Thread Rating:
  • 26 Vote(s) - 3.31 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance রূপাই নদীর রূপকথা/কামদেব
#46
 ।।১৬।।  

                      ওয়ে আউট সেন্টারের নীচে দাঁড়িয়ে আছি।একটা গাড়ি এসে থামতে বর্নালি নেমে আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, কনগ্রাচুলেশন!তারপর সেন্টারের ভিতর চলে গেল।বর্ণালী গড়িয়াহাট শাখার মেয়ে,বিত্তশালী পরিবার।গাড়ী করে যাতায়াত করে।যেচে আলাপ করেছিল আমার সঙ্গে,মেন অফিসে আসলে দেখা হয়। হুকুমের ধার ধারিনা বলেও কেন দাঁড়িয়ে আছি বুঝতে পারছিনা। রাজদিপ আর অনুদি বেরিয়ে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, কিরে দাঁড়িয়ে আছিস,যাসনি?

--দুটোর আগে ট্রেন নেই।
--প্লাটফর্মে গিয়ে অপেক্ষা কর।তুই কি দময়ন্তীর জন্য দাঁড়িয়ে আছিস?
--না ঠিক তা নয়।মিসেস সেন এত করে বললেন--।
--তোর এটাই দোষ,কোনটা যে ঠিক সেটা বুঝতে বুঝতেই সময় চলে যায়।অনুদি বলল।
ওরা চলে গেলেন।মনে মনে ভেবেছিলাম দশ মিনিট দাড়াবো এর মধ্যে যদি না আসে চলে যাবো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দশের জায়গায় চোদ্দ মিনিট হয়ে গেছে সিদ্ধান্ত বদলে পনেরো মিনিট করলাম। নজরে পড়ল বাস থেকে নেমে মাথা নীচু করে আসছে দময়ন্তী। ঢিলা জামা জিনসের প্যান্ট পরেছে, এলোমেলো চুল।গম্ভীর থমথমে মুখ।আমাকে দেখেও ভাব করছে যেন দেখেনি। সব সময় কেন যে এত বিষণ্ণ থাকে বুঝিনা।অন্য মেয়েদের মত সাজগোজের তেমন বাহার নেই।কাছে এসে বলে, কতক্ষণ?
--দিয়া তোমাকে একটা কথা বলবো?
--ভণিতা নাকরে যা বলতে চাও বলো।
--সব সময় এত গম্ভীর থাকো কি করে,একটু হাসতে পার না?
--অকারণ হাসে পাগলে,আমাকে কি পাগল মনে হয়?
কার সঙ্গে কি কথা বলছি,জানি এরকম কিছু বলবে। আমি চুপ করে গেলাম,কি বলতে কি বলে দেবে।
--তুমি বিসিএস দিয়েছ কই আমাকে তো বলোনি?
-- সব কথা তোমাকে বলতে হবে?তুমি ডাক্তার হয়েছো আমাকে বলেছো?
--তা ঠিক। আমি তো অনুরাধা বসু নই।
--তুমি কি ঝগড়া করবে বলেই এসেছো?
ফিক করে হেসে ফেলে দিয়া।হাসলে গালে টোল পড়ে ,কি সুন্দর হাসি অথচ সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকে। দিয়া বলল, তোমার সাফল্যে আমি খুশি,কি খাবে বলো?
ওর সঙ্গে ওভাবে কথা বলে খারাপ লাগছে।মনে হচ্ছে মুড ভাল এই মওকা, এই সুযোগে কথাটা বলে ফেলি। ভণিতা না করে বলি,তুমি আজ আমার সঙ্গে বাড়ী চলো।
ভ্রু কুচকে আমাকে দেখে দিয়া বলল, দালালি পেশা কবে শুরু করলে? কে তোমায় লাগিয়েছে ডাক্তার সেন না মিসেস সেন?
--মিসেস সেন আমাকে বললেন,বাবা আমি তোমার মায়ের মত--।
--ব্যস অমনি গলে গেলে? কতটুকু জানো তুমি ওদের?
