপোর ট্রেতে চা নিয়ে ঢুকল বিন্দু।আমার দিকে তাকিয়ে ঠোট বেঁকিয়ে চোরা হাসি দিল।গায়ে মাখলাম না। বিন্দু চা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দামিনী ফিস ফিসিয়ে মাকে বললেন,এ বাড়িতে কাউকে বিশ্বাস করা যায়না। একমাত্র সরকারবাবু ছাড়া। দাদুভাই একা-একা কোথাও যেওনা।
বসে বসে ভাবছি কখন একটু সুযোগ পাবো,ভালোভাবে পৌছেছি দিয়াকে খবরটা দিতে হবে।
[+] 8 users Like kumdev's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: রূপাই নদীর রূপকথা/কামদেব - by kumdev - 20-04-2020, 11:08 AM



Users browsing this thread: 6 Guest(s)