--একদম বাজে কথা বলবে না।গুরুজনদের নিয়ে এভাবে কথা বলা আমি পছন্দ করিনা। তোমার দিদি আত্মহত্যা করার পর তোমাকে নিয়ে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছিলেন--।
আমার আকস্মিক উত্তেজনায় দিয়া বিস্মিতভাবে আমাকে লক্ষ্য করে। আমার মধ্যেও একটা কঠিন লোক লুকিয়ে আছে তাকে আগে কখনো দেখেনি।
--মোন, দিদি আত্মহত্যা করেনি তাকে বাধ্য করা হয়েছে। তুমি সেসব জানোনা,ডাক্তার সেন গায়ে পড়ে তোমাকে অপমান করেন তুমি গায়ে মাখো না কিন্তু আমি উপেক্ষা করতে পারিনা।
--দিয়া প্লিজ আজ অন্তত আমার একটা কথা শোন আর কখনো তোমাকে বলব না।
দিয়া খুটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে,হয়তো বোঝার চেষ্টা করে কেন আমি এত পিড়াপিড়ি করছি। তারপর বল্টাঠিক আছে  চলো,কাল ভোরেই আবার চলে আসবো।
দুপুরের ট্রেনেও ভীড়,ব্যারাকপুরে এসে বসার জায়গা পেলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে দময়ন্তী। উদাস দৃষ্টি, মন যেন কোন গভীরে ঘুরে ফিরছে। আমার প্রস্তাবে বাড়ি যেতে রাজি হবে ভাবিনি।ওকে খুশি করার জন্য বললাম, দিয়া আমি তোমাকে একদিন একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাবো।
আমার দিকে ঘুরে তাকালো,দেখলাম মুখটা হাসি-হাসি,ভরসা করে বললাম,দেখবে একটা নদী--এমনিতে শুকনো খটখটে কিন্তু অমাবস্যায়-পুর্নিমায় সে অতি কষ্টে কোত্থেকে একটুখানি ক্ষীণ জলধারা নিয়ে আসে।
দময়ন্তী চোখ বড় করে তাকায়।
--মা-বাবার ভালবাসাও ঐরকম,সব সময় দেখা যায়না কিন্তু থাকে।
--ওসব বলে আমাকে সান্ত্বনা দেবার দরকার নেই।আমি আমার মত থাকতে চাই। কবে দেখাবে সেই আশ্চর্য নদী?
এরপর আর উৎসাহ পাইনা বলি, সে একদিন হবে।
--একদিন না,আজই দেখবো।চলো--।
পাগলি ক্ষেপেছে, বললাম, মাজদিয়া যেতে হবে।রাত হয়ে যাবে,বাড়িতে চিন্তা করবে।অন্য একদিন বরং--।
--না আজই। কে কি চিন্তা করল আমি পরোয়া করিনা।
কাকে কি বলতে গেলাম? ইচ্ছে করছে নিজের পাছায় আচ্ছা করে লাথি কষাই।ওকে নিরস্ত করব সাধ্য কি? চারটে নাগাদ মাজদিয়া নামলাম।
--অনেকটা হাটতে হবে,পারবে তো?
--পারবো।
রেল লাইন বরাবর কিছুটা গিয়ে ডান দিকে নেমে মেঠোপথ ধরলাম।এবড়ো-খেবড়ো আলপথ ধরে হাটছি।দিয়ার হাইহিল জুতো হাটতে অসুবিধে হচ্ছিল।জিজ্ঞেস করি,যাবে না ফিরে যাবো?
--ইয়ার্কি হচ্ছে?
আমাদের বাঁদিকে হেলে পড়েছে সুর্য।লালচে ম্লান রোদ চুইয়ে পড়ছে তখনো। 'আউফ' বলে দিয়া মাটিতে বসে পড়ে।পা মচকে গেছে।জানতাম এরকম একটা কিছু হবে। আমি ওর পা কোলে তুলে নিয়ে ম্যসাজ করতে থাকি।দিয়া আমার দিকে পরিপুর্ন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে।সুর্যের লালিমা ওর মুখে। হাতে ধরা ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে, এর মধ্যে স্প্রে আছে।
আমি হ্যাণ্ডব্যাগটা নিয়ে জিপার খুলে ভলিনি-স্প্রে বের করে স্প্রে করে দিলাম।
--তোমার পা মচকে যাবে আগেই জানতে?
--ভুলে যেওনা আমি ডাক্তার।এইছোট্ট ব্যাগে ফার্স্টেএইডের সব কিছু আছে।তুমি হাতটা ধুয়ে ফেলবে।
--কেন?
--কেন কি?পায়ে হাত দিলেনা? চলো--।
রুপাই নদী এখানে অনেকটা বিস্তৃত।দিয়া বলল,তুমি একটু দাড়াও,আমি আসছি। নদীর পাড় বেয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল। আমি বললাম,দাড়াও আমি আসছি সাপ-খোপ থাকতে পারে,একা যেওনা।
ঝোপের কাছে গিয়ে প্যান্টের জিপার খুলতে খুলতে হেসে বলল,এ্যাই অসভ্য তোমাকে আসতে হবেনা।
ধবল পাছা এক মুহূর্ত ঝলসে উঠে জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেল।ব্যাপারটা বুঝে আমি উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। চাঁদের ম্লান আলো চুইয়ে পড়ছে,পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে রুপাই। নিশব্দ চরাচর আচমকা মিষ্টি সুরে কানের কাছে ডাক শুনতে পেলাম,কিগো গোঁ-সা-ই!

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম দময়ন্তি। জোছনার মত মুখে এক রাশ হাসি।ভ্যাদলামুলের গন্ধ পেলাম। নদীর ধারে পাশাপাশি বসলাম।
জানো দিয়া এই নদী আমাদের মায়ের মত।আমাদের আবদার অত্যাচার মুখ বুজে নীরবে সহ্য করে চলেছে। কখনো তার কর্তব্য থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হয়না।কান পেতে শোন তুমি তোমার হারিয়ে যাওয়া কিশোর বেলার কত কথা শুনতে পাবে।
--তুমি একটা পাগল,অতীত আর ফিরে আসেনা। তোমার বাবা আমার দিদি জয়ী আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। তুমি জানো ডাক্তার সেনের মেয়ে জয়ন্তী কিভাবে মারা গেছে? জয়িদিটা খুব বোকা--।
জয়ন্তী সেন মেধাবী ছাত্রী,কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতো।এক বিপ্লবী ছাত্রনেতার প্রেমে পড়ল।গেরুয়া পাঞ্জাবি একমুখ দাড়ি নিয়ে তুখোড় বক্তৃতা করতো সিরাজুল। বাকুড়ায় নাকি ধনী পরিবারে তার জন্ম। মা কলেজে অধ্যাপিকা বাবা রাজনীতি করেন। নানা উড়ো-খবর ডাক্তার সেনের কানে আসছিল।একদিন আর থাকতে নাপেরে সরেজমিনে গেলেন দেখতে। ততক্ষণে পাখি উড়ে গেছে। কলেজের ছেলেদের কাছ থেকে খবর নিয়ে ডাক্তার সেন বাকুড়া গেলেন।সেখানে অপেক্ষা করছিল আর এক চমক। সিরাজুলের বাবার সামান্য জমি,চাষ করে অতি কষ্টে দিন গুজরান করে।একবোন টিউশন করে কলেজে পড়ে।বাড়িতে গরু আছে দেখভাল করে মা। সিরাজুলের বাবা বলেছিল, তার ছেলে বছর তিনেক নাকি বাড়ি আসেনা। দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
--পুলিশে ডায়েরি করনি?
--পুলিশে ডায়েরী করা হয়েছিল কিন্তু ডাক্তার সেন পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে তদবির করেননি। জয়িদি আপনিই ফিরেছিল বছর খানেক পর।একা নয় পেটে তার বাচ্চা।সিরাজুল একদিন আসছি বলে বেরিয়ে আর ফেরেনি। জয়িদির পরনে ছেড়া ময়লা শাড়ি,চেহারা শুকিয়ে কাঠ। মা ধরে ঘরে আনছিল।বাবা চিৎকার করে উঠল, খবরদার মনো! এটা হোটেল নয়।এতদিন যেখানে ছিল সেখানে যেতে বলো।
আমি বললাম, বাবা দিদি ভুল করেছে বলে তুমিও ভুল করবে?
ডাক্তার সেন বলেছিলেন,ডোণ্ট শাউট।ইফ ইউ উইশ ইউ ক্যান ফলো হার--আমি জানবো আমি নিঃসন্তান!
সেইরাতেই জয়িদি রেল লাইনে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
গভীর নীরবতা নেমে আসে।ওর দিকে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছিল, সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম, দেখো দিয়া,মানুষ একের পর এক অসম্মান সহ্য করতে করতে চরম সীমায় পৌছে সহ্যের বাঁধন ছিড়ে যায় দিশা হারিয়ে আত্মহত্যা করে।কতবার অসম্মানিত হবার পর আত্মহত্যা করে তার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই।তোমার দিদি আগেও অসম্মানিত হয়েছে বহুবার, অবশেষে ডাক্তার সেনের দ্বারা অপমানিত হয়ে তাকে এই পথ বেছে নিতে হল। আমি বলতে চাই তোমার দিদির আত্মহত্যার জন্য ডাক্তার সেন একমাত্র দায়ী নন। তুমি ডাক্তার সেনের দিক থেকে ভাবার চেষ্টা করো--।
--উঃ মাগো পায়ে ঝি-ঝি লেগে গেছে।মোন আমার হাতটা ধরো।
আমি টেনে তুলে দাড় করিয়ে বললাম,একটু দাঁড়িয়ে থাকো,নরম্যাল হয়ে যাবে।
--কতকাল আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে।দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
--ঠিক হয়েছে? এবার চলো অন্ধকার হয়ে গেছে।হঠাৎ বসে পড়ে বলল,আমি আর যাবনা।
বলে কি! পাগল হয়ে গেল নাকি? ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।চারপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই।ধু-ধু প্রান্তর।এই অঞ্চলে কিছু জানি না চিনি না বললাম,দিয়া লক্ষীটি--।
--তুমি যাও।দু-হাত তুলে চুল বাধে।
--অচেনা জায়গা প্লীজ ছেলে মানুষী করে না।
যেন দয়া করছে এমনভাবে বলল, যেতে পারি।তোমার সব কথা শুনবো যদি একটা জিনিস দাও।বলো দেবে? বলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল--মুখটা উঁচু করে কাঙ্গালের মত বলল,গোসাই দেবেনা?
আমি অতি দীন কি আছে আমার দেবার মত,মুখটা নামিয়ে ওর ঠোটের উপর ঠোট রাখলাম।কতকালের তৃষ্ণার্ত দিয়া দুহাতে ধরে আমার চেতনা-চৈতন্য-অস্তিত্বকে আকণ্ঠ শুষে নিতে লাগল।কতক্ষণ জানি না সারা শরীর মনে অভুতপুর্ব এক অনুভুতি রক্তে চারিয়ে যেতে থাকে।তারপর ছেড়ে দিয়ে হাটতে শুরু করে।মনে মনে বললাম,দিয়া আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো?
হাটতে হাটতে চলেছি আলের উপর দিয়ে,দিয়া পিছন থেকে বলল,তোমার ভীষণ জিদ।
--কেন?
--সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে অপেক্ষা করছি কবে তুমি বলবে?শেষ পর্যন্ত আমাকেই বলতে হল।
অনুদি বলে আমার নাকি বুঝতে বুঝতে সময় চলে যায়। জানো দিয়া, আমি খুব একা।
দময়ন্তী আল থেকে নেমে আমার বাহুমূলে বুক চেপে বলে, খবরদার বলছি আর কখনো তুমি একথা বলবে না।
রক্তে যেন জোয়ারের প্লাবন,ভয় হল জোয়ারের জল আমাকে আছড়ে ফেলবে নাতো?বোকাটাকে নিয়ে কোনো নতুন খেলা নয়তো?
[+] 9 users Like kumdev's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: রূপাই নদীর রূপকথা/কামদেব - by kumdev - 19-04-2020, 08:35 PM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)